পিয়ানোর সুর
#২য়পর্ব
মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেল। বারান্দার দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়েছিলাম। আজ বিছানা করেছি দরজা বরাবর। নানা নানুর রুমে এসি লাগানো নেই। ওনারা বয়স্ক মানুষ এসির বাতাস সহ্য করতে পারেন না। বাকি সব বেড রুমে এসি আছে। এমন কী গেস্ট রুমেও। কেন জানি গেস্ট রুম আমার জন্য বরাদ্দ হয়নি। হবে হয়তো কোনো কারণ। গ্রামের মেয়ে হলেও আমাদের বাড়ীতে সবার ঘরে একটি দুটি করে এসি আছে। পারিবারিক দিক দিয়ে সবাই যথেষ্ট স্বচ্ছল। কিন্তু এই শহুরে জীবনের তুলনায় আমরা নিতান্তই সাধারণ মানুষের গ্রাম্য জীবন কাটাই। রুচিতে আধুনিক হলেও পোশাক পরিচ্ছদে একেবারে গ্রামীন ফ্যাশন ফলো করি। আহামরি কিছু না। টানা বৃষ্টি হলেও ভ্যাপসা গরম পড়েছে খুব। সেজন্য বারান্দার দরজার কাছেই বিছানা পেতেছি যেন বৃষ্টির শীতলতা পাই। কে জানতো যে সেই বৃষ্টির ছাঁটেই ঘুম ভেঙে যাবে। এমনিতেই সৌরের আচরণে মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিলাম। ঘুমোতে বেশ কষ্ট হয়েছে। আর এই এখন মধ্য রাতের ঝড়োবৃষ্টি দিল ঘুমের বারোটা বাজিয়ে। শিথানে রাখা মোবাইলে সময় দেখলাম রাত আড়াইটা বাজে। নাহ বিছানা ভিজে যাচ্ছে। পরে মামী বকতে পারে। ওনার এত দামি ম্যাট্রেস ভিজে গেলে কী বলে বসে কে জানে। উঠে বিছানা টেনে সরালাম। নানা নানু বেঘোরে ঘুমুচ্ছেন। একবার ঘুম ভাঙলে সহজে আমার ঘুম আসে না। বারান্দায় বের হয়ে এলাম। বেতের সোফাগুলো ঘুমোবার আগে প্ল্যাস্টিক পেপারে মুড়ে রেখেছিলেন বড়মামা। সরাই যদি ভিজে যাবে। বৃষ্টির ছাটে ভিজতে ভিজতে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়ালাম। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কুকুর ডাকছে। এমন বৃষ্টির রাতেও কুকুর ডাকে, আশ্চর্য! হয়তো ভিজছে কোথাও অবলা প্রাণী। হটাৎ পাশের বারান্দার আলো জ্বলে উঠলো। বারান্দার দরজা খুলে কেউ বের হচ্ছে বুঝতে পেরে একছুটে ঘরে এলাম। এত রাতে একটি মেয়ে বারান্দায় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে অঝোরে কাঁদছে কেউ দেখুক মোটেও চাই না। হুট করে আলো নিভে গেল। কয়েক মিনিট অপেক্ষার পরেও জ্বলছে না। তারমানে কেউ কোনো প্রয়োজনে এসছিল আবার চলে গিয়েছে। নিশ্চয়ই সে সৌর নয়। আচ্ছা আমি সৌরভকে সৌর সৌর করছি কেন! কারো নাম বিকৃতি খুব অপছন্দ করি। অথচ আমিই…
একটু পরেই আবার বারান্দায় বের হয়ে এলাম। বৃষ্টি কমে এসেছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মেঘ ডাকছে। অমানিশা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আমি আমার ভাগ্যকে দুর্ভাগায় পরিণত হওয়া উপলব্ধি করতে করতে ক্লান্ত ভীষণ।
— মিথি রাগ কমেছে?
এই ভৌতিক অন্ধকারে পাশের বারান্দা থেকে সৌরভের ভরাট অথচ শান্ত ধীর কন্ঠ শুনে সত্যিই ভয় পেলাম। কাঁপা কাঁপা অনুভূতি নিয়ে তাকিয়ে দেখি সেই আবছায়া অবয়ব। সৌরভকে চিনতে দেরি হলো না। কাঁপুনি যেন বাড়লো আরও। মনে হলো উনি এখুনি আমায় ধরে ফেলবেন। যদিও তা অসম্ভব।
— কী হলো মিথি কথা বলছেন না? বাব্বাহ এত রাগ!
এবারও নিরুত্তর আমি। কী জবাব দেবো! অচেনা এক মানুষের ওপর রাগ কেন হবে! হওয়া অনুচিত। ওনাকে বলতে পারছি না সেকথা। চুপ করে মুখ ঘুরিয়ে আগের মতই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি দেখছি।
— গত সন্ধ্যায় আমার প্রেমিকার ওয়েডিং রিসিপশন ছিল মিথি। তেরো বছরের প্রেম, সাত বছরের লিভ ইন রিলেশনশীপ ছিল আমার আর টিনার। ফিরেই বিয়ে হবার কথা ছিল আমাদের। সময়মত ফিরতে পারিনি বলে ব্রেক আপ হয়েছিল। ফিরবো না শুনে সে জেদ করে এক্সট্রা রিলেশনশীপ এ্যাফেয়ারে জড়ালো। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো খুব। প্রেম কী এতই ঠুনকো! দূরত্বে শেষ হয়ে যায় বলুন? ভেবেছিলাম টিনা ফান করছে। গত সন্ধ্যায় সেই ভ্রম ভাঙলো। মনটা দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল। পিয়ানোর সুর শুনে যা অনুভব করেছিলেন আপনি। সত্য ছিল। এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আপনার রিএকশন সারপ্রাইজড করলো আমাকে। রেগে যাবেন ভাবিনি। সরি!
সৌরভের কথা শুনতে শুনতে আমি যে হাপুসনয়নে কাঁদছি এই ভদ্রলোক জানতে পারলে সারপ্রাইজড হওয়া বাদ দিয়ে না হার্টফেল করে। আমরা বাঙালী। কারো একটু দুঃখের কথা শুনলেই চোখে পানি এসে যায়। আর এটা তো রীতিমতো সম্পর্ক ভাঙার গল্প! কীভাবে বোঝাই ওনার কষ্টে আমি এ্যাম্প্যাথেটিক হয়ে পড়েছি। ভিজে একাকার অবস্থায় ওনার সামনা-সামনি যেতে পারছি না। জোরে কথা বললে নানুমণি শুনে ফেলবেন হয়তো। কী করবো বুঝতে না পেরে শেষে বারান্দা থেকে রুমে চলে আসার জন্য ঘুরতেই সৌর বললো,
— সরি একসেপ্ট্যাবল হোলো না মিথি? আলো জ্বেলেছিলাম আপনাকে একনজর দেখবো বলে। আপনি রীতিমতো কথাই বন্ধ করে দিলেন। অচেনা মানুষের ওপর অভিমান করতে নেই মিথি। এতটা আবেগীয় হলে জীবন আপনাকে ঠকাবে। ব্যালেন্স করতে শিখুন।
আমি আর একমুহূর্তও দাঁড়ানোর অবস্থায় নেই। কান্না শব্দ তুলবে। দ্রুত পায়ে রুমে এলাম।
.
টানা পাঁচদিন আর বারান্দা মুখো হইনি। এর দুটো কারণ প্রথমত, প্রতিদিন সন্ধ্যায় সৌর বারান্দায় সময় কাটাতো। যেটা আগে করতে দেখিনি। ব্যাপারটি বেশ ভাবায় আমাকে। দ্বিতীয়ত, এই পাঁচদিন সৌর পিয়ানোয় সুর তোলেনি। এটাই মেইন কারণ। পিয়ানো শোনা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। পাঁচটা দিন শুনি না। এই শহরে থাকার ইচ্ছেটাই বুঝি মরে শেষ। সকাল থেকে কেমন নাকি সুরে কান্নার আওয়াজ তোলার মত বৃষ্টি নেমেছে। এই বৃষ্টি খুব বিরক্তিকর। ভ্যাপসা গুমোট। গরম বাড়ে এতে। এমুহূর্তে সবাই নাশতার টেবিলে। সবার সাথে একসাথে নাশতার টেবিলে বসা ইন্ডাইরেক্টলি নিষেধ আমার জন্য। ষোলো চেয়ারের ডাইনিং টেবিলে আমার বসার জায়গা হয় না। মামা মামী, নানা নানু, কাজিনরা প্রায় একসঙ্গে খেতে বসে। ফ্যামিলি মেম্বার ওরা। হুট করে আসা অতিথির খাবার আলাদাভাবে পরিবেশন হয়। বড়মামী এসে নাশতার প্লেট দিয়ে গিয়েছেন। দুই পিস পরোটা, ছোট্ট স্যুপের বাটিতে করে গরুর পায়ার নেহারি। ও হ্যাঁ বলতে ভুলে গিয়েছি, এই পাঁচদিনের ভেতর একদিন কুরবানির ঈদ ছিল। সব মামারাই ব্যক্তিগত ভাবে আলাদা আলাদা গরু কুরবানী দিয়েছেন। যার যার ঘরে কুরবানির গোশত রান্না হচ্ছে। যদিও খাচ্ছেন সবাই একসঙ্গে। কিন্তু অতিথি আপ্যায়ন হচ্ছে ভিন্নভাবে। মামারা নিজেদের শ্বশুরবাড়ির মেহমানদের নিজেরা দেখভাল করছেন। কারো ওপর কারো মেহমানের খাতিরযত্নের দায়ভার নেই। কাজিনরাও ওদের ফ্রেন্ডদের নিয়ে বেশ উৎফুল্ল সময় কাটাচ্ছে ঈদ আমেজে। এ বাড়ীতে ওদের আরও একজন কাজিন যে এসেছে তা নিয়ে কারো আগ্রহ নেই। গ্রাম্য মেয়ের ওদের সাথে তাল মিলিয়ে চলার সাধ্য আছে নাকি। আমি মনেমনে হাসি। কষ্ট যে পাই না তা না। পাই। কী এসে যায় তাতে।
— কীরে মেথি খাসনি এখনও!
— ছোটমামা মেথি না মিথি।
— ঐ হোলো। তোর নাম আমি বন্যা রাখতে চেয়েছিলাম বুঝলি। বন্যার সময় জন্মেছিস কিনা তাই। তোর বাপে রাখলো মিথি! হাহ এই নামের অর্থ কী খোদায় জানে। নে খাওয়া শুরু কর বিসমিল্লাহ বল।
— তুমি এখানে খাবার নিয়ে এসেছো যে!
— তোর সাথে খাবো।
— সবাইকে ফেলে..
— কথা বাড়াসনে, চুপচাপ খা। না মানে আমার সাথে প্যাঁচাল পারতে পারিস চাইলে। নে হা কর তো মা..
— তুমি আমায় খাইয়ে দেবে ছোট মামা!!
— হা কর না বাপ! খেতে খেতে কথা বলা যায়।
অগত্যা চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে হা করতেই ছোটো মামা খুব যত্ন করে মুখে পরোটার সাথে গোশত ভাজা পুরে দিলেন। এই আইটেমটা আমাকে দেয়া হয়নি। ছোট মামার ট্রেতে নানান পদের বাহারি নাশতা। এতটা আমার জন্য আসে না কখনো। আসছি অবধি পরোটা বা রুটির সাথে যে কোনো একটা পদ দিয়েই প্রতিদিন নাশতা করি। অথচ হরেকরকমের পদ দিয়ে ঠাসা থাকে ডাইনিং টেবিল সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার, রাতের খাবার, বিকেলের জলখাবারে। দেখি, বুঝি সবই। যা বোঝার নয় তাও বুঝিয়ে দেয়া হয়। পারিবারিক সম্পর্কে নিয়মিত আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় না রাখা, যোগাযোগ না থাকার খেসারত টানছি আমি।
…
চলবে……