প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৫৭ এবং শেষ পর্ব

0
664

#প্রিয়াঙ্গন
#অন্তিম
জাওয়াদ জামী জামী

সাড়ে পাঁচ বছর পর,

” স্যার, আজকেই ম্যামকে সি সেকশনে নিতে হবে। আপনি কাইন্ডলি ডক্টরের সাথে কথা বলুন। ”
তাহমিদ কেবলমাত্র ভার্সিটি থেকে হসপিটালে এসেছে। গত দুইদিন আগে থেকে কুহু এখানে এডমিট আছে। ওর শারিরীক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাহমিদ রিস্ক নিতে চায়নি। তাই আগেই কুহুকে ডক্টরের তত্ত্বাবধানে রেখেছে।

” আমি ডক্টরের সাথে কথা বলছি। তার আগে আমার স্ত্রী’র সাথে দেখা করে আসছি। ” তাহমিদ আর সেখানে দাঁড়ায়না। সরাসরি চলে যায় কেবিনে।

” ভাইয়া, এসেছ? তুমি ডক্টরের সাথে কথা বল। তিনি রাউন্ডে এসে ভাবিকে আজকেই সি সেকশনে নিতে চেয়েছেন। ” তাহমিদকে দেখে নাহিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসল।

” আমি এখনই যাব ডক্টরের কাছে। তোমরা কি লাঞ্চ করেছ? সৃজন কোথায়? ”

” ভাবিকে খাইয়ে দিয়ে আমি খেয়েছি। সৃজনকে বাসায় পাঠিয়েছি কিছু জিনিসপত্র নিয়ে আসতে। ও কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। ”

তাহমিদ কুহুর দিকে এগিয়ে যায়। মেয়েটা বেডে শুয়ে শুয়ে অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে তাহমিদের দিকে। সাড়ে আটমাসের অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটা নড়তে চড়তে পারেনা। শরীরে পানি এসেছে। ফুলে গেছে পুরো শরীর।

তাহমিদ কুহুর কাছে এসে ওর কপালে হাত রাখল।

” বউ, খুব খারাপ লাগছে? পেট পুরে খেয়েছিলে? ” কুহুর কপালে চুমু দিয়ে বলল তাহমিদ।

” খারাপতো একটু লাগছেই। খেতে পারিনি আজকে। নাহিয়া জোর করে একটু খাইয়ে দিয়েছে। তাতেই আমার হাঁসফাঁস শুরু হয়েছে। ”

তাহমিদ রুমে তাকিয়ে দেখল নাহিয়া ভেতরে নেই। ওদের দু’জনকে একা কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে নাহিয়া বাহিরে গেছে।

” একটু খেতে হবেতো, বউ। নইলে তুমি আর আমার সোনামণিরা সুস্থ থাকবে কেমন করে? তুমি না খেলে ওরা যে উইক হয়ে যাবে। ”

” আমার না ভিষণ ভয় করছে। আমার যদি কিছু হয়ে যায়? তবে আপনি ওদের একা একা কিভাবে সামলাবেন? ” কুহু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

কুহুর মুখে এমন কথা শুনে তাহমিদের বুক কেঁপে উঠল। ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তার প্রানপ্রিয় স্ত্রী’কে। ওর শরীর কাঁপছে। কুহুর মুখে এমন কথা ও মানতে পারছেনা।

” এভাবে বলতে নেই, বউ। তোমার কিছু হবেনা। তুমি নিজেকে শক্ত কর। মনোবল বাড়াও। তোমার কিছু হলে আমাদের কি হবে সেটা তুমি একবারও ভেবে দেখেছ? তুমি আমাদের জন্য হলেও নিজের মনকে শক্ত কর। তুমি জানোনা, আমার জীবনে তুমি কি। তুমি ছাড়া আমি শূন্য। আমরা শূন্য। ” তাহমিদ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল। ও এই মুহূর্তে নিজেকে দূর্বল করতে চায়না। ও চায়না ওর ভেতরে বহমান শংকার স্রোত কুহু দেখতে পাক।

কুহুকে শান্ত করে তাহমিদ যায় ডক্টরের কাছে।

এক ঘন্টা পর। তাহমিদ হসপিটালের করিডোরে অস্থিরভাবে পায়চারী করছে। রায়হান আহমেদ চেষ্টা করছেন ওকে শান্ত রাখতে। কিন্তু তিনি কিছুতেই তাহমিদকে শান্ত করতে পারছেননা। নায়লা আঞ্জুমও চেষ্টা করছে তাহমিদের সাথে কথা বলার। কিন্তু তাহমিদ তার কথা কানেই তুলছেনা।
রিশা আর নাহিয়া তাহমিদের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, একটা মানুষ কিভাবে কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারে!

সৃজন করিডোরের একপাশে চেয়ারে বসে আছে। ছেলটার চোখে পানি ছলছল করছে। বাবা-মা’কে হারানোর পর এই বোনটাই ওকে আগলে রেখেছে। আজ সেই বোনও অপারেশন থিয়েটারে নিজের জীবন বাঁচাতে যুদ্ধ করছে। নানান চিন্তা করতে করতে কয়েক বিন্দু অশ্রু ঝরে পরল সৃজনের দু-চোখ বেয়ে।

” তাহমিদ, এত অস্থির হয়োনা। একটু শান্ত হয়ে বস। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। কুহু আর তোমার সন্তানরা ঠিকঠাক থাকবে। ” রায়হান আহমেদ চেষ্টা করছেন তাহমিদকে শান্ত করতে।

” আমি শান্ত থাকতে পারছিনা, চাচা। ভেতরে মেয়েটার হয়তো অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমি কত অসহায় স্বামী দেখেছেন? নিজের স্ত্রী’র পাশে তার কঠিন বিপদের সময় থাকতে পারছিনা। আজকের মত অসহায় নিজেকে আমার আর কখনোই লাগেনি। ”

” তুমি আল্লাহকে ডাক। দেখবে তিনি সব ঠিক করে দিবেন। ”

” চাচা, ডক্টর এতক্ষণ কি করছে? ইনি কি ডক্টর হিসেবে পারফেক্ট? আপনাদের কথায় কুহুকে আমি তার তত্বাবধানে রেখেছি। তিনি তো সব ঠিকঠাক করতে পারবেন? ”

তাহমিদকে পা’গ’লে’র ন্যায় করতে দেখে নায়লা আঞ্জুম তার দিকে এগিয়ে আসল।

” তাহমিদ, তুমি ডক্টরের ওপর নির্দিধায় ভরসা করতে পার। কুহুর জন্য আমরা দেশের নামকরা ডক্টরকে সিলেক্ট করেছি। তুমি দেখে নিও তিনি আমাদের নিরাশ করবেননা। তুমি শান্ত হয়ে একটু বস। ” নায়লা আঞ্জুম স্ব স্নেহে হাত রাখে তাহমিদের মাথায়। সাড়ে পাঁচ বছর আগের সেই নায়লা আঞ্জুমের সাথে আজকের নায়লা আঞ্জুমের আকাশপাতাল তফাৎ। মাথায় খালামনির পরশ পেয়ে হু হু করে কেঁদে উঠল তাহমিদ।

” খালামনি, আমার কুহু আমার সন্তানেরা ঠিক আছে তো? ডক্টর এত দেরি করছে কেন? আমার ভিষণ ভয় হচ্ছে। ”

” কিছু হবেনা, বেটা। তোমার স্ত্রী-সন্তানেরা সহিসালামতে তোমার কাছে আসবে দেখে নিও। তুমি একটু ধৈর্য্য ধর। ”

তাদের কথার মাঝেই দুইজন সিস্টার দুইটা বেবিকে নিয়ে হাজির হয়। নায়লা আঞ্জুম তাদের দেখামাত্রই তাহমিদকে ইশারা করে। তাহমিদ সামনে তাকিয়ে দেখল তার কাঙ্ক্ষিত ধনেরা দু’জন সিস্টারের কোলে। ও একলাফে দাঁড়িয়ে যায়। ওর চোখে পরল দু’জন পুতুল পিটপিটিয়ে চেয়ে আছে। আবেগে দুফোঁটা নোনাজল গড়ায় তাহমিদের চোখ বেয়ে। আজকের মত সুখী তার নিজেকে আর কখনোই মনে হয়নি।

” তাহমিদ, আমার নাতি-নাতনিকে আমার কোলে দাও দেখি। দেখি ওরা কার মত হয়েছে। ” রাশেদ কুরাইশি নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারলেননা। তিনি আনন্দে কেঁদে ফেললেন।

তাহমিদ নিজের কোলে থাকা কন্যাটিকে বাড়িয়ে দেয় বাবার দিকে। নায়লা আঞ্জুমের কোলে আছে তাহমিদের ছেলে।

কুহুকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। ওর শারিরীক অবস্থা খারাপ হওয়ায় ডক্টরকে এমন সিদ্ধান্ত হতে হয়েছে। তবে ডক্টর জানিয়েছেন, আগামী দুইদিনের মধ্যেই কুহু পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে।

” এই যে পুত্র-কন্যার বাবা, নতুন নতুন বাবা হয়ে কেমন বোধ করছ? সন্তানের মায়া কেমন সেটা বুঝতে পারছ? তাদের না দেখলে, কাছাকাছি না থাকলে কেমন লাগে সেটা বুঝতে পারছ? ”

বাবার কথা শুনে তাহমিদ মাথা নিচু করল। ওর মনে পরেনা কত বছর ও বাবাকে ডাকেনি। বাবার সাথে মন খুলে কথা বলেনি। নিজের দুঃখকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ও এতদিন বাবাকে কষ্ট দিয়েছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে। বাবাতো ভুল কিছু বলেনি! এই একদিনেই সন্তানদের ওপর মায়া জন্মেছে। ওদেরকে এক মুহূর্ত না দেখলে মনে হচ্ছে কতকাল বুঝি দেখেনি। ওদের কান্নার শব্দে বুকের ভেতর তোলপাড় করছে। অথচ ওর বাবা কত বছর ছেলের মুখে বাবা ডাক শুনতে পায়না! আজ নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। কিভাবে বাবার চোখে চোখ মেলাবে! অনেকক্ষণ পর মুখ তুলে চাইল তাহমিদ।

” বাবা, এভাবে বলোনা। আমার দোষ আমি স্বীকার করে নিচ্ছি। আমি বুঝতে পেরেছি একজন মানুষের জীবনে সন্তান কি। ” তাহমিদের গলা ভারি হয়ে আসল। ও আর কিছুই বলতে পারলনা।

ছেলের মুখে বাবা ডাক শুনে রাশেদ কুরাইশির খুশিতে পা’গ’ল হওয়ার দশা। তিনি ছুটে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। এক হাতে তিনি নাতনিকে ধরে রেখেছেন। আরেক হাতে ধরে রেখেছেন ছেলেকে। অনেক বছরের মান-অভিমানের পালা নিমেষেই দূর হয়ে যায়।

কেবিনে উপস্থিত সকলের চোখে পানি এসেছে বাবা-ছেলের মিলন দেখে।
শাহানা আক্তারও কাঁদছেন। এত বছর ধরে তিনি এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলেন।
নায়লা আঞ্জুম আজ শান্তি পেলেন। তার বোন, দুলাভাইয়ের ভুলের শাস্তি ছেলেটা এত বছর ধরে ভোগ করেছে। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মা’র ভালোবাসা বঞ্চিত ছেলেটা ধীরে ধীরে পরিনত হয়েছিল কঠিন হৃদয়ের ব্যাক্তিতে।

কুহুর কলিগরা দেখতে এসেছে তাহমিদের কলিজার টুকরাদের। হ্যাঁ, সেই কুহু আজ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা। সফলভাবে পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে যোগ দিয়েছিল সাতমাস আগে। কুহুকে কেবিনে দেয়া হয়েছে। সকল বাঁধা বিপত্তি কাটিয়ে মেয়েটা ফিরে এসেছে তার পরিবারের কাছে। সবার মধ্যে থেকেই বারবার ওর নজর যাচ্ছে তাহমিদের দিকে। মানুষটার কোলে রয়েছে তার ছেলে। সে পরম আদরে আগলে রেখেছে তার ছেলেকে। আজ কুহু তাহমিদের মুখে একজন সুখী মানুষের ছায়া দেখতে পাচ্ছে। অজান্তেই ওর চোখের কোনে জমা হয় আনন্দাশ্রু।

” ডেইজি, তুমিও আমার সাথে চল। বউমাকে আর আমার নাতি-নাতনীদের দেখে আসবে। রায়ান, জাহিয়াকে বললাম ওদের দেখে আসার কথা। কিন্তু ওরা কি আমার কথা রাখতে জানে। তাদের নাকি সময় নেই! অথচ তোমার মেয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে সিঙ্গাপুর বেড়াতে গেল! আর তোমার ছেলে বউকে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে গেল। আফসোস হয় মাঝেমধ্যে। এমন ছেলেমেয়েরও বাবা আমি! অথচ তাহমিদ, যাকে দিনের পর দিন অবহেলা করেছি, সে যতই অভিমান করে থাকুক, আমার কথা শোনার চেষ্টা করেছে। ”

” এখন তোমার বড় ছেলেই সব। সে ভালো, সে এটা, সেটা! আমার ছেলেমেয়েরা এখন খারাপ! ওদের যদি বেড়াতে যাওয়ার দরকার হয় তবে কি ওরা যাবেনা? ওদের একটা স্ট্যাটাস আছে। তোমার বড় ছেলের মত হাভাতে ঘরে বিয়ে হয়নি আমার ছেলেমেয়েদের। ওদেরকে নিজেদের স্ট্যাটাস বজায় রাখতে হয়। তোমার বড় ছেলের সেসবের বালাই আছে নাকি! আর তাছাড়া ঐ বেয়াদব ছেলের বেয়াদব বউকে দেখতে গিয়ে ওদের কি লাভ? গাঁইয়া মেয়ে কি গাঁইয়া জন্ম দিয়েছে, তাদের দেখবার জন্য তোমার আগ্রহ দেখে আমার রাগ হচ্ছে। তোমার যত ইচ্ছে তুমি তাদের দেখ। আমাদের এর ভেতর টানবেনা। ”

স্ত্রী’র এরূপ কথা শুনে তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন রাশেদ কুরাইশি। তিনি কি বলবেন সেটা বুঝতে পারছেননা। তার কথা রাখতে তাহমিদ ডেইজিকে ফোন করেছে। ওর সন্তানদের দেখতে যেতে বলেছে। কিন্তু ডেইজি কুরাইশি তার অহংকার নিয়েই থাকল!

” ঠিক আছে, তোমার কোথাও যেতে হবেনা। আমি গর্বিত ঐ গাঁইয়া মেয়ের শ্বশুর হতে পেরে। তোমার শহুরে ছেলের বউতো জীবনে সম্মান করলনা। তাই ওদের কাছ থেকে সম্মান আশাও করিনা। আর রইল তোমার মেয়ের জামাই। সে তো আমার সম্পদের লোভে তোমার মেয়েকে বিয়ে করেছে। সে উঠতে-বসতে আমাদের হুজুর হুজুর করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে যেদিন আমার এই সম্পদের পাহাড়ে ধ্বস নামবে, সেদিন তুমি তোমার মেয়ে জামাইয়ের আসল রূপ দেখতে পাবে। মনে রেখ, তোমার পাশে সেদিন কেউ যদি থাকে তবে তাহমিদই থাকবে। ” রাশেদ কুরাইশি আর কথা বাড়ালেননা। তিনি বেড়িয়ে গেলেন হসপিটালের উদ্দেশ্যে।

” তাহমিদ, অনেক তো হল। এবার তোমার দুই বোনের বিয়ের ব্যবস্থা কর। তারা যেহেতু পাত্র পছন্দ করেই রেখেছে, তবে আর দেরি করে লাভ কি? এখন বউমাও সুস্থ আছে, আর আমাদের সোনামণিরাও এসে গেছে। ওরাও এবার দুই ফুপির বিয়েতে ভাগ বসাক। ” নায়লা আঞ্জুম নাতিকে আদর করে বলল। তার কথা শুনে কুহু হাসল। ওর সেই অহংকারী চাচি আজ তাকে ছেলের বউয়ের মর্যাদা দেয়। সংসারের নানান আলোচনা ওর সাথে করে। ওকে যথেষ্ট ভালোবাসে। আবার ওর ছেলেমেয়েদেরও চোখে হারাচ্ছে।

” ভাইয়া, আম্মু কিন্তু ঠিক বলেছে। আর কতদিন এভাবে বাবার বাড়িতে থাকব? এখন কোথায় স্বামীর সাথে দুনিয়া ঘুরে বেড়াব। কিন্তু তোমরা সেটা হতেই দিচ্ছনা। ” রিশাও নায়লা আঞ্জুমের সাথে তাল মেলাল।

” একটুতো লজ্জা কর। আমি তোর বড় ভাই। ভাইয়ের সামনে এভাবে নিজের বিয়ের কথা বলতে লজ্জা করছেনা? থাপ্পড় দিয়ে কান লাল করে দেব। ”

” ফরজ কাজের বেলায় কোন লজ্জা নেই, ভাইয়া। তুমি কালকেই আমার শ্বশুরকে ফোন দিয়ে সব ঠিক করতে বলবে। রিয়াদ তোমার ফোনের অপেক্ষায় দিন গুনছে। ” মেয়ের মুখে নিজের বিয়ের কথা শুনে নায়লা আঞ্জুম লজ্জায় মাথা নিচু করলেন। তার তাহমিদও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। তাহমিদের অবস্থা দেখে কুহু হেসে কুটিকুটি হয়।

” এক কাজ করুন, রিশার সাথে নাহিয়ার বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক করুন। সে ও তো পাত্র পছন্দ করেই রেখেছে। আমি কি ভুল কিছু বললাম, নাহিয়া? হলে একসাথে দুই বোনের বিয়েই হোক। ”

” নাহিয়া, তুমি কি ইশানকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছ? আপা-দুলাভাই কিন্তু তোমার সিদ্ধান্ত মানতে পারছেনা। তাদের একমাত্র মেয়ে তুমি। আর কোন বাবা-মা’ ই চাইবেনা তাদের একমাত্র মেয়ে কোন বিপত্নীক পুরুষকে বিয়ে করুক। আবার সেই পুরুষের এক বছরের মেয়েও আছে। ” নায়লা আঞ্জুম উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল। নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে সবাই একযোগে নাহিয়ার দিকে তাকায়। নাহিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুখ খুলল।

” আমি এডাল্ট। নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আমার আছে। আর কিছুদিন পর মাস্টার্স কমপ্লিট করব। তাই আমি যা করছি ভেবেচিন্তেই করছি। এছাড়া আমি দুনিয়াকে দেখিয়ে দিতে চাই, দুনিয়ায় যেমন মিথিলা আরজুমান্দের মত মানুষ আছে, তেমনি নাহিয়ার মত মেয়েও আছে। মিথিলা আরজুমান্দরা নিজের সুখের জন্য সন্তানকে ছাড়তে যেমন দ্বিধা করেনা, তেমনি নাহিয়ার মত মেয়েরাও অন্যের সুখের কারন হতে দুইবার ভাবেনা। আর একটা মা হারা সন্তানকে বুকে তুলে নিতে নাহিয়া দুইবার ভাববেনা। বিয়ে যদি করতেই হয় তবে আমি ইশানকেই করব। এটাই ফাইনাল। ” নাহিয়ার কথায় এমন কিছু ছিল যে আর কেউ কোন কথা বলতে পারলনা।

তাহমিদ নায়লা আঞ্জুম আর রায়হান আহমেদের সাথে কথা বলে রিশা আর নাহিয়ার বিয়ের ব্যাপারে পাত্রপক্ষের সাথে কথা বলতে উদ্যত হয়।

কুহু বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ওর পাশে বসে নাহিয়া ফোনে ব্যস্ত। বাচ্চারাও ঘুমাচ্ছে। রিশা রিয়াদের সাথে কথা বলছে। নায়লা আঞ্জুম তাহমিদের বাসায় গেছে। সে ফ্রেশ হয়ে খাবার নিয়ে তারপর আসবে। তাহমিদ ফার্মেসিতে গেছে একটা মেডিসিন আনতে। নিচে যেতেই রাশেদ কুরাইশির সাথে ওর দেখা হয়। রাশেদ কুরাইশিও ছেলের সাথে ফার্মেসিতে গেলেন। প্রয়োজনীয় মেডিসিন কিনেই তারা একসাথে হসপিটালে প্রবেশ করল। এরপর সোজা চলে আসে কেবিনে।

বাচ্চাদের ঘুমাতে দেখে রাশেদ কুরাইশি নাহিয়া আর রিশার সাথে টুকটাক কথা বলতে থাকলেন। রিশা আর নাহিয়ার সাথে তার সম্পর্ক বেশ ভালো।

প্রায় অনেকক্ষণ পর কেবিনে আসল নায়লা আঞ্জুম। সে ভেতরে এসে রাশেদ কুরাইশিকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। সে একবার রাশেদ কুরাইশির দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই তাকায় দরজার দিকে। ত্র দৃষ্টি অনুসরণ করে রাশেদ কুরাইশিও দরজার দিকে তাকান। কিন্তু দরজায় দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে তার মুখের হাসি মুছে যায়।

মিথিলা আরজুমান্দও এই সময় এখানে রাশেদ কুরাইশিকে আশা করেনি।
তাহমিদ কুহুসহ সকলে হঠাৎ মিথিলা আরজুমান্দের আগমনে অবাক হয়েছে। মিথিলা আরজুমান্দ সব অনুশোচনা দূর করে ভেতরে প্রবেশ করল। সে।সরাসরি তাহমিদের সামনে এসে দাঁড়ায়। তাহমিদ মা’কে দেখে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকল।

” আমি জানি আমার ওপর তোমার অনেক রা’গ আর অভিমান জমা হয়েছে। আমি সেসবের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে আসিনি। কারন আমি জানি ক্ষমা চাইলেও কোন লাভ হবেনা। আমি তোমার কাছে জরুরী দরকারে এসেছি। ”

” কেন এসেছেন? ” তাহমিদ ছোট্ট করে বলল।

” নাহিয়া যখন ইশানকে বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে, তাকে আর বাঁধা দেয়ার কোন কারণই দেখছিনা। ওর বাবাও রাজি হয়েছে। আমরা কিছুতেই চাইনা, মেয়েটা আমাদের থেকে দূরে চলে যাক। তুমি ওদের বিয়ের ব্যবস্থা কর। যেহেতু ও তোমাকে বড় ভাই মানে। সেহেতু ওর বিয়ের সব দ্বায়িত্ব পালন করতে হবে তোমাকেই। ” মিথিলা আরজুমান্দ কোন ভনিতা ছাড়াই বলল।

রাশেদ কুরাইশি কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলে তাহমিদ তাকে আটকায়।

” এখানেই থাক, বাবা। এখানে এমন কোন আলোচনা হচ্ছেনা যে তোমাকে বাহিরে যেতে হবে। ” ছেলের কথা শুনে রাশেদ কুরাইশি রিশার কাছে গিয়ে বসলেন। তিনি মাথা নিচু করে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে লাগলেন। তিনি ভাবছেন, তার একটা ভুল সিদ্ধান্তের দরুন কিভাবে একটা সংসার তছনছ হয়ে গেছে। মিথিলার দিকে তাকানোর সাহস তার আজ নেই।
অথচ দিনশেষে তিনি ছাড়া বাকি সকলেই সুখী হয়েছে।

” আমি আপনার ওপর রে’গে কিংবা অভিমান করে নেই। নিজের অতীত মেনে নিয়েছি আমি। আর বর্তমান নিয়ে সুখী আছি। এবং ভবিষ্যতেও সুখী থাকতেই চাই। নিজের সন্তানদের একটা সুসজ্জিত ভবিষ্যৎ দিতে চাই। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়েই আমি অতীতের সব ভুলতে পেরেছি। এসেই যখন পরেছেন, তখন আমার ছেলেমেয়েকে দোয়া করে যাবেন। আর নাহিয়াকে নিয়ে ভাববেননা। রিশার সাথে ওর বিয়ের ব্যবস্থাও করব। ”

মিথিলা আরজুমান্দ কি মনে করে ছেলের দু-হাত ধরে কেঁদে উঠল। এরপর সে বাচ্চাদের কাছে গিয়ে তাদের একে একে কোলে নেয়। কুহুর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে, শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। তার সাথে নায়লা আঞ্জুমও যায়।

মিথিলা আরজুমান্দ চলে যেতেই রুমের দমবন্ধ পরিবেশ ঘুচে যায়। কিছুক্ষণ পর রাশেদ কুরাইশিও বেরিয়ে যান।

তাহমিদের মাথায় দ্বায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে সবাই। কুহুকে হসপিটাল থেকে নিয়ে যাওয়ার পরই, রিশা, নাহিয়ার বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বিষয়টা সহজ হবেনা। ওকে কিছুদিন রাজশাহী, ঢাকা দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।

” কি ভাবছেন এত? আমাদের দিকেও তো একবার তাকান। আপনার প্রিন্সেস কেমন ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে আছে দেখুন। ” কুহুর কথা শুনে তাহমিদ ওর মেয়ের দিকে তাকায়। মেয়েটা তখন চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে। তাহমিদ হেসে মেয়েকে কোলে তুলে নিল। ততক্ষণে কেবিন থেকে সবাই বেরিয়ে গেছে।

” আমার চিন্তা অন্য কোথাও থাকলেও আমার মন, দৃষ্টি সব সময় তোমাদের দিকেই থাকে। তোমরা আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন। ” কুহুর কপালে চুমু দিয়ে বলল তাহমিদ।

” মা’কে দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে। আমার বাচ্চারা তাদের দাদা-দাদীর দোয়া পেয়েছে, এটা ভাবতেই ভালো লাগছে। এবার নাহিয়ার বিয়ের ব্যবস্থা করুন। মেয়েটা ইশানকে খুব ভালোবাসে। ”

” আগে তুমি সুস্থ হয়ে ওঠ। আগামী একমাস কেউ চাইলেও আমি সেদিকে নজর দেবনা। আমার কাছে আগে তোমার সুস্থতা, পরে অন্যকিছু। ”

” আপনি এত ভালো কেন! এত ভালোবাসেন কেন আমাকে? আপনার মত পুরুষ সকল নারীই চায়। আপনি আমার পরম আরাধ্যের পুরুষ। জীবনে অনেক সওয়াব করলেই তবে আপনার মত মানুষ পাওয়া যায়। ” আবেগে বুজে আসে কুহুর গলা।

” তুমি ভালোবাসার মতই একজন। তোমার মত মেয়েকে ভালোনাবেসে কি পারা যায়! কয়জন পুরুষের কপালে তোমার মত নারী জোটে। জেনে রেখ, তোমাকে ভালোবাসার কোন কারন থাকতে নেই। তোমাকে কারনে-অকারনেই ভালোবাসা যায়। এমনি থেক আজীবন। আমার পাশে থেকে অনুপ্রেরনার কারন হও। আদর্শ মা হয়ে সমাজের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াও। দেখবে ভালোবাসা তোমার পায়ে লুটোপুটি খাবে। ”

” শুধু একটা আফসোস থেকে গেল। ছোট চাচি আমাদের মানতে পারলনা। চাচা কালকে আসবে। কিন্তু চাচি আসবেনা। তার এত কিসের রা’গ এটাই বুঝলামনা। ”

” চাচির চিন্তা বাদ দিয়ে আমার চিন্তা কর। তোমার ভালোবাসাবীনা আমার জীবন কিভাবে কাটছে সেটা কি একবারও ভেবেছ? এখন রুমে কেউ নেই ফটাফট কয়েকটা চুমু দাওতো। তুমি কি জানো, তোমার আদরহীনতায় আমার কলিজা বেরিয়ে আসতে চাইছে? তারাতারি কয়েকটা চুমু দিয়ে আমার কলিজা ঠান্ডা কর। ” তাহমিদ কুহুর দিকে গাল এগিয়ে দেয়। কুহুও দরজার দিকে তাকিয়ে টুপ করে তাহমিদের গালে চুমু দেয়। আর তখনই কেঁদে উঠল ছেলেমেয়ে দুটো। তাহমিদ অসহায় মুখে কুহুর দিকে তাকায়।

” এরা কি আমার ভালোবাসার বিপক্ষে এখন থেকেই অবস্থান নিয়েছে! মানবোনা বউ এসব মানবনা। প্রয়োজনে ওদের ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কবার। তবুও তোমার মত রসকষহীন হতে দিবনা। ওরা আমার মত প্রেমিক পুরুষ হবে। ”

” চুপ করুন এবার। নাহিয়া, রিশাকে ডাকুন। বাচ্চাদের খাওয়াতে সাহায্য করবে ওরা। ”

” নিষ্ঠুর বউ। ” তাহমিদ বেরিয়ে যায় রিশা আর নাহিয়ার খোঁজে।

কুহু তাহমিদের দিকে তাকিয়ে সুখের হাসি হাসল। সে হাসির প্রতিটি কনায় জড়িয়ে আছে পরিতৃপ্তি। যে মানুষটা ওকে ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ করেছে। যার কাছ থেকে দূরে যাওয়ার কথা ও কল্পনাই করতে পারেনা।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে