#ফারাহ
#পর্ব:২
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৩,
“ধর তোর মা ফোন দিয়েছে। কথা বল।”
রাতের বেলা খাওয়া শেষে বাড়ির সামনের পুকুরপাড়ে বসেছিলো ফারাহ। সজীব এসে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে কথাটা বললো। ফারাহ বসা থাকা অবস্থাতেই একবার সজীবের দিকে তাকালো। তাকিয়ে বললো,
“কথা বলবোনা উনার সাথে। অন্তত আজকের দিনে নয়।”
সজীব ভ্রু কুচকালো। এই মেয়ে একদম অসহ্যকর। সে কানে ফোনটা ধরলো। ফোনের ওপাশে লাইনে থাকা তার ফুফু আছিয়া বেগমকে বলেন,
“ফুফু আপনার মেয়ে কথা বলবে না।”
আছিয়া বেগম এপাশ থেকে বললেন,
“আগামীকাল ওরে রাইখা যাইও বাবা।”
“আপনি আপনার পোলারে পাঠাইয়েন ফুফু। এখন ধানের কাম বাড়িতে। ধান লাগাচ্ছি কামলা নিয়া। কামলার সাথে থাকা লাগে।”
“আচ্ছা সম্ভব হয় পাঠাবোনে। না পারলে একটু দিয়া যাইও বাবা।”
আছিয়া বেগম কল কে’টে দেন। ফারাহ এবার উঠে দাড়ালো। সজীব ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে সবে। ফারাহ সজীবের হাত ধরে টান দেয়। সজীব আচমকা এমন হওয়ায় থমকে দাড়িয়ে পরে। মাথা ঘুরিয়ে একবার ফারাহকে আবার একবার হাত ধরে রাখা হাতের দিকে তাকায়। ফারাহ থমথমে স্বরে বলে,
“আপনি আমার মায়ের সাথে কথা বললেন কেনো?”
“আজব তো? আমার ফুফু হয়। কথা বললে কি দোষ?”
“আপনি জানেন না আমার মা-কে আমি সহ্য করতে পারিনা। বদ মহিলা। উনাকে কেনো বললেন আমায় নিয়ে যাওয়ার কথা? ”
“তো তোর বাড়িতে তুই ফিরবিনা?”
“ও বাড়িতে আমার ফিরতে ইচ্ছে করেনা সজীব ভাই। বাড়ির আনাচে কানাচে বুবুর সাথে কাটানো সময়ের স্মৃতি।”
সজীব নিরবে শ্বাস ফেলে। চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা ফের শ্বাস নেয়। এরপর বলে,
“যেটা যাওয়ার, সেটা শত চেষ্টা করলেও চলে যায় ফারাহ। তাকে যত্ন করে স্মৃতিতে আগলে না রেখে মুক্ত করে দে। ভালো লাগবে।”
“সেটা ভাবলেও আমার দম আটকে যায় সজীব ভাই। আমি পারিনা। আপনি একটু আমার আপাকে ফিরিয়ে এনে দেন না সজীব ভাই।”
সজীব এবার ঝাড়া দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয়। চটে গিয়ে ফারাহর গালে থাপ্পড় দিয়ে বসে। ফারাহ গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে সজীবের দিকে তাকিয়ে আছে। চাদের নির্মল আলোয় বিরক্তিত সজীবের চাহনী পর্যবেক্ষণ করছে ফারাহ। সজীব ফারাহর দিকে তাকায়। ঘন কালো পাপড়ির আবেশে টানা চক্ষুদ্বয়ে জলের আনাগোনা। সজীব কণ্ঠ খাদে নামিয়ে নরম সুরে বলে,
“এই যে থাপ্পড় টা দিলাম! এটার ঝটকা যদি মাথায় থাকে, জিদ থাকে! তবে নিজের ভালো বুঝে ফাতিহার কথা এতো ভাববি না। নিজেও ভালো থাকবি! আর বাকি মানুষগুলোকেও শান্তি দিবি। নিজের আত্মসম্মান যদি থাকে! এমন কোনো কাজ করবিনা যাতে ফের তোকে এই থাপ্পড় আমায় দিতে হয়। তুই আমার ফুফুর মেয়ে না হলে চড়িয়ে সিধে করে দিতাম ফাজিল মেয়ে। সবটা সময় বোনের জন্য শোক। বলি তোর যে একটা সুন্দর জীবন, ভালো ক্যারিয়ার আছে ভুলে বসেছিস? নাকি তোর অসহায় বাবার কথাটা মনে থাকে না? যিনি রোজ রোদে পুরে মানুষের কথা শুনে, কামলা দিয়ে তোদের পালতেছে! তার জীর্ণ শীর্ণ অসুস্থ শরীর আর মায়া ভরা মুখটার কথা মনে পরেনা? যখনই দেখি তখনই বোনের জন্য শোক তাপ পালন করছিস? যে গেছে, সে কি ফিরে আসবে? নাকি তোদেরও তার কাছে যেতে হবে? যাওয়ার দরকার পরলে বল? সাতার তো জানিস না! পুকুরে ধাক্কা দিই?”
ফারাহ পুরো নিস্তব্ধতায় মুড়িয়ে যায়। সজীবের বলা প্রতিটা কথা তার কানে ঝনঝনিয়ে বাজতে শুরু করে। সে সজীবকে পাশ কাটিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। এককাধে পরে থাকা ওরনাটা মাটিয়ে মেখে যাচ্ছে। সজীব পিছ থেকে তা দেখে চেচিয়ে বলে,
“ওরনা দিয়ে কি ঝাড়ু দিচ্ছিস? ওরনা বুকে রাখার জিনিস, মাটিতে রাখার না।”
ফারাহ কথাটা গায়ে মাখে না। হনহনিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে। সজীব কপাল চাপড়ে নিজে নিজে বলে,
“পাগল দেখেছি, এর মতো পাগল দুটো দেখিনি।”
৪,
সকালবেলায়, কলপাড়ে দাড়িয়ে ব্রাশ করছে ফারাহ। কলপারের গেট খোলাই আছে। ফারাহর বড়ো মামী সজীবের মা আজিমা বেগম মাছের পাতিল নিয়ে কলপারে ঢুকলেন। ফারাহকে দেখে বললেন,
“চট করে মুখটা ধুয়ে মুরগী, হাস, কবুতর গুলো ছেড়ে দে না মা! মাছ কুটতে গিয়ে দেরি হয়ে গেলো। কমালা হবে ১২টা। সজীব ভোরে উঠে আগে মাছ তুলে দিয়েছে পুকুর থেকে। একা কাটতে গিয়ে কোমড় শেষ রে মা। তোর নানীও বাতের ব্যথায় উঠতে পারেননি।”
“দিচ্ছি মামী।”
ফারাহ বললো, এরপর চট করে মুখ ধুয়ে চলে যায় বাড়ির সামনের উঠোনে। হাস, মুরগী, কবুতর ছেড়ে দিয়ে সে বারান্দার এক মাথায় ওদের জন্য রাখা খাবারের জার থেকে ধান বের করে উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে দেয়। সজীবের বোন সাইমা তখনই আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে মুখে ব্রাশ ঢুকিয়ে বাইরে আসে। ফারাহকে দেখে বলে,
“ফারাহ বুবু! এতো সকালে উঠে পরছো?”
“ঘুম ধরছিলো না ফজরের পর। সেজন্য উঠে নামাজ পরে একটু শুয়ে ছিলাম। ঘুমে চোখ লেগে আসলো, পরে আবার একটু সময় পরই ভেঙে গেলো। তুই এতো সকালে উঠলি কেন?”
“আমার যে সাড়ে ছ’টায় প্রাইভেট আছে! জানো না?”
“না, আর প্রাইভেটে আসি না। তাই জানিনা।”
“তুমি আর প্রাইভেট পড়বা না বুবু?”
“না রে বোন। প্রাইভেটের বেতন বাড়ছেনা? বাবা কুলিয়ে উঠতে পারেনা”
“আচ্ছা তুমি থাকো, আমি যাই।”
সাইমা চলে যায়। ফারাহ মনোযোগ দেয় কবুতরের দিকে। একসাথে অনেকগুলো কবুতর, ২২জোড়ার মতোন হবে। সে একমনে গুণে গুণে এটাই ভাবলো। হয়তো বেশি বা কমও হতে পারে। এক রকম দেখতে কতগুলো আছে! তখনই আবার উঠোনে আসে ফারাহর ছোটো মামী তহুরা বেগম। এসেই ফারাহকে দেখে বলেন,
“সকালে আমাদের ঘরে ভাত খাবি কিন্তু। তোর মামা বলে দিয়ে মাঠে গেছে।”
“আচ্ছা মামী৷”
ফারাহ মুচকি হেসে উত্তর দেয়। ফারাহর মামী পুকুরের দিকে কালি মাখানো পাতিলগুলো ধুতে চলে যায়। ফারাহর মামা দুইজন। সজীবের বাবা বড়ো, তিনি মা’রা গেছেন। যার ফলে পুরো সংসারের দায়িত্ব তার। অনার্স শেষবর্ষে পড়াশোনা করে সে। পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার রেখে যাওয়া জমিজমা আবাদ ফসল করে সংসার দেখছে। সজীবদের বাড়িটা এমন বারন্দার মাঝ বরাবর মণ(বাড়িতে ঢোকার সরু ছোটো রাস্তার মতো, শুদ্ধ ভাষায় কি বলে জানা নেই)। একপাশে বড়ো মামার তিনঘর এক সিরিয়ালে। ঘর একটাই, মাঝখানে সেপারেশন দেওয়া। অন্য পাশে ছোটো মামার একই রকম করে দেওয়া তিন ঘর। বাড়ির সামনে বড়ো বাংলা বারান্দা। তার সামনে বড়ো উঠোন। উঠোনের শেষ মাথায় পুকুর, যেখানে মাছ চাষ করা হয়েছে। সজীব সেখান থেকেই মাছ তুলে দিয়ে মাঠে চলে গেছে। পুকুরের উপরে মানুষের হাটার জন্য একটু রাস্তা রাখা হয়েছে। রাস্তার পশ্চিম পাশে আমগাছ, নারিকেল গাছ মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে। পুরো গ্রাম জুড়ে এখন আমন ধান বোনার ধুম। ফারাহর ছোটো মামার দুই ছেলে মেয়ে, তারা শহরের হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছে। বাড়িতে মানুষ বলতে, ফারাহর নানী, দুই মামী, এক মামা, আর সজীব,সাইমা। বাড়ির পাশে ফারাহ নানার বড়ো ভাইয়ের ছেলে মেয়েরা বাড়ি করেছে সেসবই তিন বাড়ি। উত্তর পাড়ার শেষ প্রান্তে তার নানীর বাড়ি বলে মানুষজনও কম। তার নানীর বাড়ির পর আর বাড়ি নেই। আবাদী জমির শুরু। সজীব সেই কাদায় হাত পা মাখিয়ে লুঙ্গি হাটুর উপর একভাবে পেচিয়ে বেধে দুহাতে ধানের চারার গোছা নিয়ে বাড়ি ফিরছে। সজীবকে এমন কাদায় মাখামাখি দেখে ফারাহর অনেক হাসি পায়। সে মুখে হাত দিয়ে হেসে ফেলে। সজীব উঠোনের একপাশে পেয়ারা গাছের গোড়ায় ধানের চারাগুলো রেখে ফারাহর দিকে তাকিয়ে হাসতে দেখে বলে,
“হাসছিস কেনো?”
ফারাহ হাসা বন্ধ করে দিয়ে বলে,
“কই হাসছি?”
“এখনি দেখলাম তুই হাসছিলি?”
“একদম আমার উপর মিথ্যা আরোপ করবেনা সজীব ভাই।”
“সজীব নাম ধরেই ভাই যখন বলবি! তোর আমায় ভাই বলারই দরকার নেই। ফাজিল মেয়ে।”
সজীব বাড়ির ভেতরে ঢুকে পরে। ফারাহ কোমড়ে হাত দিয়ে দাড়িয়ে পরে। ভাই বলে সম্মান দেয় এটাই বেশি! সেটা নিয়েও এই লোকের সমস্যা। ফারাহ তিড়িংবিড়িং করে হাত পা ছুড়ে বলে,
“ধুর ভাল্লাগে না। এর বউ যে হবে! তার কপালে খারাপি আছে। পচা লোক একটা। ”
“কার কথা বলছিস রে ফারাহ?”
ফারাহ বারান্দার দিকে তাকায়। আদিবা বেগম হাটুতে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে হেটে আসতে আসতে প্রশ্নটা করেন। ফারাহ বলে,
“কে আবার! তোমার গুণধর বড়ো নাতী।”
“তার বউ তুই হলে কেমন হয়?”
“এ্যহ?”
ফারাহ নানীর কথায় চমকে উঠে।
চলবে?