প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৪৯+৫০

0
532

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৪৯
জাওয়াদ জামী জামী

রাশেদ কুরাইশি ছেলের বাসায় আসতে চেয়েও পারেননি। তাকে ব্যবসার কাজে দেশের বাহিরে যেতে হয়েছে। সাতদিনের আগে তিনি ফিরতে পারবেননা।

কুহু মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে। তাহমিদও কেমিস্ট্রির শিক্ষক হওয়ায় কুহুকে সব দেখিয়ে দিচ্ছে। এছাড়া ওর বন্ধু সজলের মাধ্যমে কুহুর ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকের সাথে কথা বলে ল্যাবের বিষয়ে জেনে নিয়েছে। এবং নিজের ভার্সিটির ল্যাবে কুহুর কয়েকদিন যাওয়ার জন্য পারমিশন নিয়েছে। এছাড়াও কুহু ওর ফ্রেন্ডদের মাধ্যমে ক্লাসের খুঁটিনাটি জেনে নিচ্ছে। যদিও এসবে টুকটাক সমস্যা থেকেই যায়। কিন্তু কুহু আপাতত এতেই সন্তুষ্ট।
এদিকে তাহমিদ বুঝতে পারছে এভাবে করলে কুহুর রেজাল্ট হয়তো খুব ভালো হবেনা। তাই ও কুহুকে রাজশাহী রেখে আসতে চেয়েছে কয়েকবার। কিন্তু কুহু রাজি হয়নি। ও এখন ঢাকা থেকে যেতে চাচ্ছেনা। শাহানা ফুপু না আসা পর্যন্ত তাহমিদকে বাসায় একা থাকতে হবে। তার খাওয়াদাওয়া ঠিকমত হবেনা। এসব কারনেই কুহু যেতে চাইছেনা। তবে ও তাহমিদকে কথা দিয়েছে, মন দিয়ে পড়াশোনা করবে।

শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে উঠে তাহমিদ কাঁচাবাজার নিয়ে বাসায় এসেই আবারও বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। এবং প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পরে। কুহু রান্নাঘরে কাজ করতে ব্যস্ত। সব কাজ শেষ করে কুহু তাহমিদকে ডেকে তোলে। তাহমিদ সকালে খায়নি জন্য কুহুও না খেয়েই সব কাজ শেষ করেছে। তাহমিদ উঠলে দু’জনে একসাথে খেতে বসেছে। ঠিক তখনই কলিং বেল বেজে উঠল। তাহমিদ উঠতে চাইলেই কুহু ওকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই দরজা খুলতে যায়।

দরজা খুলে দরজার ওপারের দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে তাহমিদ যেন খানিকটা বিরক্ত হয়। ও সামান্যতম তোয়াক্কাও করলনা সামনের মানুষটিকে দেখে।

” এভাবে খাম্বার মত দাঁড়িয়ে আছ কেন? সরে দাঁড়াও, আর আমাকে ভেতরে ঢুকতে দাও। তোমাকে দেখতে আজ এখানে আসিনি। ” রাশেদ কুরাইশি তাহমিদের কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দিয়ে নিজে ভেতরে ঢুকলেন। তার পেছন পেছন দুইজন হাত ভর্তি বাজার নিয়ে ভেতরে ঢুকল।

কুহু শ্বশুরকে আসতে দেখে খাবারের প্লেট সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায়। মেঝেতে একটা মাদুরে খাবার সাজানো দেখে রাশেদ কুরাইশির মন খারাপ হয়ে যায়। তিনি যেখানে তিনবেলা লাখ টাকার ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খান, সেখানে তার ছেলে আর ছেলের বউ মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে খাচ্ছে! সাথে সাথেই তার মনে হয়, হায়রে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস!

” বাবা, আপনি! ” কুহু শ্বশুরকে দেখে অবাক হয়ে গেছে।

” এই তোমরা বাজারগুলো বউমাকে দাও। ” রাশেদ কুরাইশির নির্দেশ পেয়ে লোক দুটো বাজার রেখে বাহিরে চলে যায়।

” বউমা, এখানে তোমার, আমার আর ঐ উজবুকের পছন্দের মাছ-মাংস আছে। তুমি মজা করে রান্না কর দেখি। অনেকদিন ধরে তোমার হাতের রান্না খাইনা। ” লোক দুটো চলে যেতেই রাশেদ কুরাইশি পুনরায় বললেন।

” আপনি বসুনতো, বাবা। আগে আমাদের সাথে বসে খেয়ে নিন। তারপর আপনার পছন্দমত সব রান্না করব। ”

রাশেদ কুরাইশি ছেলের বউয়ের কথামত মুখহাত ধুয়ে এসে মাদুরে বসল। তাহমিদ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। সে রাশেদ কুরাইশির এহেন কাজে তব্দা খেয়ে গেছে।

” তুমি কি আমাদের সাথে খাবে? নাকি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে? বউমা, খেতে দাও দেখি। আজকে খাওয়ার সময় পাইনি। ”

কুহু আর দেরি না করে প্লেটে দুইটা পরোটা, ডিম ভাজা, আলুভাজা তুলে রাশেদ কুরাইশির হাতে দেয়। কুহু তাহমিদকে ডাকলে সে-ও এসে বসে।

খাওয়া শেষ করে কুহু সকালের সব খাবার ফ্রিজে তুলে রাখে। এরপর রাশেদ কুরাইশির নিয়ে আসা বাজার ব্যাগ থেকে বের করে সেগুলোর প্রসেসিং শুরু করল।

রাশেদ কুরাইশি রান্নাঘরে বসে কুহুকে কাজে সাহায্য করছে। তাহমিদ ড্রয়িংরুমের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সব কান্ডকারখানা দেখছে আর অবাক হচ্ছে। যেই বাবা আজ পর্যন্ত নিজের বাসার রান্নাঘরে ঢোকেনি সেই মানুষ এখানে এসে রান্নাঘরে কুহুকে সাহায্য করছে! বিষয়টা তাহমিদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন।

কুহু জোর করে রাশেদ কুরাইশিকে ড্রয়িংরুমে পাঠিয়ে দেয়। যদিও তিনি আসতে চাইছিলেননা কিন্তু কুহু তার আপত্তি কিছুতেই শুনলনা।

রাশেদ কুরাইশি ড্রয়িংরুমে আসলে তাহমিদ তার দিকে চেয়ার এগিয়ে দেয়।

” বাসাটা খারাপ নয়। একে একে সব রকম ফার্নিচারও কিনতে হবে। কবে কিনবে সেগুলো? ফার্নিচার ছাড়া বাসা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ” রাশেদ কুরাইশি চেয়ারে বসেই তাহমিদকে জিজ্ঞেস করলেন।

” প্রতিমাসেই একটা একটা করে কিনে নিব। আমারতো আপনার মত অঢেল টাকা, সম্পত্তি নেই যে তুড়ি মে’রে সব কিনব। ”

” বলছি কি, এভাবে বাসা থেকে দূরে না থাকলে কি হয়না? বাসায় থাকলে অন্তত জানতে পারি তুমি ঠিক আছো, সুস্থ আছো। এখানে কিছুদিন কাটালে ঠিক আছে। এবার বাসায় ফিরে চল। ”

” আমি এখানেই ঠিক আছি। আশা করব আর কখনোই আপনার বাসায় যাওয়ার কথা বলবেননা। ”

রাশেদ কুরাইশি বুঝলেন তার এই ত্যাড়া ছেলের সাথে এভাবে কথা বলে কোন লাভ নেই।

রাতে খেয়েই তবে রাশেদ কুরাইশি বাসায় ফিরলেন। তিনি তৃপ্তি সহকারে খেয়েছেন। কুহুকে বলেছেন, প্রতি সপ্তাহে তিনি এখানে আসবেন। কুহুও সানন্দে রাজি হয়।

একমাস পর কুহু তাহমিদের সাথে রাজশাহী আসে। আর চারদিন পর থেকে ওর পরীক্ষা শুরু। রাজশাহী এসে প্রথমেই ওরা নানিমাকে দেখতে যায়ন। আজকাল নানিমা বেশি অসুস্থ হয়ে গেছেন। তিনি বেশিরভাগ সময়ই ঘুমিয়ে কাটান। এমনকি জেগে থাকলেও কাউকে চিনতে পারেননা। কিছুদিন থেকে খাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছেন।

তাহমিদ নানিমার কাছে তার ধরে সারাটা সময় বসে রইল। ও বেশ বুঝতে পারছে নানিমা আর বেশিদিন ওদের মাঝে থাকবেনা। কথাটা ভাবতেই তাহমিদের বুকের ভেতর ফাঁকা হয়ে যায়। বিষন্নতা ওকে ঘিরে ধরল। এই মানুষটাই এক সময় ওর বেঁচে থাকার কারন ছিল। এই মানুষটাই ওকে সাহস জুগিয়েছে। দুনিয়ার মানুষের বাঁকা দৃষ্টি, অপমান থেকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছে। আজ সেই মানুষটার আয়ু প্রতি সেকেন্ডে কমে আসছে। তাহমিদ হঠাৎই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ওর অতিপ্রিয় নানিমা আর থাকবেনা এটা ও মানতে পারছেনা। কিভাবে থাকবে সে এই মানুষটাকে ছেড়ে।

কুহু নিরবে সবকিছু দেখছে। ও একটিবারের জন্যও তাহমিদকে শান্তনা দিতে যায়নি। কিছু কিছু কষ্টের শান্তনা কখনোই হয়না। ওর মুখের সামান্য শান্তনার বিনিময়ে তাহমিদের মন কখনোই ভালো হবেনা, এটা ও ভালো করেই জানে। কাঁদুক না মানুষটা। এতে যদি তার কষ্ট একটু লাঘব হয়। প্রায় দুই ঘন্টা পর কুহুকে নিয়ে তাহমিদ বাসায় ফিরল।

পরদিন সকালে কুহুর বড় ফুপু গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কুহুও ভার্সিটিতে যায়। তাহমিদ ওকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে সোজা নানিমার কাছে যায়। কুহু বাসায় না ফেরা পর্যন্ত ও নানিমার কাছেই থাকবে।

তাহমিদ বাসায আসলে রাজিয়া খালা তার দিকে হাসিমুখে এগিয়ে যান। তাহমিদ তাকে জড়িয়ে ধরে। রাজিয়া খালা তাহমিদের সাথে ফাতিমা খানমের কাছে যান। সেখানেই তিনি গত একমাসের সব গল্প তাহমিদকে শোনাতে শুরু করলেন।

তিনদিন পর তাহমিদ ঢাকা ফিরে যায়। কুহুরও পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ওর পরীক্ষা খুব একটা ভালো না হলেও খারাপ হচ্ছেনা। ও দুই-এক দিন পর পরই নানিমাকে দেখে যায়।

বৃহস্পতিবার বিকেলে তাহমিদ রাজশাহী এসেছে। কুহুর পরীক্ষা তিনদিন পর। তাহমিদ বাসায় এসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে কুহুকে তৈরী হতে বলল। ওরা এখন নানিমার কাছে যাবে। কুহু তৈরী হতে গেলে তাহমিদ নায়লা আঞ্জুমকে ফোন করে জানায, সে নানিমাকে দেখতে যাবে। নায়লা আঞ্জুমও জানায়, এই সুযোগে সে-ও যাবে তার মা’কে দেখতে।

নানিমার অবস্থা সে-ই আগের মতই। নায়লা আঞ্জুম মা’য়ের পাশে গিয়ে বসল। সে তার মা’য়ের মাথা, চোখমুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সেই সাথে তার চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরছে। এই বাসায় এত বছর থেকে সে মা’য়ের মমতা সম্পর্কে উদাসীন ছিল। কিন্তু এখান থেকে যাবার পরই সে বুঝতে পেরেছে মা নামক মানুষটি কত আদরের, মমতার। সে প্রতি মুহূর্তে তার মা’কে মিস করে। এত বছর তার প্রতি উদাসীনতার জন্য নিজেকে দোষারোপ করে। সে এখন নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে। প্রতি মোনাজাতেই সে মা’য়ের সুস্থতার জন্য দোয়া করে। সপ্তাহের তিনদিন সে মা’কে দেখতে আসে। ঘন্টার পর ঘন্টা সে মা’য়ের পাশে বসে থাকে। তার চোখমুখে হাত বুলায়।

তাহমিদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নায়লা আঞ্জুমের দিকে। সে পরম মমতায় তার মায়ের মুখে হাত বুলাচ্ছে। হঠাৎই তাহমিদের বুকের ভেতর উথলে ওঠে। ওর মা’য়ের কি একবারও ওর কথা মনে হয়না? একবারও কি তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করেনা! মা’য়ের আদর কতদিন সে শরীরে মাখেনি। মায়ের শাসনে কখনো নিজেকে শুদ্ধ করা হয়নি। কত বছর হয় মা’য়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমানো হয়নি। তাহমিদ জানে এটা কখনোই হয়ে উঠবেনা। বাকিটা জীবন ওকে মা’য়ের আদর,শাসন ছাড়াই কাটাতে হবে।

” তাহমিদ, দেখতো আম্মা এমন করছে কেন? কি হয়েছে আম্মার? ” নায়লা আঞ্জুমের উদগ্রীব গলা শুনে তাহমিদের চিন্তা ভঙ্গ হয়। ও নানিমার দিকে তাকায়।

ফাতিমা খানম চোখ খুলেছেন। তার ঘোলাটে চোখ কাউকে খুঁজে চলেছে। তাহমিদ নানিমার দিকে ঝুঁকে তাকে মৃদু গলায় ডাক দেয়।

” নানিমা, কি হয়েছে তোমার? খুব কষ্ট হচ্ছে? ”

বৃদ্ধা যেন তার আদরের নাতির কথা শুনতে পেলেন। তিনি একহাত বাড়িয়ে দিলেন তাহমিদের দিকে। তাহমিদ নানিমার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিতেই তিনি উঠে বসার চেষ্টা করলেন। তাহমিদ একটু অবাক হয়ে তাকে তুলে বসাতে চাইলেও সেটা করতে পারলনা। তাকে পুনরায় শুইয়ে দিল। বৃদ্ধা তাহমিদের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছেন।

” আম্মা, ও আম্মা, কি হয়েছে তোমার? আমার দিকে তাকাও, আম্মা। ” নায়লা আঞ্জুম কাঁপা কাঁপা গলায় মা’কে ডাকল। এবার বৃদ্ধা তার মেয়ের দিকে তাকালেন। হঠাৎই যেন এক চিলতে হাসি ছুঁয়ে দেয় বৃদ্ধার ঠোঁটের কোন।

ততক্ষণে সৈকত ও তার স্ত্রী রুমে এসেছে। বৃদ্ধা একে একে সকলের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরান তাহমিদের দিকে। তিনি তাহমিদের হাত নিজের দিকে টেনে নিয়ে ছোট্ট করে চুমু দেন। এরপর হঠাৎই তার হেঁচকি উঠে। তারপর ধীরেসুস্থে তিনি চোখ বন্ধ করলেন। তখনও তার ঠোঁটে হাসির রেখা স্পষ্ট।

চলবে…

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৫০
জাওয়াদ জামী জামী

কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে তাহমিদ। গত তিনদিন ধরে সে নিশ্চুপ। নানিমার এভাবে চলে যাওয়া সে মানতেই পারছেনা। যখনই নানিমার কথা মনে হচ্ছে, তখনই ওর দুনিয়া ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। কুহু এই তিনদিন চুপচাপ তাহমিদের পাশে বসে থেকেছে। কখনো ওর মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়েছে। কুহুর ছোঁয়া পেতেই তাহমিদ বারবার কেঁদে উঠেছে। তাহমিদকে কাঁদতে দেখলেই কুহু ওকে জড়িয়ে ধরেছে, কখনো শান্তনা দিয়েছে আবার কখনোবা তাকে কাঁদতে দিয়েছে। ওরা গত তিনদিন থেকে নায়লা আঞ্জুমের বাসায় আছে। তাহমিদকে ভেঙে পরতে দেখে রায়হান আহমেদ ওদেরকে ঐ বাসায় যেতে দেননি।
নায়লা আঞ্জুমও ভেঙে পরেছে। সে মা’য়ের কথা ভেবে একটু পরপরই কাঁদছে।

নানিমার মৃ’ত্যু’র খবর পেয়েই কুহুর বড় ফুপু এসেছেন। তিনিই বাসার যাবতীয় কাজকর্ম করছেন। নায়লা আঞ্জুমের খেয়াল রাখছেন। ফুপু আসাতে কুহুও যেন স্বস্তি পেয়েছে। ও তাহমিদকে সামলাতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে গেছে। তারউপর নায়লা আঞ্জুমকে সামলানো ওর পক্ষে সম্ভব ছিলনা।

কুহু গিয়ে তাহমিদের পাশে বসল। হাত রাখল ওর মাথায়। কুহুর স্পর্শ পেয়ে তাহমিদ চোখ খুলল। ওর চোখজোড়া লাল হয়ে আছে।

” এবার উঠুন, চোখমুখে পানি দিয়ে একটু খেয়ে নিন। এভাবে না খেয়ে থাকলে আপনি অসুস্থ হয়ে যাবেন। ”

” আমার যে ক্ষুধা পাচ্ছেনা। সমস্ত শরীর কেমন অসার হয়ে আছে। বারবার মনে হচ্ছে, আমার একটা অঙ্গহানি হয়েছে। আমার বুকের পাঁজর বুঝি ভেঙে গেছে। ”

কুহু সযতনে তাহমিদের গালে হাত রাখল। ছোট্ট করে চুমু দেয় তার একান্ত পুরুষের কপালে। কোমল কন্ঠে বলল,

” এভাবে বলতে নেই। আপনি এভাবে ভেঙে পরলে আমার কি হবে! আপনার কান্না আমি সইতে পারছিনা। আপনাকে এভাবে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে। এভাবে কান্নাকাটি না করে, নানিমার জন্য দোয়া করুন। আমি দেখেছি তিনি আপনাকে অনেক ভালোবাসতেন। তার ভালোবাসার প্রতিদানে আপনি নানিমার জন্য বেশি বেশি দোয়া করুন। এতে তিনি শান্তি পাবেন। ”

কুহুর কথা শুনে তাহমিদের মনে যেন শান্তির পরশ লাগে। ও কুহুর কোলে মাথা রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকে। কুহুও চুপটি করে বসে বসে তাহমিদের চুলে আঙুল চালায়।

শায়লা হাসান জয়কে সাথে নিয়ে নায়লা আঞ্জুমের বাসায় এসেছে। সে কুহুর দিকে যতবার তাকাচ্ছে, ততবারই তার ভ্রু কুঁচকে আসছে। কুহুকে সে সব সময়ই ছোটলোকের চোখে দেখেছে। তার কাছে কুহু এবং তার পরিবার ছোটলোক বৈ কিছুই নয়। কুহু শায়লা হাসানের মনোভাব ঠিকই বুঝতে পারছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর শায়লা হাসানের চাহনিকে পাত্তা দেয়ার ইচ্ছা নেই মোটেও। তাই ও শায়লা হাসানকে সযতনে এড়িয়ে যায়। এদিকে জয় নির্লজ্জের মত কুহুর চারপাশে ঘুরঘুর করছে। বিষয়টা তাহমিদও লক্ষ্য করেছে। ও যতবারই কুহুর আশপাশে জয়কে দেখছে, ততবারই ও রা’গে ফেটে পরছে। কুহুও জয়ের এমন ছ্যাঁচড়ামো দেখে বিরক্ত হয়ে গেছে। ও জয়ের থেকে যতই দূরে থাকছে, জয় ততই ওর কাছে আসার চেষ্টা করছে। আবার মাঝেমধ্যে ইশারায় কিছু বলছে যা কুহু বুঝতে পারছেনা। কুহু ভাবছে, তাহমিদ যদি এসব জানতে পারে, তবে সে জয়ের অবস্থা খারাপ করে দেবে। কিন্তু বেচারি জানেইনা, জয়ের এমন বেহায়াপনা ঠিকই তাহমিদের নজরে পরেছে।

” কোকিল পাখি, তুমি এভাবে আমার সাথে লুকোচুরি করছ কেন? আমি আগে তোমার দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিলাম। কিন্তু এখনতো আমাদের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। এখন আমরা চাইলেই কথা বলতে পারি। এমনকি হাসিঠাট্টা কিংবা ইয়ার্কিও করতে পারি। এখন আমি তোমার দেবর। জানোতো বরের থেকেও দেবরের সাথে ভাবীদের সম্পর্ক মধুর হয়। এবং দেবরের অধিকারও বেশি হয়। তাই মাঝেমধ্যে একটু মধুর ভুল করাই যেতে পারে। ”

জয়ের কথা শুনে রা’গে কুহুর শরীর রি রি করছে। জয়ের ইংগিত বুঝতে কুহুর মোটেও কষ্ট হয়না। ওর ইচ্ছে করছে জয়ের গালে সপাটে থা’প্প’ড় মা’র’তে। কিন্তু ও এখন চাচার বাসায় আছে। তাই অনেক কষ্টে নিজের ইচ্ছেকে সংবরণ করল। তবে ও জয়কে শাসাতে ভুল করলনা।

” মুখ সামলে কথা বলুন। আপনি ভুলে যাবেননা, আমি আপনার বড় ভাইয়ের বউ। সে যদি জানতে পারে, আপনি আমার সাথে অসভ্যতা করেছেন, তবে কিন্তু আপনাকে ছাড়বেনা। এই মুহূর্তে যদি আপনি অন্য কোথাও থাকতেন, তবে থা’প্প’ড় দিয়ে আপনার দাঁত ফেলে দিতাম। এমন নির্লজ্জতা অন্য কোথাও দেখান গিয়ে। ” কুহু রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের রুমে যায়। ও ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখতে পেত পাশেই করিডরে তাহমিদ দাঁড়িয়ে ছিল।

রাত দশটা বিশ। জয় টি বাঁধে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ওর সাথে তিনজন ছেলে আছে। যারা জয়ের পরিচিত। ও রাজশাহী আসলেই এদের সাথে আড্ডা দেয়। জয় কেবলই বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিয়েছে। ঠিক তখনই ওর ঘাড়ে কারও স্পর্শ টের পায়। কেউ একজন পেছন থেকে ওর কাঁধে হাত রেখেছে। জয় বিরক্ত হয়ে হাতটা সরিয়ে দিলে, পরক্ষনেই আবার কাঁধে হাতের অস্তিত্ব টের পায়।
এবার জয় রে’গে একটা বাজে গালি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

” কে বে? এভাবে বিরক্ত করছিস কেন? ভোগে যাওয়ার সাধ জেগেছে নাকি? শা’লা মাদারটোস্ট। ” জয় পেছনে তাকাতেই ভয়ে জমে যায়। ও দেখল আট থেকে দশজন দশাসই চেহারার মানুষ হাতে হকিস্টিক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতেকের মুখ মুখোশে ঢাকা।

জয়ের সাথে থাকা তিনজনও চমকে গেছে। সেই দশজন ছেলের মধ্যে থেকে একজন এগিয়ে এসে জয়ের তিনজন বন্ধুকে এখান থেকে চলে যেতে বলল। তারা প্রথমে চোটপাট করলেও সেই মুখোশধারী ছেলেটার হুমকিতে সেখানে থাকার সাহস হারায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা জয়কে
রেখে চলে যায়।

এবার জয় সত্যিই ভয় পায়। তার গত এক বছর আগের সেই রাতের কথা মনে হয়। আজও কি সেবারের মতই কিছু ঘটতে যাচ্ছে! ও এবার ছেলেগুলোর হাত-পায়ে ধরতে থাকে। তবে সেই ছেলেরদল ওর অনুরোধ পাত্তা না দিয়ে জয়কে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গাড়িতে তোলে।

প্রায় বিশ মিনিট পর গাড়ি থেমে যায়। ওরা গাড়ি থেকে নেমে জয়কে নিয়ে একটা সুনশান জায়গায় আসল। এরপর সবাই জয়কে ঘিরে দাঁড়ালে দীর্ঘদেহী একজন এগিয়ে এসে দাঁড়ায় জয়ের মুখোমুখি। এক ঝটকায় খুলে ফেলে তার মুখোশ।

সামনে দাঁড়ানো তাহমিদকে দেখে জয় ভিষণ অবাক হয়। বোধহয় একটু খুশিও হয়। ও ভাবছে, তাহমিদ বুঝি ওর সাথে প্রাঙ্ক করছে।

” ভাইয়া, তুমি! এসব কি! এভাবে মজা করার কোনও মানে হয়? ”

” কে মজা করছে তোর সাথে! তোর সাথে মজা করার মুড বা ইচ্ছে কোনটাই আমার নেই। ”

” মজাই যদি না করবে, তবে আমাকে এখানে, এভাবে নিয়ে এসেছ কেন? ”

” তোকে সাইজ করতে। খুব বেড়ে গেছিস। তাই তোকে একটু সাইজ না করলেই নয়। আবারও তুই আমার সম্পদে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করছিস। ”

” কি বলছ, ভাইয়া! তোমার সম্পদে আমি হাত দিতে যাব কেন? আমার বাবার কি সম্পদ কম আছে নাকি! ”

” আমার কাছে যে সম্পদ আছে, সেই সম্পদ তোর বাপ-দাদার চৌদ্দ গোষ্ঠীতে নেই। তাই সেদিকে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে হওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক কিছুই নয়। ”

” ভাইয়া, এমন হেয়ালি করোনা। বাসায় ফিরতে হবে। বেশ রাত হয়েছে। ”

” কুহুকে দুপুরে কি যেন বলেছিলি? মধুর ভুল করতে ইচ্ছে করছে? বরের থেকে দেবরের সাথে ভাবীদের সম্পর্ক মধুর হয়? আমার বউকে এমন কথা বলার সাহস তোর কিভাবে হয়! ”

হঠাৎই তাহমিদকে প্রসঙ্গ পাল্টাতে দেখে জয় থতমত খেয়ে গেছে। তাহমিদ এই সময়ে এমন কথা বলতে পারে সেটা ওর ধারনায়ই ছিলনা।

” ভা..ভাইয়া, আমিতো কোকিল পাখির সাথে মজা করেছি। আ…” জয় কথা শেষ করতে পারলনা। তাহমিদের প্রকান্ড থাপ্পড় খেয়ে ও চোখে আঁধার দেখে।

” কুহু শুধু আমার। ও আমার কোকিল। আমার হলদে পাখি। তোকে সেবার খু’ন না করে শোধরানোর সুযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু তুই শোধরাবার মানুষ নয়। এক বছর পরে এসেও তুই আবার কুহুর দিকে নজর দিয়েছিস। যে কুহুর জন্য আমি দুনিয়ার সাথে লড়াই করতে পারি, সেই কুহুর দিকে তুই আরেকবার চোখ তুলে তাকিয়েছিস। তাহমিদের কাছে তোর অন্যায়ের বারবার ক্ষমা নেই। সেবারও তুই কুহুর দিকে কুদৃষ্টি দেয়ার অপরাধে মা’র খেয়েছিলি। এবারও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। ”

জয় তাহমিদের কথা শুনে শুকনো ঢোক গিলল। তাহমিদ যে মিথ্যা বলছেনা, সেটা তার চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবে গতবারের বিষয়টা ওর কাছে ক্লিয়ার হয়ে যায়। সেবার ওর করুন অবস্থার পেছনে যে তাহমিদেরি হাত ছিল, সেটা ভাবতেই ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়। আজ আবার কি হতে চলেছে ওর সাথে!

বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। প্রিয় পাঠকমহল, আগামী পাঁচ-সাতদিন আমি নিয়মিত গল্প দিতে পারবনা। সেজন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমার ছোট ননদের বেবি হবে। ওকে সি সেকশনে নিতে হবে। আমি একমাত্র ভাবী হবার সুবাদে তার সকল দ্বায়িত্ব পালন করতে হবে। সে কারনে হয়তো ঠিকঠাক লিখতে পারবনা। দোয়া করবেন যেন সবটা ঠিকমত সামলাতে পারি।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে