#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২১
জাওয়াদ জামী জামী
মিথিলা আরজুমান্দ স্বামী-সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় একটা পাঁচতারকা হোটেলে উঠেছে। নাহিয়া ঘৃ’ণা’য় বাবা-মা’ র দিকে তাকাচ্ছেনা।
” নাহিয়া বেইবি ,তুমি এভাবে আমাদের দিক থেকে মুখ ঘুড়িয়ে রেখনা। আমি তোমাকে এভাবে দেখতে পারছিনা। কথা বল বেইবি। ” মিথিলা আরজুমান্দ মেয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে।
” শ্যাটআপ, মম। তোমার এমন কথা আমি জাস্ট নিতে পারছিনা। তোমার কথাকে আমার ন্যাকামো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তোমার সব অভিনয়। একটা কথা বলতো, এতদিন ধরে তুমি তোমার প্রথম সন্তানকে একদিনও মনে করনি? কি করে পেরেছ, তাকে না দেখে থাকতে! ” নাহিয়া মা’য়ের সঙ্গে ঘৃণাভরে কথা বলছে।
” আমার জীবনে তোমাদের মূল্য সবথেকে বেশি। তাই কারও কথা ভাবার সময় আমি পাইনি। তোমরাই আমার কাছে সব। আব্বার কথায় বিয়ে করেছিলাম রাশেদ কুরাইশিকে। তার অর্থ, প্রভাব-প্রতিপত্তির কমতি ছিলনা। একসময় আমার কোলজুড়ে সন্তানও আসল। ও ধীরে ধীরে বড় হতে থাকল। একসময় বুঝতে পারলাম, রাশেদ কুরাইশির মন সংসার থেকে উঠে গেছে। একদিন জানতে পারলাম, রাশেদ কুরাইশির তার সেক্রেটারির সাথে সম্পর্ক চলছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করায়, সে অস্বীকার করল। আমিও আর কথা বাড়াইনি। একদিন তাহমিদকে নিয়ে শপিংয়ে গিয়ে তোমার পাপার সাথে পরিচয়। সেই পরিচয় পরিনয়ে গড়াতে সময় লাগেনি। ধীরে ধীরে রাশেদ কুরাইশির সাথে আমার দূরত্ব বাড়তে থাকে। একদিন সময় বুঝে কুরাইশি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি তোমার পাপার কাছে। এর দুইমাস পর চলে যাই সুইজারল্যান্ড। ”
” কি করে পেরেছ, সন্তানকে রেখে অন্য কারো হাত ধরে চলে যেতে? একবারও কি ঐ ভাইয়াটার চেহারা তোমার চোখে ভাসেনি? এখানে পাপাও সমান দোষী। সে চাইলেই পারত একটা সংসারকে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করতে। কি করে পারলে! ”
” আমার কাছে তোমার পাপাই সব ছিল। আমার তখন অন্য কারো কথা ভাববার অবকাশ ছিলনা। এরপর আমার জীবনে তুমি আসলে। আমি আমার দুনিয়ায় ব্যস্ত হয়ে পরলাম। তোমার পাপাও আমাকে অন্যকাউকে মনে করার সুযোগই দেয়নি। তাই তাহমিদকে আমার একটা দিনের জন্যও মনে পরেনি। আমি জানতাম ও সুখে আছে। ইভেন গতকাল পর্যন্তও আমি ওকে মনে করিনি। আমি তাহমিদের জন্য দেশে আসিনি, এসেছি তোমার নানুকে দেখতে। দেশে আসার আগে জানতে পেরেছি তাহমিদ রাজশাহীতে আছে। তখনই শুধু মনে হয়েছে ওকে আমি একবার দেখতে পাব। আশা করছি তোমার উত্তর পেয়ে গেছ। ”
নাহিয়া অবাক হয়ে মিথিলা আরজুমান্দদের দিকে তাকিয়ে আছে। ও ভাবছে, কোনও মা আদৌ কি সন্তানকে না দেখে থাকতে পারে! কতটা পাষাণ হলে মানুষ এমন করতে পারে!
” এখন যদি তোমার অন্য কাউকে ভালো লাগে, কিংবা পাপার অন্য কোন মেয়েকে পছন্দ হয়, তবে কি তোমরা আলাদা হয়ে যাবে? আমাদের কথা মনে করবেনা নিশ্চয়ই? ”
” এসব কি বলছ, সোনা? তুমি আমাদের প্রিন্সেস। আমাদের ভালোবাসার ফল। তোমাকে, মিশালকে ছেড়ে যাবার কথা আমরা কল্পনাই করতে পারিনা। শান্ত হও বেইবি। তুমি আমার কথা একটু বুঝতে চেষ্টা কর। এত হাইপার হলে তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে। ”
” আমি কিভাবে শান্ত হই, মম! তোমাদের করা অন্যায়ের কথা মনে হলেই আমার বুকে ঘৃণারা আছড়ে পরছে। বারবার ঐ ভাইয়াটার কান্না ভেজা চোখদুটো চোখে ভাসছে। একটা নয় বছরের ছেলে মা’কে ছাড়া কতটা অসহায় তার কথা শুনে আমি বুঝতে পারছি। আমি তার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে, নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছিনা। সে তাহলে কিভাবে জীবনের এতটাদিন কাটিয়েছে, ভাবলেই আমার কান্না পাচ্ছে। মা ছাড়া একটা সন্তান যে কতটা অসহায়, সেটা তুমি দুইদিনের জন্য বাহিরে গেলে আমি বুঝতে পারি। তবে আজ আমার মনে হচ্ছে, তুমি ভিষণই স্বার্থপর একজন মানুষ। নিজের সুখের জন্য সংসার ছেড়েছিলে, আবার নতুন সংসারে গিয়ে সেই পরিবারের সবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছ। আমাদের সাথে দাদু বাড়ির সম্পর্ক রাখতে দাওনি। দেশে এসে দাদুর বাড়িতে না গিয়ে উঠেছিলে হোটেলে। আবার আজকেও সেটাই করলে। আর পাপাও তোমাকে অন্ধের মত সাপোর্ট দিয়ে গেছে। যাহোক আমি আর কথা বাড়াতে চাচ্ছিনা। তোমার নিজের জীবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত তুমি নিতেই পার। আর আমিও পারি নিজেকে একটু ভালো রাখতে। তাই এখন থেকে সেই চেষ্টাই করব। আমি সুইজারল্যান্ড ফিরে হোস্টেলে উঠব। সেখান থেকেই পড়াশোনা করব। এবং এটাই ফাইনাল। ”
” নাহিয়া সোনা, তুমি এসব কি বলছ! আমরা তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবনা। তুমি আমাদের চোখের মনি। ” নাহিদ সারোয়ার মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করছে।
” বাসায় থাকলেই তোমাদেরকে দেখতে হবে। আর যতবারই তোমাদের দেখব, ততবারই এক অসহায় সন্তানের হাহাকার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠবে। যেটা আমি সহ্য করতে পারবনা। তাই আশা করছি তোমরা আমাকে কোন বাঁধা দেবেনা। ”
নাহিদ সারোয়ার এবং মিথিলা আরজুমান্দ দুজন দু’জনের দিকে তাকায়। তারা বুঝতে পারছে তাদের মেয়ে এই মুহুর্তে তাদের কোন কথা শুনবেনা। তাই তারা আপাতত চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। একবার সুইজারল্যান্ড যেতে পারলে তারা নিশ্চয়ই তাদের মেয়েকে বোঝাতে পারবে।
সকাল থেকে তাহমিদ রুম থেকে বের হয়নি। সকালে নাস্তা করবার জন্য রাজিয়া খালা কয়েকবার ওকে ডাকতে এসেছিলেন। কিন্তু তাহমিদ যায়নি।
বেলা এগারোটার দিকে খালা আরেকবার ওকে ডাকতে আসলেন।
” বাপজান, চল খাইবা। সবার খাওয়া শেষ। এখন তুমি খাইলেই আমরা খাইতে পারি। আর দেরি কইরোনা, বাপজান। ” খালার দরদ মাখা কথা শুনে তাহমিদ আর শুয়ে থাকতে পারলনা। ও উঠে বসল।
” খালা, তুমি যাও। আমি আসছি। টেবিলে তিনজনের খাবার দিও। তোমার সাথে সাথে নিশ্চয়ই সেই মেয়েও খায়নি? তোমরা দেখছি আমাকে ব্ল্যাকমেইলের ওপরই রাখবে। আমার সকাল হবে ব্ল্যাকমেইলের নাস্তা করে, রাত হবে ব্ল্যাকমেইলের ডিনার করে। ভাবা যায়! জীবনটাই ব্ল্যাকমেইলময়। ”
” আর কথা কইওনা। নিচে আস, আমি খাবার দিতাছি। খাওয়ার পর তোমার নানিমার কাছে যাইবা। হেয় কাইল থাকা খালি কানতাছে। ”
” আচ্ছা, খালা। ” তাহমিদ আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে ঢুকল।
তাহমিদ খাবার টেবিলে আসলে কুহু গরম ভাতের প্লেট এগিয়ে দেয় ওর দিকে।
” খালা, তোমরা খাবেনা? জলদি এস। ”
” তুমি খাও, বাপজান। আমি হাতের কাজ কইরাই খাব। কুহু মা, তুমিও বাপজানের সাথে খাইয়া লও। ”
” না খালা, আমি আপনারই খাব। ”
তাহমিদ কিছু না বলে শুটকি ভর্তা দিয়ে ভাত মেখে এক লোকমা ভাত কুহুর মুখের দিকে ধরে।
তাহমিদের এমন কাজে কুহু চরম বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে।
” খাবে? নাকি আমি প্লেট রেখে উঠে যাব? সিদ্ধান্ত তোমার। ”
কুহু আঁড়চোখে তাকায় ড্রয়িংরুমের চারপাশে। সেখানে কাউকে না দেখে, একটু ইতস্তত করে খাবার মুখে নেয়।
রাজিয়া খালা দৃশ্যটা দেখে স্বস্তির হাসি হাসলেন।
কুহু এক লোকমা ভাত মুখে নিয়েই রান্নাঘরে চলে যায়। চুপচাপ খালার পেছনে সেঁধিয়ে থাকে। লোকটা বারবার ওকে লজ্জায় ফেলে দেয়। সে যেমন নিজের অনুভূতি লুকায়না, তেমনি কুহুর অনুভূতিও টেনে বের করতে ওস্তাদ।
” নানিমা, তুমি কালকের সব ঘটনা শুনেছ? তোমার বড় মেয়ে উনিশ বছর পর মাতৃত্বের দাবী নিয়ে এসেছে। অথচ যে একটা সময় আমাকে ছেড়ে যেতে দু’বার ভাবেনি। তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ, নানিমা? কষ্ট পেয়েছ তোমার মেয়ের সাথে খারাপ আচরণ করেছি জন্য? কষ্ট পেলে আমাকে জানিয়ে দিও, আমি এই বাসা ছেড়ে চলে যাব। ” তাহমিদের চোখের কোনে চিকচিক করছে দুঃখের অশ্রু। সে খাওয়া শেষ করেই নানিমার কাছে এসেছে।
তাহমিদের কথা শুনে বৃদ্ধা তার একমাত্র সচল হাতটি বাড়িয়ে দিলেন। তাহমিদ তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিতেই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। এক হাত দিয়ে তাহমিদকে নিজের কাছে টেনে নেয়ার চেষ্টা করছেন। তাহমিদ তার দিকে এগিয়ে গেলে তিনি একহাতে ওকে জড়িয়ে নিলেন।
কুহু কোচিং-এ যাবার সময় আশেপাশে তাহমিদকে দেখলনা। আজ সারাদিন মানুষটা বাসা থেকে বের হয়নি। সে এখনো রুমেই আছে। কুহুর বুক চিঁড়ে আপনাআপনি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। ও একনজর দোতলায় তাকিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।
কোচিং শেষ করে বেরিয়ে আসতেই, তাহমিদকে সামনের দোকানে বসে থাকতে দেখল কুহু। সে উদাস নয়নে সূদুরে তাকিয়ে আছে। আশেপাশে কি হচ্ছে সেদিকে তার কোনও খেয়াল নেই। কুহু বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু তাহমিদ ওকে লক্ষ্যই করলনা। বাধ্য হয়ে কুহু মৃদু পায়ে এগিয়ে আসে।
তাহমিদের সামনে এসে দাঁড়ালেও সে কুহুকে লক্ষ্য করলনা। এবার কুহু অবাক হয়। মানুষটা সেই কখন থেকে কিছু একটা ভেবেই চলেছে। তার মন-মস্তিস্কে চিন্তার ঝড় বইছে, সেটা কুহু বুঝতে পারছে। কিন্তু ও কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? তাহমিদকে এবার ডাকতেই হবে। ও তাহমিদকে কিভাবে ডাকবে সেই চিন্তাই করছে।
” এই যে মহাশয়? কোথায় হারালেন? আমি অনেকক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। ” সাহস করে কুহু কথা বলল।
হঠাৎ কারো আওয়াজ পেয়ে চমকে তাকায় তাহমিদ। সামনে দাঁড়ানো কুহুকে দেখে স্মিথ হেসে উঠে দাঁড়ায়। একটা ফাঁকা রিক্সা ডেকে উঠে বসল।
আজও ও কুহুকে নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছে। একটু ফাঁকামত জায়গা দেখে কুহুকে নিয়ে বসল। কুহু জড়োসড়ো হয়ে বসতেই, তাহমিদ ঘাসের ওপর সটান হয়ে শুয়ে পরল।
” আজকে শুধু বাদাম কিনেছি। প্যাকেট খুলে দেখ সবগুলো বাদাম ছিলে রেখেছি। তুমি চুপচাপ এগুলো খাও। এই সুযোগে আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। খবরদার আমাকে ডাকবেনা বলে দিলাম। আমাকে ডেকেছ তো ফেঁসেছ। তোমাকে ক্যাম্পাসে রেখে আমি বাসায় চলে যাব। সময় না কাটলে আমার ফোনে টিকটক দেখতে পার। ” কথাগুলো বলেই চোখ বুজল তাহমিদ। অবশ্য তার আগে নিজের ফোন পকেট থেকে বের করে কুহুর দিকে এগিয়ে দিয়েছে।
কুহু তাহমিদের এমন বেপেরোয়া কথা শুনে মুখ বাঁকায়। তাহমিদের চোখ বন্ধ দেখে ও কিছু বলার ইচ্ছেকে মাটিচাপা দিয়ে বাদামের প্যাকেট খুলল।
মাগরিবের আজান দিয়েছে। কুহু এবার উসখুস করছে। আজ চাচি ওকে ছাড়বেনা। কিন্তু কুহু হঠাৎ করেই অনুভব করল আজ ও চাচিকে মোটেও ভয় পাচ্ছেনা। তাহমিদের দিকে চোখ পরতেই দেখল মানুষটা প্রশান্তিতে ঘুমাচ্ছে। তাই তাকে ডাকতে কুহুর মন সায় দিলনা। ও গত এক ঘন্টায় বাদামগুলো খেয়ে নিয়েছে। সেই সাথে একক আধিপত্য খাটাচ্ছে তাহমিদের ফোনে।
আরও পনের মিনিট পর তাহমিদের ঘুম ভাঙ্গলো। ও হাই তুলে উঠে বসল। সামনে বসা মেয়েটার দিকে তাকাতেই আপনাআপনি ঠোঁটের কোন প্রসারিত হল।
” বাসায় যাবেনা নাকি এখানেই সংসার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছ? ”
তাহমিদের কথা শুনে বিরক্ত হয় কুহু। এ কেমনধারা কথা বলছে লোকটা! সে-ই আমাকে অপেক্ষা করতে বলে, উল্টো আমাকেই খোঁ’চা দিচ্ছে!
” তারাতারি বাসায় চলুন। আমি চাচিকে নিয়ে চিন্তা করছি। আজ আমার কপালে কি আছে আল্লাহই জানেন। ”
” তোমার কপালে আমার আদর বৈ কিছুই নেই। বুঝলে মেয়ে তোমার কপালে তাহমিদের রাজত্ব শুরু হয়েছে অনেকদিন আগেই। ”
” ছিহ্। অসভ্য লোক খালি আজেবাজে কথা বলে! ”
কুহুর কথা শুনে তাহমিদ নিরবে হাসল। ও কুহুর কথার উত্তর না দিয়েই সামনে হাঁটতে থাকে। কুহুও বাধ্য মেয়ের মত ওর পিছু নেয়।
চলবে….
#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২২
জাওয়াদ জামী জামী
গত কয়েকদিনের ন্যায় আজ কুহু রিক্সায় জড়োসড়ো হয়ে বসলনা। তাহমিদ আজ ওর মধ্যে কোন জড়তা না দেখে গোপনে হাসল। তবে ও কুহুর পেছন দিয়ে রিক্সায় হাত রাখতে ভুললনা।
প্রায় আধাঘন্টা পর ওদের রিক্সা বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়। কুহুর হঠাৎ করেই ভয় লাগতে শুরু করল। অন্যদিনের মত আজ তাহমিদ ওকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলনা। বাসার ভেতর ঢুকে কিসের সম্মুখীন হবে, সেটা ভাবতেই কুহুর গলা শুকিয়ে আসছে। ওর দু’পা যেন মাটির সাথে সেঁটে গিয়েছে।
” কি হলো, বাসায় না গিয়ে এখানে ল্যাম্পপোষ্টের মত দাঁড়িয়ে রইলে কেন? নাকি মহল্লার মানুষদের আলো দেয়ার সাধ জেগেছে? তবে তুমি থাক, আমি ভেতরে গেলাম। ” তাহমিদ কথাটা বলেই বাসার দিকে পা বাড়ায়।
তাহমিদের রুদ্রমূর্তি দেখে কুহুর কথা বাড়ানোর সাহস হয়না। ও তাহমিদের পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। আর মনে মনে দোয়া-দরুদ পাঠ করতে থাকে।
বাসায় ঢুকতেই ড্রয়িংরুমে রায়হান আহমেদকে বসে থাকতে দেখল কুহু। তার পাশে নায়লা আঞ্জুমও বসে আছে।
কুহুকে তাহমিদের সাথে দেখে কুটিল চোখে তাকায় নায়লা আঞ্জুম। সে কুহুকে কঠিন কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু তার আগেই কথা বললেন রায়হান আহমেদ।
” কুহু মা, তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি? আমি চিন্তায় পা’গ’ল হয়ে যাচ্ছিলাম। ফোন নিয়ে যাসনি কেন? আর তাহমিদের সাথে কোথায় দেখা হয়েছে তোর? ” রায়হান আহমেদের গলায় নিখাঁদ উদ্বেগ।
” চাচা, আমি…. কুহু কথা শেষ করতে পারলনা। তার আগেই তাহমিদ কথা বলল,
” তালুকদার সাহেব, ও কোচিং থেকে বেরিয়ে সম্ভবত রিক্সার অপেক্ষায় ছিল, আমিও তখন সেখান দিয়েই আসছিলাম। ওকে দেখে ভাবলাম, আমিও বাসায় যাচ্ছি, ওকেও নিয়ে যাই। তো আসার পথে আমার একটা কাজ পরে যায়। আর আমার কাজের জন্যই বাসায় আসতে দেরি হয়েছে। ”
কুহু হা করে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা অনায়াসে যা ইচ্ছে তাই বলল, কোন বিকার নেই তার চেহারায়!
” ওহ্ বুঝেছি। রুমে যা, মা। ভালোই হয়েছে তাহমিদের সাথে এসেছিস। তবে এরপর বাহিরে গেলে ফোন নিতে ভুলবিনা। ”
” ঠিক আছে, চাচা। ” কুহু আর সেখানে দাঁড়ায়না।
পরদিন সকালে শায়লা হাসান স্বামী-সন্তান নিয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। জয়কে বাসা থেকে বেড়োতে দেখে কুহু হাঁফ ছাড়ল। তবে যাওয়ার আগে জয় ওকে চোখের ইশারায় কিছু বলে গেল, যা কুহুর বোধগম্য হয়না। যেটা তাহমিদের নজর এড়ায়নি এবং ও জয় কি বলতে চেয়েছে, তা ঠিকই বুঝেছে।
সেদিন বিকেলে কোচিং থেকে বেরিয়ে কুহু বরাবরের মতো তাহমিদকে দেখতে পায়। আজকেও তাহমিদ কুহুকে নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছে। আজও তাহমিদ বাদাম ছিলে রেখেছে। যা দেখে কুহু হাসল।
” যখন-তখন এভাবে হেসে আমাকে খু’ন করার মতলব এঁটেছ, মেয়ে! তুমি কি জানো তোমার হাসিতে আমি খেই হারিয়ে ফেলি? ওলট-পালট হয় আমার পুরো দুনিয়া? নাকি আমাকে ঘায়েল করতেই এই মোক্ষম অস্ত্রের ব্যবহার কর! ”
কুহু তাহমিদের কথা নীরবে শুনে যায়। ও কি উত্তর দেবে! এই মানুষটার সামনে আসলেই ওর সাথে কথারা বেইমানী করে। তারা ঘাপটি মেরে বসে থাকে কন্ঠায়। চেপে ধরে রাখে ওর কন্ঠ নালী।
কুহুকে নীরব থাকতে দেখে আবারও মুখ খুলল তাহমিদ।
” আজ রাতেই আমি ঢাকায় ফিরছি। আগামী আড়াইমাস এমুখো হতে পারবনা। এরইমধ্যে তোমার এডমিশনও হয়ে যাবে। এই কয়দিন তুমি রিক্সায় যাতায়াত করবে। আমি রিক্সা ঠিক করে রেখেছি। প্রতিদিন সময় মত রিক্সাওয়ালা চাচা এসে তোমাকে নিয়ে যাবে, আবার বাসায় পৌঁছে দিয়ে যাবে। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু ধাক্কা খেল।
” আজকেই চলে যাবেন! ”
” হুম। অনেকদিন ছুটি কাটালাম, আর কত? এত ছুটি কাটাতে গিয়ে চাকরিটা চলে গেলে, অভিভাবকরা কি তাদের মেয়েকে কোন বেকার ছেলের হাতে তুলে দেবে? এখনকার অভিভাবকদের আকাশসম চাহিদা। অল্পে তাদের মন ভরেনা। তারা মেয়ের জন্য ইলন মাস্কের মত পাত্র খোঁজে। তবে তাদের চেহারাও হতে হবে টম ক্রুজের মত। আবার তাদের আচরণও হতে ত্যালতেলে মোমের পুতুলের মত। কথায় কথায় গলে পরবে। আমারতো আবার এসব কিছুই নেই। আছে একটা সামান্য চাকরি। এটা চলে গেলে জীবনে কপালে বউ জুটবেনা। আজীবন আমাকে বউ হীনতায় কাটাতে হবে। আমি সারাজীবন একবেলা করে খেয়ে কাটতে রাজি আছি। কিন্তু বউ হীনতায় একদিনও কাটাতে রাজি নই। বউ হীন পুরুষ আর ঘাসহীন গরুর মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। ঘাস আর বউ, গরু আর পুরুষের পরিপূরক। এই দুটো ছাড়া গরু আর পুরুষ অচল। ”
এবার কুহুর মাথা বন বন করে ঘুরছে। এই লোক কোন কথাকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে! একটা ছোট প্রশ্নের উত্তর সে কিভাবে প্যাঁচাচ্ছে এটা ভাবা যায়! আসলেই লোকটা ত্যাড়া।
” আমি বাসায় যাব। আজকে দেরি হলে চাচিকে দেয়ার মত কোনও উত্তর আমার কাছে নেই। ” কুহু উঠে দাঁড়িয়ে বলল।
” চুপ করে বস। আজকেও আমার সাথে বাসায় যাবে। আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। ”
তাহমিদের চোখ রাঙ্গানি দেখে কুহু ধপ করে বসে পরল।
” কি বলবেন তারাতারি বলুন। ”
” এত তাড়াহুড়ো কিসের? আমি কি বলেছি মনে আছে তো? ”
কুহু বুঝতে না পেরে তাকায় সামনে বসে থাকা সুদর্শন যুবকটির দিকে।
” প্রতিদিন সময়মত গেইটের সামনে দাঁড়াবে, আজকে আমরা যে রিক্সায় যাব, সেই রিক্সাই তোমাকে নিতে যাবে। আসার সময়ও সেই রিক্সায়ই আসবে। রাস্তায় কারও সাথে কথা বলবেনা। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। আর নায়লা আঞ্জুমের কাছ থেকে যতটা দূরে থাকা যায় থাকবে। ”
তাহমিদের কথা শুনে চিন্তায় পরে যায় কুহু। ও প্রতিদিন অটোতে চলাফেরা করে। আর রিক্সার তুলনায় অটোর ভাড়া কম। প্রতিদিন রিক্সায় চলাফেরা করলে ওর ৬০-৭০ টাকা ভাড়া লাগবে। এত টাকা ও রিক্সা ভাড়ার জন্য খরচ করবে! যদিও চাচা প্রতিদিন ওকে টাকা দেয়। কিন্তু তাই বলে এত টাকা খরচ করতে ওর বিবেকে বাঁধবে। এমনিতেই চাচি ওদের টাকা দিকে দেখলে চোখ গরম করে তাকায়। কুহু এবার সত্যিই অকূল পাথারে পরল। ও তাহমিদকে কি বলবে?
কুহুকে নীরব থাকতে দেখে তাহমিদ যা বোঝার বুঝে নেয়।
” কি এত চিন্তা করছ? যা যা বললাম, সেগুলো মাথার ভেতর ভালোভাবে ঢুকিয়ে নাও। আমার কথার অন্যথা হলে তোমার কঠিন শাস্তি অবধারিত। আর এতদিনে আমাকে নিশ্চয়ই চিনেছ তুমি? ”
” হুম। ” কুহু ছোট্ট করে উত্তর দেয়। ওর মনের মধ্যে চিন্তার ঝড় বইছে।
আরও কিছুক্ষণ ওরা ক্যাম্পাসে বসল। কুহু চুপচাপ বসে আছে, আর তাহমিদ ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন বহুকালের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। মেয়েটাকে এত দেখছে তবুও ওর মনের তৃষ্ণা, চোখের তৃষ্ণা কিছুই মিটছেনা। ওর বুকের ভেতর এখন থেকেই হাঁস-ফাঁস করছে। মেয়েটাকে এতদিন না দেখে থাকবে কিভাবে! এই মেয়েটা যে ওর বেঁচে থাকার খোরাক। ওর মরুর মত জীবনে এক পশলা শীতল বৃষ্টি হয়ে ঝরেছে এই মেয়েটা। যে বৃষ্টির তোড়ে ছাপিয়ে গেছে হৃদয়ের দু কূল। বাঁধভাঙা ভালোবাসা এসে জমা হয়েছে হৃদয় অম্বরে।
কুহু অনুভব করছে তাহমিদ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ওর সমস্ত শরীর শিরশিরিয়ে উঠল। টুপ করেই ভালো লাগায় ছেয়ে যায় ওর পুরো সত্তা। আজকাল এই মানুষটার ধমকেও ভালোবাসা খুঁজে পায় কুহু। তার মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দকনা অমৃত ঢেলে দেয় কুহুর কর্নকুহরে। তার একটুখানি হাসিও কুহুর রাতের ঘুম কেড়ে নিতে যথেষ্ট। হঠাৎই কুহুর চোখজোড়া মানুষটাকে দেখার জন্য উতলা হয়ে যায়। ও হাসিমুখে সামনে বসা পুরুষটির দিকে তাকাতেই থমকে যায়। সেই পুরুষটি ওকে নেশাক্ত চোখে দেখছে! দু’জনের চোখাচোখি হয় কয়েক মুহুর্তের জন্য। এই কয়েক মুহূর্ত সাক্ষী হয়ে রইল দু’জনের অব্যক্ত ভালোবাসার। নীরবে কথা হয় দুটি হিয়ার। দু’জনের প্রেমময় আঁখি জোড়ায় আরেকবার সৃষ্টি হয় প্রনয়ের পদ্মদিঘি।
কুহু লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। ওর লজ্জায় আরক্তিম চেহারা দেখে তাহমিদ প্রানখোলা হাসল।
” এই সামান্য চোখাচোখিতেই লজ্জায় রাঙা হচ্ছ রমনী! যেদিন আমার চোখজোড়া প্রেয়সীর সর্বাঙ্গে প্রেমের দংশন করবে, সেদিন কি সে সইতে পারবে? নাকি লজ্জায় সংজ্ঞা হারিয়ে আমার রোমাঞ্চের চৌদ্দটা বাজাবে! রমনী তুমি আজ আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলে। লজ্জায় সংজ্ঞা হারানো বউ পাহারা দিয়ে রাত কাটানোর কথা ভাবতেই আমার শরীরের প্রতিটি র’ক্তকনিকা ছলকে উঠছে। ”
তাহমিদের এমন নির্লজ্জ কথা শুনে কুহু আর বসে থাকতে পারলনা। ও এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে যায়। ওর সর্বাঙ্গ কাঁপছে। আজ অব্দি কেউ ওকে এভাবে বলেনি। এই নিলাজ লোকটার সাথে আর কিছুক্ষণ থাকলে ও নির্ঘাত জ্ঞান হারাবে।
” আমি বাসায় যাব। আপনি না গেলেও আমি একাই চলে যাব। ”
” আগে কাঁপা-কাঁপি বন্ধ কর, তারপর বাসায় যাও। নতুবা লোকজন তোমাকে এভাবে কাঁপতে দেখলে ভাববে, আমি তোমার সাথে কোন দুষ্টুমি করেছি। আদতেই যেটা আমি করিনি, সেই দোষ কেন নিজের কাঁধে নেব! যদি সামান্যও কিছু করতাম, তবে না হয় মানা যেত। করব নাকি কিছু? ”
ব্যাস, আর কুহুকে পায় কে। ও আর সেখানে দাঁড়ায়না। দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করল।
তাহমিদও হেসে কুহুর পেছন পেছন হাঁটতে থাকে। মেয়েটা যেভাবে টালমাটাল পায়ে হাঁটছে, যেকোন মুহূর্তে হোটচ খাবে। তাই ওর পেছনে থাকা তাহমিদের কাছে আবশ্যক মনে হল।
চলবে….