#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-২৪
#মিফতা_তিমু
বাড়ির পথে হাঁটা ধরেছে শাওমি। মনটা কেমন ভারাক্রান্ত। রোজ স্কুল আসছে যাচ্ছে অথচ তার কোনো বন্ধু নেই। থাকবেও বা কি করে ? তার মতো মানুষ যার পিছনে চব্বিশ ঘন্টা এক গোমড়া মুখো কালো পোশাক পরিহিত দেহরক্ষী ঘুরে বেড়ায় তাকে দেখে কেইবা বন্ধুত্ব করতে চাইবে। লোকটার গম্ভীর মুখ দেখে এমনিতেই তো সকলে ঘাবড়ে পালিয়ে যায়। সেখানে ওর সঙ্গে কেউ যেচে পড়ে কথা বলতে আসবে এটা ভাবাই তো বিলাসিতা।
শাওমি তার আবজির(বাবা) কাজে যার পরনাই বিরক্ত। মানুষটা কেন এমন করে ? কেনই বা অত ছোট বয়সে ওর অন্নিকে(বড় বোন) ওই দূর দেশে পাঠিয়ে দিল আর কেনই বা এখন ওর পিছনে গার্ড দিয়ে রেখেছে ? এসবে নিয়মে বাধা ধরা জীবনে সে বিরক্ত। উঠতে বসতে ডিসিপ্লিন মেনে চলতে হয়। কোনোকিছু শখ করে খেতে চাইলে আগে মাপচোক করবে যে সেটা ওর শরীরে কত ক্যালোরি গেইন করবে তারপর ইচ্ছা হলে খেতে দিবে নইলে নয়।
উঠতে বসতে খালি নিয়ম আর নিয়ম। ওদের দুই বোনের জীবনটা তো নিয়মের শেকলেই বাধা পড়ে আছে। মোতালেব সাহেব এই সুদূর কোরিয়ায় বসে থেকেও যখনই ঝুমুরকে ফোন করেন তখনই নিয়ম মেনে চলার উপর স্বল্প বাক্যে কিছু ভাষণ দিয়ে শোনান। শাওমি ভেবে পায়না কেন অমনি চলে গিয়ে তাদের এই সোনার খাঁচায় আটকে দিল। ওর অন্নি তো তাও দূর দেশে কিন্তু সে তো চব্বিশ ঘণ্টা আবজির সামনেই আছে। যখনই দেখা হচ্ছে তখনই তিনি পড়াশোনায় টপ করা আর নিয়ম মেনে জীবন অতিবাহিত করার পিছনে এক গাদা ভাষণ দিচ্ছেন। আর ছোট শাওমিও তার আবজিকে খুশি করতে গিয়ে হাপিয়ে উঠছে।
তবুও যদি মানুষটা ওর সঙ্গে দুদন্ড হাসিমুখে কথা বলত। কিন্তু এক জীবনে কি আর সব ইচ্ছে পূরণ হয় ? তাইতো যবে থেকে জ্ঞান হয়েছে তবে থেকে কখনও আবজিকে হাসিমুখে হেসে দুটো কথা বলতে দেখেনি। হয়তো এই তার নিয়তি। তবে এই গদবাধা জীবনে শাওমি অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
তাইতো রোজ সকালে উঠে নিত্য দিনের একই ডায়েট চার্ট মেনে ব্রেকফাস্ট করা তারপর রেডি হয়ে আবজির প্রিয় জেনেসিস জি নাইন্টি কারে করে স্কুল যাওয়া তার রোজকার রুটিন হয়ে গেছে।
তবুও যদি আবজি গাড়িতে বসে কোনো কথা বলত। কিন্তু সে তো সেখানেও ব্যস্ত মানুষ। পড়াশোনা নিয়ে রোজ শাওমিকে ধরাবাঁধা কিছু কথা বলবেন তারপর নিজের মতো ডেইলি স্টার পড়তে ব্যস্ত হয়ে যাবেন। অথচ এই কথাগুলো তিনি ব্রেকফাস্টে বসেও বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা বলবেন না কারণ ব্রেকফাস্ট টেবিলে তিনি আবার পিন ড্রপ সাইলেন্স পছন্দ করেন কিনা।
ওর জীবনটাই নিয়মের শেকলে বাঁধা পড়ে গেছে। রোজ স্কুলে যাওয়া, সেখানে ক্লাস শেষে টিউটরের কাছে পড়া তারপর সেসব সেরে বাড়ি ফিরে ফিক্সড নিউট্রিশন ইনটেক করতে না করতেই আবার পিয়ানো ক্লাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাওয়া। তার উপর সপ্তাহে তিনদিন সুইমিং ক্লাস তো আছেই। সব মরার উপর খাড়ার ঘা।
এসবে অভ্যস্ত শাওমি মাঝে মাঝে এটা ভেবে খুশি হয় যে এত কঠিন নিয়মে বাধা পড়া জীবন অন্তত ওর অন্নিকে কাটাতে হচ্ছে না। ঝুমুরের সঙ্গে ওর প্রায়ই কথা হয়। প্রায়ই ঝুমুর তার সামনে নিঃশব্দে অশ্রু ফেলে একবার কোরিয়া যেতে পারার অভিলাষ জাহির করে। কিন্তু ঝুমুরের এই অভিলাষের কথা তাদের আবজির কানে উঠা মাত্র সঙ্গে সঙ্গে তিনি না করে দেন। তার কথা হলো ঝুমুর ওই দেশে আছে, পড়াশোনা করছে সেটাই করুক। তার প্রয়োজন নেই শুধু কারণে এই দেশে আসার।
অথচ মানুষ যে আপনজনকে দেখতেই সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে দূর দেশে যায় সেটা আর তিনি বোঝেন না। শাওমি এসবে অভ্যস্ত তবুও ওর খারাপ লাগে। বোনটাকে কতদিন দেখেনা। এই দশ বছরে মাত্র নাকি দুবার এসেছে। যদিও ওর জ্ঞান হওয়ার পরে একবারই দেখেছে কিন্তু ও যখন আরও ছোট ছিল তখন আরও একবার এসেছিল।
এসব অতিরিক্ত নিয়ম কানুনে অভ্যস্ত শাওমি তবুও মাঝে মাঝে মনের সুখ মিটিয়ে কাদে হালমনির(দাদু) কোলে মাথা রেখে। বিলাপ করে আজ তার অমনি থাকলে এসব হতো না। দুই বোন এমন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো থাকতো না। তখন মৃণালিনী বেগম কিছু চাইলেও বলতে পারেন না। নাতনীদের চোখের পানি দেখতে তারও কষ্ট হয় কিন্তু ছেলের জেদের কাছে হেরে যান তিনি।
শাওমি যেমন বাবার খুশির জন্য সব করতে পারে তেমনি নিজের খুশির জন্য মাঝে মাঝে বাবার অবাধ্যও হতে পারে। যেমন আজ হয়েছে। আজ সে গাড়ি ছেড়ে পথে নেমে এসেছে। পণ করেছে বড়লোকি ওই গাড়িতে চড়ে আজ বাড়ি ফিরবে না। নিজ পায়ে হেঁটে মনের অভিলাষ মিটিয়ে চারদিকে মানুষ দেখতে দেখতে ফিরবে। এর জন্য যা হয় হোক। আবজি বকবে ? বকলে বকুক, শাওমির কিছু করার নেই।
কিন্তু এখানেও শান্তি নেই। ওই হাড়িমুখো সম্পূর্ণ কালো পোশাকে সজ্জিত দেহরক্ষী লোকটা ঠিকই তার পিছু নিয়েছে। শুধু এই নয়, ওর আগেপিছে অন্য সময় তো আরো লোক থাকে। আজ যে কোন সুখে আবজি মাত্র একজন রাখলেন কে জানে। শাওমি পিছনে ফিরে একবার লোকটাকে দেখলো। সেই রোজকার একই রকম সাজধাজ। রোজ যেমন আপাদমস্তক কালো জামা কাপড়ে সাজে আজও তাই। কোটের বা পাশটায় পরিষ্কার কোরিয়ান ভাষায় লেখা ইউ সং।
শাওমি জানে ওই লোকের নাম ইউ সং। এ নতুন কিছুই না। বরং লোকটা যে এখনও ওকে কিছু বলেনি এই বিস্ময়কর ব্যাপার। এতক্ষণে তো বলে ফেলার কথা। অবশ্য শাওমির কথা ফলতে বেশিক্ষন লাগলো না। সঙ্গে সঙ্গেই ইউ সং বলে উঠলো ‘ ম্যাডাম আমাদের দ্রুত যাওয়া উচিত। স্যার আজ বাড়িতেই আছেন। জরুরী মিটিং আছে উনার। ‘
বিরক্ত শাওমি আর উপায় না পেয়ে গাড়িতে উঠে গেলো। এমনিতেও এখনো অনেকটা পথ যাওয়া বাকি।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওল। এরই দক্ষিণাংশে প্রসিদ্ধ এক শহর গোয়ানচিওন-রো। গোয়ানচিওন-রো এর সবথেকে আধুনিক মনন আর উন্নত মানের বিরাট বিলাসবহুল বাড়ি ‘ Mrinalini Mansion ‘। এই ম্যানশনের ধর্তা কর্তা মোতালেব সাহেব কোরিয়ারই বিখ্যাত ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ব্যবসায়ী। কোরিয়ায় তার ভীষন প্রতাপ প্রতিপত্তি। শুধু কোরিয়াই নয়, বাংলাদেশেও আছে তার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। নিজের বুদ্ধি ও দক্ষতার জোরে বাবার ডুবন্ত ব্যবসাকে শূন্য থেকে শুরু করে আজ এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন যে এর জন্য তাকে আজ উপরের মহলের মানুষরাও সমীহ করে চলেন।
সোসাইটিতে তার বেশ সুনাম আছে। সকলের মধ্যমণি তিনি। তার মেয়েরা একেকজন মেধাবী, তুখোড় ছাত্রী। তিনি নিজেও যে ছাত্র জীবনে তুখোড় মেধাবী ছিলেন সেই কথাও আশেপাশে সকলের মুখে বেশ ভালই শুনতে পাওয়া যায়। তার এই এত সম্মান, প্রতিপত্তি, অর্থবিত্ত সবই তো তার নিয়ম বাধা জীবনের ফল। ডিসিপ্লিন মেইনটেইন না করলে কখনও এসব অর্জন করতে পারতেন না। তার স্বগতোক্তি ‘ discipline is the main rule of success ‘। ঠিক এই কারণেই মেয়েদেরও তিনি এই পথেই চালনা করতে চান।
লিভিং রুমেই বসেছিলেন মোতালেব সাহেব। মেয়েকে দেখা মাত্র অসন্তোষ গলায় শক্ত চোখ মুখে বললেন ‘ এত সময় লাগার কারণ ? তুমি গাড়িতে ফেরনি ? ‘
ভীত শাওমি মোতালেব সাহেবের গম্ভীর চোখ মুখ দেখে ভয়ে কুকড়ে গেলো। ভয়ে মাথা নামিয়ে নিলো। ওকে চুপ করে যেতে দেখে মোতালেব সাহেব ইউ সংকে সুধালেন ‘ কি ব্যাপার ইউ সং ? গাড়িতে ফেরোনি তোমরা ? ‘
শাওমি তখন ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করছিল ইউ সংয়ের উত্তর শোনার জন্য। ওর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ইউ সং গলা ঝেড়ে বললো ‘ আমরা গাড়িতেই ফিরেছি স্যার। আসলে মাঝপথে গাড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই মেকানিক দিয়ে গাড়ি সারিয়ে ফিরতে হয়েছে। ‘
আর কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শোনার প্রয়োজন মনে করলেন না মোতালেব সাহেব। ইউ সংকে বিশ্বাস করেন তিনি। সে মিথ্যা কথা বলার মানুষ না। তাই উনি শাওমিকে খেয়ে পিয়ানো ক্লাসের জন্য তৈরি হতে বলে চলে গেলেন নিজের স্টাডি রুমে।
শাওমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো ওর চোখ মুখ। মাথা ঝুঁকিয়ে ইউ সংকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের ঘরের দিকে ছুটলো। হালমনিকে এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটা বলতে হবে। কি ভাগ্য করেই না বেচেঁ গেলো আবজির প্রশ্নের হাত থেকে। সোনায় মোড়া কপাল তার।
—-
‘ তোমাকে বিয়ে করাটা আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল ছিল মোতালেব। ভাবিনি তুমি আমার ভালোবাসার মূল্য এভাবে দিবে। আমাকে ঠকিয়ে দিলে তুমি। আমাকে, আমাদের ভালোবাসাকে, আর আমাদের সন্তানদের ঠকালে তুমি। ওই চার ইঞ্চি হাই হিল পড়া,সবসময় আটা ময়দার চাকচিক্যে নিজেকে মুড়িয়ে রাখা কেতারদুরস্ত মেয়ের জন্য আমাকে ভুলে গেলে তুমি। ছিঃ…. ‘
স্ত্রী তাসনুবার এই মারাত্মক ভুল ধারণা কি করে ভাঙবেন ভেবেই পাগল হওয়ার দশা মোতালেবের। তিনি রাগে মাথার চুলগুলো টেনে ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। মিনিট দুয়েক পরে শান্ত হয়ে কাউচ ছেড়ে এগিয়ে গেলেন স্ত্রীয়ের দিকে। তাসনুবা ততক্ষণে ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছেন। আজই বাড়ি ছেড়ে মেয়েদের নিয়ে চলে যাবেন তিনি। এই মানুষটার সঙ্গে আর এক মুহূর্তও থাকা চলবে না তার।
‘ লিসেন হানি, তুমি ভুল বুঝছো আমাকে। এগুলো সবই তোমার মনের ভুল ধারণা। এমন কিছুই না তুমি যেটা ভাবছো। তুমি শুধু শুধুই সন্দেহ করছো আমাকে। আমি আজ ইলিয়ানার সঙ্গে দেখা অব্দি করিনি। ‘ নিজেকে সামলে প্রিয়তমার হাত আকড়ে বললেন মোতালেব।
মোতালেবকে ছেড়ে এক ঝটকায় দূরে সরে গেলেন তাসনুবা। ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন ‘ ওহ এখন নিজের দোষ ঢাকতে এগুলোকে আমার ভুল বলে চালিয়ে দিচ্ছ ? তোমার লজ্জা করছে না আমাকে, নিজের স্ত্রীকে পাগল বলতে ? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না মোতালেব তুমি ওই ইলিয়ানার জন্য এসব করছ। তাহলে আমাদের এত বছরের ভালোবাসাতে কি কমতি ছিল বলো ? তুমি বলছো তুমি ওর সঙ্গে দেখা করনি, তাহলে কোথায় ছিলে এতক্ষণ ? ‘
তাসনুবাকে আরও একবার বোঝানোর চেষ্টা করলেন মোতালেব। কিন্তু তাসনুবা বুঝলেন না। বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে রাগত স্বরে বললেন ‘ ঠিকাছে তোমার যেখানে ইচ্ছা হয় যাও কিন্তু খবরদার আমার মেয়েদের হাতও লাগাবে না। ওরা আমার মেয়ে, আমার কাছেই থাকবে। ‘
রাগে দুঃখে হতবাক তাসনুবা তখন অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়েছিলেন প্রাণপ্রিয় স্বামীর দিকে। মানুষটা এভাবে জীবনের মাঝপথে তার হাত ছেড়ে দিবে ভাবেননি। মিনিট কয়েকের মধ্যে নিজের হতভম্ব অবস্থা কাটিয়ে অভিমানী তাসনুবা নিঃশব্দে মেয়েদের না নিয়েই চলে গেলেন। আর সেটাই ছিল মোতালেবের তাকে শেষ দেখা। এরপর আর কোনোদিন দেখা পাননি স্ত্রীয়ের।
ঘুমের মাঝে আবারও বছর পুরনো সেই ভয়াল রাতের স্মৃতি দেখে হুড়মুড় করে উঠে বসলেন মোতালেব সাহেব। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসেও তার প্রচন্ড গরম লাগছে। গলার কাছটা শুকিয়ে এসেছে। আবারও সেই একই স্বপ্ন। আবারও সেই ভয়াল রাত। যেই রাতটা তার জীবনে সর্বনাশ ডেকে এনেছিল।
রাগে, দুঃখে জর্জরিত মোতালেব সাহেব নিজের চুল টেনে ধরলেন। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। যখনই সেই রাতের কথা মনে পড়ে আফসোস হয় কেন অভিমানে স্ত্রীকে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। যেতে না দিলে সে হয়তো আজ তাদের সঙ্গেই থাকত। তাদের পাঁচজনের এক সুখী পরিবার হতো। মেয়েদের ভালোভাবে মানুষ করতে গিয়ে তাদের কাছ থেকে এভাবে হারিয়ে যেতে হতো না।
রাগ, অভিমান যে একটা মানুষকে ঠিক কোন পর্যায় নিয়ে যায় সেটা একমাত্র যে এর ভুক্তভুগী সেই জানে। মোতালেব সাহেব বরাবরই শান্ত মেজাজের। রাগারাগি করে কোনো পরিস্থিতি খারাপ করে দেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন তিনি। অথচ দশ বছর আগে সেই তিনিই মেজাজ হারিয়ে রাগের মুখে স্ত্রীকে এক কাপড়ে বেরিয়ে যেতে বললেন। সেই বলাটাই তার নাশ করলো। সব হারালেন একসঙ্গে। প্রথমে স্ত্রী তারপর মেয়েদের।
এখন তাদের হারিয়ে তিনি সর্বহারা। একলা এই দুনিয়ায় একমাত্র তারা আর তার জন্মদাত্রী মাই তো সম্বল ছিলেন। বাকিরা সবাই তো তার প্রতাপ প্রতিপত্তির লোভে তার কাছে ভিড়েন। তারা তো কেউ আপন নয়। তাহলে কেন আজ পর মানুষেরাই কাছাকাছি আর আপনরাই এত দূরে। তাদের সঙ্গে উনার এতটাই দূরত্ব যে আজ চাইলেও আর তাদের কাছে টেনে নিতে পারেন না।
~চলবে ইনশাআল্লাহ্….
#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-২৫
#মিফতা_তিমু
‘ তোমাকে ভালোবাসা আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল ছিল মোতালেব। তুমি আমাকে ঠকালে, আমাদের ভালোবাসাকে ঠকালে আর আমার সন্তানদেরও ঠকালে। আমার মুখে বলতেও বাঁধছে যে তোমার মতো মানুষকে আমি ভালোবেসেছিলাম। ‘
ঘুমের মাঝে অমনির বলা সেই কথাগুলো আজও ঝুমুরের কানে কানে বারি খেলো। ও হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো। নিশ্বাস অনিয়ন্ত্রিত তার। কথাগুলো ভুলতে কষ্ট হচ্ছে। বুঝতে পারছে না আজও কেন এত বছর পুরোনো ওই কথাগুলো ভুলতে পারেনা সে ? যেখানে অমনির চেহারাই সে স্পষ্ট মনে করতে পারে না সেখানে তার বলা কথাগুলো আজও কানে বাজে। কেন এমন হয় ?
ঝুমুরের মানসপটে জংদগ লাইব্রেরিতে অমনির সঙ্গে কাটানো সময়গুলোর স্মৃতি ভেসে উঠলো। সব স্পষ্ট মনে আছে অথচ অমনির চেহারাটাই স্পষ্ট নয়। কেমন যেন আবছা আবছা। ঝুমুরের খারাপ লাগছে। যেই অমনি বাবাকে সে এত ভালবাসতো তারাই আজ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো আলাদা। ঝুমুর জানেনা তাদের মধ্যে কি হয়েছিল। সে এটাও জানেনা কেন তার অমনি ওই কথা বলেছিল।
সে শুধু একটা কথাই জানে, তার বাবা এমন কিছু করতেই পারে না যার জন্য অমনি আর তাদের ভালোবাসার উপর এক দলা প্রশ্ন উঠে আসবে। হতে পারে সে কট্টর মানসিকতার। কিন্তু সে যে মানুষ হিসেবে ভালো এটাও জানে ঝুমুর। হতে পারে ঝুমুর বয়সে এখনও অনেক ছোট কিন্তু অমনি হারিয়ে যাওয়ার পর সে সমাজের এমন সব বাস্তবতা দেখেছে যার জন্য ছোট সেও আজ যেকোনো মানুষের মানসিকতা এক মুহূর্তে বুঝে ফেলতে পারে। ঝুমুর জানে সে আর শাওমি তার বাবার দুর্বলতা।
তবুও মনের কোণে আজও ঝুমুরের কিছুটা অভিমান জমে আছে। তাদের বাবা মেয়েদের ভালোভাবে মানুষ করতে গিয়ে, পারফেক্ট বানাতে গিয়ে বন্ধুত্বের হাতটাই ছেড়ে দিয়েছেন। ভুলে গেছেন যেকোনো মানুষকে নিজের মনমতো চালাতে হলে সবার আগে তার বন্ধু হয়ে উঠতে। আগে তাকে কিছু দিতে হয় তারপর তার থেকে কিছু নিতে হয়। স্বার্থপরতা হলেও এটাই সত্যি। ‘ Give and take ‘ এটাই সামাজিকতার নিয়ম।
ঝুমুর বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে উঠে দাড়ালো। আজ আর তার ঘুম হবে না। আজকাল আর আগের মতো ঘুম হয়না। মানসপটে প্রতি রাতে ভেসে উঠে বছর আগের তার সামনে বাবা অমনির করা সেই ঝগড়ার দৃশ্য। মনে পড়ে অমনি কিভাবে আঘাত করছিল বাবাকে অথচ বাবা সবটাই মুখ বুজে সহ্য করে শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও চেষ্টা করছিলেন অমনিকে আটকাতে। কিন্তু ভাগ্যের যা পরিহাস। মানুষ সবসময় যা চায় তাই কি আর পায়। ঝুমুর খুব করে চেয়েছিল ওই স্মৃতিগুলো ভুলতে অথচ স্মৃতিগুলো আজও প্রতি রাতে তাড়া করে বেড়ায়। ঘুমোতে দেয় না তাকে। বাবা মায়ের মধ্যকার মান অভিমান যে সন্তানের উপর কি গভীর প্রভাব ফেলে সেটা ঝুমুরকে দেখলেই বোঝা যায়।
ঝুমুর লবি চেয়ারটা টেনে ঘরের মাঝ বরাবর আনলো। বারান্দার দরজাটা খুলে দিল। শেলফ থেকে নামিয়ে আনা গিটার নিয়ে চেয়ারে বসলো। গিটারে স্ট্রিংয়ে হাত রেখে সুর তুললো। কন্ঠের সবটুকু বিষাদ ঢেলে গান ধরলো…
Oceans apart, day after day
And I slowly go insane
I hear your voice on the line
But it doesn’t stop the pain
… If I see you next to never
How can we say forever?
… Wherever you go, whatever you do
I will be right here waiting for you
Whatever it takes or how my heart breaks
I will be right here waiting for you
… I took for granted all the times
That I thought would last somehow
I hear the laughter, I taste the tears
But I can’t get near you now…
অন্ধকার রাতে স্ট্রিট লাইটের আলো ঝুমুরের ঘরে পড়া মাত্র সেই আলোয় ঝুমুরের চোখের কোণে মুক্তো ঝড়া অশ্রুগুলো চিকচিক করে উঠলো। ঝুমুরের কণ্ঠে এক আকাশ সমান বিষাদ। মুখে মলিন হাসি, চোখগুলো নিশ্চল। ফাহমান ঘরেই ছিলো। পেশেন্ট হিস্ট্রির ছবি তুলে এনেছে ফোন। সেগুলোই দেখছিল। কিন্তু এই রাতে ঝুমুরের বিষাদময় গান শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। বারান্দায় এসে দাড়ালো।
গান শেষে ঝুমুর কিছুক্ষণ গন্তব্যহীন পথিকের মতো উলটপালট সুর তুললো। টুং টাং করলো মন ভরে। অসহায় পথিকের মত সুরের রাজ্যে মুদিত পায়ে ঘুরে একসময় ক্লান্ত হলো। গিটার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। এক নজর বারান্দা দিয়ে ফাহমানের বারান্দায় তাকালো। ফাহমান ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ঝুমুর এগোলো না, নিশ্চল পায়ে এলোমেলো গতিতে লবি চেয়ারের উপর গিটার রেখে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
ফাহমান ক্লান্তির নিশ্বাস ফেললো। ঝুমুরকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় শুয়ে পড়েছে। অথচ মেয়েটার স্লাইড ডোর খোলা। এই ঠান্ডার মধ্যে দরজা খুলে রাখা ঠিক হয়নি। ঠান্ডা তো এখনও পুরোপুরি কমেনি। ফাহমান এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেও ঘরে ঢুকলো। বারান্দার দরজা না লাগিয়েই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। প্রেয়সীর মন খারাপে তারও যে ঘুম আসতে চাইছে না। ঘুম তার চোখ ছেড়ে পালিয়েছে প্রিয়তমার কন্ঠের বিষাদের সুরে।
—-
পরেরদিনও ঝুমুরের ঘুম ভাঙলো বেলা করে। তখন প্রায় দুটো বাজে। ঘুম ভাঙতেই সে শুনতে পেলো ফোন বাজছে তার। ও ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো। ঘুমঘুম কণ্ঠে বললো ‘ অঙ্গনা ঝুমুর স্পিকিং, হুজ দ্যাট ? ‘
ফোনের ওপারে থাকা ফাহমান হেসে বললো ‘ ডাক্তার সাহেব স্পিকিং। ‘
সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলো ঝুমুর। ফোন কান থেকে নামিয়ে দেখলো ফোনের ডিসপ্লেতে ডাক্তার সাহেব নামটা জ্বলজ্বল করছে। ঝুমুর জিভ কেটে ফোন কানে দিলো। বললো ‘ জি, কিছু বলবেন ? ‘
‘ কেন কোনোকিছু না বলার হলে কি ফোন দিতে পারিনা ? ‘
ফাহমানের কথায় ঝুমুর মাথা নেড়ে বললো ‘ না না সেটা বলিনি। আমি আসলে বুঝাতে পারছি না কি বলবো। আপনি ভুল… ‘
ফাহমান হাসলো ঝুমুরের কথায়। বললো ‘ হয়েছে থাক আর বলতে হবে না। আমি বুঝেছি তুমি কি বলতে চেয়েছ। আমি শুধু এটা বলতে ফোন দিয়েছি যে এই যে এরকম রাত বিরাতে জেগে যে থাকো তাতে ক্ষতিটা কার হচ্ছে ? ‘
ঝুমুর চুপ। ঝুমুরকে নিরব দেখে ফাহমান আবারও বললো ‘ জীবন এমন এক রাস্তা যেখানে হাঁটতে গেলে বিপদ আসবে। পার হতে হবে কাঁটাযুক্ত পথ দিয়ে। তাই বলে কি ভয় পেয়ে থেমে যাবে ? বাগান কন্যা কি এতটাই ভীতু যে কাটা লাগার ভয়ে হাঁটবে না ? তাহলে এখন এই মন খারাপ কেন ? কেনই বা খাওয়া দাওয়া করো না ? বাগান কন্যা কি জানেনা তার এই উদাস মন দেখতে একজনের ভালো লাগে না ? তাছাড়া দেবদাস ফিমেল ভার্সন দেখতে কারই বা ভালো লাগে ? মনে হচ্ছে চোখের সামনে ফিমেল শাহরুখ খান দেখছি। ‘
ফাহমানের কথা বলার ধরনে না হেসে পারল না ঝুমুর। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এলো যেটা ফাহমান এত ক্রোশ দূরে থেকেও ঠিক টের পেলো। ফিসফিস করে মোহনীয় গলায় বললো ‘ হাসলে আপনাকে অনেক সুন্দর লাগে বাগান কন্যা। ‘
ঝুমুরের হাসি থেমে গেলো। মানুষটা তার সামনে নেই অথচ তার এই ফিসফিস কন্ঠের মাদকতায় সে যেন ডুবে মরলো। লজ্জাবতী লতা লজ্জার ভূষণ জড়ালো। মৃদু গলায় কোনোমতে বললো ‘ আমি তবে রাখছি। ‘
ঝুমুর ফোন কাটতেই ফোনটা কান থেকে নামিয়ে রাখলো ফাহমান। আনমনে হেসে নিজের কাজে মন দিল। এইদিকে ঝুমুরের উজ্জ্বল কপোল দুটো লাজে রাঙা হয়ে উঠেছে। মানুষটা কাছে না থেকেও কেমন ভালোবাসায় আকন্ঠ ডুবিয়ে রাখে। যখন সে পুরোপুরি কাছে চলে আসবে তখন ঝুমুর কোথায় রাখবে তার এই লজ্জা। ঝুমুর ভেবে পেলো না। শুধু ইচ্ছে করলো লাজে রাঙা হয়ে উঠার জন্য হলেও মানুষটা তার হোক। তাকে জীবনসঙ্গী রুপে বেছে নিক।
ঝুমুর ফোন রেখে চটপট উঠে গোসল সেরে নিল। মনোয়ারা বেগম এসে জানিয়েছেন আজ সন্ধ্যায় তাদের ফাহমানদের বাড়িতে দাওয়াত আছে। মারিয়াম নিজে এসে একটু আগে নাকি দাওয়াত দিয়ে গেছেন তাদের। ঝুমুর খানিকটা অবাক হলো। একটু আগেই ফাহমানের সঙ্গে কথা হলো তার। অথচ এই ব্যাপারে সে কিছুই বললো না। সে কি তবে জানেনা ? আর দাওয়াত কোন খুশিতে ? আজ কি কারোর জন্মদিন ? কোথায় ঝুমুরের তো মনে পড়ে না। হৈমন্তীর জন্মদিন তো চলে গেছে। তাহলে ?
যাক সেতো সন্ধ্যায় দেখা হলেই বোঝা যাবে। ঝুমুর দ্রুত গোসল সেরে খাবার ঘরে গেলো। ইতিমধ্যে সকলে খেয়েদেয়ে উঠে গেছে। এখন শুধু সে, মনোয়ারা বেগম আর আঞ্জুম আরা বাকি। তাকে দেখে মনোয়ারা বেগম প্লেটে খাবার সাজিয়ে ঝুমুরের চেয়ারের সামনে রাখলেন। ঝুমুর গিয়ে নিজের নির্দিষ্ট চেয়ারটায় বসলো। মনোয়ারা বেগম আর আঞ্জুম আরাও খেতে বসেছেন। মনোয়ারা বেগম ঝুমুরের একদম মুখোমুখি টেবিলের অন্য মাথায়।
আঞ্জুম আরা, মনোয়ারা বেগম টেবিলের এক মাথায় আর ঝুমুর আরেক মাথায়। মাঝে বিস্তর দূরত্ব। আঞ্জুম আরা খেতে খেতে বললেন ‘ এখন তোর শরীর কেমন লাগছে ঝুম ? ভালো লাগছে মা ? খেতে পারবি না খাইয়ে দিবো ? ‘
ঝুমুর চামচে ভাতের লোকমা মুখে পুরে বললো ‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো লাগছে মামী। কষ্ট করার প্রয়োজন। খেতে পারছি আমি। ‘
মনোয়ারা বেগম সুধালেন ‘ তোর শরীরের কি অবস্থা ? জ্বর কমেছে কি ? যদিও তুই যখন ঘুমিয়েছিলি তখন কপালে হাত রেখে মনে হয়েছিল কমেছে অনেকটা। শরীর তো ঘেমেছিল। ‘
ঝুমুর মাথা নেড়ে বললো ‘ হ্যাঁ জ্বর কমেছে। বলা যায় নাইই। দেখি কাল থেকে আবার কোচিং যাবো। ‘
নাতনীর হাসিখুশি মুখ দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন মনোয়ারা। এই কটাদিন তার শান্তিতে কাটেনি। শুধু বারবার মনে হয়েছে ছুটে যেতে চান তিনি ঝুমুরের কাছে। অথচ ঝুমুরকে নিয়ে সকলের এত দুশ্চিন্তা ঝুমুরের নিজেরই পছন্দ নয়। মুখে মুখে ভালবাসার এত প্রকাশও সে সঠিক মেনে নিতে পারে না। তাই মনোয়ারা বেগমের এত আদর যত্নে তার খানিক অসস্তি হয়।
খাওয়া দাওয়া শেষে ঝুমুর কোচিংয়ের পড়াগুলো দেখে নিল। কাল আবার কোচিং গিয়ে এই দুদিনের পড়া কালেক্ট করতে হবে। এগুলো করে উঠতে উঠতে বিকেল প্রায়। শরীর এখনও সেরকম শক্ত সামর্থ্য নয় বলে ঝুমুর এক্সারসাইজ করলো না। আগে খাওয়া দাওয়া পরিমিত করা দরকার। তারপর নাহয় ওসব শরীর চর্চায় যাবে।
ঝুমুর বইখাতা গুছিয়ে রেখে উঠে দাড়ালো। আলমারি খুলে ঘাটাঘাটি করলো সন্ধ্যার দাওয়াতে ফাহমানদের বাড়িতে কি পড়ে যাওয়া যায় ভেবে। বেশ খানিকক্ষণ সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে ঝুমুর মেরুনের মাঝে নীল আর মিষ্টি কালার মিশেলে স্ট্রাইপ পেইন্ট করা লাইট একটা কাফতান নামিয়ে নিলো। শরীর মন সতেজ করতে আরও একবার গোসল করে নিলো। যদিও সন্ধ্যা বিকেলে গোসল করলে তার ঠান্ডা লেগে যাওয়ার প্রবণতা আছে কিন্তু ঝুমুরের এখন মন মেজাজ ঠান্ডা রাখা দরকার। তাই গোসল করাটা জরুরী।
ঝুমুর ওর লম্বা ঢেউ খেলানো চুলগুলো হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নিয়ে চুলে সাইডে সিথি করে ঢিলে বেণী করে নিলো। চুল বাঁধা শেষে মেরুন রংয়ের ওড়নাটা তুলে নিলো কাধে। তৈরি হতে হতেই তার বিকেল পেরিয়ে গেছে। সময়টা গৌধুলির। আসলে মেয়ে মানুষ তো, সে যতই ঝড়ের গতিতে কাজ করুক না কেন তবুও রেডি হতে গিয়ে সময় ঠিকই লাগে।
ঝুমুর একবার আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখে নিলো। কিছু একটা কম কম মনে হচ্ছে। অনেক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখার পর ঝুমুর বুঝতে পারলো ওর হাত খালি। তাই ও ড্রেসিং ড্রয়ার খুলে ওর প্রিয় কাঠের চুড়িগুলো নামিয়ে আনলো। বাম হাতে ঢুকিয়ে নিলো চুড়িগুলো। এবার ঠিক আছে, সব একদম পারফেক্ট।
ঝুমুর তৈরি হয়ে বসার ঘরে এলো। দেখলো মনোয়ারা বেগম, আজমাঈন সাহেবসহ বাকিরা সকলে রেডি। শুধুমাত্র আঞ্জুম আরাই এখন পর্যন্ত তৈরি হয়ে হাজির হতে পারেননি। এ নিয়ে মনোয়ারা বেগম কিছুক্ষণ রাগারাগি করে এখন মুখ গোমড়া করে বসে আছেন। ঝুমুর ভাবলো আঞ্জুম আরাকে গিয়ে ডাকা দরকার। ও উঠতে নিলো তবে আঞ্জুম আরা ততক্ষণে এসে হাজির।
আঞ্জুম আরা তৈরি হয়ে আসতেই সকলে বেরিয়ে পড়লো ফাহমানদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ির পথ তো আর দূর নয়। দশ পা রাখলেই পৌঁছে যাবে। তাই সবাই ঢিলে তালে এগোলো। বিল্ডিংয়ে ঢুকতেই আজমাঈন সাহেবের সঙ্গে বন্ধু মুজিব সাহেবের দেখা হলো। বন্ধুকে পেয়ে তিনি খোঁজ খবর নেওয়ার নামে গপ্প জুড়ে দিলেন। আজমাঈন সাহেব সবাইকে এগোতে বলে ওখানে দাড়িয়েই বন্ধুর সঙ্গে কথাবার্তা দেওয়া নেওয়া করলেন।
ডোর বেলের শব্দে মারিয়াম এসে দরজা খুললেন। অন্যদিন তিনি এই সময় বাসায় বসে বেকারির কাজ করেন। আজ আবার বাড়িতে মেহমান আসবে আর তিনি তাদের অ্যাপায়ন করতে গিয়ে সুযোগ পাবেন না বলে কাল বেকারী বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মারিয়াম দরজা খুলেই সবার আগে তার চোখ পড়ল কোণায় দাড়িয়ে থাকা ঝুমুরের দিকে। ভীষন মিষ্টি হেসে স্বল্প সাজে দাড়িয়ে আছে সে। ঝুমুর কখনোই অত সেজেগুজে সামনে আসেনা বলে ঝুমুরের এই অল্পস্বল্প সাজের মুখখানা মারিয়ামের খুব পছন্দ।
মারিয়াম সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে সকলকে বসার ঘরে বসালেন। ঝুমুরের থুতনিতে হাত রেখে হেসে বললেন ‘ মাশাল্লাহ আমার ঝুমকে কত সুন্দর লাগছে। একেবারে পরী মনে হচ্ছে। এ যে আমাদের বেহেস্তি নূর। মনোয়ারা আপা মেয়ের রূপ তো আমাকে ঘায়েল করলো। দিন যত যাচ্ছে আমাদের ঝুম যেন ততই বড় হচ্ছে। কাজেকর্মে, সৌন্দর্য গুনে সবকিছুতেই যেন লক্ষ্মী। ‘
মনোয়ারা বেগম নাতনীর প্রশংসা শুনে হাসলেন। আঞ্জুম আরা মারিয়ামের কথায় বললেন ‘ কথা ভুল বলেননি। আসলেই আমার ঝুম সবকিছুতে লক্ষ্মী। আপনাদের বাসায় আসার কথা শুনে কি সুন্দর সেজেগুজে তৈরি হয়ে বসেছিল কি বলবো। আমার ভাগ্নি বলে না, এমনিতেই ঝুম সবকিছুতে তড়িৎ গতির। যত দ্রুত কাজ করতে পারে ততই গুছিয়েও করতে পারে। ‘
ঝুমুরের অসস্তি হচ্ছে নিজের এত প্রশংসা শুনে। ও সেই অসস্তি কাটাতে বললো ‘ হৈমী কোথায় মনি ? ফেরেনি কোচিং থেকে ? ‘
মারিয়াম ঝুমুরের কথার জবাবে বললেন ‘ নাহ্ কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবে। ফাহমানটাও একটু পরেই ফিরবে। আজ শুভ একটা দিন অথচ ফারুক নেই। ছেলেটার তো এখন ডিউটি নাহলে ও থাকলে কত ভালো হতো। ‘
‘ শুভ দিন ‘ কথাটা শুনে সবার চোখে মুখেই চাপা কৌতূহল ফুটে উঠলো। ঝুমুর সরু চোখে তাকিয়ে আছে মারিয়ামের দিকে। আঞ্জুম আরা বললেন ‘ শুভ দিন ? ‘
মারিয়াম জবাব দিতেন কিন্তু তার পূর্বেই সদর দরজায় কড়া পড়লো। ঝুমুর নিজে খুলবে বলে ইশারায় মারিয়ামকে বসতে বলে নিজে এগিয়ে গেলো। কিন্তু দরজা খুলে ঝুমুর দেখলো আজমাঈন সাহেবের পাশে এক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা দাড়িয়ে আছেন। ঝুমুর চিনে না তাদের। তবে দেখে মনে হচ্ছে তারা বেশ ভদ্র গোছের। ভদ্রমহিলার পরনে জামদানি শাড়ি। গলায় কানে স্বল্প কারুকার্যের খাঁটি সোনার গহনা শোভা পাচ্ছে। মুখে এক মিষ্টি হাসি। ভদ্রমহিলার বয়স হয়েছে অথচ এখনও আলতা বরণ সুন্দরী।
ভদ্রমহিলার পাশে দাড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকও ঝুমুরকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে হেসে বললেন ‘ আসসালামু আলাইকুম, মা কেমন আছেন ? ‘
ঝুমুর চমকালো, মুহূর্তেই সে সরে দাড়িয়ে আগত অতিথিদের ঘরে ঢোকার জায়গা করে দিলো। এখন তার মাথা খুটে মরতে ইচ্ছে করছে। এতক্ষণ কি করে পারলো বেজ্জতের মতো দরজা আগলে দাড়িয়ে থাকতে ? অতিথিরা কি ভাবছে কে জানে।
‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম আঙ্কেল। আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনারা ভালো আছেন ? ‘ ঝুমুর খানিকটা অসস্তি নিয়ে বললো। এই প্রথম এরকম এক পরিস্থিতির মুখে পড়লো। পূর্বে কখনও এরকম কিছু মুখোমুখি হতে হয়নি। অথচ উনাদের সে চেনেই না।
~চলবে ইনশাআল্লাহ্…