#প্রাপ্তির শহরে সিজন ০২
#পর্ব-১১
#তাহরীমা
আদ্র তাহুর স্মৃতি ভুলতে পারেনা। ঘরের প্রতিটা জায়গায় যেন তাহুর স্মৃতি।কি নিদারুণ কষ্ট তাহু নেই সেটা ভাবতে আহা।এমন শাস্তি তার জীবনে পাওয়া কি উচিৎ ছিলো?তারপর ও তাহু বলত না সবকিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ।হ্যা আদ্র ও বলে সবকিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ।
আদ্রর মা আয়াতকে নিয়ে খেলছিল।তারপর আয়াতকে রুমে আনতেই দেখে আদ্র মাথা ধরে বসে আছে।আর কি যেন ভাবছে।আদ্রকে দিনদিন এরকম চিন্তিত দেখে আদ্রর মায়ের খুব কষ্ট হয়। সাহস নিয়ে আদ্রকে বলেন,
-“একটা কথা বলবো তোকে?”
মায়ের উপস্থিতি টের পেয়ে আদ্র মায়ের মুখের দিকে তাকায়।
–“বলো?”
–“আয়াতের জন্য নতুন মা নিয়ে আয়?”
আদ্র কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে হু হু করে হেসে উঠে।আদ্রর এমন হাসিতে আদ্রর মা অবাক ই হন।হাসি থামিয়ে আদ্র বলে,
–“তোমার কি মনে হয় আমি তাহুর জায়গায় অন্য কাউকে বসাবো?তাহু আমার প্রথম এবং শেষ ভালবাসা শুনে রাখো।নেক্সট এসব বলার সাহস দেখাবে না।”
–“কিন্তু আয়াতের মায়ের দরকার।”
–“আমি ওর বাবা আমি ই ওর মা।নতুন মা আমার সন্তানকে ভালবাসবে কি নিশ্চয়তা?এর চেয়ে হাজারগুণ ভালবাসা আমি আমার সন্তানকে দিবো।”
আদ্রর মা আর কিছুই বলেনা।যতদিন বাঁচবে ততদিন আয়াতকে আগলে রাখবে।এভাবে যদি তাহুর প্রতি অন্যায়গুলোর একটু হলেও প্রায়শ্চিত্ত হয়।
.
আদ্রর মাকে এখন কাজ করতে হয়না।কাজের মহিলা এসে কাপড় ধুয়া ঘর মোছা সব করে।রান্নাবান্না ও করতে চেয়েছিল কিন্তু আদ্রর মা অনেকটা সুস্থবোধ করায় রান্না তিনি করেন।
কিন্তু মেঘা এসবে সন্তুষ্ট নয়।মেঘা চায়না একসাথে থাকতে।সে আকাশকে জোর করে যাতে এ ব্যপারে আদ্রর সাথে কথা বলে। রাতের খাবার খাওয়া শেষে আকাশ আদ্রর রুমের দিকে যায়।আকাশকে আসতে দেখে আদ্র বলে,
–“কিছু বলবি?”
–“বলছি মায়ের তো বয়স হয়েছে।”
–“তো?”
–“মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠালে ভাল হয়না?”
আদ্র অবাক হয়,আর বলে
-“আকাশ তুই কি মানুষ? তুই আপন ছেলে হয়ে এ কথা কিভাবে ভাবিস জ্ঞান লোপ পেয়েছে?”
আকাশ মাথা নিচু করে বলে,
–“মেঘা মা কে সহ্য করেনা।আমি চাইনা কোনো ঝামেলা হোক।”
আদ্র অবাক হয় এই সেই বউ যে বউয়ের পক্ষে মা কথা বলত।যে বউকে নিয়ে তাহুকে কষ্ট দিতো।
যে বউকে মাথায় তোলে রেখেছিল।আর সেই বউ মা কে সহ্য করেনা বাহ।
আদ্রকে ভাবতে দেখে আকাশ বলে,
–“প্লিজ ভাই আমার কথাটা ভেবে দেখো?”
আদ্র হাসে।
–“আমি বেচে থাকতে মা কে কখনো ই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবো না।তবে হ্যা আমি খেয়াল করেছি তোর বউ আমার ছেলেটাকে ও পছন্দ করেনা।আমার ছেলেকে অবহেলা আমি কখনো ই সহ্য করবো না।আমি আমার মা কে নিয়ে অন্যবাসা দেখবো।”
আকাশ খুব খুশি হয়।আর চলে যায়।আর আদ্র আফসোস করে।স্বার্থ মানুষ কে কতটা নিচে নামাতে পারে।যে যেমন কর্ম করবে সে তেমন ই শাস্তি পাবে এটাই বিশ্বাস আদ্রর।
_________
কয়েকদিন হলো নতুন বাসায় উঠেছে আদ্র।মেঘা খুব খুশি নিজের একা বাড়িতে এখন সে যা ইচ্ছে তাই করবে।আদ্র তাহুর সব জিনিস পত্র নতুন বাড়ি নিয়ে আসে স্মৃতি হিসেবে।আয়াত নতুন বাড়ি এসে সব অচেনা লাগায় খুব কাদে।তারপর আদ্র আলোকে কয়েকদিনের জন্য আসতে বলে।
আলো হাসবেন্ড সহ আসে।
আয়াত আহিতা একসাথে হয়ে খুব খুশি হয়।দুজনে প্রায় সমবয়সী তাই তারা একসাথে খেলা করে।
আলো আকাশের ব্যপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে।তখন আদ্র বলে,
–“সময়ের উপর ছেড়ে দে। কাউকে কষ্ট দিয়ে কখনো ই সুখী হওয়া যায়না।”
আলো চুপ হয়ে যায়।নতুন বাসাতে তারা ভালই মানিয়ে নিয়েছে।আদ্র বিদেশ আর যাবে না ভাবে।তবে ওখানের সব খোজখবর অনলাইনে রাখে।ওখানে যাদের হাতে সব দিয়ে এসেছে তারা সবাই বিশ্বস্ত আর আদ্রকে খুব ভালবাসে।
______
আকাশ অনেক চেষ্টা করে ও একটা বাচ্চা নিতে পারেনা।মেঘা এতদিন ক্যারিয়ার এর দিকে চিন্তা থাকলেও এখন খুব করে মা হতে চাচ্ছে।কিন্তু অনেক ডাক্তার দেখানোর পরে ও সে মা হতে পারছে না।এদিকে আকাশের ও খুব ইচ্ছা তার ভাইবোনের মতো তার ও একটা বাচ্চা থাকুক।আশেপাশে ঘুরাঘুরি করুক।যদিও আকাশ কখনো আয়াতকে কোলে নিয়ে দেখেনি তাও মেঘার ভয়ে।
মেঘা মন খারাপ করে বসে থাকে।আকাশ বলে,
–“সমস্যা তো আমাদের দুজনেরই।”
–“কিন্তু আমি মা হতে চাই?”
মেঘার করুণ চাহনি দেখে আকাশ বলে,
–“একটা দত্তক নিলে কেমন হয়?”
মেঘা তখন বলে,
–“ঠিক আছে তবে মেয়ে নিবো।অনেক কিউট আর সুন্দর মেয়ে দেখে নিবো”
আকাশ হাসে,
–“আচ্ছা ঠিক আছে।”
আকাশ আর মেঘা একটা কিউট দেখে বাচ্চা দত্তক নেয়।বাচ্চা মেয়েটা কিউট হলে কি হবে অতিরিক্ত কান্নাকাটি করে।মেঘা আর আকাশ মিলে বাচ্চাটার নাম রাখে মাহি।মাহির বয়স দুইবছর।মাহি প্রথম একদিন ভাল ছিল কিন্তু তারপরের দিন থেকে এটা সেটা খালি বায়না করে।
যেটা চায় সেটা ই মাহিকে এনে দিতে হয় নইলে মেঘার চুল মুঠো করে ধরে আর ছাড়ে না।মেঘা ও মাহি যা চাই এনে দেয়।
_____
আদ্র তাহুর সব ছবি লুকিয়ে রাখে।যাতে আয়াত দেখতে না পায়।এতদিনে হয়ত তাহুর চেহারা আয়াত ভুলে গেছে।যদি দেখে যদি হাজারটা প্রশ্ন করে যদি জানতে পারে এটা তার মা ছিল।যদি বলে কোথায় তার মা? কি জবাব দিবে?তাই আয়াতকে আদ্র বলে, আদ্রই বাবা আদ্রই মা।আয়াত ও ছোট মাথায় এটাই বুঝে নেয়।
আদ্র সবসময় আয়াতের কাছাকাছি থাকে।আয়াতের দেখাশোনা করে।খাওয়া,কাপড়, পছন্দ, অপছন্দ, হাসি,কান্না সবকিছুর নজরে রাখে।আর আদ্রর মা তো আছেন ই।
মাঝেমাঝে সংসার টা ভাঙ্গার জন্য নিজেকে দায়ী মনে করে ডুকরে কেঁদে উঠেন।কাজ করতে হাপিয়ে উঠলে তাহুকে মনে করে কাঁদেন।মেঘাকে ভালবেসে তার তিক্ত ব্যবহার গুলোর কথা মনে করে কষ্ট পান আর উপলব্ধি করেন তাহুর কষ্টগুলো কেমন ই ছিলো।কিন্তু এখন আফসোস করা ছাড়া কিছুই করার নেই।আদ্রর বাবা এ দিনটার কথায় সেদিন বলেছিলেন অথচ আদ্রর মা কানে নেয়নি।
আলো মাঝেমাঝে এসে আয়াতকে সঙ্গ দেয়।আকাশ আদ্রর মায়ের তেমন খুজ নেয় না।আদ্রর সাথে মাঝেমাঝে কথা বলে।এই যা।
.
.
একপ্রকার ভালই আছে সবাই।আলোর আরো একটা ছেলে হয়।নাম আহান।আয়াত আস্তে আস্তে বড় হয়।
আয়াত আর আহিতা একসাথে খেলা করে।আলো বাসা চেঞ্জ করে এখন আদ্রদের সাথে থাকে।আলোর হাসবেন্ড ও চায় এটা।তার তো আপনজন বলতে কেউ নেই আলোর ভাই,মা মানে তার ই ভাই মা।
আহিতা শান্ত হলেও আয়াত একটু দুষ্টুমি করে।খেলার মাঝেই আহিতার চুল এলোমেলো করে।আহিতা ঠোট উলটে বলে,
–“ভাই তুই কি চুপচাপ বসে থাকতে পারিস না?”
আয়াত তখন বলে,
–“আপু তোকে রাগাতে খুব ভাল লাগে।”
–” আমি কিন্তু তোকে খুব মারবো”
–“আমি ও মারবো তাহলে।
দুজনে ঝগড়া করে।আবার ভাল ও হয়ে যায়।
তাহুর চাচি মাঝেমাঝে আয়াতের জন্য আদ্রকে কল করে।উনার শরীর এখন তেমন ভাল না।রিপা রিয়াদ ও বড় হয়ে যায়।রিপাকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন।আদ্র যদিও হেল্প করেছে অনেকটা।
অবশেষে ভাল পাত্র দেখে রিপার বিয়ে দেন।তাহু থাকলে এসব দেখলে হয়ত অনেক খুশি ই হতো।
_______________
দেখতে দেখতে আয়াত আহিতার পাচ বছর হয়ে যায়।আদ্র ছেলেকে শিশুশ্রেণীতে ভর্তি করায়।
পড়ালেখা করতে বসে আয়াতের বাহানার শেষ থাকেনা।আদ্র আয়াতকে পড়াতে বসিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায় থাকে।আয়াত ও ভ্রু নাচিয়ে বলে,
–“আমাকে সুন্দর স্কুলের ড্রেস কিনে দিতে হবে।রঙ পেন্সিল কিনে দিতে হবে।’
–“দিবো আর কিছু?”
–“সুন্দর ব্যাগ।”
–“আর?”
আয়াত তখন হেসে বলে,
–“তুমি বউ বউ করে একা কথা বলো যে,এরকম বউ কিনে দিতে হবে।আমি ও কথা বলবো।”
আদ্র মাথা চেপে ধরে। এটা কেমন ছেলে?
–“আচ্ছা সব কিনে দিবো।আগে পড়ালেখা করে বড় হও।”
তারপর আয়াত পড়া শুরু করে।আদ্রর মা এসব দূরে বসে দেখছিলেন।আদ্রকে অনেকবার বলতে চেয়েও বলেনি আরেকটা বিয়ের কথা।তাছাড়া যে মনে একজনের বসবাস,সে মনে অন্যজনকে কি সহজে জায়গা দেয়া যায়?শুধু শুধু আরেকটা মেয়ের জীবন নষ্ট হবে।তাছাড়া সে মেয়ে ভাল হবে বা কি নিশ্চয়তা আছে?
তাইতো আদ্র যেভাবে ভাল থাকতে চায় উনি ও তাই চান।অনেক তো পাপ করলো জীবনে।
__
আজকে আয়াত স্কুলের ড্রেস কিনতে যাবে তাও নিজের পছন্দে।বাবার হাত ধরে ড্রেসের দোকানে গেলো।আয়াত পছন্দ করে নিলো।ড্রেস অর্ডার করে আদ্র লাইব্রেরি তে গেলো।সেখানে আদ্র রঙ পেন্সিল কিনলো।
হঠাৎ তাদের পাশে একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল।পরনে এপ্রোন।স্কার্ফ করা,সুন্দর আর গোলগাল চেহারা।সুন্দর করে স্কার্ফ করেছে।
মেয়েটি দোকানদারকে বলল,
–“আংকেল মেডিকেল থ্রিলার বই হবে?আমি প্রচুর বইপোকা।”
আদ্র মেয়ে মানুষের কন্ঠে শুনে সরে দাঁড়ায়।আর কোনো মেয়েকে দেখার অথবা কন্ঠ শুনার আগ্রহ তার নেই।আগ্রহ নেই বলে সে পরিচিত অপরিচিত কোনো কন্ঠ ই পছন্দ করছেনা।
কিন্তু আয়াত মেয়েটির তাকিয়ে থাকে।মেয়েটি আয়াত কে খেয়াল করে বলে,
–“হাউ কিউট বয়।”
আয়াত বলে,
–“থ্যাংকইউ।”
–“ওয়াও।”
মেয়েটি আদ্রর দিকে তাকায়।আর মনে মনে বলে,
–” এত সুন্দর ছেলে এ প্রথমে দেখছি।আচ্ছা ছেলেটি বিবাহিত না অবিবাহিত?’
হাজার টা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
আদ্র আয়াতকে বলে,
–“চলো সব কেনাকাটা শেষ।”
আয়াতের হাত ধরতে দেখে মেয়েটির মন ভাঙ্গলো।এত সুন্দর ছেলের সাথে বাচ্চা তার মানে বিবাহিত ই।জীবনে যা ও প্রথম কাউকে সুন্দর লাগলো তাও বাচ্চা আছে।
আদ্র পাশ ফিরে যেতেই হাল্কা চোখাচোখি হয়।কিন্তু মনের ভুল ভেবে দ্বিতীয়বার মেয়েটির দিকে তাকায়।
মুহুর্তে বিস্ময়ে চেয়ে যায় চোখ।আদ্রকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটি লজ্জা পায়।
আয়াত বলে,
–“যাবে না বাবাই?”
আদ্র অস্ফুট স্বরে বলে–“তাহু?”
হাস্যেজ্জল মেয়েটি বলে,
–“সরি প্রিয়া।সবাই পিয়ু বলেই ডাকে।ডাক্তার প্রিয়া।এইতো ইন্টার্নি করছি।আসিয়েন আমাদের মেডিকেলে অনেক সুবিধা পাবেন।”
আদ্রর সেদিকে হুশ নেই তার চোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।একমুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল এটা তাহু ই।আদ্রর চোখের জল দেখে মেয়েটি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো।কান্নার মত ত কিছুই বলেনি সে………
চলবে..