বর্ষার প্রণয়ের কথা পর্ব-০১

0
930

#বর্ষার_প্রণয়ের_কথা
#পর্ব_০১
#নুর_নবী_হাসান_অধির

হসপিটালের করিডর জুড়ে চাপা কান্নার রেশ বয়ে যাচ্ছে৷ মৃত্যুর সাথে লড়াই করে কোনরকম বেঁচে আছে মেঘ৷ জীবনের প্রতি মায়া মোহ সব তুচ্ছ হয়ে গেছে৷ দৃশ্যটা বারবার চোখের সামনে সাড়া ফেলছে৷ কখনও ভাবতে পারেনি মাহমুদ বিশ্বাসঘাতকতা করবে!

ভার্সিটিতে পরীক্ষা থাকায় মামাতো বোন ইভার বিয়েতে আসতে পারেনি মেঘ৷ অনেক স্বপ্ন ছিল ইভার বিয়েতে নাচবে, গান গাইবে৷ বাহারী রঙের ফুলে নিজেকে সজ্জিত করবে৷ পরীক্ষা থাকায় স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল৷ পরীক্ষা শেষ করে ঘুরতে মামার বাড়িতে আসে৷ আজ মেঘের খুব ভালো লাগছে। ইভা এবং ইভার স্বামীকে দেখতে পারবে৷ অপেক্ষার প্রহর যেন কাটছে না৷ অধীর আগ্রহে ইভার পথ চেয়ে বসে আছে৷ ইভাদের বাসা বনানীতে৷ রোড নং ০২ ব্লক এল৷ দুতালা থেকে দেখতে পেল একটা কালো রঙের গাড়ি ভিতরে প্রবেশ করছে৷ মেঘ কোন কিছুর অপেক্ষা না করে দৌড়ে দেয় ইভাকে দেখতে৷ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ ইভার বিয়ে মেঘের বয়ফ্রেন্ডের সাথে হয়েছে৷ পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল৷ অজান্তেই চোখ থেকে দুই ফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ল৷ ইভার মেঘকে দেখে জড়িয়ে ধরে অভিমানী কন্ঠে বলল,

–‘তুই আমার বিয়েতে আসলি না কেন? তোর সাথে কোন কথা নেই৷’

মেঘ বুকের মাঝে কষ্ট চাপা রেখে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল৷ ইভার কাঁধে মেঘের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে৷ ইভা ইতস্তত হয়ে বলল,

–‘মেঘ তুই কান্না করছিস কেন? কি হয়েছে? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’

মেঘ এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে সামলিয়ে নিল৷ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
–‘আমাকে ক্ষমা করে দাও আপু৷ আমি তোমার বিয়তে আসতে পারিনি৷ রাজশাহী থেকে ঢাকা আসা যাওয়া প্রায় দুই দিন চলে যায়৷ আমি ঢাকা থাকলে অবশ্যই তোমার বিয়েতে আসতাম৷’

ইভা মুচকি হেঁসে জবাব দিল,
–‘ দূর পাগলী! এসব নিয়ে কান্না করে৷ তোর ভাইয়ার সাথে পরিচয় হবি না৷’

ভাইয়া শব্দটা বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল৷ বিষাক্ত তীরের মতো বুকে বিঁধে গেল৷ নিজেকে সংযত রেখে বলল,
–‘ভাইয়া কোথায়? ভাইয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দে৷’

ইভা মাহবুদের হাত ধরে বলল,
–‘মেঘ তোর ভাইয়া৷ আমি রাগ করেই তোর ভাইয়ার পিক দেয়নি৷ তুই আমার বিয়তে আসিসনি বলেই অনেক মন খারাপ ছিল৷ পরে ভাবলাম তোকে সারপ্রাইজ দিব৷’

মেঘ মলিন মিহি হাসি দিয়ে বলল,
–‘ভাইয়া দেখতে মাশাল্লাহ খুব সুন্দর। তোমাদের দু’জনকে খুব সুন্দর মানিয়েছে৷ তোমরা একে অপরের জন্য সৃষ্টি হয়েছো৷’

মেঘ দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পেল না৷ দৌড়ে চলে গেল৷ মেঘের এমন ব্যবহার ইভাকে ভাবিয়ে তুলল৷ মাহমুদের দিকে পলক ফেলে দেখল মাহমুদ মাথা নিচে করে দাঁড়িয়ে আছে৷ মুখে হাজার ভয়ের আশংকা ডানা মেলছে৷ ইভা সন্দিহান কন্ঠে বলল,

–‘এভাবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? বাসায় যেতে হবে নাকি৷’

মাহবুব নিজেকে সামলিয়ে নিল৷ ভাবতে পারেনি ইভা মেঘের কাজিন৷ সবকিছু কুয়াশার মতো লাগছে৷ মেঘ তাদের জীবনে কিছু করবে না তো! মেঘ অনেক জেদি মেয়ে৷ মাহবুব মলিন হাসি দিয়ে বলল,

–‘তোমার কাজিন আমাকে দেখে এভাবে পালিয়ে গেল কেন?’

–‘মেঘ একটু লাজুক টাইপের মেয়ে৷ তোমায় দেখে লজ্জা পেয়েছে৷ সেজন্য দৌড়ে চলে গেছে৷’

মাহবুব আর কথা বাড়াল না৷ একে একে সবার কথা কৌশল বিনিময় হলো৷ কিন্তু মাহবুবের অবুঝ চোখ জোড়া মেঘকে খুঁজে চলছে৷ দুপুরে খাওয়ার পর মাহবুব ছাঁদে আসে৷ সিগারেট জ্বালিয়ে নিকোটিনের ধোঁয়া আকাশে উড়িয়ে দিতেই পিছন থেকে মেঘ বলে উঠল,

–‘বিশ্বাসঘাতকতার রক্ত বইছে তোমাদের গায়ে৷ কি করে পারবে সেই রক্ত দূর করতে? ভালোবাসার মানুষকে ভুলে বিয়ের পিরিতে বসতে লজ্জা লাগল না৷’

মাহবুব সিগারেট পায়ে পিষে নিবিয়ে নিল৷ মেঘ সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারে না৷ মাহবুব অপরাধী কন্ঠে বলল,

–‘আমার বয়স থেমে নেই৷ আজ নয়তো কাল আমাকে বিয়ে করতে হতো৷ তোমাকে বিয়ের কথা জানালে তুমি বললে অনার্স শেষে বিয়ে করবে৷ ততদিন আমি অপেক্ষা করতে পারব না৷ তাই আমি বিয়ে করে ফেলেছি৷’

–‘বিয়ে করার পরই কেন আমার সাথে সম্পর্ক রেখেছেন৷ ভেঙে দিতে পারতেন নানা অজুহাতে। আমি শুধু আপনার প্রয়োজন মিটানোর সামগ্রী ছিলাম৷’

–‘বিয়ে করেছি বেশ করেছি৷ তোমার বাবার কি আছে? তোমার বাবা ইভাদের অফিসে সামান্য বেতনে জব করে৷ তোমাকে বিয়ে করলে আমি কি পেতাম? তোমার মতো ছোটলোকে বিয়ে নয় ব্যবহার করা যায়৷’

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ মাহবুবের প্রতি ভীষণ রাগ হচ্ছে৷ মেঘ নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না৷ ক্ষোভ নিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে মাহবুবের গালে কষিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। মাহবুব মেঘের হাত চেপে ধরে বলল,

–‘যে মেয়ে নিজের সম্মান সুপেয় দেয় তাকে আমি বিয়ে করব! তোর মতো মেয়ের সাথে সম্পর্ক থাকার একমাত্র কারণ হলো নিজের চাহিদা মেটানো৷ তোর কাছে দিবার মতো কিছু নেই৷ এখন তুই দেখে যা তোর বেঁচে থাকা অসম্ভব করে তুলব৷ সাথে তোর মামাতো বোন ইভার জীবনেও আসবে.. ।’

পিশাচেরা মতো হাসি দিয়ে মাহবুব চলে গেল৷ মেঘের দেওয়া থাপ্পড় মাহবুবের গালে৷ সমাজ মেঘের কথা বিশ্বাস করবে না৷ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের দোষটাই দেখে। ছেলেরা হাজারও দোষ করলে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও দেখে না৷ মেঘ কাউকে না জানিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিল৷ আত্মহত্যা মহাপাপ। দরকার পড়লে ঢাকায় আর আসবে না৷ আজই রাজশাহীতে চলে যাবে৷ আনমনে হেঁটে যাচ্ছে। মাহবুবের প্রতিটি কথা কানে প্রতিধ্বনি হচ্ছে৷ হাঁটতে হাঁটতে কখন রাস্তার মাঝে চলে আসছে জানা নেই৷ ভাগ্য অনুকূলে না থাকায় গাড়ির সাথে ধাক্কা খায়৷ দ্রুত গতিতে গাড়ি চলে গেলে অন্যরা মেঘকে ধরাধরি করে হসপিটালে নিয়ে আসে৷

মেঘের মাথার পাশে বসে আছে মেঘের মা৷ অক্সিজেন মাক্স পড়ে আছে মেঘ৷ জ্ঞান ফিরলেও এখনও অবচেতন অবস্থায় আছে৷ চোখ থেকে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে৷ সবার ভাবনা মেঘ কেন হুট করেই বাড়ি থেকে বের হয়েছে৷ সবার কল্পনা জল্পনার মাঝে হাজির হয় ইভা মাহবুব। মাহবুবের গালে স্পট আঙুলের ছাপ পড়ে আছে৷ ইভা নিজের ফুপুকে রাগ নিয়ে বলল,

–‘তোমার মেয়ে আদৌও মা-রা যাবে না৷ কৈ মাছের প্রাণ মেঘের৷ মেঘের অপকর্মের কথা জানলে গলা টিপে মে রে ফেলতে৷ আমি এখানে কথা শুনাতে আসিনি৷ কোনদিন যদি তোমাদের পদচরণ আমাদের বাড়িতে পড়ে সেদিন বাকী ইতিহাস জানতে পারবে৷’

ইভা মাহবুবের হাত ধরে চলে যায়৷ ইভার কথায় বুঝা যাচ্ছে ইভা মেঘের মৃত্যু কামনা করছে৷ আদৌও কি ইভা সত্যিটা জানতে পেরেছে? নাকি মাহবুবের মিথ্যা মায়াজালে নিজেকে সুপেয় দিয়েছে৷ তাছাড়া স্বামীর কথা সাধারণত প্রতিটি স্ত্রী বিশ্বাস করে৷

______________
মেঘের শারীরিক অবস্থা আগে থেকে অনেকটা ভালো৷ মাথায় ব্যান্ডেজ৷ পায়ের দিকে গুরুতর আঘাত না লাগলেও হাত ভেঙে গেছে৷ সারাদিন চোখের নোনা জল ফেলে যাচ্ছে৷ কাউকে কিছু বলছে না৷ কিভাবে মাহবুব পারল তার সাথে প্রতারণা করতে? কিছু বাজে ছেলের জন্য মেয়েরা আজ এতটা অসহায়। ভালোবাসার প্রমাণ দিতে নিজেকে সুপেয় দিতে হয়৷ পরিবারের কথা একবারও ভাবেনা৷ অথচও বিপদের সময় পরিবার সবার আগে এগিয়ে আসে৷ আমাদের উচিত সব সময় পরিবারের কথা চিন্তা করা৷ পরিবারের লোকজন যদি এখন পুরো ঘটনা জানতে পারে তাহলে তাদের মান সম্মান ঠুনকো হয়ে যাবে৷

মেঘ গভীর তন্দ্রায় মগ্ন। মাহির গলায় Sthatoscop (স্টেথোস্কোপ) নিয়ে মেঘের কেবিনে প্রবেশ করে৷ মাহির ছেলেটা প্রথম দিন থেকেই মেঘের যত্ন একটু বেশি নিচ্ছে৷ কারণে অকারণে চলে আসে মেঘের কেবিনে৷ মাহির ডক্টর হওয়ার সুবিধার্থে তাকে কিছু বলতেও পারেনা৷ রোগীর স্বজনরা চান ডক্টররা যেন তাদের একটু বেশি সুযোগ সুবিধা দেন৷ মাহির মেঘের মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–‘আন্টি মেঘ ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছে তো! মেঘ কিন্তু কোন একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত। যথাসম্ভব মেঘকে চিন্তা মুক্ত রাখবেন৷’

মেঘের মা বিনয়ের সাথে বললেন,
–‘বাবা তুমি খুব ভালো৷ আমাদের কত খেয়াল রাখ৷ আজকাল এমন ডক্টর পাওয়া দুষ্কর।’

মাহির মুচকি হেঁসে লজ্জমাখা মুখে বলল,
–‘আন্টি এগুলো আমাদের কর্তব্য। আমরা চাই কোন রোগী যেন অবহেলায় বা সেবা থেকে দূরে না থাকে৷ এমনি তাদের মন খুব খারাপ থাকে। আমরা যদি আমাদের কর্তব্যে অটুট না থাকি তাহলে আপনাদের মন আরও খারাপ হয়ে যাবে৷’

–‘ঠিক বলছো বাবা৷ এমন কয়জনে ভাবে৷ দেখি তো সব ডাক্তার রুমে বসে গল্প করে৷’

–‘সবাই তো এক নয়৷ আমার কাছে আমার কর্তব্য সবার আগে৷ মেঘ ঘুমাচ্ছে। বিরক্ত না করি৷ ঘুম ভেঙে যেতে পারে৷’

মাহির মেঘের দিকে এক পলক মুগ্ধতার সাথে তাকিয়ে প্রস্থান করল৷ অবাধ্য চোখ জোড়া মেঘকে বন্ধি করতে চাই৷ নিষ্পাপ ঘুমন্ত মাথায় পরশ আবেশে হাত ভুলিয়ে দিতে ইচ্ছা করে৷

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে