প্রণয় আসক্তি পর্ব-১৬

0
1034

#প্রণয়_আসক্তি
#লেখিকাঃমাহযাবীন
পর্বঃ১৬

বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর্শ।মৃদু বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে।তার স্থির দৃষ্টি রাতের অন্ধকার শহর পানে।রাস্তার ১-২ টা গাড়ি চলাচলের শব্দ ও ঘরের সাউন্ড বক্সে চলা গানের মৃদু শব্দ তার কানে এসে লাগছে।বিষয়টি মন্দ লাগছে না তার।বরং ভালোই লাগছে।
আর্শি আজ সন্ধ্যাতে মিয়ামির বাড়ি গিয়ে তাকে নিজের সাথে নিজ বাড়িতে নিয়ে এসেছে।শুধু যে মিয়ামিকেই সাথে নিয়ে এসেছে, এমনটি নয়।মিয়ামির সাথে মিয়ামির খালাতো দুই বোনকেও নিয়ে এসেছে।তাদের পরিকল্পনা ছিলো,আজ রাতে মেহেদী দেওয়া টা সেরে নেবে।সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী এখন মেহেদী লাগানোতে ব্যস্ত মেয়েরা।আর আর্শের ছেলে কাজিনরা জোরে গান ছেড়ে নিজেদের মতো করে নিত্য প্রদর্শন করে চলছে।সেই সাথে বেশ কয়েক পদের খাবার-দাবারেরও ব্যবস্থা রয়েছে সেথায়।তবে এসব কিছুতে আর্শের অংশগ্রহণ বারণ।বিয়ের আগে নাকি বর-বউয়ের দেখা করা যাবেই না।কড়া নির্দেশ সবার।এর মাঝে কোনো যুক্তি খুঁজে পায় না আর্শ।এতো বছর ধরে তো সে মিয়ামিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখে নিয়েছে তবে বিয়ের আগে এমন নাটকের কোনো যুক্তি আছে কি?
মেয়েটিকে এক দফা দেখার বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে আর্শের।কিন্তু এতো মানুষের ভীড়ে মেয়েটিকে একা পাওয়া টা অসম্ভব।ফলে উপায়ন্তর না পেয়ে সে বারান্দায় দাঁড়িয়েই অন্ধকার শহর পানে দৃষ্টি রেখে মিয়ামিকে ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে।
হটাৎই দরজা খুলার মৃদু শব্দ কানে এসে লাগে আর্শের।সে নিজের স্বপ্নের জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে কান খাঁড়া করে নেয়।এতো রাতে তো কারোরই তার কক্ষে আসার কথা নয়।তবে কে এলো!এটি ভাবার মাঝেই আর্শ আবারও দরজা লাগাবার শব্দ শুনতে পায়।এবার আর দেরি না করে সে বারান্দা হতে নিজ কক্ষের দিকে অগ্রসর হয়।
নিজের কক্ষে প্রবেশ করতেই মিষ্টি হাসি ঠোঁটে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি শ্যামবতীর দেখা পায় আর্শ।শরীরে তার কালো রঙ এর জর্জেটের শাড়ি জড়ানো।শাড়িতে আবার কালো রঙ এর পাথর বসানো আছে যা অল্প আলোতেও জ্বলজ্বল করছে।মেয়েটি নিজের হাত জোড়া টান টান করে মেলে রেখেছে।দু’হাতের কনুই অব্দি মেহেদী দেওয়া তার।
আর্শ মুগ্ধ নয়নে নিজের প্রিয়কে দেখে নিয়ে ঠোঁটে আলতো হাসি টেনে এক ব্রু উঁচু করে বলে ওঠে,
-আমাকে তো কড়া করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তোমার সামনে না যাবার।তবে তোমায় আমার রুমে আসতে দিলো কি করে?
-ওখানে এতো এতো হাস্যউজ্জ্বল চেহারার মাঝে গম্ভীর মুখো মানুষটির অভাব অনুভব করছিলাম।তাই আমার একমাত্র কলিজার বান্ধবী ও হবু ননদকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে তার সাহায্যে তোমার রুম অব্দি এলাম।
ঠোঁটে দুষ্টু হাসি নিয়ে কথাটি বলে ওঠে মিয়ামি।
উত্তরে আর্শ ব্রু কুঁচকে বলে ওঠে,
-আমি গম্ভীর?
-অনেকককক।
ঠোঁটে হাসি টেনে বলে ওঠে মিয়ামি।মিয়ামির কথার উত্তরে আর্শ কিছু বলে ওঠার আগেই মিয়ামি স্বস্তি মাখা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলে ওঠে,
-তর্ক পরে।আগে শোনো,আমি ভাবছি সব বান্ধবীদের উপদেশ দিবো যে,বিয়ে করলে বেস্টির ভাইকেই করা উচিৎ।নাহয় এমন সুযোগ খুঁজে সাহায্য কোন ননদে করে?
মিয়ামির কথায় শব্দ ছাড়াই হেসে ওঠে আর্শ।মিয়ামির কাছে এগিয়ে আসতে আসতে সে বলে ওঠে,
-আচ্ছা আচ্ছা।
মিয়ামিও হাসি মুখে বলে ওঠে,
-জ্বি জ্বি।
আর্শ মিয়ামির কাছে এসে হাতে লাগানো মেহেদীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।মেহেদীর নকশায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে সে বলে ওঠে,
-সুন্দর।
আর্শের এই একটি শব্দেই টানা দু’ঘন্টা বসে থেকে কোমর ব্যথা করে মেহেদী দেওয়াটা যেনো মুহূর্তেই সার্থক হয়ে গেলো মিয়ামির।ঠোঁটে বড়সড় হাসি ফুটিয়ে মিয়ামি বলে ওঠে,
-ভাইটু,মেহেদীতে তোমার নামের অক্ষরগুলো লুকোনো আছে,পারলে খুঁজো তো!
আর্শ মিয়ামির দিকে এক ব্রু উঁচু করে তাকিয়ে ভাবুক কন্ঠে বলে ওঠে,
-উম, এই কাজটা না বাসর রাতে করতে হয়?
আর্শের কথায় মিয়ামি একটু চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে ঠোঁট উল্টে চিন্তিত স্বরে বলে ওঠে,
-হ্যা,তাই তো।তাহলে তো আজ মেহেদী টাও দেখানো উচিৎ হয়নি।ধুর!
বলেই মিয়ামি মেজাজ খারাপ করে বিপরীত দিকে ঘুরে দরজার দিকে অগ্রসর হয়।কক্ষ ত্যাগ করার উদ্দেশ্যে।কিন্তু নিজের কোমরে কারো শীতল হাতের স্পর্শে থেমে যায় সে।
মিয়ামি শাড়ি পরে থাকায় সুবিধেই হলো আর্শের।সে আলতো করে মিয়ামির উন্মুক্ত কোমরে হাত রেখে তাকে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।কানের কাছে মুখ নিয়ে কানের পেছনের দিকটায় নাক ঘষে আর্শ মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-বাসর রাতে তো অনেক কাজ থাকবে।এই কাজটি নাহয় এখনই সেরে ফেলি?
আর্শের গরম নিঃশ্বাস ও স্পর্শে নিজের মাঝে এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করে মিয়ামি।এক সুন্দর অনুভূতি অনুভব হওয়ায় আবেশে নিজের চোখ জোড়াও বুজে নিয়েছে সে।এরই মাঝে আর্শের উক্তি কানে আসতেই একরাশ লজ্জারা এসে জায়গা করে নেয় তার মনে।
আর্শ মিয়ামির অবস্থা বুঝতে পেরে মৃদু হাসে।কোমরে রাখা হাতদুটো দ্বারা মিয়ামিকে আরো নিবিড়ভাবে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় সে।ওমনি একটু কেঁপে ওঠে মিয়ামি।আর্শ মিয়ামির কানে মুখ লাগিয়েই মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-দেখি হাত দুটো একটু উপরে তোলো তো।
আর্শের কথামতো চোখ বুজে রেখেই হাতজোড়া মেলে ধরে মিয়ামি।
ছেলেটির স্পর্শে মিয়ামি এই মুহূর্তে যেনো নিজের মাঝেই নেই।তার মন আদর কুড়োতে ব্যস্ত হয়ে আছে।আর্শের এই অল্প স্বল্প স্পর্শে চুপটি করে নিজের মনে উৎপন্ন হওয়া এক অপরিচিত,সুন্দর অনুভূতি অনুভব করে চলছে মেয়েটি।
মিয়ামির ঘাড়ে মুখ ঠেকিয়ে কয়েক মিনিট তার হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে আর্শ বলে ওঠে,
-হাতের তালুতে আঁকা ঐ ফুলটির মাঝে ‘আ’ লেখা।আর ঐ যে অনামিকা আঙুলের মাঝ বরাবর ‘র্শ’ লেখা।
এতোক্ষণ চোখ বুজে রাখলেও,আর্শের উচ্চারিত বাক্য দু’টি কানে আসতেই চোখ মেলে তাকায় মিয়ামি। অবাক কন্ঠে বলে ওঠে,
-এমন অল্প আলোতে আর এতো কম সময়ের মাঝে কি করে খুঁজে নিলে?
মিয়ামির কথায় মৃদু হাসে আর্শ।মেয়েটির চুল থেকে ভীষণ সুন্দর ঘ্রাণ কানে এসে লাগছে তার।দেরি না করে মিয়ামির চুলে নাক ডুবিয়ে আর্শ মৃদু স্বরে থেমে থেমে বলে ওঠে,
-প্রিয় মানুষটিকে আমরা গভীর থেকে গভীরতম দৃষ্টিতে দেখি।তাই প্রিয় মানুষটির কোনো কিছুই এ গভীর দৃষ্টি হতে লুকিয়ে থাকতে পারে না।

!!
ভালোবাসার বিপরীতে ভালোবাসা না মিললে এ সুন্দর অনুভূতিটি জঘন্য লাগতে আরম্ভ করে।কারণ, এ অনুভূতিটি মানুষকে না নিজের ভালোবাসার মানুষের থেকে দূরে যেতে দেয় আর না মানুষটি তীব্র ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রিয় মানুষটির কাছে যেতে পারে।প্রিয় মানুষটির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলে অবহেলা নতুবা উপেক্ষা মেলে।আবার দূরে যাবার চেষ্টায় নিজেকে ব্যস্ত রাখলেও কোনো লাভ হয় না।কারণ, হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও প্রিয় মানুষটিকে ভুলে থাকা টা সম্ভব হয় না।মানুষটির চিন্তা মনের মাঝে ঘুরপাক করবেই।যেমনটি করে বিহানের চিন্তা রাত-দিন ২৪ ঘন্টাই আর্শির মনে ঘুরপাক খায়।মেয়েটির নিজের ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে বা কাজিনদের নিয়ে শত ব্যস্ততা থাকবার পরও এক মুহূর্তের জন্যও বিহানের কথা ভুলে থাকতে পারে না সে।কাজের মাঝেই ছেলেটির কথা বারংবার মনে পরে তার।ঠোঁটে সদা হাসি লেগে থাকলেও তার মনের দীর্ঘশ্বাস টি সবার দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে যায়।

আজকাল আর্শির ব্যাপারটি খুব ভাবাচ্ছে বিহানকে।মেয়েটির বয়স কম।সবে ১৭/১৮ হবে হয়তো।এই বয়সের ছেলে-মেয়েদের মাঝে আবেগ কাজ করে অনেক।আর্শির অনুভূতিটিও তো আবেগ হতে পারে।আবার ভালোবাসাও তো হতে পারে।এ বিষয়টি নিয়ে বেশ সন্দিহান বিহান।আর্শি কি তাকে আদৌও ভালোবাসে নাকি সে আর্শির আবেগ মাত্র?
তাদের শেষ কথপোকথনে বিহান কি একটু বেশিই বলে দিয়েছে?মেয়েটি কি খুব কষ্ট পেয়েছে তার কথায়?তার ওভাবে কথাটি বলা কি অনুচিত ছিলো?
এমন হাজারো প্রশ্ন ও চিন্তেরা এসে ভীড় জমাচ্ছে বিহানের মনে।কিন্তু সে বুঝে উঠতে পারছে না এর সঠিক উত্তর কি এবং তার আসলে কি করা উচিৎ!

!!
আর ঠিক ২ দিন বাদেই আর্শ ও মিয়ামির বিয়ে।আগামী কালই তাদের হলুদ।কাজিনরা আগে চলে এলেও এবার পালা বড়দের আগমনের।গত কালই বিয়ের কার্ড তৈরি করা সম্পন্ন হয়েছিলো।বিয়ের কার্ডটি সম্পূর্ণটাই মিয়ামি,আর্শ ও আর্শির পছন্দে বানানো হয়েছে।কার্ড গুলো হাতে আসতেই তা সকল আত্মীয় সজনদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন আর্শের বাবা আরহান সাহেব ও মিয়ামির বাবা মুজিব সাহেব।
এখন বলতে গেলে ঘরের বড়রা সবাই ই বিয়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত।মিয়ামি বৌ হওয়ায় তাকে কেউ কোনো কাজ করতে দিচ্ছে না।তার এখন শুধু দু’টি কাজ।প্রথমটি হচ্ছে,ঘুম এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে রূপচর্চা।
আর উভয়ের মাঝে কোনোটই ঠিক মতো করছে না মিয়ামি।নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়ে যাবার আনন্দে ও উত্তেজনায় ঘুমই আসে না তার।আর রুপচর্চা করা টা বেশ বিরক্তির তার কাছে।কারণ,আর্শ তো তাকে নতুন করে দেখছে না।তার প্রকৃত রূপ আর্শ এতো বছর ধরে তো দেখে আসছেই তাই এখন এতো রূপচর্চা করা টা মিয়ামির কাছে সময়ের অপচয় মাত্র।তবুও নিজের মা-খালা ও কাজিন বোনদের সাথে পেরে না উঠে একটু-আধটু রূপচর্চা তাকে করতেই হচ্ছে।

এখন ঠিক মধ্য দুপুর,নিজের কক্ষে জোরে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে মুখে একটি হারবাল প্যাক লাগিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে মিয়ামি।কিছু একটা চিন্তা করে সে নিজের ফোনটি হাতে নিয়ে নিজের কোচিং এর বান্ধবী নিশিকে কল দেয়।
“হ্যালো,মিমি?”
ফোনটি ধরে কথাটি বলে ওঠে নিশি।উত্তরে মিয়ামি ঠোঁটে হাসি টেনে বলে ওঠে,
-বিয়েতে আসছিস তো?
-হ্যা,হ্যা আসছি।আর্শি আগেই দাওয়াত দিয়ে দিয়েছে।
-খুবই খুশি হলাম।আচ্ছা শোন,তোর ভাই মেডিসিন ডাক্তার নাহ?
-হ্যা।
-মেডিসিন ডাক্তার রা তো সব রোগ সমন্ধেই ধারণা রাখে তাই না?
-হ্যা।কিন্তু তুই কেনো জানতে চাইছিস?কোনো সমস্যা?
-আরেহ না না।আমার পরিচিত একজন মেডিসিন ডাক্তার এর খোঁজ চাইছিলো তো তাই তোর ভাইয়ের কথা মনে পরলো।তা তোর ভাইয়ের চেম্বার টা কোথায়?
-সালাউদ্দীনে।চিনিস তো?
-চিনি।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে