প্রিয়াঙ্গন পর্ব-১১+১২

0
514

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১১
জাওয়াদ জামী জামী

” নানিমা, এই যে গত আট বছর ধরে একটামাত্র ছেলেকে দেখোনি, তোমার কষ্ট হয়না? তোমার কত আদরের ছেলে ছিল সে। কেন তাকে যেতে দিলে? মেয়েদের কথা শুনে, ছেলেকে পর করে দিলে! আজ কোনও মেয়ে কি তোমাকে দেখছে? তুমি তোমার স্বামীর বাড়িতে আছ, তার টাকায়ই তোমার চিকিৎসা চলছে। তবে সেদিন কেন মেয়েদের কথা শুনতে গেলে! আমার বলতে খারাপ লাগছে, তবুও বলতে হচ্ছে, তুমি সারাজীবন মরিচীকার পেছনে ছুটেছ। নিজেও যেমন সম্পর্কের মূল্য দিতে পারোনি, ছেলেমেয়েদেরও তেমনভাবে গড়ে তুলেছ। কি পেলে এসব করে? ছেলেমেয়েরাও আজ তোমাকে বোঝা মনে করে। ” তাহমিদ ফাতিমা খানমের হাত ধরে রেখে করুণ স্বরে বলল।

বাকহীনা ফাতিমা খানম কোন কথা বলতে না পারলেও, তার দুচোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরতে থাকে। তিনি হাতের ইশারায় তাহমিদকে কিছু বলছেন। তাহমিদ মনোযোগ দিয়ে তার ইশারা বোঝার চেষ্টা করছে।

বৃদ্ধা বেশ কিছুক্ষণ হাত নেড়ে ক্ষান্ত হন। কিন্তু তার কান্না থামলনা। তাহমিদও বুঝতে পারছে ওর নানিমা কি বলতে চায়।

” নানিমা, আমি মামার সাথে যোগাযোগ করব। তাকে দেশে আসার কথা বলব। কিন্তু তারা দেশে আসলে তোমার মেয়েরা যদি তাদেরকে কিছু বলে, সেদিন কিন্তু আমি তোমার মেয়েদের ছেড়ে কথা বলবনা। ”

বৃদ্ধা কাঁপা কাঁপা হাতে তাহমিদের হাত চেপে ধরে কাঁদতে থাকেন।

কুহু ফাতিমা খানমকে খাইয়ে দিয়েই রান্নাঘরে চলে এসেছে। রাজিয়া খালার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করতে থাকে।

রায়হান আহমেদ ডাইনিং টেবিলে এসে তাহমিদের খোঁজ করলেন। ততক্ষনে নায়লা আঞ্জুমও চলে এসেছে। সে কুহুকে দেখেও না দেখার ভান করে চেয়ার টেনে বসল।

” কুহু মা, সৃজন কোথায়? ওকে ডাক। ”

রায়হান আহমেদের কথা শুনে নায়লা আঞ্জুমের মন বিরক্তিতে ছেয়ে যায়। সে তার স্বামীর নিজের ভাতিজা-ভাতিজীর ওপর এমন আদিখ্যেতা সইতে পারছেনা।

” কুহুপু, সৃজন কই? ওকে তারাতারি ডাক। ” নিশো চেয়ারে বসতে বসতে বলল।

” কুহুপু, তুমি আমাদের সাথে বসবেনা? এসো আজ একসাথে খাই। ” রিশা হাসিমুখে বলল।

” তুমি খাও, রিশা। আমি পরে খাব। সকালে আমি খেতে পারিনা। ”

রাজিয়া খালা সৃজনকে ডাক দিলে সৃজন কুহুর পাশে এসে দাঁড়ায়। নিশো সৃজনকে নিজের পাশের চেয়ারে বসাল।

” কেমন আছো, খালামণি? রিশা, নিশো তোরা কেমন আছিস? ”

” তুমি কখন এসেছ, তাহমিদ! ” নায়লা আঞ্জুম বিস্মিত।

” গতরাতে এসেছি। তা তোমাদের দিনকাল কেমন যাচ্ছে? ” কুহুর দিকে তাকিয়ে নায়লা আঞ্জুমকে জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।

” ভাইয়া, আগে আমাদের সাথে কথা বল। পরে আম্মুর সাথে গল্প করবে। তুমি কতদিন পর আসলে! আজকে নাস্তা করেই আমাকে পড়া দেখিয়ে দেবে। তোমার মত করে কেউই পড়ায়না। ” নিশোর গলায় অভিযোগ খেলা করছে।

তাহমিদ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

” আগে খেয়ে নে। তারপর বই নিয়ে আসবি। ”

” ভাইয়া, তুমি কুহুপুকে চেন? আর সৃজনকে? ওরা কিন্তু এখন আমাদের সাথেই থাকে। এই সৃজন, তুই ভাইয়ার সাথে কথা বলছিসনা কেন? তুই জানিস আমার ভাইয়া কত ভালো পড়ায়? ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে তার স্টুডেন্টরা তার ওপর ফিদা। ভার্সিটির মোষ্ট হ্যান্ডু টিচার ভাইয়া। আমি ঠিক বলেছিনা, ভাইয়া? ” রিশা একনাগাড়ে কথাগুলো বলে তাকায় তাহমিদের দিকে।

” এই ফাজিল মেয়ে, তুই চুপ করবি? এত বকবক করিস কেন? পড়াশোনা রেখে শুধু চাপাবাজী করা? এতদিন পড়াশোনা কেমন করেছিস, তা একটু পরেই দেখছি। একটা করে ভুল করবি, একটা করে স্কেলের ঘা পড়বে পিঠে। ”

তাহমিদের ধমকে রিশা মুখ কাঁচুমাচু করে এদিকওদিক তাকায়।

” সৃজন, তুমি যেন কোন ক্লাসে পড়ছ? এখানে কোন স্কুলে ভর্তি হয়েছ? ঠিকমত পড়াশোনা করছ তো? কোন টিচারের কাছে পড়ছ? ” এবার সৃজনকে জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।

” আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি, ভাইয়া। কলেজিয়েট স্কুলে চাচা আমাকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। স্কুলেরই এক স্যারের কাছে পড়ি। ”

” গুড। আমি প্রতি সপ্তাহে দুইদিন এখানে এসে থাকি। আমি আসলে রিশা, নিশো আমার কাছে পড়া দেখিয়ে নেয়। তুমিও ওদের সাথে বই নিয়ে চলে আসবে। আর এখানে থাকতে কোন সমস্যা হচ্ছেনাতো? সমস্যা হলে আমার খালামণিকে বলবে। যখন যেটা প্রয়োজন হবে সব তাকেই বলবে। ” তাহমিদ আড়চোখে তাকায় নায়লা আঞ্জুমের দিকে।

তাহমিদের কথা শুনে নায়লা আঞ্জুমের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। যা তাহমিদের নজর এড়ায়নি।

টুকটাক কথা বলতে বলতে ওরা খেতে থাকে।
খাওয়া শেষ করে রিশা, নিশো, সৃজন বই নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে তাহমিদের কাছে পড়া দেখিয়ে নেয়।

রাজিয়া খালা টেবিল পরিষ্কার করে রান্নাঘরে বসেই কুহুকে নিয়ে খেয়ে নেয়। যদিওবা কুহু খেতে চায়নি, কিন্তু খালার জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়ে ওকে খেতে হয়। এবং এটা গত বিশদিন যাবৎ প্রতিদিন সকালেই হয়ে আসছে। অন্যদিন তারা ডাইনিং টেবিলেই বসে। কিন্তু আজ তাহমিদ ড্রয়িংরুমে থাকায় কুহু রান্নাঘরে খাওয়ার বায়না ধরলে, খালা তাতে সায় দেয়। খাওয়ার পর কুহু কোচিং-এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। তাহমিদ আঁড়চোখে কুহুর চলে যাওয়া দেখে, রিশাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, কুহু সাহেব বাজারে অবস্থিত একটা কোচিং-এ ভর্তি হয়েছে। ও চালাকি করে কোচিং-এর নামও জেনে নিল।

” মেজো চাচি, আপনার চা এখানেই নিয়ে আসব নাকি ড্রয়িং রুমে গিয়ে খাবেন? ” কুহুর প্রশ্নে মাথা তুলে তাকায় নায়লা আঞ্জুম। তার ঠোঁটের কোনে ঝুলছে তাচ্ছিল্যের হাসি।

” গুড, নিজের পজিশন ঠিকই বুঝে নিয়েছ তাহলে। মন দিয়ে সব কাজ করবে। এখানে থাকছ জন্যেই নিজেকে এই বাড়ির মালিক ভাবতে যেওনা। সব সময়ই একটা কথা মাথায় রাখবে, তোমরা দুই ভাইবোন এই বাড়িতে আশ্রিত। আমার দয়ায় এখানে থাকতে পারছ। তাই একটু কৃতজ্ঞতা তোমাদের কাছ থেকে আশা করতেই পারি। আর সেই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আশা করব তোমার চাচাকে কিছুই জানাবেনা। ”

” না চাচি, কাউকেই কিছু জানাবোনা। আমরা খুব ভালো করেই জানি, এখানে আমরা আশ্রিত। তাই এই বাড়িতে নিজের বাড়ি ভাবার কোন প্রশ্নই আসেনা। তবে আশা করছি বেশিদিন এখানে আমাদের থাকতে হবেনা। তিনমাসের মধ্যে কিংবা এ্যাডমিশনের পর কিছু একটা ব্যবস্থা করে ফেলব। আপনার ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকার ইচ্ছেও আমার নেই। আপনার চা কি এখানেই নিয়ে আসব? ”

কুহুর সোজাসাপটা উত্তর শুনে নায়লা আঞ্জুম কপাল কুঁচকে তাকায়। ঠোঁট ভেংচে হেসে উঠল।

” এখানেই নিয়ে এস। আজ তোমার কনফিডেন্স দেখে একটা প্রবাদই মনে আসছে, ছাল নাই কু’ত্তা’র বা’ঘা নাম। মুরোদ থাকলে তো আর এখানে এসে পরে থাকতেনা। সেই আবার গলা উঁচিয়ে কথা বলে! ”

কুহু বুঝতে পারছে এই মুহূর্তে চাচির সাথে বিতন্ডায় জড়ানো ঠিক হবেনা। কিন্তু নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে ওর চোখে পানি এসেছে ঠিকই। তার তিক্ত কথার বাণ কুহুর বুকে আঘাত করেছে।

ঘোর অমানিশা। আকাশ সেজেছে আঁধারের ঝালোর নিয়ে। গায়ে মেখেছে অমাবস্যার প্রলেপ। মৃদুমন্দ হাওয়া ছুঁয়ে দিচ্ছে বিটপীদের শাখা-প্রশাখা। হাওয়ার তোড়ে যেন দুলছে ধরাধাম। আশেপাশে কোথাও একনাগাড়ে ডেকেই চলেছে ঝিঁঝিঁদের দল। কয়েকটা রাতচোরা পাখি উড়ে গেল মেঘেদের গা ছুঁয়ে দিয়ে। ইট-পাথরের এই রাজ্যে পাখিদের কদাচিৎ দর্শন পাওয়া যায়।

কুহু মুখ তুলে উর্ধ্বাকাশে চাইল। ঘন আঁধারে ছাওয়া অম্বরে পাখির দলকে দেখার বৃথাই চেষ্টা করল সে। ওর কানে শুধু বাজল একঝাঁক পাখির কিচিরমিচির ধ্বনি।
হাওয়ায় দুলছে ওর কৃষ্ণবরণ কেশরাশি। আজি এ কৃঞ্চকালো রজনীতে উন্মুক্ত অন্তরীক্ষ তলে এক শ্যামাঙ্গীনি অষ্টাদশী কন্যার ডাগর আঁখিতে জমা হয়েছে এক সরোবর অশ্রুরাশি। তার আঁখিতে জমেছে অভিযোগের পাহাড়। কেন ওরা আজ অবহেলিত? কেন পরিজনদের নিকট ওরা বোঝা? বারবার খুঁজে চলেছে প্রশ্নগুলোর উত্তর।

” এত রাতে তুমি বাহিরে কি করছ! তোমার ভয় করছেনা? ”

কারও গলা শুনে চমকে উঠে কুহু। পাশে তাকিয়ে দেখল তাহমিদ দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিদকে দেখে আপনাআপনিই ওর মাথা নিচু হয়ে যায়। কন্ঠায় এসে মুখনিঃসৃত বাণী আটকে গেছে।

” কি ব্যাপার? এমন সাইলেন্ট মোডে কনভার্ট হলে কেন? শোন মেয়ে, সাইলেন্ট মোড আমার ভিষণ অপছন্দের। চাইলে ভাইব্রেট মোডেও যেতে পারো, কিন্তু আমার সামনে আসলে সাইলেন্ট মোড সাইডে রাখবে। এবার ভায়োলেন্ট মোডে আসো জলদি। ” কুহুর মুখের তুড়ি বাজিয়ে বলল তাহমিদ।

” ঘুম আসছিলনা, তাই বাগানে এসেছিলাম। ” অস্ফুট স্বরে বলল কুহু।

” বাগানে কি ঘুমের ঔষধের বীজ পুঁতে রাখা আছে! বীজ থেকে কি চারাগাছ জন্মায়? কতবড় হয় সেই গাছ? ফুল-ফল কিছু ধরে সেই গাছে? ফুলের সুবাস আছে? ফল কি মিষ্টি হয়? ঘুম গাছের ফুল দিয়ে কি বাসর সাজানো যায়? ”

” কিহ্! ”

কুহুর মুখে আর কোন কথা জোগায়না। ওর মনে কেবল একটা কথাই বাজছে, সামনে দাঁড়ানো এই লোক বিরাট মাপের ত্যাঁদর। এর আশেপাশে থাকলেই শুধু খোঁ’চা হজম করতে হবে। তাই ও বাসায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।

” আমি চিন্তা করে দেখলাম, ঘুম গাছের ফুল দিয়ে বাসর সাজালে আমার লস হয়ে যাবে। তাই সেই প্ল্যান ক্যান্সেল। বউকে ভালোবেসে ঘুম পাড়াতে হয়। বউ জাতী হয় ভালোবাসায় কাবু। তাদের ভালো……

তাহমিদ কথা শেষ করতে পারলনা। তার আগেই কুহু হুড়মুড়িয়ে বাসার ভেতর ঢুকে গেছে।

তাহমিদ গমনরত কুহুর পানে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠল।

চলবে।

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১২
জাওয়াদ জামী জামী

কুহুু দৌড়ে রুমে দরজা লাগিয়ে দিয়ে, বিছানায় গিয়ে বসল। ও ভয়ে জুবুথুবু হয়ে গেছে। সেই সাথে শরীরে হালকা কাঁপুনির অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। তাহমিদ ওর সাথে কেন এমন আচরণ করছে, তা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছেনা কুহুর। এর আগে মাত্র একবার তাহমিদের সাথে কুহুর দেখা হয়েছে। সেটাও কোন সুখকর পরিস্থিতিতে হয়নি। মায়ের মৃ’ত্যু’র পর শোকে আচ্ছন্ন কুহু একরাতে তাহমিদকে প্রথম দেখেছিল উঠানে পাতা চেয়ারে বসে থাকতে। পরদিন সকালেই সে গ্রাম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর পেরিয়েছে দুই মাস। এর ভেতর আর দেখা হয়নি তার সাথে। কিন্তু গতরাতে বাসায় এসেই কুহুকে দেখেই কেমন হেয়ালি কথাবার্তা শুরু করেছিল সে। কুহু কালকেও না পেরেছে তাহমিদের কথার মানে বুঝতে। আর আজও না পারছে তার কথার অর্থ বের করতে।
অবশ্য তাহমিদের কথার মানে বোঝার কোনও ইচ্ছেও নেই ওর। ও ভয় পাচ্ছে মেজো চাচিকে। চাচি যদি জেনে যায় বিষয়টা? তবে নিশ্চয়ই কুহুকে কথা শোনাতে ছাড়বেনা!

পরদিন সকালে কুহু আর তাহমিদের সামনে যায়না। তাহমিদ খেতে আসলে কুহু নিজের রুমে গিয়ে ঘামটি মে’রে বসে থাকল।

তাহমিদ খেতে বসে এদিকওদিক তাকিয়ে কুহুকে খোঁজার বৃথাই চেষ্টা করল। কিন্তু কুহুকে না দেখতে পেয়ে হতাশ হয়ে খাওয়া শেষ করে রিশা,নিশো, সৃজনকে পড়তে বসায়।

সেইদিন কুহু আর তাহমিদের সামনে আসলনা।তাহমিদ রাত দশটায় বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। ও তখনও চারপাশে তাকিয়ে কুহুকে খুঁজল। কিন্তু যে একবার নিজ থেকে আড়ালে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে বৃথাই খোঁজার চেষ্টা করা বোকামি বৈ কিছুই নয়।
তাহমিদ মনমরা হয়ে বিদায় নেয় সকলের কাছ থেকে। ও যাবার সময় বারবার পেছন ফিরে তাকায়, যদি একটি বার তার রাতজাগা তারাকে দেখতে পেত। কিন্তু ওর আশা অপূর্ণই থেকে যায়। ওর স্বপ্ন অংকুরিত হতে পারলনা। বিরস বদনে, অলস পায়ে ত্যাগ করল, তার প্রিয় অংগন।

” মাগো, তুমি কাইল সারাদিন রুম থাইকা বাইর হইলানা ক্যা? কি হইছিল, মা? ” রাজিয়া খালা মলিন গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

” তেমন কিছু না, খালা। শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল, তাই বের হইনি। ” কুহু অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বলল। ওর খুব খারাপ লাগছিল মাতৃসমা এই বৃদ্ধাকে মিথ্যা বলতে।

কুহুর কথা শুনে খালা একটু হাসলেন। তিনি কোমল চোখে তাকালেন কুহুর পানে।

” মাগো, এই জীবনে স্বামী-সন্তান নিয়া সংসার করবার পারিনি। সন্তান হইলনা জন্য স্বামী আরেকটা বিয়া করল। এক বছর পর সতীনের পেটে সন্তান জন্মালো। তার তখন থাইকাই আমার নরকদর্শন শুরু হইছে। স্বামী, সতীন মিল্লা কি অত্যাচারডাই না করত। অত্যাচার সইবার না পাইরা একদিন স্বামীর ঘর ছাড়লাম। বাপের বাড়িতে গেলাম। কিন্তু ভাইয়ের বউয়েরা আমাকে সেই বাড়িতে থাকপার দিলনা। বাপের ঘরও ছাড়লাম। ট্রেনে চাইপা গেলাম ঢাকা। সেখানে কাজ করলাম কত জায়গায়। একদিন রাস্তায় দেখা হইল তাহমিদ বাবার নানার লগে। হেয় আমার দুঃখের কথা শুইনা নিজের সাথে এইখানে নিয়া আসল। আর তখন থাইকাই আমি এই বাসায় আছি। এখানে আইসা আমি তাহমিদ বাবারে পাইলাম। আমি তার মা হইয়া উঠলাম। আর সে হইল আমার সন্তান। আমার বহু বছরের আক্ষেপ ঘুচল তাহমিদ বাবারে পাইয়া। জন্ম না দিয়াও আমি তার মা হইলাম। ”

কুহু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সামনে দাঁড়ানো মমতাময়ী খালার দিকে। তার মনে কত কষ্ট সে পুষে রেখেছে, অথচ তার মুখ দেখলে সেটা বোঝা যায়না।

এদিকে রাজিয়া খালা একমনে বলেই চলেছেন,

” তারপর জীবনে অনেক চড়াই-উৎরাই দেখলাম। সংসারের ভাঙ্গন দেখলাম, লোভ, হিংসা দেখলাম। এতকিছুর পরও আমি তাহমিদ বাবার মা-ই থাইকা গেলাম। রিশা, নিশো ওরাও আমারে খুব ভালোবাসে। ওদেরকে নিজ হাতে মানুষ করলাম। আবার তুমি আসলা আমার কাছে। তোমারে পাইয়া আরেকবার আমার মা হওয়ার দুঃখ ঘুচল। তুমি আমারে আপন কইরা নিলা। আমিও ভালোবাসলাম তোমারে। আসলে তুমি মাইয়াডাই এমন। তোমারে ভালো না বাইসা থাকাই যায়না। এখন আবার তোমারে ভালোবাসার সাথে সাথে নতুন দ্বায়িত্বও কাঁধে পরছে। তোমারে ভালো রাখার দ্বায়িত্ব, তোমার নিরাপদ রাখার দ্বায়িত্ব। তাই কই কি মা, আমার কাছে মিথ্যা কইওনা। মা মনে কইরা আমারে সব খুইলা কইবা, কেমন? ”

কুহু খালার কথা শুনে ধন্দে পরে যায়। ও খালার বলা শেষের কথাগুলোর মানে বুঝতে পারছেনা। খালা ওকে কি বোঝাতে চাইল? চিন্তারা মাথায় জট পাকাচ্ছে। কিন্তু ওর চিন্তা পাখনা মেলার আগেই নায়লা আঞ্জুম রাজিয়া খালাকে ডাক দেয়। খালা বাহিরে গেলে কুহুও চিন্তায় ক্ষান্ত দেয়।

দুইদিন পর কোচিং থেকে বাসায় এসে কুহুর চক্ষু চড়ক গাছে রুপান্তরিত হয়। বাসায় বেশ কয়েকজন নতুন মানুষকে দেখে ও গুটিয়ে যায়। একজন মধ্যবয়সী নারীর সাথে মেজো চাচি হেসে হেসে কথা বলছে।

কুহু কোন কথা না বলে ধীর পায়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই কথা বলল সেই মধ্যবয়সী মহিলা।

” নায়লা, এটাই কি তোর সেই হাভাতে ভাসুরের মেয়ে? ভাতের অভাবে নিজের বাড়িতে না থেকে অন্যের ঘাড়ে বসে বসে খাচ্ছে! আসলে গ্রামের মানুষদের লজ্জাশরম সব সময়ই একটু কম থাকে। ”

ভদ্রমহিলার কথা কানে যেতেই কুহু লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। থমকে গেছে ও। মাটির সাথে যেন সেঁটে গিয়েছে ওর দুই পা। চক্ষু গহবরে ঠাঁই নিল অশ্রুকনারা। তারা জানান দেয়, আমরা অতিসত্তর আসছি। ঠোঁট কা’ম’ড়ে চেষ্টা করছে অশ্রুবিন্দুদের পতন ঠেকানোর।

” হুম ছোট আপা, এ-ই সে। তবে বেশি কিছু বলোনা। রিশার বাবা জানলে আমাদের অসুবিধা আছে। এই মেয়েটাকে দেখতে যেমন সাধাসিধা মনে হয়, বাস্তবে তার উল্টো। দেখবে ইনিয়েবিনিয়ে চাচার কাছে আমাদের নামে বিচার দেবে। তুমি সত্যিই বলেছ, গ্রামের মিসকিনদের লজ্জাশরম কমই হয়। ”

এবার কুহুর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু বিন্দুরা ঝরে পরল। যেন ওরা প্রতিযোগিতায় নেমেছে, কার আগে কে ঝরতে পারে।

রাজিয়া খালা রান্নাঘর থেকে সবকিছুই শুনলেন। তার চোখেও পানি জমেছে। ড্রয়িংরুম আর রান্নাঘরের মাঝখানে পাথরের স্ল্যাবের ব্যবধান থাকায়, রান্নাঘর থেকে ড্রয়িংরুমের সব কথাবার্তাই শোনা যায়। একটা এতিম মেয়েকে কেউ যে এভাবে বলতে পারে, সেটা তার কল্পনাই ছিলনা। তার মন অনেক কিছু বলতে চাইলেও, সে যে এই বাসার কাজের মেয়ে। সেজন্য নিজের ইচ্ছেকে জলাঞ্জলি দিয়ে কাজে লেগে যান।

কুহু রুমে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ওর এই মুহুর্তে এই বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটা একপর্যায়ে ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। কিন্তু পরক্ষণেই চাচার কথা মনে হতেই কাপড়চোপড় ব্যাগ থেকে বের করে আলমারিতে গুছিয়ে রাখল। ও ভালো করেই জানে, চাচার কানে আজকের কথাগুলো গেলে, চাচা ওদেরকে ছাড়বেনা। কুহু চায়না ওর কারনে চাচার সংসারে অশান্তি হোক। তাই শত অপমানেও ওর নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। ধীরে ধীরে নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে হবে। একটা কাজ জোগাড় করে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। তবে তার আগে চাচাকে বোঝাতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে, কুহু আর ছোটটি নেই। পরিস্থিতি ওকে বদলে দিয়েছে। সে এখন নিজের সাথে সাথে ভাইয়েরও খেয়াল রাখতে পারে। ভাইয়ের দ্বায়িত্ব পালন করতে সক্ষম সে।

কুহুর সম্বিৎ ফিরে খালার ডাকে। খালা কোন কথা না বলে কুহুকে জড়িয়ে ধরলেন। খালার একটু আদরের ছোঁয়া পেতেই কুহুর নিলাজ মন হু হু করে উঠল। আবারও কাঁদতে শুরু করল মেয়েটা।

রাজিয়া খালা অনেকক্ষণ কুহুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন। কুহু শান্ত হলেই তবে ওকে নিয়ে রান্নাঘরে গেলেন তিনি।

” হেই রাজিয়া খালা, তোমার সাথে এই পরীটা কে? উঁহু পরী নয়, এটাতো ব্ল্যাক ডায়মন্ড! তা এই ব্ল্যাক বিউটি কে? ” রান্নাঘরের ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে ডক ডক করে পানি পেটে চালান দিয়ে বলল জয়। সে নীরবে কুহুকে পরখ করতে ব্যস্ত। জয় নামক ছেলেটার চোখ কুহুর সর্বশরীরে বিরাজ করছে।

কুহু ছেলেটাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখেই জড়সড় হয়ে কাজ করছিল। তখনই ছেলেটি রাজিয়া খালার সাথে কথা বলল। তাকে জিজ্ঞেস করল কুহুর কথা।

” ও কুহু। রিশার বড় চাচার মেয়ে। ” রাজিয়া খালার জয়ের কথা বলার ধরন পছন্দ হয়না। তাই তিনি আর কথা বাড়ালেননা।

” কু….হু। মানে কোকিলের ডাক। ভেরি গুড। তাকে একটু কথা বলতে বলবে, খালা? তার গলা দিয়ে কোকিলের স্বর বের হয় কিনা একটু দেখতাম। এই যে হট বিউটি? একটু কথা বলোনা? ” চোখ টিপে বলল জয়।

কুহু জয় নামক ছেলেটার কথা শুনে ওড়না দিয়ে শরীর ভালোভাবে পেঁচিয়ে নিয়ে রাজিয়া খালার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায়।

” জয় বাবা, তোমার কাম শেষ হইলে এখান থাইকা যাওগা। আমরা কাম করতাছি। রান্দোন ঠিক সময়ে না হইলে তোমার মা খ্যাচখ্যাচ করব।তখন তারে তো তোমার এই কথাগুলান কইতে পারমুনা। ”

রাজিয়া খালার হুমকিতে কাজ হলো। জয় রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

সেইদিন জয় কারনে-অকারণেই কুহুর আশেপাশে আঠার মত চিপকে রইল। ও কুহুর সাথে কথা বলতে চেষ্টা করছে। কিন্তু কুহু তাকে পাত্তা না দিয়ে রাজিয়া খালার সাথেই রইল। ও খালার কাছ থেকে জেনেছে জয় ওর চাচির ছোট বোনের ছেলে। তাই সে ভয়ে আরও গুটিয়ে যায়।

” হেই ডুড, আজকে নানুর বাসায় এসে একটা হট আইটেম দেখলাম। এবার রাজশাহীর ট্রিপটা আমার জন্য লাকি। আগে এখানে এসে বোর হতাম। এখন থেকে সেটা আর হতে হবেনা। মেয়েটাকে পটাতে পারলে মন্দ হবেনা। এটলিষ্ট রাজশাহীতে একটা বেড পার্টনার তো মিলবে। ”

অপার পাশ থেকে কিছু একটা শুনে জয় জোড়ে হেসে উঠল। ওর চোখ চকচক করছে। ঠোঁট দিয়ে ভেজায় নিজের ঠোঁট।

এতক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে সবটাই শুনল কেউ একজন। জয়ের কথা শেষ হতেই সে অতি সন্তপর্ণে সেখান থেকে সড়ে যায়।

রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশ। কুহু পড়ছে । সৃজন ঘুমিয়ে গেছে অনেক আগেই। এমন সময় দরজায় টোকার শব্দ শুনে কুহুর বুক ধক করে উঠল। এই রাতে কে এসেছে!

দরজার অপরপ্রান্তে দাঁড়ানো ব্যক্তি যেন কুহৃর মনের কথা শুনতে পেল। তার গলা শুনেই কুহুর ভয় নিমেষেই উবে যায়।

” কুহু মা, দরজা খুইল্যা দেও। আমি রাজিয়া খালা। ”

কুহু দরজা খুলেই দেখল খালা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন।

” খালা, আপনি এত রাতে? ”

” আইজ তোমার লগে শুইতে আইলাম। আমারে শুইতে নিবা? ”

” কেন নিবনা, খালা! আসেন ভেতরে আসেন। কিন্তু বিছানায় তো তিনজন শোয়া যাবেনা। এক কাজ করি সৃজন খাটে ঘুমাক। আমরা দুইজন মেঝেতে বিছানা করে ঘুমাই। ”

” তুমিও সৃজন বাবার লগে বিছানায় শোও। আমি নিচে শুই। ”

” আপনি এটা কি বলছেন! আপনি মুরব্বি হয়ে একা নিচে শোবেন, আর আমি ওপরে শোব! এটা কিছুতেই হয়না। আমিও আপনার সাথে নিচে শোব। আপনি আমাকে গল্প শোনাবেন। কতদিন গল্প শুনিনা। আগে বাবা নিয়ম করে গল্প শোনাত। কিন্তু সে অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই আর গল্প শোনা হয়নি। ” কুহুর চোখ চিকচিক করছে। চোখে পানি স্পষ্ট।

রাজিয়া খালা কিছু না বলে বিছানা করে কুহুকে নিয়ে শুয়ে পরল। আজ সে কুহুকে অনেক গল্প শোনাবে।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে