#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১৭
জাওয়াদ জামী জামী
” তাহমিদ, তুমি বোধহয় বেশ কয়েকদিন ছুটি নিয়েছ? এক কাজ কর, আমাদের সাথে খুলনা চল। আমার বাসার রাস্তা তুমি বোধহয় ভুলেই গেছ। ” শায়লা হাসানের স্বামী খালেদ হাসান তাহমিদকে বললেন। ভদ্রলোক ছেলের খবর শোনামাত্রই খুলনা থেকে রওনা দিয়েছিলেন।
” আমি আর চার-পাঁচ দিন রাজশাহীতে আছি। যে কয়দিন ছুটি পেয়েছি, সে কয়দিন নানিমার সাথে কাটাতেই আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব। ”
খালেদ হাসান তাহমিদের পিঠ চাপড়ে দিলেন। তিনি মনে মনে তাহমিদকে বেশ পছন্দ করেন।
” ঠিক আছে ইয়াংম্যান। তুমি সময় করেই না-হয় খুলনা থেকে বেরিয়ে এস। আসলে সত্যি বলতে কি, আমি তোমাকে যতই দেখি, ততই মুগ্ধ হই। কি কর্মস্পৃহা তোমার! সেই সাথে অদম্য ইচ্ছাশক্তি। এখনকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে এমনটা খুব একটা দেখা যায়না। আমার ছেলেকেই দেখ, তাকে আমরা মানুষ করতে পারলামনা। একটা মানুষের মধ্যে যত খারাপ গুণ থাকলে তার পিতামাতাকে সমাজের কাছে হেয় হতে হয়, তার সব গুণই ওর মধ্যে আছে। অথচ ওকে কোন সুযোগসুবিধা দিইনি! না করেছে মন দিয়ে পড়াশোনা, না ধরেছে আমার ব্যবসার হাল। এইযে আজ হাত-পা ভেঙে বিছানায় শুয়ে আছে, এটা হয়তো ওর কোন পাপেরই ফল। শাসন করেও কোন কাজ হলোনা। আর নিজের সন্তান জন্য ফেলেও দিতে পারিনা। ” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন খালেদ হাসান।
তাহমিদের হঠাৎই খারাপ লাগছে। ওর জন্যই আজ জয়ের এই অবস্থা। আর ওর জন্য কষ্ট পাচ্ছে এই মানুষটা। এক অসহায় পিতার দীর্ঘশ্বাস ওকে পো’ড়া’তে লাগল। মাথা নিচু করে ও নিজেকে প্রবোধ দেয়। জয় নিজের কৃতকর্মের ফল পেয়েছে। ও যা করেছে তার জন্য এউ শাস্তিটুকু ওর পাওনা ছিল।
” তুমি এসব কি শুরু করলে? আমার ছেলেটা বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে, আর তুমি ওকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলছ? কেমন বাবা তুমি? কি করেছে আমার ছেলে? এই বয়সের ছেলেমেয়েরা একটুআধটু দুষ্টুমি করেই থাকে। তাই বলে তুমি আমার ছেলেকে যাচ্ছেতাই বলতে পারনা। ” স্বামীর কথা শুনে খেঁকিয়ে উঠল শায়লা হাসান।
তাহমিদ শায়লা হাসানের দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকল।
” আমি যা বলেছি ভেবেচিন্তেই বলেছি। এবং এক বিন্দুও ভুল বলিনি। জয়ের এই অবস্থার জন্য দায়ী তুমি। তুমি নিজে না করেছ ছেলেকে শাসন, আর না করতে দিয়েছ আমাকে। কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ সে সম্পর্কে ওকে কোন ধারনাই দাওনি তুমি। ছোটবেলা থেকেই ওকে নিজের মত করে গড়ে তুলেছ। আজ তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে আমাকে। আমার আব্বার তিলে তিলে গড়ে তোলা রাজত্বের ভীতে কুঠার চালিয়েছ তুমি। ছেলেকে বানিয়েছ উশৃংখল, বেয়াদব আর স্বেচ্ছাচারী। তোমার জন্য আমার পরিবারে ভাঙ্গন ধরেছে। আমার ভাইবোনেরা আজ আমাকে ঘৃণা করে। সব কিছুর মূলে তুমি। তুমি তাদের থেকে আমার ছেলেকে দূরে রেখছ সব সময়ই। তবে আমি শঙ্কিত তোমার শেষ পরিণতি কি হবে এই ভেবে। ”
” হোয়াট ননসেন্স? মুখ সামলে কথা বল। তোমার ঐ রাবনের গোষ্ঠীর সাথে থাকিনা জন্য আমি খারাপ? আমার কি নিজের মত করে বাঁচার অধিকার নেই? তোমার বোনেরা এসে সংসারে মাতব্বরি করবে আর সেটা আমাকে মেনে নিতে হবে! আমি পারবনা মানতে। আর রইল আমার ছেলের বিষয়। আমার ছেলেকে আমি কার সাথে মিশতে দেব, কার সাথে দেবনা এটা আমিই বুঝব। এসব নিয়ে তোমাকে চিন্তা না করলেও চলবে। ”
” খালামনি, চুপ করবে তুমি? কি শুরু করেছ এসব! মনে রেখ এটা তোমার বাবার বাড়ি। আর এই ভদ্রলোক তার শ্বশুর বাড়িতে এসেছেন। এটা তার বাড়ির ড্রয়িংরুম নয় যে তুমি তার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলবে। তুমি নিজে যেখানে বাবার বাড়িতে এসে মাতব্বরি কর, সেখানে তার বোনেরা করলে দোষ কোথায়? এত রিয়্যাক্ট করছ কেন! তার ছেলে অসুস্থ। টাকা খরচ হচ্ছে তার। সে চিন্তা করছে। সেজন্য সে রিয়্যাক্ট করতেই পারে। তার সাথে তোমার এই আচরণ শোভা পায়না। ”
তাহমিদের কথা শুনে শায়লা হাসান চুপ করে যায়। কারণ সে ভালো করেই জানে, সে এখন একটা কথাও বললে তাহমিদের কাছে হেনস্তা হতে হবে।
এতক্ষণ কুহু রান্নাঘর থেকে সবই শুনছিল। ও ভীতু চোখে তাহমিদকে দেখছে। এই লোকটাকে দেখে সবাই এত ভয় পায় কেন তার আংশিক উত্তর আজ ও পেয়ে গেছে।
রাতে তাহমিদের কাছে বাচ্চারা পড়তে বসেছে। তাহমিদ একে একে সবার প্রবলেম সলভ জরে দিচ্ছে। সৃজন আর নিশো ঠিকঠাক পড়লেও রুশা মাঝেমধ্যেই ফাঁকিবাজি করছে। সেজন্য তাহমিদ ওকে ঠুসঠাস করে বসিয়েও দিচ্ছে। কাঠের স্কেলের বারি খেয়ে রিশা কিছুক্ষণ পড়ছে ঠিকই, সেই মা’রে’র মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে তারপরই শুরু করছে ফাঁকিবাজি।
” রিশা, তুই যদি পনের মিনিটের মধ্যে এই পাঁচটা অংক করে না দিস, তবে আজ তোকে সারা রাত আমি ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রাখব। সেই সাথে স্কেলের বারি ফ্রি থাকবে। নিশো, তোর খাতা দেখি। সৃজন, তুমি অংকগুলো শেষ করেছ? ” তাহমিদের কথা শুনে রিশা মুখ কাঁচুমাচু করে লিখতে থাকে।
নিশো খাতা এগিয়ে দিলে তাহমিদ সেটা দেখে, সৃজনের খাতায় নজর দেয়। নিশো টুকটাক ভুল করলেও সৃজন কোন ভুল করেনি। অনেকক্ষণ ধরেই তাহমিদ লক্ষ্য করছে, সৃজন কিছু একটা বলতে চাচ্ছে।
” সৃজন, তুমি কিছু বলতে চাও? ”
” একটা কথা ছিল, ভাইয়া। বললে তুমি রাগ করবে নাতো? ”
” কি কথা বল শুনি। ”
” তুমি রিশাপু আর নিশোকে তুই বল কিন্তু আমাকে তুমি বল। এটাই বলতে চাচ্ছিলাম। ”
” তোমাকে তুই বললে খুশি হবে? ”
সৃজন মাথা নাড়ায়।
তাহমিদ স্মিথ হেসে সৃজনের চুল এলোমেলো করে দেয়।
রাতে সৃজন রুমে আসলে কুহু প্যাকেটটা ওর হাতে ধরিয়ে দেয়। সৃজন প্যাকেট খুলে টি-শার্ট আর প্যান্ট দেখে খুশিতে কেঁদে দেয়। কতদিন হয়ে গেছে ও নতুন কাপড় পায়নি। এখানে আসার পর চাচা কিনে দিতে চেয়েছে অনেকবারই। কিন্তু চাচির ভয়ে ও প্রতিবারই না করে দিয়েছে।
কুহু ভাইয়ের আনন্দ দেখে নিজেও কেঁদে ফেলল।
” আপু, এই প্যাকেটে কি আছে? ” অপর প্যাকেট দেখাল সৃজন।
” জানিনা এতে কি আছে। আগে দেখে নেই। ”
কুহু প্যাকেট খুলে অবাক হয়ে গেছে। সেখানে দুইটা থ্রী-পিস। একটা হালকা কলাপাতা রংয়ের আরেকটা রানী গোলাপি রংয়ের। দুইটা থ্রী-পিসই সুতির। এবং পুরোটাতেই সুতার কাজ। কুহু অবাক হয়ে থ্রী-পিস দুটো হাতে নিয়ে বসে আছে। তাহমিদ সৃজনকে কিনে দিয়েছে এটা না হয় মানা যায়। কিন্তু তাই বলে ওকে কেন কিনে দিতে গেল!
” আপু, দেখতো এটা কিসের কাগজ? প্যাকেটের ভেতর ভাঁজ করা ছিল। ” কুহু দেখল সৃজন এক টুকরা কাগজ হাতে নিয়ে ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
কহু কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলতেই আরেকবার চমকে যায়। কাগজে গোটা অক্ষরে কিছু লিখা আছে।
” শোন মেয়ে, আমি যদি দেখি তুমি থ্রী-পিসগুলো ফেলে রেখছ, তবে তোমার সব কাপড় আমি আ’গু’নে পু’ড়ি’য়ে ছাই করব। আর সেই ছাই দিয়ে দাঁত মাজব। ”
তাহমিদের এমন প্রচ্ছন্ন হুমকিতে কুহু ঘাবড়ে গেছে। এই লোকটা কি ওকে এখন লিখেও হুমকি দিতে শুরু করেছে! আজব লোক।
কুহু সযতনে থ্রী-পিস দুটো আলমারিতে রেখে দেয়। সুযোগ বুঝে এগুলো ও টেইলার্সে নিয়ে যাবে। নয়তো দেখা যাবে ঐ আধপাগল লোকটা সত্যি সত্যিই ওর সব কাপড়চোপড়ে আ’গু’ন ধরিয়ে দিয়েছে।
কুহু নানিমাকে রাতের খাবার খাইয়ে দিতে এসেছে। ওকে দেখেই বৃদ্ধা হেসে উঠলেন। এক হাতের ইশারায় নিজের কাছে ডেকে নিলেন কুহুকে। কুহু তার কাছে যেতেই তিনি একহাতে মেয়েটাকে বুকে জরিয়ে নিলেন। কুহু লক্ষ্য করেছে, আজকাল নানিমা ওকে একটু বেশিই আদর করছেন।
কুহু নানিমাকে খাইয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ তার সাথে গল্প করে রান্নাঘরে যায়। খালা আরেকজন মেইডকে সাথে নিয়ে টেবিলে খাবার দিচ্ছেন। কুহুও তাকে সাহায্য করতে কাজে হাত লাগায়।
রাত বারোটা বিশ। কুহু মেঝেতে বিছানা পেতে সেখানে পড়ছে । খালা কয়েকদিন থেকেই ওর সাথে ঘুমাচ্ছে। সৃজনের দিকে তাকালে দেখতে পায় সে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। খালাও তাই। এদিকে কুহুর আর পড়তে ইচ্ছে করছেনা। তাই উঠে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পরল। জানালার কাঁচ ভেদ করে চাঁদের রুপালি আলোয় রুম উদ্ভাসিত হয়েছে। কুহু শুয়ে থেকেই জানালার দিকে তাকায়। ও ভেতর থেকেই বুঝতে পারছে আজকে পূর্নিমার রাত। ওর মন আনচান করে উঠল। গ্রামে থাকতে প্রতি পূর্নিমার রাতেই ও বাবা-মা’ র সাথে উঠানে বিছানা পেতে শুতো। বাবা অসুস্থ অবস্থায়ও ওদের নিয়ে পূর্ণিমা রাতে উঠাতে বসত। কতরকম গল্প শোনাত বাবা। আজ বাবা নেই, মা নেই। গ্রামের সেই বাড়িটা ঠিকই আছে। কিন্তু পূর্নিমা রাত দেখার মত সেখানে আর কেউ নেই। অঝোরে কুহুর চোখ দিয়ে অশ্রুবৃষ্টি ঝরতে থাকে। বাবা-মা’ র শূন্যতা আরেকবার উপলব্ধি করল ও। আজ বাবা-মা বেঁচে থাকলে ওদের এমন উদ্বাস্তুদের মত জীবন কাটাতে হতোনা। অনেকক্ষণ এভাবে বসে থাকার পর কুহু কি মনে করে রুমের দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
ছাদের দরজা খোলা দেখে কুহু চিন্তায় পরে যায়। আজকে ও একবারও ছাদে আসেনি। তবে শেষে যে ছাদে এসেছে, সে দরজা না লাগিয়ে রেখেই চলে গেছে! নাহ্ কালকে খালাকে বলতে হবে।
আজ কুহু নির্ভয়ে ছাদে এসেছে। কারন ও জানে আপাতত জয় এখন বিছানায়। আর ঐ লাফাঙ্গা ছাড়া ওকে কেউ বিরক্তও করবেনা।
ছাদে পা রাখতেই শীতল মলয় এসে ছুঁয়ে দেয় কুহুর সর্বাঙ্গ। ও অন্যদিকে না তাকিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। থালার মত চাঁদ নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে ধরনীকে করেছে গরবিনী। চাঁদের দিকে তাকিয়েই এক পা দু পা করে ও এগিয়ে যায় রেলিঙের দিকে। রেলিঙের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে অম্বর পানে চেয়ে।
এত রাতে কুহুকে ছাদে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে তাহমিদ। মেয়ের তো সাহস কম নয়! এত রাতে ছাদে এসেছে!
তাহমিদ কিছুক্ষণ আগেই ছাদে এসেছে। ও উত্তর দিকে কয়েকটা গাছের আড়ালে চেয়ারে বসে ছিল। চাঁদের আলো থাকায় ও লাইট জ্বালায়নি। কুহু দাঁড়িয়েছে দক্ষিণের রেলিং ঘেঁষে। মেয়েটাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর ভালো লাগছেনা।
” তাকে একটু বিরক্ত করতে না পারলে যে আমার শান্তি লাগছেনা। তাহমিদ, ভাব কিভাবে ওকে বিরক্ত করা যায়। কিন্তু দেখিস তোকে দেখে সে যেন চিৎকার না দেয়। সেটা করলে তোর ইজ্জতের দফারফা হয়ে যাবে। ” তাহমিদ বিরবিরিয়ে নিজের সাথেই কথা বলছে। হঠাৎই কিছু একটা মনে আসতেই তাহমিদ হেসে ফেলল।
” কাঁটা লাগা….
কুহু এত রাতে গানের আওয়াজ পেয়ে চমকে এদিকওদিক তাকায়। হঠাৎ দেখল উত্তরদিকে থাকা গাছগুলোর পেছন থেকে আলো আসছে। ও ভয় পেয়ে গেছে। এত রাতে কে এখানে!
” ভয় পেয়োনা, চন্দ্রাবতী। আমি এখানে। কোন ভূতটুত নই। ”
তাহমিদের গলা পেয়ে কুহু আরও ভড়কে যায়। এই লোকটা ওকে একেক সময়ে একেক নামে ডাকে।
তাহমিদ হাই তুলতে তুলতে কুহুর সামনে এসে দাঁড়ায়।
” এত রাতে ছাদে কি? পেত্নীদের সাথে কনফারেন্স আছে নাকি? তা ওদের সাথে কোন ভাষায় কথা বল? ওরা কি তোমাকে সম্মান দেয়? ”
এতগুলো উদ্ভব প্রশ্ন শুনে কুহুর চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।
” আমি পেত্নীদের সাথে কনফারেন্স করব কেন! আমিতো পূর্নিমায় ভিজতে ছাদে এসেছি। কিন্তু আপনি এখানে কি করছেন? মামদো ভূতের সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন বুঝি? ” কথাটা বলেই কুহু দুই হাতে মুখ চেপে ধরল। কি বলে ফেলল এই লোকটাকে!
তাহমিদ কুহুর এমন অবস্থা দেখে মনে মনে হাসল।
” উঁহু, আমি কারও সাথে সাক্ষাৎ করতে আসিনি। ভাগ্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে, আমার পূর্ণিমার সাথে সাক্ষাৎ করাতে। ”
কুহু কিছু না বলে রেলিঙের দিকে চলে যায়। এই লোকটার সাথে কথা বলতে চায়না ও। লোকটা কখন কি বলবে তার কোন ঠিক নেই।
” দশ মিনিট সময় দিলাম। এরমধ্যে যত খুশি পূর্ণিমা দেখে নাও। এরপর রুমে চলে যাবে। ”
” আমি মাত্রই এলাম। আর আপনি আমাকে দশ মিনিট সময় দিচ্ছেন! ”
” আপাতত দশ মিনিটেই নিজের হিয়াকে প্রবোধ দাও। ভবিষ্যতে আমি তোমার সারা রাত পূর্ণিমা দেখবার ব্যবস্থা করে দেব। সেদিন লুকিয়ে ছাদে আসতে হবেনা। অধিকার নিয়ে আসবে। নিজের অধিকার বলে বাড়ির প্রতিটা কোনায় তোমার পদচারণা থাকবে। ”
কুহু তাহমিদের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলনা। ও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল।
চলবে….
#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১৮
জাওয়াদ জামী জামী
বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে আকাশপাতাল চিন্তায় মত্ত কুহু। ও বারবার তাহমিদের এহেন আচরণের কারন খুঁজে চলেছে। মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়েই তাহমিদের এমন অধিকারবোধ দেখে কুহু বিস্মিত। যদিও পরিচয়টা শুধু তেমনভাবেও হয়নি। কিন্তু কুহু এটা বুঝতে পেরেছে লোকটা মন্দ নয়। একটা মেয়েকে মাঝরাতে একা পেয়েও যে দুরত্ব বজায় রাখে, আর যাই হোক সে কখোনো খারাপ হতে পারেনা। কিন্তু কুহু ভয় পাচ্ছে, যদি চাচির চোখে এসব পরে যায়, তখন কি হবে! কিন্তু ও নিজেই কেন তাহমিদকে এড়িয়ে চলতে পারছেনা? হাজারো ভাবনার মাঝেই কুহু একসময় ঘুমিয়ে পরল। ওর আর উত্তর খুঁজে পাওয়া হলোনা।
পরদিন সকালে ড্রয়িংরুমে এসে কুহু বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। পুরো ড্রয়িংরুমের ফার্নিচার কয়েকজন মিলে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। একপাশে নতুন ফার্নিচার রাখা হয়েছে। জানালা-দরজায় নতুন পর্দা লাগানো হয়েছে। ও একনজর চোখ বুলিয়ে রান্নাঘরে যায়।
তাহমিদও নিচে এসে অবাক হয়ে গেছে। হঠাৎ এমনভাবে বাসা সাজানোর কোন কারন খুঁজে পায়না ও। খালাকে জিজ্ঞেস করেও কিছুই জানতে পারলনা।
খাবার টেবিলে আসলে কুহু ওকে নাস্তা এগিয়ে দেয়। আজকে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় সবাই যে যার মত নাস্তা করে নিয়েছে।
” খালা, তোমরা খেয়েছ? ”
” আমি খাইছি, বাপজান। কিন্তু কুহু মা খায়নি। তার নাকি সকালে খাইতে ইচ্ছে করেনা। অনেকবার কইলাম, তবুও সে খাইলনা। ”
” তার খাওয়া লাগবেনা। আমার মনে হয় সে সন্যাসীনি। আর সন্যাসীদের না খেলেও চলে। আলো-বাতাসেই তাদের পেট ভরে যায়। তাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখ, আলো-বাতাস খেয়েছে কিনা। যদি না খেয়ে থাকে তবে তার জন্য আমি সেসবের ব্যবস্থা করব। এতটুকু উপকারতো আমি করতেই পারি। ”
” আবার শুরু হয়ে গেছে খোঁ’চা দেয়া! কুহু, কেন যে তুই এই লোকটাকে নাস্তা দিতে গেলি? তুই জানিসনা, এইটা খোঁ’চা কুমার? সে খোঁ’চা দেয়া ছাড়া কিছুই বলতে পারেনা। তুই আসলেই একটা গর্দভ। ” কুহু আনমনে নিজেকেই গালি দিচ্ছে।
” গালি দেয়া শেষ হলে বসে নাস্তা করে নাও। সময় তোমার জন্য বসে নেই। ”
” আমার ক্ষুধা নেই। ” কুহু মনে মনে ভাবে, এই মানুষ বুঝল কেমন করে ও গালি দিচ্ছে!
” খালা, এই মেয়ে যেন আগামী তিনদিন খেতে না পায়। ও না খেয়ে নিজের চাচার পয়সা বাঁচাক। ”
তাহমিদের কথা শুনে রা’গে কুহুর পিত্তি জ্ব’লে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে তাহমিদকে দু-চার কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু বরাবরের মতো কথারা কন্ঠায় এসে আটকে গেছে। তারপরও মুখ খুলল ও। কঠিন কথা না হোক, অনন্ত হালকা করে হলেও দুইটা কথা শোনাতে পারলে আপাতত শান্তি পাবে।
” তিনদিন না খেয়ে থাকতে পারব। এটা তেমন কিছুই নয়। একটু কষ্ট হলেও সহ্য করে নেব। ”
কুহুর কথা শুনে আপনাআপনিই তাহমিদের কপাল কুঁচকে আসে। ও মেয়েটাকে যতটা সরল ভেবেছিল, আদতেই যে মেয়েটা সেটা নয়, তা বুঝতে তাহমিদের দেরি হয়না। একে একটু শায়েস্তা না করলেই নয়।
” খালা, জয় যে কয়দিন এখানে আছে, সে কয়দিন তোমার এই ত্যাড়া মা তার সেবা করবে। আমি সিস্টারকে বলে দেব। ওকে এখনই জয়ের রুমে পাঠাও। জয়কে খাওয়ানো, ঔষধ খাওয়ানো, ওর যাবতীয় কাজ যেন এই মেয়ে করে। আমি খালামনিকে বলে দিচ্ছি। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর বুকের ভেতর ধক করে উঠল। এই লোক বলে কি! ঐ উজবুকের সামনে গেলেই নির্ঘাত সে অসভ্যতা করবে। তার হাত-পা ভাঙ্গলে কি হবে! মুখ তো ঠিকই আছে। কুহু আর কিছু ভাবতে পারলনা। চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পরল। সামনে থাকা প্লেট নিজের দিকে এগিয়ে নিয়ে একটা পরোটা তুলে নেয়।
কুহুর কাজ দেখে তাহমিদ মৃদু হেসে খেতে থাকল। সোজা কথায় কাজ না হলে, মাঝেমধ্যে একটু ছলনার আশ্রয় নিলে ক্ষতি কি। ছলনা থেকে যদি ভালো কিছু হয়, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছলনাই শ্রেয়।
কুহু ধীরে ধীরে খাচ্ছে। ওর খেতেই ইচ্ছে করছেনা। কিন্তু সামনে বসে থাকা যমের ভয়ে কষ্ট করে খেতে হচ্ছে।
তাহমিদের খাওয়া হয়ে গেলে সে উঠে যায়। এরপর কুহুরও খাওয়া শেষ হয়।
কুহু খাওয়া শেষ করে নানিমার কাছে যায়। অভিযোগের ঝুড়ি নিয়ে বসে বৃদ্ধার কাছে। তার নাতির নামে বিচার দেয়।
” নানিমা, আপনার ঐ নাতিটা ভিষণ খারাপ। শুধু শুধু আমাকে ভয় দেখায়। আমার ক্ষুধা না লাগলে কি করব, বলুনতো? তাকে দেখতে যতই নিস্পাপ লাগুকনা কেন, আদতেই সে বদের হাড্ডি। বাবুর মেজাজ সব সময়ই গরম থাকে। যাকে বলে মিলিটারির মেজাজ। এই মেজাজ নিয়ে শিক্ষকতা করে কেমন করে! ছাত্রছাত্রীদের না জানি কত নাকানিচুবানি খাওয়ায়! বেচারা স্টুডেন্টসদের জন্য আমার করুণা হচ্ছে। অনেক পাপ করলেই তবে এমন শিক্ষক কারও ভাগ্যে জোটে। গোমড়ামুখোটাকে একদিনও হাসতে দেখলামনা। যেটা সবাই দেখতে চায়। কিন্তু কারো ভাগ্যে সেটা দেখা হয়না। অথচ তার ধমক কেউ শুনতে না চাইলেও ফ্রিতে সবাই সেটা পেয়ে যায়। ”
কুহু লক্ষ্য করল নানিমা এক হাত দিয়ে কিছু একটা ইশারা করছে। সে বারবার রুমের ব্যালকনির দিকে ইশারা করছে।
নানিমা কি দেখাচ্ছেন! কুহু কৌতুহলী হয়ে ব্যালকনির দিকে যায়। সেখানে হাসিমুখে বসে থাকা তাহমিদকে দেখে ওর পিলে চমকে গেছে। তাহমিদ ব্যঙ্গ হেসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
” আল্লাহরে! ভুল জায়গায় ঠিক কথা বলে ফেলেছি। কুহুরে, তুই আসলেই উচ্চ মাপের গা’ধী। ” কোনমতে কথাটা বলেই কুহু দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
কুহু চলে যেতেই তাহমিদ হো হো করে হেসে উঠল। ও খাবার পর নানিমার কাছে এসেছিল। তখনই একটা ফোন আসায় ব্যালকোনিতে যায়। তার কিছুক্ষণ পর রুমে কুহু আসে। আর তারপরই বেচারি ফেঁসে যায়।
তাহমিদ নানিমার কাছে এসে বসল। ও তখনো হেসেই চলেছে। আচ্ছা জব্দ করেছে ও মেয়েটাকে।
” বুঝলে নানিমা, আমার পাখিটা কিন্তু বেশ দুষ্টু। শুধু ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়াল দেয়। বেশতো অভিযোগ করছিল। হঠাৎ করে ব্যালকনিতে গেল কেন! নিশ্চয়ই তুমি ইশারা করেছিলে? মোটেও ঠিক করনি। এই সুযোগে ওর মনের সব কথা আমি জেনে নিতাম। যেগুলো ও আমার জন্য মনেই জমা রেখেছে। ”
তাহমিদের কথা শুনে নানিমাও হাসল।
” ভালো কথা, নানিমা। বাসায় আজ সাজ সাজ রব কেন? কি হতে চলেছে? তোমার দুই মেয়ে বাসা নতুন করে সাজিয়েছে। ”
বৃদ্ধা হাত নাড়িয়ে বললেন, তিনি কিছুই জানেননা।
বিকেলে কোচিং থেকে বের হতেই কুহু দেখল তাহমিদ কোচিংয়ের সামনে দোকানে বসে আছে। তাহমিদ কুহর দিকেই তাকিয়ে আছে। কুহু সেটা দেখেই চোখ নামায়।
” বাব্বাহ্, আজ ভদ্রলোক দোকানে কেন! ” নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করল কুহু।
তাহমিদ কুহুকে দেখে উঠে এসে ওর পাশে দাঁড়ায়। কেউ কোন কথা বলছেনা। কুহু ভয় পাচ্ছে সকালের ঘটনার জন্য। না জানি বদ লোকটা কখন কি বলে বসে।
কিন্তু কুহুকে অবাক করে দিয়ে তাহমিদ চুপ থাকে। ও চুপচাপ হাঁটছে। ওর পাশাপাশি হাঁটছে কুহু। যেন নীরবতাই ওদের দুজনের পথ নির্দেশ করছে। একজন আগে থেকে ঠিক করা গন্তব্যে হাঁটছে। তার পাশে অপরজন কোন দ্বিধা ছাড়াই হেঁটে চলেছে।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর তাহমিদ রিক্সা নিল। কুহু আরেকবার অবাক হয়। ও চিন্তা করছে, রিক্সাই যখন নিবে, তখন আবার হাঁটলো কেন? কিন্তু মেয়েটাতো জানেনা, তাহমিদের খুব ইচ্ছে ছিল ওর পাশাপাশি হাঁটার। হাঁটার ফাঁকে আলতোকরে ওর হাত ছুঁয়ে দেয়ার তীব্র বাসনা জন্মেছে তাহমিদের মনে।
তাহমিদ রিক্সাওয়াকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে বলল। কুহু কোন প্রশ্ন করলনা। তাহমিদের সিদ্ধান্তকে মনে মনে সায় দিল। প্রতিবারের মত তাহমিদ কুহুর পেছন দিয়ে হাত নিয়েছে। তবে আজ কুহুর ভেতর তেমন একটা জড়তা নেই।
ক্যাম্পাসের সামনে দাঁড়িয়ে তাহমিদ বাদাম, পপকর্ন আর চকলেট নিল। কুহু এবারও চুপচাপ দেখে গেল।
ক্যাম্পাসের ভেতর এসে ফাঁকা জায়গা দেখে বসল তাহমিদ। ওর দেখাদেখি কুহুও বসল।
বাদামের প্যাকেট কুহুর দিকে বাড়িয়ে দিলে কুহু আপত্তি জানায়।
” বাদাম খেতে ভালো লাগেনা। ”
” কেন! ”
” ছিলতে বিরক্ত লাগে, তাই। ”
তাহমিদ কিছু না বলে কয়েকটা বাদাম ছিলে কুহুর দিকে এগিয়ে দেয়। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে কুহু তাহমিদের দিকে তাকায়। সেই মুহূর্তে চোখাচোখি হয় দুজনের। কুহু এখন পর্যন্ত ভালোভাবে তাহমিদের দিকে তাকায়নি। আজ হঠাৎই তাহমিদকে কাছ থেকে লক্ষ্য করল।
সরোবরের স্বচ্ছ পানির মত তার টলটলে চোখজোড়ায় বড্ড মায়া মেশানো। টিকোলো নাক, পুরুষ্টু কালচে খয়েরী ঠোঁট। চওড়া কপাল। কাঁচা হলুদের ন্যায় গাত্রবর্ণের তাহমিদকে সুপুরুষ বলাই যায়। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়েই কুহু চোখ নামিয়ে নিল। হঠাৎই সামনে বসা এই যুবকটিকে ওর কাছে বেশ আকর্ষনিয় মনে হচ্ছে।
কুহুকে মাথা নিচু করতে দেখে হাসল তাহমিদ। এতদিন পর মেয়েটা ওর দিকে সরাসরি তাকিয়েছে, ভাবতেই ভালো লাগছে।
” চোখ নামিয়ে নিলে যে? আমাকেও নাহয় দেখতে দিতে তোমার কাজল দীঘির ন্যায় গভীর চোখজোড়া। আমি আরেকবার ডুবতাম তোমার আঁখিপল্লবের ঝলকানিতে। ”
কুহু এবার বেশ লজ্জা পায়। ওর শ্যামলা চেহারায় লালচে আভা ফুটে উঠল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে লজ্জা নিরারণের মিছেই চেষ্টা করল। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বলছে, তাহমিদ ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
তাহমিদ হঠাৎই হো হো করে হেসে উঠল। ওর হাসিতে প্রকম্পিত হল চারপাশ। বিকেলের আবছা আলোর রোশনাই ঝরে পরল ধরনীতে। আশেপাশের কয়েকজন মেয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল তাহমিদের দিকে। এই সুযোগে কুহু আরেকবার তাকালো হাস্যরত মানুষটার দিকে। এই প্রথম লক্ষ্য করল তাহমিদের গজ দাঁতটি। কুহু মুগ্ধ হয়ে দেখছে মানুষটার হাসি। কাউকে হাসলে এত চমৎকার লাগে, এটা আজই প্রথম উপলব্ধি করল।
চলবে….