বর্ষণের সেই রাতে- ২ পর্ব-৫৪+৫৫

0
1636

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৫৪.

কথায় আছে, বিপদ যখন আসে চারপাশ দিয়েই আসে। অনিমা আর আর্জুর ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি হতে শুরু হল। আশেপাশে কোন ছাউনি না থাকায় ভিজে গেল ওরা দুজন। কিন্তু এই বৃষ্টি থামার বদলে আরও বেড়ে গেল। চৈত্র মাস ছিল। তাই সেই বৃষ্টি ঝড়ে পরিণত হতে বেশি সময় লাগল না। প্রচন্ড জোড়ে বাতাস বইছে। কিছুক্ষণ পরপরই ভীষণ জোরে বজ্রপাত হচ্ছে। অনিমা এমনিতেই বজ্রপাতে ভীষণ ভয় পায়। এই প্রথম বজ্রপাতের সময় ও বাইরে আছে। প্রচন্ড ভয় পেয়ে অার্জুকে জড়িয়ে ধরে গুটিশুটি মেরে বসে আছে ও। আর্জু্ও ওকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। ঠান্ডায় দুজনেই কাঁপছে প্রচন্ড। আর্জু কাঁপতে কাঁপতে বলল,

” তুমি কেন বেড়িয়ে এলে? বললাম চলে যেতে গেলেনা। ওরা যদি কেউ চলে আসে তোমারও ক্ষতি করে দেবে।”

অনিমা কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল,

” আমি তোমাকে একা ছেড়ে দিতে পারব না। মাদার তোমাকে আমার কাছে রেখে গেছে।”

” তুমি এখনো বাচ্চা মেয়ে অনি। তুমি জানোনা ওরা কত ভয়ংকর। যা খুশি করে দিতে পারে। প্লিজ চলে যাও।”

” আমি যাবোনা।”

অনিমার জেদের সাথে পেরে উঠলনা আর্জু। আর্জু যতবার ওকে যেতে বলেছে অনিমা তত শক্ত করে আর্জুকে আকড়ে ধরে বসে ছিল। কিন্তু যেটার ভয় ছিল সেটাই হল। একটু পরেই দুটো গাড়ি এসে থামল ওখানে। হেডলাইটের আলোতে চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল ওরা দুজন। আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখল গাড়ি থেকে কয়েকজন লোক বেড়িয়ে। আর্জু আর অনিমা প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল এরকম অবস্থা দেখে। আর্জু কম্পিত কন্ঠে বলল,

” অ-অনি পালাও।”

বলে উঠে দাঁড়িয়ে অনিমার হাত ধরে দৌড়াতে শুরু করল। ঝড়ের জন্যে দৌড়াতেও সমস্যা হচ্ছে ওদের। ওই লোকগুলোও গাড়ি নিয়ে পিছু করল ওদের। তাই বেশিক্ষণ পালাতে পারল না। দু দিক থেকে গাড়ি এসে আটকে দিল ওদের। আর্জু বুঝে গেছে যে এখন আর বাঁচা সম্ভব নয়। তাই বলল,

” অনিমা তুমি পালিয়ে যাও। ওরা আমাকে পেলে তোমার পিছু নেবেনা।”

কিন্তু অনিমা শুনলোনা। আর্জুকে ছেড়ে ও যাবেনা কোথাও। লোকগুলো এসে ওদের দুজনকেই টেনে নিয়ে গাড়িতে তুলল। আর্জু অনেকবার ওদের অনুরোধ করেছিল অনিমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্যে কিন্তু ওরা অনিমাকে সাথে নিয়ে গেল। দুজনেরই হাত-পা মুখ বেঁধে দিল। বেশ অনেকক্ষণ পর একটা একতলা বড়সর একরুমের শাটার দেওয়া একটা ঘরে ওদের নিয়ে এলো। একটা গাড়ি চলে গেল ওখান থেকে। পাঁচজন রইল ওখানে। একজন অনিমা আর আর্জু দু-জনেরই ছবি তুলে কোথাও একটা পাঠিয়ে ফোন করে বলল,

” স্যার কোন মেয়েটা? নীল গ্রাউন পরাটা নাকি কালো টিশার্ট পরাটা?”

আসলে অনিমা নীল রঙের গ্রাউন আর আর্জু কালো টিশার্ট পরে ছিল। ওপাশ থেকে কিছু একটা বলল। এরপর ওরা ওখানে অনিমাকে একটা খুঁটির সাথে বেঁধে রাখল। কিন্তু আর্জুকে বাঁধল না। বোঝাই যাচ্ছে ওরা এই ব্যাগটাই চায়। আর্জুকে ওরা প্রথমে মুখে জিজ্ঞেস করে সেই ব্যাগটার কথা। কিন্তু আর্জু বলেনি। এরপর শারীরিকভাবেও অত্যাচার করেছে। অনিমার চোখের সামনে এরকম নৃশংসতা সহ্য করতে পারছিল না। কিন্তু কিছু বলতেও পারছিল না কারণ ওর হাত-পা, মুখ বাঁধা ছিল। কিন্তু ও যতবার ছটফট করেছে ওকে থাপ্পড় মেরে চুপ করিয়ে দিয়েছে। তাই ও মুখ ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে কাঁদছিল শুধু। যখন আর্জু কিছুতেই মুখ খুলছিল না তখন অনিমার গলায় ছুড়ি ধরে ওকে মেরে ফেলার ভয় দেখালো। অনিমার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে একপ্রকার বাধ্য হয়েই আর্জুকে বলে দিতে হল যে ঐ ডকুমেন্টগুলো ওদের কাছে না ঐ মাদারের কাছে আছে। কিন্তু এরপরই ঘটল সেই ভয়ংকর ঘটনা। ওই লোকগুলোর একজন আবার কাউকে ফোন করে বলল,

” রঞ্জিত স্যার! মেয়েটার কাছে নেই ঐ আশ্রমের মাদারের কাছে আছে।”

তখন ওপাশ থেকে কী নির্দেশ এলো জানা নেই। কিন্তু ওরা অনিমার চোখের সামনেই আর্জুকে নৃশংসভাবে মেরে ফেলল। রক্তের কয়েকফোটা ছিটকে অনিমার মুখে এসে পরল। কিন্তু অনিমা কোন প্রতিক্রিয়া করতে পারল না। চোখের এরকম হত্যাকাণ্ড দেখে ও স্তব্ধ হয়ে গেছে। চোখ একদম পাথরের মত স্হির হয়ে গেছে। সেই দৃষ্টি নিয়েই ও তাকিয়ে আছে আর্জুর লাশটার দিকে। এরপর ওদের একজন এসে অনিমার গলায় ছুড়ি ধরল। কিন্তু অনিমার তবুও কোন প্রতিক্রিয়া নেই। লোকটা ছুড়ি টান দিতে যাবে তখনই আরেকজন বলল,

” থাম। স্যার ওকে মারতে বারণ করেছেন। মাদারের থেকে ফাইল নিতে ওকে কাজে লাগবে।”

এরপর ওরা আর্জুর লাশটা একটা বস্তায় ভরে কোথাও একটা নিয়ে গেল। আর অনিমার নিয়ে আবার গাড়িতে তুলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনিমা জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। আর যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখতে ও ঐ গাড়িতে শুয়ে আছে, কিন্তু কোন লোক নেই। ওর হাত-পা ও খোলা। এভাবে ওকে হাত-পা খুলে দিয়ে কোথায় চলে গেল সেটাই ভাবছিল অনিমা। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে পরতেই ও কেঁদে ফেলল। ওর চোখের সামনেই ওরা আর্জুকে মেরে ফেলল। কিন্তু ও কিছু করতে পারেনি। কিন্তু ওর মনে হল এখন পালাতে হবে। সেইমুহূর্তেই ঐ গাড়ি থেকে বেড়িয়ে পালিয়েছিল ওখান থেকে।

__________

অনিমা আর বলতে পারল না। হাসান কোতয়ালের বুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ও। আদ্রিয়ান লালচে চোখে তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে। কিছুই বলছে না। হাসান কোতয়াল অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

” তুমি শিওর ফোনের ওপাশে রঞ্জিত চৌধুরী ছিলো?”

” ফোনেতো রঞ্জিত স্যারই বলে ডাকল।”

” আবার বাড়িতে ফিরে আসোনি কেন?”

অনিমা মুহূর্তেই কন্ঠ শক্ত করে বলল,

” আমি আসতে চাইনি। ঘৃণা করি আমি ওদেরকে। আর্জু আপুর মৃত্যুর জন্যে ওনারাও দায়ী।”

বলেই চমকে উঠল। ও তো ওর বাবাকে বলতে চায়নি ওর মামা মামীর আসল চেহারা। কিন্তু রাগের বসে বলে ফেলল। আদ্রিয়ানের সেদিকে খেয়াল নেই। ও গম্ভীরভাবে কিছু একটা ভেবে চলেছে। হাসান কোতয়াল বললেন,

” আমাদের যেটুকু জানার আমরা জেনে গেছি। আর কিছুই বলতে হবেনা। যাও রুমে গিয়ে রেস্ট কর। আর একদম কান্নাকাটি করবেনা। যেটা হয়েছে সেটাতে তোমার কোন হাত ছিলোনা।”

অনিমা একটু অবাকই হল। এরা দু-জন এমন কেন?.সবকিছুই অর্ধেক বলে, অর্ধেক শোনে। এমন মনে হয় যেন পুরো রিসার্চ করে তবেই শুনতে আসে। আদ্রিয়ান অনিমার হাত ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে বলল,

” চল, রুমে চল।”

অনিমা আর আদ্রিয়ান যেতে নিলেই হাসান কোতয়াল আদ্রিয়ানের নাম ধরে পেছন থেকে ডেকে উঠল। আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে তাকাল। এখন আবার অনিমার সাথে যেতে বারণ না করে বসে! কিন্তু হাসান কোতয়াল বললেন,

” রাতে ফোন কর। কথা আছে।”

আদ্রিয়ান একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যাক ওর শশুরের একটু সু-বুদ্ধি হয়েছে তাহলে। এই বুদ্ধিটুকু দিয়েই যদি এখন ওর বউটাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পার্মিশনটা দিয়ে দিতো। কিন্তু ওর কপাল এখনো এতোটাও খোলেনি। এসব ভাবতে ভাবতে অনিমাকে নিয়ে চলে গেল রুমে।

_________

অরুমিতা দুপুরে খেয়ে একটা ভাতঘুম দিচ্ছিল। বাঙালির অতি প্রিয় কাজ এটা। কিন্তু ওর এই আড়াম বেশিক্ষণ টিকল না। ঠিকই ডিসটার্ব করার জন্যে ফোনের রিংটন বেজে উঠল। অরুমিতা ভ্রু কুচকে নাম্বার না দেখেই ফোনটা রিসিভ করে বলল,

” হ্যালো?”

” আশিস বলছি।”

সাথে সাথেই অরুমিতার ঘুম গায়েব হয়ে গেল। এই ছেলেটার সমস্যা কী? রোজ এতো অপমান করে তবুও কেন ফোন দেয় ওকে। হঠাৎ এখন এতো মনে পরছে কেন। ও চোখে-মুখে বিরক্তি ভাব এনে বলল,

” হ্যাঁ বলুন।”

ওপাশ থেকে আশিস কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এরপর ইতস্তত করে বলল,

” তোমার সাথে একটু দেখা করতে চাই। কিছু কথা বলার ছিল।”

অরুমিতা এবার কঠোর গলায় বলল,

” কিন্তু আমি কিছু শুনতে চাইনা। আপনার কথাতো না-ই।”

আশিসের এবার একটু রাগ লাগল। তাই রাগী গলায় বলল,

” তো কার কথা শুনতে চাও। তোমার ঐ অয়ন স্যারের কথা?”

অরুমিতা খানিকটা চমকে উঠল। অয়নের কথা আশিস কীকরে জানে? কিন্তু সেসব চিন্তা সেখানেই বাদ দিয়ে ও রাগী কন্ঠে বলল,

” হ্যাঁ ওনার কথাই শুনতে চাই। তাতে আপনার কী? উনি যথেষ্ট ভালো মানুষ। আপনার মত ঠকবাজ নয়। কারো ফিলিংস, কারো অনুভূতি নিয়ে খেলেনা সে। তাই এসব ফাল্তু কথা বলতে ফোন করবেন না আমাকে। আমি বিরক্ত হই।”

অরুমিতা ফোন রেখে শুয়ে পরল। ভেতরটা কষ্টে ফেটে গেলেও বাইরে দিয়ে তার একবিন্দুও প্রকাশ ঘটালো না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। ওদিকে আশিস ফোনটা ছুড়ে মারল মেঝেতে। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে একপ্রকার। কিন্তু অরুমিতাকে কী সত্যিই দোষ দেওয়া যায়? ও যা করেছিল তার পরে এই ব্যবহারটাইতো স্বাভাবিক। বরং এরচেয়ে খারাপ ব্যবহার ডিসার্ব করে সে।

__________

আদ্রিয়ান অনিমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই চলে যাবে ও। যাওয়ার আগে অনিমাকে ঘুম পারিয়ে রেখে যেতে চায়। তাই আলতো হাতে অনিমার চুলে আঙুল নেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু আদ্রিয়ান খেয়াল করল যে অনিমা কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার। আদ্রিয়ান বুঝতে পারল যে অনিমা কাঁদছে। আদ্রিয়ান হাত দিয়ে অনিমার মুখ উঁচু করে ধরে ভ্রু কুচকে বলল,

” কাঁদছো কেন? দেখ আর্জুর সাথে যা হয়েছে খুব খারাপ হয়েছে। বাট দ্যাট ওয়াজ নট ইউর ফল্ট। তাই কান্না করোনা প্লিজ। তুমি জানো আমি তোমাকে কাঁদতে দেখতে পারিনা।”

অনিমা কিছু বলছেনা। শুধু নিচের দিকে তাকিয়ে ফোঁপাচ্ছে। আদ্রিয়ান হাত দিয়ে অনিমার চোখ মুছে দিয়ে ওকে আবার বুকে টেনে নিয়ে বলল,

” কেঁদোনা। ওসব কথা মাথায় এনোনা এখন। ঘুমিয়ে পরো।”

অনিমা আদ্রিয়ানের বুকে মুখ গুজে রেখে বলল,

” আমি ওসব ভুলে যেতে চাই। আমি মনে রাখতে চাইনা কিছু। ওসব মনে পরলে আমার ভীষণ কষ্ট হয় আদ্রিয়ান। আমি সব ভুলতে চাই।”

আদ্রিয়ান কিছু না বলে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল অনিমাকে। ওর শরীর হালকা কাঁপছে। মনে হচ্ছে যে নিশ্বাসটাও ভীষণ কষ্টে নিচ্ছে। মুহূর্তেই চোখ-কান সব লাল হয়ে উঠল ওর। অনিমার স্বাভাবিক কথাটাও যেন ওর মানতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

#চলবে…

[ রি-চেইক করা হয়নি।]

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৫৫.

রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। অনিমা টেবিলে বসে পড়ছে। কিন্তু পড়ার তেমন মনোযোগ দিতে পারছেনা। একেতো আদ্রিয়ানকে মিস করছে। তারওপর আর্জুর ঘটনার কথা আরও বেশি করে মনে পরছে ইদানীং ওর। তাই পড়তে বসেছিল যাতে মনোযোগটা অন্যদিকে নেওয়া যায়। কিন্তু সেটা সম্ভব হল না। বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছেনা বেশিক্ষণ। তাই রাতের ঔষধ খেয়ে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরল। ঘুমাতে পারলে হয়তো ভালো লাগবে। ফোনের রিংটন শুনে চোখ খুলে তাকাল ও। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখতে পেল এটা আদ্রিয়ানই ফোন করেছে। অনিমা ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। শত কষ্ট বা মন খারাপের মাঝেও এই মানুষ ওর মন ভালো করার জন্যে, ওকে শান্তি দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। ও ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আদ্রিয়ান বলল,

” ঘুমিয়ে পরেছিলে?”

” না, এমনিই শুয়ে ছিলাম।”

আদ্রিয়ান একটু দুষ্টুমির স্বরে বলল,

” আমাকে মিস করছিলে, জানপাখি?”

অনিমা একটা লাজুক হাসি দিলেও সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল,

” আমার কাজ নেই না-কি আর?”

” এখনতো নেই। কিন্তু একবার তোমাকে ঘরে এনে তুলি। তারপর না হয় এই সময়টাতে তোমাকে ব্যস্ত রাখা যাবে।”

অনিমা ভ্রু কুচকে ফেলল। বেশ অনেকটা সময় লাগল ওর আদ্রিয়ানের কথার মানে খুঁজে বেড় করতে। ব্যাপারটা বুঝে লজ্জায় গুটিয়ে গেল একপ্রকার। ভাগ্যিস আদ্রিয়ান সামনে নেই তাহলে তো লজ্জায় মরেই যেত।

” আচ্ছা শোন, নাহিদ একটু কথা বলবে তোমার সাথে।”

অনিমা অনেকটাই অবাক হল। নাহিদ ওর সাথে কথা বলতে চায়? তাও এখন? কিন্তু কেন? ও অবাক কন্ঠেই বলল,

” নাহিদ ভাইয়া?”

” হুমম, নাহিদ একটু কথা বলবে।”

” আচ্ছা দিন।”

কিছুক্ষণ পরেই ফোনের ওপাশ থেকে নাহিদের কন্ঠস্বর ভেসে এলো,

” কেমন আছো অনু?”

অনিমা মুচকি হেসে বলল,

” ভালো ভাইয়া। আপনি?”

” হ্যাঁ ভালো আছি। কী করছ এখন?”

” তেমন কিছুই না। শুয়ে আছি।”

” ঘুম আসছে?”

” এখনো না।”

” কেন? কোন সমস্যা হচ্ছে? শরীর ঠিক আছে?”

” মাথা হালকা ঝিমঝিম করছিল। এখন ঠিক আছি।”

” এমনিতে আর কোন সমস্যা নেইতো?”

নাহিদের এরকম প্রশ্নে খুব অবাক হচ্ছে অনিমা। এগুলো জিজ্ঞেস করতে ফোন করেছে? এগুলো জেনে তার কী লাভ? আর এভাবে খুটিয়ে খুটিয়ে ওর খোঁজ কেন নিচ্ছে? তবুও নিচু গলায় বলল,

”তেমন কিছুই না।”

” শিওর?”

” ইয়া।”

” আচ্ছা নিজের খেয়াল রেখো। রাখছি।”

বলে আদ্রিয়ানকে ফোন ধরিয়ে দিল। অনিমা অনেকটাই বোকা বনে গেল। কী হল ঠিক বুঝে উঠতে পারল না ও। আদ্রিয়ানের ডাকেই ওর হুশ ফিরল। আদ্রিয়ানের সাথে কথা বলতে বলতেই অনিমা আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পরল অনিমা। আদ্রিয়ান যখন দেখতে পেল যে অনিমার কোন আওয়াজ আসছে না তখন বুঝতে পারল যে অনিমা ঘুমিয়ে পরেছে। তাই ফোনটা রেখে দিয়ে ওও ঘুমিয়ে পরল। কারণ ইতিমধ্যে অনেক রাত হয়ে গেছে।

__________

সকালবেলায় রঞ্জিত চৌধুরী আর কবির শেখ সোফায় বসে চা খাচ্ছিলেন। একবারে রেডি হয়েই নিচে নেমে এসছেন ওনারা। চা খেতে খেতে গত সপ্তাহে ওনাদের দুটো গোডাউন বন্ধ করতে হয়েছে সেই বিষয়েই কথা বলছেন। স্নিগ্ধা রান্নাঘর থেকে ওনাদের নাস্তা এনে রাখল টেবিলে। বেশ কিছুক্ষণ পর ওপর থেকে একদম রেডি হয়ে রিক নেমে এলো। একটা নীল পাঞ্জাবী আর হোয়াইট জিন্স পরে নিচে নেমে এসছে ও। রঞ্জিত চৌধুরী আর কবির শেখ দুজনেই অবাক হলেন। এই কয়েকমাসে আজ প্রথম কোথায় বেড় হওয়ার জন্যে রেডি হয়েছে রিক। স্নিগ্ধাও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। রিক এসে সোফায় বসতেই রঞ্জিত চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন,

” কোথায় যাবে?”

রিক পাঞ্জাবীর হাতা গোটাতে গোটাতে বলল,

” পার্টি অফিসে! অনেকদিন যাইনা। এবার তো যেতে হবে না-কি?”

কবির শেখ অবাক হয়ে বললেন,

” সত্যিই যাবে?”

রিক ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,

” না যাওয়ার তো কিছুই নেই। ঐ একটা মেয়ের জন্যে কী সারাজীবন রুমে বসে থাকব না-কি?”

কবির শেখ আর রঞ্জিত চৌধুরী বোকার মতো একে ওপরের দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছুই বললেন না। এই ছেলের মাথা কখন বিগড়ে যায় ঠিক নেই। যদি মত বদলে ফেলে তাহলে? তাই ওনারা চুপচাপ খেয়ে উঠে গেলেন। রিক বলল, ও খেয়ে নিজের গাড়ি করেই আসছে। ওনারা চলে যেতেই স্নিগ্ধা রিকের খাবার নিয়ে এলো। খাবারটা টি-টেবিলে রিকের পাশে বসে বলল,

” কী করছ কী তুমি? তুমি জানো সব সত্যি। তবুও __”

রিক স্নিগ্ধার কথায় পাত্তা না দিয়ে ফোন স্ক্রোলিং করতে করতে বলল,

” খাইয়ে দে তো।”

” রিক দা তুমি__”

” তুই খাওয়াবি না আমি উঠে যাবো?”

স্নিগ্ধা ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে রিক কে খাইয়ে দিতে শুরু করল। কিছুই ভালো লাগছে না ওর। অনেক কষ্টে এই কয়েকদিনে মদের নেশাটা ছাড়িয়েছে। যদিও এতে অনিমার ভূমিকাও আছে কিছুটা। কিন্তু অনেকটা খাটতে হয়েছে স্নিগ্ধাকে। কিন্তু এখন আবার না এই ছেলে কোন ভুল করে বসে। হঠাৎ করেই রিক বলে উঠল,

” তুই খেয়েছিস?”

স্নিগ্ধা মাথা নেড়ে বলল,

” না, তুমি চলে গেল তারপর খাবো।”

” এখনই খা।”

” এটা তো তোমার জন্যে এনেছি। তুমি খাও আমি খেয়ে নেব পরে__”

রিক বিরক্তি নিয়ে বলল,

” একটু বেশিই কথা বলিস তুই আজকাল। চুপচাপ খেয়ে নে আমার সাথে। এক কথা বারবার বলতে ভালোলাগেনা।”

স্নিগ্ধাও আর কোন উপায় না পেয়ে রিকের সাথে খেতে আরম্ভ করল। রিকের খাওয়া শেষে পানি খেয়ে স্নিগ্ধার ওড়নাতেই নিজের মুখ মুছে উঠে দাঁড়াল। একটু এগিয়ে গিয়েও পেছন ঘুরে তাকিয়ে আসছি বলে চলে গেল। স্নিগ্ধা শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেদিকে। কেমন অদ্ভুত এক শিহরণ, অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করে ওর ভেতরে। বেশ বুঝতে পারছে যে দিনদিন ও রিকের প্রতি দুর্বল হয়ে পরছে। কিন্তু ওর তৈরী হওয়া এই অনুভূতির কী কোন মূল্য দেবে রিক? রিকের সবটা জুড়ে তো এখনই তাঁর নীলপরীরই বসবাস। ওর কী এখানেই থেমে যাওয়া উচিৎ? না-কি রিককে আরও কিছুদিন সময় দেওয়া উচিত?

__________

দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল। এই একমাসে অনিমা আর আদ্রিয়ানের যোগাযোগের প্রধান মনে মাধ্যমই ছিল ফোন। খুব কমই সামনাসামনি দেখা হয়েছে। তাও আদ্রিয়ান এসছিল ভার্সিটিতে। আর আরেকটা মজার পরিবর্তন হলো ঐদিনের পর হাসান কোতয়াল বাড়ির দুজন সার্ভেন্টকে ছাড়িয়ে দিল। অনিমার মামা-মামি যখন কারণ জানতে চাইল। তখন হাসান কোতয়াল সোজাসুজি বলল, বাড়িতে ওনারাই যেহেতু ফ্রিতে বসে আছে তখন আর কাজের লোকের কী দরকার? বাড়িতে থাকতে হলে এটুকু তো করতেই হবে। অনিমা তখন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল নিজের বাবার দিকে। কারণ নিজের বাবার এরকম রূপ এর আগে ও দেখেনি ও। তবে একটা জিনিস সত্যি মানুষ যতই উদার হোক, নিজের সন্তানের অপরাধিকে কেউ ক্ষমা করতে পারেনা।

অনিমা আজ বেশ দেরী করেই ভার্সিটি এসে পৌঁছেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরী হয়ে গেছে ওর। ভার্সিটির গেইটটের সামনেই দেখা হল রবিনের সাথে। অনিমাকে দেখেই রবিন কেমন ভয়ে পেয়ে সরে বেশ দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে ফেলল ওর গ্যাং এর লোকরাও একই কাজ করল। অনিমার বেশ হাসি পেল কিন্তু হাসিটা ভেতরে চেপে রেখেই পাত্তা না দিয়ে চলে গেল ওখান থেকে। ক্যাম্পাসে ভেতরে ঢুকে দেখল তীব্র আর অরুমিতা বিল্ডিং এর সিঁড়িতেই বসে আছে। ও ভ্রু কুচকে ফেলল। এতক্ষণে তো ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। ওরা এখানে বসে আছে কেন? ও এগিয়ে গিয়ে ওদের সামনে গিয়ে বলল,

‘ কী ব্যাপার তোরা এভাবে বসে আছিস কেন? ক্লাস শুরু হয়নি?’

তীব্র কান থেকে হেডফোন নামিয়ে একটা মেকি টাইপ হাসি দিয়ে বলল,

‘ উমহুম! তোর জন্যেই ওয়েট করছে সবাই। তোকে ছাড়া ক্লাস হয় না-কি? কী যে বলিস!’

অনিমা ঠোঁট বাকিয়ে তীব্রর মাথায় একটা চাটা মেরে পাশে বসে ব্যাগটা কোলে রাখতে রাখতে বলল,

” লেগপুল না করে আসল কেসটা বলে দিলেই তো হয়।”

তীব্র মাথা ডলতে ডলতে বলল,

” মানুষ দিন দিন শান্ত হয়। আর তুই দিন দিন ফাজিল হচ্ছিস। এরকম অত্যাচার ঠিক না!”

অরুমিতা হেসে দিয়ে বলল,

” আরে এই বাঁদরের কথা ছাড়তো! আসলে আজ অয়ন স্যার আসেন নি তাই এই ক্লাসটা হবেনা। ওনার মা অসুস্থ তাই।”

অনিমা আর তীব্র অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকাল। অনিমা অরুমিতাকে একটা খোঁচা মেরে বলল,

‘” বাহ! তুমিতো দেখছি স্যারের ঘরের খবরও রাখো। কী ব্যাপার? কী চলে হুম?”

অরুমিতা বিরক্তি নিয়ে বলল,

” আর খবর। নিজেই নিজের সব খবর দেয় আমাকে। রোজ অকারণেই মেসেজ করবে। মাঝেমাঝে ফোনও করে। ভালোলাগেনা এসব এখন আর।”

অনিমা একটু ভাবুক হওয়ার ভান করে বলল,

” হুম বুঝলাম।”

” কী বুঝলি?”

” যে স্যার তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে একেবারে।”

বলে অনিমা হেসে ফেলল সাথে তীব্রও। অরুমিতা মুখ গোমড়া করে বসে রইল। অরুমিতাকে এতোটা সিরিয়াস দেখে অনিমা ভ্রু কুচকে ফেলল। ও কিছু বলতে যাবে তখনই ওখানে আশিস এসে দাঁড়াল। আশিস কে দেখে ওরা তিনজনই বেশ অবাক হল। অরুমিতা তো বেশ রেগে গেল। লোকটা ওর পেছনে এভাবে পরে আছে কেন? অনিমা মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আশিস অরুমিতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” আমার কথা আছে তোমার সাথে।”

তীব্র আর অনিমা বেশ অবাক হয়ে গেল। আশিস অরুমিতাকে পার্সোনালি চেনে না-কি? এভাবে কথা বলছে যে? অরুমিতা ঝট করেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

” আমার কাজ আছে। আমি বাড়ি যাব।”

বলে চলে যেতে নিলেই আশিস অরুমিতার হাত শক্ত করে ধরে বলল,

” আমার তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।”

অরুমিতা রেগে হাতটা এক ঝকটায় ছাড়িয়ে বলল,

” যার-তার সাথে হুটহাট কথা বলার মতো সময় আমার নেই।”

বলে লম্বা লম্বা পায়ে হেটে চলে গেল। অনিমা অনেকবার ডাকার পরেও পেছন ফিরে তাকায়নি সে। তীব্র বোকার মতো তাকিয়ে রইল অরুমিতার যাওয়ার দিকে। অনিমা আশিসের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

” ভাইয়া__”

কিন্তু অনমা কথাটা শেষ করার আগেই অাশিস চলে গেল ওখান থেকে। অনিমা কিছুই বুঝল না আশিস আর অরুমিতার ব্যাপারটা। ওর আগেই সন্দেহ ছিল যে অরুমিতা আর আশিসে আগে থেকেই পরিচয় আছে। কিন্তু আজ ও নিশ্চিত হয়ে গেল যে ওদের আগে থেকেই কোন সম্পর্ক আছে। কিন্তু সেটা কী? অনিমা তীব্রর দিকে তাকিয়ে দেখল ওও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কারণ পুরো ব্যাপারটাই ওর মাথার ওপর দিয়ে গেছে।

বাড়ি ফিরে অরুমিতা আর আশিসের ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতেই অনিমা নিজের রুমে ঢুকলো। কিন্তু রুমে ঢোকার সাথেসাথেই কেউ ওর হাত টেনে একদম নিজের বুকের ওপর ফেলল। অনিমা প্রথম বেশ চমকে উঠেছিল। কিন্তু মাথা তুলে তাকিয়ে ওর আরও অবাক হল। কারণ আদ্রিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। এই ছেলেটা কী জ্বীন-টিন টাইপ কিছু না-কি? হুটহাট যেখানে-সেখানে কীকরে চলে আসে? দেখে মনে হচ্ছে অনেক্ষণ আগেই এসছে। পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি আর জিন্স। অনিমা ভ্রু কুচকে বলল,

” আপনি এখানে?”

আদ্রিয়ান দুহাতে অনিমার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,

” কেন? খুশি হওনি?”

অনিমা আদ্রিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

” বউকে খুব মিস করছিলেন বুঝি?”

আদ্রিয়ান অনিমার কপালের চুলগুলো সরাতে সরাতে বলল,

” তোমাকে মিস? সেতো প্রতিদিন, প্রতিমিনিট, প্রতিসেকেন্ড করি। কিন্তু আজ তোমাকে নিতে এসছি।”

অনিমা অবাক হয়ে বলল,

” মানে?”

” এতো খুশি হওয়ার কিছুই নেই। তোমার বাবা পার্মানেন্টলি তোমাকে আমার কাছে দেবেনা এতো তাড়াতাড়ি। দুজনকেই নিতে এসছি।”

অনিমা কিছুই বুঝতে না পেরে বলল,

” কিন্তু কেন? হঠাৎ নিতে এলেন যে?”

” সেটা এখন বলা যাবেনা সোনা। কিন্তু হ্যাঁ, একটা গুড নিউস দিতে পারি।”

অনিমা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান বেশ খোশ মেজাজে বলল,

” মিনিস্টার রঞ্জিত চৌধুরীর কিছু অবৈধ বিজনেস ফাঁস হয়ে গেছে। সেসব কম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে এন্ড ওনাকে আজ সকালেই অ‍্যারেস্ট করা হয়েছে। সাথে আমার মামাকেও পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। এন্ড ওল ক্রেডিট গোস্ টু মিস্টার সিনিয়র।”

অনিমা হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আদ্রিয়ানের দিকে। কীভাবে কী হল? আর যদি এটা সত্যি হয় তাহলে আদ্রিয়ানই বা এতো স্বাভাবিক কীকরে? যেনো এটাই হওয়ার ছিল।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে