#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-২০
#মিফতা_তিমু
মানুষ স্বভাব জাতভাবেই অহংকারী, দাপটে, খেপাটে আর চঞ্চল। এক জায়গায় থেকে কোনোকিছু হজম করার মতো শক্তি কিংবা ইচ্ছা কোনোটাই নেই। এক্ষেত্রে তাদের ধৈর্য্যও কম। যেকোনো জিনিসে তারা ধৈর্য্য দ্রুত হারায়। তার শান্ত মনটা বারংবার উচাটন হয়। কিন্তু এই চঞ্চল মনের খেপাটে পাগল মানুষও কিন্তু দিনশেষে প্রকৃতিতে স্ব স্ব স্থানে ফিরে আসে। কারণ!! কারণ তারা প্রকৃতি সন্তান।
আসিফের অতটা শান্তভাবে বেরিয়ে যাওয়াটা ফাহমানকে আরও বেশি দুশ্চিন্তায় ফেলছে। কেন যেন আসিফের ওই ঠান্ডা ব্যবহার ওকে ভাবাচ্ছে। আসিফের মনে কিছু তো একটা চলছে। ও এতটা ঠান্ডা থাকার মানুষ নয় তাই ওর মনে যা চলছে তা ঘটে গেলে যে ফাহমানকে চরম খেসারত দিতে হবে সেটা সে বুঝতে পারছে।
অস্থির ফাহমান ঘরে শান্তি পেলো না। তাই নিজেকে সস্তি দিতে প্রকৃতি মাতার কাছেই গেলো। বারান্দার খোলা হাওয়ায় এসে দাড়ালো। হিমেল হাওয়া শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে। আজও আকাশে চাঁদের দেখা নেই অথচ স্ট্রিট ল্যাম্পের আলো তার বারান্দা অব্দি এসেছে। সেই আলোতে ছটফট করতে থাকা ফাহমান তবুও যেন সস্তি পেলো না। মনটা বড়ই উচাটন। বুঝতে পারছে না ওর এই অস্থিরতা কাটানোর উপায় কি।
ফাহমানের মনে হলো এখন যদি একবার ঝুমুরের ওই মায়া মাখা মুখটা দেখতে পেত তাহলে হয়তো অন্তঃকরণ শীতল হতো। অস্থিরতা তার অনেকটা কমে যেত। কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব ? প্রশ্নটা প্যান্টের পকেটে হাত রেখেই ভাবছিল ফাহমান। পকেটে রাখা ফোনে হাত লাগতেই কিছু একটা মনে পড়লো। সে ধীর চিত্তে ফোনটা পকেট হতে বের করে স্ক্রীন অন করলো। ফোনের কন্ট্যাক্ট অ্যাপে গিয়ে ঝুমুর লেখা নামটায় ক্লিক করলো। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠলো প্রেয়সীর নাম্বার।
কিছু কিছু সময় কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখার সাধ এত দ্রুত ঘটে যায় যে বহু আকাঙ্ক্ষিত মানুষটার আবির্ভাব ঘটলে আমরা অপ্রত্যাশিত কিছু পেয়ে যাওয়ার খুশিতে হতবাক হয়ে যাই। তখন আমাদের মস্তিষ্কের শিরায় শিরায় শুধুই মানুষটার আগমনের জন্য হতবাক সিগনাল পায়চারি করতে থাকে। আমরা হতবাক চোখে চেয়ে থাকি তার দিকে।
এই যে একটু আগে যখন ফাহমান ফোন দিবে কি দিবে না দ্বিধায় ভুগছিল তখনই তার সমস্ত সমস্যার সমাধান করে দিয়ে তার মুখোমুখি এসে দাড়ালো তার কাঙ্ক্ষিত, ভালোবাসার মানুষটা। অমাবশ্যার এই তিথিতে স্ট্রিট লাইটের আলোয় ঝুমুরের প্রখর সৌন্দর্যের মায়াবী মুখটা অজানা এক কারণে আষাঢ় মাসের বর্ষণ দিনের মেঘ মেদুর আকাশের মতোই কৃষ্ণ কালো হয়ে আছে।
ফাহমান তাকিয়ে আছে তার প্রেয়সী পানে। আজ তার প্রেয়সীরও মন খারাপ অথচ তাকে দেখা মাত্র মানুষটার অধর কোণে ছড়িয়ে পড়লো এক সুবিস্তৃত হাসি। ফাহমান লক্ষ্য করেছে ঝুমুর যখন হাসে তখন তার অজান্তে তার চোখও হাসে। কেবল হাসে না তার মোহময়ী সুর।
ঝুমুরকে আজ পর্যন্ত কখনও জোর গলায় হাসতে দেখেনি ফাহমান। ঝুমুর বরাবরই নিঃশব্দে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। ফাহমান জানে ঝুমুর বেশ গোছালো। তার কোনোকিছুই অতিরঞ্জিত নয়। সে সবসময় শৃঙ্খলা মেনে চলা মানুষ। সঙ্গে তার ব্যবহার, চরিত্র এসবও বেশ কোমল। সে মানুষটাই কোমলমতি। তাইতো তার কণ্ঠস্বর কখনও মাত্রা ছাড়ায় না, শুনতে পাওয়া যায় না তার রিনঝিনে হাসির শব্দ। কারণ মানুষটাই তো নিপাট ভদ্র আর শান্তি প্রিয়।
ঝুমুর ফাহমানকে দেখে নিঃশব্দে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসছে। মানুষটার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তার মনের মধ্যে চলছে হাজার দুশ্চিন্তা। হৈমন্তীর কাছে সবই শুনেছে সে। আজ আসিফ তার বাবা মা নিয়ে এসেছিল। সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার সময় যে অবিশ্যম্ভাবী ভাবে কোনো ঝামেলা না করেই বেরিয়ে গেছে সেটাও জেনেছে। ঝুমুর চিনে আসিফকে। তার সঙ্গে আসিফের ভালো সম্পর্ক। সত্যি বলতে লোকে আসিফকে যেমন ভাবে তার কাছে সেরকম মনে হয় না।
ঝুমুর আজ অব্দি কখনও আসিফকে তার কিংবা হৈমন্তীর সঙ্গে উচুঁ গলায় কথা বলতে দেখেনি। এমনকি আসিফ কখনও হৈমন্তীর সঙ্গে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ঘনিষ্ঠ হয়নি। অথচ এই মানুষটাকেই লোকে উগ্র, অহংকারী, দাম্ভিক বলে। হতে পারে আসিফ বদ মেজাজি, স্বাধীনচেতা কিন্তু তাই বলে সে আত্মকেন্দ্রিক নয়। সে হৈমন্তীকে অনেক ভালোবাসে।
‘ ভালোবাসা সবাইকে বদলে দেয়, আপনার চোখে যেটা অতিরঞ্জিত অধিকার খাটানো অন্যের চোখে সেটাই ভালোবাসা প্রকাশের এক মাত্র উপায়। সবার ভালোবাসা প্রকাশের ধরন এক নয়। একেকজন মানুষ যেমন আলাদা তেমনই তাদের ভালোবাসার ধরণও আলাদা। সবাইকে সুযোগ দেওয়া উচিত। এমনও হতে পারে যেই বোনটা আপনার চোখের তারা সে কারোর রাজ্যের রানী। কাউকে সুযোগ না দিয়ে কেড়ে নেওয়া বড্ড পাষাণ হৃদয়ের কাজ। ‘
ফাহমান বুঝলো ঝুমুর যা বলছে তা হয়তো কোনো এক দিক দিয়ে ঠিকও বলছে। সে চিনে আসিফকে। তারা অনেক পুরনো সময়ের বন্ধু। দুজনে কত সময় একসঙ্গে কাটিয়েছে তার হিসাব নেই। আসিফ বদ মেজাজি, স্বাধীনচেতা, অহংকারী, উগ্র ধরনের তবে ও যাদের নিজের মনে করে তাদের জন্য নিজের জীবনটাও দিতে পারে। শুধু ভালোবাসাটাই যে সে প্রকাশ করতে পারে না।
কিন্তু ফাহমানের সেখানেই তো ভয়। আসিফের রাগ তার ভালোবাসাকেও ছাপিয়ে যায়। কয়েক বছর আগে ফাহমানের কারণে আসিফ আর পাড়ার এক ছেলের মধ্যে খুনোখুনি পর্যায়ের মারামারি হয়ে গেছিলো। তখন ফাহমান আসিফকে সামলাতে গিয়ে নিজেই আসিফের মার খেয়েছে। আসিফের ভয়ানক রেগে গিয়েছিল কারণ ফাহমান তাকে আটকানোর চেষ্টা করেছে। সেই রাগেই সে ফাহমানকে ঘুসিও মেরেছিল নাকে। সেই ঘুসির ভয়াবহতা এতই ছিল যে ফাহমানের ব্যথা পাওয়ার পর কিছুদিন নাক দিয়ে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়েছিল। এবং এই ঘটনার জন্য আসিফ মোটেই অনুতপ্ত ছিল না। তার কথা তুই মাঝখানে এসেছিস কেন, আমি দেখছিলাম তো ব্যাপারটা।
কিন্তু আসিফ এটা বুঝেনি যে সে ক্ষমতা গুনে বেচেঁ গেলেও লোকে একসময় ফাহমানকেই হেয় করার সুযোগ পেয়ে যেত। আসিফ এরকমই, নিজের সিদ্ধান্তে অটল আর দুর্দমনীয়। তার কাজে যে বিরোধ করবে সে তার জানের শত্রু হোক সে নিজেরই জিগরি দোস্ত। এই দিক দিয়ে সে কাউকে কখনো ছাড় দেয়নি এবং দিবেও না।
ঝুমুর দেখলো ফাহমান নিশ্চুপ। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো ‘ আপনার ক্ষেত্রে আসিফ ভাইয়ের যেই ব্যবহার সেই ব্যবহার হৈমন্তীর ক্ষেত্রে অন্যরকমও হতে পারে। প্রেমিকা আর বন্ধু এক নয়। তাদের একই পর্যায়ে ফেলা বোকামি। আপনি যদি কাউকে ভালোবাসার সুযোগ পেতে পারেন তাহলে আসিফ ভাইও সেই সুযোগের যোগ্য। হতে পারে মানুষটা রাগী,বদমেজাজি, গম্ভীর, উগ্র কিন্তু ভালবাসার অধিকার তারও আছে। ‘
‘ আমি ভালোবাসার সুযোগ পেয়েছি ? ‘
ঝুমুরের কথা শোনামাত্র ভ্রু কুচকে দুষ্টু হেসে জিজ্ঞেস করলো ফাহমান। ঝুমুর বুঝলো না ফাহমানের মজা। সে বলল ‘ পাননি বলছেন ? তাহলে আমি এখানে দাড়িয়ে কি করছি ? ‘
ফাহমান এবার কৌতুকে হেসে বললো ‘ তুমি কি বুঝাতে চাইছ আমরা প্রেম করছি ? ‘
ঝুমুর কি বলবে বুঝে পেলো না। উত্তর দিতে না পেরে সে মৌন থাকাই শ্রেয় মনে করলো। ওকে চুপ থাকতে দেখে ফাহমান গম্ভীর মুখে বললো ‘ বুঝলাম আমাদের এখনও প্রেম হয়নি। তাহলে প্রেম হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ওকে, তাহলে বর্ষাকাল আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। তখন দুজনে বৃষ্টিতে ভিজে দেখবো তোমার সঙ্গে আমার প্রেম হয় কিনা। ‘
ঝুমুর ফাহমানের কথায় এই প্রথম চমকে গিয়ে ওর দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো। ফাহমান সেই দৃষ্টি গ্রাহ্য করলো না। সে গম্ভীর ভাব ধরে নিজের ঘরে ঢুকে গেলো। বারান্দার দরজাখানা লাগিয়ে দিয়ে সে এতক্ষণ চেপে রাখা হাসিটা মুক্ত করে দিলো। হাসতে হাসতে তার অবস্থা কাহিল। তার কথা শুনে ঝুমুরের বিস্মিত চেহারার ভাব মনে পড়লেই হাসি পায় তার। মেয়েটা কি হতবাকই না হয়েছিল।
ঝুমুর হতবাক নয়নে সম্মুখে তাকিয়ে আছে। ফাহমান কি তার চুপ করে যাওয়াতে রেগে গেলো ? রেগে না গেলে এভাবে গম্ভীর মুখে কথাই বা কেন বলবে ? সে তো থমথমে ধরনের মানুষ নয়। বেশ উচ্ছল আর হাসিখুশি মানুষ সে। উফফ ঝুমুরের ভালো লাগছে না। কেন যে তখন উত্তরটা দিলো না। অথচ সে মনে সাজিয়েই রেখেছিল উত্তর।
ঝুমুর ভেবেছিল বলবে ‘ একে অপরের চোখে চোখ রেখে হাজারও অব্যক্ত কথা ইশারায় জানানোকে যদি প্রেম বলে তবে তাই সই। ছাতা থাকা সত্ত্বেও অপর মানুষটা বৃষ্টিতে ভিজে অসুখ বাঁধাবে বলে নিজের ছাতা ছেড়ে দেওয়াটা যদি প্রেম হয় তবে তাই সই। আমরা প্রেমই তো করছি ডাক্তার সাহেব। আপনার মত অসহ্য ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে প্রেম করার অনুভূতিটাও অসহ্য রকমের সুন্দর, একটু বেশিই সুন্দর। ‘
কিন্তু অনুভূতিগুলো মনেই থেকে গেলো। মন থেকে মুখ অব্দি যাত্রা অম্লান হলেও পরে আর সেগুলো প্রকাশ পেলো না। যাত্রার সমাপ্তি সেখানেই হলো। ঝুমুরের এখন আফসোস হচ্ছে। ইশ যদি বলতো ফাহমানের শুনতে চাওয়া কাঙ্ক্ষিত সেই কথাগুলো তাহলে মানুষটা অমন ভাবে চলে যেত না। তাদের আরও কত কথা হতো। রাতটা এমন নির্জনে একাকীত্বে কাটত না।
হতাশ ঝুমুর ঘরে ফিরে এলো। আজ প্রথমবার যেন তার এই প্রিয় শীতল ঘরটা একলা ঠেকছে। ঘরের শীতল পরিবেশে কেমন গা জ্বালানো অনুভূতি টের পাচ্ছে সে। ঝুমুর সস্তি পেলো না। নিশ্চল পায়ে এগিয়ে গেলো আলমিরার দিকে। আলমিরার শেষ পাল্লাটা খুলে সযত্নে নামিয়ে আনলো বড় ঘুটঘুটে কালো রংয়ের একটা ব্যাগ। ব্যাগের চেইন খুলে নামিয়ে আনলো তার প্রিয় ইজিপশিয়ান ব্লু বর্ণের গিটার।
পিওর রোজউড মেটালের এই গিটারটা মোতালেব সাহেব ঝুমুরকে কিনে দিয়েছিলেন যখন মেয়ের অসামান্য গানের গলার হদিস পেয়েছিলেন। এই গিটার পেয়ে আনন্দে আত্নহারা ঝুমুর তৎক্ষণাৎ তার কোরিয়া ভাষী স্কুলের মিউজিক টিচারের কাছে গিটার শেখা শুরু করেছিল। তখন যে সেই তার চর্চার শুরু তারপর থেকে এত বছরে এখনও তার সমাপ্তি ঘটেনি। অবশ্য এখন চর্চা আগে হতে অনেকটা কমেছে ঝুমুরের জাগতিক ব্যস্ততার কারণে। কিন্তু তাসনুবা নিরুদ্দেশ হওয়ার পর রাতের আঁধারে এই গিটার বাজিয়ে নিজের মনের সমস্ত রস বিরহ ভোলা ঝুমুরের আগে নিত্যদিনের অভ্যাস ছিল।
ঝুমুর ঘরের নীলচে আলোয় লবি চেয়ারের উপর বসলো তার গিটার নিয়ে। মোবাইলের আলোয় সব ভালোমত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চেক করলো। সব ঠিকঠাক আছে দেখে সে আঙ্গুল তুলে টুং করে সুর তুললো। আজ অনেক মাস পর গিটারটা হাতে নিয়েছে। তার অনেক পুরনো সঙ্গী এই গিটার অথচ আজও হাতে নিলে প্রথম দিনের মতো শরীরের ভেতর সেই উত্তেজনা টের পায়।
একখানা যান্ত্রিক সুর একসময় টুং টাং সুরে রূপ নিলো। কণ্ঠে মাধুরী মিশিয়ে ঝুমুর চোখ দুটো বুজে অন্ধকার রাতের নিস্তব্ধ প্রহর ভেদ করে খালি গলায় গিটারের সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গেয়ে উঠলো…
Your big brown eyes
Stare straight back at mine
I have underline the words
I wanna say to you
Your rosy cheeks and the way you smile
Is enought just to get me through
রাতের আঁধারে নিস্তব্ধতা ভেদ করে ঝুমুরের রিনরিনে কণ্ঠের এই মিষ্টি সুর ফাহমানের শ্রবণ ইন্দ্রিয়তে গিয়ে ঠেকলো। কন্ঠের মালিকের হদিস পেতে সে এগিয়ে এসে বারান্দায় ঢুকলো। গানের গলা আসছে ঝুমুরের ঘরের দিক থেকে। ফাহমান বুঝলো গানটা ঝুমুরই গাইছে। ওর ঠোটে ছড়িয়ে পড়লো এক তৃপ্ততার হাসি। সে বিভোর হয়ে প্রেয়সীর মহুয়ার মতো কণ্ঠে গান উপভোগ করতে লাগলো।
Flowers in your hair
Lipstick stains on my neck
The way you make me care
Without you I’m a train wreck
Your lips on mine, im the lucky one…
গান শেষে ঝুমুর গিটারের সুরে ইতি টানল। চোখ তুলে বারান্দার দিকে তাকালো। বারান্দার খোলা স্লাইড দিয়ে হুড়মুড় করে শীতল হাওয়া ঘরে প্রবেশ করছে। ঝুমুর উঠে দাড়ালো। গিটারটা ঘরের সাইডে থাকা বৃহদাকার শেলফটায় রেখে এগিয়ে গেলো বারান্দার দিকে। দেখলো তার প্রিয় ডাক্তার সাহেব এসে দাড়িয়েছে এই নিস্তব্ধ রজনীতে তার ছোট্ট বারান্দাটায়। ঝুমুর তাকিয়ে আছে সেই দিকে। দুজনের মুখে নেই কোনো কথা কিন্তু চোখের ইশারায় একে অপরের সঙ্গে বিনিময় করছে হাজারও অব্যক্ত কথা।
ফাহমান তাকিয়ে আছে নিঃশব্দে। ঝুমুর মুখ ফুটে তাকে কিছুই বলেনি অথচ নিজের সুর দিয়েই যেন কতকিছু বুঝিয়ে দিল। বুঝিয়ে দিল তার মনে লুকিয়ে থাকা ফাহমানের প্রতি অনুভূতিগুলো। বুঝিয়ে দিল ফাহমানের নেওয়া সমস্ত যত্ন ঝুমুর আজও ভুলেনি। বুঝিয়ে দিল সে ফাহমানকে কতটা ভালোবাসে। কেউ যখন নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে তখন অপর ব্যক্তিকেও জবাবে কিছু বলতে হয়। কিন্তু ফাহমান!! ও বললো না, সে অপেক্ষায় আছে সঠিক সময়ের। ততদিন অব্দি নাহয় থাকুক বন্দী অনুভূতির জটলাগুলো।
~চলবে ইনশাআল্লাহ্….
#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-২১
#মিফতা_তিমু
সূর্যের চিকন রশ্মি আছড়ে পড়ছে ঝুমুরের চোখে মুখে। কালো কুচকুচে চুলগুলোয় সোনালু রং এক অন্যরকম ছায়া ফেলেছে। চোখে মুখে রোদ পড়লে আমরা বিরক্ত হই। কিন্তু ঝুমুর হলো আনপ্রেডিকটেবল। এসবে তার কোনো আপত্তি নেই। সে ব্যস্ত তার খায়েশ মিটিয়ে ঘুমোতে। তার মাথা রাখা ফাহমানের কাধের উপর।
ফাহমান অবাক না হয়ে পারছে না। মেয়েটা এই কয় মিনিটের রাস্তায় আবার দশ পনেরো মিনিট ঘুমিয়েও উঠে। আজ নাহয় জ্যামে আটকে পড়েছে দুজন কিন্তু অন্যদিন তো আরো দ্রুত পৌঁছে যায়। ফাহমান এটা বুঝে পায় না ঝুমুর এত ঘুমোয় কি করে। ওর জায়গায় সে নিজে থাকলে বাস ছুটে যাবে এই টেনশনে ঘুমই হতো না। অথচ মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে খেয়ে দেয়ে যেন দুপুরের ভাতঘুম দিয়েছে।
এইদিকে ঝুমুরের এত শান্তি আবার ফাহমানের সহ্য হচ্ছে না। মেয়েটা কাল রাতে গান গেয়ে ওকে নিজের কণ্ঠের প্রেমে এমনভাবেই ফেলেছে যে সে এখন আর চাইলেও কিছুতেই ভুলতে পারছে না কালকের সেই রিনরিনে কণ্ঠ। মেয়েটা ওকে যে মেরে ফেলার প্ল্যান করছে সে ও ভালো করেই বুঝতে পারছে। আবার কি সুন্দর লেমন ফ্রেগরেন্সও মেখে এসেছে। সেই সুগন্ধির গন্ধে ফাহমানের মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। মনটা বিষিয়ে যাচ্ছে ভালোলাগা আর খারাপলাগা অনুভূতির দাপটে।
যানজটে বসে এই শীতের সকালেও ঝুমুরের চোখে মুখে ঘাম জমেছে। ঘর্মাক্ত মুখ তার চিকচিক করছে। ফাহমান চকিতে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মেয়েটার মুখে এসে বারবার এলো চুলগুলো ছড়িয়ে পড়ছে অথচ সে কত নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। আজ বাড়ি থেকে বের হতে সময় চুলগুলো বেধেও বের হয়নি। ফাহমানের জিনিসটা মনঃপুত হয়নি। ঝুমুরের এই রেশমের মতো কালো কুচকুচে চুলগুলো সে ছাড়া আর কেউ দেখুক ও চায় না।
ফাহমান হাত এগিয়ে দিয়ে ঝুমুরের মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো যত্নে সরিয়ে দিলো। ঝুমুর ঘুমোচ্ছিল কিন্তু ফাহমান তার চুল কানের পিছনে গুঁজে দিতেই ধীরে ধীরে সে চোখ মেলে তাকালো। ফাহমান ঝুমুরকে চোখ খুলতে দেখে চুপ করে রইলো। ঝুমুর তাকিয়ে আছে ওর দিকে নির্নিমেষ চোখে। বাস তখন চলতে শুরু করেছে। শা শা গতিতে ছুটে চলা বাসে ঝড়ো হাওয়ার দাপট। হাওয়ার দাপটে ঝুমুরের গুছানো চুলগুলো আবারও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
‘ ব্যান্ড আছে ? ‘
ফাহমানের কথায় ঘোর ছেড়ে বেরোলো ঝুমুর। হকচকিয়ে বললো ‘ জি ? ‘
ফাহমান বললো ‘ চুল বাঁধার ব্যান্ড আছে ? ঐযে ঝুঁটি করে যে। ‘
ঝুমুর মাথা নেড়ে নিজের ব্যাগে হাত দিল। ব্যাগ থেকে ব্যান্ড বের করতে করতে আড়চোখে কয়েকবার ফাহমানকে দেখলো। ফাহমান তখন ওর দিকেই তাকিয়ে। ঝুমুর ব্যান্ড নামিয়ে ফাহমানের দিকে এগিয়ে দিল। ফাহমান সেটা হাতে নিয়ে ঘুরে বসতে বললো ঝুমুরকে।
ঝুমুর ফাহমানের ইশারায় প্রতিউত্তর করলো না। ওর কথা মতোই ঘুরে বসলো। ফাহমান এবার ঝুমুরের চুলে হাত দিলো। সযত্নে চুলে খোঁপা করার চেষ্টা করলো। খোঁপা করার প্রয়াস চালাতে চালাতে বললো ‘ সব জিনিস সবাইকে দেখাতে নেই। বিশেষ করে মেয়েদের চুল। ‘
ফাহমানের খোঁপা বাঁধা ততক্ষণে শেষ। ছোট থাকতে হৈমন্তীর চুলে এভাবেই খোঁপা করে দিত। তাই অভ্যাস আছে।
ঝুমুর ঘুরে বসলো। সুধালো ‘ কেন ? ‘
ফাহমান ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো ‘ কারণ এগুলোর উপর একজন বিশেষ মানুষের অধিকার আছে। ‘
ঝুমুর বললো ‘ কে ? ‘
ফাহমান বললো ‘ প্রেমিকদের ‘
ঝুমুর এবার ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। ভ্রু নাচিয়ে বলল ‘ তবে আপনি কেন আমার চুল দেখেন ? আপনি কে ? আমার প্রেমিক ? কিন্তু কাল কেউ একজন যেন বলছিলো আমাদের তো এখনও প্রেম হয়নি। তবে প্রেমিক আসে কোথা থেকে ? ‘
ফাহমান বুঝলো ঝুমুর ওকে ওর কথাতেই ফাসাচ্ছে। ও হাসি চেপে গম্ভীর গলায় বললো ‘ আমাদের প্রেম হয়েছে আবার হয়নিও। আমাদের এখনও হাত ধরাধরি করে বৃষ্টিতে ভেজা বাকি। আমাদের পূর্ণিমার রাতে জোছনা বিলাস বাকি। আমাদের এখনও কম্বল জড়াজড়ি করে শীতের রাতে টিভি দেখা বাকি। আমার এখনও তোমাকে নুডুলস রেধে খাওয়ানো বাকি। মা বলে আমার হাতের নুডুলস নাকি দারুন খেতে। ‘
ঝুমুরের এবার ঠোঁটের সঙ্গে সঙ্গে চোখও হাসলো। ও উচ্ছসিত গলায় বললো ‘ কবে রেধে খাওয়াবেন ? ‘
ফাহমান এবার মলিন হাসলো। ঝুমুরকে ছেড়ে দিয়ে বললো ‘ যখন তোমাকে সমাজের সামনে স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার অধিকার হবে। ‘
ঝুমুর বললো ‘ সেটা কখন হবে ? ‘
‘ যেদিন আমাদের বিয়ে হবে। আচ্ছা ঝুমুর, আমাদের বিয়ে হবে তো ? তোমার,আমার সম্পর্ক সবাই মেনে নিবে তো ? তোমার বাবা, উনি মেনে নিবেন আমাকে ? আমি তো মাত্র ইন্টার্নশিপ করছি। আমার মতো গরীব ছেলের হাতে নিজের রাজকন্যার মতো মেয়েকে তুলে দিবেন উনি ? আমি তোমাকে পারবো সব সুখ দিতে ? ‘
ঝুমুরের মুখটা মুহূর্তেই মলিন হলো। আচ্ছা এমন কেন হয় ? কেন কেউ কারোর প্রেমে পড়ার আগে এই কথাগুলো চিন্তা করে না ? কেন সবাই প্রেমে পড়ে জলে ভেসে ওঠা পদ্মের মতো সম্পর্কের মাঝে এসে সুখ দুঃখের চিন্তা করে ? কেন সে আগে এটা ভেবে দেখলো না আদৌ তার বাবা ফাহমানকে মানবে তো ? কেন সে এই সম্পর্কে জড়িয়ে, নিজ উদ্যোগে ফাহমানের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজের আর ফাহমানের জন্য দুঃখ বয়ে আনলো ?
ঝুমুরকে চুপ করে যেতে দেখলো ফাহমান। ও আর কথা বাড়ালো না। মনটা কেমন বিষিয়ে গেছে। আর কিছু ভালো লাগছে না। এমনকি পাশে বসা প্রেয়সীর সুন্দর মুখশ্রীও দেখতে ইচ্ছে করছে না। এমনটাই কি হয় ? ভালোবেসে কাউকে না পেলে তখন সবকিছুই কি বিরক্তিকর ঠেকে ? ভালোবেসে না পেলে কি ভালোবাসার মানুষটাকেও অসহ্যকর মনে হয় ?
মুহূর্তেই পরিবেশ গুরুগম্ভীর হয়ে উঠলো। ঝুমুর, ফাহমান কারো মুখে কোনো কথা নেই। ঝুমুর উদাস চোখে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে আর ফাহমান চোখ বুজে বসে আছে। ওর চোখের কার্নিশে জমেছে দু ফোঁটা অশ্রু। বাস এগিয়ে যাচ্ছে তার গন্তব্যের দিকে। পথ এখনও অনেক চলা বাকি।
—-
আজ ফাহমানের হাফ ডে ছিল। তাই তাড়াতাড়ি রেহাই পেয়ে গেলো সে। সবশেষে কাধে ব্যাগ তুলে সে বের হলো। বাড়ির উদ্দেশ্যে বাস ধরলো। যদিও আধা ঘণ্টা দাড়িয়ে থেকে তারপর বাস পেয়েছে। ফাহমান সিটে বসে আছে। পাশে এক পঞ্চাংশোর্ধ্ব ব্যক্তি ভোস ভোস করে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। ফাহমানের সেদিকে নজর নেই। সে ব্যস্ত কাউকে ম্যাসেজ করতে। ম্যাসেজ টাইপ করলো ‘ আধা ঘন্টা পর, ইউটোপিয়া ক্যাফে। ‘
ম্যাসেজিং শেষে ফোন অফ করে পকেটে রাখলো ফাহমান। ঠোঁটে তার মৃদু হাসি। চোখে ভাসছে ঝুমুরের মলিন চেহারা। ঝুমুর এমন একটা মানুষ যার হাসিখুশি মুখ থেকে শুরু করে মলিন চেহারা সবই ফাহমানের পছন্দ। তাকে সে কিছুতেই ভুলতে পারে না। ইদানিং তার উপস্থিতি ফাহমানের মনে নূপুর কন্যার উপস্থিতি ম্লান করে দিচ্ছে। এখন আর আগের মত ঝুমুরকে ভাবলে নূপুর কন্যাও ভাবনায় উড়ে আসে না। এ অবশ্য ভালো লক্ষণ। ফাহমান একজনেরই, শুধুমাত্র বাগান কন্যার।
মন খারাপের প্রভাব ঝুমুরের উপর গভীরভাবেই পড়লো। কোচিং শেষে ক্লান্ত ঝুমুর দূর্বল পায়ে বাড়ি ফিরলো। আজ বাস থেকে নেমে সরাসরি রিকশা নিয়ে ফিরেছে সে। শরীরে বিন্দু মাত্র শক্তিও ছিল না যে বাড়ি অব্দি হেঁটে আসবে। এই যে এখন সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠছে তাতেও ওর শরীর ভারী ভারী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কাধের হালকা ভারের ব্যাগটা ওর শরীর ভার করে দিয়েছে। ঝুমুর কোনোমতে সিড়ির রেলিং আকড়ে ধরে নিজেকে সামলে উঠলো।
নির্লিপ্ত মুখে ক্লান্ত শরীরে ঘরের দরজা খুলে ঢুকলো ঝুমুর। এগিয়ে গেলো নিজের ঘরের দিকে। ওর জন্য মনোয়ারা বেগম খাবার সাজিয়ে বসেছিলেন। আজ বহুদিন পর সুযোগ করে আগেভাগে সব কাজ শেষ করে ফেলেছেন যাতে ঝুমুরকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে পারেন। কতদিন হলো নিজ হাতে খাইয়ে দেন না। আজ খাওয়াবেন সঙ্গে নিজের পরাণটাও ঠান্ডা করবেন। উনার আদরের বাচ্চার বাচ্চা হলো ঝুমুর। তার প্রতিই উনার ভালবাসাটা প্রখর। বাকিদের প্রতি থাকলেও জাহির করতে পারেন না।
ঝুমুরকে ফিরতে দেখে মনোয়ারা বেগম বললেন ‘ এসে গেছিস, যাক গোসল সেরে আয়। তোকে আজ নিজ হাতে খাওয়াবো। ‘
ঝুমুর দাড়ালো, ওর কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার উপায় নেই ওর কি হয়েছে। এমনটাই হয়, শরীর বেশি খারাপ হলে ঝুমুর চোখ মুখ কঠিন করে ফেলে। এ হলো কাউকে ওর শরীর খারাপ সম্পর্কে জানতে না দেওয়ার ছোট এক প্রয়াস। নিজ শরীর খারাপের কথা জানিয়ে অযথা অ্যাটেনশন পাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই তার। এসব বিরক্তি ছাড়া আর কিছুই না।
ঝুমুর কাটকাট গলায় বললো ‘ খাবো না ‘
মনোয়ারা বেগম হকচকিয়ে গেলেন। ঝুমুর সচরাচর সরাসরি না করে না। ওর কোনোকিছু পছন্দ নাহলে এড়িয়ে যায় তবে মুখের উপর না কখনও করেনা। তাছাড়া খাওয়া নিয়েও সে যথেষ্ট সচেতন। সবসময় চেষ্টা করে যেন পর্যাপ্ত পরিমাণ খেতে পারে। এক ফোঁটা কমও না আবার বেশিও না। তবে আজ কি হলো ?
মনোয়ারা বেগম চিন্তিত হলেন। অস্থির গলায় বললেন ‘ কেন কি হয়েছে তোর ? শরীর খারাপ করছে নাকি ? ‘
কথাগুলো বলতে বলতে উনি এগিয়ে গেছেন ঝুমুরের দিকে। ঝুমুরের চোখ মুখ তখন কাঠিন্যতার মুখোশ পড়ানো। অস্থির তিনি ঝুমুরের কপালে হাত রাখলেন। কপালের উষ্ণতা টের পেয়ে বললেন ‘ তোর তো অনেক জ্বর। আগে বলিসনি কেন ? ‘
ঝুমুর বিরক্ত হলো। মনোয়ারা বেগমের হাত সে নিজ হাতে সরিয়ে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললো ‘ কিছু হয়নি আমার। এত চিন্তার কিছু নেই। একটু রেস্ট করলেই ঠিক হয়ে যাবে। এত ভাববেন না আমাকে নিয়ে। আমি ঘরে যাচ্ছি। দয়া করে আমায় আর ডাকবেন না। আমাকে একটু একা থাকতে দিন। ‘
ঝুমুর গিয়ে ঢুকলো নিজের ঘরে। দরজা লাগিয়ে দিয়ে ব্যাগ ছুঁড়ে মারল ডেস্কের উপর। এগিয়ে গিয়ে জামা কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। ছেড়ে দিল শীতল ঝর্নার বারিধারা। যন্ত্রণায় কপালের রগ ছিঁড়ে যাচ্ছে। চোখে কেমন অন্ধকার লাগছে। ঝুমুর দেওয়াল ধরে সামলে নিলো নিজেকে। বেশিক্ষন থাকা যাচ্ছে না বাথরুমে। যেকোনো সময় মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
কোনোমতে চুলের পানি মুছে জামা কাপড় বদলে বাথরুম ছেড়ে বের হলো ঝুমুর। তার অবস্থা এতটাই খারাপ যে দেওয়াল ধরে নিজেকে সামলাতে হচ্ছে। ঝুমুর গিয়ে আস্তে করে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। মুখের রুচির ভয়াবহ অবস্থা। হয়তো অনিয়মিত খাওয়া দাওয়ার ফল। ঝুমুরের ভালো লাগছে না। ওর এখন হুট করেই কান্না পাচ্ছে। নিজে বুঝতে না পারলেও অনুভব করতে পারছে শরীরটা তার ভীষন জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
আগে যখন এমন জ্বর হতো তখন ঝুমুরের কাছে তার অমনি থাকতো। বাবাও তো তার জন্য উতলা হয়ে উঠতো। অমনি সারারাত তার সেবা শুশ্রুষা করে কাটিয়ে দিত অথচ এখন তার জ্বর তো হয়, কিন্তু মানুষটা আর সারারাত পাশে বসে তার সেবা করে না। আগে সে ছোট থাকতে বুঝতে চাইতো না, জ্বর উঠলে অনেক অবাধ্য আবদার করতো। অমনি সেগুলো সব শুনতো, সে জ্বালালে সেটাও সহ্য করতো। নিজের সামান্যতম শরীর খারাপ হলেই ঝুমুর তখন কেঁদেকেটে নাজেহাল অবস্থা করতো সবার। বাবা, অমনি, হালমনি…সবার।
অথচ এখন কাউকে যে বলবে তার শরীর খারাপ করেছে, মনটা পুড়ছে বাবা অমনির জন্য সেটারও সুযোগ নেই। এখানে সে অনেক সুখে আছে, তাদের বাড়ি, গাড়ি আছে। নেই কোনো অভাব তবুও তার মনে হয় সে কেবলই অন্যের উপর নির্ভর। এই অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়া ঝুমুরের কোনোদিনই পছন্দ ছিল না। এখানকার মানুষ যতই ভালো হোক কিন্তু যখন কেউ তার অমনির নিরুদ্দেশ হওয়া এবং বাবার তাকে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেওয়ার কথা শুনে দুঃখ প্রকাশ করে তখন তার ভেতরটা যন্ত্রণায় পুড়ে যায়। মনে হয় মানুষগুলো তাকে দয়া করছে, তাকে নিয়ে বেশি বেশি চিন্তা করছে। এগুলো মনে হলে ভেতরটা আরও দূর্বল হয়ে পরে।
ঝুমুর বিছানা ছেড়ে কোনোমতে উঠলো। ঝাপসা চোখে এগিয়ে গেলো স্টাডি টেবিলের দিকে। টালমাতাল শরীর বয়ে ব্যাগ থেকে সেলফোন বের করলো। কন্ট্যাক্ট অ্যাপে গিয়ে ঘোলা চোখে তার অমনিকে ফোন করলো। ফোনটা কানে ধরলো সে। ওপাশে ফোন রিং হয়ে যায়। ফোন রিসিভ হতেই ওপাশ হতে ভেসে এলো পুরুষালি গলা ভেসে এলো ‘ হ্যাঁ ঝুমুর বল। ‘
~চলবে ইনশাআল্লাহ্…..