প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৪২+৪৩

0
575

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪২
________________
হন্তদন্ত হয়ে ইমতিয়াজের লেখা একটা পৃষ্ঠা খুঁজছে রাগান্বিতা। চোখে মুখে অশেষ আতঙ্কের ছাপ। না এমন কিছুই হতে পারে না। রাগান্বিতা পাগলের মতো খুঁজছে সেদিনের লেখাটা। যে লেখা ইমতিয়াজ তারই সামনে তাদের বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে লিখেছিল। যেদিন গ্রামের সকল শিক্ষিত ছেলেদের হাতের লেখা নিয়েছিল রাগান্বিতা আর সেদিন ইমতিয়াজের হাতের লেখাটাও নিয়েছিল। সেদিন ইমতিয়াজ চিঠির শেষে বাড়তি দু’লাইন লিখেছিল,“প্রেমপত্র উন্মোচনের বুদ্ধিটা দারুণ। কিন্তু সে যে এই গ্রামেরই তা জানলেন কি করে?”

সেই লেখা রাগান্বিতা খুব যত্ন করে রেখেছিল নিজের কাছে। শেষ কথাটা যে কতবার রাগান্বিতা পড়েছে তার হিসাব নেই। কিন্তু আজ সেই হুবহু হাতের লেখা আসলো তার আপার চিঠিঘর থেকে। ভাবলেই সব লন্ডভন্ড হচ্ছে। রাগান্বিতা কোথাও ভুল করছে না তো তাই হাতের লেখা মিলালোর জন্যই এমন হন্তদন্ত হয়ে সেই লেখাটা খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না। হঠাৎই রাগান্বিতার মনে হলো সে লেখাটা বোধহয় ঢাকার বাড়িতে রেখে এসেছে। রাগান্বিতার অস্থিরতা বাড়ছে। তার বুক ধুকপুক করছে এটা কি দেখে ফেললো তার অশান্তি লাগছে। মন থেকে চাইছে এই লেখার সঙ্গে যেন ইমতিয়াজের লেখা না মিলে। আর তাছাড়া তার আপার যে ছেলের সঙ্গে আলাপ ছিল তার নাম তো আরফান মজুমদার। তাহলে হাতের লেখা মিলে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। সে নিজেই ভুলভাল ভাবছে। রাগান্বিতা যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত ঠিক তখনই রাগান্বিতার কক্ষের দুয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে বললো ইমতিয়াজ,
“বউ।”

“বউ” শব্দটা কানে আসতেই রাগান্বিতার রুহু সমেত যেন কেঁপে উঠলো। রাগান্বিতা ঘাবড়ে গেল। আরফানের লেখা চিরকুটটা দ্রুত লুকিয়ে পিছন ফিরে তাকালো। ইমতিয়াজ এগিয়ে আসলো। ইমতিয়াজ যত এগিয়ে আসছে রাগান্বিতা তত ঘাবড়াচ্ছে। তার বুক কাঁপছে, হৃদয় লাফাচ্ছে, অস্থিরতায় চারপাশ বুঝি নড়েচড়ে উঠছে। এ কেমন অসহ্যকর অনুভূতি! রাগান্বিতা নিতে পারছে না।

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার চোখ-মুখের হাবভাব পর্যবেক্ষণ করলো। শীতল সুরে শুধালো,
“কিছু কি হয়েছে বউ? তোমায় খুব অস্থির দেখাচ্ছে।”

রাগান্বিতা কেমন এক ছলছল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের দিকে। হাতে তখনও আরফানের পাঠানো চিরকুটটা। খুব শক্ত করে মুঠোবদ্ধ করে চেপে ধরলো চিরকুটটা। ইমতিয়াজ আবার বললো,
“কি হলো তুমি কথা বলছো না কেন?”

রাগান্বিতা তাও কিছু বললো না। তার কেমন সবটা এলোমেলো লাগছে। রাগান্বিতা অনেক ভেবে প্রশ্ন করলো,“আরফান মজুমদার নামে আপনার কোনো বন্ধু আছে?”

ইমতিয়াজ থমকে গেল। এ কি প্রশ্ন করে বসলো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ অবাক হয়ে বললো,“কেন?”

রাগান্বিতা বিতৃষ্ণা নিয়ে বললো,“যে প্রশ্নটা করলাম তার উত্তর দিন না আপনার কোনো বন্ধু আছে বা ছিল আরফান মজুমদার নামে?”

ইমতিয়াজ স্তব্ধ হয়ে পালঙ্কে বসলো। মিনিট দুই যেতেই বললো,“হুম ছিল।”

সঙ্গে সঙ্গে দমে গেল রাগান্বিতা। ঠান্ডা পরিবেশ। রাগান্বিতা এগিয়ে গিয়ে বললো,“সে কই?”

ইমতিয়াজ মাথা নিচু করে বললো,“বেঁচে নেই।”

রাগান্বিতা এবার ইমতিয়াজের পাশে পালঙ্কে বসলো। স্তব্ধ হয়ে বললো,
“মারা কি করে গেল?”
“জানা নেই। তবে জানো ও না প্রায় আমার হাতের লেখার কিছু চিরকুট নিতো। কাকে যেন পাঠাতো আমার জানা নেই।”

রাগান্বিতার এবার যেন সবটা ঠিক লাগছে। চারপাশ ফুলের মতো সুবাসিত মনে হচ্ছে। মনের সব অস্থিরতা এক নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল। শান্তি লাগলো বুঝি অন্তরে। ইমতিয়াজ প্রশ্ন করলো, তা তুমি হঠাৎ ওর নাম জানতে চাইলে কেন? তুমি জানতে ওকে।”

চমকে উঠলো রাগান্বিতা। এবার কি বলবে? রাগান্বিতা আচমকা কেঁদে উঠলো। ইমতিয়াজ ভড়কে গেল। বললো,
“আরে আরে তুমি কাঁদছো কেন?”

ইমতিয়াজ তার হাতের পিছনে লুকিয়ে রাখা চিরকুটটা বের করলো। এগিয়ে দিল ইমতিয়াজের দিকে। বললো,
“আরফান মজুমদার এই চিরকুটটা আপাকে দিয়েছিল।”

ইমতিয়াজ চিরকুটটা দেখলো। অনেকক্ষণ ধরে দেখলো। চমকে বললো,“এই হাতের লেখা তো আমার।”

ইমতিয়াজ তাকালো রাগান্বিতার দিকে। রাগান্বিতা বললো,“আমায় খুন করুন?”

ইমতিয়াজ কয়েককদম পিছনে চলে গেল। হতভম্ব হয়ে বললো,
“এসব কি বলছো?”
“আপনায় নিয়ে আমার আর ভুলভাল চিন্তা আসার আগে আমার মরণ হোক। কঠিন এক মৃত্যু। যে স্ত্রী তার স্বামীকে এক পলকে অবিশ্বাস করে তার ভয়ংকর মৃত্যু হোক।”

ইমতিয়াজ নিশ্চুপ হয়ে গেল। রাগান্বিতাও চুপ। চারপাশ থমথমে, বিষণ্ণ। কি এক বিচ্ছিরি পরিবেশ!’
—-
এরপর কেটে গেল টানা পনের দিন। মাঝে ইমতিয়াজ একবার জরুরি কাজে শহরে গিয়েছিল আবার ফিরেও আসে। রেজওয়ানকে বাড়িতে দেখা যায় না তেমন। বাড়িতে ঢুকলেই নাকি সব কেমন লাগে দাদিমা নেই, কুহু নেই। প্রাণ প্রিয় বন্ধুটাও নেই। কিছু ভালো লাগে না রেজওয়ানের কষ্ট হয়। কিন্তু ধরা দিতে চায় না। পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায় রাগান্বিতা বুঝে তা। নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।”

নিঝুম রাত। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। ইংরেজি মাস সেপ্টেম্বর ছাড়িয়ে অক্টোবরে পা রেখেছে। শীতের আবহাওয়া বুঝি আসছে। রাগান্বিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। কাল তারা চলে যাবে দাদিমা, কুহু আপা, বাবা, দাদাভাই, রামুদা সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে রাগান্বিতা। রাগান্বিতা এই পনের দিনে রোজ বিকেলে যেত দাদিমা আর কুহুর কবর স্থানে। কত অভিযোগ করতো! কুহুকে খালি বকতো। কেন সে তাকে কিছু বলে নি? কেন জীবিত থাকতে জানালো না আরফান মজুমদারের কথা। রাগান্বিতা ভেবেছিল কোনোদিন আপার সঙ্গে অন্যায় করা ব্যক্তিটির সাথে দেখা হলে নিজ হাতে খুন করবে। কিন্তু তা আর হলো না কারণ লোকটা আরো আগেই মারা গেছে। এই জন্যই বলে যে যেমন করে তার সঙ্গে ঠিক তেমনই হয়।”

বারান্দায় রাগান্বিতার পাশে এসে দাঁড়ালো ইমতিয়াজ। নীরব স্বরে বললো,
“বৃষ্টি দেখছো?”
“না শুনছি।”
“একা একা ভালো লাগে শুনতে?”
“একা কই আপনি আছেন তো।”
“আমি তো মাত্র এলাম।”
“আমিও মাত্রই শুনতে বসেছি।”

হাসে ইমতিয়াজ। বলে,
“দিনে দিনে বড্ড বেশিই ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছো তুমি।”

রাগান্বিতা অবাক হয়ে বলে,
“কেন কি করেছি আমি?”
“কিছু করো নি আমি ভেবে নিয়েছি।”
“উল্টোপাল্টা ভাবা কিন্তু ঘোর অন্যায়।”
“তোমায় নিয়ে যাই ভাবি তাই ন্যায়।”

লাজুক হাসে রাগান্বিতা। হাত পাতে বৃষ্টির পানিতে। বৃষ্টির পানি গায়ে লাগতেই শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে। শীতের ছোঁয়ায় গায়ের পশম যায় দাঁড়িয়ে। ইমতিয়াজের গায়ে জড়ানো ছিল একটা কালো রঙের পাতলা চাদর। ইমতিয়াজ সেটা তার গা থেকে সরিয়ে রাগান্বিতার গায়ে জড়িয়ে দিলো। বললো,
“শীত আসছে তোমার কি লাগবে বলো?”
“কিচ্ছু চাই না আমি শুধু আপনি থাকলেই চলবে।”

ইমতিয়াজ কি মিষ্টি হাসি দিল। রাগান্বিতার কথাটা যেন বেশ চমৎকার শোনালো। কথাটা যেন আবার বাজলো ইমতিয়াজের কানে। কি সুন্দর বললো, “কিচ্ছু চাই না আমি শুধু আপনি থাকলেই চলবে”!
—-
বর্তমান,
“সত্যি কথাটা দারুণ শোনালো, কিচ্ছু চাই না আমি শুধু আপনি থাকলেই চলবে।”

ইলিয়াসের কথা শুনে রামু তাকালো ইলিয়াসের দিকে। বললো,“ডাক্তার বাবু আমনে বহেন আমি রাগান্বিতা আফারে খাওন দিয়াই।”

ইলিয়াস শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো রামুর দিকে। বললো,
“পুরোটা তো শেষ করলে না।”

রামু কেমন এক দৃষ্টি নিয়ে মায়া মায়া কণ্ঠে বললো,
“খাওনডা দিয়াই তারপর শেষ করতাছি।”

রামু কথাটা এমন ভাবে বললো যে ইলিয়াস আর বারণ করতে পারলো না। বললো,ঠিক আছে যাও তাড়াতাড়ি এসো।”

রামু চলে গেল। ইলিয়াস বসে রইলো। ভাবলো,“সবই তো ঠিক ছিল। ইমতিয়াজকে নিয়ে ভাবনাটাও ভুল হলো। আরফান মজুমদার আলাদা ব্যক্তি ছিল। ইলিয়াস ভেবেছিল ইমতিয়াজই আরফান মজুমদার হবে। কিন্তু পরে তো শুনলো না আরফান মজুমদার আলাদা কেউ। আর রাগান্বিতাও সব ভুলে স্বাভাবিক হয়ে গেল। তাহলে পরে কি ঘটলো? যে রাগান্বিতা পাগল হয়ে গেল। আর ইমতিয়াজ সে কেন হারালো। তার তো হারানোর কথা নয়।”

ইলিয়াস বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। রামু রাগান্বিতার ঘরে খাবার দিয়ে আসলো। মেয়েটা নীরব, চুপচাপ বসে আছে পালঙ্কে। রামুর চোখ ভেসে আসলো। যতবার রাগান্বিতার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা ভাবে ততবার তার হৃদয় কাঁদে। বার বার মনে হয় নিয়তি এত নিষ্ঠুর কেন ছিল!”

অতীত,
“ভালো থাকিস মা। আমাদের জন্য ভাবিস না বাড়িতে রামু আছে,রেজওয়ান আছে এছাড়াও গ্রামের মানুষজন আছে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরাও ঠিক থাকবো। আর কিছুদিন গেলেই রেজওয়ানের জন্য বউ আনবো। ব্যস তাহলেই পরিবারটা আবার একটু একটু করে গুছিয়ে যাবে।”

রেশবপুরের ঘাটপাড়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বললো রাগান্বিতার বাবা রাগান্বিতাকে। রাগান্বিতা শক্ত হয়ে দাড়িয়ে। কাঁদছে না। রেজওয়ান দূরে দাঁড়িয়ে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার পাশে। মোতালেব তালুকদারের বলা সব কথাই শুনেছে সে।”

সময় গড়ালো নৌকায় চড়ে বসলো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ মোতালেব তালুকদারের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভালো থাকবেন জমিদার সাহেব।”

বিনিময়ে মোতালেব তালুকদারও মৃদু হেসে বলে,
“তোমরাও ভালো থেকো।”

নৌকা একটু একটু করে চলে গেল সূদুরে।’

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪৩
________________
সময়গুলো বড্ড বেমানান। চারপাশ কেমন ঝাপসা ঝাপসা। রাগান্বিতার প্রতিদিনটা কাটছে একা একা। দাদিমার কথা ভাবলেই কান্না আসে তার। কিন্তু কাঁদে না। রাগান্বিতা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর কাঁদবে না। বাবার কথাটা রাখতে হবে তাকে। রাগান্বিতারা রেশবপুর থেকে এসেছে আজ পুরো ত্রিশদিন কেটে গেল। রবিন তার বউ বাচ্চাকে তাদের বাড়িতে রেখে এসেছে রাগান্বিতারা রেশবপুর থেকে ফিরে আসার আগেই। রাগান্বিতা এতে খানিকটা অভিমানও করেছিল কিন্তু রবিন বলেছে পরে আবার আনবে। ইমতিয়াজ আবার কেমন একটা হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে তেমন একটা থাকছে না সেই সকালে যাচ্ছে আবার রাত করে ফিরছে। কখনো দেখা হচ্ছে, কখনো হচ্ছে না। রাগান্বিতা ঘুমিয়ে পড়ছে। তবে প্রত্যেক সকালে ইমতিয়াজের বুকে নিজেকে ঠিকই দেখছে। মনে মনে মুচকিও হাসছে। মানুষটা তাকে খুব ভালোবাসে এটা বুঝে গেছে রাগান্বিতা। হয়তো কাজের চাপে সময় দিতে পারছে না।

ইমতিয়াজ কিছু একটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছে কিন্তু কি তা, এটা ধরতে পারছে না রাগান্বিতা। রাগান্বিতার খারাপ লাগে, কেমন যেন একাকিত্ব ঘিরে ধরছে তাকে।’

বুধবার রাত ন’টা। বাড়িতে হাঁটছে রাগান্বিতা। রবিন রন্ধনশালায় আছে এক্ষুণি চলে যাবে। রাগান্বিতা নিচে নেমে এলো। রবিন তখন হাতে করে একটা ব্যাগ টেবিলের উপর রেখে বললো,“রাগান্বিতা আমি বাড়ি গেলাম তুমি খাইয়া দাইয়া শুইয়া পইড়ো আইজগো ইমতিয়াজের আওনের দেরি হইবো।”

রাগান্বিতাও বেশি কিছু না ভেবে বললো,
“ঠিক আছে। সাবধানে যাবেন।”

রবিন মুচকি হেসে বলে, “তুমি খুব ভালা রাগান্বিতা। সাবধানে থাইকো আমি গেলাম।”

মৃদু হাসে রাগান্বিতা। রবিন টেবিলের উপর থেকে ব্যাগটা নিয়ে চলে গেল বাহিরে। ব্যাগের নিচে ছিল রবিনের একটা রুমাল সেটা গড়িয়ে পড়লো নিচে। রবিন খেয়াল না করে শুধু ব্যাগটা নিয়েই বেরিয়ে গেল। রাগান্বিতাও তার পিছু পিছু গেল সদর দুয়ারখানা আটকে দিতে। রাগান্বিতা দুয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে আবারও বললো,“সাবধানে যাবেন চাচা।”

বিনিময়ে রবিন মৃদু হেসে বললো, ঠিক আছে দুয়ার আটকাইয়া দেও।”

রাগান্বিতা দিল। এটা রোজই করে রাগান্বিতা দুয়ার আঁটকে দেয় এরপর রবিন যায়। না হলে নাকি তার মনের ভিতর খচখচ করে এমনটা বলে রবিন। রাগান্বিতাও মেনে নেয়।

রাগান্বিতা দরজা আটকে নিজের কক্ষে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়। টেবিলের কাছ দিয়ে যেতেই নিচে রবিনের রুমালটা নজরে আসলো রাগান্বিতার। সে দ্রুত রুমালটা উঠালো। এটা রবিন চাচার খুব পছন্দের রুমাল তার বউ বানিয়ে দিয়েছে। রাগান্বিতা একবার ভাবলো রুমালটা কাল দিবে আবার ভাবলো বেশিদূর যায় নি বোধহয় যদি রুমাল না পেয়ে সারারাত দুশ্চিন্তা করে। রাগান্বিতা রুমালখানা নিয়ে সদর দুয়ার খুললো। অন্ধকার রাত। তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। সেইদূরে চলে গেছে রবিন। রাগান্বিতা রবিন চাচা বলে ডাক দিবে। কিন্তু তার আগেই রাগান্বিতা দেখলো রবিন চাচা বাড়ির গেটের কাছে না গিয়ে পিছনের দিকে যাচ্ছে। হাতে হেরিকেন। রাগান্বিতার খটকা লাগলো এই রাতের বেলা রবিন চাচা ওদিকে কোথায় যাচ্ছে। বাহিরে শীতের আমেজ নেমেছে নভেম্বরের প্রথম রাত চলছে। এক ঠান্ডা বাতাস রাগান্বিতার পুরো শরীর নাড়িয়ে দিলো। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালো। আচমকাই রাগান্বিতার খোপা করা চুলটা খুলে গেল। সে শক্ত করে চুলটা বাঁধতে বাঁধতে পিছু নিলো রবিনের। রাগান্বিতা দেখতে চাচ্ছে রবিন চাচা যাচ্ছে কই!”

রাগান্বিতা ধীরে ধীরে পিছু নিলো রবিনের। দুরত্ব খুব অল্প। রবিন বাড়ির পিছন দিকটায় এসেই আশেপাশে তাকালো। রাগান্বিতা দ্রুত বাড়ির দেয়ালের পিছনে লুকানো। রাগান্বিতা দেখলো সেই ডালপালা জুড়ে থাকা লাঠিগুলো সরাচ্ছে রবিন। রাগান্বিতার বুঝতে সময় লাগলো রবিন কি করতে চাইছে। রবিন দ্রুত দ্রুত ডালগুলো সরিয়ে একটা দরজার মতো ঢাকনা খুললো সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে গভীর আঁধার বুঝি ধেঁয়ে আসলো বাহিরে। রাগান্বিতা স্তব্ধ বিস্মিত, বাড়ির পিছনে এমন সুরঙ্গের মতো আছে এটা তো সে জানতোই না। রাগান্বিতার সন্দেহের বীজ আবার লাগলো। ভাবলো,“তবে কি এই কারণেই ইমতিয়াজ তাকে এদিকে আসতে বারণ করেছিল। নাকি ইমতিয়াজও এটা সম্পর্কে কিছু জানে না।”

রবিন তার পকেট থেকে একটা চাবি বের করলো। তারপর ঢাকনা খুলে ভিতরে গিয়ে ঢাকনার দুয়ার আবার আঁটকে দিল। পড়ে গেল কিছু ডালপালা। রাগান্বিতা যেন তার চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মানে সেদিন বিকালেও রবিন এটার ভিতর ঢুকে যাওয়ায় রাগান্বিতা আর তাকে দেখতে পায় নি। কিন্তু এটার ভিতর আছে কি। রাগান্বিতা এগিয়ে গেল ডালপালা সরালো কিন্তু ঢাকনা খুলতে পারলো না কারণ চাবি নেই। রাগান্বিতার অস্থিরতা আর কৌতুহল দুটোই বেড়ে গেল। তার জানা চাই এটার ভিতর কি আছে কিন্তু চাবি কই! একই অন্ধকার। তারওপর চারপাশ কেমন থমথমে। রাগান্বিতা হতাশ হয়ে ওখান থেকে ফিরে এলো। সে কি এ বিষয়ে ইমতিয়াজকে কিছু জিজ্ঞেস করবে আবার ভাবলো না তাকেই আগে দেখতে হবে ওটার ভিতর কি আছে।”
—–
রবিন হাতে হেরিকেন আর ব্যাগ নিয়ে ভিতরে আসলো সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো। বিশাল একটা কক্ষ। চারপাশে হেরিকেন জ্বলছে। একখানা টেবিল আর একখানা চেয়ার শুধু। রবিন হেরিকেন হাতে এগিয়ে গেল কারো সামনে। কেউ আছে সেখানে। রবিন কতদূর যেতেই ভাড়ি কণ্ঠে শুধালো কেউ,“রাগান্বিতা কি জেগে আছে চাচা?”

রবিন পিছন থেকেই বললো,“হয় তবে কইয়া আইছি তুমার জন্য বইয়া না থাকতে খাইয়া দাইয়া যেন হুইয়া পড়ে।”

এবার পিছন ঘুরলো ইমতিয়াজ। চোখে মুখে অশেষ রাগের ছাপ। চোখ দুটো অসম্ভব লাল। রবিন ঘাবড়ে যায় ইমতিয়াজের সেই চোখ জোড়া দেখে। বলে,
“যা হইছে তা কি ভোলন যায় না?”

ইমতিয়াজ জবাব দেয় না। রবিন দাঁড়িয়ে রয়। অনেকক্ষণ যাওয়ার পর ইমতিয়াজ একটা ছবিতে হাত বুলিয়ে বলে,
“আজ রাত ১২টায় ওর মৃত্যুর পুরো একবছর পূরণ হবে তাই না চাচা।”

রবিন মাথা নিচু করে বলে,“হয়।”
—-
চিন্তিত মুখ। থমথমে চেহারা। চারপাশ কেমন ঘুরছে। ওই সুরঙ্গের মতো জায়গাটার ভিতর কি আছে জানতে চায় রাগান্বিতা তাকে জানতেই হবে। ইমতিয়াজ কি এ সম্পর্কে অবগত নাকি অবগত নশ। আচ্ছা রবিন চাচা তাদের আড়ালে কোনো বেআইনি কাজ করছে না তো। রাগান্বিতার পিলে চমকে উঠলো তার অস্থিরতা বাড়ছে। সেই চারঘন্টা যাবৎ এসবই ভাবছে সে। আচমকাই কারো কণ্ঠ বুঝি কানে বাজলো। কেউ বললো,“আমি কাল এক জায়গায় যাবো রাগান্বিতাকে দেখে রেখো।”

রাগান্বিতা জানালার আড়াল দিয়ে উঁকি মারলো। কণ্ঠটা চেনা। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের চেহারাটা দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে যেন আরো চমকে গেল তার মানে ইমতিয়াজও জানে ওই জায়গাটার সম্পর্কে। রাগান্বিতা ঘামছে। অজানা এক ভয় তাকে গ্রাস করছে। তবে কি সত্যি সত্যি ইমতিয়াজ তার থেকে কিছু লুকিয়েছে। কিন্তু কি লুকিয়েছে? কেনই বা লুকিয়েছে!’

ইমতিয়াজ বাড়ির ভিতর ঢুকলো না। রবিনকে সঙ্গে নিয়ে কোথায় যেন গেল। রাগান্বিতা নিচে বসে পড়লো। কি চলছে তার আড়ালে? রবিন আর ইমতিয়াজ এরা দুজন যে তার আড়ালে কিছু করছে এটা বেশ বুঝতে পেরেছে রাগান্বিতা। কিন্তু কি সেটা?”

রাগান্বিতা আনমনে বিড়বিড় করে বললো,
“আপনি যা তা যদি মিথ্যে হয়, আমি মানবো কেমন করে।”

পরক্ষণেই মাথা নাড়ালো রাগান্বিতা নিজেকে বোঝালো হতেই পারে ওখানে তাদের ব্যবসার কোনো কিছু ছিল। ইমতিয়াজ বলে নি,হয়তো বলবে। হয়তো কাজের জন্য সময় হয়ে উঠছে না। হতেই পারে। হা এমনটাই হয়েছে। আগের বারও ভাবনায় ভুল হয়েছিল এবারও হবে। রাগান্বিতা অপেক্ষা করবে ইমতিয়াজের বলার। তবে তার আগে সে দেখতে চায় ওখানে কি আছে?”

সময় গড়িয়ে গেল। রাগান্বিতা ঠায় বসে রইলো নিচে। তখন পুরো গভীর রাত। কিছু খোলার আওয়াজ আসলো। রাগান্বিতা কেঁপে উঠলো সে দ্রুত বসা থেকে উঠে পালঙ্কে শুয়ে পড়লো। রাগান্বিতা চাচ্ছে না ইমতিয়াজ তাকে এভাবে দেখুক।”

ইমতিয়াজদের বাড়িতে একটা গোপনীয় জানালা আছে যেটা দিয়েই ইমতিয়াজ রোজ রাতে বাড়িতে ঢোকে। রাগান্বিতা ঘুমিয়ে পড়ে বিধায় আর সদর দুয়ার খোলা হয় না। ইমতিয়াজও দুয়ার নাড়িয়ে শব্দ করে না।”

ইমতিয়াজ জানালা আঁটকে। বাড়ির ভিতর ঢুকলো সে নতুন টেলিফোন কিনে এনেছে। তবে এক্ষুণি চালানো যাবে না একটু সময় লাগবে। রাগান্বিতা দেখলে খুব খুশি হবে। তবে এখন সে দেখাবে না। পরশু দেখাবে। ইমতিয়াজ টেবিল থেকে একটু আড়ালে টেলিফোনটা লুকিয়ে রাখলো। একটা চিরকুট রাখলো। যেখানে লেখা ছিল,“শুধুমাত্র তোমার জন্য বউ।”

ইমতিয়াজ মিষ্টি হেঁসে। আড়াল করলো সেটা। পরশু বিহীন দেখানো হবে না।

ইমতিয়াজ দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে নিলো উপরে হঠাৎই নজর গেল টেবিলের ওপর সব খাবার সাজানো তারমানে রাগান্বিতা আজও না খেয়ে ঘুমিয়েছে। ইমতিয়াজ ভাবলো আজ আর বউয়ের ভোলা ভোলা ঘুমে জড়ানো মুখখানা দেখে চুপ থাকবে না। আজ সে নিজ হাতে বউকে খাইয়ে দিবে।

ইমতিয়াজ খুশি মাখা মুখ নিয়ে উপরে ছুটে গেল। আজ বোধহয় সে খুব খুশি। কোনো এক কাজের সমাধানের সন্ধান বুঝি পেয়ে গেল।”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে