প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু : Mahabuba Metu
পর্ব: ৩৭
ভর দুপুরে মীরা রিকশা-যোগে ক’ব’র’স্থা’নে পৌছায়। ঘড়িতে সময় তখন দুপুর দেড়টা। ভাদ্রের তপ্ত রোদে জনজীবন তখন অতিষ্ঠ, জরুরি কোন কাজ না থাকলে মানুষ এ সময়টা বেরুতে চায় না ঘর থেকে । কিন্তু মীরা বেছে বেছে রোদ মাথায় করেই এলো এখানটায়। মীরা যখন ক’ব’র’স্থা’নের ফটক পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলো, দমকা বাতাাস স্বাগত জানালো ওকে। এক দন্ড দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে পুরো জায়গাটাকে দেখে নিলো মীরা, জায়গাটা পুরো ফাঁকা। চলাচলের রাস্তা যদি ফাঁকা থাকে সেটাকে দেখতে কিন্তু অস্বস্তি হয়, আর এটা তো ক’ব’র’স্থা’ন এখান অস্বস্তি আরো বেশি হওয়ার কথা।
মীরা ভীতু প্রকৃতির মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও ওর একটুও ভয় করলো না সেখানে যেতে। বাবাকে দেখার ইচ্ছে ভয়কে উপেক্ষা করেছে যেন। সেখানে পা রাখার সাথে সাথে ওর মনে হলো ও ভিন্ন কোন জগতে পা দিলো ও । যেখানে শব্দদের প্রবেশ নিষেধ, সম্পর্কের মায়াবী বাঁধন যেখানে তুচ্ছ, দুনিয়ার চাকচিক্য যেখানে অর্থহীন। নিরব, শান্ত, কোমল আত্নীক শান্তি ছড়িয়ে আছে চারদিকে। যত যাই করুক মানুষ, যতই হোক ব্যাস্ত, দিন-শেষে এটাই তো সব মানুষের শেষ গন্তব্য।
একই রকম দেখতে অনেকগুলো সারি সারি ক’ব’র, দেখতে যেন ধাঁধার মতো। তা সত্ত্বেও বাবাকে খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয় নি ওকে। ধীর পায়ে বাবার খুব কাছে এসেছে মীরা। ধীরে-সুস্থে মাথার কাছটায় বসে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেয় মাটিতে। ওর হাত বুলানোর যত্নে মনে হচ্ছে ও যেন মাটিতে না হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ওর বাবার গায়ে। ঘুমানোর আগে নূহার শরীরে হাত বুলায় যেমন তেমনি। বাবাকে কত দেখতে ইচ্ছে হতো ওর, হ্যা শুধু বাবাকেই। কিন্তু পারতো না, কারন তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন তার বড় মেয়ে ম’রে গেছে। আবীরের সাথে ডি’ভো’র্সে’র দিন মৃ’ত ঘোষণা করেছিলেন তিনি মীরাকে। তারপর আর দেখা নাই, কারো সাথেই না। মীরা চেষ্টা ও করে নি, কি করে করতো? এই মুখ দেখানোর কোন রাস্তাই খোলা রাখেনি মীরা। বিয়ের পরপরই যে তাদের অভিমান ভাঙাবার চেষ্টা, তাদের কাছে গিয়ে ধরনা দিবে সে সময়টাও জীবণ ওকে দেয় নি। জীবণ এই রুষ্ঠ ওর প্রতি যে ওকে ব্যাস্ত রেখেছে ভুলের রাজ্যে। মাঝে মাঝে মনে হয় এসব যেন পূর্ব নির্ধারিত। তা না-হলে সবাই কিভাবে বুঝলো যে ও ভুল করতে যাচ্ছে? এখন না বুঝলেও যখন টের পাবে ভুলের গন্ধ তখন আর কিছুই করার থাকবে না। নাক দিয়ে একটা শব্দ তৈরী করলো মীরা। নিজেকে ধিক্কার দিলো যেন।
বাবাকে শেষ দেখার চেষ্টা করলো যখন তারা মীরাকে সফল হতে দেয় নি। মাকে দেখে যে মন শান্ত করবে তাও পারে নি ও। মীরাকে নিজের চেহারা না দেখানোর কত চেষ্টা ছিলো সেদিন ওর মায়ের । ভাইটাকে দেখে নি ও, বোধহয় ব্যাস্ত ছিলো। আর
ইরা মুখ শক্ত করে বসে ছিলো সেদিন। ওকেই একমাত্র দেখতে পেয়েছিলো মীরা। কিন্তু মীরার দিকে অবহেলা কিংবা দয়ার চোখে ও তাকায় নি ইরা। নিজেকে মীরার ন’র্দ’মার কীটের চেয়েও নগন্য মনে হয়েছিলো তখন । মীরা পালানোর পর বাবা-মাকে কিসের ভিতর দিয়ে যতে হয়েছিল তা ওর চেয়ে ভালো আর কে জানে? এটাই হয়তো ইরার মীরাকে ঘৃণা করার কারন। যাক ঘৃণা তো করেছে! এই ওর অনেক মীরার কাছে।
অথচ বাবাকে এখন দেখতে এসেছে মীরা বাঁধা দেওয়ার কেও নেই। নিথর শুয়ে আছেন তিনি ক’ব’রে নামের ঘরটায়। বাঁধা দেওয়ার সামর্থ ইশ্বর তাকে দিতেন যদি, তিনি ঠিকই বাঁধা দিতেন।
চারপাশে চোখ বুলায় মীরা। এখনো তেমনি ফাঁকা চারপাশ। এ সময়টা পুরো ফাঁকা থাকবে জায়গাটা, তাই বেছে বেছে ও এই ভর দুপুরেই এখানটায় এসেছে। তপ্ত দুপুরে বিশাল এ ক’ব’র’স্থা’নটাকে এত নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে যে রাতের নিস্তব্ধতার কথা মনে পরে যায়। শহরের কোলাহল, জ্যাম, অশান্তির ভীড়ে এই এক শান্তির জায়গা। এখানে এলে পার্থিব ভাবনা ফিঁকে হয়ে যায়। পরকালের চিন্তা মনে গাঁথে।
আজ একটা বিশেষ কারণে এখানে এসেছে মীরা ।
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মীরা কথা বলছে। যেন কোন কাজের পরিকল্পনার আলাপ করছে ও। আজ ও এসেছে বাবার কাছে দোয়া চাইতে। জীবণের নতুন একটা অধ্যায় শুরু করছে মীরা। নতুন করে স্বপ্ন বুনা শুরু হবে আজ থেকে। তা বাবাকে জানাতেই যেন ওর এখানে আসা।
বাবার সাথে দেখা শেষ করে, এখানকার অফিসে যায় মীরা। সেখানে গিয়ে দেখে পরিচালক লোকটা এখানে নেই। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে মীরা। ও যখন এ রুমটায় ঢুকেছে সূর্য তখন মাথার উপর ছিলো৷ সূর্য তার গন্তব্যের পথে একটু হেলে গেছে। তবুও লোকটার আসার নাম গন্ধ নেই। অপেক্ষা জিনিসটা খুবই কষ্টের। অবশেষে তিনি এলেন সাড়ে তিনটার কিছু পরে। মীরাকে দেখে লোকটার কপালে চিন্তার ভাঁজ পরলো। যার মানে তিনি মীরাকে চিনতে পেরেছেন। মীরা মৃদু হেসে দাঁড়িয়ে সালাম দেন। লোকটা ব্যাস্ত ভঙ্গিতে ভিতরে যেতে নিলে মীরা বলে-
: ” আমি আড়াইঘন্টা ধরে আপনার সাক্ষাতের অপেক্ষায় বসে আছি, যদি দু’টো মিনিট সময় দিতেন”
লোকটার চেহারায় কাঠিন্য ভাব স্পষ্ট। চোখের দৃষ্টি ক্রখর, তা দেখে বেঝাই যায় অনেক দখেছেন তিনি। কিন্তু ঐ রাতে এমন ছিলো না, রাত হলে কি চেহারার কাঠিন্য বোঝা যায় না, পড়া যায় না চোখ? এসব হাবিজাবি চিন্তা করতেই লোকটা বললো-
: ” গত দিনের মত উদ্ভট কিছু না তো?”
উত্তরে মীরা মিষ্টি করে হাসে, বলে-
: ” আমি বরাবরই একটু ডিফরেন্ট কি না”
: ” অনকে মানুষ দেখেছি আমি, আপনার মতো বাবাকে ভালোবাসতে কাওকে দেখি নি ”
মলিন একটা হাসি হেসে মীরা মনে মনে বলে- ” কি জানেন আপনি আমার ব্যাপারে? কিচ্ছু না, আমি আমার বাবাকে অসম্ভব ভালোবেসে অনেক যত্ন করে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছি”
লোকটা গটগট করে তার অফিস কক্ষে চলে যায়।
মীরা অফিস ঘরে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে কাল বিলম্ব না করে একটা আর্জি জানিয়ে আসে সেখানকার পরিচালকের কাছে। সে ওর কথাটা শুনে চুপচাপ থাকে৷ মীরার আর্জি সে রাখবে কি না তা বোঝা যাচ্ছে না। তার উত্তরের অপেক্ষা ও করে না মীরা। উঠে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। সত্যি দু’মিনিটের বেশী নেয় নি ও। কারন ওর পেশ করা আর্জি পূরণ হতে অনেক সময় রয়েছে ওদের হাতে। এটা তাকে আগাম জানিয়ে দেয়া আর’কি। ফিরবার পথে মীরা কিছু টাকা দানবাক্সে ফেলে বাড়ি চলে আসে।
বাড়ি ফিরে মীরা ফ্রেশ হয়। মেয়েকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে ওরও তন্দ্রার মতো আসে৷ কিন্তু চেখে মুখে পানি দিয়ে তন্দ্রাকে ভাগিয়ে দেয় ও। দুপুরের খাওয়া বিকেলে শেষ করে ল্যাপটপ নিয়ে বসে। মাগরিবের আজান পর্যন্ত কাজ করে ও। নামাজের পর একটা কল আসে মীরার ফেনে। তারপর তৈরি হয়ে কি এক কাজে বাইরে যায় ও।
সেদিন রাতে মীরা রাজিবকে বলে পিয়াসার সাথে ও ইন্ডিয়া যাবে৷ কথাটা রাজিবকে এমন ভাবে বললো মীরা যেন ওর অনুমতি চাচ্ছে না, ও যে যাবে ইন্ডিয়া সেটা জানিয়ে রাখলো। রাজিব ভুরু কুঁচকে তাকালো ওর দিকে। কিছু সময় পর কি ভেবে যেন কপালের ভাঁজ গুলো মিলিয়ে গেলো। না শোনার ভান করে ফোন স্ক্রোলিং চালু রাখলো। মীরা বেশ অবাক হলো। যে লোক বন্ধুদের সাথে দেখা করতে দিতে উসখুস করে, বন্ধুর বিয়ে কিংবা বেবী শাওরে যেতে পারমিশন নিতে যাকে অনেক অনুনয় বিনয় করতে হয় তার এত সহজে স্ত্রীর বিদেশ ভ্রমণে যাওটা মেনে নেয়া কেমন অস্বাভাবিক লাগার কথা না? মীরার ও লাগে। মনে মনে ভাবে – “রাজিব হয়তো ভাবলো কাজ হাসিলের আগে এখন ওকে রাগানো ঠিক হবে না” মীরা ঠিক এই সুযোগটাই কাজে লাগালো। আজকের তারিখটা টুকে রাখলো একটা ডায়েরিতে। ডায়েরি কভারে কালার পেন দিয়ে মোটা করেলেখা ছিলো – সেকেন্ড ইনিংস।
পরদিনের ব্যাংকের কাজ শেষ হলো বারোটার মধ্যে। সপ্তাহ-খানেক সময় লাগবে লোন পাশ হতে জানালেন ম্যানেজার। সেখান থেকে বেরিয়ে রাজিব চলে গেলো কারখানায় মীরা চলে গেলো বাড়িতে। গুছিয়ে রাখা কাগজপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেলো আবার ইন্ডিয়া এম্বাসিতে ভিসার আবেদন করতে। সেখান থেকে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।
মীরা খবর নিয়ে জেনেছে রাজিব যে বলেছিলো মালেক সাহেব (যেটা ওর নিজের ওকে দেয়া ছদ্ম নাম) মানে ও নিজে কলাবাগানে ফ্লাট কিনছে সেটা মিথ্যা কথা। ওরা ফ্ল্যাট কিনছে ওয়ারীতে। পুরান ঢাকার এখানকার ফ্ল্যাটগুলোর দাম মোটামুটি নাগালের মধ্যে। তাছড়া ঐদিকটা নিরিবিরি, ওয়ারী রাজধানী ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা , এখানে থাকাটাও নিরাপদ, পরিচিত কারো সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার ভয় নেই। তার উপর সাথী পড়াশুনা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে হিসেবে কলাবাগান থেকে ওয়ারী ভার্সিটি থেকে কাছে। যদিও এটা একমাত্র কারন না ওয়ারীতে ফ্ল্যাট কিনবার। ভার্সিটিতে তো আর একবছর যাওয়া আসা। রাজিব সাথীর পড়াশোনার ব্যাপারটা পছন্দ করে না। মেয়ে-মানুষের সক্ষমতা, যোগ্যতা যত কম স্ত্রী হিসেবে তারা তত পারফেক্ট। ঐ এক মীরাকে নিয়েই তো যন্ত্রণার শেষ নেই। মীরার সবচেয়ে অপছন্দের জিনিস হচ্ছে – ওর জ্ঞান আর
আত্ন-বিশ্বাস। তুই মেয়ে মানুষ তুই সামলাবি সংসার, বাচ্চা-কাচ্চা। তোর এত কিসের দরকার। তাই তো ও আহ্লাদ দেখিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে মীরার অনলাইন পেইজ।।
রাজিব অবশ্য সাথীর গ্রো-আপের গতিটাকে মন্থর করতে একটা ফন্দি এটেছিলো। ও সাথীকে জানিয়েছিলো ওর একটা ছেলে চাই। এ চাওয়ায় আকাঙ্ক্ষার চেয়ে বেশী ছিলো ওর পড়াশোনা বন্ধ করার ফন্দি। সাথী সোজা না করে দিয়েছে। এখনো জানাতেই পারলো না বিয়ের কথা, তার উপর বাচ্চা। সাথী এত কাঁচা মেয়ে না। তাই ও রাজিবের এ আবদারটা আমলে নেয় না । নিয়মিত বার্থ কন্ট্রোল পি’ল নেয় । যদি রাজিবের ব্যাপারটা পছন্দ না। সাথী রাজিবকে বোঝায় ইদে-চাঁদে ওকে এখনো বাড়ি ফিরতে হয়। এখন এ আবদার রাখা ওর সম্ভব না। রাজিবের জারিজুরি শেষে একটু যেন থিতু হয় ও। বেশী বাড়াবাড়ি করলে শেষে ওর কাঁধেই ঝামেলা বাড়বে।
এদিকে দেখতে দেখতে লোন দেওয়া দিন এগিয়ে আসে। সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মীরা। গোসল শেষ পূর্বনির্ধারিত ড্রেসটা পরে নেয় ও। দশটার সময় বাসা থেকে বেরুয় ওরা। সাড়ে দশটা নাগাদ পৌঁছে যায় ব্যাংকে। ব্যাংকটা শাহবাগে, আর ওদের বাসা কাঁটাবনে । প্রতিদিনের মতো বাইকেই গেলো দুজনে। ব্যাংকে গিয়ে লোনের যাবতীয় ফর্মালিটি শুরু করলো এগারোটা নাগাদ। ব্যাংক ম্যানেজারের ব্যাবহার অতিশয় আন্তরিক ঠেকলো মীরার কাছে। যাওয়ার সাথে সাথে চা-কফি নিয়ে হুলুস্থুল শুরু করে দিলেন ভদ্রলোক। ওরা জানালো চা খেয়েই বেরিয়েছে, কিন্তু ভদ্রলোক কিছুতেই মানছেম না। ভদ্রলোক মনে হচ্ছে চা-কফি না খাইয়ে ছাড়বে না।
তিনি মীরার প্রতি খুব বেশী এটেনশন দিচ্ছেন। পাশে যে রাজিব আছে তাকে মোটের উপর উপেক্ষাই করলেন তিনি। ভদ্রলোক বয়স হিসেবে মীরার বাবার সমবয়সী তবুও কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন মীরার শরীরের যত্রতত্র। সুন্দর হওয়ার এ আরেক জ্বালা। যদিও এসবে অভ্যস্ত মীরা। কাগজে সাইন করানের ছুতায় লোকটা মীরার হাত ছুঁয়ে দিলো একবার । এরপর মীরা সোজা হয়ে বসলো, বললো আপনি মার্ক করে দিন কোথায় কোথায় সাইন করতে হবে। তিনি কম দিয়ে টিক দিয়ে দেখিয়ে দেন কোথায় সাইন করতে হবে, মীরা কাগজটা ওর কাছে নিয়ে সাইন করে দেয়৷ মীরা প্রথমে সংকোচ অনুভব করলেও রাজিবের বিরক্তি বাড়াতে সহজ হলো, ও নিজেও গদগদ ভাব দেখালো ম্যানেজারের প্রতি। যদি মনে মনে বু’ই’ড়া-খা’টা’স বলে গালি দেয় ও লোকটাকে। লোকটা ম্যাডাম ম্যাডাম বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন। তার হাবেভাবে প্রকাশ করছেন তিনি মীরাকে লোনটা খুবই ঝামেলা করে ম্যানেজ করে দিয়েছে। রাজিব মনে মনে খুবই বিরক্ত তার এমন তেলতেলে আচরনে। কিন্তু টাকাটা ওর দরকার তাই ইচ্ছে হলেও কোন শক্ত কথা বলতে পারে না ও।
টাকাটা নিয়ে বেরিয়ে রাজিব মীরাকে বললো রিকশা করে বাসায় চলে যেতে। কিন্তু…
” ঠিক আছে, তুমি সাবধানে যেও ” – বলে মীরা রিকশা নিলো একটা, আর রাজিব সিকিউরিটির কথা ভেবে কাঁধে নেয়া ব্যাগটা ঘুরিয়ে বুকের দিকে নিলো।
শাহবাগ থেকে বাইকটা সোজা চলে গেলো পুরান ঢাকার লক্ষ্মী-বাজারের দিকে। সাথীকে সেখানেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে রাখে রাজিব। ভার্সিটির যাতায়াতের সুবিধার জন্য । বৃহস্পতিবার হওয়ায়
নয়াবাজার সিগনালের দিকে বেশ জ্যাম পরে। ঢাকার অন্যতম প্রবেশপথ হওয়ায় এ রোডটায় এমনিতেই জ্যাম লেগেই থাকে তার উপর সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার। জ্যামটা মিনিট পাঁচেক স্থায়ী ছিলো। জ্যামটা ছাড়ার সাথে সাথেই কোত্থেকে দু’জন লোক এসে রাজিবের দিকে ছুড়ি তাক করে ওর ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে এত সময় পর সিগন্যাল ছেড়ে দেয়ার কারনে সবার মনোযোগ ছিলো গাড়ির স্টার্টিং-এ। হতভম্ব রাজিব উপায়ন্তর না দেখে গাড়িটাকে ঘুরিয়ে পিছু নেয় ওদের। রাজিবের গাড়িও তখন চলমান। কিন্তু রায়সাহেব বাজারের দিকে আবারো সিগন্যাল পরে। ঐ বাইকটা দ্রুত সে সিগন্যাল পার হয়ে যায়। রাজিবের সামনে গাড়ি থাকায় ও আর পিছু নিতে পারে না সেই বাইকটার। বাইকটাকে রাজিব সেখানে ফেলেই নিকটবর্তী বংশাল থানায় সাহায্যের জন্য যায়। কিন্তু ততক্ষণে কচকচে এক হাজার টাকার নোটের বিশ লাখ টাকা নিয়ে হাওয়ার সাথে মিলিয়ে যায় দুজন।
আর এদিকে মীরার গোপন ফোনটায় ম্যাসেজ আসে- ” মিশন কম্পলিট ”
ম্যাসেজটা পড়ে সেটা ডিলিট করে ক্রুর হাসি হাসে মীরা।
চলবে….
প্রিয় ভুল
লেখা – মাহবুবা মিতু
পর্ব: ৩৮
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া কেও কপি করবেন না)
থানায় বসে থেকেই রাজিব কল করে ওর সব সময়ের দুঃখ সুখের সাথী মীরাকে। ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ননা করে জলদি আসতে বলে বংশাল থানায়। মীরা বলে আমিতো উত্তরা আসছি ইন্ডিয়ান ভিসা সেন্টারে। আমার পাসপোর্ট জমা দিয়েছিলাম, সেটাকে তুলতে। সার্ভারে কি না-কি সমস্যা হচ্ছে তাই দেরি হচ্ছে। বেশী সময় লাগবে না, তুমি চিন্তা করো না। আমি যত দ্রুত সম্ভব আসছি। কথাটা মিথ্যা ছিলো। ও তখন সিএনজিতে, গাড়ি তখনো পৌঁছায় নি যমুনা ফিউচার পার্কে। গাড়ি এখন বাড্ডা রোডে।
মিথ্যে বলার কারন হচ্ছে রাজিবের এই ঘোর বিপদে এবার মীরা ওর পাশে থাকবে না। এবার আর বিপদে মানসিকভাবে সাপোর্ট দিবে না ওকে৷ একা একা লড়ে দেখুক বিপদ কত যন্ত্রণার উদ্রেক করে মনে। মীরা তাই এবারকার স্ত্রী হিসপবে দায়িত্বটা কেবল হা-হুতাশ আর আফসোস করেই শেষ করলো।
রাজিবের হার্টের সমস্যার দরুন সব-রকমের ঝামেলা, বিপদ-আপদ সব মীরা একাই ফেস করেছে এতটা বছর। মানসিক চাপ কি বলে তা বুঝতেই দেয় নি রাজিবকে, পাছে ওর দূর্বল হার্টে এর প্রভাব পরে।
ওর জীবণটা হাসপাতালের পাখার মতো। একমাত্র লোডশেডিং না হলে হাসপাতালের পাখার যেমন কেন বিশ্রাম নেই। তেমনি ওর ও। রাতে ঘুমের সময় ছাড়া ওর ও কোন প্রকার বিশ্রাম নিষিদ্ধ যেন।
যে কোন ব্যাবসায়ই বেশ কয়েকটা ইনভেস্টের প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে ইদ-পূজার সিজন গুলোতে। এক ইনভেস্ট আটকে থাকে মালামাল কেনায়, একটা ইনভেস্ট থাকে কাস্টমারদের বাকীর খাতায়, আরেকটা চলমান খরচের জন্য। হাতে সব-সময় নগদ টাকা রাখতেই হয়। এদিকে ব্যাবসাটা মূলত তিনটা সিজনেই বেশ ভালো চলে। বাকী সময়ে চলে টুকটুক করে। কোন কোন মাসে খরচের টাকাও উঠে না এমনো হয়। লাভ-ক্ষতি মিলিয়েই ব্যাবসা, এজন্যই তো ব্যাবসা হালাল। ডাল সিজনটা মীরাকে চলতে হতো ব্যালেন্স করে। কিন্তু কোন কোন সময় দেখা যেতো টাকার জন্য স্টাফদের বেতন কি কারখানার ভাড়া দেয়া যাচ্ছে না। সেই সব সময়ে টাকা পয়সার দরকার হতো। রাজিব কখনোই এসবে পাত্তা দিতো না। উল্টো কখনো কখনো ঐ দুঃসময়ে ও নতুন মডেলের বাইক কিংবা এ্যাপেলের লঞ্চ করা আপডেট ফোন কিনবার ভুত চাপতো ওর মাথায়। রাগে, বিরক্তিতে, কষ্টে ঐ ঘোর দুঃসময়েও সেগুলোর জন্য মীরা টাকা দিতো ওকে। ও যেন মীরার শখ করে পোষা হাতি। যার থাকায় তেমন কোন উপকার নেই অথচ পুষতে বিশাল খরচের ধাক্কা।
এসব পরিস্থিতিতে মাঝেমাঝে মীরার নিজের গড়া গহনা বিক্রি করে দিতো, কখনো ব্যাংকে যে টাকাগুলো জমাতো ডিপিএস আকারে সেগুলোও ভেঙে টাকা ব্যাবসায় লগাতো। রাজিবের সাথে এসব ব্যাপারে আলাপ হতো খাবার টেবিলে। অথচ রাজিব একটা বারও বলতো না যে তোমার গায়ের স্বর্ণ কেন বিক্রি করবে। আমার বাইক তো দুই-তিনটা একটা বিক্রি করে দিলেই তো এ সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে, কথাগুলো বলার জন্য ও বলতো না, একটা বারও না।
সেই যত্নে পালা-পোষা হাতি এখন মীরার ঘর ভাঙতে মরিয়া৷ কবে যেন মনের মালিকানাও বদলে নিয়েছে সন্তর্পণে। এসব ভাবনা ওকে কষ্ট দেয়। তাই বলে এসব ভাবনা বন্ধ করে দেয় নি ও। কষ্টের সাথে যার অপূর্ব রসায়ন তাকে কষ্টের কথা বলে ভয় দেখিয়ে কোন লাভ আছে? আরো অনেক কষ্ট পাওয়ার আর দেওয়ার আছে ওর।
এরমধ্যে অনেকবার ফোন করেছে ও রাজিবকে। খবরা-খবর নিয়েছে, ও কেন আসতে পারছে না তার মিথ্যা গল্প ফেঁদেছে। মীরা জানিয়েছে কি এক কারনে ওকে নাকি ইনভেস্টিগেশন করবে এখানকার স্টাফরা। রাজিবের মীরাকে কি দরকার উল্টো মীরা এমন গল্প করলো যেন এ মুহূর্তে রাজিব ওর পাশে থাকলে এত সমস্যা ওকে ফেস করতে হতে না। রাজিব বলে-
: ” আমার যা হওয়ার তাতো হলোই, চিন্তা করো না
তোমার আপডেট জানাও আমাকে, দরকার হলে আমি আসবো উত্তরা”
মীরা মনে মনে বলে-” তোমাকে নিয়ে চিন্তা করবো আমি? মাথা খারাপ! তা তো সেই কবে বাদ দিয়েছি সোনা ”
মীরার ধারনা কম করে হলেও প্রতিদিন দুই হাজার লোক ইন্ডিয়ার ভিসার জন্য আবেদন করেন। একেক জন হতে ৫০০ টাকা করে নিলে ওদের কত আয়, তা থেকে স্টাফদের বেতন, অফিসের ভাড়া এসব বাদ দিয়ে তাদের লাভের মোটামুটি একটা হিসেব ও করে ফেলে লাইনে অপেক্ষা করতে করতে। ব্যাবসায়ী হওয়ার এই এক সমস্যা। যদিকে তাকায় সেদিকেই ব্যাবসা দেখে ও। বেশীক্ষণ অপেক্ষা করা লাগলো না, বাইশ নম্বর কাউন্টারে পাসপোর্ট রিসিভ করতে যেতে হলো। পাসপোর্ট জমা দিতে অনেক সময় লগে। কিন্তু পাসপোর্ট রিসিভে তেমন সময় লাগে না। তাই ফিনিশিং হিসাবটা পরের জন্য তুলে রাখলো।
পাসপোর্ট রিসিভ করে মীরা একাই ঘুরতে থাকে যমুনা ফিউচার পার্কে। আড়ং, রঙ সহ বেশ কয়েকটা দেশীয় ব্র্যান্ডের আউটলেটে ঘুরে। ফুড কোর্টে গিয়ে পছন্দের খাবার অর্ডার করে। এক্কেবারে পাক্কা “মি টাইম” সেলিব্রেট করা যাকে বলে। তারপর ধীরে সুস্থে বেরিয়ে একটা সিএনজি নেয় বাড়ি ফিরতে। সিএনজিতে উঠে ফোন করে রাজিবকে। জেনে নেয় কোথায় আছে রাজিব। ফোনটা করে ফর্মালিটি হিসেবে। প্রথম ধাক্কায় এত কঠোর হওয়া যাবে না, তাও খেয়াল রাখে মীরা। তাহলে তা চোখে ঠেকবে। ওর পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার সব ধকলের গল্প আবারো শুরু করে মীরা। ইন্ডিয়ান ভিসা সেন্টারকে ধুয়ে দেয় একচোট। এক ফাঁকে আফসোস করে এতগুলো টাকা হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ায়। মিথ্যে সাহস দেয় রাজিবকে৷ বলে-
: “একদম চিন্তা করো না রাজিব, আমি আছি তো” অথচ মনে মনে বলে- “চিন্তা কাকে বলে? কতপ্রকার ও কি কি সব তোমাকে টের পাওয়াবো সোনা একটু অপেক্ষা করো।
বাড়ি ফিরে দেখে রাজিবের বয়স এক দিনেই বেড়ে গেছে কয়েক বছর। ওর দীঘল চোখে দিশেহারা। ঠিক যেন শিকারীর ফাঁদে আটকা পরা কোন হরিণ। মীরার মনে পরে এই চোখের মায়ায় পরেই অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই প্রেমে পড়েছিলো ও রাজিবের। অথচ কত কত ছেলেকে রিফিউজ করেছিলো ও। কিন্তু ওকে না করতে পারে নি। সেই ভাবনাটা বন্ধ করে মীরা মর্তে ফিরে যেন। ব্যাগপত্র ফেলে দৌড়ে যায় ওর কাছে। আর রাাজিব? কান্নাটা বাকী ছিলো শুধু। কোন কথা না বলেই যেন বলে দিচ্ছিলো কতটা ভেঙে পরেছে ও। রাজিবের পাশে ওর হাতটা নিজের হাতে নেয় মীরা। তারপর সাহস দিতে বলে-
: ” বিশ লক্ষ টাকা কোন টাকাই না রাজিব, তুমি যে সহিসালামতে ফিরেছো এই অনেক। আমার কষ্ট হচ্ছে শুধু এটাই ভেবে যে তুমি তো সৎ একটা নিয়ত করে টাকাটা লোন করেছিলে। তারপর ও আল্লাহ এমন করলো? ” আর মনে মনে বলে- ” হা’রা’মী ফ্যাট কিনবি না না, এবার কিন ফ্ল্যাট, তোর নিয়তই তো ভালো ছিলো না”
ক্ষণকালের বিরতির পর ওর কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে-
: ” উঠো তো, তোমার বিশাল ব্যাবসার একটা কোণা ও না এই টাকাটা। টাকা গেছে ২০ লাভ তুমি কোটি টাকার চিন্তা করে ফেলেছো। এসব ভাবা বাদ দাও তো, উঠো ”
এতক্ষণে রাজিব বাবাজির সোনায় বাঁধা মুখে খানা খুলে ক্ষীণ গলায় বলে-
: “পুলিশ বলেছে এটা নন-প্রোফেশনলাল লোকেদের কাজ। যে ছুড়ি ওরা পেয়েছে তা দেখে তারা এটা নিশ্চিত হয়েছে। ওটা আসলে ফল কাটার ছুড়ি ছিলো”।
মীরা মনে মনে বলে-” গাধা গুলো ছুড়ি ফেলে এসেছে আবার, আমাকে বললোনা তো কিছু!”
মীরা রাজিবকে বলে আচ্ছা বাদ দাও, উঠে ফ্রেশ হয়ে আসো। যা গেছে গেছে তা নিয়ে ভেবে কি হবে।আমার পেটে ইঁদুর দৌড় শুরু হয়েছে”
: ” পুলিশ বলেছে নন-প্রোফেশনাল তো, দেখেন আপনার পরিচিতর মধ্যে কেও কি না, তারউপর ব্যাগে যে টাকা ছিলো তা ওরা জানলো কি করে, নিশ্চয়ই কাছের কেও এটা করিয়েছে অথবা ইনফরমেশনটা লিক করেছে”
এবার মীরা কিছুটা ভীমড়ি খায়। কাজটা যতই ওয়েল প্ল্যান হোক না কেন ধরা পরার রিস্ক কিন্তু এখনো আছেই। নিজেকে সামলে বলে-
: ” আচ্ছা সেসব পরে ভাববো দুজন মিলে, এখন চলো তো”
: ” তোমার কাওকে সন্দেহ হয়? ”
: ” আমার কাকে সন্দেহ হবে? টাকা নিয়েছে তোমার কাছ থেকে, আমি কিভাবে কাকে সন্দেহ করবো?”
: ” কাছের কেও করেছে বললো তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা লোনের ব্যাপারটা টুম্পা কি জানে?”
: “কি যে বলো তুমি, ও জানলেই বা কি, কে আছে ওর এই শহরে?”
: ” শোন যাকে দিয়ে যা অবিশ্বাস্য মনে হয়, যা আশা করা যায় না, সেই কিন্তু ঐ কাজ করে বসে”
মীরা মুখ শক্ত করে রাজিবের চোখে তাকিয়ে বলে-
: ” রাজিব আমিও তোমার থেকে এমন কিছু আশা করি নি, কিন্তু দিনশেষে কি হলো বলো?’
এবার ধাক্কা খাওয়ার পালা রাজিবের। ওতো এমনিতেই ভাঙাচোরা, তার উপর এমন কথায় ওর আত্না শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। তোতলানো সুরে বলে-
: ” মানে? ”
মীরা মুচকি হেসে বলে-
: ” এই যে বললাম পেটে ইঁদুর দৌড় শুরু হয়েছে তাও তুমি উঠছো না ”
কথাটা শুনে চোখেমুখের অস্বাভাবিকতা দূর হতে থাকে।
: ” আশার কথা এই যে পুলিশ ওদেরকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আটক করবে বলেছে”
: ” এদেশের পুলিশ! আচ্ছা দেখা যাবে এবার উঠো তো”
রাজিবের চলার ক্ষমতা টুকুনও যেন বিশ লাখের সাথে নিয়ে গেছে ওরা। মীরা উঠতে সাহায্য করবার ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়েও নূহার কান্নার শব্দ সেখানে দৌড়ে যায়। প্রকৃতিও হয়তো চায় না মীরা রাজিবকে বাড়িয়ে দিক সাহায্যের মমতা মাখা হাতটা। তাইতে অসময়ে কাঁদিয়ে দিয়েছে নূহাকে মীরাকে ওর থেকে দূরে সরাতে।
চলবে।
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ৩৯ (বোনাস পর্ব)
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
টেবিল ভর্তি রাজিবের পছন্দের খবার কিন্তু রাজিবের মন নেই সেখানে। যতই টাকা থাকুক এতগুলো টাকা হাত ফসকে চলে যাওয়াটা কিছুতেই মানতে পারছেনা ও। তারচে বড় কথা সাথী কি ভাববে? ওর কাছে রাজিবের ইমেজ নষ্ট হয়ে যাবে।
মীরা কথাবার্তা চালু রেখে ওকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। কারন ব্যাপারটা ও যত দ্রুত হজম করবে ততই মীরার জন্য ভালো। খাবার শেষে ঘরে এলে মীরা রাজিবকে জিজ্ঞেস করে-
: ” টুম্পার কথা কেন মনে হলো তোমার?”
: ” না, মানে ও তো জানতো যে আজ টাকাটা পাবো তাই…”
: ” টাকা আনার কথা মাজেদা খালা জানে, সুরমা ও জানে। তারও কি তাহলে তোমার সন্দেহের তালিকায় রয়েছে”
: ” পুলিশ জিজ্ঞেস করলো কাওকে সন্দেহ হয় কি না”
: ” রাখো তোমার পুলিশ, এসব ভাবা বাদ দাও বুঝলা, খেয়ে ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পরো, পুলিশের কাজ পুলিশকে করতে দাও”
: ” এতগুলো টাকা?”
: “ভেবো না রাজিব, একটা সিজনের লাভ এটা, যাই হোক বুঝে চললে ম্যানেজ হয়ে যাবে, এর চেয়ে কত কষ্টে দিন কেটেছে আমাদের। তোমার মনে আছে? একটা চাদর গায়ে দিয়ে দুই দিক থেকে দুজন টানাটানি করে শীত পার করেছি৷ সেদিক থেকে তো খোদা কত ভালো রেখেছে আমাদের। আমি একটুও ভাবছি না টাকার কথা। টাকা তো আসবে যাবে তোমার যদি কিছু হয়ে যেতো, তাহলে….!”
কথাটা মীরা পূর্ণ আবেগ দিয়ে বললো। রাজিব খাওয়া রেখে তাকিয়ে রইলো মীরার দিকে,ভালোবাসাপূর্ণ দৃষ্টি। এ চাওনি মীরার চেনা, লোহা গলে যাবে এ চাওনি তে। তাই চোখ ফিরিয়ে নেয় মীরা, পাছে না ওর মনটা নরম হতে শুরু করে। দু’ফোটা পানিও পরে চোখ থেকে। এ রাজিব, ওর চাওনি, মিথ্যা ভালোবাসা, সাথী, আর রাজিবের বিশ্বাসঘাতকতা।
চোখের পানির এই ছিলো কারন। ঝড়ের কবলে পরা নাবিকের মতো দিশেহারা রাজিব ভেবে নিয়েছে ওর বিপদ থেকে ফিরে সহিসালামতে আসা এই চোখের পানির কারন। মীরা প্লেট হাতে চলে যায় রান্নাঘরে। সেখানে গিয়ে সিংকে হাত রেখে কাঁদতে থাকে। কিছু সময় পর রাজিবও আসে সেখানে। মীরার কাঁধে হাতে রেখে দাঁড়ায় ও। চোখ মুছে ঘুরে দেখে ওকে। রাজিব জড়িয়ে ধরে মীরাকে। মীরা ইদানীং রাজিবের স্পর্শকে পড়তে পারে। কোনটা কামনা, লালসা, বর কোনটা ভালোবাসা। এই মূহুর্তের এ স্পর্শ পবিত্র, এ স্পর্শ অনুতাপের। কে জানে রাজিব কি ভাবছে এখন, হয়তো ভাবছে ওর পাপ আর বিশ্বাসঘাতকতার কথা।
মীরা ওর বুকে আর আগের মতো উম খুঁজে পায় না। ও কেমন সাফোকেটেড ফিল করে। তবুও আলতো করে পরে থাকে ওই বুকের উপর। ওর মনে হচ্ছে ও জড়িয়ে আছে কোন ক্যাকটাসকে, যার গা ভর্তি কাঁটা যন্ত্রণা দিচ্ছে ওকে।
রাজিবকে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দেয়। মাথার কাছে বসে হাত বুলাতে থাকে। ছোট্ট বাচ্চার মতো ঘুমিয়ে পরে রাজিব। মীরা ওকে ঘুম পাড়িয়ে চলে আসে বারান্দায়। লুকানো ফোনটা বের করে কল করে ওদেরকে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই মীরা বলে-
: ” তোমরা কি গাধা? ঐ ছুড়িটা কোন দুঃখে ফেলে এসেছো ওখানে? ”
: ” আরেহ্ হাত কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গিয়েছিলো আপা, কিভাবে যে আসছি আল্লাহ জানে”
: ” যাই হোক তোমাদের কেও চিনতে পারে নি তো?”
: ” আরেহ্ না আপা, আমারা গাড়ি উড়ায়া নিয়া আসছি”
: ” ব্যাগটা কি করেছো? ”
: ” আপনে যা কইছেন তাই করছি আপা, সোজা পুড়ায়া ফেলছি”
: ” ভালো করেছো, শোন তোমাদের কত দিতে হবে তা রেখে বাকীটা পাভেলের বাসায় পৌঁছে দিও। আর সম্ভব হলে গা ঢাকা দিয়ে দাও”
: ” কি যে কন আপা, আপনার কোন কাজে লাগতে পারাটাই আমাগো সবচেয়ে বড় মুজুরী, ট্যাকার ব্যাগ আমরা পাবেল ভাইগো বাসায় দিয়া আসছি ”
: ” না, না, তোমরা এত বড় ঝুঁকি নিয়ে কাজটা করেছো, তোমাদের পারিশ্রমিক নিতেই হবে ”
: ” আপা, আপনে আমাগো বইন, মাথার উপরে আপনে থাকলেই হইবো, এমন কাম তো ডেলিই করি, এডা না’হয় মাগনা করে দিলাম”
: ” তোমাদের এই সাহায্য আমি মনে রাখবো ভাই, যে কোন বিপদে আমাকে স্মরণ করবে”
: ” হ আপা, ভালো থাকেন”
: ” আচ্ছা ভাল থাকো”
ছেলেটার নাম মকবুল, যে মীরা থাকতে প্রতি মাসে কারখানা থেকে চাঁদা নিয়ে যেতো। যে এলাকায় কারখানা সেখানে ইদ, চাঁদ, পূজা, নেতার মৃ’ত্যু বার্ষিকী, নেতার বাপের মৃ’ত্যু বার্ষিকী, নেতার শ্বশুর, শাশুড়ীর শ্রা’দ্ধ, শালার বিদেশে ভ্রমণ উপলক্ষে চাঁদা দিতে হতো। ব্যাপারটা সিলি শোনালেও এটাই সত্যি। এমনো মাস ছিলো দুইবার আসতো, তখন মজা করে মীরা জিজ্ঞেস করতো কি ব্যাপার? এ মাসে না টাকা নিয়ে গেলে। মজা করে মকবুল বলতো- ” নেতার শালীরে ব্ল্যাকে ঢাকা ভারছিটি ভর্তি করবো। ট্যাকার সর্ট পরছে তাই আবার আসলাম। মীরারা কিন্তু বিরক্ত হতো না। যা পারতো দিতো। কারন যা দিতো তার বিনিময়ে যা শুনতো তা বেশী মজার ছিলো ওর কাছে। একবার টাকা নিতে এসে মকবুল বললো-
: ” বুজলেন আপা, নেতার বাগান বাড়ির পায়খানা বানাইবো, ট্যাকার টান পরছে তাই এই মাসে আবার আইলাম। মীরা হেসে খুন হয়ে যেতো। যতটা না কথাগুলো শুনে। তারচে বেশী ওর বলার ভঙ্গির জন্য। ওর বাবা মা’রা গেলো নেতার মিছিলে বোমা বি’স্ফো’রণে তার উপর মা ডায়াবেটিসের পেশেন্ট। ও এখন নেতার চামচামি করে কোন মতে দিন পার করে। কিন্তু মায়ের চিকিৎসা খরচ তো এভাবে চলে না। মীরা ওর মাকে নিয়ে বারডেমে যায়। প্রতি মাসে একবার করে যেতে হতো ঔষধ আনতে। পরে মীরা জানতে পারে সরকার থেকে গরিবদের জন্য ফ্রী ঔষধের ব্যাবস্থা আছে। এত ব্যাস্ততা সত্ত্বেও মীরা আবারো তাকে সেখানে নিয়ে যায়। সেখানকার ডাক্তারদেরকে বলে ফ্রী ঔষধের ব্যাবস্থা করে দেয়। এরপর থেকে প্রতি মাসে ফ্রী ঔষধ পায় ওর মা। ব্যাবস্থাটা মীরাই করে দিয়েছিলো। সেই কৃতজ্ঞতা থেকে এ কাজ করে দিতে পেরে ধন্য মনে করছে নিজেকে। যদিও তা বছর তিনেক আগের কথা। তবুও মকবুল কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ পেলে কার্পণ্য করে না।
“Do good for others. It will come back to you in unexpected ways ” – এ কথাটা তার সত্যতা না জানি কত বার জানান দিয়ে যাবে ওর জীবণে। ইশ্বর ওর প্রতি এতটাও রুষ্ট নন, রাজিবের ভালোবাসা পায়নি তো কি হয়েছে এমনি কত কত মানুষের ভালোবাসায় পূর্ণ মীরার জীবণ।
পাভেলকে ফোন করে মীরা। বেশ কিছুক্ষণ কথা হয় ওদের।
পাশ ফিরে মীরা আৎকে উঠে। পর্দা ধরে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে রাজিব। মীরা থতমত খেয়ে বলে-
: ” তুমি! ঘুমাও নি?”
: ” ঘুম আসছে না, তুমি একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে? ”
: ” চলো…”
মীরার মনে তখনো চিন্তার যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, চলছে। রাজিব কি শেনেছে ওর কথা?
রাতটা মীরার পার হয়েছে চিন্তা আর আতংকে। শেষ রাতে চোখটা বুঝে এসেছিলো ওর।
মীরার ঘুম ভাঙে রাজিবের ডাকে। ওকে ডেকে তৈরী হচ্ছে ও। বলে-
: ” শোন মীরা, জলদি ওঠো । সাব ইন্সপেক্টর সারোয়ার কল করেছে। তারা নাকি ছিনতাইকারীকে আটক করেছে। আমাকে যেতে বললো সনাক্ত করতে” খবরটা জানিয়েই বেরিয়ে যায় রাজিব। মীরা রাজিবকে থামিয়ে বলে-
: ” আমিও যাবো তোমার সাথে। তুমি আমাকে দশটা মিনিট সময় দাও চেন্জ করতে। বলেই ছোট ফোনটা মুঠোয় পুরে চলে যায় বাথরুমে। বেশ কয়েকবার ফোন করে মকবুল আর পাভেলকে। কাওকেই পায় না ফোনে। পাভেলের ফেন ধরছে না আর মকবুলের ফোন বন্ধ। এমন সময় বাইরে থেকে দরজায় তাড়া দেয় রাজিব- “জলদি করো মীরা”
মীরা কোনমতে ফ্রেশ হয়ে থানার উদ্দেশ্যে বের হয় রাজিবের সাথে। মনে মনে খোদাকে ডাকে। বলে- ‘রক্ষা করো খোদা”
চলবে….
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪০
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
থানায় যাওয়ার পথে জ্যাম তেমন ছিলো না। শুধুমাত্র যে সিগন্যাল এ ঘটনা ঘটেছে সেখানে ছোটখাটো একটা জ্যাম পরলো। তাও গাড়ি থামাতে হলো না। ও জ্যাম পর্যন্ত আসতে আসতেই সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছিলো। রাজিব ঐ ফাঁকে গাড়ি স্লো করে মীরাকে ঘটনার স্থান আর বিবরণ দুটোই দিচ্ছিলো। মীরা নিরব, কোন কিছুতে মনযোগ দিতে পারছে না। ওর ভিতরে চিন্তা, অস্থিরতা, ওদের ধরা পরার উদ্বেগ। রাজিবের পেছনে দুই পা দু’দিকে দিয়ে বসে থাকা মীরা হাতের নখ খুঁটছে। যেন সব গন্ডগোল হাতের নেইল পালিশটায়। এতে ওর উদ্বেগটা আরো স্পষ্ট হচ্ছে। মীরা পেছনে থাকায় ওর চেহারার অস্থিরতা, উদ্বেগ কেনটাই তেমন খেয়াল করেনি রাজিব। কারন ওর মনোযোগ ঐ দিনের ঘটনার বিবরনে। লক্ষ্য করলেও অবশ্য কোন সমস্যা হতো না, ব্যাপারটা খারাপ ভাবে নিতো না ও । ওটাকে বিশ লাখ টাকার ছিনতাইয়ের শোক বলে চালিয়ে দেয়া যেতো। কারন এসব বিষয়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের হা-হুতাশ চোখে পরার মতো হয় । যার স্বামীর এতগুলো টাকা লাপাত্তা তার এমন উদ্বেগ বেমানান না।
যথা সময়ে বংশাল থানায় পৌঁছালো ওরা। বাইক টা সাইডে রেখে রাজিব, মীরা থানার ভিতরে ঢুকে। সাব ইন্সপেক্টর সারেয়ার সাহেবের খোঁজ করতেই একজন তাদেরকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। তিনি ওদেররকে আগেই একটা মোটর সাইকেলের সামনে নিয়ে যান, উদ্দশ্য রাজিবের বয়ানে নিশ্চিত হওয়া, যে ওটাই সেই ছিনতাইকারীর মোটরসাইকেল কি না। রাজিব ঐদিন বাইকটার পিঁছু করেছিলো। তাই সেটাকে সনাক্ত করতে বেগ পেতে হলো না ওকে। রাজিব মটোরসাইকেলটায় হাত রেখে সারোয়ার সাহেবকে বললো-
: ” হ্যা, এটাই সেই দিনের সেই বাইক, খয়েরী রঙের
হিরো স্প্লেন্ডার, হান্ড্রেড সিসির বাইক” -কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো রাজিব। উত্তেজনা প্রকাশ পেলো ওর বলার ভঙ্গিতে। যেন বাইক না, খুঁজে পেয়েছে বিশ লক্ষ টাকার হদিস। এরপর সারোয়ার সাহেব ওদেরক ভিতরে আটক করা ব্যাক্তির সামনে নিয়ে গেলেন। তিনি এ বাইকের মালিক।
লোকটাকে আপাদমস্তক দেখলো রাজিব। পুরোদস্তুর ভদ্র চেহারার লোক। দেখে মনেই হয় না এর পক্ষে এ কাজ সম্ভব। লোকটা মীরার দিকে এক পলক তাকিয়েই সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিলো। ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো রাজিব। যে লোক একজন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না, সে ছিনতাই করবে বিশ লক্ষ টাকা? মনে মনে ব্যাপারটা লক্ষ করে ভাবে রাজিব।
লোকটাকে দেখে বুক থেকে পাথর নামে মীরার। এখানে মকবুল কিংবা পাভেল কেওই নেই। সবকিছু প্ল্যান মতো এগুচ্ছে তাহলে। তারা কি কথা বলছে এবার সেদিকে মনোযোগ দিলো মীরা।
লোকটা আত্মপক্ষ সমর্থন করছেন, বলছেন যে তার মোটরসাইকেল গত পরশু সন্ধ্যায় চুরি হয়েছিলো। সেদিন রাতেই তিনি তার লোকাল থানার বাইক মিসিং নিয়ে একটা সাধারণ ডায়েরি করেছেন। সেটার কপিও তার কাছে রয়েছে। এখানে আসার আগে সেটা সাথে করে নিয়ে এসেছেন তিনি। সাব ইন্সপেক্টর সারোয়ার তা দেখেছেন এবং ঐ থানায় যোগাযোগ ও করেছেন। ঘটনা সত্যি, গত পরশু রাত সাড়ে দশটায় ঐ থানায় জিডি এন্ট্রি হয়েছিল। তবুও সম্ভব্য সকল ক্লু যাচাই করতে চান তিনি। জিজ্ঞেস করেন-
: ” দেখেন তো মি: রাজিব, উনাকে চিনতে পারেন কিনা?”
ভদ্রলোকের চোখে-মুখে লজ্জা, ঘৃণা আর অপমানের মিশ্রত একটা ভাব ফুটে উঠেছে। রাজিব তাকে একপলক দেখে, সারোয়ার সাহেবকে বলেন-
: ” সেদিনের ঘটনার দুজনের কারোরই সাথেই এ ভদ্রলোকের চেহারায় কিংবা শারীরিক গঠনে কোন সাদৃশ্য নেই” সাব ইন্সপেক্টর সারোয়ারের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরে। তিনি আবারো বলন –
: ” ভালো করে দেখুন”
: ” হুম, দেখেছি”
তিনি এ ফাঁকে কি মনে করে যেন মীরাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। এটা তদন্তের অংশ নাকি কু-দৃষ্টি তা জানে না মীরা। কারন লোকটা মীরার দিকে তাকাতেই মীরা তার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। মানুষ মিথ্যা বললেও তার চোখ মিথ্যা বলে না। ভয় পাওয়াটা এখানেই।
সারোয়ার সাহেব তাদেরকে টেবিলের দিকে আসতে হাত দিয়ে ইশারা করেন। টেবিলে বসে জিজ্ঞেস করেন-
: ” আর কিছু মনে পরেছে ওদের ব্যাপারে?”
: ” না, তেমন কিছুই মনে পরার নেই, আমি সবই আপনাকে বলেছি”
সারোয়ার সাহেব রাজিবের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন-
: ” সত্যি বলছেন?”
থতমত খেয়ে রাজিব বলে-
: ” হ্যা”
সারোয়ার সাহেব এবার মীরার সাথে একা কথা বলতে চান। মীরার ভীতি হয় কথাটা শুনে। রাজিব উঠে অন্য টেবিলে বসে।
প্রায় দশ মিনিট নানান প্রশ্ন করেন তিনি মীরাকে। ছিনতাইয়ের ব্যাপারে কাওকে সন্দেহ হয় কি না?
রাজিবের বন্ধু মহলের কেও হতে পারে কিনা?
ওর কোন শত্রু আছে কি?
রাজিব সাহেবের জুয়া খেলার অভ্যাস আছে কি না?
মীরা ভদ্রলোকের খেলাটা বুঝেছিলো। তাই দৃঢ় ভাবেই তার সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দেয় ও। এবং তার শেষ প্রশ্নটা – ” রাজিব সাহেবের জুয়া খেলার অভ্যাস আছে কি না? ” এ সময় মীরা চুপ করে থাকে, ইচ্ছে করেই। তার ইনভেস্টিগেশন অন্য দিকে মুভ করতে। হয়তো তার ঘাঁটাঘাঁটিতে নতুন কিছু বেরিয়ে এলো।
মীরার এই বুদ্ধি প্রবল৷ এ গুনটার শুরু ওদের বর্তমানে থাকার ফ্ল্যাটটা কেনার সময় থেকে। নগদ টাকায় ফ্ল্যাট কেনার পূর্ণ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ব্যাংক থেকে টাকা লোন করেছিলো মীরা। কারন ব্যাংক লোন দেওয়ার আগে যে খাতে লোনের টাকা ব্যায় হবে তা খতিয়ে দেখে। ফ্ল্যাট কিনবার লোনের ব্যাপারেও তারা রিয়্যাল স্টেট কম্পানির খোঁজ খবর, ফ্ল্যাটের দামের তুলনা, পূর্ববর্তী মালিকানা, কাগজপত্র ইত্যাদি বিষয়ে ইনভেস্টিগেশন করে। ওর ফুপাতো বোন পিয়াসার বর প্রথম ফ্ল্যাট কিনবার সময় ধরা খেয়েছিলো। ভদ্রলোকের কাছে যে ফ্ল্যাট বিক্রি করেছিলো তা এর আগেই বিক্রি করা হয়ে গিয়ে ছিলো অন্য একজনের কাছে । পরে অবশ্য মামলা মোকাদ্দমা করে টাকা তুলতে হয়েছিল। যদিও বেচারা পুরো টাকাটা ফেরত পাননি। সেই থেকে শিক্ষা নিয়ে মীরা ওদের ফ্ল্যাট কিনবার সময় পুরো টাকাটা ওর কাছে ক্যাশ থাকা সত্ত্বেও ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিলো। সেই খেলাটাই ও এখানে খেললো। যাদের সাথে ওঠা বসা ওর, জু’য়া বিচিত্র কিছু না। কে জানে তারা এমন কিছু পেলে হয়তো ঘটনাটা উল্টেও যেতে পারে।
মনে মনে ভাবে ” ম’দ, জু’য়া, না’রী, এ তিনটা যে পুরুষকে একসাথে গ্রাস করে সে শেষ” জু’য়ার ব্যাপারটাই জানার বাকী আছে মীরার ওর সম্পর্কে। যদিও ওর শেষ হওয়া না হওয়ায় মীরার কিছু আসে যায় না। মীরা কি করবে তার সিদ্ধান্ত ও নিয়ে নিয়েছে যা অপরিবর্তনীয়। অনেক বার মীরা নিজের চিন্তা, সিদ্ধান্তকে ভাবনার সুতোয় রিফু করেছে। এখন মীরা যখনি একপলে ওর বিবাহিত জীবণের পিছন ফিরে তাকায় দেখে অসংখ্য জোড়াতালি আর রিফুতে ভরতি সেটা। ভাবনার সুতোয় টান পরেছে এখন। যার জন্য একমাত্র দায়ী রাজিবের এই বি’শ্বা’স’ঘা’ত’ক’তা।
সেখান থেকে বেরিয়ে পরে ওরা। পুলিশ ঐ ভদ্রলোককে ও ছেড়ে দেন। রাজিব আসার সময় ভদ্রলোকের সাথে হ্যান্ড-শ্যাক করে। মীরাও দুঃখ প্রকাশ করে তার এমন ভোগান্তির জন্য। লোকটাও ওদের টাকাগুলোর জন্য স্বান্তনা দেয়। শেষে যে যার গন্তব্যে রওনা দেয়।
সেখান থেকে কারখানায় যায় রাজিব, সঙ্গে মীরাও। ওর যা মানসিক অবস্থা কিছু হিসাবপত্র করতে রাজিব মীরাকে কারখানায় যাওয়ার কথা গতকাল রাতেই বলেছিলো। মীরা বলেছিলো যাবে। কারখানায় যাবার আগে ওরা নাশতা করতে জয়কালী মন্দিরের কাছের সুপার হোটেলে ঢুকলো দুজনে। ঠিক কবে ওরা একসাথে বাইরে খেয়েছে মীরা খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে তা ভাবছিলো। এমন সময় রাজিব বললো –
: ” এত এত টাকা পয়সা নিয়ে ঘুরাঘুরি করি, কখনো এমন হলো না, আর এবার”
: ” আরেহ্ বাদ দাও, টাকার কথা আর একবার বললে কিন্তু আমি এখন ঝগড়া করবো তোমার সাথে। তুমি জনগনের সেবা করতে জমি, বাড়ি বন্ধক রাখিয়েছো। তোমার সম্মানের কথা ভেবে নিজে জিম্মা হয়ে টাকা এনে দিলাম। তাও তোমার নিজের কাজে না আরেক জনের বিলাসী ফ্ল্যাট কিনায় সাহায্য করতে। এখন তোমার মালেক সাহেব করবে কোন সাহায্য লোন পরিশোধ করতে?”
রাজিব চুপ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। নিরবতার ভাষাকেই বেছে নিলো ও এখন। গুমোট অবস্থার অবসান হলো নাশতা এলো। রুটি, মিক্সড সবজি, গরুর পায়ার নেহারী। সময় নিয়ে নাশতা খেয়ে ওরা রওনা দিলো ওদের কারখানায়।
কারখানায় গিয়ে অফিস ঘরে ঢুকলো ওরা। মীরাকে দেখে ম্যানেজারের মুখ হঠাৎই অন্ধকার হয়ে গেলো। বুঝাই গলো তিনি অসন্তুষ্ট মীরার। চোখে চোখ পরায় তা প্রথম দর্শনেই বুঝেছিলো মীরা। লোকটা যদিও এখন তিনি অতিশয় বিনয় প্রদর্শনে তার সবটুকু শক্তি খরচা করছেন তা ঢাকতে। তবে তার এই তেলতেলে ভাবটা তার অসৎ থাকাটাকে ঘোষণা করছে নিরবে। ব্যাপারটা চোখে পরার মতো। এটুকু জ্ঞান, মানুষ চেনার ক্ষমতা মীরার এত বছরে হয়েছে। হিসাবপত্রে যে ঘাপলা আছে তা মীরা ঠিকই বুঝে ছিলো গতবারের সাক্ষাতে। কত শ্রম, সময় আর ত্যাগের বিনিয়োগে আজ এই অবস্থানে মীরা ফ্যাশন। অথচ রাজিব তা এই লোকটার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে আজ এখানে তো কাল ওখানে করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু রাজিব যদি নিজে খেটে এটাকে দাঁড় করাতো কখনোই এটা করতে পারতো না। এত যত্নে, কষ্টে তৈরী ব্যাবসাটার নিরব ভাঙন টের পাচ্ছে মীরা। কি করবে মীরা এখন? এটাকে সরাবে দুদিন পর তো রাজিব ওকেই সরিয়ে দিবে। এসব কথার যোগ বিয়োগে ব্যাস্ত মীরার সংবিৎ ফিরে একটা ফোন কলে। গ্রাম থেকে রাজিবের মামাতো ভাই পলাশ ফোন করেছেন। কথা বলার এক ফাঁকে ও জানালো পলি গেছে নেপালে ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে, আর আগামী মাসের সাত তারিখে ছোট মামার মেয়ে সাথীর বিয়ে। ছেলে লন্ডন প্রবাসী। বিয়ের পর ওকেও নিয়ে যাবে সাথে করে। কথাটা শুনে মুচকি হাসে মীরা, ফোনটা কানে রেখেই রাজিবের দিকে তাকায় ও।
চলবে….