#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা ( ৬ )
উপরের ফ্ল্যাটের পুরোটা জুড়ে প্রহরদের বসবাস। তিন তলায় উৎসবের আমেজ, সাজ সাজ রব। বক্সে অনবরত হিন্দি গান বেজে চলেছে। নাচ, গানের আয়োজন ও চলছে নির্দিষ্ট কক্ষে। হৈ হুল্লোরের আওয়াজ নিচ তলাসহ আশপাশের ভবনগুলোতেও পৌছাচ্ছে। প্রিয়তার এসবে আগ্রহ নেই তেমন। যদিও নিধি পই পই করে বলে দিয়েছে সব অনুষ্ঠানে থাকতে হবে তাকে। মিসেস নাবিলাও বলে গিয়েছেন তার আশেপাশে থাকতে। তবুও এত মানুষের সামনে যেতে কেমন উদ্ভট লাগছে প্রিয়তার। আরহামের খুশির শেষ নেই। খুশিতে হয়তো সারারাত ঘুম হয়নি ছেলেটার। ভোর হতেই ছুটে বেরিয়ে গেছে উপরে। সবার মাঝে বসে গল্পের আসর বসিয়েছে। এনগেইজমেন্ট-এর কার্যক্রম হচ্ছে নিতান্তই শখের বশে। চাইলেই মেয়ের বাড়িতে গিয়ে আঙটি পরিয়ে এনগেইজমেন্টের ঝামেলা ক্লোজ করতে পারতো। কিন্তু তা না করে আয়োজন করে প্রোগ্রাম করা হচ্ছে। পিয়াস করিম বলেছেন কোন ত্রুটি থাকা যাবে না তার ভাগ্নের বিয়েতে। ছোট খাটো অনুষ্ঠান গুলোও করতে হবে, সে যতই ঘরোয়া ভাবে হোক। গায়ে হলুদ আর বিয়ের আয়োজন হবে ছাদে। ঘরে এত মানুষের জায়গা হলেও ঘেঁষাঘেষি হবে। দাঁড়ানোর জায়গা হবে না। মেয়ে বাড়ি থেকেও তো লোকজন আসবে হলুদ নিয়ে। ঘরের মাঝে এমন আয়োজন দেখতে ভালো লাগবে না।
প্রিয়তা সকালে উঠেছে আজ। কোচিং আর টিউশন সকালে রেখেছে। বিকেলে উপরের ফ্ল্যাটে থাকতে হবে। পড়ানোর সময় পাবে না। আরহামের এই খুশিটা কোনোভাবেই ভাঙতে চায় না প্রিয়তা। সে গেলে আরহামকে দেখে রাখতে পারবে। কখন কোন দুষ্টুমি করে বলা যায় না।
আজ তরকারি রান্নার ঝামেলা নিল না প্রিয়তা। চাল, ডাল একত্রে মেখে পানি দিয়ে বসিয়ে দিল চুলায়। সাথে ডিম পোজ করে দিবে আরহামকে। যদিও ও বাড়িতে খাবার দেওয়ার মানুষ আছে আরহামের।
টিউশনিতে গিয়ে আজ মনটা খারাপ হলো প্রিয়তার। কুসুমের মা কিছুটা অসুস্থ। আজ গার্মেন্টস-এ যায়নি তিনি। মহিলা ভিষণ ধুর্ত প্রকৃতির। অসুস্থ হলেও বারবার পড়ার জায়গায় এসে খোঁজ নিয়েছেন। সময়ের এক মিনিট আগেও প্রিয়তাকে ছাড়তে চাননি তিনি। প্রিয়তা কুসুমকে ফিন্যান্সের একটি অঙ্ক বুঝিয়ে করতে দিয়েছে। কোয়েল এসে পাশে বসল তখন। জিজ্ঞেস করলো আরহামের কথা। আরহামের কথা বলতে বলতেই বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পর্কে বলে ফেলল প্রিয়তা। আরহাম কেন আজ এত খুশি? কি করছে? এসব বলতে গিয়ে অনুষ্ঠানের বিবরণ দিয়ে দিয়েছে। ও ঘর থেকে সব শুনেছে কুসুমের মা। ততক্ষণাৎ তিনি এসে হাজির হলেন পড়ার ঘরে। কোয়েলকে বকা দিয়ে ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরে গিয়ে মেয়েকে উচ্চস্বরে বললেন,
” মাসে মাসে দুই হাজার টাকা দিমু কি এমনি এমনি নাকি? কিসের এত গল্প? পড়া বাদ দিয়া এমনে প্রত্যেকদিন গল্প করস ম্যাডামের লগে? ম্যাডামেরও দেখি কাণ্ডজ্ঞান নাই। পড়ানো বাদ দিয়া কি আলাপ শুরু করছে। ট্যাকা তো ঠিকই গুইনা নিবো। গল্প করার লাইগা দুই ট্যাকা কম তো নিবো না।
প্রিয়তা ঘরের বাইরে থেকে সবটাই স্পষ্ট শুনেছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রিয়তার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। নরম সত্তা নিমিষেই দুমড়ে মুচড়ে উঠছে তার। কথাগুলো বারবার ভেসে উঠছে মস্তিষ্কে। বিষণ্ণতায় ছেয়ে যাচ্ছে কোমল হৃদয়। চিকচিক করে উঠছে চোখের কার্ণিশ। নিজের কর্মে নিজে লজ্জিত হলো প্রিয়তা। এভাবে স্টুডেন্টকে বসিয়ে রেখে আসলেই তার গল্প করা উচিত হয়নি। পড়ানোর বিনিময়ে টাকা নিবে সে। এইভাবে গল্প করলে তো মেয়েটার পড়ায় সমস্যা হবে। অপরদিকে মন এসব মানতে নারাজ। বারবার বলে উঠছে “তুই অপমানিত হচ্ছিস, তোকে হেয় করা হচ্ছে। তুই কোন ভুল না করেও দোষী হচ্ছিস। কি এমন হয়েছে মেয়েটার সাথে কথা বলায়? পড়ানো বাদ দিয়ে তো কিছু করিসনি”।
প্রিয়তা বুঝল কুসুম লজ্জা পাচ্ছে। প্রচন্ড পরিমানে লজ্জা পাচ্ছে মেয়েটা। মাথা নিচু করে রয়েছে তার সামনে। মায়ের এমন কথাবার্তায় মেয়েটা কাঁচুমাচু হয়ে আছে। প্রিয়তার সামনে মায়ের মুখে এমন কথা বোধহয় আশা করেনি মেয়েটা। প্রিয়তা কুসুমকে স্বাভাবিক করতে হাসল। পড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল। এমন ভাব ধরলো যেন সে কিছু শোনেইনি। কিন্তু হৃদয়ে যে তোলপাড় শুরু হয়েছে তা কি কেউ জানল? বুঝল সে ব্যথা?
এরপর এক মিনিট ও পড়ার বাইরের কোন কথা বলেনি প্রিয়তা। নির্দিষ্ট সময়ের কয়েক মিনিট বেশিই পড়িয়ে দিল। বেরিয়ে আসার আগে কুসুমের মা প্রিয়তার পাশে এসে বসলেন। একটু হেসে বললেন,
” আপনে তো কুসুম রে পড়ান। আমার ছোট মাইয়ারে একটু দেইখেন তো। ও সবই পারে। অঙ্ক আর ইংরেজি পারে না। যোগ বিয়োগে ভুল করে। ইংরেজি লেখতে পারে না। কুসুমরে পড়া দেখাইয়া বইসা না থাইকা ওরেও কিছু বুঝাইয়া দিয়েন। এক লগে দুই জনেরই পড়া হইয়া যাইবো।
প্রিয়তা হেসে সম্মতি জানাল ভদ্রতার সাথে। পড়ানোর কথা ছিল শুধু কুসুমকে। কোয়েলকে পড়ানোর কথা আগে বলা হয়নি। কোয়েলকে পড়ালে কি বেতন বাড়িয়ে দিবে? প্রশ্ন জমলো প্রিয়তার মনে। প্রত্যেকটা মানুষই সুযোগ সন্ধানী। সুযোগ পেলে সেই সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে চায় সবাই। প্রিয়তাও তার ব্যতিক্রম নয়। তার মন বলে উঠল বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হবে কিনা জানতে। কিন্তু স্বভাব বশত মুখ ফুটে উচ্চারণ করতে পারল না বেতনের কথা। ব্যাগ গুছিয়ে চলে এলো বাইরে। দুদিন ধরে ভার্সিটিতে যাচ্ছে না। তন্ময়ের সাথে দেখা হচ্ছে কোচিং শেষে। ছেলেটা সবসময় প্রিয়তার জন্য চিন্তা করে। হাত খরচের টাকা দিতে চায়। প্রিয়তা নেয় না। ছেলেটা নিজেই মেসে থাকে। বাবা-মায়ের দেওয়া টাকায় চলতে হিমশিম খায়।
মাথার ব্যথাটা ক্ষণে ক্ষণে বেড়ে যায় প্রিয়তার। জ্বলে ওঠে শিরা উপশিরা। অস্থির অস্থির লাগে। হুট করেই রাগ কেমন বেড়ে যায়। ক্লান্তিতে চোখ বুজে যায়। আবার হুট করেই কান্না দলা পাকিয়ে যায় গলায়। এমন কেন হচ্ছে জানা নেই প্রিয়তার। নতুন নতুন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে অনেক। কোন গার্ডিয়ানের কাছ থেকে এমন কথা শুনতে হবে কখনো ভাবেনি সে। এটা ছিল প্রিয়তার টিউশনির এক নতুন অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা হয়তো প্রায় টিউশনি করা মানুষরাই পেয়ে থাকে। তাদের কাছে এইসব স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রিয়তা একটু ভালবাসা চায়, যত্ন চায়, ভরসা করার মানুষ চায়। চায় পাশে থাকার মানুষ।
আজ প্রিয়তা ঘরে ফিরল দুপুরের পর পর। কোচিংয়ে আজ কম শিক্ষার্থী এসেছিল। এ দুদিন সকাল সকাল পড়িয়ে দিবে বলে জানিয়েছে সবাইকে।
প্রিয়তা ঘরে প্রবেশ করে হাত ঘড়িটা রাখল তোষকের উপরে। আরহামকে এসে বাড়িতেই পেল। কিছু একটা খুঁজছে আরহাম। প্রিয়তা গা থেকে ওড়না সরিয়ে যান্ত্রিক পাখার নিচে বসল কিছুক্ষণ। ফ্যানটা কেনার সময় দরদাম করেছে তন্ময়। এগুলো কিনতে গিয়েই প্রিয়তার টাকা শেষ। কিছু কিনবো না কিনবো না করেও বাজারে গেলে নৈমিত্তিক অনেক কিছুই কিনতে হয়। দেখা যায় দৈনন্দিন জীবনে অনেক কিছুর প্রয়োজন হয় আমাদের। না কিনলেও গরমে বাঁচা যাচ্ছে না। কয়েকদিন পরেই শীতকাল। তখন বিদ্যুত বিল আসবে না, ফ্যানের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু গরমের সময়ে এই যান্ত্রিক পাখা একমাত্র ভরসা
” কি খুঁজছো আরহাম? শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো প্রিয়তা।
আরহাম আড়চোখে চাইল প্রিয়তার দিকে। ছেলেটা যে দৌড়াদৌড়ি করেছে বুঝতে পারল প্রিয়তা। ফোলা গালগুলো কেমন লাল হয়ে আছে। ললাটে দেখা যাচ্ছে ঘামের চিহ্ন। প্রিয়তাকে দেখে হাসল আরহাম। বললো,
“কোন শার্ট পড়বো আপু? আমাকে ভালো লাগবে কোনটায়?
হাসল প্রিয়তা। কাছে টেন নিল ছোট্ট শরীরটাকে। গালে গাল ঘষে দিল। চুলে হাত বুলিয়ে দিল যত্ন নিয়ে। ছেলেটাকে এত সুন্দর লাগে প্রিয়তার। মন চায় সর্বক্ষণ জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে। আরহামের গাল আলতো করে ছুঁয়ে প্রিয়তা বললো,
” তোমাকে সবকিছুতেই মানায় ভাই। যেটা ইচ্ছে পড়ে নাও।
” বিয়েতে কি পড়বো? তুমি কিন্তু নতুন শার্ট কিনে দিবে বলেছো।
” দিবো তো।
” রাতে তিয়াশ ভাইয়াকে হলুদ মাখাবে। সবাই হলুদ জামা পড়বে। আমার তো হলুদ শার্ট নাই। একটা ছিল, ওটায় তো ময়লা লেগেছে।
” আমি ধুয়ে দিবো। ওটাই পরবে। তন্ময় ভাইয়া তোমার জন্মদিনে বাদামি রঙের যে শার্টটা দিয়েছিল ওটা পরে নাও এখন।
আরহাম খুশি হলো। রশি থেকে টেনে বাদামি রঙের শার্টটা হাতে নিল। প্রিয়তার কাছে নিয়ে এলো শার্টটা। প্রিয়তা আগে পড়তে বসলেই আরহামকে এটা ওটা পড়াতো। এই বয়সেই ছেলেটা অনেকগুলো ছড়া শিখে ফেলেছে, যোগ বিয়োগ করতে পারে, এক থেকে বিশ অবধি কথায় লিখতে পারে। রঙ সম্পর্কে ও ধারণা আছে আরহামের। কথাবার্তা বলে স্পষ্ট। সামনে মাসেই আরহামকে ভর্তি করতে হবে স্কুলে। টিউটর হিসেবে প্রিয়তা তো আছেই।
কয়েকমাস আগে আরহামের জন্মদিনে তন্ময়ের দেওয়া বাদামি রঙের শার্টটা পড়িয়ে দিল প্রিয়তা। বোতাম ঠিকঠাক ভাবে লাগিয়ে বললো,
” ওখানে গিয়ে একদম দুষ্টুমি করবে না বুঝলে? তিয়াশ ভাইয়ার বউ আসলে আমাকে জানাবে।
আরহাম শুনল সব। প্রিয়তা আরহামের চুল আচরে দিল। নতুন জুতো বের করে দিল। হাতে লাইট জ্বলে ওঠা ছোটদের ঘড়ি পরিয়ে দিল। আরহাম চলে যেতেই হলুদ শার্টটা ধুয়ে দিলো প্রিয়তা।
____
টকটকে লাল রঙের একটা থ্রিপিস পড়েছে প্রিয়তা। হাতে ঝলমলে লাল রঙের রেশমি চুরি। চোখের পাতায় চিকন আইলাইনার নিল। ললাটে জায়গা করে নেওয়া ভ্রূ অবধি চুলগুলো আঁচড়ে নিল প্রিয়তা। লাল রঙে ফর্সা মুখ আরো উজ্জল লাগছে। ঠোঁটে লিপবাম নিয়ে বাড়ির জুতোই পড়ল প্রিয়তা। ধীর পায়ে তিন তলায় গেল। ঘরে ঢুকে নিধির পাশে গিয়ে বসল। আশপাশে তাকিয়ে প্রহরকে দেখতে পেল না প্রিয়তা। তবে সামনের মানুষটাকে দেখে শ্বাসরুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরী হলো। সাহিল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। গতকাল ওই কথা বলার পর এক দৌড়ে এখান থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। না জানি লোকটা কত রেগে আছে।
সাহিল প্রিয়তার পাশের চেয়ারে এসে বসল। পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে বাঁকা হাসল। বললো,
” কাল তুমি আমায় কি বলছিলে? আমি যেন কী?
প্রিয়তা বিরক্ত হলো কিছুটা। কালকে কি বলেছে সেটাও মনে রাখতে হবে? এমন উদ্ভট কথা বললে যে কেউ পাগল বলবে একে। প্রিয়তা তো ভুল কিছু বলে নি। শুধু শুধু লোকটা ঝগড়া করতে এসেছে। প্রিয়তার বিরক্তি প্রকাশ পেল না তার অঙ্গভঙ্গিতে। একটু হেসে সে বললো,
” আমি? আপনাকে? কখন, কোথায়? কবে,কাকে, কিভাবে? আমি আপনাকে চিনি নাকি?
প্রিয়তার অভিব্যক্তিতে ভ্যাবাচ্যাকা খেল সাহিল। মনে মনে হাসল প্রিয়তা। লোকটা রসিকতা করে বেশি। হাসিখুশি থাকতে ভালোবাসে বোধহয়। প্রিয়তার এমন কথায় সাহিল যে হতভম্ব হয়েছে তা তার অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছে। প্রিয়তা নজর সরিয়ে আশপাশে তাকাল। পালিয়ে যাওয়ার কৌশল খুঁজল। চোখ বড় বড় করে সাহিল বললো,
” তুমি দেখছি বেশ পাঁজি আছো। এমন ভাব করছো যেন আমাকে চিনোই না।
” চিনি বুঝি?
” আমি একজন আর্টিস্ট। অত হেলাফেলা করো না।
খুব গর্বের সাথে পাঞ্জাবী হাতা গুটিয়ে কথাটা বললো সাহিল। ভেংচি কেটে চুল ঠিক করল। প্রিয়তা থমকাল। একজন আর্টিস্টের হাবভাব এমন হয়? সেধে সেধে ঝগড়া করতে আসে? প্রিয়তার ভালো লাগে এই পেশাটা। জিজ্ঞেস করলো,
” কি আর্ট করেন আপনি?
” পোর্ট্রেট।
” আমার একটা ছবি এঁকে দিবেন?
” দিবো। যদি তুমি আমাকে হ্যান্ডসাম বলে সম্বোধন করো।
” দুঃখিত ভাইয়া। আমি মিথ্যে বলতে পারি না।
কথাটুকু বলে বাক্য ব্যয় করলো না প্রিয়তা। নিধিকে ডেকে তার সাথেই চলে গেল ভিতরে। যাওয়ার সময় বলে উঠল ” মানুষের সৌন্দর্য তার ব্যক্তিত্বে লুকিয়ে থাকে। আপনার মতো ঝগড়াইট্টা মানুষের হওয়া উচিত পাগলাগারদের হেড অফিসার”। সাহিল করুণ চোখে থাকিয়ে রইল। ভার্সিটিতে কত মেয়ে তাকে প্রপোজ করে। আর এই মেয়ে বলে কি না সে সুদর্শন নয়? এত বড় মিথ্যে বলে বলছে মিথ্যা বলে না?
তিয়াশকে প্রথম খেয়ালে আসল প্রিয়তার। প্রহরের বংশের ছেলেরা অধিক সুন্দর। সকলের মাঝেই মাধুর্যতা আছে। তিয়াশ ভাইয়া সবার চেয়ে চিকন হলেও অতিরিক্ত ফর্সা। তিয়াশ ভাইয়ার হবু বউ আঁখি মেয়েটাও সুন্দর। গোলাপী রঙের লেহেঙ্গা পড়েছে মেয়েটা। সুন্দর ভাবে সেজেছে। তিয়াশ ভাইয়া আর আঁখি কে মানিয়েছে একসাথে। আরহাম ফোন নিয়ে ওদের গেছে ছবি তোলার জন্য। প্রিয়তা বসে রইল দিশা আর নিধির সাথে। টুকটাক কথাবার্তা বলতে লাগল। সকলেই প্রিয়তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করল। প্রহর আর তিয়াশ ভাইয়া কোথায় যেন গিয়েছে। সে এলেই আংটি পড়ানো হবে। ততক্ষণে সবাই ছবি তুলছে অনবরত। গায়ে হলুদের প্ল্যান করতে লাগল। নিধির ঘরে তখন একটা মেয়ে আসলো। মেয়েটা আঁখির বড় বোন মিথিলা। এসেই টুকটাক খোশগল্প করলো সবার সাথে। অতঃপর নিধির পাশে এসে বসল মেয়েটা। হাসিখুশি মুখে বললো,
” আংটি পড়াতে তো এখনো দেরি আছে। আমায় একটু দেখাও না আংটিটা। আন্টিকে বলে এসেছি চিন্তা নেই।
নিধি উঠে দাঁড়াল প্রিয়তার পাশ থেকে। পড়ার টেবিলে থাকা ঝুরি থেকে ওয়ারড্রবের চাবি বের করল। ওয়াড্রবের লকার খুলে আংটিটা বের করতে গিয়ে ভীতিগ্রস্থ হলো নিধি। চোখমুখে থাকা হাসি গায়েব হয়ে গেল মুহুর্তেই। এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল আংটির বক্স। কোথাও আংটি নেই। গতকাল রাতেও আংটি বের করে সবাইকে দেখিয়েছে সে। এখানেই রেখেছিল দেখানোর পর। কোথায় যাবে আংটিটা? নিধির স্পষ্ট মনে আছে আংটিটা এখানে রেখেছিল।
নিধি জামাকাপড় সরিয়ে ওয়ারড্রবের তাক গুলো খুঁজল। কোথাও হীরের আংটির অস্তিত্ব নেই। নিধির দুশ্চিন্তা বাড়ল। দ্রুত মিসেস নাবিলার কাছে ছুটল। খানিকক্ষণ বাদে মিসেস নাবিলাও হন্তদন্ত হয়ে নিধির ঘরে এলেন। তোষক সরিয়ে, সুকেস ঘেঁটে আংটি খুঁজতে লাগলেন। আঁখির বোন আঁখির চেয়ে অনেকটাই বড়। অধিক স্বাস্থ্যের অধিকারি বলে আঁখির মায়ের বয়সী লাগে মেয়েটাকে। পান খেয়ে দাঁত কেমন লাল করে ফেলেছে মেয়েটা। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আংটি পাওয়া গেল না। তিয়াশের মা সাবিনা বেগম ঘরে এলেন। হা হুতাশ শুরু করে দিলেন। সেইসময় আঁখির বোন মুখ খুললো। বললো,
” আর পাইবেন না মাওয়ই। চুরি হইছে। বাড়ি ভরা মানুষ। একটু ভালো কইরা রাখবেন না?
মিসেস নাবিলা ঘামতে লাগলেন। পিয়াস করিম জানলে খুব রাগারাগি করবেন। আংটিটা অনেক দামী। একটু পরেই আংটি পড়ানো হবে ছেলেমেয়েকে। এখন যদি জানা যায় মেয়ের জন্য কেনা আংটি হারিয়ে গেছে, তাহলে নির্ঘাত আলোচনার মুখোমুখি হতে হবে।
মিসেস নাবিলা বললেন,
” হারাবে কেন? ঘরেই আছে। কে চুরি করবে?
” সবাই বাড়ির মানুষ তো? দেখেন ভাড়াটিয়া, প্রতিবেশী আসছে নাকি।
নিধির কাজিন তানিশা মেয়েটা ঘরে ঢুকল আরহামের সাথে। বললো,
” ভাড়াটিয়া বলতে শুধু প্রিয়তা আপু আর আরহামই এসেছে। ওরা চুরি করার মানুষ নয়। আন্টি তো না জেনেশুনে দাওয়াত দেয়নি। ঘরেই আছে। ভালো করে দেখো।
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে ফেলল মিথিলার কথা শুনে। এ ধরনের কথা বলার মানে কি? ঘরের মানুষ চুরি করবে না, তার মানে বাইরের মানুষ চুরি করেছে? এ বাড়িতে ওরা ছাড়া আর কেউই বাইরের নয়। কোনভাবে দোষ চাপাতে চাইছে ওদের উপর? প্রিয়তা আরহামকে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। সাবিনা বেগম মেকি সুরে কাঁদতে লাগলেন। বললেন,
” তোমারে কইছিলাম ভাবি। কইছিলাম সব অনুষ্ঠান ছাদেই করো। ঘরের ভিতর অনুষ্ঠান করলে চোর বাইড়া যায়। আমার মামাতো বইনের বিয়ার দিন ঘর থিকা ফোন হারাইছিল। বাটি চালান দেওয়নের পর দেখছে পাশের বাড়ির এক মহিলা চুরি করছে। এহন এই বাড়িতে আমরা আত্মীয়রা ছাড়া বাইরের মানুষ কইতে গেলে এরাই আছে। চাপ দেও ভাবি কইয়া দিবো। নাইলে আমি বাটি চালান দিমু।
প্রিয়তা বাকশক্তি হারাল। এতক্ষণ সরাসরি তাদেরকে চোর বলা হয়নি বলে চুপ ছিল প্রিয়তা। কিন্তু এখন সরাসরি চোর অপবাদ দেওয়ায় মুর্ছা গেল সে। হাস্যজ্জল মুখ অন্ধকারে ঢেকে গেল। প্রিয়তার নিজেকে নির্জীব বলে মনে হলো। যেন কোন কষ্ট নেই, কোন আনন্দ নেই। এক মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়তা। টপ করে চোখের পানি মেঝেতে পরল। বললো,
” আমি বা আমার ভাই আংটি নেইনি। আমরা আংটিটা দেখিওনি। প্রমাণ ছাড়া এইভাবে বলবেন না আন্টি।
সাবিনা বেগম ক্ষেপে গেলেন। বললেন,
” মুখ দেইখাই কইয়া দিতে পারি কে কেমন। তোমার বাপ-মা নাকি বিদেশে। এই কাজ কইরা বেড়ায় দেইখাই বাপ-মা থুইয়া গেছে। নাইলে বাপ-মায় থাকে বিদেশ। ছোড ভাই নিয়া এইখানে থাকবো ক্যান?
মিসেস নাবিলা থামতে বললেন সাবিনা বেগমকে। কোনভাবেএ থামলেন না তিনি। পাত্তা দিলেন না কারো কথায়। বললেন,
” এই পোলাডা সারাদিন এই ঘর ওই ঘর করছে। দেইখো এই-ই নিছে।
প্রিয়তার মাথায় আকাশ ভাঙল। এত বড় অপবাদ কি করে কেউ প্রমাণ ছাড়া দিতে পারে? আরহাম এইসব চুরিটুরি করার ছেলেই নয়। সবার সামনে এইভাবে ছেলেটাকে মিথ্যা কিভাবে অপবাদ দিচ্ছে এরা? প্রিয়তা কেঁদে দিল নিঃশব্দে। সবসময় তার সাথেই এমন হচ্ছে। একের পর এক এমন সব ঘটনা ঘটছে যে বারবার ভেঙে যাচ্ছে প্রিয়তার হৃদয়। ভাইয়ের হাসি মুখটা দেখার জন্যেই এই অনুষ্ঠানে এসেছিল প্রিয়তা। সবকিছুতেই ব্যর্থ হচ্ছে প্রিয়তা, হেরে যাচ্ছে বারবার। সমাজের মানুষ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে তাদের বাবা-মা নেই। জীবনের আনন্দ গুলো এত ক্ষণিকের জন্য আসে কেন? আসার সাথে সাথেই আবার চলে যায় কেন? প্রিয়তা তো ভাইকে একটু সুখী দেখতে চেয়েছে, একটু ভালো থাকতে দেখতে চেয়েছে। তার ইচ্ছে গুলো এভাবে অপূর্ণ রয়ে যাচ্ছে কেন? বাইরের মানুষ বলে এইভাবে ওদের অপমান করবে কখনো ভাবেনি প্রিয়তা। হৃদয়ে এক অদ্ভুত ব্যথা অনুভব করলো সে। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। নিজের জীবনকে নিয়ে আফসোস হচ্ছে। আরহাম ইতিমধ্যে কেঁদে ফেলেছে। প্রিয়তার ওড়নার এক অংশ ধরে ছেলেটা বললো,
” আমি কিচ্ছু ধরিনি আপু। তুমি বলেছিলে কিছু না ধরতে। আমি কিচ্ছু ধরি নি। আমি আংটি দেখিও নাই আপু।
প্রিয়তা ঠোঁট চেপে ধরে কান্না আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো। আরহামের হাত শক্ত করে ধরে বললো,
” আমার ভাই সোনা কোনটা আর সিটিগোল্ড কোনটা জানে না। হীরে আর পাথরের পার্থক্য বোঝে না। ও কেন আংটি নিবে। আরহাম এমন ছেলে নয়।
সাবিনা বেগম বললেন,
” ও না নিলে তুমি নিছো। চুরি করার মতো আর তো কেউ নাই এই বাড়ি। ভালোয় ভালোয় আংটি দাও। একটু পরেই আংটি বদল হইবো। আমার ভাইয়ের পোলায় কিন্তু পুলিশ।
প্রিয়তা বসে পরল মেঝেতে। আরহামকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। গাল বেয়ে তপ্ত নোনা পানি গড়াল অনবরত। চুপচুপে ভিজে গেল দুজনের গাল। প্রিয়তার নাকের পাটা লাল হলো। চোখ লাল হয়ে উঠল। মিসেস নাবিলার উদ্দেশ্যে জড়তা নিয়ে বললো,
” আমরা চোর নই আন্টি। এত বড় মিথ্যা অপবাদ দিবেন না। আমার ভাই এসব করতেই পারে না। নিষ্পাপ ছেলেটাকে নিয়ে এমন অপবাদ রটাবেন না প্লিজ। আমাকে কি আপনার এতটা খারাপ মনে হয় আন্টি? আমরা এমন নই।
চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ