প্রণয়ের রংধনু পর্ব-০২

0
368

#প্রণয়ের_রংধনু✨
#পর্ব-২
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
‘তোমার মতো চরিত্রহীন মেয়ের,এই অভি শিকদারের বউ হওয়ার কোন যোগ্যতাই নেই। তোমার মতো তোমার ভালোবাসাও সস্তা! কি করে পারলে এতো নিঁখুতভাবে নাটক করতে?’
অনন্যার ছবির দিকে তাঁকিয়ে, একমনে কথাগুলো বিড়বিড়িয়ে যাচ্ছে অভি। বুকটা কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তার। তার সারা ঘর আজ অন্ধকার! নেই কোন সাজসজ্জা। অথচ আজ তার ঘর আলো করে, অনন্যার বধুরুপে আসার কথা ছিলো, তার ঘরও ফুলে ফুলে বাসরের সজ্জায় সজ্জিত হতো, অথচ সবকিছু নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো! কীকরে পারলো অনন্যা? এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা করতে? ছেলে মানুষ সহজে নাকি কাঁদে না। তাহলে আজ অভির আখিজোড়ায় কেন অশ্রুবিন্দু বিদ্যমান? বিষয়টা ভেবে অভির অদ্ভুদ লাগলো, হ্যা তার আখিজোড়া বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে,কারণ তার শখের নারী আজ তাকে সবথেকে বড় আঘাত উপহার স্বরুপ দিয়েছে। অভির দুনিয়া জুড়ে যেই রমনীর অস্তিত্ব বিরাজমান ছিলো,আজ সেই রমনী তাকে শূন্য করে দিয়েছে। ব্যাপারগুলো বেশকিছুক্ষন ভেবে তাচ্ছিল্যের হাসি হাঁসলো অভি।

_______
অনন্যা পিটপিট করে নিজের আখিজোড়া খুললো। মাথায় বেশ যন্ত্রনা হচ্ছে তার। আখিজোড়া খুলে তাঁকিয়ে,আশেপাশে পর্যবেক্ষন করে বুঝতে পারলো সে একটি অপরিচিত ফ্লাটে অবস্হান করছে। সে শুয়া থেকে আস্তে ধীরে উঠে, বিছানায় হেলান দিয়ে বসতেই, পাশের সোফায় সেই ফারিশ নামক নিকৃষ্ট যুবককে দেখে চমকে উঠলো! হ্যা ফারিশ তার কাছে বর্তমানে দুনিয়ার সবথেকে নিকৃষ্ট এবং ঘৃনিত ব্যাক্তি! ফারিশ সোফায় এক পায়ের উপর আরেক পা রেখে, আরামের সহিত বাম হাতে সিগারেট নিয়ে, অপরহাতে ফোন টিপছে। ফারিশকে দেখে অনন্যার কিছুক্ষন আগের কথা মনে পরলো, সে রাস্তায় যেই কালো গাড়িটিকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে, অজ্ঞান হয়ে পরেছিলো। তাহলে সেই কালো গাড়ির ফারিশ খানের ছিলো! আচ্ছা লোকটা তাকে এই নির্জন ফ্লাটে নিয়ে এসেছে কেন? কোনো কু মতলবে? নিজের দিকে ভালো করে তাঁকাতেই, স্বস্হির নি:শ্বাস ফেললো সে, গাঁয়ে এখনো সেই বিয়ের বেনারশি। অর্থাৎ লোকটি এখনো তার সাথে কোন খারাপ কিছু করেনি। অনন্যাকে দেখে ফারিশ বাঁকা হেসে, প্রশ্ন করলো, ‘ এতো দূর্বল আপনি? সামান্য একটা কারণে অজ্ঞান হয়ে গেলেন? এইভাবে চলতে থাকলে তো হবেনা। ইউ নো! আই টোটালি ডোন্ট লাইক দিজ টাইপ অফ ইউক গার্লস! এদের সাথে গেম খেলেও মজা নেই। ‘

ফারিশের গাঁ জ্বলানো কথা শুনে,ক্ষোভ নিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল অনন্যা। অত:পর ফারিশের সামনে থাকা টি টেবিলে সজোড়ে হাত দিয়ে শব্দ করে বললো, ‘ তার আগে আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দিন, কেন করছেন আপনি এইসব? আমি তো আপনাকে চিনতামও না,তাহলে ওই ফেইক ভিডিও কী করে করলেন আপনি? আজ আপনার জন্যে আমার আমার বিয়ে ভেঙ্গে গেলো। আমার বাবা আজ মৃত্যুপথযাত্রী। তার চিকিৎসা অব্দিও আমি করাতে পারছি না, কারণ আমাদের কম্পানি এখন আপনার। কেন করছেন আপনি আমাদের ক্ষতি? কিসের শত্রুতা আপনার?

বেশ খানিক্টা উত্তেজনার সহিত কথাগুলো একদমে বলে ফেলে অনন্যা। ফারিশ কোনরুপ বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে নিজের চশমা ঠিক করতে করতে শান্ত গলায় উত্তর দিলো,

‘ ফার্স্ট অফ অল! ভিডিওটি একদমই ফেইক না।আর সেকেন্ডলি ফারিশ খান কারো প্রশ্নের জবাব দিতে বাধয় নয়, অন্তুত আপনার প্রশ্নের তো নয়-ই ‘

ফারিশের এমন গাঁ ছাড়া কথা শুনে নিজেকে সামলাতে পারলো না অনন্যা। উত্তেজিত হয়ে, দ্বিগুন চিৎকারের সহিত বললো,

‘ জবাব দিতে বাধ্য নন?এর মানে কি? আপনি একটা মেয়ের সম্মান নিয়ে খেলবেন, তার পরিবারকে নিমিষের মধ্যেই রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দিবেন, অথচ জবাব দিতে পারবেন না? আপনাকে তো আজ জবাব দিতেই হবে, ফারিশ খান। ‘

ফারিশ এতোক্ষন শান্ত থাকলেও, এইবার সে নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না। মস্তিষ্কে এসে হানা দিলো ভয়ংকর ক্রোধ! এইটুকু মেয়ের কাছে কিনা ফারিশ খানকে জবাব দিতে হবে? যার ভয়ে গোটা বাড়ি থেকে শুরু করে, বড় বড় বিসনেজম্যানরাও কেঁপে উঠে, সে কিনা একটি মেয়েকে জবাব দিতে যাবে? ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর হলেও, রাগ হলো ফারিশের। সে এক পা -দু পা করে অনন্যার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। ফারিশকে হুট করে এগিয়ে যেতে দেখে, দ্রুত ভয়ে পিছাতে লাগলো অনন্যা। তার সামনে থাকা যুবকটিকে এই মুহুর্তে যথেষ্ট ভয়ংকর লাগছে অনন্যার। অনন্যা দেয়ালে সাথে ঠেকে গেলে, তাকে হেচকে টান দিয়ে নিজের কাছে টেনে আনে ফারিশ। ফারিশের এতোটা কাছে আসায় নি:শ্বাসের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে যায় অনন্যার। ফারিশ
খপ করে অনন্যার ডান হাতখানা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে বলতে থাকে,

‘ ফারিশ খানের সামনে উচ্চগলায় কথা বলার সাহস ভুলেও আর দেখাবেন না। আই টোলাটি ডোন্ট লাইক ইট গার্ল! ‘

বলেই নিজের জ্বলন্ত সিগারেটটি অনন্যার হাতের কব্জিতে দিয়ে, চেপে ধরে রাখে। জ্বলন্ত সিগারেটটি এইভাবে কোন মানুষ হাতের কব্জির সাথে চেপে ধরতে পারে, তা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি অনন্যা। অনন্যা ব্যাথায় কাতড়ে উঠে। আখিজোড়া থেকে টুপটুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পরছে তার। অনন্যা চাইলেও নিজের থেকে ফারিশকে সরাতে পারছে না। শক্তির তুলনায়, বিশালদেহী ফারিশের কাছে সে অতি নগন্য এক রমনী। অনন্যার এই ছটফট যেন বেশ তৃপ্তি দিচ্ছে ফারিশকে। সে বেশ কিছুক্ষন পরে, অনন্যাকে ছেড়ে দিয়ে, সিগারেটটি জানালা দিয়ে, বাইরে দিয়ে ছুড়ে ফেলে। অনন্যা হাতের কব্জি ধরে বসে পরে, পুড়ে গিয়ে ফোসকা পরে গেছে কব্জিতে। অনন্যা কাঁদতে কাঁদতে ফারিশের দিকে তাঁকায়।
‘এখন থেকে আমাকে কিছু বলার আগে নিজের হাতের দিকে তাঁকাবেন! ফারিশ খানের সামনে গলাবাজি করার পরিনতি কতটা ভয়ংকর। ‘

কথাটি বলেই আরাম করে ফের সোফায় বসে পরে ফারিশ , যেন কিছুই হয়নি। একটা মানুষ এতোটা নির্দয় কী করে হতে পারে? অনন্যা বুঝেছে লোকটার সাথে তর্ক করে লাভ নেই, তাকে আপাতত নিজের বাবাকে বাঁচাতে হবে চিকিৎসা করিয়ে। তাই সে ফারিশের মুখোমুখি বসে নিচু গলায় বলে, ‘ আমাদের কম্পানি কেন আপনি নিজের এক্সেসে নিয়েছেন? আমরা ব্যাংক থেকে ক্যাশটাও তুলতে পারছি না। এই মুহুর্তে আমার বাবার জীবন বাঁচাতে ক্যাশ টাকা গুলো বড্ড জরুরী। দয়া করুন! আমার বাবার চিকিৎসাটা খুবই দরকার। ‘

ফারিশ নিজের চোয়ালে হাত দিয়ে স্লাইড করতে করতে বলে, ‘ তাহলে আমি কী করতে পারি? মি: লতিফ হাওলাদার নিজ হাতে মোটা অংকের টাকার বিনময়ে তার কম্পানির ৮০℅ শেয়ার বিক্রি করেছেন। আমার কাছে যথেষ্ট ডকুমেন্ট রয়েছে। ‘

কথাটি বলেই, ফারিশ ড্রয়ার থেকে একটা ফাইল এনে, অনন্যার দিকে ছুড়ে দিলো। ফাইলগুলো দেখে মুখে হাত দিয়ে ফেললো অনন্যা। সত্যি পেপারগুলোতে তার বাবার সাইন জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু তার বাবা কেন তার সাধের কম্পানি বিক্রি করবে, তাও আবার ফারিশ খানের মতো জঘন্য লোকের কাছে। সব হিসাব গড়মিল হয়ে যাচ্ছে তার। ফারিশ খান নিশ্চই কোন কারসাজি করেছে, কিন্তু এখন এইসব ভাবার সময় নেই, তাকে যে করেই হোক টাকা জোগাড় করতে হবে। তার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ ফারিশ বলে উঠে,

‘ আমি জানি আপনি এখন আপনার বাবার চিকিৎসার টাকা জোগাড় করার কথা ভাবছেন। এই বিষয়ে আমি আপনাকে একটা হেল্প করতে পারি, মিস অনন্যা। ‘

ফারিশের কথা শুনে, চমকে উঠে অনন্যা। ফারিশ পকেটে হাত গুজে, অনন্যার আশে-পাশে ঘুড়তে ঘুড়তে বলে, ‘ আমি চাইলেই আপনাদের কম্পানি রিটার্ন দিতে পারি, কিন্তু একটা শর্তে! ‘

‘ কি শর্ত?’

অনন্যার পাল্টা প্রশ্নে ফারিশ বাঁকা হাসি দিয়ে, একটি কন্ট্রাক্ট পেপার অনন্যার দিকে এগিয়ে বলে,

‘ আজীবনের জন্যে আমার বাড়ির কাজের লোক হয়ে থাকতে হবে আপনাকে। আজীবন! ‘

ফারিশের শর্তে ভরকে যায় অনন্যা। অনন্যা হাওলাদার শেষে কিনা ফারিশ খানের মতো নিকৃষ্ট মানুষের বাড়ির কাজের লোক হবে? তাও সারাজীবনের জন্যে? কখনো না! অনন্যা ঘুড়ে দাঁড়িয়ে, হাতের উপর হাত ভাজ রেখে বললো, ‘ হাও ডেয়ার ইউ টু টক মি লাইক দিজ! আমি কিনা আপনার বাড়ির কাজের লোক হবো? শুনে রাখুন মি: ফারিশ খান! মেয়েরা কোন পন্য নয়,যাকে আপনি কিনে ফেলবেন। দরকার নেই আপনার সাহায্যের। আমি নিজেই টাকা জোগাড় করে, আমার বাবার চিকিৎসা করাবো। ‘

কথাটি বলেই অনন্যা কন্ট্রাক্ট পেপারটি ফারিশের হাতে ধরিয়ে দিয়ে, হনহনিয়ে ফারিশের ফ্লাট থেকে বেড়িয়ে যায়। সদর দরজার দিকে তাঁকিয়ে, ফের বাঁকা হাসে ফারিশ। সে জানে আজ না হয় কাল, তার সদর দরজাতেই ফিরে আসতে হবে মিস অনন্যা তালুকদারকে। ফারিশ কন্ট্রাক্ট পেপারটির দিকে তাকিয়ে তাঁকিয়ে বলে,

‘ দ্যা গেইম হেজ অলরেডি স্টার্টেড। ‘

___________________
অপরদিকে কাউকে কিছু না বলে, বাড়ি থেকে বেড়িয়ে নিজের চেম্বারে চলে আসে অভি। বেশ বড় একজন উকিল সে। যখন সে নি:সঙ্গতা অনুভব করে, তখন সে নিজের চেম্বারে এসে পরে। নিজের ঘরে সে থাকতে পারছিলো না, তাই উপায় না পেয়ে সে চেম্বারে চলে এলো। তখনি সেখানে জুঁই এর আবির্ভাব হয়। জুঁই সম্পর্কে অনন্যার একজন ভালো বন্ধু এবং ক্লাসমেট। অনন্যার সাথে অভির সম্পর্ক থাকাকালীন সে অভিরও যথেষ্ট ভালো বন্ধু হয়ে উঠে। সে অভির বাড়িতে গিয়ে, অভিকে না পেয়ে চেম্বারে চলে এসেছে। সে জানে অভির যা মনের অবস্হা, তাতে অভিকে তার চেম্বারেই পাওয়া যাবে। জুঁই এগিয়ে এসে, অভির কাঁধে হাত রেখে বলে,

‘ অভি! শুনছো? আমি জুঁই। ‘

অভি মাথা নুইয়ে ছিলো, জুঁইকে দেখে বলে ‘ তুমি এখানে হঠাৎ? ‘

_________________

অপরদিকে অনন্যা ভাবছে এই মুহুর্তে সে কি করবে? সে কিছুতেই ওই নিকৃষ্ট লোকের কাছে মাথা নত করবে না, অন্যদিকে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। রাতের মধ্যে তাকে টাকা জমা দিতে হবে, নাহলে তার বাবার চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এতো কম সময়ে, এতো টাকা সে কী করে জোগাড় করবে? তখনি তার হুট করে অভির কথা মনে পরে। এই বিপদের সময় নিশ্চই তার অভি তাকে ফিরিয়ে দিবে না,যতই অবিশ্বাস করুক না কেন। অনন্যার অভির বাড়ির একজন কাজের লোককে ফোন দিয়ে, খবর পায় অভি তার চেম্বারে। তাই সে সময় নষ্ট না করে, অভির চেম্বারের দিকে রওনা দেয়। অভির চেম্বারে গিয়ে, হঠাৎ সে থমকে দাঁড়ায়।

চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে