পরিণতি পর্ব-৪
লেখক:জান্নাতুল ফেরদৌস মীম
সেদিন হতাশ হয়ে রিয়ান পিছিয়ে গিয়েছিলো।তবে মোহনা নামের মেয়েটিকে রিয়ান ভুলতে পারে নি। রিয়ান যে কাজই করতো মোহনাকে তার মনে পড়তো।একদিন স্কুলের ক্লাসে মেহজান কে নিয়ে, মোহনাকে আসতে না দেখলে রিয়ান অস্থির হয়ে যেতো।তখনি সে বুঝতে পারে এটা শুধু তার ভালোলাগা না। তার থেকে বেশি কিছু। একদিন রাতে রিয়ান ঘুমানোর সময়ও মোহনা কে নিয়ে ভাবতে থাকে।চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় পাতলা গড়নের একটা মেয়ে চুল গুলো খোপা করে সামনের দিকে কিছু চুল গালের উপর পরে আছে। বাচ্চা একটি মেয়েকে নিয়ে স্কুলের ভিতর ঢুকছে। মোহনাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই একটা সময় রিয়ানের মাথায় এলো, মোহনার হাজবেন্ড কে কোনদিন স্কুলে আসতে দেখে নি।মেহজানের সাথে অনেক কথা হয়েছে তার। তবে, মেহজানের মুখে কোনদিন বাবার নাম শুনে নি। সব সময় তাকে নিতে তার মা আর নানু এসেছে, এছাড়া অন্য কেউ না।রিয়ানের কিছু একটা ঝামেলা লাগলো।কেন জানি মনে হলো কোন একটা কাহিনী আছে এখানে।এসব কিছু চিন্তা করে সেদিন রাতে রিয়ান আর ঘুমাতে পারে নি। সকালে স্কুলে আগেই চলে গেলো। গেইট দিয়ে দেখা গেল, মোহনা মেহজান কে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে।মেহজান আসার সময় রিয়ান গিয়ে মেহজান কে দুইটা চকলেট দিয়ে বললো, যাও মামোনি ক্লাসে যাও।মেহজান চলে যাচ্ছিলো তখন আবারো মেহজানকে ডাক দিলো রিয়ান।কাছে গিয়ে বললো, স্কুল ছুটি হলে তোমার নানু নিতে আসলে একটু অপেক্ষা করো আমার জন্য। তোমার নানুর সাথে পরিচিত হবো।মেহজান আবারো হেসে বললো,’ আচ্ছা।’হাসার সময় মেহজানের সামনের দাঁতদুটো পড়ে যাওয়ার ফলে তাকে অদ্ভুদ সুন্দর লাগছিলো।ফলে রিয়ানও হালকা একটা হাসি দেয়।মেহজান ক্লাসে চলে যায়।
স্কুল ছুটি হলে রিয়ান আগে থেকেই গেইট এর কাছে গিয়ে দাড়িয়ে ছিলো।বীনা আহমেদ কে ঢুকতে দেখে বললো,
-আসসালামু আলাইকুম।আপনি মনে হয় মেহজান এর নানু?
-ওয়ালাইকুম সালাম।
জ্বি বাবা।তবে তুমি?
-আমি এই স্কুলেরই টিচার।
আমার নাম রিয়ান।
-ওও..,কিছু বলবে আমাকে?
-না তেমন কিছু না।এমনি পরিচিত হলাম।আসলে মেহজান কে দেখি তো সব সময় আপনি নিতে আসেন তাই কথা বলতে আসলাম আজ।
– হ্যাঁ, আসলে ওর মা-ই প্রতিদিন দিয়ে যায় স্কুলে।দুপুরে মেয়েটা অফিসে থাকে। তাই আমি নিতে আসি।
– ওর বাবা কে তো কখনো দেখলাম না। উনি কি বাহিরে কোথাও থাকেন?
কথাটা শুনার সাথে সাথে বীনা আহমেদ এর মুখটা শুকনো হয়ে যায়।একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলেন, মেহজান এর বাবা নেই।মেহজানের জন্মের এক বছরের মাথায় তার বাবা মারা যায়।
এমন কিছু শুনার জন্য রিয়ান প্রস্তুত ছিলো না। মেয়েটির বাবা নেই কথাটা শুনে কেন জানি খুব খারাপ লাগলো ওর। এর পর কিছুক্ষন দুজনেই নিরব ছিলো। এর মাঝেই মেহজান চলে আসে। বীনা আহমেদই বলেন,
-আজ তাহলে আসি বাবা। পরে আবার কথা হবে। এই বলে চলে যায় তারা। রিয়ানও বাসায় চলে আসে।
কোন এক আশার আলো পাবে বলেই আজ কথা বলতে গিয়েছিলো মোহনার মায়ের সাথে। আলোটা পেয়েছেও রিয়ান।মোহনার হাজবেন্ড নেই এতে কি তার খুশি হওয়ার কথা ছিলো?তবে সে তো খুশি হতে পারছে না। ওইটুকু একটা বাচ্চা মেয়ে বাবা ছাড়া মানুষ হয়েছে। মোহনা একা সংসারটা চালাচ্ছে। পরে আর বিয়ে করে নি। এখনকার দিনে তো আজ স্বামী মারা গেলে কিছুদিন শোক তারপরই আবার স্ত্রীরা বিয়ে করে। পুরুষদের ক্ষেত্রেও এমনটাই হচ্ছে। যুগটাই পাল্টে গেছে। তবে এমন সময়েও মোহনা এতগুলো বছর ধরে একা, মা আর মেয়েকে নিয়ে আছে। ভাবতেই কেমন একটা কষ্ট হচ্ছে রিয়ানের।
সেই সাথে এক ধরনের অদ্ভুত অনুভুতিও হচ্ছে। মোহনার প্রতি তার ভালোলাগাটা আরো অনেকগুন বেড়ে গেছে। কেন যেন তার মনে হচ্ছে তাকে মোহনার পাশে চাই।মোহনার হাত ধরে অনেকটা পথ যেতে ইচ্ছে করছে।
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে মেহজানকে তুলতে গিয়ে মোহনা লক্ষ করলো মেয়ের শরীরের উত্তাপ। মেহজানের জ্বর হয়েছে।মোহনা উঠে মেয়ের মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিলো। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলো। জ্বরের কারণে স্কুলে যায়নি আজ। মোহনা মেয়েকে মায়ের কাছে রেখে অফিসে চলে গেলো। বস কে বলে দুদিনের ছুটি নিয়ে দুপুরেই বাসায় চলে এলো।
এদিকে মেহজানকে স্কুলে আসতে না দেখে রিয়ানের কেমন অস্থির লাগতে লাগলো। বাসায় গিয়েও কোন কাজে মন বসছিলো না। রাতে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে লাগলো। স্কুলের স্টুডেন্ট এর ডিটেইলস থেকে অভিভাবকের জায়গায় মোহনার ফোন নাম্বার ছিলো, সেটা রিয়ান কিছুদিন আগেই জোগাড় করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলো। কোন দিন ফোন দেয়নি সে মোহনাকে। ফোন দিয়ে কি বলবে ? এটা ভেবেই ফোন দেয়নি । তবে এখন খুব ইচ্ছে করছে ফোন দিতে। কিন্তু, এতো রাতে ফোন দিয়ে বলবেই বা কি? তাই আর কল করলো না। এভাবেই শুয়ে ঘুমিয়ে গেলো কিছুক্ষন পর।
পরদিন সকালেও স্কুলে গিয়ে রিয়ান মেহজানকে দেখতে পেলো না। কোনরকমে ক্লাস শেষ করে বাসায় চলে এলো। ফ্রেস হয়েই মোহনার নাম্বারে কল দিলো।
ওপাশ থেকে…
-হ্যালো
-জ্বি আমি রিয়ান বলছিলাম।মেহজান এর স্কুলের টিচার।আপনার সাথে কথা হয়েছিলো আমার।
রিয়ানের ফোন পেয়ে মোহনা একটু অবাক হয়েছিলো।পর মুহুর্তেই আবার বললো,
-জ্বি চিনতে পেরেছি।কিন্তু আপনি হঠাৎ?
-আসলে মেহজান দুদিন হলো স্কুলে আসছে না তো তাই।
-মেহজানের একটু জ্বর হয়েছে সেজন্যই স্কুলে যেতে পারছে না।
-সেকি! এখন কেমন আছে?জ্বর কি বেশি?
-হ্যা জ্বরটা বাড়তেছে আবার কমতেছে।
রিয়ান কি বলবে বুঝতে পারলো না। এমন পরিস্থিতিতে কি বলতে হয় ওর জানা নেই। তাই বললো,
-আচ্ছা আমি তাহলে এখন রাখি,ওর খেয়াল রাখবেন।
-জ্বি আচ্ছা।আর খোঁজ নেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মোহনা আর কিছু না বলে ফোনটা কেটে দিলো।
ফোনটা রাখার পর মোহনা খেয়াল করলো এই ছেলেটা ইদানিং তাদের বেশিই খোঁজ খবর রাখছে। কিন্তু কেনো?
কিছুক্ষনের জন্য আনমনে হয়ে গিয়েছিলো মোহনা। তারপর আবার মেয়েকে স্যুপ খাওয়াতে লাগলো। মোহনা মেহজানকে বললো,
-আম্মু, তুমি রিয়ান টিচারের থেকে একটু দূরে দূরে থাকবে।
-কিন্তু কেনো আম্মু ? টিচারতো আমাকে অনেক আদর করেন।চকলেট দেন, তোমার আর নানুর কথা জিঙ্গেস করেন।
এ কথার পর মোহনা মেয়েকে আর কিছু বললেন না। কি করে বলবেন, তার মেয়েটাকে নিয়ে যে তার খুব ভয়। তার সমস্তটা জুড়ে আছে মেহজান। সব সময় মনে হয় তার মেয়ের জীবনটা যাতে তার মতো না হয়। তাই তো সব সময় চোখে চোখে রাখে মেয়েকে। সমস্তটা দিয়ে আগলে রাখে।
চলবে….