প্রেমাচ্ছন্ন প্রহর পর্ব-০৬

0
387

#প্রেমাচ্ছন্ন_প্রহর
#লাবিবা_আল_তাসফি

৬.
হলের এই সরু রাস্তায় রাত দশটার পর যানবাহন চলাচল কমে যায়। বৃষ্টি হলে দু একটা রিকশা ব্যতীত অন্য কোনো যানবহনের খোঁজ মেলে না। আজ রাস্তাটা একদম শুনশান নিরব। রাস্তার মাথায় যেখানে রাস্তা মেইন রোডের সাথে মিলেছে সেখানে একটা চায়ের দোকান আছে। ওখানে দু একজন লোকের উপস্থিতি বোঝা যাচ্ছে। রোড লাইট গুলো টিমটিম করে জ্বলছে। ভাবখানা এমন যেন তাদের জীবনের অন্তিম পর্যায় চলছে। আমি আর সাহিল পাশাপাশি হাঁটছি। উঁচু নিচু রাস্তার কিছু কিছু জায়গায় পানি জমে আছে। সাহিল খুব বিরক্তি নিয়ে সেসব জায়গা লাফিয়ে লাফিয়ে পার করছে। আমার কেন যেন হাসি পেলো। সবসময় পরিপাটি ফর্মাল মানুষটা কাঁদাপানিতে প্রচন্ড বিরক্ত অনুভব করছে ভাবতেই প্রশান্তি এলো। অত বেশি পারফেক্ট মানুষ আমার পছন্দ না। আমি মুচকি হেসে তাকে বললাম,

‘বৃষ্টি অপছন্দ বুঝি?’

‘ঠিক অপছন্দ নয় তবে পছন্দের তালিকায় ও ফেলতে পারছি না।’

আমি মুখ বাঁকালাম। এত নাটকিয় ভাবে জবাব দেওয়ার কি আছে?

‘আপনিকি আমার প্রতি বিরক্ত শুভ্র?’

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। সাহিলের দৃষ্টি স্থির। আমি তার দিকে ফিরে দাঁড়ালাম। কিছুটা ঝুঁকে বললাম,

‘যদি বলি হ্যা তবে?’

সহিল শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই শান্ত কথার বাণ ছুঁড়ল,

‘তবে বিরক্তকে আপন করে নিন শুভ্র। এখন থেকে এই বিরক্ততা আপনাকে ঘিরে সর্বদা অবস্থান করতে চলেছে।’

সাহিলের ডাকা ‘শুভ্র’ কথাটা বারবার কানে ঝংকার তুলছে। লোকটার মুখে ডাকটা যেন একটু বেশিই আদুরে ঠেকছে। অনুভব করলাম আমার শরীরের প্রত্যেকা লোমকূপ নিজের অবস্থানে দাঁড়িয়ে পড়েছে। শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়েছে লজ্জা। মুখমণ্ডল গরম হয়ে উঠেছে। ইশশ! কি ভয়ংকর!
আমাদের মাঝে নিরবতা চললো বেশ কিছুক্ষণ। পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে চলছি দুজন। ইতিমধ্যে আমারা হলের রোড ছেড়ে মেইন রোড উঠেছি। পাশ থেকে শা শা করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। রোড সংলগ্ন দোকানগুলো এখনো গমগমে। নিরবতার ব্রেকটা আমিই চেপে ধরলাম। শুধালাম,

‘বললেন না তো এত রাতে শিক্ষকের এই ছাত্রীর কাছে কি চাই?’

সাহিলের মুখভাব বদলালো। শক্ত গলায় বললেন,

‘আপনি আমার ছাত্রী নন তনয়া। আমাদের মাঝে তেমন সম্পর্ক কখনো ছিল না। আমি কখনোই ছাত্রীর নজরে দেখিনি আপনাকে।’

সাহিল থামলেন। আমি তার দিকে আড় চোখে চেয়ে প্রশ্ন ছুড়লাম,

‘তো কোন নজরে দেখতেন? পাত্রী?’

সাহিল এবার হুট করেই ঠোঁট কামড়ে হাসলেন। লোকটার এত দ্রুত মুড সুইচ করতে দেখে আমার চোখ ছোট হয়ে এলো। এই লোকের মুড কি রিমোট কন্ট্রোলড নাকি? সুইচ টিপলেই মুড চেন্জ! স্টেঞ্জ! এই ব্যক্তিতো একেরপর এক রূপ দেখিয়ে চলছে। আর কত রূপ আছে তার?

‘উহু! আমি আপনাকে আরো একধাপ এগিয়ে ভেবেছি শুভ্র! আমি আপনাকে বউয়ের নজরে দেখেছি। না হওয়া বউ!’

আমি চকিত নয়নে তাকালাম। লোকটার মুখে খেলে যাচ্ছে এক চিলতে হাসি। কি সরল সে হাসি। যেন সব কিছু নিয়ম অনুসারে চলছে। এখানে অস্বাভাবিক কিছুই নেই। অথচ সে তার কথা দ্বারা আমার শ্বাস রোধ করে ফেলেছে। আমার অন্তঃসত্ত্বা ছটফট করতে লাগলো। ‘বউ’ শব্দটা ছোট হলেও এর গভীরতা অনেক। আমার চিন্তারা এলোমেলো হলো। ঘনঘন শ্বাস ফেলে ছোটছোট পা ফেলে আমি সাহিলের পাশ ঘেঁষে চলতে লাগলাম।

‘চা খাবেন?’

আমি মাথা উঁচু করে তাকালাম। আমাদের পাশেই বেশ লোকজনে পরিপূর্ণ একটা চায়ের দোকান। আমি মাথা নাড়িয়ে না করলাম। এ মুহূর্তে আমার কিছুটা বিশ্রাম চাই। আমার মস্তিষ্ক কাজ করতে ভুলে গেছে। তার বিশ্রামের দরকার। আমি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললাম,

‘অনেক রাত হয়েছে। এখন ফেরা উচিত।‌ অন্যকোনোদিন চা খাব।’

কথা শেষ করেই উল্ট পথে পা বাড়ালাম। সাহিলের কথা শোনা কিংবা তার থেকে বিদায় নেওয়ার মতো শক্তিও অবশিষ্ট নেই আমার। শরীর নেতিয়ে আসতে চাইছে। এই অনুভূতিরা এত ভয়ংকর কেন?

______________

আজ শুক্রবার। সেই সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি। জানালা খোলা থাকায় শীতল বাতাস হু হু করে রুমে ঢুকছে। বৃষ্টির পানিতে মেঝের অনেকাংশ ভিজে গেছে। সাহিলের ঘুম ভাঙলো দশটার দিকে। তখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। বিছানা থেকে নেমে জানালার গ্লাস টেনে দিলো। মেঝেতে পানি দেখে বিরক্তি চ শব্দ করলো। রাতে জানালা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। শরীরটা কেমন ভারী লাগছে সাথে অসহ্য মাথা ব্যাথা। ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে যেতে বিরক্তি আরো একধাপ বেড়ে গেলো। খাওয়ার মতো কিছুই নেই। অগ্যতা স্টোভ অন করে তাতে গরম পানি বসালো। এক মগ কফি হলে খারাপ হয়না। তখনি বাসার ল্যান্ড লাইনে কল আসলো। সাহিল এগিয়ে তা পিক করতেই ওপাশ থেকে তার মা বলে উঠলো,

‘ফোন বন্ধ কেন তোমার?’

সাহিল সচেতন হয়ে বসলো। মনে করার চেষ্টা করলো তার ফোন বন্ধ থাকার কারণ।

‘চুপ কেন?’

‘পাওয়ার অফ হেয়ে গেছে মা। চার্জ শেষ। রাতে শরীর খারাপ করেছিল ভীষণ। চার্জে দেওয়া হয়নি।’

সোহেলি বেগমের গলা নরম হয়ে এলো। চিন্তিত গলায় বললেন,

‘শরীর অনেক খারাপ? আমি আসব?’

‘না মা। ব্যস্ত হতে হবে না। মাথা ব্যাথা মাত্র। ঠিক হয়ে যাবে।’

‘আচ্ছা। ছুটি নিয়ে ময়মনসিংহ আসতে পারবে দুদিনের জন্য?’

সাহিলের কপালে ভাঁজ পড়লো। ছোট করে বলল,

‘কেন?’

‘মেয়ে দেখেছি। এইতো কাছেই বাড়ি। বেশ সুন্দরী। একবার এসে দেখে যাও। পছন্দ হলে সামনের মাসেই বিয়ে ঠিক করবো।’

সাহিল ছোট করে শ্বাস ছেড়ে বললো,

‘সময় হবেনা মা। আমার বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হতে হবেনা। সময় হলে আমি নিজেই তোমার জন্য বউ নিয়ে আসবো।’

‘সময়টা আর কবে হবে? ত্রিশ শেষ করে একত্রিশ এ পা ফেলেছ। আর কত? তোমার ছোট ভাইয়ের বাচ্চা হতে চলেছে আর তুমি কিনা এখনো বিয়েটাই করতে পারলে না!’

সাহিল তপ্ত শ্বাস ফেলল। তার মা এবার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। বিয়ে না করা অবদি এই অত্যাচার থামবে বলে মনে হয় না।

‘মা আমাকে কয়েকটা দিন সময় দাও। তারপর এই বিয়ে নিয়ে ভেবে দেখবো। প্রচন্ড প্রেশারের মাঝে আছি। এই মুহূর্তে বিয়ে ইমপসিবল।’

কথা শেষ করে সাহিল কল কেটে দিল। বিগত পাঁচ মাস ধরে তার সাথে এটাই চলছে। এক বিয়ে নিয়ে তার বাড়িতে যাওয়াও কমে এসেছে। আগে প্রতি সম্তাহে যাওয়া হতো। এখন মাসেও একবার যাওয়া হয়না।
.
.
হেঁচি দিতে দিতে শরীর থেকে আত্মা আলাদা হওয়ার উপক্রম। সকাল সকাল বৃষ্টিতে গোছল করার ফল এটা। বৃষ্টি দেখলে নিজেকে ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পরে। কেমন এক আকর্ষণ অনুভব করি। সেই আকর্ষণ থেকেই এই হাল! সকল আকর্ষণীয় জিনিস-ই কি এমন বিপদজনক নাকি?
পুরো রুম খুঁজেও নাপা নামক কোনো ওষুধের হদিস পেলাম না। ইতিমধ্যে আমার রুমের মেঝেতে টিস্যুর স্তুপ জমেছে। নাক মুছতে মুছতে নাক লাল হয়ে এসেছে। গা কাঁপিয়ে জ্বর ও এসে পড়েছে। আমি পাতলা চাদর মুড়িয়ে চুপটি করে বিছানায় বসে নাক টেনে চলছি। আকাশ মেঘলা। হয়তো আরো এক পশলা বৃষ্টি হয়ে তবেই থামবে। হল থেকে বের হয়ে ফার্মেসি পর্যন্ত যাওয়ার ইচ্ছে হলো না। কারো কাছে চাইলে হয়তো ওষুধ পাওয়া যেত কিন্তু তাতে আমার ঘোর আপত্তি রয়েছে। এই চাওয়া চাওয়ি জিনিসটা বড্ড অপছন্দ আমার। অগ্যত ওভাবেই বসে থাকলাম। তখনি সাহিলের কল এলো। রিসিভ করে হ্যালো বলতেই অপর পাশ থেকে তিনি চিন্তিত গলায় বললেন,

‘ঠান্ডা লেগেছে?’

‘হুম।’

ঠান্ডার জন্য গলা কেমন ফ্যাসফ্যাস করছে। সাহিল কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত গলায় বললেন,

‘বৃষ্টিতে ভিজেছেন?’

‘হুম।’

অপর পাশ থেকে বড় করে শ্বাস ফেললেন সাহিল। আমি তখনো নাক টেনে চলছি। কেমন একটা পরিস্থিতি! এই মানুষটার সামনেই আমাকে এসব জঘন্য পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।
তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেন,

‘ওষুধ খেয়েছেন?’

‘উহু।’

সাহিল চুপ করে রইল। মিনিট খানেক বাদে শক্ত গলায় বললেন।

‘হলেই থাকুন। আমি আসছি। কোথাও পালানোর মতো দুঃসাহস দেখাবেন না। বি এ গুড গার্ল।’

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে