বর্ষণের সেই রাতে- ২ পর্ব-৫২+৫৩

0
1729

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৫২.

আকাশটা বেশ পরিষ্কার। কয়েকদিন টানা বর্ষণের পর আজ রৌদ্রজ্জ্বল সকালের দেখা মিলেছে। চারপাশের ভেজা সবুজ প্রকৃতিতে অদ্ভুত এক স্নিগ্ধতা বিরাজ করছে। এই বিশুদ্ধ বাতাসে চোখ বন্ধ করে প্রাণখুলে নিশ্বাস নেওয়া যেতে পারে। বেশ বেলা হয়ে গেছে। অনিমা গোসল করে ছাদে এসে ওর আর আদ্রিয়ানের ভেজা পোশাকগুলো শুকানোর জন্যে মেলে দিল। ওর আগে আদ্রিয়ান গোসল করেছে। পোশাক মেলে দিয়ে অনিমা চুল মুছতে মুছতে রেলিং এর পাশে এসে দাঁড়ালো। টাওয়েল টা রেলিং এ মেলে দিয়ে মুক্ত আকাশের দিকে তাকাল। নিজেকে বেশ ফ্রেশ লাগছে এখন ওর। এই কটা দিন আদ্রিয়ানকে ছাড়া খুবই বাজে কেটেছে। কিন্তু কাল রাতে এতোদিন পর আদ্রিয়ানের বুকে ঘুমোতে পেরে এখন শান্তি অনুভব করছে। তখনই পেছন থেকে কেউ ওকে জড়িয়ে ধরে ভেজা চুলে মুখ গুজে দিল। অনিমা শিউরে উঠল। আদ্রিয়ানের স্পর্শ চিনতে ওর একটুও দেরী হয়নি। ও চোখ বন্ধ করে বলল,

” রকস্টার সাহেব, এটা আপনার বাড়ি না। কেউ চলে আসবে, ছাড়ুন।”

আদ্রিয়ান অনিমার চুলে মুখ গুজে রেখেই বলল,

” আসুক! কেন ছাড়বো? আমার মোটেও ছাড়তে ইচ্ছে করছেনা।”

অনিমা একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে নিজেই ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু আদ্রিয়ান আরও শক্ত করে ধরে বলল,

” জানপাখি! এতো ছটফট করোনা। আ’ম ইনজয়িং দিস। তোমার চুলের স্মেলটা দারুণ!”

” ওটা চুলের না শ্যাম্পুর স্মেল।”

” উমহুম। এটা তোমার চুলের স্পেশালিটি। তোমার চুলের স্পর্শ পেয়েই শ্যাম্পুটা এতো সুন্দর স্মেল দিতে পারে। আমার বউ বলে কথা।”

অনিমা হেসে কুনুই দিয়ে আদ্রিয়ানের পেটে একটা গুতো মারল। আদ্রিয়ান হাসতে হাসতে অনিমাকে ছেড়ে দিল। অনিমা ঘুরে তাকাকেই আদ্রিয়ান একহাতে ওর কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নিল। অনিমা মুচকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে আদ্রিয়ানের দিকে তাকাল। একটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে আছে, ভেজা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে, যার অনেকটাই কপালে ভর্তি। অনিমা হাত দিয়ে আদ্রিয়ানের ভেজা চুলগুলো নেড়ে দিল। আদ্রিয়ান হাসল। অনিমা আদ্রিয়ানের দু-কাধে হাত রেখে বলল,

” সবসময় এমন চিল মুডে কীকরে থাকেন?”

আদ্রিয়ান এবার মুখ হালকা গম্ভীর করে বলল,

” আর চিল! আমার সব চিল করা বিকেলেই শেষ হয়ে যাবে। বিকেলবেলা চলে যেতে হবে।”

এবার অনিমার মুখেও হালকা আঁধার নেমে এলো। ও সামান্য অসহায় কন্ঠে বলল,

” বিকেলেই চলে যাবেন?”

” হ্যাঁ ! কীকরে থাকবো? তোমার আব্বুতো পারলে আমাকে এক্ষুনি পাঠিয়ে দেয়। আরে আমি এ বাড়ির জামাই। কোথায় বলবে এসছো আরও দুটো দিন থেকে যাও। তা-না, বলে কি-না কখন যাচ্ছো? এসবের মানে হয়?”

অনিমা ঠোঁট চেপে হেসে বলল,

” আপনি আবার কবে থেকে কারো কথা শুনতে শুরু করলেন?”

আদ্রিয়ান অনিমার কপালের চুলগুলো সরাতে সরাতে বলল,

” তোমার বাবা আর বাকি সবাই আমার কাছে এক নয়। ওনাকে আমি এমনি এমনি মিস্টার সিনিয়র বলে ডাকিনা। মন থেকে ভীষণ শ্রদ্ধা করি। এমনিতে দুষ্টুমি করলেও, তার প্রতিটা শব্দই আমার কাছে আদেশ।”

অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে হাসল হালকা। আদ্রিয়ান অনিমার চোখে হাত দিয়ে বলল,

” চোখ বন্ধ রাখো। আমি বললে খুলবে।”

অনিমা কোনরকম কোন প্রশ্ন না করেই চোখ বন্ধ করে রাখল। আদ্রিয়ান ওর পকেট থেকে একটা ঝিনুকের মালা বেড় করল। তারপর সেটা অনিমার গলায় পরিয়ে দিল। অনিমা ভ্রু কুচকে ফেলল। আদ্রিয়ান বলল,

” এবার খোলো!”

অনিমা চোখ খুলে দেখল ওর গলায় বেশ সুন্দর একটা ঝিনুকের মালা। এরকম মালা ওর খুব পছন্দের। ও হেসে দিয়ে বলল,

” এটা কোথায় পেলেন?”

আদ্রিয়ান অনিমার দুইকাধে হাত রেখে বললেন,

” কক্সবাজার থেকে এনেছি। আরও অনেক কিছুই এনেছি। তোমার রুমে পেয়ে যাবে। কিন্তু এইটা স্পেশাল। কারণ এটা দেখার পর তোমার কথাই মনে পরেছিল সবার আগে! পছন্দ হয়েছে?”

অনিমা উচ্ছসিত কন্ঠে বলল,

” ভীষণ!”

এরপর কিছু একটা ভেবে বলল,

” আন্টি আর জাবিনের জন্যে কিনেছেন তো?”

আদ্রিয়ান অনিমার নাক টিপে দিয়ে বলল,

” জি ম্যাডাম, কিনেছি।”

অনিমা কোন উত্তর দিলোনা। ও খুশি মনে মালাটা হাত দিয়ে নেড়ে নেড়ে দেখছে। আদ্রিয়ান মুগ্ধ চাহনীতে তাকিয়ে রইল অনিমার দিকে। কত অল্পতেই খুশি হয়ে যায় এই মেয়ে। ভালোবাসায় মোড়ানো ছোট্ট উপহারও ওকে কতটা আনন্দ দেয়। আদ্রিয়ানের তো টাকা কম নেই। অনিমা যখন তখন ডায়মন্ড, গোল্ডের জিনিস চেয়ে বসতে পারে। কিন্তু কিছু তো চায়ই না উল্টে আদ্রিয়ানের দেওয়া এই সামান্য ঝিনুকের মালাই ওর কাছে কতটা প্রিয় হয়ে গেল। অনিমার এই ব্যাপারগুলোই আদ্রিয়ানকে বারবার মুগ্ধ করে। কারণ অনিমার কাছে উপহার নয়, তাতে মিশে থাকা ভালোবাসাটাই ইম্পর্টেন্ট।

___________

রিক নিজের রুমে শুয়ে আছে। এখনো বাড়ি থেকে কোথায় বেড় হয়নি ও। পারেনি বেড় হতে। স্নিগ্ধার সাপোর্টে আগের চেয়ে অনেকটা নরমাল হলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেনি এখনো। বুকে পাথর চেপে দেয়ালে টানানো অনিমার ছবিটা সরিয়ে ফেলেছে। ওটা দেখলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনা ও। ওর ফোন বা ল্যাপটপেও অনিমার কোন সিঙ্গেল ছবি রাখেনি। এখনো না চাইতেও অনিমার কথাই ভাবছে।

” এভাবে ঘরে বসে কতদিন চলবে?”

রিক নিজের বাবার গলার আওয়াজ পেয়ে চোখ বন্ধ করে একটা বিরক্তির শ্বাস ফেলল। এরপর উঠে বসে ঘুরে তাকিয়ে বলল,

” যতদিন আমার ইচ্ছে হয়, ততদিন।’

রঞ্জিত চৌধুরীর গা জ্বলে উঠল রাগে। ছেলেটা ইদানীং বেশি কথা বলছে। আগে তো এতো তর্ক করত না! উনি কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,

” এসব কী হচ্ছে কী? পার্টি অফিসে যাচ্ছোনা, কোন কাজে পার্টিসিপেট করছ না। ঐ একটা মেয়ের জন্যে কী সারাজীবন ঘরে বসে পার করবে না-কি? এগুলো কেমন ছেলেমানুষী?”

রিক কিছুই বলল না। যেন ও কথাগুলো শুনতেই পায়নি। কবির শেখ বললেন,

” বাবাই, আমরা তো বলেছিলাম তোমার যদি ওকে এতোই প্রয়োজন কিছু করো। বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে? অনেক কিছুই করা যেত। আর যদি তুমি না পারো তো আমাদের বলো! আমরা__”

রিক ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

” একদম না! কোনভাবে যদি তোমরা অনি-আদ্রিয়ানের সংসার বা শান্তি নষ্ট করার কথা ভাবো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা। শুধুমাত্র আমার বাবা বা মামা বলে আমি কিন্তু তখন আর চুপ থাকব না। আমি চুপচাপ শান্ত আছি, সেরকমই থাকতে দাও। তোমাদের জন্যে ভালো হবে।”

” আমরা তো তোমার ভালোর জন্যেই__”

” অনেক ভালো করেছ তোমরা আমার। আর করতে হবেনা। যাও এখন।”

ওনারা বুঝে গেছেন যে রিককে কিছু বলে কোন লাভ হবেনা। তাই বেড়িয়ে এলেন রুম থেকে। রঞ্জিত চৌধুরী ভ্রু কুচকে কবির শেখকে বললেন,

” কী ব্যাপার বলোতো? রিক কখনও আমাদের সাথে এভাবে কথা বলেনা। কোনভাবে কী কিছু জেনেছে?”

কবির শেখও গম্ভীরভাবে কিছু ভাবতে ভাবতে বলল,

” ঐ মেয়েটাই হয়তো সব বলে দিয়েছে।”

” তারমানে তো__”

” আরে চিন্তা করবেন না। ও ততটাই বলতে পেরেছে যতোটা ওর জানা আছে। এখনো অনেক কিছুই ওর অজানা। আর ও যেটুকু জানে সেটুকু দিয়ে আমাদের কিচ্ছু করতে পারবেনা।”

রঞ্জিত চৌধুরী থুতনি চুলকে বললেন,

” আর হাসান? ওর কী করবো?”

কবির শেখ বাঁকা হেসে বললেন,

” ওর আপাতত কিছুই করতে হবে না। মরতে গিয়েও মরল না। বেঁচে যখন গেছে। থাকুক। যেহুতু ও আমাদের কিছুই করছেনা। শুধুশুধু ওকে কিছু করে আমাদের রিস্ক বাড়িয়ে লাভ নেই। অনিমা, হাসান সবকিছুই এখন সাইডে রেখে আমাদের তাঁর খোঁজ করতে হবে ঠিক করে। আদ্রিয়ানকে সন্দেহ আমার হয় মাঝেমাঝে। কিন্তু কেউ তো আছে যে এখোনো আড়ালে বসে খেলছে। কালকেও একটা গোডাউনে পুলিশ চলে এলো। এগুলো কে করাচ্ছে সেটা জানতে হবে। এখন চুনোপুঁটি ধরছে তাই অল্পে বেঁচে যাচ্ছি। কিন্তু রাঘব বোয়াল ধরে ফেললে সমস্যা। আর তারওপর মাদারও গুম হয়ে আছে।”

রঞ্জিত চৌধুরী রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,

” সব ঐ মেয়েটার থেকেই শুরু হয়েছে। ঐ আর্জুকে…”

সাথেসাথেই কবির শেখ ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

” চুপ করুন। এগুলো মুখ দিয়েও উচ্চারণ করবেন না। ছোট্ট একটা ভুল সব বরবাদ করে দিতে পারে।”

রঞ্জিত চৌধুরী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চুপ হয়ে গেলেন। আসলেই এখন যা অবস্থা ওনাদের! ছোট ছোট ভুলগুলোও সর্বনাশ করে ছাড়তে পারে।

___________

অনিমা হাসান কোতয়ালের রুমের দরজার কাছে এসে একটু উঁকি দিলো। কারণ রুমের ভেতরে টানা একঘন্টা যাবত জামাই-শশুরের মিটিং চলছে। যেখানে কারো আসা বারণ ছিলো। দুপুরের খাওয়া শেষ করেই এই মিটিং বসেছে দুজনের। কিন্তু হঠাৎ করেই অনিমার ডাক পরায় ওকে আসতে হল। অনিমা গলা ঝেড়ে বলল,

” আব্বু আসবো?”

অনিমার আওয়াজ পেয়ে ওনারা ওনাদের কথা থামিয়ে দিলো। তারপর হাসান কোতোয়াল মুচকি হেসে বলল,

” হ্যাঁ ভেতরে এসো।”

অনিমা ভেতরে গেল। এরপর বিছানার ওপরে উঠে বসল আসাম করে। ওর একপাশে হাসান কোতয়াল আরেকপাশে আদ্রিয়ান বসেছে। হাসান কোতয়াল বলল,

” আদ্রিয়ান বিকেলে চলে যাচ্ছে জানো তো?”

অনিমা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল। আদ্রিয়ান অভিযোগের কন্ঠে বলল,

” যাচ্ছিনা, বলো তাড়িয়ে দিচ্ছো।”

হাসান কোতয়াল হাসলেন। অনিমাও ঠোঁট চেপে হাসছে। আদ্রিয়ান মুখ ফুলিয়ে বলল,

” হ্যাঁ তুমিতো হাসবেই। আমার কী ইচ্ছে করছে জানো? তোমাকে এখন আরেকটা বিয়ে করাই। পরে একবছর পর সেই বউকে কিডন্যাপ করে গুম করে দেই। তখন বুঝতে আমার কষ্টটা!”

হাসান কোতয়াল একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

” সেটাতো অনেক আগেই বুঝেছি জুনিয়র।”

অনিমার মুখটাও মলিন হয়ে গেছে। আদ্রিয়ান বুঝতে পারল দুষ্টুমি করতে গিয়ে দুজনকেই একটু কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। তাই পরিস্হিতি স্বাভাবিক করতে বলল,

” তাছাড়াও তোমাকে কেউ বিয়ে করবেনা। বুড়ো হয়ে গেছো।”

অনিমা তৎক্ষণাৎ আদ্রিয়ানের কথার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলে উঠল,

” মোটেও না। কোন এঙ্গেল দিয়ে বুড়ো মনে হয়? দেখো এখনো কত ফিট আছে। পেটে একটুও মেদ নেই। আর চুল মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা সাদা হয়েছে। গুনে ফেলা যায়। কোথাও তেমন বলিরেখাও নেই।”

হাসান কোতয়ালও মেয়ের কথায় সম্মতি দিয়ে বললেন,

” তাইতো! কোন দিন দিয়ে বুড়ো আমি?”

আদ্রিয়ান মুখের সামনে এনে হাত জোড় করে বলল,

” মাফ চাই! ভুল হয়ে গেছে আমার। কান ধরে উঠবস করব?”

অনিমা আর হাসান কোতয়াল দুজনেই হেসে দিলেন। এটা নিয়ে কিছুক্ষণ হাসিমজার পর হাসান কোতয়াল অনিমার উদ্দেশ্যে বললেন,

” মামনী। এখন আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করব। সোজাসুজি সেগুলোর উত্তর দেবে। যেটুকু জানতে চাইব সেটুকুই বলবে বেশি কিছু না।”

অনিমা ভ্রু কুচকে ফেলল ওনার এরকম সিরিয়াস কথায়। এমন কী জিজ্ঞেস করবে যে এতো গম্ভীরভাবে বলছে? আদ্রিয়ান বলল,

” বাট মাথায় কোনরকম প্রেশার নেবেনা। সিম্পলি উত্তর দেবে।”

অনিমা বলল,

” কী জিজ্ঞেস করবে?”

হাসান কোতয়াল কয়েকসেকেন্ড নিরব থেকে বলল,

” আর্জু শারমা কে ছিল? ওর সাথে তোমার কীভাবে আলাপ? আর ও এখন কোথায়?”

অনিমা হালকা চমকে উঠল হাসান কোতয়ালের কথায়। আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখল ওও উত্তর শোনার জন্য তাকিয়ে আছে। কিন্তু উত্তর দেওয়ার আগে ওর মাথায় চলছে আর্জুর কথা ওর বাবা আর আদ্রিয়ান কীকরে জানে? ওদের সাথে এই ঘটনার কী সম্পর্ক?

#চলবে…

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৫৩.

পুরোনো কথা মনে করতেই অনিমার বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল। অতীত এমন একটা শব্দ, যেটা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি, নিজেদের শোধরাতে পারি। কিন্তু সেই অতীতই অাবার মানুষের পিছু ছাড়েনা। মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যেতে চায়না সে। কখনও রাতের আঁধারের গভীর স্বপ্নে হানা দেয়। কখনও বাস্তবতা হয়ে সামনে এসে। যতই ভোলার চেষ্টা করোনা কেন। অতীত নিজেকে ভুলতে দেয়না। আর্জুর কথা মনে পরলেই অনিমার চাপা এক যন্ত্রণা হয় ভেতরে ভেতরে। কতটা বিষাদময় আর ভয়াবহ ছিল সেই দিনটা? সেইসব দৃশ্য কল্পনা করলেও যে শরীর কেঁপে ওঠে ওর। মাথাও ঝিমঝিম করে উঠছে হালকা। অনিমার চোখে-মুখে এরকম আতঙ্ক দেখে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে আদ্রিয়ান বলল,

” তোমার কষ্ট হলে কিছু বলতে হবেনা।”

অনিমা গ্লাসটা নিয়ে পানিটা শেষ করল। এরপর লম্বা দুটো শ্বাস ফেলে একবার আদ্রিয়ান আরেকবার হাসান কোতয়ালের দিকে তাকাল। তারপর একটা ঢোক গিলে বলল,

” তোমরা আর্জু আপুকে কীকরে চেনো?”

হাসান কোতয়াল অনিমার দিকে একটু এগিয়ে বসে অনিমার মাথায় হাত রাখল। এরপর নরম স্বরে বলল,

” আছে কোন যোগসূত্র। এখন আপাতত আমাদের সত্যিটা বলো। কী হয়েছিল আমি চলে যাওয়ার পর?”

অনিমা চোখ বন্ধ করে হাত দিয়ে সারামুখের ঘামটা মুছে নিল। এরপর বলতে শুরু করল,

” তুমি আমাকে মামাবাড়িতে রেখে যখন রাজশাহী গেলে। এরপর ও বাড়িতে এমনিতে সব ভালোই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ ফোন এলো যে ওখানে তোমার এক্সিডেন্ট হয়েছে আর তুমি মারা গেছ। সেটা শুনে আমার অবস্থা কী হয়েছিল জানো? আমার তো নিজের বলতে তুমিও আছো। মানতেই পারিনি কথাটা। কিন্তু যখন ওরা একটা লাশ নিয়ে এলো, আর তারসাথে থাকা তোমার আইডি কার্ড। পুলিশ যখন নিশ্চিতভাবেই বলল ওটা তুমি। আমার দুনিয়াই থেমে গিয়েছিল। চিৎকার করে কেঁদেছিলাম সেদিন আমি। আমারও মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো আব্বু।”

বলে হাসান কোতয়ালকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। বাবা সবসময় আমাদের ছায়া দিয়ে আগলে রাখে। যতদিন বাবা নামক সেই ছায়া আমাদের মাথার ওপর থাকে ততদিন আমরা বুঝতেই পারিনা এই পৃথিবী কতটা কঠিন। কিন্তু সেই বাবার ছায়া মাথার ওপর থেকে সরে যায়। তখন আমরা বুঝতে পারি আমরা কী হারিয়েছি। সেটা অনিমাও হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল। অনিমার কান্না দেখে আদ্রিয়ানের ভেতরটা ছটফট করছে। ওর মায়াবিনীর কান্না ওর মোটেও সহ্য হয়না। কিন্তু বাবা-মেয়ের মধ্যে ঢোকা ঠিক হবেনা। তাই চুপচাপ বসে আছে। হাসান কোতয়াল মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলল,

” কাঁদেনা মামনী। আমি চলে এসছি তো। এবার বলো কী হয়েছিল তারপর?”

অনিমা সোজা হয়ে বসে চোখ মুছে নিল। এরপর কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আদ্রিয়ান আর হাসান কোতয়ালও ওকে সময় দিলো নিজেকে স্বাভাবিক করে নেওয়ার জন্যে। নিজেকে সামলে নিয়ে অনিমা বলতে শুরু করল,

” আমি প্রচণ্ড ভেঙ্গে পরেছিলাম। তখন থেকে মামা-মামী আর অর্ক ভাইয়াদের সাথে ওনাদের বাড়িতেই থাকতে শুরু করি। আমি তখন সবেমাত্র ক্লাস নাইনে ছিলাম। তাই বাবার অফিসটা মামাই দেখতো। কিন্তু…”

আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে বলল,

” কিন্তু কী?”

অনিমা চুপ করে আছে একদম। কারণ ওর মামা-মামি তেমন ভালো ব্যবহার করতো না ওর সাথে। যদিও খুব খারাপ ব্যবহার যে করত ঠিক তাও না। তবে ওর বাড়িতেই ওকে একপ্রকার কাজের লোকের মতই কাজ করতে হতো। অনিমাও চুপচাপ সব করতো। মাঝেমাঝে ওর মামী দু-একটা কটু কথা শোনাতো। আগের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের জন্যে ফোনও ছিলোনা ওর সাথে। তারওপর ও যত বড় হচ্ছিলো অর্ক ওকে কেমনভাবে যেন দেখতো। সেই দৃষ্টির উদ্দেশ্য সেদিন বুঝতে না পারলেও আজ বুঝতে পারে ও।

” কী হল বল?”

হাসান কোতয়ালের ডাকে হুশ এলো অনিমার। না, ওসব বলে এখন সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টি করার কারণ নেই। এখন তো হব ঠিকই আছে। তাহলে ঝামেলা করে লাভ কী?

” এভাবেই কয়েক বছর কেটে গেল। স্কুল-কলেজ, মিলিয়ে সব ভালো চলছিল। একদিন বিকেলবেলা আমি আমার মন ভালো ছিলোনা তাই কলেজ শেষে একাই হাটতে বেড়িয়েছিলাম।”

আসলে সেদিন সকালে কলেজ আসার সময় ওর মামী বকাবকি করেছিল। তাই না খেয়েই বেড়িয়ে পরেছিল আর মনও খারাপ ছিল ওর ভীষণ। অনিমা একটু থেমে বলল,

” ওখান থেকে বেশ নদীর পারে গিয়ে বসে ছিলাম আমি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে মনটা ভালো হচ্ছিলো। ওখানে থাকতে থাকতে ঠিক কখন যে সন্ধ্যা হয়ে এলো বুঝতেই পারলামনা।”

আদ্রিয়ান আর হাসান কোতয়াল দু-জনেই বেশ কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে। এরপরের ঘটনাতেইতো এই কাহিনীর আসল মোড়। ওনাদের জন্যে সবচেয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। অনিমা আবার বলতে শুরু করল। আর তারসাথে ভাবতে লাগল সেদিনের কথা।

একটা মেয়ের গোঙানোর আওয়াজ আসছির অনিমার কানে। অনিমা প্রথমে ভয় পেলেও পরে ভেবে দেখল কেউ বিপদে পরেছে নিশ্চয়ই। আর কোন বিপদে পরা ব্যাক্তিকে সাহায্য করা উচিত। ও সেই শব্দ অনুসরণ করে খানিকটা এগোলো। ও যত এগোচ্ছে আওয়াজ ততই বাড়ছে। ও খেয়াল করল আওয়াজ টা একটু দূরে থাকা বড় মেহগনি গাছের ওদিক থেকে আসছে। অনিমা দৌড়ে গেল সেদিকে। গিয়ে দেখল গাছের সাথে হেলান আধশোয়া হয়ে একটা মেয়ে বা হাতের বাহু চেপে ধরে কাতরাচ্ছে। অনিমা দ্রুত বসে মেয়েটাকে ধরে বলল,

” আপু কী হয়েছে তোমার?”

মেয়েটা হাফানো কন্ঠে বলল,

” জ-জল।”

অনিমা দ্রুত ব্যাগ থেকে পানির বোতল বেড় করে মেয়েটাকে খাইয়ে দিয়ে বলল,

” আপু তোমার তো প্রচুর রক্ত পরছে।”

বলে ওর ওড়না খুলে মেয়েটাকে জখম জায়গাটা বেঁধে দিল। মেয়েটা বলল,

” আমাকে প্লিজ এখান থেকে নিয়ে যাও দ্রুত। ও-ওরা চলে এলে আমায় মেরে ফেলবে। প্লিজ তাড়াতাড়ি করো।”

অনিমা ওকে ধরে ওঠার। অনিমার কাঁধের ওপর ভর দিয়ে। হাটছে মেয়েটা। মেইন রোডে গিয়ে প্রথমেই ওরা হাসপাতালে গেল। গুলিটা হাত ছুঁয়ে বেড়িয়ে গেছে তাই আর তেমন কিছু করতে হয়নি। মেয়েটা বেশ ক্লান্ত। বেশ রাতেই অনিমা মেয়েটাকে নিয়ে বাড়িতে এলো। মেয়েটাই রিকুয়েস্ট করেছে ওকে আজ রাতটা কোথাও একটা নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করতে। বাড়ি ফেরার পর ওর মামী এ নিয়ে অনেক ঝামেলা করল কিন্তু অনিমা পাত্তা দেয়নি। শুধু বলেছে ও ওর কলেজের এক সিনিয়র আপু। আজ রাত এখানে থাকবে।
অনিমার রুমে শুয়ে মেয়েটা রেস্ট করছে। অনিমা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল,

” তোমার নাম কী?”

মেয়েটা চোখ খুলে একটু হেসে বলল,

” আর্জু! আর্জু শর্মা।”

অনিমা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

” তুমি ভারতীয়? তারওপর অবাঙালী? তাহলে এতো ভালো বাংলা বলছ কীভাবে?”

” আমার বাবা ইন্ডিয়ান ছিলেন। কিন্তু মা বাঙালি। তাই এতো ভালো বাংলা জানি।”

অনিমা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। এরপর কিছু একটা ভেবে বলল,

” তুমি এদেশে কী করছ? আর তোমাকে গুলি কে করল? ওরা তোমাকে মারতে চায় কেন? তুমি কী করেছ? আর ঐ ব্যাগে কী আছে? যা তুমি ঐরকম হাতছাড়া করোনি? জাপটে ধরে ছিলে।”

আর্জু কিছুক্ষণ অনিমার দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে দিয়ে বলল,

” একদম বাচ্চাদের মত প্রশ্ন করতেই থাকো তুমি। মিষ্ট মেয়ে। তোমার নাম তো অনিমা মানে অনি তাইনা?।”

” হ্যাঁ। কিন্তু তুমি বলোনা আসল ব্যাপারটা!”

আর্জু একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে ঠিক হয়ে বসে বলল,

” আমার পাপা পাঁচ সাল আগেই মারা গেছেন। দু-বছর আগে আমি বাংলাদেশে মা’র কাছে চলে আসি। ও হ্যাঁ। আমার মা পেশায় একজন সিআইডি অফিসার ছিলেন। এখানকার এক আশ্রমের মাদারের সাথে মায়ের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। এখন আমারও বেশ ভালো সম্পর্ক। মায়ের কাজের ব্যাপারে আমি তেমন খোঁজ রাখতাম না। কিন্তু একদিন বেড় হওয়ার আগে মা আমাকে একটা ছোট ব্যাগ দিয়ে যায়। আর বলে এই ব্যাগে যা আছে সেটা আমাকে যত্ন করে রাখতে। উনি যদি না ফেরেন। তাহলে এটা নিয়ে কোন ক্রাইম রিপোর্টারকে দিতে। কিন্তু ভালোভাবে জেনেবুঝে তারপর। আমি অবাক হয়েছিলাম। মা নিজে আইনের লোক হয়ে পুলিশ বা কোন অফিসারকে দিতে না বলে জার্নালিস্ট কে কেন দিতে বললেন। আর দিলে তো মা’ই দিতে পারতেন। আমাকে কেন বললেন? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম এটাতে কী আছে। মা বলেছিল এটাতে মিনিস্টার রঞ্জিত চৌধুরী আর কবির শেখ কে শেষ করে দিতে পারে। আর কিছু না বলেই বেড়িয়ে গেছিল মা। কিন্তু আর ফিরে আসেন নি। ঐদিন একটা অপরেশনে মা মারা যায়।”

বলতে বলতে চোখ ভিজে এলো আর্জুর। অনিমা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ওও তো ওর বাবাকে হারিয়েছে। তারসাথে অবাক হল এটা ভেবে যে রঞ্জিত চৌধুরীকে ও সবসময় সৎ নেতা হিসেবেই জেনে আসছে। সত্যি দুনিয়া কত অদ্ভুত! তারচেয়েও অদ্ভুত এই গ্রহে বাস করা মানুষগুলো। কোনটা মুখ আর কোনটা মুখোশ বলা মুশকিল। অনিমা আর্জুর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিল। আর্জু বলল,

” কিন্তু ওরা কোনভাবে জেনে গেছে আমার কাছেই এই ব্যাগটা আছে। আমাকে মারার জন্যে আর ব্যাগটা পাওয়ার জন্যে উঠে পরে লেগেছে ওরা। আমাকে যেকোন মুহূর্তে মেরে ফেলবে ওরা।”

” তুমি ব্যাগটা কোন রিপোর্টারকে দাওনি কেন?”

” অনেক রিপোর্টারই ওদের কেনা। তাই হুটহাট কারো হাতে তুলে দিলেই হবেনা। তুমি শুধু একটা হেল্প করো। আমাকে কাল মাদারের কাছে পৌঁছে দাও। তোমার পোশাক পরে মুখ ঢেকে আমি যাবো। তাহলে আমায় চিনতে পারবেনা ওদের লোক।”

অনিমা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। পরেরদিন সকালে কথামত অার্জুকে নিরাপদে পৌঁছে দিল মাদারের কাছে। এরপর বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। অনিমা গিয়ে আর্জু আর মাদারের সাথে দেখা করত। আর্জু ঐ অনাথ আশ্রম ছেড়ে বেড়ই হতোনা। এই যাওয়া-আসায় আর্জু আর মাদার দুজনের মধ্যেই বেশ ভালো বন্ডিং তৈরী হয়ে গেছে ওর। মাদার আর্জুর সাথেসাথে অনিমাকেও চোখে হারায়। সেই ছোট্ট ব্যাগে থাকা জিনিসপত্র মাদারের কাছেই আছে সযত্নে। ওরা শুধু অপেক্ষা করছিল তিনজন ওয়েট করছিল একটা উপযুক্ত সময়ের।কিন্তু মাদারকে মাসখানেকের জন্যে বেড় হতে হয়। আর অনিমা বা আর্জু কারো কাছেই ঐ জিনিসগুলো নিরাপদ নয় বলে মাদার সেগুলো সাথে করে নিয়ে যায়।

ঐ একমাসের জন্য অনিমা আর্জুকে নিয়ে আসে ঐ বাড়িতে। এই নিয়ে অনিমার মামী কম ঝামেলা করেন নি। কিন্তু এবারেও অনিমা পাত্তা দেয়নি। বেশ অনেকগুলো দিন পার হয়ে যায়। আর্জু মাঝেমাঝেই বলতো অর্কর ব্যবহার ওর ভালো লাগেনা। কেমন খারাপ নজরে দেখে ওকে। অনিমা প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বোঝে ব্যাপারটা। আর্জুকে বলে একটু দূরত্ব মেনে চলতে। কিন্তু একদিন অর্ক এতোটাই বাড়াবাড়ি-ই করে ফেলে যে আর্জু চড় মেরে বসে। আর এইজন্যই ঐরকম সন্ধ্যাবেলাতেই আর্জুকে ঘর থেকে বেড় করে দেয় অনিমার মামী। নিজের ছেলের দোষটা চোখেই দেখতে পায়না সে। অনিমা যাতে পেছনে যেতে না পারে তাই ওকে আটকে রেখেছিল ঘরে। কিন্তু অনিমা পেছনের দরজা খুলে বেড়িয়ে যায়। কারণ আর্জুর লাইফ কতটা রিস্কে সেটা শুধুমাত্র ও-ই জানতো। ও ছুটে যায় আর্জুর কাছে। আর্জু তখন রাস্তার পাশে ভয়ে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। অনিমা ওর পাশে গিয়ে বসতেই। আর্জু অনিমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। এখন কী করবে ওরা সেটাই ভাবছে। আপাতত দুজনের প্রাণই ভয়ংকর বিপদের মুখে আছে। শো শো শব্দে তীব্র বাতাস বইছে। আকাশের গুরুম গুরুম শব্দে যেনো মেঘেদের যুদ্ধের শঙ্খনাদ করছে। সেটা যেন স্পষ্ট বলে দিচ্ছে আজ শুধু আকাশে নয় মাটিতেও ভয়ংকর কিছু হতে চলেছে। শীঘ্রই অনাকাঙ্ক্ষিত কোন অঘটন ঘটতে চলেছে। খুব শীঘ্রই।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে