বইছে আবার চৈতী হাওয়া
দ্বিতীয় পর্ব
২
মীরা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ I শুভর কোন দেখা নেই I এরমধ্যে ফোন করেছে দুবার I শেষবার বলল দু মিনিটের মধ্যে আসছি I সেটারও মিনিট পাঁচেক হয়ে গেছে I মীরা ঘড়ি দেখল I নয়টা বেজে পাঁচ I বোধহয় বৃষ্টি হবে I কেমন ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে I শীতকালের বৃষ্টি ঠান্ডাটাকে আরও বাড়িয়ে দেয় I শীত করছে মীরার I আনমনে গায়ের ওড়নাটা একটু টেনে জড়িয়ে নিল I রাস্তা পার হলেই ওর হল I টিউশনি শেষ করে প্রতিদিন এখানে এসে দাঁড়ায় মীরা I শুভ লাইব্রেরী থেকে বের হলে একবার দেখা করে যে যার বাড়ি ফিরে যায় I এই নিয়মটা মীরাই করেছে I
গত এক বছর ধরে ওদের সম্পর্ক I শুভ মীরার দুই ব্যাচ সিনিয়ার I যদিও সম্পর্কের ব্যাপারে আগ্রহটা প্রথমে শুভর দিক থেকেই এসেছিল I তবু মীরার মনে হয় শুভ বোধ হয় ওর ব্যাপারে সিরিয়াস না I তা না হলে এত রাত করে এভাবে কাউকে দাড় করিয়ে রাখে ? হঠাৎ ভীষণ অভিমান হল মীরার I যখন মনে হল আর নয় ,এবার রাস্তা পার হয়ে চলে যাবে ,ঠিক তখনই দূর থেকে শুভকে আসতে দেখা গেল I কোন তাড়াহুড়া নেই , ধীরেসুস্থে ,পকেট হাত দিয়ে হেঁটে আসছে I সেটা দেখে রাগ আরো হল মীরার I এত দেরি করে এলো, কোথায় দৌড়াতে দৌড়াতে আসবে I এসে সরি বলবে I তা নয় হেলে দুলে আরাম করে আসছে মহারাজ I এবং সত্যি সত্যি আসার পর একবার সরি বললো না I বরং বলল
– কিছু খাবে ? ঠান্ডা পড়েছে I চলো কফি খাই I
– না আমি চলে যাব I
– তাহলে এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে রইলে কেন ?
– তোমাকে এটা দেবো বলে I
মিরা ওর ব্যাগের ভেতর থেকে একটা বই বের করে শুভর হাতে দিল I
-টিউশনির টাকা পেয়েছ ?
– হু
– কেন কিনলে আমার জন্য ? আমি তো তোমাকে কিছু দেইনা I
– তুমি দাও না সেটা তোমার ব্যাপার I আমার ভালো লাগে I
-তুমি জানো আমি বই পড়ার সময় পাইনা আজকাল I
– সব পড়তে হবে না I কয়েকটা পৃষ্ঠা আমি ভাজ করে দিয়েছি Iশুধু সেগুলো পড়লেই হবে I
– আচ্ছা পড়বো সময় পেলে I
– তাহলে আমি এখন যাই I
-আচ্ছা যাও I
আরেক দফা মন খারাপ হলো মীরার I শুভ একটুও জোর করল না I এমনকি রাস্তা পার করিয়ে দিতে চাইল না I কি ক্ষতি হতো ওর হাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে দিলে I আবার ফিরে আসতে হতো এদিকে I তাতে কি ? ভালবাসলে কি মানুষ এইটুকু করতে পারে না ? মীরার খুব ইচ্ছে করে শুভ খুব কেয়ার করুক I হলের গেটে পৌঁছে মিরা পেছন ফিরে তাকাল I ভেবেছিলো শুভ হয়তো ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে I কিন্তু না I ও হাঁটতে শুরু করেছে I আগের মত পকেটে হাত দিয়ে , মাথা নেড়ে নেড়ে হাঁটছে I সম্ভবত কানে হেডফোন গুঁজে দিয়েছে I মীরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হলের ভেতর ঢুকে পরল I
৩
ক্লাস সুদ্ধ সবাই হাততালি দিচ্ছে I ছেলেরা কেউ কেউ শিস বাজাচ্ছে I কেউবা ডেস্কে হাত দিয়ে শব্দ করছে I নুরুন্নাহার ম্যাডাম অগ্নিদৃষ্টিতে আশিকের দিকে তাকিয়ে আছেন I আচমকাই তিনি হুংকার দিয়ে উঠলেন
– সাইলেন্ট
হঠাৎ করেই ক্লাসরুমে পিনপতন নিরবতা নেমে এলো I আজও আশিকের ক্লাসে ঢুকতে দেরি হয়ে গেছিল I অনুমতি নিয়ে বসতে যাবে তার আগেই ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন
– সিডেটিভ হিপনোটিক এর পার্থক্য বল I
আশিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল I এমন নয় যে উত্তরটা ও জানে না কিন্তু আচমকা প্রশ্ন করায় সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল I হঠাৎই একটা কবিতার লাইন মনে পড়ে গেল I মনে পড়তেই ভীষণ হাসি পেল I ম্যাডাম থমথমে গলায় বললেন
– তুমি হাসছো কেন?
– ম্যাডাম একটা কবিতার লাইন মনে পড়ে গেল তাই I
– কবিতা ?!! হোয়াট ইজ দা রেলেভান্স ?
-না মানে ,আমি উত্তরটা জানি ,কিন্তু আপনি জিজ্ঞেস করায় ভুলে গেছি I এই আর কি I
– কি লাইন?
– জি?
– লাইনটা বল
– তুমি যখন প্রশ্ন করো
আমি করি অধিক ভুল ।
ক্লাসে হাসির গুঞ্জন উঠলো
– এই কবিতা তুমি পুরোটা জানো ?
– জি? জী ম্যাডাম I
– শোনাও দেখি I
আশিককে চুপ করে থাকতে দেখে ম্যাডাম আবার হুংকার দিলেন I আশিক শুরু করল এবং মিনিটখানেকের মধ্যেই ক্লাসের সবাই হাততালি দিয়ে শিস বাজানো শুরু করলো I কিন্তু ততক্ষণে আশিকের নেশা ধরে গেছে I ও বলেই যাচ্ছে
তুমি যখন প্রশ্ন করো
আমি কি তোমায় ভালোবাসি?
অন্ধকারে লুকিয়ে মুখ
আমি নিজের মনেই হাসি ।
উত্তরে কি বলবো বলো
বিশ্বকোষেও হয়তো নাই,
উথালপাথাল খুঁজে মরি
কোথায় যোগ্য শব্দ পাই ।
জানো কি এই প্রশ্নে তোমার
হঠাত্ থামে নদীর ধারা
আকাশখানি কালো করে
মেঘে ঢাকা সন্ধ্যাতারা ।
তার চেয়েও গভীর ঘন
লজ্জা ঢাকে আমার মুখ
পাইনে খুঁজে একটি কথাও
শঙ্কা ভয়ে কাঁপে বুক ।
এতোদিনেও বোঝেনি যে
আজ বোঝাবো কোন ভরসায়?
না বলা সেই ছোট্টো কথা
বলিনি কি কোনো ভাষায়?
বলিনি কি এই কথাটি
তোমার দিকে নীরব চেয়ে,
এই গান কি সারাজীবন
জীবন দিয়ে যাইনি গেয়ে?
সেই কথা তো জানে ভালো
শিশির ভেজা ভোরের ফুল
তুমি যখন প্রশ্ন করো
আমি করি অধিক ভুল ।
সবাই ভেবেছিল আজকে হয়তো প্রলয়ঙ্করী কিছু একটা হবে I কিন্তু প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নুরুন্নাহার ম্যাডাম যথাযথভাবেই ক্লাস শেষ করলেন I শুধু ক্লাস শেষে আশিককে দেখা করতে বললেন I পরবর্তীতে জানা গেল আশিককে একটা 5000 শব্দের অ্যাসাইনমেন্ট লিখে কালকে সকাল আটটার মধ্যেই উনার টেবিলে রাখতে বলেছেন I এসবে অবশ্য বিশেষ কিছু বদলাল না I শুধু তার পরদিন থেকে ম্যাডামের নাম শিশির ভেজা ভোরের ফুল হয়ে গেল I
৪.
অনেকক্ষণ ধরে রসিয়ে রসিয়ে আশিকের গল্পটা মীরাকে বলার পর ,মিরার দিকে তাকাল শুভ I ও ভেবেছিল মীরা হয়তো অনেক মজা পাবে I হাসবে খুব করে I কিন্তু ও হাসল না I কেমন গম্ভীর হয়ে গেল I তারপর আচমকাই প্রশ্ন করল
– তুমি কি আমাকে ভালোবাসো শুভ ?
– আমি তোমাকে কি গল্প শোনালাম আর তুমি কি প্রশ্ন করলে ?
– তোমার গল্প আমি শুনেছি I এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দাও I
– এ প্রশ্নটা কেন করলে ? তোমার মনে হয় আমি তোমাকে ভালোবাসি না ?
মীরা জবাব দিল না মন খারাপ করে বসে রইল I শুভ নরম গলায় বলল
– দেখো মীরা , আমি হয়তো অন্য ছেলেদের মত এত প্রেমের কথা বলতে পারিনা Iতারমানে এই নয় যে আমি তোমাকে ভালোবাসি না I আচ্ছা ঠিক আছে তোমাকে একটা জিনিস দেখাই তাহলেই তুমি বুঝতে পারবে I
– কি জিনিস ?
শুভর ব্যাগের ভেতর থেকে একটা ডাইরি বের করল I তারপর শেষ পাতা গুলো খুলে মীরার সামনে মেলে ধরে বললো
– এখানে আমি আগামী পাঁচ বছরের প্ল্যান করেছি I ঠিক আর দুই বছর পর আমরা বিয়ে করবো I আমার থিসিসটা শেষ হলেই I তারপর পিএইচডির জন্য বাইরে যাব I আমরা দুজন একসঙ্গে I তুমি তোমার গ্রাজুয়েশন ওখানেই শেষ করবে I
মীরা হতভম্ব হয়ে গেল Iএক দিকে ওর ভালো লাগছে যে শুভ বিয়ের কথা ভেবেছে I অন্যদিকে মনে হচ্ছে ও পুরো প্ল্যানটা করেছে নিজের কথা ভেবে I মীরা তো বাইরে যেতে চায় না I ও এখানে থেকে চাকরি করতে চায় I ওর ফ্যামিলিকে সাপোর্ট করতে চায় I একবার ও ওর সঙ্গে কথা না বলে এত প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে ফেলল I আর এখন বলছে এটা ভালোবাসার প্রমান I কি অদ্ভুত !
চলবে……….