#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি
১৯.
রাতে ভাত খেতে বসে পুতুল কোনো কথা বললো না। শিউলি ভাতের প্লেট হাতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। পুতুল এখন অবদি গালে ভাত তোলেনি। সেই কখন থেকে আঙ্গুল দিয়ে নাড়িয়ে চলেছে। শিউলি ভাতের প্লেট নামিয়ে রেখে বললো,
‘ভাত তরকারি কারা দিয়া গেছে?’
পুতুল স্বাভাবিক জবাব দিলো,
‘সুজন ভাই।’
শিউলি কেমন করে যেন তাকালো। কিছু ভেবে বললো,
‘যাক গে! ভালোই হইছে!’
পুতুল এ কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। শিউলি নিজ থেকেই বললো,
‘বাপরে অমনে না বললেও পারতি। হাজার খারাপ হোক তবুও তো তোর জন্মদাতা বাপ।’
পুতুল জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল।
‘ মানুষটা কিন্তু অতটাও খারাপ না! ভালা মনের মানুষ! নিজের সুখের কতা ভাবা কি খারাপ কাজ? সুখের জন্যই অন্য সংসারে মন দেছে। এতে পাপের কি?’
এ পর্যায়ে পুতুলের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো। খাবার রেখে হনহনিয়ে রুমে ঢুকে দরজায় খিল এঁটে দিলো। পেছন থেকে শিউলি বার কয়েক ডাকল। সারাদিন বাদে খেতে বসেও মেয়েটা পাতে ভাত রেখে উঠে গেল। তার খারাপ লাগলো। এসব কথা পড়ে বললেও হতো!
রুমের বাতি নিভিয়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো পুতুল। নিস্তব্ধ রাতের আঁধারে চাপা পড়ে গেল তার কান্নার সুর। দূরে ধলা ও ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। এত মানুষের মাঝে ঐ বোবা প্রাণীটাই বোধহয় পুতুলের আকাশ সমান কষ্ট উপলব্ধি করতে পারলো!
______________
বাহিরে তপ্ত রোদ। বাজারের দোকানগুলোতে খদ্দের নেই। এমন গা ঝলসানো গরমে ঘর থেকে পোশা প্রাণী গুলোও বের হতে চায় না। পুতুলের স্কুল মাত্র ছুটি হয়েছে। ছয় ঘন্টা একটানা স্কুল শেষে ছেলে মেয়েরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অন্যসময়ের মতো কারো ভেতর বাড়ি যাওয়ার তাড়া দেখা গেলো না। সবাই ধীরে সুস্থে পা ফেলে এগোতে লাগলো। ক্লান্ত শরীর টেনে বাহিরে আসলে আজ ও পুতুল তিহানকে কোথাও দেখতে পেলো না। মুহূর্তেই মন বিষিয়ে উঠলো। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বাড়ির পথে পা বাড়ালো। সুজনকে দেখা গেলো চায়ের দৌকানে। পুতুল এক পলক সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজ তিনদিন হয়েগেল তিহানের সাথে তার কোনোরূপ যোগাযোগ হচ্ছে না। সুজনকে জানালে সে খুব সাবলিল ভাবে জানালো তিহান তাকে এ ব্যপারে কথা বলতে না করেছে। পুতুলের চোখ ভরে আসে। কেন এমন করছে লোকটা তার সাথে? পুতুল কোনো ভুল করলে সে পুতুলকে এ ব্যাপারে একবার জানাতেতো পারে। এমন লুকচুরি কেন করছে? পুতুলের অভিমান হয় সাথে কষ্টোও পায়। পাতলা ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে বিরবির করে,
‘পাষাণ লোক! আপনার সাথে কাটি করলাম! আমি আর একদম আপনার কথা মনে করে মন খারাপ করবো না। আপনি ধমকালেও না।’
পারুল পুতুলের যাওয়ার পানে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল। তিহানকে মনে মনে খুব করে বকলো। সুজন এমন করলে সে সরাসরি তার বাড়িতে গিয়ে খুন করে আসবে। এসব লুতুপুতু একদম তার সাথে চলবে না। পারুলকে দেখে সুজন এগিয়ে এলো।
‘ওদিকে কি দেখ? আমি এইদিকে জানেমান!’
পারুল গরম চোখে তাকালো। সুজনের হাসি মিলিয়ে গেল। ভরাট মুখে বলল,
‘এমন করে তাকাও কেন? আমি মরে গেল দায় ভার কে নিবে?’
পারুল দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘আগে আপনাকে মারি তারপর দায়ভার নেওয়ার লোকের খোঁজ লাগাব।’
সুজন সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সে ভেবে পায়না এই মেয়ে সবসময় এমন ভয়ংকর মেজাজে কেন থাকে!
‘চলো আগায়ে দেই তোমাকে।’
‘লাগবে না। এই রাস্তা আমার চেনা আছে।’
সুজন অসহায় চোখে তাকালো।পারুল ততক্ষনে হাঁটতে শুরু করেছে। সুজন তার পাশ ঘেঁষে হাঁটছে। নরম গলায় বললো,
‘কোনো সমস্যা হইছে জান? আমাকে বলতে পারো।’
পারুল আর চোখে সুজনকে দেখে মুখ টিপে হাসলো। গম্ভীর গলায় বললো,
‘আপনার বন্ধু পুতুলের সাথে যা করছে তা কি ঠিক?’
সুজন একটু ভেবে বললো,
‘বেঠিকেরতো কিছু দেখছি না!’
পারুল দাঁড়িয়ে পরলো। ঘুরে দাঁড়িয়ে সুজনের দীকে আঙ্গুল তুলে বললো,
‘এই ছিল আপনার মনে? তারমানে আমার সাথেও আপনি এমন কাজ করতে চাইছেন তাইনা? ভুলেও আমাকে পুতুলের মত ভাববেন না। আমি মোটেই দুঃখ পেয়ে চোখের পানি ফেলব না। সরাসরি হামলা চালাব।’
সুজন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। কি হলো কেষ হলো তার কিছুই সে বুঝলো না। না কুঁচকে বললো,
‘তুমি কি একটু সভ্য আচরণ করতে পারো না? সব কাজে এমন দস্যি পানা কেন?’
কথা শেষ করে জ্বিভ কাটলো। অতি সত্যি কথা অকপটে বলার জন্য আফসোস হলো। পারুল ততক্ষনে ছলছল চোখে তাকে ফেলে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছে। এ কেমন যন্ত্রণা!
____________
তারিম আজকাল খুব ব্যস্ত। নতুন গার্মেন্টস এর কাজ ধরেছেন তিনি ঢাকায়। সেটা ঘিরেই বিভিন্ন ঝামেলায় তিনি জড়িয়ে আছেন। সপ্তাহে প্রায় চার পাঁচ বার তাকে ঢাকা যাওয়া আসা করতে হচ্ছে। ছেলেটা যদি একটু নিজের কাঁধে কিছুটা দায়িত্ব তুলে নিত তাহলে হয়তো সে একটু স্বস্তি পেত। স্টাডি রুমের চেয়ারে গা এলিয়ে দিতেই চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। তখনি দরজায় খটখট শব্দ হলো। সোজা হয়ে বসে চশমা চোখে পড়তেই তিহান এসে ঠিক তার সামনে বসে পড়লো। তিহান বাড়িতে আসার পর আজ প্রথম তাদের সরাসরি সাক্ষাত হলো। তিহানের চোখ মুখ শুকনো। আগের থেকে শরীরের কিছুটা অবনতি সয়েছে। তারিম ছোখ চোখে তাকালো।
‘শরীরের হাল বলছে বেশ খাটাখাটনি করছ! তা এত খাটনি ঠিক কিসের পেছনে?’
টেবিলে থাকা গোল পেপার ওয়েটটা নাড়িয়েচাড়িয়ে তিহান জবাব দিলো,
‘চাকরি করছি। অন্যের কামলা খাটলে এতটুকু হাল তো হবেই!’
তারিম হো হো করে হাসলো। গলা উঁচিয়ে বললো,
‘তো কেমন লাগছে? বাপের হোটেল বাদ দিয়ে খেটে খাওয়ার মজা কেমন?’
‘তৃপ্তিময়। এখন কথা সেটা নয়। কথা হচ্ছে আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি!’
এ পর্যায়ে তারিম নড়েচড়ে বসলেন। মুচকি হেসে বললেন,
‘এতদিনে তোমার সুবুদ্ধি হয়েছে তিহান! আমি তোমার মায়ের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করবো। আমার এক বন্ধুর মেয়ে আছে….’
তাকে শেষ করতে না দিয়েই তিহান গমগমে গলায় বলে উঠলো,
‘আমি আপনার পছন্দে বিয়ে করতে পারব না এটা আমি আগেও বলেছি। আমি জাস্ট এটাই জানাতে এসেছি যে খুব দ্রুত আমি বিয়ে করছি! পাত্রী অবশ্যই আমি নিজে খুঁজে নিব।’
তারিম থমথমে মুখে ছেলের দিকে চাইলেন। তিহানের চাহনি কঠোর। তারিম মুচকি হাসলেন। তিহান তবে তার কথার প্রমাণ দিয়েই ছাড়লো!
‘তোমাল যা মন চায়! তবে তোমার মায়ের সাথে আলোচনা করে নিও। আমি হয়তো বাবার দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছি তোমার মা তো তার দায়িত্ব পালন করেছে। তাকে অন্তত কষ্ট পেতে দিও না।’
তিহানের দৃষ্টি নরম হয়ে এলো। বাবা নামক ব্যক্তিটার প্রতি আত্মীক টান সে কখনোই অনুভব করেনি। মা কে ঘিরেই ছিল তার সব। বাবা নামক এই ব্যক্তিটা কখনো তার সাথে হেসে কথা বলেছিল বলেও তার মনে হয়না। যখন সে ছোট ছিল ছুটির দিনগুলোতে তাদের দেখা হতো। দেখা হলে তারিমের তরফ থেকে প্রথম কথটা এমন থাকত যে,
‘পড়াশোনা কেমন চলছে? স্কুলের টিচাররা তোমায় এক্সট্রা কেয়ার করছে তো? হোম টিউটর লাগবে?’
একসময় এসব প্রশ্নে অধৈর্য হয়ে তিহান এই ছুটির দিনগুলোতে বাড়িতে না থাকার চেষ্টা করতো। ঢাকায় চলে যাওয়ার পর দূরত্বটা আরো বেড়ে যায়। তারিম কখনো তার সাথে যোগাযোগ করেন নি। কেয়ারটেকারের সাথেই কথা হতো তারিমের। মাস শেষে প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকাই পাঠাতেন। কিন্তু বাবা ছেলের সম্পর্কটা আর গড়ে উঠলো না। অপরিচিত দুজন মানুষের মতোই ছিল তাদের সম্পর্ক।
চলবে……
(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ধন্যবাদ।)