বিবর্ণ ভালোবাসা পর্ব-০১

0
1844

#বিবর্ণ ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

১.

বাসররাতে নিজের স্বামীর মুখশ্রী দেখে ভয়ে অচেতন হয়ে যায় নববধু।

বিয়ের প্রথমরাতে নববধূর চিৎকার শুনে বাড়ির ছোট-বড়ো কেউই লজ্জায় আর এই ঘরের দিকে আসে না।

পুরনো জমিদার বাড়ি। দেয়ালগুলোতে রাজকীয় কারুকাজে সজ্জিত। বাগানে আছে দেশ-বিদেশি নানান ফুলের গাছ। বাতাসের দোল খেয়ে বাগানে ফুটে থাকা ফুলগুলো থেকে যখন মিষ্টি সুবাস নির্গত হয়। তখন আশেপাশের অট্টালিকায় থাকা ভৃত্য আর প্রহরীরা প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়। কারণ, এই জমিদার বাড়িতে শুধু এই ফুল থেকে নির্গত সুবাস খানি পবিত্র। বাকিটা শুধুই মানুষের আত্মচিৎকার আর রক্তের পঁচা গন্ধ।

রাত তখন ঢের ভালো। আকাশের চাঁদ পশ্চিমের দিকে হেলে পড়েছে। খানিকটা লাল আভা ছড়াচ্ছে। তারা অগণিত। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি কতই না সুন্দর! তার সৃষ্টির সাথে কোনো কিছুরই তুলনা করা বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়।

জানালার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বিগত জীবনের এক একটি মূহুর্ত স্মরণ করছে চৌত্রিশ বছর বয়সী রুদ্র। শুভ্র সাদা গায়ের রঙ। চোখদুটো আদিবাসীদের মতো। নাকটা খাড়া। গালভর্তি দাড়ি-গোঁফ। জমিদার বংশের রক্ত রুদ্রের প্রতিটা শিরা-উপশিরায় বহমান। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে তারই বিয়ে করা বৌ তাকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে অচেতন হয়ে যায়। এখনো জ্ঞান ফিরে আসেনি। রুদ্রের এই বিষয়ে কোনো মাথা নেই। কিন্তু, লাল শাড়িতে আবেষ্টনী এক পরমা সুন্দরীকে এক পলক দেখে হৃদয়ে চাপা পরে যাওয়া পুরনো সেই ভালোবাসা ফের জাগ্রত হয়েছে রুদ্রের মানসপটে।

নিজের ভাবনা ধীক্কার জানিয়ে জানালার পাশ থেকে সরে আসে। টেবিলের ওপরে থাকা এক বোতল থেকে গ্লাসে কিছুটা সুরা ঢেলে একঢোকে পান করে নেয় রুদ্র। পুরনো সেই ভালোবাসা, অতীত হয়ে যাওয়া মূহুর্তগুলোকে আর ভাবতে চায় না সে। তাই আজ যতক্ষণ না অব্দি সেই এই দুনিয়ার স্মৃতি থেকে মুক্তি না পাচ্ছে ততক্ষণ অব্দি সুরা পান করেই যাবে। একের পর এক গ্লাস গলায় ঢালছে বিরতিহীন।

খাটের ওপর অচেতন হয়ে পরে থাকা যুবতী এই সবকিছুরই টের পাচ্ছে না। রুদ্র আরও এক গ্লাস সুরা গলায় ঢেলে ক্লান্তি ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে অর্ধনগ্ন নারীদেহের দিকে। পেটের ওপরের শাড়িটা সরে গিয়ে দেবির ন্যায় দেহ উন্মুক্ত হয়ে আছে রুদ্রের চোখের সামনে। রুদ্রের এতক্ষণ অব্দি নেশা লাগেনি। কিন্তু, এই নারীকে দেখে রুদ্রের ভীষণ নেশা লেগেছে ; যাকে বলে কঠিন নেশা।

ক্লান্ত দেহকে নিয়ন্ত্রণ করে হেলেদুলে এগিয়ে যায় ফুল দিয়ে সাজানো খাটের দিকে। খাটের কিনারায় দাঁড়িয়ে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে নিজের স্ত্রী’র দিকে। অনেকবার তাকে চোখের সামনে থেকে দেখেছে। কিন্তু, এভাবে আজ প্রথমবারের মতো দেখছে। লোভ সামলানো দায় পরেছে। তাই তো নিঃশব্দে নিজের স্ত্রীর পাশে শুয়ে পরে। নিশ্বাসটাও খুব ধীরে ধীরে ত্যাগ করছে। যাতে পাশে শুয়ে থাকা তনুজা রুদ্রের উপস্থিতি টের না পায়।

তনুজার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ক্লান্ত আর নেশার ঘোরে অতল হয়ে ঘুমের ঘরে হারিয়ে যায় রুদ্র।

———————-

ফজরের নামাজ আদায় করে এই বাড়ির বায়োজৈষ্ঠ্য সদস্য সালেহা তাজবীহ পাঠ করতে করতে বারবার রুদ্রের কামরার দিকে তাকাচ্ছেন। তিনি মনে মনে ভীষন ভয় পাচ্ছেন। গতকাল রাতে তনুজার আত্মচিৎকারে এই জমিদার বাড়ির প্রতিটা ইট থরথর করে কেঁপে উঠেছে যেন। মেয়েটা আদৌও সুস্থ আছে নাকি সেই ভাবনায় চিন্তায় কাতর হয়ে আছেন সালেহা।

সালেহার বারবার রুদ্রের কামরার দিকে তাকানো দেখে রুদ্রের বড়ো আম্মাজান রুক্মিণী নিজের শ্বাশুড়িকে ধীর গলায় বললেন,

— আম্মা, আপনি অযথাই ভয় পাচ্ছেন এবং দুশ্চিন্তা করছেন। এমনও তো হতে পারে রুদ্র তনুজাকে ভয় দেখিয়েছে। আর তনুজাকে দেখলে রুদ্র কেমন বাচ্চামো করে সেটা আমরা সকলেই অবগত।

— বড়ো বৌ, আমি জানি রুদ্র তনুজাকে দেখলে কতটুকু বাচ্চামো করে। কিন্তু, একটা জিনিস ভুলে যেও না রুদ্র কিন্তু সেই আগের রুদ্র নয়। রুদ্রের আচরণগত অনেকটাই পরিবর্তন চলে এসেছে। তুমি মা হয়েও কি এই পরিবর্তন ধরতে পারছো না?

— আম্মা, ধরতে পেরেছি। কিন্তু, তাই বলে তনুজার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করবে সেটা আমি কল্পনায় ভাবতে চাই না। কারণ, রুদ্র আর যাই কিছু করুক তনুজার সামনে সে কিছুই করতে পারবে না।

ছেলের বৌয়ের কথা শুনে শান্তি পাচ্ছেন না সালেহা। মনে হচ্ছে সামনে ভয়াবহ বিপদ আসতে চলেছে।

———————

তীব্র রোদের তাপের স্পর্শ পেয়ে তনুজার ঘুম ছুটে যায়। তড়াক করে লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসতে চায়। কিন্তু, কিছু একটার সাথে বাঁধা পেয়ে ফের শুয়ে পরতে হয় তনুজাকে। পরে যাওয়ার আশংকায় চোখ বন্ধ করে ফেলে।

নিজের কপালে কারো গরম নিশ্বাসের স্পর্শ পেয়ে তনুজা ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কারণ, চোখের সামনে যে আছে সে আর কেউই নয় রুদ্র। ওর স্বামী। যার সাথে গতকাল তনুজার একশ টাকার কাবিনে বিয়ে হয়েছে।

রুদ্র গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে আছে তনুজার মুখের দিকে। লেপ্টে যাওয়া চোখের কাজল দেখলে যে কেউ এখন তনুজাকে ভুত বলতে দুইমিনিট সময় নিবে না। হাত বাড়িয়ে আলতোভাবে তনুজার চোখের লেপ্টে যাওয়া কাজল মুছে দেয়। তনুজা চোখ বন্ধ করে শক্ত হয়ে পরে থাকে। যেন রুদ্রের সামনে নড়াচড়া করলে দুই নলের বন্দুকে দিয়ে তনুজাকে গুলি করে মেরে ফেলবে।

— গোসল সেড়ে তারপরই এই ঘর থেকে বের হবে। গোসল ছাড়া বের হতে যেন না দেখি।

কথাটি বলেই তনুজাকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে খাট থেকে নেমে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

এইদিকে রুদ্রের কাছ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ পেয়ে তনুজার চোখে জল ভরে আসে। গোসল করার মতো কিছু হয়েছে নাকি। এত শীতের সকালে কোন পাগলে গোসল করবে? তনুজা মুখ ভেঙিয়ে খাট থেকে নীচে নেমে পরনের এলোমেলো হয়ে থাকা শাড়িটাকে সুন্দর করে গুছিয়ে আবারও পরিধান করে। তারপর, হাঁটতে হাঁটতে বের হয়ে যায় রুদ্রের ঘর থেকে। তারপর,সোজা রুদ্রের দাদিজান সালেহার ঘরের দিকে।

সালেহার ঘরের দরজা তখন খোলা ছিল বিধায় রুদ্রের ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া এবং তনুজার এই ঘরের দিকে হেঁটে আসা সবটাই দেখছে সালেহা। তনুজা এলে হাতের তাজবীহটা রেখে তনুজাকে গলায় জড়িয়ে ধরলেন। তনুজা খুশি হয়ে সালেহাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ ধরে। সালেহা তনুজাকে বুকের কাছ থেকে সরিয়ে এনে তনুজার সারা শরীরে চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

— কি রে গতকাল রাতে ওমন করে চিৎকার দিয়েছিস কেন? রুদ্র উল্টাপাল্টা কিছু করেনি তো?

তনুজা কি উত্তর দিবে ভাবতে থাকে? যখনি উত্তর গুছিয়ে সালেহাকে বলবে তার আগেই কে যেন এক বালতি ঠান্ডা পানি এনে তনুজার গায়ে ঢেলে দেয়। আকস্মিক ঘটনায় সালেহা এবং তনুজা দুজনেই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে