প্রেমোত্তাপ পর্ব-৩+৪

0
661

#প্রেমোত্তাপ

পর্বঃ ৩

আকাশে আলো আঁধারের মিশেলে মুগ্ধ একটা রঙ সৃষ্টি করেছে কারণ- সময়টা ঠিক সন্ধ্যা। সন্ধ্যাবেলা টা একেক জনের কাছে একেক ভাবে পরিচিত৷ কেউবা সন্ধ্যাকে মন খারাপের সাথে তুলনা করে, কেউবা বলে সন্ধ্যা হলো মুক্ত অনুভব করানোর সময়, সারাদিন ব্যস্ততা শেষে এই সন্ধ্যাবেলা মানুষকে এক আকাশ সমান বিরতি দেয়, কারো কাছে প্রেমের গদ্য হলো সন্ধ্যা, আকাশে যেন প্রেমিকার মুখ ভাসে। কিন্তু চাঁদনীর কাছে সন্ধ্যা মানেই কেবল বিষন্নতা। এই সময়টা তাকে মনে করিয়ে দেয়, সে একজন মানুষকে ভালোবেসে খুব বাজে ভাবে ঠকেছে। যে মানুষটার সাথে তার ঘর করার কথা ছিলো, সে মানুষটার সাথেই ঘর করছে অন্য কেউ। যে মানুষটা তাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখিয়েছে, সে মানুষটাই আজ নিজের ঘরে অন্য একটা বউ নিয়ে সুখে মেতে আছে। যাকে ছাড়া চাঁদনীর চলবেই না ভেবেছিলো, তাকে ছাড়াই চাঁদনী বেঁচে আছে। অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না!

চারদিকে সন্ধ্যা ঘন হয়ে আসছে। চাঁদনীর বিশাল রুমটা অন্ধকারে ডুবে আছে ঠিক চাঁদনীর মতন। এক ফোঁটা আলো নেই। চাঁদনী বালিশে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে আছে। অন্যান্য দিন সে এ সময়টা অফিসেই থাকে। একটা নামকরা প্রাইভেট অফিসেই উচ্চ পদে কর্মরত সে। পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর পরই সে চাকরিতে জয়েন করে। ভালো ছাত্রী বিধায় চাকরির এই মূল্যবান বাজারে চাকরি পেতে অসুবিধা হয় নি। তাছাড়া বাবা চাচার নাম ডাকও ভূমিকা পালন করেছে বলা যায়। আজ চাঁদনিী অফিস যায় নি। তার মায়ের জন্য ই যেতে পারে নি বলা যায়। আজকে তাদের বাড়ি মেহমান আসবে। শাহাদাৎ এবং তার নতুন বধূ সহ তাদের পরিবারের সবাইকে সওদাগর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে আজ। ব্যবসায়িক একটা ভালো সম্পর্ক আছে এই দুই পরিবারের ভিতরে, সেই সুবাদেই এই আয়োজন।

খুব বেশিক্ষণ চাঁদনীর শুয়ে থাকা হলো না। তার আগের তার মা রোজা সওদাগর ব্যস্ত পায়ে ছুটে এলেন মেয়ের ঘরে। পুরো ঘর আঁধার দেখে খানিকটা চেঁচিয়ে বললেন,
“কী ব্যাপার চাঁদ? তুই ঘরের লাইট জ্বালাস নি কেন?”

চাঁদনী উত্তর দিলো না। তা দেখে ভদ্র মহিলা আরেকটু বিরক্ত হলো। আঁধার হাতড়ে সুইচ বোর্ড খুঁজে বের করে পুরো ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলেন। ঘর, ঘরের সাথে লাগোয়ক বারান্দা এমনকি বিছানার সাইটের ছোটো লাইট অব্দি জ্বালিয়ে দিলেন। এতক্ষণ অন্ধকারে ছিলো বিধায় হঠাৎ আলোটা চাঁদনীর চোখে গিয়ে বিঁধলো। সে বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“মা, জ্বালাচ্ছো কেন?”

“আমি জ্বালাচ্ছি? হ্যাঁ, আমি জ্বালাচ্ছি। তোরা আমার র ক্ত মাংস চিবিয়ে খাচ্ছিস না? তোদের সংসারে পরে আমার জীবনটা শেষ।”

“উফ্ মা, বিরক্ত করো না।”

মেয়ের মনের অবস্থা বুঝলেন না রোজা সওদাগর বরং কিছুটা চেঁচিয়েই বলে উঠলেন,
“তোরে কে বিরক্ত করছে? বিয়ের বয়সী একটা মেয়ে এখনো বাপের ঘাড়ে বসে আছে, কেউ কিছু বলে না তাই মাথা কিনে নিয়েছিস। আমি বলি তাই আমাকে সহ্য হয় না, তাই না।”

চাঁদনী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। গত কয়েকটা দিন যাবত হাসিখুশি মেয়েটা নেতিয়ে গিয়েছে, চোখের নিচে পড়েছে কালো প্রলেপ। হাঁটুর বয়সী মেয়েটা বুঝতে পারছে তার আপা ভালো নেই অথচ তার মা! তার মা কি সুন্দর আরও ভেঙে দিলো! বাবা-মা গুলো মাঝে মাঝে এতটা অবুঝ হয় কেন? তারা একটু সন্তানকে সঠিক সময় বুঝলে খুব কী ক্ষতি হয়ে যেতো? চাঁদনী খুব শক্তপোক্ত মেয়ে কিন্তু তার মায়ের আচরণ তাকে ভেতর থেকে ভেঙে দিয়েছে। মুহূর্তেই তার শুকনো চৌচির হয়ে থাক চোখ গুলো অশ্রুতে টলমল করে উঠলো। অথচ রোজা সওদাগর নিজের মতন কথা শুনিয়ে যাচ্ছেন আর পড়ার টেবিল টা গোছাচ্ছেন। মায়ের এত হৈচৈ, চিৎকার চেঁচামেচির মাঝেই চাঁদনী কোমল, অসহায় কণ্ঠে বললো,
“আমি কী তোমাদের বোঝা হয়ে গেছি, আম্মু? আমাকে কী আর বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে না?”

রোজা সওদাগর থেমে গেলেন। আড়চোখে তাকালেন মেয়ের দিকে। মায়ের কঠিন মন বোধহয় কিছুটা নরম হলো। সে আর চেঁচামেচি করলেন না তবে ধীর কণ্ঠে বললেন,
“আমাদের তুই ই একটা সন্তান। আমাদের কী ইচ্ছে করে না তোকে বিয়ে দিবো, তোর সংসার দেখবো। তোর সুখ দেখবো।”

“বিয়ে করলেই সবাই সুখী হয় আম্মু? কই, ছোটোমা তো বিয়ে করলো চাচ্চুকে, তাকে তো সুখী হতে দেখলাম না।”

“চাঁদ, মুখ সামলে কথা বল। বে য়া দব হয়ে যাচ্ছিস দিন দিন।”

চাঁদনী হাসলো কিন্তু উত্তর দিলো না। রোজা সওদাগর বাহিরে যেতে যেতে তাড়া দিয়ে বললেন,
“এসব জামাকাপড় বদলে শাড়ি পড়। মেহমান আসবে, সেখানে একটা মানানসই পোশাক দরকার। তোর বয়সী ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে। আর তুই ঘরে পড়ে পড়ে কেবল বেয়াদবী করে যা। আর কী করবি।”

কথা শেষ করেই রোজা সওদাগর আবার চঞ্চল পায়ে চলে গেলেন। চাঁদনী তার মায়ের যাওয়ার পানে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো। মুখে ফুটে আছে চরম তাচ্ছিল্যের হাসি। ভিতর থেকে অন্তর আত্মা হয়তো চিৎকার দিয়ে বলছে,
“আমায় একটু বুঝলে না কেন, আম্মু। আমায় একটু বাঁচতে দিচ্ছো না কেন। আমার যে বাঁচতে ইচ্ছে করছে, আমায় সাহায্য করো তোমরা। আর ভেঙে দিও না।”

কিন্তু মেয়ের আর্তনাদ মা অব্দি পৌঁছালো না। হয়তো ‘কুড়িতে বুড়ি’ প্রবাদ বাক্য বিশ্বাস করা সমাজ কুড়ির পর আর মেয়েদের মন বলতে কিছু থাকে তা ভুলে যায়। মেয়ে তখন অযত্নের এক শোপিস হয়ে ঘরের কোণায় পড়ে থাকে। যে শোপিসের কোনো দরকার নেই অথচ বাবা-মা দয়া করে পালেন।

_

চিত্রা আর বনফুল চিত্রার রুমে বসে আছে। বাহিরে তখন অতিথি গমগম করছে। চিত্রা তার প্রিয় বান্ধবী ছাড়া বাড়ির একটা অনুষ্ঠানেও থাকে না। বনফুলকে তার চাই ই চাই। অন্যান্য দিন হলে চিত্রার মনে উচ্ছ্বাস থাকতো। মেহমান এসেছে আর পড়া লাগবে না, সে ভেবে খুশি থাকতো কিন্তু আজ ব্যাপারটা উল্টো। আজ তার মেহমানের সামনে যেতে মন চাচ্ছে না। শাহাদাৎ লোকটাকে তার দু-চোখে সহ্য হচ্ছে না। এত বিরক্তিকর মানুষ তার জীবনে আর একটাও দেখে নি সে।

অন্যদিকে বনফুল মেয়েটা আজ চঞ্চল পায়ে এধার ওধার হাঁটাহাঁটি করছে। মেয়েটা চিত্রার মতন তত চঞ্চল না। কিছুটা সহজ সরল আর বোকা বোকা ধরণের। শরীরের রঙটা একটু চাপা, রোগা-সোগা শরীর, কোঁকড়া চুল কিছুটা ভাইয়ের মতনই। কিন্তু বাহার ভাই আর বনফুলের চেহারায় কোনো মিল নেই, এমনকি বাহার ভাইয়ের সাথে তার মায়ের চেহারারও মিল নেই না আচরণের মিল আছে, একদম বিপরীত ধর্মী সে। সে রাগী, গম্ভীর অথচ বনফুল কখনো রাগ করে না, অভিমান করে না। চিত্রাই যেন তার সর্বেসর্বা। কিন্তু আজ মেয়েটা একটু উত্তেজিত, কিছু একটা কারণে প্রচন্ড উতলা হয়ে আছে। চিত্রা হয়তো জানে সে কারণ। তাই তো মিটমিটিয়ে হাসছে।

বনফুল বোকা বোকা চোখে তাকালো চিত্রার দিকে। কপাল কুঁচকে বললো,
“কিরে চিতাবাঘ, হাসছিন কেন?”

চিত্রা গলা পরিষ্কার করার মতন শব্দ করলো। কিছুটা গম্ভীর গম্ভীর ভাব ধরে বললো,
“বনফুল, একটা কাজ করে দিবি আমার?”

“কি কাজ বল, আমি এখনই করে দিবো। ঘর ঝাড়ু দিবো?”

বনফুলের কথায় চিত্রা নিজেই নিজের কপালে চাপড় মারলো। দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“ধরে থাব্রা দিবো তোরে। ঘরের কাজ করতে আসিস নাকি এখানে। তোর কাজ হলো তুহিন ভাইয়ের ঘরে যাওয়া।”

তুহিন নামটা শুনতেই বনফুলের কোমল চিত্ত চঞ্চল হয়ে গেলো। হৃদপিণ্ড আকস্মিক তার কম্পন বাড়িয়ে দিলো। মেয়েটার কাঁপা কাঁপিও শুরু হলো। আমতা-আমতা করে বললো,
“কেন, কেন?”

“ভাইয়া মাত্র অফিস থেকে এসেছে হয়তো, গিয়ে বলবি আমার ঘরে আসতে। আমরা সবাই মিলে আড্ডা দিবো। যা।”

বনফুল ভীতু ভীতু কণ্ঠে বললো, “তুই, তুই যা চিতাবাঘ। আমি যাবো না।”

“কী? তুই এই আমাকে ভালোবাসিস? এত ছোটো একটা কাজও করে দিতে পারবি না?”

বোকা মেয়েটা চিত্রার কৌশল বুঝলো না। বান্ধবী কষ্ট পেয়েছে ভেবে সে তৎক্ষনাৎ বললো,
“রাগ করিস না চিতাবাঘ। আমি যাচ্ছি এক্ষুনি। তবুও তুই রাগিস না।”

“হু, যা।”

চিত্রা খুব কষ্টে নিজের হাসি চেপেই গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো। বনফুলও ছুটে গেলো সাথে সাথে। বনফুল বেরিয়ে যেতেই চিত্রা হেসে উঠলো। মেয়েটা যে কেন এত ভয় পায় তার ভাইকে সে বুঝে উঠে না। আবার এই ভাইয়ের জন্য ই রাত সাতটা বাজে জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। কখন তুহিন নামক লোকটা আসবে আর বনফুল তা দেখে চোখ জুড়াবে।

চিত্রার ভাবনার মাঝেই হৈ হৈ করে ঘরে প্রবেশ করলো মৃন্ময়, তার পিছে পিছে চাঁদনী ও অহিও হাজির হলো। চিত্রা হা হয়ে মৃন্ময়ের দিকে তাকাতেই ছেলেটা মিষ্টি হাসি দিলো। মিষ্টি করে বললো,
“ওহে প্রিয় চিতই পিঠা, তোমারে না দেখিতে পাইয়া মোর মন আনচান আনচান করছিলো। তাই তোমার বোনদের সহিত চলে এলাম তোমাকে দেখতে।”

চিত্রাও মৃন্ময়ের মতন ভঙ্গিমা করে বললো,
“ওহে আমার মৃগী রোগী ওরফে মৃন্ময় ভাইয়া, তোমায় দেখিয়া মোর হৃদয় ছলাৎ করিয়া উঠিলো।”

দু’জনই দু’জনের অদ্ভুত কথা বলে হেসে উঠলো। চাঁদনীও কিঞ্চিৎ হাসলো। কেবল মুখ গোমড়া করে চিত্রার পড়ার টেবিলের সাথে থাকা চেয়ারে এসে বসলো অহি৷ কিছুটা বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“এই মৃন্ময় ভাইয়া টা আমারে একটু পড়তে দিলো না। চেরি কে দিয়ে এমন তাড়া পাঠালো, আমি তো ভাবলাম কি না কি যেন বলবে।”

“বিদ্যাসাগরের জুতা, অহি বেগম, এত পড়ে আপনি কী বিদ্যাড্রেন হতে চান?”

মৃন্ময়ের কথায় হেসে দিলো চিত্রা ও চাঁদনী। অহি মুখ ফুলিয়ে ফেললো তা দেখে। চিত্রা এবার চাঁদনী আপার দিকে তাকালো, মানুষটা কী সুন্দর সাদা শাড়ি পড়েছে! কোনো প্রসাধনী ব্যবহার করা ছাড়াও মেয়েটা কী সুন্দর চাঁদের ন্যায় জ্বলজ্বল করছে। অথচ এমন একটা মেয়েকেই ফিরিয়ে দিয়েছে কোনো পুরুষ! কী বোকা সে!

তন্মধ্যেই তাদের ঘরে উপস্থিত হলো শাহাদাৎ এবং তার নতুন বউ। রোজা সওদাগরই নিয়ে এসেছেন তাদের। এসেই ধমকে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
“ওরা ওখানে একা বসে আছে আর তোরা আড্ডা দিচ্ছিস। ওদের ডাকবি না।”

অতঃপর শাহাদাৎ এর দিকে তাকিয়ে গদোগদো কণ্ঠে বললো,
“বাবা, আম্মু তোমরা বসো এখানে। ওদের সাথে আড্ডা দেও। আমি শরবত পাঠাচ্ছি।”

মহিলা আবার ব্যস্ত পায়ে চলে গেলো সেখান থেকে। চাঁদনী ছোটো একটা হতাশার শ্বাস ফেললো। তার মা না জেনেই তার ভেতর কেমন ক্ষত করে ফেলছে!

মৃন্ময় ছুটে গেলো নতুন বউয়ের দিকে। উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো,
“এটা আমাদের ঘরের বউ। কিউট না? ও নিলা, সবে এসএসসি দিয়েছে। আমার অনেক ছোটো অবশ্য। তবে বেশ আদুরে তাই না?”

অহি মাথা দুলালো কিন্তু চিত্রা দাঁড়িয়ে রইলো শক্ত মুখে। চাঁদনী খাটে বসে ছিলো, মিষ্টি হেসে মৃন্ময়ের উত্তরে বললো,
“হ্যাঁ ভীষণ সুন্দর। নাহয় আমিও তো বলি, তোমার ভাই এমন পাগল হলো কেন। বিদেশ থেকে এসে এক সপ্তাহেই বিয়ে করে নিলো। অল্প বয়সী পুতুল বউ।”

চাঁদনীর কথায় শাহাদাৎ মাথা নিচু করে রাখলেও নিলা মেয়েটা সুন্দর এক হাসি উপহার দিলো। মৃন্ময় মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,
“ভাইয়ার ছোটো বউ ভাল্লাগে আর আমার সিনিয়র বউ। কেমন একটা এডভেঞ্চার ভাব থাকে।”

“তোমার কপালে বউ জুটলে তো!”

কথাটা বলেই চিত্রা ভেংচি কাটলো। চাঁদনী সে দিকে ধ্যান না দিয়ে তাকিয়ে রইলো নিলার দিকে। অল্প বয়সী একটা মেয়ে। সদ্য ফোটা পুষ্পের ন্যায়। সেজন্যই তো প্রেমিক পুরুষ পথ ভুলেছে, প্রেম ভুলেছে সাথে ভুলেছে প্রেমিকা। চাঁদনীর সাথে শাহাদাৎ এর যখন প্রেম শুরু হয় তখন চাঁদনীও সদ্য যুবতী। নিলার চেয়েও বোধহয় সুন্দর তার রূপ। শাহাদাৎ এর সাথে এক ক্লাসে পড়তো। শাহাদাৎ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতো। এরপর সেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকা ছেলেটার প্রেমে যে সে পড়লো, দুনিয়ার আর কোনো ছেলেকে আর ভালো ই লাগলো না। অথচ সেই রূপ আজ কিছুটা চাপা পড়েছে, তাই প্রেমিকের প্রেমও হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কিন্তু বয়সের এই সরল নামতা যেই প্রেমিকের জন্য পাড় করলো, সেই প্রেমিকই আজ বয়সের দোহাই দিয়ে ছেড়ে গেছে। আহা প্রেমিক, আহা জীবন!

চাঁদনীর ভাবনা ভাঙলো মৃন্ময় আর চিত্রার তুমুল ঝগড়ায়। এটা নতুন কিছু না। ছেলেটা সবার সাথেই এমন লেগে থাকে। চাঁদনী বসা থেকে উঠে এসে নিলার হাত ধরলো, মিষ্টি হেসে বললো,
“এসে নিলা, বসবে এসো।”

“এ মা, না না আপু, আপনি বসুন। এটা আপনার স্থান তো।”

“সব জায়গা কী সবসময় সবার থাকে? কখনো কখনো কিছু জায়গা ছেড়ে দিতে হয় নতুনদের জন্য।”

নিলার কথার বিপরীতে বাহার তার গম্ভীর কণ্ঠে কথাটা বলতে বলতেই ঘরে প্রবেশ করলো।

_

সওদাগর বাড়ির সবচেয়ে দক্ষিণ দিকের রুমটায় নীল রঙের নিভু নিভু একটা বাতি জ্বলছে। লো ভলিউমে রবীন্দ্র সংগীত ‘আমারও পরানে যাহা চায়’ বাজছে। ফ্যানের নিঃশব্দ বাতাসে উড়ছে ঘরের পর্দা গুলো। বাথরুম থেকে ভেসে আসছে পানির শব্দ। আর ঘরে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে বনফুল। এটা বাড়ির বড়ো ছেলে তুহিনের রুম। সবচেয়ে ভদ্র ছেলে সে। অথচ তাকে দেখলেই বুক কাঁপে বনফুলের। কেন কাঁপে সে জানেনা। হৃদপিণ্ড টা তার কম্পন বাড়িয়ে দেয়। মনে হয় এই বুঝি শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। এ কেমন মরণ মরণ অসুখ! তবে বনফুল এই মরণ মরণ অসুখটা ভালোবাসে। লোকটা যে তার ভীষণ প্রিয়!

বনফুলের ভাবনার মাঝে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো তুহিন। ভিজে শরীরে সাদা একটা পাঞ্জাবি পড়া। লাল হয়ে আছে নাকটা। মাথা থেকে শিশির বিন্দুর ন্যায় জলের ফোঁটা পড়ছে।

বনফুলকে নিজের ঘরে দেখে হাসলো তুহিন। মিষ্টি কণ্ঠে শুধালো,
“আরে বনফুল যে! তা এ ঘরে যে? কোনো দরকার?”

মেয়েটা মাথা তুলে তাকালো না। মেঝেতে দৃষ্টি রেখেই বললো,
“তোমাকে চিতাবাঘ ডাকছে। সবাই একসাথে আড্ডা দিবে।”

“ও তাই নাকি! আচ্ছা যাচ্ছি। তা তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?”

“ভা, ভালো ভাইয়া।”

বনফুলের কথায় হাসলো তুহিন। ঠাট্টা করে বললো, “হ্যাঁ আমি তো ভালো জানি, পড়াশোনাটা কেমন চলছে!”

বনফুল অস্বস্তিতে আরেকটু মাথা নত করলো। তা দেখে তুহিন হো হো করে হেসে উঠলো। লোকটা হাসলে কতো সুন্দর লাগে! কিন্তু এই মুগ্ধতা বেশিক্ষণ টিকলো না। চিত্রার রুম থেকে কেমন ধমক ভেসে এলো। বনফুল আর তুহিন দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে দ্রুত ছুটে গেলো চিত্রার রুমের দিকে। চিত্রার রুমের দরজায় গিয়ে তুহিনের চক্ষু চড়কগাছ। চিত্রা গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সামনে দেয়াল হিসেবে বাহার দাঁড়িয়ে আছে।

#চলবে

মম সাহা

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

পর্বঃ ৪

হৈচৈ এ পরিপূর্ণ রুমটা মুহূর্তেই নিশ্চুপতায় মগ্ন হলো। টিক টিক করে ঘড়ির কাঁটা শব্দ করে জানান দিলো সময় অতিবাহিত হওয়ার গল্প। বাহার দাঁড়িয়ে আছে রণমুর্তি ধারন করা একজন মানুষের সামনে, চিত্রা তার পিছনেই গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার গাল লাল হয়ে আছে, চোখে অশ্রুদের মাখামাখি। মৃন্ময় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বলে উঠলো,
“আঙ্কেল, ও মজা করছিলো। চ ড় দেওয়ার মতন,,,,”

মৃন্ময়ের কথা শেষ করার আগেই শক্ত পুরুষ মূর্তি টা থামিয়ে দিলো তাকে। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন
“শাক দিয়ে মাছ ঢাকার দরকার নেই, মৃন্ময়। আমি নিজের চোখে দেখেছি সবটা।”

নুরুল সওদাগরের রাগী কণ্ঠ পরিস্থিতি আরও বিপরীতে নিয়ে গেলেও উপস্থিত একজনের মুখে হাসি ফুঁটে রইলো। অগোছালো সেই লোকটা হাসে কম আর যতটুকু হাসে তা ভুল জায়গায় তবে সঠিক হাসি। এখনও তাই হলো। হাসতে হাসতে সে কিছুটা হেয়ালি করে বললো,
“সমস্যা টা তো এখানেই, স্যার। আপনারা নিজের চোখে যা দেখেন তা দেখেই বিচার করতে উঠে পড়ে লেগে যান। চোখের আড়ালেও যে গল্প থাকে, সেটা আর জানার কিংবা বোঝার চেষ্টা করেন না।”

নুরুল সওদাগর বোধহয় আরেকটু রাগলেন। রুক্ষ কণ্ঠে বললেন,
“তোমাকে নাক গলাতে বলা হয় নি এখানে। সো শাট আপ।”

“আচ্ছা! আপনার কী মনে হয়, মানুষ কিছু করতে বলবে এরপর আমি সেটা করবো!”

নুরুল সওদাগর আরেকটু রাগলেন। হাত বাড়িয়ে বাহারের পেছনে লুকিয়ে থাকা চিত্রাকে ধরতে নিলেই হাত টা ধরে ফেললো বাহার। বেশ গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বললো,
“আহা স্যার, এত নিজের মন মতন নাচবেন না তো। আপনার অনেক ক্ষমতা আছে বুঝলাম কিন্তু বাহার যেখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে ক্ষমতা দেখানো নেহাৎ ই বোকামি।”

“ক্ষমতা দেখাবো আমি। কী করবে তুমি? কী করবে হ্যাঁ?”

কথাটা বলেই বাহারের দিকে তেড়ে গেলেন নুরুল সওদাগর কিন্তু বেশি কিছু করতে পারলেন না, তার আগেই তুহিন এসে পড়লো। বেশ শান্ত কণ্ঠে বাবার উদ্দেশ্যে বললো,
“আপনি সিনক্রিয়েট করতে ভালো জানেন সেটা আমাদের জানা আছে কিন্তু তাই বলে বাহিরের মানুষের সামনে ঘরের মেয়েকে অপমান করার কোনো অধিকার আপনার নেই।”

নুরুল সওদাগর কিছুটা দমে গেলেন ছেলেকে দেখে। কিন্তু পুরোপুরি থেমে গেলেন না। সে কড়া চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছেলেকে বিশ্লেষণ করে বললেন,
“তোমার বোন কী করেছে জানো? আমি দরজার সামনে এসে শুনি সে হিংস্র চোখে শাহাদাৎ এর দিকে তাকিয়ে মৃন্ময়কে বলছে, এমন ব্রিলিয়ান্টের ধার নাকি সে ধারে না। শাহাদাৎ নাকি মানুষ ভালো না। বাড়িতে ডেকে এনে মেহমানকে অপমান করার শিক্ষা কোথা থেকে পেলো সে?”

বাবার কথায় ভ্রু কুঁচকালো তুহিন। বোনের দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক কণ্ঠেই বললো,
“আমার চিতাবাঘ, তুই তো এসব এমনি এমনি বলার মেয়ে না। কী জন্য বলেছিস এমন?”

“তুহিন, তুমি আশকারা দিচ্ছো ওকে। ঘরের মানুষ, বাহিরের মানুষ সবাই মিলে আমাকে অপদস্ত করার খেলায় মেতেছো দেখি!”

বাবার ভরাট কণ্ঠের বিপরীতে তুহিন তীক্ষ্ণ স্বরে জবাব দিলো, “যে নিজে যেচে অপদস্ত হতে চায়, তাকে তো সেটাই করা হবে। অহি, বল তো কী হয়েছে এখানে।”

শেষের কথাটা তুহিন অহির দিকে তাকিয়ে বললো। অহি ভীতু ভীতু চোখে একবার নুরুল সওদাগরের দিকে তাকালো অতঃপর ঢোক গিলে বলতে লাগলো,
“সবাই ই কথা বলছিল। বাহার ভাই ও এসেছিলেন চিত্রাকে পড়াতে। এর মাঝেই চাঁদ আপা নিলা ভাবীকে বললো ‘নিলা, তোমার শাড়িটা তো বেশ সুন্দর। লাল টকটকে। নতুন বিয়ে হয়েছে, শাড়ি দেখলেই বোঝা যাবে।’ তখন মৃন্ময় ভাইয়া ফোড়ন কেটে আপাকে বললেন, ‘ওর না-হয় নতুন বিয়ে হয়েছে বলে লাল শাড়ি পড়েছে তা আপনার কী জামাই মারা গেছে যে সাদা ধবধবে একটা শাড়ি পড়ছেন বুড়িদের মতন।’ বাহার ভাই আবার মৃন্ময় ভাইয়ার কথার পিঠে বলেছেন ‘হ্যাঁ স্বামী মারা গেছে বলেই পড়েছে। কোথায় সৃষ্টি তো কোথাও ধ্বংস। কারো গায়ে সৃষ্টির মেলা কারো বা ধ্বংসের খেলা।’ এরপর আরেকটু কথা কাটাকাটি হয় মজার ছলেই তখন চিত্রা রেগে গিয়ে মৃন্ময় ভাইয়াকে বলে, ‘শাহাদাৎ ভাইয়ার কোনো যোগ্যতা নেই ভালো মানুষ হওয়ার। আপার সাথে তার তুলনা চলে না। এমন ব্রিলিয়ান্টের কেথায় আগুন যদি সে মানুষই না হতে পারে।’ আরও অনেক কিছু বলে। এর মাঝেই মেঝো বাবা এসে পড়ে এবং চিত্রাকে ধরে চ ড় মেরে বসে।”

তুহিন চুপ করে একবার চিত্রাকে পর্যবেক্ষণ করলো। মেয়েটা লজ্জায়, অপমানে যে একবারে মূর্ছা গেছে তা বুঝাই যাচ্ছে। তার আরেকটু দূরে চাঁদনী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। মৃন্ময়েরও মাথা নত করা। সাথে শাহাদাৎ আর নিলাও স্তব্ধ। তুহিন সবসময়ই বুদ্ধিমান ছেলে। বাবার এমন বিবেকহীন কাজটা তার ভীষণ অপছন্দ হলেও সে আর কথা বাড়ালো না বরং বেশ গম্ভীর কণ্ঠে শাহাদাৎ এর উদ্দেশ্যে বললো,
“শাহাদাৎ ভাইয়া আর ভাবী, কিছু মনে করবেন না। আমার পরিবারিক সমস্যার জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী।”

অতঃপর সে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“কিছু মনে করবেন না আব্বু, আপনার আচরণ দিন দিন বাজে হচ্ছে। নিজেকে সুস্থ করুন। আর বাহার ভাই, আব্বুর হয়ে ক্ষমা চাচ্ছি আমি। আমার বোনকে রক্ষা করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।”

বাহারের ঠোঁটে তখনও বাকি হাসি। শার্টের কলারটা সে পিছে ঠেলতে ঠেলতে বললো,
“মনুষ্যত্ব ছাড়া নাকি মানুষ হওয়া যায় না, স্যার? অথচ আপনাকেও নাকি লোকে মানুষ বলে! হাস্যকর। শালা, পৃথিবীতে সব এতো হাস্যকর ক্যান? টাকাই সব, টাকাই রব।”

বাহার আর দাঁড়ালো না। অলস পায়ে ঘরে এলেও বেরিয়ে যাওয়ার সময় ছিলো তার রাজ্যের ব্যস্ততা। ভাব এমন, কোনো একটা রাজ কার্য করতে যেন যাচ্ছে। নুরুল সওদাগর সেখানে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে ছোটো কণ্ঠে বললেন, “বেয়াদব ছেলে” অতঃপর বেরিয়ে গেলেন সেও। তুহিন, শাহাদাৎ আর নিলাকে নিয়ে গেলো। অহিও দ্রুত রুম ত্যাগ করলো। পুরো রুমে দাঁড়িয়ে রইলো চিত্রা, মৃন্ময়, বনফুল আর চাঁদনী। মৃন্ময় আমতা-আমতা করে চিত্রাকে বললো,
“আমার চিতই পিঠা, রাগ করো না।”

চিত্রা অগ্নি দৃষ্টি ফেলে তৎক্ষণাৎ রুম ছাড়লো। মৃন্ময়কে আর কিছু বলার সুযোগও দিলো না। চিত্রার পেছন পেছন বনফুলও চলে গেলো। চাঁদনী আগের জায়গায় মুর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। মেয়েটাকে শাড়ি নিয়ে বলার পর থেকে এতই চুপ করলো যে আর একটা শব্দ করলো না। মৃন্ময়ের খারাপ লাগছে, মজা করতে গিয়ে হয়তো বাজে মজাই করেছে নাহয় পরিস্থিতি এত খারাপ হতো না। মৃন্ময় দু’পা এগিয়ে এলো চাঁদনীর দিকে। অপরাধীর ন্যায় বললো,
“আপনাকে আমি কষ্ট দিতে চাই নি, ইন্দুবালা।”

“সমস্যা নেই, ঠিক আছি আমি।”

আজ চাঁদনী রাগ দেখালো না, ধমকালো না। মৃন্ময়ের অপরাধ বোধ আরও বাড়লো। সে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“আপনাকে বুড়ি বলা উচিৎ হয় নি।”

“বুড়িকে বুড়ি বলবে সেটাই তো স্বাভাবিক তাই না? আমি কিছু মনে করি নি। তুমি সত্যি বলার সৎসাহস রাখো সেটাই অনেক।”

“কে বলেছে আপনি বুড়ি? আপনি হাসি দিলে পুরো দুনিয়া আপনার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়বে আর আপনি বলেন আপনি বুড়ি।”

চাঁদনী মুচকি হাসলো মৃন্ময়ের কথায়৷ ছেলেটার কোঁকড়া চুল গুলো আলগোছে এলোমেলো করে দিয়ে আদুরে স্বরে বললো,
“তোমার কথায় আমি কষ্ট পাই নি। তবুও তুমি আমাকে হাসানোর চেষ্টা করেছো তাই নির্দ্বিধায় তুমি পৃথিবীর সুন্দর মনের মানুষের মধ্যে একজন। তোমার আশেপাশের মানুষ গুলো এমন সুন্দর হলে হতোই।”

“আমার আশেপাশের মানুষ গুলো কে?”

চাঁদনী জবাব দিলো না। ধীর পায়ে চলে যেতে নিলেই মৃন্ময়ের হেয়ালি কণ্ঠে বললো,
“আশেপাশের মানুষটা কী আমার ভাই?”

চাঁদনী তৎক্ষনাৎ থেমে গেলো। বিদ্যুৎ খেলে গেলো তার শরীরে। ভ্রু কুঁচকে বললো, “মানে!”

“চাঁদের হাঁটে পাপের উৎসব
ভুল ছোঁয়ার অপরাধে,
প্রেমিক তবু ভালো থাকে
প্রেমিকা বাঁচে অবসাদে।” (মম)

মৃন্ময়ের চোখে-মুখে দুষ্টু হাসি। চাঁদনী কেবল তাকিয়ে রইলোই। ছেলেটা কী বুঝাতে চাইলো!

_

গভীর রাত, চারপাশ তুমুল নিরবতায় আচ্ছন্ন। অহির ঘরে লাইটের আলো জ্বলজ্বল করছে। মেয়েটা মনযোগ দিয়ে পড়ছে। ঘরে অন্য আরেকজনের উপস্থিতি অনুভব করতেই অহি মাথা তুললো। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো অবনী বেগম হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে এক গ্লাস দুধ। অহি তেমন পাত্তা দিলো না, আগের ন্যায় বইয়ে মুখ গুঁজলো। তা দেখে গোপনে হতাশার শ্বাস ফেললো অবনী। দুধের গ্লাসটা অহির টেবিলে রেখে মিষ্টি হেসে অহির মাথায় হাত রাখলো। সাথে সাথেই হাতটা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলো অহি। বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“ডিস্টার্ব করছেন।”

“দুধটা খেয়ে নেও, অহি।”

“আপনাকে অত নাটক করতে হবে না। যান, নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমান।”

অহির কণ্ঠে কেমন তিক্ততা! অবনীর চোখ টলমল করে উঠলো কিন্তু কণ্ঠ কোমল। নিবিড় কণ্ঠে বললেন,
“খেয়ে নেও দুধটা, আমি গ্লাসটা নিয়ে যাই।”

“আপনার এসব আমার পছন্দ না। বার বার বলার পরও কী বুঝেন না? যত্তসব।”

“অহি, ভদ্র ভাবে কথা বলো। আমি তোমার মা।”

অবনীর দৃঢ় কণ্ঠের বিনিময়ে অহির তাচ্ছিল্য ভেসে এলো। হো হো করে হেসে বললো, “মা!”

_

বাহার চিলেকোঠার ঘরে মাত্রই প্রবেশ করলো। ওদের ছাঁদটা অন্ধকার। ও ঘরে ঢুকেই ছাঁদের হলুদ বাতিটা জ্বালিয়ে দিলো। ঘরের বাতি জ্বালালো। ঘড়ির কাঁটা গিয়ে থেমেছে দুইয়ের দিকে। তার মানে রাত দু’টো বাজছে। বাহার নিজের খাটে বসলো। সারাদিন প্রচুর খাটাখাটুনির পর সে ক্লান্ত। টি-শার্ট নিয়ে চলে গেলো গোসলে। এটা তার সবসময়ের স্বভাব। যখনই ঘরে ফিরবে তখনই গোসল করবে।

গোসল সেড়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় বসলো সে। চোখ জুড়ে ঘুম আসছে কিন্তু ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। তার ইচ্ছে গুলোই বড়ো অদ্ভুত। বাহার তার বইয়ের টেবিলের পাশ থেকে গিটার টা তুলে নিলো। মাঝরাতে তার গিটার বাজাতে ভীষণ ভালো লাগে। এক প্রকার তৃপ্তি পায় সে। এই মহল্লাটা শান্তি প্রিয়। কোনো হৈচৈ তাদের পছন্দ না। বাহারের এই গিটার বাজানো নিয়ে কয়েকজন প্রায় কমপ্লেইন করতো আগে কিন্তু বাহার কারো কথা পাত্তাই দেয় নি। বরং কেউ তাকে বুঝাতে এলে সে বলে দেয়, যা তাকে সুখ দেয় সে তা করবেই। মানুষের তো স্বভাবই, অন্যের সুখে বাঁধা দেওয়া। সেসব ভাবলে সুখী হওয়া যায় না। লোকে বলে সবাইকে নিয়ে সুখী হতে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সবাইকে নিলে আর সুখী হওয়া যায় না।

ছাঁদের চওড়া রেলিঙে আরাম করে বসলো বাহার। কেবল একটা আঙ্গুল ছুঁয়ে দিলো গিটার। ঠিক সে মুহূর্তে মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে এলো,
“বাহার ভাই, খাবেন না?”

এমন রাতে মেয়েলি কণ্ঠ শুনে বাহারের ভীষণ রকমের চমকে যাওয়ার কথা কিন্তু বাহার চমকালো না। বরং চোখ গিটারে রেখেই পা ঝুলাতে ঝুলাতে বললো,
“এত রাতে এখানে কী?”

মেয়েলি অবয়বটা এগিয়ে এলো। ভাবুক স্বরে বললো,
“আপনি চমকালেন না কেন?”

“এত রাতে এখানে কী?”

বাহারের একই প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হলো চিত্রা। কোমড়ে দু-হাত চেপে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
“আপনার জন্য খাবার এনেছি।”

“ফিরিয়ে নিয়ে যাও।”

বাহার এখনো চিত্রার দিকে তাকালো না। চিত্রা ভীষণ বিরক্ত হলো। সিঁড়ির কাছটাতে কাঠের মোড়ায় ঢেকে রাখা প্লেটের খাবারটা নিয়ে এলো। বাহারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“আজ তো আপনাদের দাওয়াত ছিলো আমাদের বাড়ি। আপনি তো গেলেন না পরে আর। তাই আপনার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম।”

“অপেক্ষা না করে পড়াশোনা করলে কাজে দিতো না? যাও বাড়ি। অনেক রাত হয়েছে।”

“আপনি খাবেন না? অনেক কষ্ট করে লুকিয়ে এনেছিলাম।”

“খাবো না বলেই তো বলছি নিয়ে যেতে। আমরা পান্তা ভাতের পেট নিয়ে এসেছি, বিরিয়ানি সহ্য করতে পারবে না। যাও, মেয়ে।”

চিত্রা ঠোঁট ফুলালো। অভিমান করলো। সেও তো খায় নি, লোকটা কী জানে সে কথা? একটা বার জিজ্ঞেস করলে কী ক্ষতি হতো শুনি!

বাহার এবার কণ্ঠ উঁচুতে তুললো, কিছুটা ধমকের স্বরে বললো,
“রাত বিরাতে এমন মানুষের বাড়ি আসবে না। লোকে কী বলবে সেটা ভেবে বলছি না, আমার ভালো লাগে না তাই বলছি। যাও।”

চিত্রার তো কান্না এসে পড়লো। লোকটা পাষাণ, বড্ড পাষাণ। কিন্তু চিত্রা যে বড্ড কোমল! সে তাও ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,
“আপনি খাবেন কী তাহলে?”

“বনফুল ভাত আর ডিম ভাজি রেখে গেছে। খেয়ে ফেলবো।”

“তাও আমার আনা খাবার খাবেন না?”

“এক কথা বার বার কেন বলছো? না এর কোনো সমার্থক শব্দ আছে? থাকলে সেটা দিয়েও বলছি, আমি খাবো না। যাও।”

চিত্রা ভীষণ অভিমান করলো। খাবার হাতেই নেমে গেলো দ্রুত। বাহার আকাশ পানে তাকিয়ে গিটারে সুর তুললো। কিন্তু কণ্ঠ দিয়ে বের হলো না কোনো সুর, ছন্দ। বাহার ঘাড় ঘুরিয়ে পথের দিকে তাকালো। মেয়েটা ছুটে যাচ্ছে নিজের বিল্ডিং এর দিকে। বাহার হাসলো। কোমল কণ্ঠে বললো,
“রঙ্গনা, এমন মিষ্টি অভ্যাস হয়ে এসো না আমার কাছে। পরে হারিয়ে গেলে আমার শূন্যতা জাগবে। সব শূন্যতা পূরণ করা গেলেও তোমার শূন্যতা কখনো পূরণ করা যাবে? শুনছো মেয়ে, তুমি চাঁদ দেখো দশ তলা বিল্ডিং এ শুয়ে, আর আমি চাঁদ দেখি চিলেকোঠার জানলার ফাঁকে। আমাদের আলাদা করতে এর চেয়ে বড়ো পার্থক্য হয়? তুমি যেই আকাশের চাঁদ আমি সেই আকাশের নিচে বসে থাকা সর্বস্ব হারা এক পথিক। আমাদের যে বড্ড তফাত, বড্ড পার্থক্য! রঙ্গনা, তুমি তোমার অবুঝ আবেগ সামলে নিও, তোমার প্রেমিক যে বাস্তবতার বেড়াকলে বড্ড বেশিই পাষাণ, হৃদয়হীন।”

চিত্রা বিল্ডিং এর ভেতর ঢুকে পড়তেই বাহার গলা ছেড়ে গান ধরলো,
“বন্ধু মন ভাঙিয়া চইলা গেলে
সুখ মেলে না মেলে না,
প্রেম করিয়া ছাইড়া গেলে
সুখ মেলে না মেলে না
প্রেম করে মন দিলা না,
আমি মরলে একটুও কানবা না।”

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে