প্রিয় বকুলফুল-Arisha Jannat

0
501

#গল্পপোকা_চিঠি_প্রতিযোগিতা_২০২০
#চিঠি_নং_১

প্রিয় বকুলফুল,
পত্রের প্রথমে আমার তরফ থেকে ঘোষ কাকুর দোকানের পাঁচ টাকা মূল্য নির্ধারিত সন্দেশের চাশনির মতো মিষ্টতা পূর্ণ ভালোবাসা নিবি।আমার জানামতে,নিজ জন্মভূমি রেখে বিদেশ বিভূঁইয়ে গিয়ে তুই খুব একটা ভালো নেই।আমার সম্বন্ধে বলতে চাইলে বলবো যে,গ্রাম ছেড়ে শহরবাসী হয়ে আমিও মোটেও ভালো নেই রে!
.
ছোটকাল থেকে শুরু করে বিয়ে বসার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আজীবন আমাদের মনের সুপ্ত বাসনা ছিল যে,আমরা মোহনগঞ্জ নামক ছোট্ট গ্রামাঞ্চল থেকে ইষ্টিকুটুম পাখির ন্যায় ডানা মেলে শহরতলীতে উড়ে গিয়ে নিজেরা নিজেদের সঙ্গী পাখিদের সাথে সুখের সংসার গড়ে তুলবো।সঙ্গী পাখি আর ছানাপোনাদের নিয়ে পরিপূর্ণ আমাদের সেই সংসারে সুখ,খুশি,আনন্দ,আমোদ,ফূর্তি ছাড়া আর কোনোকিছুর আনাগোনা থাকবে না। ইচ্ছা বা স্বপ্ন যাই বলি না কেনো বিয়ের পিঁড়িতে বসার মাধ্যমে তা পূরণ হয়েছে।কিন্তু পূরণীয় সেই স্বপ্নের সুখ খোয়াবে অনেক মনোমুগ্ধকর হলেও,বাস্তবে সেই মুগ্ধতার ছিটেফোঁটা পর্যন্ত খুঁজে পাই নি আমি।স্বামী,সন্তান নিয়ে সুখে থাকলেও আগেকার মতো মুক্তভাবে জীবনযাপন করতে পারি না।নিজেকে কিছুটা খাঁচায় বন্দি পাখির মতো মনে হয় আমার!
.
বড়ই মনে পরে রে আগেকার সেই দিনগুলোর কথা!সেই দিনগুলোতে তুই,আমি এখনকার মতো মধ্যবয়স্কা কোনো নারী ছিলাম না।ছটফটে টুনটুনি পাখির মতো টইটই করে সারাদিন ঘুরে বেড়ানো,উড়নচণ্ডী নামে খ্যাতিপ্রাপ্ত দুই কিশোরী মেয়ে ছিলাম আমরা,যাদের বয়স সবেমাত্র পনেরোর কোঠা ছুঁয়েছে।গরুর বাছুরের মায়াবী নয়নযুগলের মতো আমাদের আঁখিকোণেও সবসময় রাঙানো থাকতো কাজলরেখা।পিঠ বরাবর লম্বা কেশে চম্পা ফুলের সুগন্ধিওয়ালা তেল দিয়ে মাথার দুইপাশে দুই ঝুঁটি বাঁধাই ছিল আমাদের নিত্যদিনের সাজ।সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত গ্রামের প্রতিটি জায়গা চষে বেড়ানো ছিল তখনকার দিনে আমাদের প্রধান কাজ।বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রথম দুই ঘণ্টা চুপটি মেরে বসে থাকলেও টিফিনের ঘণ্টা বাজতেই বিদ্যালয় চত্বর থেকে একছুটে বের হয়ে আসা ছিল আমাদের স্বভাব।সেই যে বের হয়ে যেতাম তারপরে সারাদিনে আর নীড়ে ফিরে যাওয়ার মতো কোনোপ্রকার তাগিদ অনুভব করতাম না আমরা।ঘোষ কাকুর দোকানে গিয়ে কখনো নগদে আবার কখনো বাকিতে ভোজন সেড়ে নিয়েই দৌড় দিয়ে চলে যেতাম তমিজ দাদার পুকুরপাড়ে।পুতুলের বিয়ে,রান্না বাটি,লুকোচুরি,এক্কাদোক্কা,বৌছি খেলা থেকে শুরু করে নিতিন কাকুর বাগানের গাছগুলোর ডালে বাঁদরীর মতো বসে থেকে দিনদুপুর পার করে দিতাম দুজনে মিলে।চন্দন তুল্য মাটি অহরহ মেখে থাকতো আমাদের হাতে,পায়ে,কাপড়ে।
অন্যান্য সইদের সাথে মোটামুটিরকম ঘনিষ্ঠতা থাকলেও তোর আর আমার সম্পর্কের গভীরতা ছিল সবচেয়ে বেশি প্রখর এবং নিখাদ ভালোবাসাযুক্ত।দিনশেষে নিজের ঘরে ফিরে গেলেও পরবর্তী দিন থেকে পুনরায় আরম্ভ হতো আমাদের বাউণ্ডুলেপনা।সেই দিনগুলোর কথা ভেবে বলতে গেলে বলা যায় যে,তখন আমাদের দুজনের আত্না ছিল একই কিন্তু সেটি অর্ধেক ভাবে বসবাস করতো আমার দেহে আর বাকি অর্ধেকের বিরাজ ছিল তোর দেহে।সারাদিন আমরা মুক্ত পাখির মতো নিজেদের ইচ্ছেতে উড়ে বেড়ালেও কোনো একটি ক্ষণে আলোচনারত অবস্থায় যদি মনের লুকায়িত কামনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হতো তাহলে সেই ক্ষেত্রে সবসময় মিলে যেতো আমাদের বাণী।প্রিয় মানুষের হাত ধরে গ্রাম ছেড়ে শহরাঞ্চলে গিয়ে সুখের কুঠরি গড়ে তোলাই ছিল আমাদের বাসনা।কথায় আছে না?”মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে না”,আমাদের বেলাতেও ঠিক একই কাণ্ড ঘটেছিল।গ্রামের স্বতঃস্ফূর্তভাবে যাপিত দিনরাত্রি গুলো হয়তোবা তখন আমাদের কাছে একঘেয়েমি হয়ে গিয়েছিল তাই তো নতুন কিছুর আশায় শহরের ভবনে বসবাসের মনোভাব তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমাদের ছোট্ট মনে।কিন্তু তখন কি আর জানতাম রে,মোহনগঞ্জের স্বাধীন,খাঁটি মাটির ঘ্রাণ মিশ্রিত বাতাসের সাথে শহরের কালো ধোঁয়ার তুলনা করা ভুল বৈকি আর কিছুই নয়!কোথায় আমাদের সেই সবুজ গাছগাছালি,ধানক্ষেত,পাখপাখালির কলকাকলি মখুর প্রাণের গ্রাম আর কোথায় এই তুচ্ছ কংক্রিটের বাসভবন,গাড়িঘোড়া ভরপুর শহর!আকাশপাতাল তফাৎ!দুটির মাঝে তুলনা করা কখনোই উচিত না রে,কখনোই না!আর যদি কেউ তুলনা করেও ফেলে তাহলে পরবর্তীতে গিয়ে তারও আমাদের মতো বোধগম্য হবে যে,গ্রাম নামক অতি সাদামাটা মানুষের বসবাসরত স্থানটি সবচেয়ে সেরা এবং শ্রেষ্ঠ!
.
তোর সাথে গতবার মুঠোফোনে কথোপকথনরত সময়ে তুই আমাকে গ্রাম সম্পর্কিত তোর বর্তমান মনোভাব জানিয়ে আবারো আগেকার দিনগুলো ফিরে পাওয়ার জন্য আক্ষেপ করলেও এ সম্বন্ধে আমি আমার অনুভূতি তখন ব্যক্ত করতে পারি নি।আমার ইচ্ছা হয়েছিল যে,চিঠিপত্র লিখে আমি আমার অনুভূতিপ্রবণ প্রকাশ করবো।তাই লিখতে বসে গেলাম আমার মোহনগঞ্জের স্মৃতি সম্বলিত অব্যক্ত অনুভবযোগ্য বাণীকে লিখিত রূপে রূপান্তরিত করা এই চিঠি।লিখে যা প্রকাশ করতে পারি আমি,তা মুখে বলেকয়ে ব্যক্ত করা আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়।
.
স্বামী,সন্তান,সংসার সর্বদিক সামলিয়ে শত ব্যস্ততার মাঝেও অবসরে পাওয়া ক্ষণিকের কিছু সময়ে মোহনগঞ্জ আর আগেকার সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করি আমি।আমি জানি যে,তোর ক্ষেত্রেও ঠিক একই ঘটনা ঘটে।যখন দুজনের অবস্থায় একই তাহলে চল না স্মৃতিগুলোকে অতীত না বলে বর্তমান বলার জন্য কিছু কার্য সম্পাদন করি আমরা।দীর্ঘদিনের জন্য না হলেও অন্তত এক-দুইদিনের জন্য স্বামী,সন্তান এবং আর সকল ব্যস্ততাকে ভুলে গিয়ে নিজেদের মতো করে একান্তে সময় উপভোগ করার জন্য মোহনগঞ্জের উদ্দেশ্য চলে যাই।ফিরিয়ে নিয়ে আসি আগেকার সেই দিনগুলো।ফিরে যাই নিজ জন্মভূমিতে।আবারো মেতে উঠি বৌছি,কুতকুত,কানামাছি খেলার সমাহারে।মোহনগঞ্জের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যময় প্রকৃতি নিজ চোখে অবলোকন করে আসি।নিজেদেরকে সজীব কিছু সময় দান করি।আমার প্রস্তাবে তুই রাজি থাকলে চল দিনক্ষণ ঠিক করে ঘুরে আসি গিয়ে।
.
আজকের মতো এখানেই ইতি টানি।আমার আশা এবং বিশ্বাস যে,তোর কাছ থেকে ইতিবাচক ইশারা পাবো আমি।দয়া করে,মুঠোফোনে না জানিয়ে চিঠি লিখে বার্তা জানিয়ে দিবি আমাকে।তোর উত্তর বহনকারী চিঠির অপেক্ষায় রইলাম আমি।পরিবারের সবাইকে নিয়ে সবসময় ভালো এবং বিপদমুক্ত থাক এই দোয়াই করি।খোদা হাফেজ।

ইতি,
তোর প্রিয় সখী কুঞ্জলতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে