বইছে আবার চৈতী হাওয়া
১০.
সকাল থেকে হালিমা বেগমের মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। এমনিতেই বাড়ির সমস্ত কাজ তাকে করতে হয়, বড় ভাবি পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকে তার উপর আজকে আবার এমন একটা ঘটনা ঘটালো। প্রাথমিকভাবে হালিমা ইচ্ছা করেই সব কাজের ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল। ভেবেছিল এতে করে সংসারের কর্তৃত্বটা তার হাতে থাকবে কিন্তু আদতে সেটা হয়নি। বড় ভাবি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে রেখেছেন। টাকার হিসাব থেকে শুরু করে বাজারের ফর্দ সবকিছুই তাঁর হাতে। এমনকি, কি রান্না হবে সেটাও তিনিই ঠিক করে দেন। আগে দুই জা ভাগাভাগি করে রান্না করতো। হালিমা ইচ্ছা করেই পুরো কাজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল যাতে করে পুরো দখলদারিটা তার হাতে থাকে। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি বরং কাজের চাপ বেড়েছে। আজকাল তো নিজেকে বাড়ির কাজের বুয়া মনে হয়। তবু দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছিল। শুধু এই ভেবে যে একদিন তো পুরো কর্তৃত্বটা তার মেয়ের হাতেই আসবে। সেদিন সে ও দেখিয়ে দেবে মাতব্বরি কাকে বলে। কিন্তু সকালে যে খবরটা পেল তাতে তার মাথা ঘুড়ে গেছে। বড় ভাবি নাকি সৌরভের বিয়ে ঠিক করেছেন। আজ সন্ধ্যায় পাত্রী দেখতে যাবেন। সকাল সকাল এসে দুপুরের রান্নার মেনু দিয়ে গেছেন আর সেইসঙ্গে সুসংবাদ ও শুনিয়ে গেছেন।
সুসংবাদ না ছাই। ইচ্ছা করছে চুলায় পানি ঢেলে দিতে। এর মধ্যে তার ছোট মেয়ে সুমনা এসে বলল
– মা, বড় চাচী চা দিতে বলেছে
হালিমার মাথায় মাথায় আগুন ধরে গেল। কোন মতে মেয়ের হাতে চা দিয়ে, কড়াই খুন্তি আছড়ে ফেলে জোরে জোরে বলল
-তোর চাচিকে গিয়ে বল আমার শরীর ভালো নেই। আজ রান্না হবে না
পাশের ঘর থেকে মীরার বড় চাচী সব শুনলেন মুখ বেঁকিয়ে বললেন
– কিসের এত পোরানী মনে হয় আমি বুঝিনা? নিজের মেয়েকে মৌচাকের মহারানী বানাতে চেয়েছিল, এখন চাকে ঢিল পড়েছে। খা মৌমাছির কামড়
হালিমা রেগে মেগে ঘরে গিয়ে মেয়েকে ফোন দিল। মায়ের ফোন পেয়ে মিরা বেশ অবাক হলো। সাধারণত এই সময় মা খুব ব্যস্ত থাকে। ফোন করলেও ধরতে পারেনা। ফোন ধরে বলল
– কেমন আছো মা?
হালিমা সে কথার জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল
– তুই সৌরভকে কি বলেছিস?
– আমি কি বলবো? আমার সঙ্গে তো কতদিন কথাই হয় না
– একটু কথা বললে কি এমন ক্ষতি হয়? এখন ভালো হয়েছে না? অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।
– ভাইয়ার বিয়ে নাকি? এটা তো ভাল খবর। মিরা আনন্দিত গলায় বলল। হালিমা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। চিৎকার করে বললো
– তাহলে তোর কি হবে?
-এর সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক?
রাগে হালিমর কথা বন্ধ হয়ে গেল। মিরা বার দুয়েক হ্যালো হ্যালো বলে বুঝলো মা ফোন রেখে দিয়েছে। আরেকবার ফোন দিতে আর সাহসে কুলালো না।সাতপাঁচ ভেবে মিরা সৌরভকে ফোন দিলো। দুটো রিং হতেই সৌরভ ফোন ধরে খুশি খুশি গলায় বলল
– কিরে মিরা, কি খবর তোর?
– ভালো। ভাইয়া তোমার নাকি বিয়ে? কিছু জানালে না যে? যাই হোক কংগ্রাচুলেশনস! আমি খুব খুশি হয়েছি।
-থ্যাঙ্ক ইউ তোকে কে বললো ?
– মা ফোন করেছিল
– আচ্ছা! তাই বল
– ভাইয়া একটা কথা বলবো?
– হ্যাঁ। বল না
– মা মনে হয় ঝামেলা করতে পারে
– আমারো তাই মনে হয়। দেখ মীরা, তুই তো জানিস তোকে আমি ছোটবেলা থেকে পছন্দ করতাম। তুই ঢাকা যাবার পর চাচিকে সে কথা বলেছিলাম ও। চাচি খুব খুশি হয়েছিল। বাবার সঙ্গে কথা বলেছিল এই বিষয়ে।
– বল কি? এত কিছু হয়েছে?
– হ্যাঁ। এজন্যই আমি যখন শুভর ব্যাপারটা জানতে পারি, আমার খুব রাগ হয়েছিল। শুধু রাগ না, এক ধরনের ভয় ও হয়েছিল। তুই যদি খারাপ কারো হাতে পরিস। কিন্তু শুভর ব্যাপারে খোঁজ আমি নিশ্চিন্ত হয়েছি। শুভ খুব ভালো ছেলে।
মিরা একটু লজ্জা পেল, তারপর বলল
– তুমি এত খোঁজ খবর নিয়ে ফেলেছ?
– নিব না কেন ? তুই আমাদের বাড়ির মেয়ে। তোর প্রতি আমাদের একটা দায়িত্ব আছে।
-বড় চাচা ও কি ঝামেলা করবে?
– জানি না। এটা নিয়ে আমি একটু টেনশনে আছি
– কিছু হবে না। চাচি সব ম্যানেজ করে নেবে। মেয়েটা কে ভাইয়া?
– ও রত্নার কথা বলছিস? ওকে তো তুই চিনিস মিজানের ছোট বোনে
– আচ্ছা আচ্ছা, স্কুলে আমাদের এক ব্যাচ জুনিয়ার ছিল। কি করে হল ভাইয়া?
– এই হয়ে গেল আর কি। তোর মতই
– খুব ভালো হয়েছে। আমি খুব খুশি হয়েছি
– শোন মিরা, বিয়ের সব দায়িত্ব কিন্তু তোর। সব কিন্তু তোকে করতে হবে
– সে তুমি না বললেও আমি করব। আমাকে জানিও কি হলো
– আচ্ছা, রাখছি এখন
মীরার মনটাই ভালো হয়ে গেল। অনেক রাত পর্যন্ত যখন সৌরভের কোন ফোন এলোনা , মিয়া ভাবলো হয়তো ফিরতে দেরি হচ্ছে। কিন্তু পরদিন সকালবেলা মায়ের কথা শুনে মিরার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। মা জানাল বড় চাচা ওই মেয়ের সঙ্গে বিয়েতে রাজি নন। তার ইচ্ছে মীরার সঙ্গে সৌরভের বিয়ে হোক। এই তারিখ মীরা বাড়ি এলে ওদের কাবিন করিয়ে ফেলা হবে। মীরা কি বলবে কিছুই বুঝতে পারলো না।
চলবে……
১১.
মায়ের সঙ্গে কথা বলে যতটা না মন খারাপ হয়েছিল শুভর সঙ্গে কথা বলে মীরার আরো বেশি মন খারাপ হয়ে গেল। শুভ ব্যাপারটাকে পাত্তাই দিল না। হাসতে হাঁসতে বলল
– ভালই তো। আমাকে ইনভাইট করো কিন্তু
মীরার ভীষণ কষ্ট হলো কথাটা শুনে। শুভ সব সময় ওকে, ওর ইচ্ছাকে এত হালকা ভাবে কেন নেয়? মীরা কথা বাড়ানো না। ইচ্ছে করে অন্য প্রসঙ্গে দু-একটা কথা বলে উঠে গেল। মন খারাপ নিয়েই বিকেলবেলা টিএসসি গেল।
বাকিরা এখনো এসে পৌঁছায়নি। আশিক একাই বসে ছিল ক্যাফেটেরিয়ায়। ওকে দেখে বলল
– বস মিরা। কিছু খাবে?
– না ভাইয়া
– চা খাও
– চা খাওয়া যায়
আশিক হাতের ইশারায় চা দিতে বলল। এখানে সবাই ওকে চেনে। মীরা ওর লিস্টটা বের করে আশিককে দেখাল। আশিক একবার চোখ বুলিয়ে নিল। বেশ গুছিয়ে লেখা।
– কোথা থেকে কিনবে?
– এলিফ্যান্ট রোড থেকে কিনলে দাম বেশি পরবে। নিউমার্কেট থেকে নিলে কিছুটা খরচ কম হবে।
আশিকের ভালো লাগলো।মেয়েটা বেশ হিসেবি। স্টেজ ডেকোরেশন পুরো টাকাটাই আশিকের পকেট থেকে যায়। আগেও তাই হত। তখনতো এর মধ্যে চা সিঙ্গারার টাকাও যোগ হত। কেউ কখনো টাকা বাঁচানোর কথা ভাবেনি।
আশিক এবার একটু অন্যরকমভাবে করতে চেয়েছিল। ভেবেছিল অন্যান্যবারের তুলনায় খরচ বেশি পড়বে। ডিপার্টমেন্ট থেকে শুধু স্টেজ বানানোর আর সাউন্ড সিস্টেমের টাকা দেয়া হয়েছে, তাও যেটা দিয়েছে তা দিয়ে মানসম্মত কোন সাউন্ড সিস্টেম পাওয়া যাবেনা। প্রতিবার সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা রাসেল করে। সেখানেও এক্সট্রা কিছু টাকা চলে যায়। আবৃত্তি উপস্থাপনা মধ্যে হঠাৎ করে শো শো শব্দ আশিকের ভীষণ অপছন্দ। কাজের শুরুতে ঘন্টাখানেক হ্যালো হ্যালো মাইক টেস্টিং ব্যাপারটা ও ওর অসহ্য লাগে। সাউন্ড সিস্টেমের লোককে নিয়ে রাসেলের এতক্ষণে চলে আসা উচিত। আশিক মোবাইল বের করে কল দিল। চা এসে গেছে। মীরা চায়ের কাপে চুমুক দিল। শীতের বিকেলে চা টা বেশ আরামদায়ক লাগছে।
রাসেল ফোনে জানিয়েছে ওর আসতে দেরি হবে। ট্রাফিক জ্যামে ফেঁসে আছে। শুভর ও আসার কথা ছিল। মীরার কেন যেন ফোন করতে ইচ্ছা করলো না। চা শেষ করে ও উঠে দাঁড়ালো।
– আমি তাহলে যাই
আশিক মীরার হাতে টাকা দিয়ে বললো
– চলো তোমাকে এগিয়ে দিই
তখনো বিকেলের আলো ফিকে হয়ে যায়নি, কিন্তু পশ্চিম আকাশে মেঘ জমেছে। কেমন মন খারাপ করা সন্ধ্যা। মীরা বললো
-আপনাকে আসতে হবে না। মেঘ করেছে, মনে হয় বৃষ্টি নামবে
– আমার রোদ বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যাস আছে
কিছুক্ষণ নীরবে হাঁটল দুজন। আশিক বলল
-তুমি কি কোন কারনে আপসেট মীরা?
মীরা একটু চমকালো, তবে মুখে বলল
– না তেমন কিছু না
ভেতরে ঢোকার আগে বলল
– এখনই বৃষ্টি নামবে। তাড়াতাড়ি চলে যান
আশিক একটু হাসলো, তারপর বললো
তুমি ভাবছ মেঘ করেছে
বৃষ্টি পড়বে অনেকক্ষণ
আসলে তো মেঘ করেনি
মন খারাপের বিজ্ঞাপন”
চলবে….