প্রাপ্তির শহরে পর্ব-০৬ সিজন০২

0
969

#প্রাপ্তির শহরে সিজন০২
#পর্ব-০৬
#তাহরীমা

তাহু সব গুছিয়ে রাখতে যায়।আর মেঘা এটা সেটা গল্প করে আদ্রর মায়ের মাথা আছড়ে দেয়।মেঘার বাড়ি থেকে মেঘার বাবা মা আসবে।তাই প্রচুর রান্নাবান্না করতে হচ্ছে।আদ্র আরো একজন মহিলা নিয়ে আসে।তাহুর সাথে হেল্প করার জন্য।সারাদিন খাটতে খাটতে তাহুর নিজের দিকে তাকাবার সময় নেই।আর নেই সুন্দর শাড়ি পড়ে ঘুরে বেড়াবার।আদ্র ও রান্নাঘরে আসতেছে তাহুকে দেখার জন্য।

মেঘা সেটা খেয়াল করে।সে আকাশকে গিয়ে বলে,
–“তোমার ভাই ত দেখছি বউপাগলা।প্রেম করে তো বিয়ে করে নাই।”

আকাশ তখন বলে,
–“হ্যা তাহুকে খুব ভালবাসে।আর প্রেম করে বিয়ে না করলে বুঝি বউপাগলা হওয়া যায় না?”
–“না যায় তাও বললাম আরকি।যেভাবে রান্নাঘরে ঘুরঘুর করছে দেখলাম।”

আকাশ আর কিছু বলল না।মেঘার বাবা মা চলে এসেছে।সাথে মেঘাদের আরো অনেক আত্মীয় এসেছে।মেঘা গিয়ে তাদের জড়িয়ে ধরে।তাহু সামনে গিয়ে সালাম দেয়।যখন তাহুর পরিচয় দেয় মানে সে আদ্রর বউ।

মেঘার মা মুখ ভেংচি কেটে বলে,
–“দেখতে তো বউয়ের মতো লাগছে না।লাগছে কাজের মেয়ে।”

তাহু তখন হাসিমুখে বলে,
–“যেহেতু আমি কাজ করতে পারি,সেহেতু কাজেরই তো মেয়ে।কারোর মতো অকাজের হয়ে জীবনে বাচতে চাইনা আন্টি।”

মেঘার মা চুপসে গেলো।আদ্রর মা তাহুকে টেনে আনে।
–“চুপ করে থাকতে পারিস না।জানিস ওরা কত বড়লোক আর মানিসম্মানি মানুষ।”
–“আর আমি মানুষ নই আম্মু?”

আদ্রর মা চুপ করে থাকে।তারপর তাহু নাস্তা পানি দিয়ে আপ্যায়ন করেন।মেঘার মায়ের প্রথমে তাহুর কাপড়চোপড় দেখে ভাল না লাগলেও ব্যবহারে খুব সন্তুষ্ট হন।

মেঘার বাবা মা যাওয়ার সময় তাহুকে ও জড়িয়ে ধরে যায়।

বিয়ে উপলক্ষে অনেক খাবারের আয়োজন করা হয়েছিলো।তবে সবটা খাওয়া হয়নি।কেউ কেউ ত প্লেটে খাবার নিয়ে অল্প খেয়ে রেখে দিয়েছে।এত অপচয় দেখে তাহুর খুব খারাপ লাগে।

সে প্লেট থেকে ভাল ভাল খাবারগুলো সরিয়ে একটা হাড়িতে নেয়।আদ্রর মা তাহুর কান্ড দেখে বলে,
–“কি করছিস এসব ফেলে না দিয়ে?”

তাহু তখন শান্ত হয়ে বলে,
–“কত মানুষ আছে আম্মু এক লোকমা ভাত পায়না।আর আমি এত ভাত মাংস ফেলে দিবো?এগুলা সবগুলো এখনো ভালো।”

–“এহহ এই খাবার আমরা তো কেউ খাব না।তোর মানুষিকতা এত নীচ।বলি হারি তুই ত বাপের বাড়িতে এসব দেখিস ই নি।”

তাহু তখন বলে,
–“আপনাদের খেতে হবে না।যারা খেতে পারেনা তাদের কাছেই আমি খাবারগুলো পৌছে দিবো”

আদ্রর মা মুখ ভেংচিয়ে চলে যান।

_________

কিছুদিন হচ্ছে তাহুর কেমন শরীর খারাপ খারাপ লাগে।মাথা ঘুরায়।আদ্রকে এ ব্যপারে বললে, আদ্র বলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।কিন্তু আদ্রর মা শুনে বলে,
–“ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না।এসব লক্ষণ সম্পর্কে আমি জানি।আমার নাতি নাত্নি আসবে।”

আদ্র এটা শুনে খুশিতে কি করবে বুঝতে পারেনা।এদিকে তাহু ও খুশি।শুধু ভয় একটা আদ্র ও চলে যাবে।সংসার পড়ালেখা সব একা ই সামলাতে হবে।তার উপর এই ছোট্ট প্রাণ বড় হচ্ছে।

তাহুকে মন খারাপ করে ভাবতে দেখে আদ্র বলে,
–“যেহেতু আমাদের ঘরে মেহমান আসতেছে সেহেতু আমি আপাতত আর বিদেশ যাচ্ছি না।”

তাহু অবাক হয়।
–“তাহলে আপনার দোকান কে দেখাশোনা করবে?”
–“আমার অনেক বিশ্বস্ত লোক আছে।তাছাড়া গেলে ও একদিন কি দুইদিনের জন্য ই যাবো।আমার এই বউকে ছেড়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না।”

তাহু খুব খুশি হয়।
–“যদি আম্মু বকে?”
–“কেন বকবে?এত ভয় পাও কেন?তোমার এতকিছু ভাবতে হবেনা।তুমি শুধু আমাদের এই ভালবাসার চিহ্ন কে আগলে রাখবে ঠিক আছে?”

তাহু মুচকি হাসে।পরিবারের সবাই মোটামুটি খুশি।দুইটা মেহমান আসবে।
_______

দিন যেতে থাকে তাহুর পেট ভারি হয়।কলেজে আদ্র দিয়ে আসে।ক্লাস শেষে নিয়ে আসে।

কলেজ থেকে এসে তাহু একদম ক্লান্ত হয়ে পড়ে।শুয়ে থাকতে মন চায়।কিন্তু ও তো বাড়ির মেয়ে নয়,বউ। ওকে ওর দায়িত্ব পালন করতেই হবে।

তাহু ফ্রেশ হয়ে এসে রান্নাঘরে ডুকে।কাজের মহিলাটি ভাত রেধে রেখেছিলো।বাকি রান্না তাহু ই করবে।তাহুকে রান্নাঘরে দেখে আদ্র ও যায়।
–“কি ব্যাপার আবার এসব করছো যে?”

আদ্রর মা রুম থেকে তাকিয়ে আছে ছেলের কান্ড।বউকে নিয়ে সে একটু বেশি ই করছে।যেন বিয়ে শুধু সে একাই করেছে।

তিনি রুম থেকে বের হয়ে বলেন,
–“তাহুর বয়সে আমরা ও এমন সংসার সামলিয়েছি।তোদের পেটে নিয়ে আমরা কি সংসারের কাজ করিনি?”

আদ্র তখন বলে,
–“আম্মু এ ঘরে আরো অনেকেই আছে।কই তাদের তো তেমন কাজ করতে দেখিনা।আলো যেমন অসুস্থ যে কাজ করতে নিষেধ করেছো, তাহু ও তো অসুস্থ তার বেলায় কেন এ নিয়ম?”

–“শুন আমার মেয়ের সাথে তুলনা করবি না।ওর শরীরে তেমন শক্তি নেই।তাছাড়া কাজেও তেমন অভিজ্ঞতা নেই।তাহু সেদিক দিয়ে এগিয়ে।”

মায়ের সাথে তর্ক করে কোনো লাভ হবেনা।আদ্র আর কিছুই বলল না।তাহু ও কিছু বলল না।সবাইকে খেতে দিয়ে নিজেও খেয়ে নেয়।
তারপর নামাজ আদায় করে নেয়।আজকে দুইটা ক্লাস হয়েছে বলেই তাড়াতাড়ি চলে আসতে পেরেছে।সায়েন্স এর স্টুডেন্টদের একটু পড়ালেখার চাপ বেশি ই থাকে স্বাভাবিক।

সামনে আবার কোচিং ও শুরু হবে।সবকিছুতে আল্লাহ ভরসা।আল্লাহ তার জীবন যেমন চালাবেন তাতেই সে সন্তুষ্ট।শুধু তার স্বামীটা তার পাশে থাকুক আর ধর্য্যের শক্তি দিক আল্লাহ। মোনাজাতে আর কিছুই চায়না তাহু।

____________

মেঘা রুমে বসে ছিল।সে সবসময় রুমে ই থাকে আর ফোন টিপে।তাহুকে যদিও সাহায্য করতে যায় আদ্র মা বলে,
–“তোমার সময় হলে তুমি কাজ করিও।এখন তাহু আছে অই করুক।”

আকাশ জব থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়ে বসে।
–“যাও তো আমার জন্য শরবত করে আনো?”

মেঘা ফোন রেখে শরবত করে আনে।তারপর আকাশ এক চুমুকে শরবত পান করা শেষ করে।মেঘা তখন আদুরে হয়ে বলে,
–“বলছি কি আমি ও চাকরি করবো।”

আকাশ অবাক হয়ে বলে,
–“কেন আমি তো জব করছি নাকি?”
–“এত পড়ালেখা করে যদি জব ই না করি আমার নিজের পরিচয় বলতে কিছুই থাকলো না।”
–“কিন্তু?”
–“তোমার বড়ভাই থেকে কিছু শেখো।বউকে কিভাবে পড়াচ্ছে দেখো।সে যদি বাড়ির বড় বউ হয়ে পড়তে পারে,আমি কেন চাকরি করতে পারব না?”

আকাশ তখন বলে,
–“ঠিক আছে আমি আব্বু আম্মুর অনুমতি নিয়ে দেখি।”

মেঘা আকাশকে খাবার দিয়ে আবারো রুমে চলে আসে।আকাশ চুপচাপ একা ই খাবার খেয়ে বাবা মার রুমের দিকে যায়।

আদ্রর বাবা আকাশকে দেখেই বলে,
–“কি জন্য এসেছিস বলে ফেল?”
–“আসলে একটা কথা বলার ছিলো।’

আদ্রর মা বলে,
–“কি কথা?”
–“মেঘা চাকরি করতে চায়।”

আদ্রর মা অবাক হয়।
–“বাড়ির বউদের ঘরে ই মানায়।”
–“কিন্তু তাহু তো পড়ালেখা করছে।পড়ালেখা করে সে ও চাকরি করবে তাহলে মেঘা কেন পারবে না?”

আদ্রর বাবা বলে,
–“তাহু ত ঘরের সব কাজ সামলাচ্ছে তোর বউকে ও তাহলে সব কাজ সামলে চাকরি করতে বল।যেহেতু তাহুর তুলনা এসেছে এখানে।”

আদ্রর মা বলে,
–“তুমি চুপ করো।ঠিক আছে করতে বল গা।তোরা আজকালকার ছেলে মেয়ে পড়াশুনা করেছিস, চাকরি করবি না?”

আকাশ খুশি হয়,
–“এই না হলে আমার আম্মু।”

আকাশ মা কে জড়িয়ে ধরে খুশির খবর টা মেঘাকে দিতে যায়।মেঘা ও খুব খুশি।তখন আকাশ বলে,
–“আমাদের মেহমানটা কবে আসবে?”

মেঘা তখন হাল্কা রাগ করে বলে,
–“আগে আমার ক্যারিয়ার।বাচ্চা নেয়ার বয়স চলে যায়নি বুঝলে?”

আকাশ একটু অবাক হয় বিয়ের আগে এক মেঘা ছিল।বিয়ের পরে মনে হচ্ছে অন্য মেঘাকে দেখছে।থাক এসব ভেবে তাদের জীবনে ঝামেলা করা উচিৎ নয়।

___________

দেখতে দেখতে তাহুর ফাস্ট ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা চলে এসেছে।আদ্র তাহুর অনেকটায় কেয়ার নেয়ার চেষ্টা করে।সবসময় তাহুর কাছাকাছি থেকে তাহুকে সাহস দেয়।মায়ের বকায় যাতে তার মন খারাপ না হয় সেদিক দিয়ে সবসময় খেয়াল রাখে।

আদ্র মাকে বলেছে।পরীক্ষার কয়েকদিন যেন তাহুকে অন্তত ভাল প্রিপারেশন নিতে দেয়।দরকার হলে কাজের জন্য আরো মহিলা আনবে।আদ্রর মা রাজি হয়।বউকে পড়িয়ে কি এমন লাভ হবে তিনি ও দেখবেন।

তাহুকে আদ্র রাত জেগে পড়তে দেয় না।ঘুমাতে নিয়ে যায় গা।মাঝেমাঝে পায়ে ফুলা আসে।জ্বালাপুড়া করে। আদ্র তাহুর মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ায়।

তাহু মা হবে এটা তাহুর চাচি শুনে খুব খুশি হন।কিন্তু রিপা আর রিয়াদকে ফেলে তাহুর কাছে আসা সম্ভব নয়।আর না তাহুকে আদ্র ওখানে পাঠাবে।আদ্র তাহুকে চোখের আড়াল করতে চায় না।তাহুর চাচির বয়স হয়েছে তাই আদ্র ঠিক করলো।রিয়াদ বড় হওয়া পর্যন্ত তাদের সংসারের টাকা আদ্র ই দিবে।তবে এটা আদ্র বাবা মা কাউকে জানায় নি।আদ্র মনে করে তাদের টাকা গুলো যদি অসহায়দের কাজে না আসে আর এত টাকা থেকে কি লাভ?
_______________

আজ তাহুর পরীক্ষা শেষ।রাস্তার ধারে এক বৃদ্ধকে দেখতে পেয়ে তাহু এগিয়ে যায়।সাথে আদ্র ও যায়।
–“দাদু আমায় চিনছেন?অই যে নাত্নি বলে ডেকেছিলেন?”

ভিক্ষুক টি তাহুকে দেখেই হাসে।
–“চিনছি রে।”

তাহু তখন আদ্রকে সব বলে।আদ্র লোকটির বাড়ির ঠিকানা জানতে চায়।যেহেতু তাহু লোকটিতে দাদু ডেকেছে আজ থেকে তার ও দাদু।আদ্র এখন থেকে প্রত্যেক মাসে তার খরচ দিবে।

এসব শুনে বৃদ্ধ লোকটি বলে,
–“এই ছেলেটা কে রে?”
তাহু হাসে,
–“আপনার নাতজামাই দাদু।”

লোকটি এবার হু হু করে কেঁদে উঠে আদ্রকে জড়িয়ে ধরে।রক্তের মানুষ তার আপন হলো না অথচ পরের ছেলে হয়ে তাকে এভাবে কাছে টেনে নিয়েছে।আসলে আপন পর বলতে কথা নেই।মন মানসিকতা,আর বিবেক ঠিক মানে সব ঠিক।
তিনি তাহুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
–“অনেক সুখী হ রে।অনেক সুখী হ।”
–“দোয়া করবেন দাদু।”

_________

আলোর প্রসববেদনা উঠেছে।তাহু এসব এই প্রথম দেখছে।মনে মনে সে খুব ই ঘাবড়ে যায়।তাও তাহু আলোকে অভয় দেয়।আকাশ, আলোর হাসবেন্ড কেউ ই ঘরে ছিল না।
তারপর আদ্র আলোকে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যায়।

আলোর একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান হয়।

চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে