প্রেমাচ্ছন্ন প্রহর পর্ব-০৩

0
388

#প্রেমাচ্ছন্ন_প্রহর
#লাবিবা_আল_তাসফি

৩.
বিরক্ত নিয়ে বাস কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছি। এই ভোরেও স্টেশনে লোকের কমতি নেই। আকাশে কেবল আলো ফুটতে শুরু করেছে। কিন্তু স্টেশনের ভেতরের দৃশ্য দেখলে মনে হবে বেলা পড়ে গিয়েছে। প্রতিবার আশা যাওয়া ট্রেণে করলেও এবার বাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সবকিছুতে একটা পরিবর্তন আনা উচিত।
খাটো করে মোটা লোকটা টিকিট কাঁটার ফাঁকে ফাঁকে কেমন করে তাকাচ্ছে। মূলত এটাই আমার বিরক্তির প্রধান উৎস। এই জনবহুল স্টেশনে এমন কুরুচিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অবাব নেই। আমার অগোচরে আরো কয়েক চোখ হয়তো একই ভাবে দেখছে আমায়!পালা করে আমার টিকিট নেওয়ার সময় এলো।

‘সিঙ্গেল সিট। জানালার পাশ দেখে দিবেন।’

লোকটা কেমন উগ্রভাবে হাসলো। মিনমিনিয়ে বললো,

‘ম্যাডাম একা নাকি?’

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। ঝাঁঝালো গলায় উত্তর দিলাম,

‘সিঙ্গেল সিট পরিবার মিলে যাওয়ার জন্য কেউ বুক করেনা নিশ্চই!’

লোকটা গা জ্বালানো হেসে বললো,

‘সুন্দরী মেয়ে মানুষের একা কোথাও না যাওয়াই ভালো। দিনকাল তো ভালোনা বোঝেন না!’

আমি জবাব দিলাম না। টিকিট নিয়ে বড় বড় পা ফেলে সরে আসলাম। বাস ছাড়বে ঠিক ছয়টায়। এসি বাস হওয়ায় জানালা খোলার সুযোগ নেই। আমার পাশের ছিটের ব্যক্তি এখোনো আসেনি। না আসলেই ভালো। আরাম করে যাওয়া যাবে। কানে হেডফোন গুঁজে একটা চোখ বন্ধ করলাম। প্রায় সাথে সাথেই কল এলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ছোট ফুপির উচ্ছাসিত কন্ঠ ভেসে এলো।

‘তোকে একটা দারুণ খবর জানতে কল করেছি।’

আমি হতাশ চিত্তে বললাম,
‘ফুপা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন?’

ফুপর উচ্ছাস বাড়লো।
‘সে সুযোগ পেলেতো! এবার তোর ফুপাকে পেছনে ফেলে আমি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছি। উদ্দেশ্য সাজেক। সপ্তাহ খানেকের জন্য ডহাওয়া হয়ে যাব। তুই চাইলে জয়েন করতে পারিস।’

আমার মন খারাপ হলো। নেতিয়ে যাওয়া কন্ঠে বললাম,
‘তোমার ভাইয়ের আদেশে ময়মনসিংহে পাড়ি জমাতে হচ্ছে। এবার নাহয় একাই ঘুরে আসো। নেক্সট মিশনের আগে আগে জানিও।’

‘ব্যাপার না। যোগাযোগের সকল মাধ্যম বন্ধ থাকবে বুঝলি। তোর ফুপা কল করলে বলবি যেদিন থেকে সে ঐ ছাতামাতার উপন্যাস পড়া বন্ধ করবে সেদিনই আমি ফিরব।’

আমি হাসলাম। শুধালাম,
‘এসব জেনে শুনেইতো প্রেমে পড়েছিলে!’

‘সেটা বহু আগের কাহিনী। সময় বদলেছে, রুচি বদলেছে। এখন সময় বরকে নিয়ে অজানাকে জানার সেখানে ঘরে বসে বাসন মাজা অসম্ভব। সংসার আর আমি! ইমপসিবল! আমি রাখছি। বেস্ট অফ লাক।’

কল কেটে গেল। আমি চোখ বুঝে নিলাম। মানুষ স্বভাবতই ভিন্নধর্মী। একেক জনের স্বভাব সুলভ অন্যজনের থেকে ভিন্ন। এই ভিন্নতা প্রদর্শন করতে কিছু মানুষ খুব পছন্দ করে। এমনই এক ব্যক্তি আমার ছোট ফুপি। ফুপির সাথে সম্পর্কটা আমার বন্ধুত্বপূর্ণ। সেই সূত্রে ফুপির আগা গোড়া সমস্তটা আমার জানা। ফুপা এক সময় ফুপির প্রেমিক পুরুষ ছিল। ফুপার নাম জাহির। লোকটা অদ্ভূত ধাঁচের। গম্ভীর এবং ভাবুক টাইপের। এমন এক যাত্রাপথেই তাদের দেখা হয়েছিল। পাশাপাশি বসা সত্তেও কোনোরূপ কথা হয়নি তাদের। এটাই ছিল ফুপারর প্রতি ফুপির ইমপ্রেস হওয়ার কারণ। তার মতে এই ব্যক্তির মধ্যে সততার এক চরম ক্ষমতা রয়েছে। সততা যেখানে বিলুপ্ত হতে বসেছে সেখানে এমন একজন ব্যক্তির খোঁজ মেলা ভার! যেখানে বাঙালি প্রেমিকরা প্রেমিকার জন্য বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে সেখানে ফুপি ঘন্টার পর ঘন্টা ফুপারর হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো। কখনো চিঠির সাথে ইটের টুকরো বেঁধে ছুড়ে মারতো বারন্দায়। ফুপার হলের ঠিকানা খোঁজার পেছনে রয়েছে আরো এক ইতিহাস। সেটা নাহয় না জানা থাকলো। পুরো চারমাস বারোদিন প্রচেষ্টার পর ফুপা ফুঁপির প্রেমে সাড়া দেয়। ফুপির মতে কম কথা বললেও লোকটার ভেতর মানুষকে আকর্ষন করার ক্ষমতা আছে। এরপর একপ্রকার সবার অমতেই তাদের বিয়েটা হয়। মূলত বিয়েটা তারা পালিয়েই করেছিল। তাদের বিয়ের বয়স দুবছর। তবে দুজন দুই মেরুর মানুষ হওয়ায় বোঝাপড়াটা একটু কমই হয়।
______________

কিভাবে যেন দেখতে দেখতে তিনটা দিন পার হয়ে গেল। এই তিনদিনে কতটুকু কি বদলেছে জানি না। তবে আমার মনের অশান্তিটা বেড়েছে। কথায় আছে শান্ত মস্তিষ্কে শয়তানের বাস! কথাটার নিদারুণ সত্যতা উপলব্ধি করলাম। যেই অনুভূতির থেকে পালিয়ে যেতে এতদূর সেই অনুভূতি আরো প্রগাঢ় রূপ নিচ্ছে যেন। বুঝলাম এর থেকে মুক্তি নেই। ব্যাপারটা সময়ের সাথে সাথে আরো জটিল হতে লাগলো। কেমন দম বন্ধ অনুভূতি হতে লাগলো। মোবাইলের কন্টাক্ট লিস্টে খুব অবহেলায় পড়ে থাকা নাম্বারটা অনেক দিন বাদে ধরা দিল। অশান্ত মনকে দমাতে না পেরেই একটা ভুল করে বসলাম। তাকে কল করে ফেলেছি। ততক্ষণে আমার অস্বস্তি আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। দুবার রিং হতেই ওপাশ থেকে পুরুষালি কন্ঠ ভেসে এলো।

‘শুভ্রলতা!’

দ্বিতীয় ভুলটা আমি এখানেই করে বসলাম। টুপ করে কলটা কেটে ফোন বন্ধ করে দিলাম। ব্যাপার গুলো এত দ্রুত ঘটলো মস্তিষ্ক ভাববার সময় পেল না। যখন মন মস্তিষ্ক শান্ত হয়ে এলো তখন নিজের উপর ভিষণ রাগ অনুভব হলো। এমন ইম’ম্যাচিউর আচরণ করার জন্য লজ্জাও পেলাম খানিকটা। কি ভাববেন লোকটা? এই অস্বস্তিকর অবস্থায় থেকে বাঁচতেই তৃতীয় বারের মতো ভুল করে বসলাম। নম্বর বদলে ফেললাম। সামাজিক নেটওয়ার্ক সাইড গুলো থেকে সাময়িক সময়ের জন্য সরে এলাম। এক কথায় নিজেকে গুটিয়ে নিলাম পুরোপুরি। কিন্তু সমস্যা ঘটলো ঠিক তার দুদিন বাদেই নিসা হাস্যজ্জল মুখ নিয়ে যখন আমায় বললো,

‘তোমার তিনি দেখা করতে চাইছেন। ঝটপট তৈরি হয়ে নাও।’

আমি বিষ্ময় নিয়ে চাইলাম। নিসার দুষ্টমি ভেবে চোখ ছোট করে বললাম,

‘এই তিনি টা ঠিক কোন তিনি?’

‘তোমার স্নিগ্ধ পুরুষ।’

আমি চমকে উঠলাম। এই নাম ও কোথা থেকে জানলো? আমার চাহনিতেই হয়তো নিসা বুঝলো। সোফায় পা তুলে আরাম করে বসে বললো,

‘একচুয়েলি আমি তোদের ব্যাপারে কিছুই জানি না। ভদ্রলোকের নাম সাহিল। তোর ডায়েরিতে ভুল বশত স্নিগ্ধ পুরুষ নামটা দেখে ফেলেছিলাম। ইউ নো আমার guessing পাওয়ার কতটা ভালো! লেগে গেল!’

আমার চিন্তা হলো। সাধারণ চিন্তা করাটা আমার ব্যক্তিত্বের বাহিরে। তবে আজ চিন্তা হলো। সাহিল হঠাৎ কেন দেখা করতে চাইবে? সেদিনের কল করার ব্যাপার নিয়ে যদি কিছু জানতে চায়? এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো পালিয়ে যাব। এই সাহিল নামের লোকটি আমায় খুঁজে পাবে না এমন কোনো উপত্যকায় গা ঢাকা দিব। পরক্ষণে তীব্র আত্মসম্মান বোধ তার চরম বিরোধীতা করে বসলো। এভাবে পালিয়ে যায় চোর বা অপরাধীরা।‌ আমিতো কোনো অপরাধ করিনি? তবে কেন পালাব?

সাহিলের সাথে দেখা হলো নিকটস্থ এক পার্কে। বাড়ি থেকে বিশ মিনিটের পথ মাত্র। ঝিমিয়ে পড়া বিকেলে পার্কের বেঞ্চিতে কপত কপতীর মেলা বসেছে। ছোট পরিসরের পার্কটিতে বাচ্চাদের তুলনায় কপোত কপোতীদের পরিমাণ বেশি। ময়মনসিংহের বিকেল সুন্দর। নিজের শহর বলেই কি এত ভালো লাগা? এত মানুষের ভিড়ে সাহিলকে খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট হলো না। ছোট ছোট ফুলগাছের মাঝের ফাঁকা বেঞ্চিতে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে ফোনে কিছু একটা করছে। পরনে সাদা কালো ডোরাকাটা হাফ হাতার গেঞ্জি। এই প্রথম আমি তাকে ইনফরমাল ওয়েতে দেখলাম। বরাবরের মতো চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করা নেই। কপালের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে অগোছালো ভাবে পড়ে রয়েছে চুলগুলো। কতটাই না স্নিগ্ধ লাগছে! না চাইতেও পা জোড়া থেমে গেলো। ভেতর আত্মা যেন চিৎকার করে বলে উঠলো,
‘তুই প্রেমে পড়েছিস তনয়া! এই স্নিগ্ধপুরুষের প্রেমের গহিন অরণ্যে তলিয়ে গেছিস তুই।’
চোখ বুঝে নিলাম। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটাতে লাগলো যেন। এই লোকের আশপাশে এলে আমি বড্ড এলোমেলো হয়ে পড়ি। বড় করে শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলাম। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখ না তুলেই সে স্নিগ্ধ কন্ঠে শুধালো,

‘শুভ অপরাহ্ন শুভ্রলতা!’

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে