বক্ষ পিঞ্জর পর্ব-১৫

0
915

#বক্ষ পিঞ্জর
#Anaisha_Ehmat
#পর্বঃ১৫

“চারিদিকে পাখির কলরব শুরু হয়ে গেছে। কোকিল ডাকছে মধুর সুরে। শহরের আনাগোনাও বেড়েছে। যানবাহন চলাচল শুরু করেছে। কৃষ্ণচূড়ার আবডালের ফুল গুলো ছড়িয়ে পড়ছে ফুটপাতে। পাখিদের গুঞ্জন যেনো মধু মাখাময় হয়ে উঠেছে। অনেক বেলা হয়ে গেছে কিন্তু শহরের মানুষগুলো এখনো ঘুমের দেশে পড়ে আছে। প্রকৃতি যেনো বড্ড বেশামাল হয়ে পড়েছে এই শহরাঞ্চলের মানুষ গুলোর প্রতি। গভীর রাতে ঘুমাতে যাওয়ায় সবাই এখন ঘুমিয়ে আছে। রায়াফ চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে ও কোথায় আছে। আপু তুমি কোথায় আমি এখানে কেনো। পাশে তাকিয়ে দেখলো আবির শুয়ে আছে। পরক্ষনে রায়াফ বুঝতে পারলো কাল ও আবিরদের বাসায় এসেছে৷ তাই রায়াফ উঠে আবিরের বেলকনিতে চলে গেলো আর দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে। এভাবে বেশ খানিক্ষন বসে থেকে রায়াফ বলল, আপু কোথায় শুয়েছে। দেখে আসি তো। যেই ভাবা সেই কাজ রুমে এসে দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে এদিক ওদিক ঘুড়তে লাগলো। এতগুলো রুম থাকায় রায়াফ ঠিক খুঁজে পেলোনা রাত্রি কোথায় শুয়েছে। তারপর আবার আবিরের কাছে এসে আবির কে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো। আবির ও শক্ত করে রায়াফ কে জড়িয়ে ধরলো। রায়াফ ডোর লক না করেই এসে ঘুমিয়ে পড়েছে।”

“বেলা তখন ১১ঃ০০ টা বাজে আস্তে আস্তে সবাই ঘুম থেকে উঠছে। রাত্রি শরীর মোচরে উঠে পড়লো। তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে ইভা কে ডেকে তুলল। দুজনেই ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে৷ ইভা তুই এখানে বস আমি দেখে আসি রায়াফ উঠলো কিনা। তারপর ইভা কে সোফায় বসিয়ে দিয়ে রাত্রি উপরে চলে গেলো আবিরের রুমে। গিয়ে দেখলো দরজা খোলা আছে বেশ অবাক হলো। ধীরে ধীরে রুমে প্রবেশ করলো। গিয়ে দেখলো দুজনেই বেশামাল অবস্থায় শুয়ে আছে একটার ও শুয়ে থাকার সেন্স নেই। রাত্রি রায়াফ কে ডাক দিলো, এই ভাই উঠ বেলা হয়ে গেছে অনেক তো৷ তাড়াতাড়ি উঠে পর৷ ”

“কিন্তু রায়াফ যে আবার সেকেন্ড টাইম ঘুমিয়েছে তাই ওর তেমন হুশ নেই ঘুমের ঘোরে আছে। কিন্তু আবির জেগে গেলো৷ রাত্রি কে দেখে মুহুর্তের মধ্যেই আবিরের ঘুম উধাও হয়ে গেলো। চট জলদি উঠে বসলো। হাই তুলে বলল গুড মর্নিং মাই কুইন।”

“গু গুড মর্নিং। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল রাত্রি। ওর ধারনা ছিলোনা যে আবির উঠে যাবে। তারপর বলল, আপনার রুমের দরজা খুলা ছিলো কেনো।”

“আবিরের ব্রু যুগল কুচকে গেলো। বলল, কি বললে। কিভাবে? আমিতো ডোর লক করেই ঘুমিয়ে ছিলাম আমার স্পষ্ট মনে আছে তাহলে কে খুলবে ডোর। ”

“তাহলে মনে হয় ভূ’ত খুলেছে তাই না।”

“না তা কেনো হবে। তাহলে কি রায়াফ ঘুম থেকে উঠেছিলো। আবার এসে ঘুমিয়েছে হইতো। ”

“ওহ সেটা হতে পারে। হইতো ভাই উঠেছিলো কাওকে জাগ্রত না দেখে আবার এসে শুয়ে ঘুমিয়ে গেছে। ”

“হুম। তো তুমি কি এখানে আমায় এই সকালে ভালোবাসতে এসেছো। ঠোঁট বাঁকা করে বলল আবির। ”

“আপনিও না কি যে বলেন। ফ্রেশ হতে যান আমি যাচ্ছি। বলেই রাত্রি এক দৌড়ে রুমের বাইরে৷ এই লোকটা কি তাকে লজ্জা দিবার জন্যই এই সমস্ত কথা বলে। আমাকে দেখলেই কি ওনার এসব মনে পড়ে নাকি। বিরবির করে নিচে নেমে এলো। এসে দেখে আবিরের সব কাজিনরা উঠে পড়েছে সবাই লিভিং রুমে ইভার সাথে আড্ডা জমিয়েছে। রাত্রিও যোগ দিলো। বেশ কিছুক্ষন পর রাত্রির মনে হলো এখানে তো ফয়সাল ভাইয়া নেই তাহলে ওনি কোথায় চলে গেলো৷ ওনি কি উঠে নি। রাতের ওই ঘটনার পর তো আর ওনাকে দেখা হয়নি। মনে মনে বলল রাত্রি। না পেরে জিজ্ঞাসা করে বসলো ফারিয়া আপুকে, আপু ফয়সাল ভাইয়া কোথায় আমরা তো সবাই এখানে আছি। আবির ভাইয়া ও নেই। আবিরের কথা ইচ্ছে করেই বলেছে যাতে ফারিয়া মাইন্ড না করে৷ না হলে বলবে যে ফয়সাল কে কেনো খুঁজছো। ”

“মনে হয় ফয়সাল ঘুমাচ্ছে। সবাই তো অনেক রাতে ঘুমিয়েছি তাই হইতো ও উঠেনি এখনো। বসে থাকো তো ও সময় হলে উঠে যাবে। বলেই ফারিয়া আড্ডায় মন দিলো।”

“রাত্রির মন টা যেনো খচ খচ করছে। ছেলেটা খুব কষ্ট পেয়েছে মনে হয়৷ কিন্তু আমি তো কিছু করিনি। আমার তো এখানে কোনো দোষ আছে বলে আমি দেখছিনা৷ আমাকে কি ভুল বুঝো ফয়সাল ভাইয়া। না না আমাকে ক্ষমা চাইতে হবে ওনার কাছে। মনে মনে কথা গুলো বলল রাত্রি।”

“সার্ভেন্টরা আবিরের মায়ের কথা মতো ওদের চা দিলো। কিন্তু রাত্রি চা খাইনা এটা আবিরের আম্মু জানে তাই তিনি রাত্রির জন্য কফি পাঠালেন। তারপর আবির রায়াফ কে সাথে নিয়ে নিচে নেমে এলো। তারপর ডাইনিং এ বসে গেলো৷ একে একে সবাই ডাইনিং এ বসলো। সার্ভেন্ট ওদের নাস্তা দিলো৷ নাস্তা করার সময় সবাই জিজ্ঞাসা করলো ফয়সাল কই৷ ওকে রেখে সবাই খাচ্ছি যে। প্রতিত্তোরে কেও কিছু বলতে পারলোনা৷ তাদের খাবারের মাঝ খানেই ফয়সাল বেশ পরিপাটি হয়ে নিচে নেমে এলো। আর ফারিয়া কে বলল, আপু খেয়ে রেডি হয়ে নাও বাসায় যাবো তাড়া আছে। ”

“সে কি কথা ফয়সাল আজই চলে যাবি কেনো। আবিরের মা বলল।”

“ফয়সাল জোরপূর্বক হেসে বলল, খালামনি আমার একটু কাজ আছে ইম্পর্ট্যান্ট তাই যেতে হবে অন্য এক সময় না আসবো। ”

“তোর এখন আবার কিসের কাজ পড়লো। যার জন্য আজই চলে যেতে হবে তোকে। বিজনেস ম্যান হয়ে গেছিস নাকি। আবির বলল।”

“ফয়সাল কিছু বলল না। কিন্তু রাত্রির মনে হচ্ছে রাতের ঘটনার জন্যই ফয়সাল চলে যাবে।”

“আচ্ছা তাহলে খেয়ে নে আগে তারপর না হয় যাস। আবিরের আম্মু বলল।”

“খিদে নেই খালামনি খাবোনা।”

“পাগল নাকি তুই সেই কবে কাল রাতে খেয়েছিলি আর তুই বলছিস খিদে নেই। মুখ টা চুপসে আছে। ”

“ও কিছুনা খালামনি। বলেই ফয়সাল মাথা উচু করল।”

“আবিরের মা দৌড়ে ফয়সাল এর কাছে গিয়ে বলল, বাবা তোর চোখ মুখ এমন ফুলে আছে কেনো৷ দেখে মনে হচ্ছে কেও তোকে মেরেছে। তুই কান্না করেছিস! চোখ যে এভাবে ফুলে আছে।”

“ধুর খালা মনি তুমি কি যে বলোনা। রাতে ঘুম হয়নি তো তাই এমন হচ্ছে। ”

“তারপর ফারিয়া আর ফয়সাল কিছুক্ষনের মধ্যেই চলে গেলো। যাবার সময় একবার করুন চোখে রাত্রির দিকে তাকালো। রাত্রি বেশ বুঝতে পারলো যে ফয়সাল খুব কান্না করেছে আর কষ্ট পেয়েছে অনেক। কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ টা অব্দি পেলোনা । ”

“কিছুক্ষন পর আভা রাত উঠে এলো নাস্তা সেরে আবার সবাই আড্ডা দিলো। আবিরের আব্বু নাস্তা করে তার রুমে গিয়ে পেপার পড়ছেন।”

“আবির সবাইকে রাতের ঘটনা সবাইকে বললেন। শুধুমাত্র ফয়সালের ঘটনা টা কাওকে বললো না। এতে ঝামেলা সৃষ্টি হতে পারে তাই৷ রাত্রি বেশ লজ্জা পেলো সবার সামনে এভাবে বলায়।”

“আভা বলল, আবির ভাইয়া রাত চলোনা আমরা ঘুরে আসি৷ ”

“ইভা বলল, হ্যাঁ আমিও যাবো। রায়াফ ও লাফিয়ে উঠলো। ”

“আবিরের বাকি কাজিনরা বলল, তাদের কাল ক্লাস আছে ফুপি ফোন করে বলেছে তাই ওরাও চলে যাবে। ওরাও চলে গেলো বিদায় বাসায় এখন কেও নেই। তাই আবির রাত্রি রায়াফ ইভা রাত আভা মিলে ঘুড়তে চলে গেলো গাড়ি নিয়ে৷ তবে আজ ড্রাইভার সহ ফেমিলি গাড়ি নিয়ে বেড়িয়েছে। প্রাইভেট কার নেইনি। সামনে রায়াফ বসেছে আর গানের সাথে সাথে সিটে বসেই নাচছে৷ রাত্রি ইভা আবির মাঝ খানের সারিতে৷ আভা রাত পেছনের সারিতে৷ তারা একটা পার্কে গেলো আবিরিয়া ড্রিম হলি পার্ক। সারাদিন ঘুরে ফিরে বাসায় ফিরলো সবাই।”

“রাতের খাবার শেষে সবাই যে যার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো। কিন্তু আবিরের ঘুম আসছেনা তার তো এখন রাত্রিকে লাগবে৷ খুব যে ইচ্ছে করছে ওকে জড়িয়ে ধরতে। ”

“পাঠকমহল তো এখন ভাববে যে এতোদিন কেনো ইচ্ছে করেনি। হ্যাঁ এতোদিন করেনি কারন এতোদিন তো লুকুচুরি ছিলো কিন্তু আজ তো সব কিছু খোলাসা। তাই আর একা থাকা হয়ে উঠছেনা ”

“আবির রায়াফ কে ঘুম পাড়িয়ে রাত্রির রুমের দিকে গেলো। ডোর লক করা দেখলো। তাই আর বিরক্ত করেনি। কাল ও ঘুমাতে পারেনি বেচারি আজকে ঘুমাচ্ছে ঘুমাক বিরক্ত করা ঠিক হবেনা। কুল আবির তোকে এতো উত্তেজিত হলে চলবেনা৷ সামনে অনেক সময় আছে। এগুলো নিজেই নিজেকে বলে আবির রুমে গিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।”

“পরদিন আভা রাত রায়াফ ইভা রাত্রি তাদের বাসায় ফিরে এলো। ইভা আরও একদিন থেকে তার বাসায় চলে গেলো। ”

“তিনদিন পর রাত্রি কলেজে গেলো আগের মতোই রায়াফ আর রাত্রিকে রাত দিয়ে এসেছে৷ বিয়ে করে ফেলেছে বলে কোনো দিকেই তার দুই ভাই বোনের রুলস অমান্য করবেনা। রাত্রি রায়াফ যে রাতের শরীরের দুইটা অংশ। কলিজার টুকরা ভাই বোন ওরা। তাই তো ওদের এতো খেয়াল রাখে।”

“রেজাল্ট দিয়েছে রাত্রি সেকেন্ড ইয়ারে প্রমোশন পেয়েছে। আর ফয়সাল টেস্ট এ এলাও হয়েছে। কিন্তু ফয়সালের মুখে হাসি ছিলোনা। বিষন্নতার ছাপ ছিলো। রাত্রি একবার এগিয়ে গেলো ফয়সালের দিকে কিন্তু ফয়সাল রাত্রিকে এড়িয়ে চলে গেলো।”

“ক্যাম্পাসের সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে বসে রাত্রি ওইদিনের সব ঘটনা ইতিকে বলল। ”

“দেখেছিস আমার কথায় সত্যি হলো। আবির ভাইয়া তোকে পছন্দ করে আগেই বলেছিলাম কিন্তু তুই শুনিস নি। যাই হোক ফয়সাল ভাইয়ার কি করা যায়। ওই তো বেচারা খুবই কষ্ট পেয়েছে মনে হয় এখন কি করবি দুস্ত।”

“ইতু আমি কিছু বুঝতে পারছিনা কি করবো। কিন্তু আবির ভাইয়া যে এতোটা রাগি মানুষ ভাবতে পারিনি। কি মা’র ই না দিলো ভাই টাকে। তাও আমার জন্য। নিজেকে তো এখন অপরাধী মনে হচ্ছে রে। ”

“তোর তো দোষ নেই তাহলে এতো হাইপার হচ্ছিস কেনো। যা হবে ভালো হবে। আশা করি সমস্যা হবেনা কোনো রকম আবির ভাইয়া মানে হবু জিজু ঠিক সামাল দিয়ে দিবে। ”

“দাড়া তোর মজা করা বের করছি। বলেই রাত্রি আর ইতি ক্যাম্পাসে দৌড়াতে লাগলো।”

“উপর থেকে ফয়সাল এগুলো দেখছে আর আনমনে একটু হেসে বলছে, সরি স্বপ্নপরি তুমি না হয় আমার স্বপ্নের ভ্রম হয়েই থেকে গেলে। স্বপ্নেতেই না হয় তোমাকে ভালোবেসে যাবো। দেয়াল হয়ে দাড়াবোনা তোমার আর ভাইয়ার মাঝে। আমি যে সত্যি তোমাকে ভালোবাসি পারবোনা যে তোমাকে কষ্ট দিতে। তোমার চোখে যে আমি ভাইয়ার জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা দেখেছি সেটা তো মিথ্যে হতে পারেনা। অনেক দূরে চলে যাবো তোমাদের থেকে। আমাকে যে এখন অনেক লড়াই করতে হবে জীবনের সাথে। ভালো থেকো সব সময় তুমি দোয়া করি। এই অধম কে মনে রেখো এই টুকুই আশা করি। তারপর নিজের চোখের জল টা মুছে নিল বৃদ্ধাঙুল দিয়ে। তারপর ফয়সাল বাসায় না গিয়ে নদীর পারে চলে গেলো। এই সেই তিতাশ নদীর পার। যেখানে ফয়সাল সব সময় আসে। বসে বসে ভাবছে, একটা সময় স্বপ্ন বুনেছিলাম তোমাকে নিয়ে এই খানে আসবো সারাদিন তোমার কুলে মাথা রেখে শুয়ে থাকবো এই পাথর বিছানো ঘাসের উপর। কিন্তু আমার সব কিছু যে সাদা কালো হয়ে গেলো রাত্রি। আমার জীবন টা কি আদো রঙিন হবে। আমি খুঁজে পাবো তোমারই ন্যায় সত্তা। পাবো কি সেগুলো যে গুলো তোমার মাঝে পেয়েছি। আমি যে নিতে পারছিনা আর রাত্রি খুব কষ্ট হচ্ছে আমার খুব। ছেলেদের নাকি কান্না করা নিষেধ কিন্তু আমি তো পারছিনা আমার অশ্রুকণা গুলো সামলে রাখতে। এগুলো ভেবেই আরো কান্না করছে ফয়সাল।”

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে