প্রাণেশ্বরী পর্ব-২৪+২৫

0
926

#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৪

প্রাণ সময় কাটাতে ফোন হাতে নিতেই অপরিচিত এক নাম্বার থেকে মেসেজ আসে৷ সে মেসেজটি ওপেন করতেই দেখতে পায় তাতে লেখা, “প্রাণ, আমি নয়ন। জানি তুমি আমার সাথে কোনপ্রকার কথাবার্তা বলতে ইচ্ছুক না কিন্তু তাও বলছি সময় করে একটু মিট করতে পারবে? তোমার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে। প্লিজ না কর না। ইট ইজ মাই লাস্ট রিকুয়েষ্ট টু ইউ।”

মেসেজটা পড়ে প্রাণ মোবাইলটা পুনরায় সিটে ফেলে দিল। বিতৃষ্ণায় মন বিষিয়ে গেল তার। সাথে প্রশ্ন জাগলো মনে, হঠাৎ নয়ন দেখা করতে বলছে কেন? নতুন করে কি মতলব এঁটেছে সে? তবে যাই হোক, তার কোন প্রকার ইচ্ছে নেই নয়নের সাথে দেখা করার। পাশে বসেই চৈতি প্রাণের আঁধারে ঘনীভূত চেহেরা দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কিছু কি হয়েছে ম্যাম?”

প্রাণের দৃষ্টি জানালার কাঁচ ভেদ করে স্থির হলো বড় বড় অট্টালিকার চূড়ায়। মন্থর কন্ঠে বলল, “নয়ন দেখা করার জন্য বলছে।”

‘নয়ন’-এর নাম শুনেই চৈতির কপালে তিনটে ভাঁজ পড়লো। সে কৌতূহল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি দেখা করবেন ম্যাম?”

প্রাণ উদাসীন কন্ঠে বলল, “ইচ্ছে নেই।”

প্রাণের উত্তরে চৈতি যেন বেশ খুশি হলো। মনে মনে আওড়ালো, “ওই রা’স’কে’ল’টার সাথে দেখা করতে চাইবেই কে? ননসেন্স একটা।”

________

“তুমি কি বলতে চাইছো, প্রাণ সেই রাতে ছন্দের সাথে বাহিরে ছিল?”

চৈতি মাথা নত করে বললো, “জি আশা ম্যাম।”

আশা বেগম তবুও নিজের মনের দ্বিধা দূর করতে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি নিশ্চিত ও ছন্দের সাথেই ছিল?”

“আমি শতভাগ নিশ্চিত। কেন না, ম্যামের ফোন তার কাছে ছিল। আমি সেদিন নিজের চোখে দেখেছি, তিনি যাওয়ার আগে পকেট থেকে বের করে ম্যামের ফোন তার পাশে রেখে গিয়েছিলেন।”

আশা বেগম রূঢ় কন্ঠে বললেন, “আমাকে আগে জানাও নি কেন এই ব্যাপারে?”

চৈতি তটস্থ কন্ঠে বলল, “মাথা থেকে ব্যাপারটা বেরিয়ে গিয়েছিল ম্যাম। তার উপর মাঝ দিয়ে ম্যামের শরীর এত খারাপ ছিল, আপনি তাকে নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত ছিলেন। তাই সুযোগও হয়ে উঠেনি। সরি ম্যাম!”

আশা বেগম দৃষ্টি সরু করে বললেন, “কাজে এমন হেরফের পছন্দ করি না আমি।”

চৈতি মাথা নত করে পুনরায় বলে উঠল, “সরি ম্যাম! আর এমন হবে না।”

“ওইখানে প্রাণকে টাইম টু টাইম মেডিসিন দিয়েছিলে তুমি?”

“জি দিয়েছি। শুধু ওইদিন রাতে মিস হয়ে গিয়েছিল তার জন্যই হয়তো পরেরদিন জেসিকার মৃ’ত্যু’র খবর শুনে তিনি ওমন রিয়্যাক্ট করে বসেন।”

আশা বেগম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। অবসন্ন কন্ঠে বললেন, “ছন্দের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখেছ? কেমন ও?”

“খারাপ কিছু খুঁজে পায়নি তার সম্পর্কে। সব রেকর্ড ক্লিয়ার তার। এমনকি কখনো কোন সম্পর্কেও ছিলেন না।”

“ফ্যামিলি সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছ?”

“হ্যাঁ! ছন্দ যখন অফিশিয়ালি বিসিবিতে জয়েন করেন তখন তার বাবা-মা এবং ছোট বোন লন্ডনে শিফট হয়ে যান। তার একটা বড় ভাইও আছে, বাংলাদেশেই থাকেন। তিনি ঢাকার প্রখ্যাত এক হসপিটালে কার্ডিওলজিস্ট হিসাবে আছেন। কিন্তু দুই ভাই একসাথে থাকেন না। বড় ভাই,তার বউ-বাচ্চা নিয়ে আলাদা থাকেন। তবে দুই ভাইয়ের একে অপরের বাসায় যাওয়া-আসা আছে। বলতে, তাদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড বেশ ভালো।”

আশা বেগম সন্তুষ্ট হলেন নাকি অসন্তুষ্ট বুঝা গেল না। শুধু দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। তিনি নিঃস্পন্দ কন্ঠে বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে। সময় মত সব খবর দিতে থাকবে আমায়। আর তোমায় যে যে কাজ দিয়েছি ওইগুলো ঠিক মত করবে। এখন যেত পারো তুমি।”

চৈতি মাথা নাড়িয়ে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। চৈতি যেতেই গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হলেন আশা বেগম।

_____

দুইদিন হলো, নয়ন প্রাণকে দেখার করার জন্য ক্রমান্বয়ে মেসেজ করেই চলেছে। তবে প্রাণ সম্পূর্ণভাবে তাকে উপেক্ষা করে চলেছে, কোনপ্রকার রেসপন্স করছে না তাকে। শেষে নয়ন মাত্রা ছাড়িয়ে যেতেই প্রাণ এক প্রকার বিরক্ত হয়ে তাকে ব্ল’ক করে দেয়৷ সে খুঁজে পায় না, একটা মানুষ এত হ্যাংলা কিভাবে হয়? অসহ্য!

এর মাঝে জিহানের সাথে প্রাণ একটা অ্যাডভারটাইজমেন্টের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। সেই শুটের ডেট পড়েছে আজকে। যার জন্য বনানী আসতে হলো তাকে। জমপেশ ভাবেই শুটিং চলছিল কিন্তু হঠাৎ করেই শুটিং স্পটে নয়নের আগমন ঘটে। তাকে দেখামাত্র সকলে নীরব হয়ে যায়, গোলগোল চোখে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। ইতোমধ্যে ক্রিউ মেম্বারদের মাঝে কানাঘুষাও শুরু হয়ে যায়। সকলেই মূল কৌতূহল এখানেই, “নয়ন কেন প্রাণের সেটে এসেছে? আবার কি চলছে তাদের মাঝে?”

প্রাণের নজর নয়নের উপর পড়তেই তার ভ্রু কুঁচকে আসে। সে তী’র্য’ক দৃষ্টিতে তাকায় নয়নের দিকে। এই ফাঁকেই নয়ন তার সন্নিকটে এসে বলে উঠল, “আমার তোমার সাথে কথা আছে প্রাণ।”

প্রাণ বিরক্ত সহিত কন্ঠে বলল, “কিন্তু তোমার সাথে আমার কোন কথা নেই৷ তুমি যেতে পারো।”

নয়ন নম্র কন্ঠে বলল, “এটাই লাস্ট মিট আমাদের। বেশি সময় নিব আমি তোমার, সত্যি বলছি। ইটস ইমপোর্টেন্ট, ট্রায় টু আন্ডাস্ট্যান্ড।”

প্রাণ তবুও রাজি হলো না। নয়ন তবুও হাল না ছাড়ায় চৈতি মাঝে এলো। কিন্তু লাভ হলো না। জিহান তখন উপস্থিত ছিল বিধায় এগিয়ে এসে নয়নকে বাঁধা দিল৷ মুহূর্তেই দুইজনের মধ্যস্থলে বেঁধে গেল হুলুস্থুল। প্রাণ পরিবেশ ঠান্ডা করতেই রাজি হলো নয়নের সাথে কথা বলতে। জিহান প্রাণের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আর ইউ সিউর?”

প্রাণ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। অতঃপর চৈতিকে সেটে থাকতে বলে ডিরেক্টরের কাছ থেকে অনুমতি প্রাণ বেড়িয়ে গেল। রাস্তার ওপাড়েই একটা ক্যাফে ছিল। প্রাণ ও নয়ন গিয়ে সেখানে বসলো। দুইজনে দুইটা কফি অর্ডার দিয়ে প্রাণ অপ্রসন্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “এসবের মানে কি নয়ন? ক্যান ইউ প্লিজ এক্সপ্লেইন?”

নয়ন মাথা নত করে বলল, “এসবের জন্য সরি বাট তুমি কোন রেসপন্স করছিলে না, তাই বাধ্য হলাম তোমার সেটে আসতে আমি।”

প্রাণ বিতৃষ্ণায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, “কি কথা বলার আছে বল, সময় যাচ্ছে তোমার।”

নয়ন থেমে বলল, “কথা ঘুরাতে চাচ্ছি না আমি তাই ডাইরেক্ট পয়েন্টে আসছি। জেসিকা সু’ই’সা’ই’ড করেনি। শি ওয়াস রে’প’ড এন্ড কি’ল’ড।”

কথাটা কর্ণগোচর হওয়ামাত্র প্রাণের অভিব্যক্তি বদলে গেল। সে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকায় নয়নের দিকে। নয়ন স্মিত কন্ঠে বলল, “কি বিশ্বাস হচ্ছে না?”

প্রাণ প্রত্যুত্তর করলো না। নয়ন কয়েকটা ডকুমেন্টস এগিয়ে দিয়ে বলল, “হয়তো এগুলা দেখার পর হবে।”

প্রাণ ডকুমেন্টস গুলো হাতে নিয়ে দেখলো। জেসিকার পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট এটা, তাতে স্পষ্টরূপে লেখা আছে জেসিকাকে গ’ণ’ধ’র্ষ’ণ এবং হ’ত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোথাও এইসব উল্লেখ করা হয়নি কেন? সোশ্যাল মিডিয়া, নিউজ সবখানেই এই নিউজ দেওয়া হয়েছে জেসিকা সু’ই’সা’ই’ড করেছে। তাহলে সত্য কোনটা? নিউজে যা বলেছে তা, নাকি তার হাতে ধরে থাকা রিপোর্টগুলো? বুঝে উঠতে পারলো না প্রাণ। সে স্থির হলো। নয়নের পাণে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এটা যদি সত্যি হয় তাহলে নিউজে বলা খবরটা কি? মিথ্যে? এটা বলতে চাচ্ছ তুমি?”

নয়ন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “খবরের নিউজটা সত্য না। আসল সত্যটা মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে প্রাণ। কারণ যারা কাজটা করেছে তারা ভীষণ পাওয়ারফুল। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ডার্ক সিক্রেট তুমিও জানো, আমিও। তাই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো এইগুলা কোন ব্যাপার না। আর আসলে কি ঘটেছে।”

প্রাণ বুঝতে পারলো না কি করবে। প্রমাণ তার হাতে, তবে সামনে বসে থাকা মানুষটাও নয়ন। যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক’প’ট’তা, ধোঁ’কা’র চলাচল। কিভাবে তার কোন কিছুতে বিশ্বাস করে প্রাণ?
প্রাণকে চুপ দেখে নয়ন নিজ থেকেই বলে, “জানি আমাকে বিশ্বাস করার মত কোন কিছু করিনি আমি৷ তবে আমাকে বিশ্বাস করতে বলছিও না তোমাকে, প্রমাণগুলো দেখাতে চাইছি শুধু। বাকি বিশ্বাস করা বা না করা সম্পূর্ণ তোমার ব্যাপার।”

প্রাণ ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কারা করেছে এসব?”

এর মাঝে ওয়েটার কফি নিয়ে আসতেই চুপ বনে গেল দুইজন। ওয়েটার কফি সার্ভ করে চলে যেতেই নয়ন নিঃশব্দে বাকি কাগজপত্রও এগিয়ে দিয়ে বলল, “দেখে নাও।”

প্রাণ কাজগপত্র সব হাতে নিল। একেক করে সবগুলো নামই দেখলো, তবে একজনের নাম দেখে ভড়কে উঠলো সে। দৃষ্টি স্থির হয়েই রইলো তাতে৷ যৎসামান্য সময় অতিবাহিত হলো এভাব্দি। প্রাণ নিজেকে ধাতস্থ করে জিজ্ঞেস করলো, “এসব করার মোটিভ কি ছিল তাদের?”

নয়ন বলে, “সঠিক জানি না। তবে মাঝে জেসিকা আমায় একদিন ফোন করে জানিয়েছিল তারা তাকে বিভিন্ন ধরনের কু’প্র’স্তা’ব দিচ্ছে এবং থ্রে’ট দিচ্ছে। আমি বিষয়টা তখন আমলে নেয়নি। ভেবেছিলাম জেসিকা নতুন করে কোন চাল চলছে আমাকে ফেরত পাওয়ার জন্য। আমার ওর সাথে কোন কিছু ঠিক করার ইচ্ছে ছিল না তাই ইগ্নোর করে যাই। কিন্তু এর সপ্তাহে খানিক পর যখন ওর মৃ’ত্যু’র খবর পাই তখন নিজ থেকেই খোঁজ লাগাই৷ আর শেষে এই সত্যটা বেরিয়ে আসে।”

নয়ন একটু থেমে আবার বলে, “জেসিকা এবার কোন মিথ্যে বলেনি আমায়। মেয়েটা আসলেই ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিল, নিতে পারছিল না পাপাজিদের ও নেটিজেনদের টক্সিসিটি। মেন্টালি ডিপ্রেসড হয়ে পড়েছিল সে, দিনে দিনে মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তবুও বিশ্বাস করতে পারিনি আমি ওকে।”

নয়নের কথা শুনে প্রাণের সেই ছোটবেলায় পড়া মিথ্যাবাদী রাখালের কাহিনীটি মনে পড়ে গেল৷ সেখানে কিন্তু ঠিক এই একই ঘটনা ঘটেছিল। রাখালটি এতবার মিথ্যে বলে গ্রামবাসীকে বো’কা বানিয়েছিল যে শেষে যখন সত্যি সত্যি বাঘ এসেছিল তখন গ্রামবাসীরা আর তাকে সাহায্য করতে আসেনি৷ রাখাল মিথ্যে বলছে ভেবে বসেছিল তারা। যার ফলে জীবন হারাতে হয়েছিল রাখালটিকে। তাই হয়তো গল্পের শেষে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, “কখনো মিথ্যা বলবে না।” আজ কথাটির বাস্তবিক প্রমাণ পেল সে। সে সাথে মনে হলো, “ছোটবেলায় শোনা গল্প সব শুধু রূপকথা না, বাস্তবও হয়।”
প্রাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। নয়নের দিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এখন আমার থেকে তুমি কি চাও?”

নয়নের সহজ স্বীকারোক্তি, “সত্যিটা সামনে আনতে তোমার সাহায্য চাইছি। আমি জানি জেসিকা তোমার সাথে অনেক খারাপ করেছে, আমিও করেছি কিন্তু কেউ আমরা কম শাস্তি পায়নি৷ নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি পুরা। বিশ্বাস কর। প্রতিনিয়ত কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি শুধু আমি জানি। তাই বলতে পারি শেষে ওর সাথে যা হয়েছে অন্যায় হয়েছে। এত করুণ পরিনতির হওয়ার কথা ওর ছিল না। এখন আমার হাতে পাওয়ার,পজিশন কিছু নেই এর জন্য সত্যিটা আমার পক্ষে আনাও সম্ভব না। আমার সব চেষ্টাই বৃথা যাবে।”

“তাই তুমি আমার পাওয়ার আর পজিশনের ইউস করতে চাইছো তাই তো? তা মি. নয়ন মেহরাব আপনার এটা কেন লাগলো আমি আপনার সাহায্য করবো?”

প্রাণের শাণিত কন্ঠে করা প্রশ্ন। তবে নয়ন অপ্রস্তুত হলো না, সে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল প্রাণ এমন কোন প্রশ্নই করবে। তাই সে ধাতস্থ কন্ঠে বলে, “আমি যে প্রাণকে চিনে, সে কখনো কাউরো সাহায্য করতে কৃপণতা করে না। হোক সে-টা শত্রু বা মিত্র। তবে তুমি সাহায্য করতে না চাইলে সমস্যা নেই। জোড় করবো না তোমায়।”

প্রাণ প্রত্যুত্তরে বলল, “আমি ভেবে দেখবো।”

নয়ন কন্ঠস্বর নামিয়ে বললো, “আমি অপেক্ষায় থাকবো। আর ধন্যবাদ।”

প্রাণ একবার সময় দেখে নিয়ে বলে, “তোমার কথা শেষ হলে আমি যেতে পারি?”

আকস্মিক নয়ন প্রাণের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না প্রাণ?”

প্রাণ কথাটা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, “সবাইকে ক্ষমা করা গেলেও খু’নি ও প্র’তা’র’ক’দে’র কখনো ক্ষমা করা যায় না। তাদের ক্ষমার যোগ্যই হয় না। তাই ভুলে যাও।”

কথাটা বলে প্রাণ সেখানে থেকে বেরিয়ে যায়। নয়নও তার যাওয়ার পাণেই তাকিয়ে থাকে শুধু৷

_________

প্রাণের সেট আপে নয়নের আগমন ও পরবর্তীতে তাদের আলাদা সাক্ষাৎ-এর নিউজ খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। নতুন হেডলাইনের সাথে নতুন গসিপ উঠেছে জনসাধারণের মাঝে। সকলের আশঙ্কা এটাই যে, জেসিকার মৃ’ত্যু’র পর এখন হয়তো নয়ন ও প্রাণ পুনরায় এক হতে চলেছে৷ এর কোন কিছুই এবার ছন্দের নজর এড়ায়নি। সে প্রাণকে নিয়ে উঠা সব নিউজই খুব মন দিয়ে পড়েছে, সাথে জিহানের মুখেও দুপুরের ঘটনা শুনেছে। কিন্তু তবুও নিউজগুলোর হেডলাইনগুলো সে যতবারই পড়ছে ঠিক ততবারই তার অন্তঃকরণে ভিন্ন এক ধরনের জ্ব’ল’ন অনুভব হচ্ছে। র’ক্ত’খ’ন’নের ন্যায় ধাঁ’রা’লো সেই অনুভূতি। ছন্দ দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠে, “এই নয়নের সমস্যা কি? প্রাণের পিছনে পড়ে আছে কেন এভাবে? কি চাই ওর? আর প্রাণেরও কি দরকার ওর সাথে আলাদা কথা বলার?”

জিহান পাশে বসে সবটাই শুনে। সে ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করে, “প্রাণ ও নয়ন যাই করুক তাতে তোর এত জ্বলছে কেন? তোমার সমস্যাটা কই?”

জিহানের কন্ঠ শুনেই ছন্দ সম্বোধি ফিরে পায়। তখন নিউজগুলো দেখে তার মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল। যার ফলে ক্রোধের বসে কথাগুলো বলে উঠেছিল। অথচ জিহান যে তার পাশেই বসা তা বেমালুম ভুলে ছিল সে। এখন জিহানের কথার কি উত্তর দিবে সে? কেন এমন রিয়্যাক্ট করছিল? প্রাণ যা ইচ্ছাই করুক তার এত জ্বলে কেন? কিভাবে বুঝাবে সে? কিভাবে?

#চলবে

#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৫

“চুপ করে আছিস কেন? প্রশ্ন করেছি আমি।”

ছন্দ তবুও মৌন। উত্তর কি দিবে তাই খুঁজে পাচ্ছে না সে। ছন্দকে এভাবে নীরব থাকতে দেখে জিহান ভ্রু কুঁচকে তাকায়, “বল! নয়ন ও প্রাণের বিষয় নিয়ে তোর এত মাথাব্যথা কেন? আমার খেয়াল আছে, ওদের ব্রেকাপের নিউজ বের হওয়ার পর তোকে খুশি খুশি লাগচ্ছিল৷ আবার এখন রাগ দেখাচ্ছিস। মাঝে দেখলাম প্রাণ ও তোকে নিয়ে কন্ট্রোভার্সিও হচ্ছে। মানে ব্যাপারটা কি বলতো?”

ছন্দ মাথার পিছনে হাত গলিয়ে অপ্রস্তুত হেসে বলে, “তেমন কিছুই না।”

জিহান তী’র্য’ক দৃষ্টিতে তাকে একবার পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে, “বাই এনি চান্স, তুই কি প্রাণকে পছন্দ করিস? ডু ইউ হ্যাভ ফিলিংস ফর হার?”

কথাটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্রা ছন্দ পূর্ণচোখে তাকায় একবার। দৃষ্টি-দেহ ভঙ্গি একদম স্বাভাবিক। অথচ এই কথা শুনে তার ভড়কে উঠার কথা ছিল। তৎক্ষনাৎ নাকচ করার কথা ছিল। জিহান খেয়াল করে বিষয়টা, উত্তর সে পেয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে৷ সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “তুই ভালো করেই জানিস, প্রাণ এবং তোর মাঝে কিছু হওয়া সম্ভব না। তবুও এই ভুলটা কিভাবে করলি?”

ছন্দ এক হাতের মুঠোয় আরেক হাত নিয়ে ঘেঁষতে থাকে। নিজেকে কোনরকম ধাতস্থ করে বলে, “ইচ্ছে করে তো মানুষ আর ভুল করে না, তাই না?”

ছন্দের এমন উত্তরে জিহান শতভাগ নিশ্চিত হয়ে যায়, ছন্দ আসলেই প্রাণকে পছন্দ করে অথবা এর উর্ধ্বেও হতে পারে। সে অসন্তোষজনক কন্ঠে বলে, “তুই বাচ্চা না ছন্দ। ভালো-মন্দ সবই বুঝিস৷ এখানে কমপ্লিকেশন অনেক, সে-টা জানিস তুই। একটা ফ্যাক্ট নাহয় অদেখা করলাম আমি, কিন্তু বাকিগুলা?”

ছন্দ সোফার পিছনে মাথা হেলিয়ে আঁখিপল্লব এক করে বলে, “জানি না।”

“পাথরের বুকে ফুল ফুটে না ছন্দ। অযথা চেষ্টা করিস না। আর নয়ন যা যা করেছে, এরপর প্রাণকে পাওয়া একেবারে দুঃসাধ্য ব্যাপার।”

“দুঃসাধ্য ব্যাপার কিন্তু অসাধ্য তো নয়।”

জিহান বলে, “তা নাহয় মানলাম। তবে আঙ্কেল-আন্টি মানবে বলে তোর মনে হয়? প্রাণ কিন্তু তোর…”

জিহানকে আর বলতে না দিয়ে ছন্দ চোখ খুলে বলে উঠে, “বাবা-মায়ের কথা চিন্তা করলে আজ আমি এই পর্যায়ে থাকতাম না। তারা কিন্তু কখনো আমার ক্রিকেট খেলা সাপোর্ট করেনি অথচ এখন আমাকে নিয়ে তাদের গর্বের শেষ নেই। তাই তাদের কথা টানবি না।”

“আমাকে বুঝ দিলেই হবে না ছন্দ। সবটা তুই যতটা সহজ ভাবছিস ততটাও না।”

“প্যারা নেই। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। বাদ বাকি চেষ্টা করতে সমস্যা কই?”

“ফল ব্যর্থতা ব্যতীত কিছু হবে না জেনেও, চেষ্টা করা কি বো’কা’মি না?”

ছন্দ সরু দৃষ্টিতে তাকায়, “বো’কা’মি’ই যদি হতো তাহলে ফল ব্যর্থতা জেনেও রবার্ট ব্রুস এতবার চেষ্টা করতেন না।”

জিহান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “আমি জানি না তোর পরিনতি কি হবে। তবে এতটুকু দোয়া করি, মন যাতে না ভা’ঙ্গে তোর।”

ছন্দ দূর্লভ হাসে। সে নিজেও জানে এসব এত সহজ না। প্রাণ ও সে দুটো ভিন্ন পৃথিবীর মানুষ। জীবনাদর্শ, স্বভাব, চালচলন, আচার-আচরণ সবই ভিন্ন। এমনকি কল্পনায় তার যেরকম মেয়ে পছন্দ, প্রাণ তার সম্পূর্ণ বিপরীত একজন। অথচ এই রমনীতেই তার মন,কৌতূহল, ধ্যাণ আটকে রয়েছে। এসব কখন,কেন, কিভাবে হলো জানা নেই তার। শুধু এতটুকু জানে প্রাণহীন রমণীটাকেই তার চাই। খুব করে চাই।

_____

সময়ের অবধারিত স্রোতের সাথেই কেটে গেল সপ্তাহ। ঋতু বদল হলো, আনকোরা ফুল প্রস্ফুটিত হলো বৃক্ষের আঁকেবাঁকে। পাখিরা ধরলো অন্য সুর। দিবাবসানের সময় তখন। নীলাভ আকাশে হরিদ্রাভ,র’ক্তি’মার পাতলা আস্তরণ, ধূমকেতুর ন্যায় ছুটে গিয়েছে দূর-দূরান্তেে। প্রাণ অলিন্দে দাঁড়িয়ে দেখছে সায়াহ্নের অরূপ-রতন দৃশ্য। বাতাস নেই কোন, ভ্যাপসা গরম পড়ায় কপালে ও নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। অতি উজ্জ্বল গাল দুটো ঈষৎ লাল। বুঝাই যাচ্ছে, এই মাত্রাতিরিক্ত গরম তার সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু তবুও সে স্থির দাঁড়িয়ে, যাচ্ছে না ভিতরে ঠান্ডা হাওয়ার নিচে৷ অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছে এখানে। সেবার ছন্দ তাকে প্রকৃতির ঐশ্বরিক সৌন্দর্যের সাথে পরিচয় করাতেই, আলাদা এক মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছে সে৷ প্রকৃতির মাঝেই প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছে৷ যার জন্য এখন সময় পেলেই সৃষ্টির অপূর্ব,অদ্ভুত উপভোগ করতে পিছপা হয় না। প্রাণ যখন আপন ভাবনায় মগ্ন ঠিক তখন আগমন ঘটলো আশা বেগমের। তিনি প্রাণের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “কি করছিস?”

প্রাণের ধ্যাণ ভাঙ্গলো। সে পাশ ফিরে তাকিয়ে বলল, “তেমন কিছু না। বল তুমি!”

আশা বেগম আদুরে হাতে প্রাণের মাথা বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “এবারও কি বড়সাহেবের অনুষ্ঠানে যাবে না?”

প্রাণ নিশ্চল কন্ঠে বলল, “যাবো তো। এবার যে আমার যাওয়াই লাগবে।”

প্রাণের উত্তরে আশা বেগম বিস্মিত হলেন। প্রাণ প্রত্যেকবার নিহাল শিকদারের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ঠিকই, কিন্তু কখনো সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয় না। এটাই রীতি হয়ে গিয়েছিল যেন। উল্লেখ্য যে, তার কর্তব্য আছে বিধায় প্রাণকে প্রতিবার যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেন তিনি। কিন্তু আজ প্রাণকে রাজি হতে দেখে আশ্চর্যান্বিত না হয়ে পারলেন না। কিয়ৎক্ষণ লাগলো তার বুঝতে প্রাণের যাওয়ার পিছনে ঠিক কোন উদ্দেশ্য আছে। কিছু তো চলছে তার মাথায়। আশা বেগম কন্ঠস্বর নামিয়ে বলেন, “তুই কি সত্যি যাচ্ছিস?”

“হ্যাঁ আশামা।”

আশা বেগম গোপনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে প্রাণের গালে হাত রেখে বললেন, “যাই করিস না কেন সাবধানে। নিজের ক্ষতি যাতে না-হয়। এখন যা, রেডি হয়ে নে। সময় চলে যাচ্ছে।”

প্রাণ হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিয়ে মাথা দুলালো৷ শব্দহীন পায়ে এগিয়ে গেল রুমের দিকে।

_____

বহুদিন পর ‘শিকদার ভিলা’ আজ তার নিজস্ব রূপে সেজেছে। জৌলুস, আভিজাত্যপূর্ণ। নিহাল এবং মেহরিমা শিকদারের পঁচিশ তম বিবাহ বার্ষিকী বলে কথা। সাধারণ হলে কি হয়? দোতলা বাড়ির পিছনে, খোলা আকাশের নিচে বাগানে বেশ আয়োজন করেই সাজানো হয়েছে সব। আমন্ত্রণের সংখ্যা খুব কম, তাই বাসার ভিতর আয়োজন করা। কিন্তু যারা আমন্ত্রিত সকলেই প্রখ্যাত ব্যক্তি, শিল্পী, পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী। যার ফলে তাদের আগমন ঘটতেই পরিবেশ হয়ে উঠে রমরমা। গেটের বাহিরেই রিপোর্টারদের ভিড়, ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না তাদের। যার কারণে শোরগোল শোনা যাচ্ছে।

প্রাণ এসে পৌঁছায় সাড়ে আটটার পরে। আসতেই সর্বপ্রথম তার চোখে পড়ে নিহাল ও মেহরিমা শিকদারকে। ঠোঁটের কোণে দুইজনের চওড়া হাসি, একদম সুখী দম্পতি যেন। পাশেই তাদের দুই ছেলে-মেয়ে পিউ ও প্রিয়ম দাঁড়ানো। দুইজনই প্রাণের ছোট। তবে তাদের চারজনকে একত্রে এক ফ্রেমে বন্দী করলে যে কেউ বলে উঠবে, “এ হ্যাপি ফ্যামিলি।” কিন্তু এর মধ্যে প্রাণ কোথায়? আদৌ কি কোন স্থান আছে তার এই পরিবারে? কথাটা ভেবে প্রাণ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো৷ অতঃপর মন্থর পায়ে এগিয়ে গেল নিহাল শিকদারের দিকে। তার সন্নিকটে গিয়ে অ’ভি’ন’ন্দ’ন জানালো। নিহাল শিকদার যদিও বা প্রাণকে দেখে খুশিই হলেন তবে মেহরিমা শিকদার, পিউ বা প্রিয়ম কেউ তেমন একটা খুশি হলো না বোধহয়৷ তাকে দেখামাত্র তারা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। তাদের ব্যবহারই প্রকাশ করে দিচ্ছে, ঠিক কতটা অপ্রিয় সে তাদের নিকট।
প্রাণ তাদের সম্মুখে বেশিক্ষণ দাঁড়ালো না, দ্রুত চেপে আসলো। সে এক কিনারে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকজন এসে তার খোঁজ নিতে থাকে। যেহেতু আগে সে কখনো এই আয়োজনে উপস্থিত হয়নি সেহেতু মানুষের কৌতূহল অনেক। নানা রকম প্রশ্ন করেই যাচ্ছে তারা। সময় যত গড়াচ্ছে প্রাণ তত অস্বস্তিবোধ করছে। অসহ্য লাগছে সব।
এন্টারটেইমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে ডেবিউ করার পর নিহাল শিকদার যখন প্রাণকে নিজের মেয়ে বলে পরিচয় করান তখন সর্বপ্রথম এই প্রশ্নটাই উঠে, “প্রাণ এতদিন কোথায় ছিল? আর তাকে কেন কখনোই কোন অনুষ্ঠান ও নিজের বাবা-মায়ের বিবাহ বার্ষিকীতে দেখা যায় না? এর কারণ কি?” নিহাল শিকদার যদিও বা নিজের জীবন সম্পর্কে সব গোপন রাখতেন তবুও পাপাজিরা ঠিক তার বিবাহ আর সন্তানের খোঁজ পেয়ে যায়। কিন্তু প্রাণের তথ্য কারো কাছেই ছিল না বিধায় প্রশ্নটা তখন হট টপিক হয়ে যায়। সেসময় নিহাল শিকদার খুব চালাকির সাথে প্রাণের অন্তর্মুখী হওয়ার বিষয়টা ব্যবহার করেন এবং একটি কাহিনী বানিয়ে দেন। এ নিয়ে প্রথম প্রথম গুঞ্জন উঠলেও পরবর্তী যখন প্রাণকে আসলেই কোন পার্টি বা গ্যাদারিং-এ দেখা যেত না তখন সবাই শান্ত হয়ে যায়৷ তবে আজ প্রাণকে দেখে সকলের কৌতূহল পুনরায় সৃষ্টি হয়। ফলে, আজ তাকে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে৷
প্রাণ সুযোগ খুঁজছিল নিহাল শিকদারের সাথে আলাদা কথা বলার। অতঃপর তাকে একা পেতেই প্রাণ এগিয়ে যায় এবং তার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে বলে জানায়। নিহাল শিকদার প্রাণকে স্টাডিরুমে গিয়ে অপেক্ষা করতেন বলেন। প্রাণ তাই করে। কিঞ্চিৎ সময় পেরুতেই নিহাল শিকদার হাজির হন স্টাডিরুমে। প্রাণের দিকে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন, “হঠাৎ আমার সাথে কিসের কথা তোমার?”

প্রাণ কয়েকটা ডকুমেন্টস এগিয়ে দিয়ে অতি শান্ত কন্ঠে বলে, “কারো কু’কী’র্তি দেখানোর ছিল আপনাকে।”

কথাটা শুনে নিহাল শিকদারের কপালের ভাঁজ গভীর হয়। সে ডকুমেন্টসগুলো হাতে নিয়ে দেখতে থাকে সব। হঠাৎ এক জায়গায় দৃষ্টি গিয়ে আটকে যায় তার। মুখমণ্ডল হয়ে উঠে র’ক্ত’শূ’ণ্য। অবিশ্বাস্য নয়নে তাকায় প্রাণের দিকে। প্রাণ তা দেখে শ্লেষের হাসি হেসে বলে, “প্রিয়ম শিকদার! আপনার কনিষ্ঠ পূত্র উরফে জেসিকার রে’পি’স্ট ও মা’র্ডা’রা’র। কি সুন্দর উপাধি, তাই না?”

কথাটা শুনে নিহাল শিকদারের কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করে। তিনি প্রস্ফুরণ কন্ঠে বলে, “এসব মিথ্যে! প্রিয়ম এমন ছেলে না। ও এমন করতে পারে না।”

“মানলাম মিথ্যে। কিন্তু মিথ্যে বলে আমার লাভ কি? তাও আবার তার পক্ষ নিয়ে যে কি-না আমার শত্রু ছিল?”

নিহাল শিকদার কথা বলার মত কিছু খুঁজে পেলেন না। আপাতত তার মাথা কাজ করছে না। সারা শরীর অস্বাভাবিকভাবেই কাঁপছে তার। সে ধপ করে পাশে রাখা চেয়ারে বসে পড়েন। প্রাণ তা দেখে বলে, “এখানের কোন কিছুই মিথ্যে না। আমি চেক করিয়েছি। প্রিয়ম অনেক আগে থেকেই এসব কাজে যুক্ত। আর এর মধ্যে ওকে সাহায্য করছে আপনারই বন্ধু রবিন কর্মকার।”

নিহাল অসহায়ত্বপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকান। প্রাণ তা দেখে বলে, “কি অবাক হচ্ছেন? আপনার আদর্শে বড় হওয়ার সন্তান এভাবে ব’খে গেল কিভাবে? তার তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। ব’খে যাওয়ার কথা না আমার ছিল? আত্মসম্মানহীন এক নারীর সংস্পর্শে ছিলাম বলে?”

নিহাল নিশ্চুপ। আজ তার গর্ব, অ’হং’কা’র সব চু’র’মা’র হয়ে গিয়েছে যেন। তিনি মাথা নত করে ফেললেন। প্রাণ পুনরায় বলে, “মনে আছে, একবার আমার মায়ের শিক্ষা-দীক্ষা ও আদর্শ নিয়ে আঙ্গুল তুলেছিলেন আপনি? অপমান করেছিলেন আমায়, তার মেয়ে হওয়ার জন্য? আমাকে নিজের মেয়ে বলতেও নাকি আপনার লজ্জা করে? তাই তো সরিয়ে দিয়েছিলেন নিজের জীবন থেকে। তবে আজ আমি প্রশ্ন করছি আপনার আদর্শ নিয়ে, আপনার ছেলের এমন অধঃপতন কিভাবে হলো? বলুন?”

নিহাল পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকান একবার৷ অতঃপর বলেন, “এখন কি তার প্র’তি’শোঃধ নিতে চাও তুমি? সকলের সামনে আমায় অ’প’দ’স্ত করে?”

“চাইলে তো কতকিছুর এই প্র’তি’শো’ধ নেওয়া যায়। আপনার আমার হিসাব যে শেষ হওয়ার না।”

“তো চাও কি তুমি?”

“আপনাকে দিয়ে এই তথ্যগুলোকে পাবলিশ করতে। তবে নিজের ছেলের নাম এই তালিকায় রাখবেন কি-না সে-টা আপনার ইচ্ছা।”

নিহাল শিকদার ভ্রু কুঞ্চিত করে বলেন, “চাইলে তো তুমিই সব পাবলিশ করাতে পারতে তাই না? আমাকে এই সুযোগ দিচ্ছ কেন?”

প্রাণ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে, “আমার এত ইচ্ছে নেই এসব ঝামেলায় জড়ানোর।”

নিহাল শিকদার কিয়ৎকাল তাকিয়ে থাকেন প্রাণের মুখপাণে। তার কথা একবারে অযৌক্তিক না। এই তালিকায় যাদের যাদের নাম আছে, তারা বেশ প্রভাবশালী। একবার তাদের নাম বাহিরে আসলে, পরমুহূর্তেই তারা খুঁজে বের কে করেছে কাজটি। কস্মিনকালেও যদি তারা প্রাণের নাম জানতে পারে, তাহলে হয়তো কু’কু’রে’র আচরণ করবে তার সাথে। শেষ পরিনতি মৃ’ত্যু হলেও মাঝ দিয়ে ভ’য়ং’ক’র কিছু ঘটে যাবে। যা হবে অসহ্যনীয়, মৃ’ত্যু’দ’ন্ডের চেয়ে জঘন্য। নিহাল শিকদার তাই ভেবে, থেমে বলেন, “যা চাইছো তাই হবে। কিন্তু প্রিয়মের কথা কেউ জানবে না।”

প্রাণ শ্লেষাত্মক চাহনিতে তাকায় শুধু৷ সে ভালো করেই জানতো নিহাল শিকদার কখনোই নিজের ছেলের নাম প্রকাশ্যে আসতে দিবেন না। তার সো কল্ড সম্মান আছে না? সে-টা কিভাবে মিইয়ে যেতে দিবেন তিনি? তবে পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে সে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। নয়ন যে এবারও তাকে ফাঁসাতে চাইছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই তার। সত্য সকলের সামনে আনতে চাইছে ঠিকই কিন্তু তাকে ফাঁ’সি’য়ে। তাই তো, এই ব্যবস্থা নেওয়া তার। হয়তো প্রস্ফুটনে একজন অপরাধী শা’স্তি পাবে না কিন্তু দিনশেষে কোন না কোনভাবে তার শা’স্তি সে পেয়েই যাবে। প্রাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “প্রিয়মের কথা কেউ না জানলেও ওকে আপনি নিজ হাতে শাস্তি দিবেন। পর্যাপ্ত শাস্তি যাতে ও পায় এটা নিশ্চিত করবেন। অন্যথায় আমি বাধ্য হবো ওর নাম প্রকাশ করতে। মনে থাকে যেন।”

কথাটা বলেই প্রাণ বেরিয়ে গেল সেখান থেকে৷ হঠাৎ করেই সব বি’ষা’ক্ত লাগছে তার। এই পৃথিবী এমন কেন? দেখতে রঙ্গিন কিন্তু ভিতর দিয়ে পুরোয় বেরঙ্গিন, দুর্গন্ধযুক্ত?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে