#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-১৬
#মিফতা_তিমু
আমিরের কথায় ধীর তালে এগিয়ে গেলো হৈমন্তী। মুখোমুখি দাড়ালো আসিফের। হৈমন্তীকে এগিয়ে আসতে দেখে আসিফ সোজা হয়ে বসলো। হাতের সিগারেট ফেলে দিল সে। এখন এই সিগারেটের তার কোনো প্রয়োজন নেই। হৈমন্তীর নেশাই যথেষ্ট কৃত্রিম সেই নেশাকে ভুলিয়ে দিতে। হৈমন্তীর উপস্থিতিতে আসিফের তৃতীয় কিছুর উপস্থিতি একেবারেই পছন্দ নয়। হোক সে মানুষ কিংবা জিনিস।
হৈমন্তী গিয়ে আসিফের মুখোমুখি দাড়াতেই আমির বাকিদের ইশারা করলো ওদের একলা ছেড়ে দিতে। আমিরের ইশারায় রিভু আর রাজীব তখনই সেখান থেকে কেটে পড়ল। শেষ মুহূর্তে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আমিরও পিছন ফিরে একবার দেখলো প্রিয় মানুষ দুটোকে। এই এলাকায় সেই ছোট থেকে আছে ও। এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ায় এখানে বহু দিনের বাস তার। তাই আসতে যেতে পথে ঘাটে হৈমন্তীর সঙ্গে তার প্রায়ই দেখা হতো। এমনকি আসিফেরও পূর্ব হতে সে হৈমন্তীকে চিনত। অথচ ভাগ্যের পরিহাসে যেই মেয়েটাকে কাছের মানুষ করবে ভেবেছিল সেই আজ তার সবথেকে দূরের মানুষ।
‘ কি খবর ? দিন কিরকম যাচ্ছে ? ‘
আসিফের প্রশ্নে কি উত্তর দিবে বুঝলো না হৈমন্তী। লোক মুখে শুনেছে আসিফ অনেক রাগী আর জেদী ধরনের মানুষ। যা বলে করেই ছাড়ে। এমনকী সে নিজেও এর সাক্ষী। অবশ্য যার বাবা অত প্রতাপশালী সে যদি জেদী, একরোখা নাহয় তাহলে আর কে হবে। বাবার অর্থে তো সন্তানরাই গরম দেখায়।
হৈমন্তীকে চুপ করে থাকতে দেখলো আসিফ। তার মেজাজ এখন উত্তপ্ত দাবানলের মত উষ্ণ। যেকোনো সময় ফেটে পড়তে পারে। কিন্তু তবুও সে সবুর করলো। শান্তি কণ্ঠে আবারও একই প্রশ্ন সুধালো। হৈমন্তী চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি দিলো। ফাহমান যদি দেখে ফেলে তবে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। কাউকে আশেপাশে না পেয়ে সে রয়েসয়ে বললো ‘ ভালো খবর, বুয়েটে… অ্যাডমিশন দেওয়ার জন্য কোচিং করছি। ‘
কথাগুলো ধীর লয়ে খানিকটা সময় নিয়েই বললো। আসিফের চক্ষু রক্তিম, দাতে দাত চেপে শক্ত চোয়ালে সে বললো ‘ কি মনে হয় তোর আমাকে ? কি মনে করিস আমার চোখ নেই ? তুই কি করে বেড়াচ্ছিস কিছুই জানিনা ? ‘
হৈমন্তী ঘাবড়ে গিয়ে দুই পা পিছালো। ভয়ার্ত গলায় বললো ‘ আমি এরকম কেন মনে করবো ? ‘
আসিফ হৈমন্তীর এই অবুঝপনা দেখে যেন আরও রেগে গেলো। রাগত গলায় সে বললো ‘ রোজ যেই ছেলের সঙ্গে কোচিং থেকে বাসে করে ফিরিস ঐ ছেলে কে হয় তোর ? ওর সঙ্গে এত হাসাহাসি কিসের ? ভুলে গেছিস যে তোর উপর আমার নজর আছে ? আমার জিনিসে যে নজর দেয় তার নজর আমি উপরে নিতে জানি হৈমন্তী। ‘
আসিফের ধমকের দাপটে কেপে উঠলো হৈমন্তী। শরীরটা তার কাটা দিচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসছে। আসিফের এই রক্তচক্ষু দেখে তার ভয় লাগছে। আসিফ হাত মুঠো করে দাড়িয়ে আছে। যদি একবার হাত উঠিয়ে হৈমন্তীকে চড় লাগায় তবে তো হৈমন্তী সেখানেই শেষ। চড়ের কথা ভাবতেই হৈমন্তীর ভয় যেন আরো বেড়ে গেলো। কোনোমতে নিজেকে সামলে বললো ‘ ও আমার কোচিংয়েই পড়ে, কোচিং ফ্রেন্ড। ওর বাসায় সফিউদ্দীন রোড আর আমার মোক্তার বাড়ি। একই পথে বলে একই বাসে আসি। ‘
হৈমন্তীর কথায় আসিফ শান্ত হলো বোধহয়। মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটো শিথিল হলো। নির্লিপ্ত গলায় বললো ‘ সেই ছেলে যেন কোচিং অব্দিই থাকে। ওকে বাসায় কিংবা নিজের জীবনে আনার ভুল করলে… আর বললাম না। যা বাড়ি যা। বাড়ি গিয়ে মা আর ভাইকে বলবি তৈরি হতে। কাল তাদের মেয়েকে আমার পুরো পরিবার সমেত দেখতে যাবো আমি। ‘
আসিফের কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হৈমন্তী। তাদের মেয়েকে দেখতে যাবে মানে!! তাদের তো একটাই মেয়ে আর সে তো ও নিজেই। তারমানে ওকে দেখতে যাবে ? ইয়া আল্লাহ, ফাহমান জানলে খুনাখুনি হয়ে যাবে। ফাহমান আসিফের উগ্র মেজাজ সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ওয়াকিফ। সে কখনোই রাজি হবে না নিজের বোনকে এমপির বদ মেজাজি খটমটে ছেলের কাছে বিয়ে দিতে।
হৈমন্তীকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে ফেললো আসিফ। গম্ভীর গলায় বললো ‘ কি হলো দাড়িয়ে আছিস কেন ? এখানেই থাকতে ইচ্ছে করছে ? আমার সঙ্গে থাকবি ? কিন্তু বিয়ের আগে যে তোর আমার সঙ্গে থাকা হবে না। একবার বিয়ে হোক তারপর তোকে নিজের ঘরে তুলবো আমি। ‘
অসহায় হৈমন্তী আর এক মুহূর্ত দাড়ালো না। এখন তার আসিফের উপর উল্টো রাগ হচ্ছে। লোকটা ভেবেছে কি ? সে কি জানে না ফাহমান তাকে কখনোই মেনে নিবে না ? তবে কেন এসব করছে ? কেন হাজারও ভালো মেয়ে ছেড়ে এখনও তার পিছনে পড়ে আছে ? কি পাচ্ছে সে হৈমন্তীকে এভাবে কষ্ট দিয়ে ?
হৈমন্তীর নিজের নিয়তির কথা ভেবেই কান্না পাচ্ছে। যাকে সবসময় ভাইয়ের নজরে দেখতো তাকেই হঠাৎ এক অন্ধকার সন্ধ্যায় মনে ধরে গেলো। এরপর দিন এলো, দিন গেলো কিন্তু হৈমন্তীর ভালো লাগা আর কমলো না। বরং কমার বদলে উত্তরোত্তর বাড়তে লাগলো। অথচ হৈমন্তী যে এও জানে তার ভাই কোনওদিন আসিফকে মেনে নিবে না। এর পিছনে আসল কারণ হলো আসিফ বদমেজাজি, রগচটা আর একরোখা মানুষ। রাগ উঠলে কাউকে দেখে না।
বাকিটা রাস্তা হৈমন্তী কাদতে কাদতে বাড়ি ফিরলো। বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা দিলো। ঝুমুর তখন বাইরের ঘরে ছিল। মারিয়াম রান্নাঘরে দুপুরের খাবার রাধছেন আর ফারুক ফাহমান বসার ঘরে বসে খেলা দেখছে। দরজা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল হৈমন্তী। তার এখন কিছুই ভালো লাগছে না। আসিফের জীবনে ঢোকা তার জন্য নিষিদ্ধ। সেই দরজা তার ভাই নিজেই বন্ধ করেছে।
বিকেলে রান্নাঘরে দাড়িয়ে সবার জন্য চা বানাচ্ছে ঝুমুর। মারিয়াম তার হাতের চা খুবই পছন্দ করেন। তাই তার সঙ্গে সঙ্গে বাকিদের জন্যও চা করছে ঝুমুর। গৌধুলির শেষ লগ্ন সন্নিকটে। আরেকটু পরেই নির্জলা এই বিকেল মিলিয়ে যাবে অমানুষ অন্ধকারে। তখন তাদের তৈরি হয়ে বের হতে হবে।
ঝুমুর গুনগুন করতে করতে চায়ের কাপে চা নিলো। চা ঢালতে ঢালতে গান করার মজাই আলাদা। ঝুমুরের মন মেজাজ তুলনামূলক এখন অনেকটা ভালো। কারণ একটাই, সবাই গেলেও সে বাহিরে যাবে না। সবাই তৈরি হয়ে তার জন্য অপেক্ষা করবে, বিশেষত ফাহমান। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে ঝুমুর বলবে সে যাবে না। তখন বুঝবে ওই লোক অন্য মেয়ের প্রশংসা করার মজা।
অবশ্য শেষ মুহূর্তে এসে কোথাও বেরোবার সিদ্ধান্ত বদলানোর এই স্বভাব নতুন কিছু নয়। এমন তো হর হামেশাই হয়ে আসছে। ঝুমুর প্রায়শই এমন করে। আগে যখন ছুটিতে এসে সবাই মিলে কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করতো তখন ঝুমুর প্রথমে রাজি হলেও শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতো। আসলে এসব বেড়ানোর ব্যাপার ওর মুডের উপর ডিপেন্ড করে। ওর যদি ইচ্ছা করে তাহলে যায় নাহলে না।
ঠিক এই কারণেই এবার মনোয়ারা বেগম ঝুমুরকে বিয়েতে যাওয়ার প্রস্তাব সবার আড়ালে দিয়েছিলেন। কারণ সবার সামনে দিলে তো লাভ নেই। সেই ঝুমুর শেষ মুহূর্তে এসে আবারও না করতে পারে। কাজেই ঝুমুরের এই স্বভাব বহু পুরনো।
অতঃপর সারাদিন নির্বিঘ্নে কেটে ঘনিয়ে এলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ। মারিয়াম ফোন করে জানিয়েছেন তাদের ফিরতে আরও দেরি হবে, বিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে হতেই দেরি হয়ে গেছে। সম্ভব রাত হবে। আকাশে আঁধার নেমেছে। ফারুক, ফাহমান আর হৈমন্তী ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে এসেছে। হৈমন্তী গেলো ঝুমুরকে খুঁজতে।
বসার ঘরে বসে ঝুমুরের জন্য অপেক্ষা করতে করতে কথাবার্তা বলছিলো ফাহমান, ফারুক। মারিয়াম বেকারির উদ্দেশ্যে বের হচ্ছে। যাওয়ার আগে বললেন ঘর ভালো করে লক করে যেতে। ফারুক আর ফাহমান দুজনেই তার কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়ল। মারিয়াম কাধে তার সেই ঐতিহাসিক সাইড ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেলেন তার নিজের চাবিটা নিয়ে। ওই ব্যাগের আছে এক করুন কাহিনী।
হৈমন্তী ফাহমানের বাবা যখন বেচেঁছিলেন তখন ভালোবেসে স্ত্রীয়ের জন্য সাইড ব্যাগ এনেছিলেন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত এই ব্যাগ ব্যবহার করেই যাচ্ছেন মারিয়াম। যদিও পর্যাপ্ত যত্নের কারণে ব্যাগ এখনও ছিঁড়েফেড়ে যায়নি কিন্তু রং চটে গেছে। তাতে কি ? ব্যবহার করতে পারলেই তো হলো। মারিয়াম সেই ব্যাগে তার নতুন এন্ড্রোয়েড ফোন আর ঘরের চাবি রাখেন। কিছুদিন আগে শখ করে নতুন ফোন কিনেছেন।
কিছুক্ষণ পর বসার ঘরে এসে দাড়ালো হৈমন্তী। ওর মিইয়ে যাওয়া মুখ দেখেই ফারুকের যা বোঝার বোঝা হয়ে গেলো। বিরক্তিতে সে ভ্রু কুচকে বললো ‘ ঝুম আবারও লাস্ট মোমেন্টে বেরোবে না বলেছে ? ‘
ফারুকের কথা শুনে ফাহমান হৈমন্তীর দিকে নজর দিল ওর উত্তর শোনার জন্য। তবে হৈমন্তী কিছু বললো না। ফারুক পকেটে হাত গুজে উঠে দাড়ালো। বিরক্ত হয়ে বললো ‘ তাহলে ওকে ওর মতোই ছেড়ে দে। থাকুক ও বাসায় একা। ‘
ফারুক তার মতো কথা বলেই বেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু ফাহমান ওকে আটকালো। বললো ‘ তোর আপত্তি না থাকলে আমি ওর সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারি। যদি বাই চান্স রাজি হয়ে যায়। ‘
ফারুক ফাহমানের মুখ পানে চেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল ‘ ঝুমুরের যে লাস্ট মোমেন্টে না করবার বদ অভ্যাস আছে সে তো তুইও জানতি। বলে তো ছিলাম তোকে। যেখানে ও আমার কথাই শুনে না সেখানে তোর কথা কি করে শুনবে ? ছেড়ে দে আশা, ওই মেয়ে শুনবে না। ‘
ফাহমান তবুও মনে আশার আলো বেধে বললো ‘ আগে থেকে নেগেটিভ চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। চেষ্টা করতে তো অপরাধ নেই। তোরা বের হ আমি আসছি। ‘
ফারুক আর কথা বাড়ালো না। সে আর হৈমন্তী জুতো পায়ে বেরোলো। ফাহমান এগোলো মায়ের ঘরের দিকে। ঝুমুর ওই ঘরেই আছে। ঘর জুড়ে অন্ধকার। তবে বোঝা হচ্ছে ঘরে ঝুমুর নেই, বারান্দার দরজাটা হা করে খোলা। ফাহমান একবার ভাবলো বারান্দায় উকি দেওয়া যায়। হয়তো ঝুমুর সেখানেই।
বারান্দার খোলা পরিবেশে লম্বা কেশরাশি মুক্ত করে দিয়ে উদভ্রান্তের মতো দাড়িয়ে ঝুমুর। শীতের এই রাতে তার হাতে আইস্ক্রিমের কাপ। ফ্লেভারটা ব্ল্যাক ফরেস্ট। ঝুমুর এমনিতে মিষ্টি জিনিস না খেলেও মাঝে মাঝে তার মন মেজাজ ভালো না থাকলে সে হুট করেই আইস্ক্রিমের কাপ নিয়ে বসে পড়ে। যতটুকু সাধ্যে থাকে ততটুকু খায়। এমনিতেই বড়জোর আইস্ক্রিমের ওই বাটিটার চার ভাগের এক ভাগই সে খেতে পারে।
ঝুমুর সন্ধ্যের নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে থাকা আকাশ দেখতে ব্যস্ত ছিল। মাঝে বার কয়েক দৃশ্য দেখা স্থগিত করে আইস্ক্রিম মুখে তুলেছে সে। ঝুমুরের একটা লুকোনো প্রতিভা আছে। সেটা হলো যেকোনো মানুষের উপস্থিতিতে তার চেনা ঘ্রাণ নাকে এলেই সে বুঝে যায় মানুষটা কে। এই যেমন এখন ফাহমান ওর পাশে দাড়িয়ে আছে সেটাও ধরে ফেলেছে ও। তার শরীর দিয়ে ভেসে আসছে বুনো মন মাতাল করা এক ঘ্রাণ। ঘ্রানটা যেন ঝুমুরের নাকে লেগে আছে। অথচ ফাহমানকে অতটা কাছ থেকে ওই একবারই অনুভব করতে পেরেছিল ঝুমুর। সেটা হলো কাল রাতে।
কাল রাতে যখন মুগ্ধ ফাহমান ঝুমুরের দিকে অনিমেষ চেয়ে ঝুঁকেছিল তখনই এই বুনো মন মাতাল করা ঘ্রাণের উৎস খুঁজে পেয়েছিল ঝুমুর। তার বিশেষ ওই প্রতিভার বদৌলতে ঘ্রাণটা সে তখনই চিনে নিয়েছে। তাইতো মানুষটা পাশে এসে দাঁড়াতেই তার ধরতে দুই মুহূর্ত সময় লাগলো না। নির্লিপ্ত ঝুমুর কাট কাট গলায় বললো ‘ কি চাই ? ‘
ফাহমান চকিতে ঝুমুরের দিকে দৃষ্টি ফেললো। ঝুমুরের কণ্ঠ খানিকটা রুঢ় শোনালো কি ? হয়তো,কারণ ঝুমুর তো তার উপর রাগ করেই ঘুরতে যাবে না বলে ঠিক করেছি। ফাহমান মনে মনে কথাগুলো সাজিয়ে নিলো। তারপর ধীর লয়ে বললো ‘ যেতে চাচ্ছ না কেন ? ‘
‘ এই প্রশ্ন আপনি করছেন ? আপনার কি জানা নেই উত্তর ? ‘ ঝুমুরের কণ্ঠ আরও ক্রুদ্ধ শোনালো।
ফাহমান ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। উত্তর দিলো না সে। তার বিশ্বাস খানিকবাদে ঝুমুর নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর দিবে। আর তার এই ধারণা সত্যিও হলো। ঝুমুর মুখ খুললো। বললো ‘ জানতে চাচ্ছেন কেন যাচ্ছি না ? তাহলে শুনুন, আমি আপনার কারণে যাচ্ছি না। হ্যাঁ, আপনার জন্যই যাচ্ছি না। ‘
‘ আমার জন্য কেন ? আমি কি করেছি ? আমার কি দোষ ? ‘ চকিতে প্রশ্ন করে উঠলো ফাহমান।
ঝুমুর হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করলো। মনে মনে বলছে এখানে রেগে যাওয়ার কিছু নেই। এই ডাক্তার সাহেব শুধুমাত্র ওকে রাগিয়ে দিতেই এমন করছে। তাই ও নিজেকে সামলে মেকি হাসলো। বললো ‘ দোষ তো আপনার আছেই। আপনার একমাত্র দোষ হলো আপনি আমার সামনে আপনার ওই নূপুর কন্যার প্রশংসা করে আমাকে রাগিয়ে দিয়েছেন। আর এই দোষের শাস্তিই এখন বাকিরাও পাচ্ছে। ‘
ফাহমান খানিকটা ভরকে গেল বোধহয়। ঝুমুর যে এতটা সহজ সরল স্বীকারোক্তি দিবে সেটা ওর কল্পনাতীত। ও তো শুনেছিল মেয়েদের বুক ফাটলেও মুখ ফোটে না। কিন্তু ঝুমুর দেখি একেবারেই অন্যরকম। বরাবরের মতই আনপ্রেডিকটেবল এন্ড স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড।
হবে নাইবা কেন ? অন্য সবার থেকে আলাদা বলেই তো সে ফাহমানের এত পছন্দের। ফাহমান তবুও ঝুমুরের নিজ মুখ থেকে শুনতে চাইল সবটা। চাইলো ঝুমুরের মনের কথা শুনতে। তাই সে বললো ‘ আমি অন্য কারোর প্রশংসা করাতে তোমার কি যায় আসে ? আমি নূপুর কন্যার প্রশংসা করলে তুমিই বা কেন রেগে যাবে ? ‘
ঝুমুরের এবার মাথার ঘাম ছুটে গেলো। রাগে তার মেজাজ ৫০° সেলসিয়াসে চড়ে আছে। ঝুমুর নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারলো না। এগিয়ে গিয়ে ফাহমান আর তার মাঝে দূরত্ব ঘুচালো। ফাহমানের শার্টের কলার চেপে ধরে নিজের দিকে টেনে নিলো। দাতে দাত চেপে বললো ‘ আবার জানতে চাইছেন আমার কি আসে যায় ? আপনি জানেন না আমার কি আসে যায় ? আপনি সত্যিই জানেন না কেন আমি এসব করছি ? ‘
ফাহমান আলতো হাসলো। বললো ‘ জানি নাতো। তুমিই নাহয় বলে দাও কেন এসব করছ। ‘
ঝুমুর ফাহমানকে ছেড়ে দু পা পিছিয়ে গেলো। ফাহমান আবারও হাসলো। সে জানতো ঝুমুর কিছুতেই মনের কথা বলবে না। দিনশেষে সেও তো একজন মেয়ে। আর মেয়েরা কখনোই নিজ থেকে মনের কথা বলে না।
তবে ফাহমান যা ভেবেছিল তার সবটাই হয়তো ভুল ছিল। এই কদিনে সে পারেনি ঝুমুরকে চিনতে। সে ভেবেছিল সে ঝুমুরকে চিনে, জানে এবং বুঝে। কিন্তু ওই যে সে নিজেই যে একটু আগে বললো ঝুমুর আনপ্রেডিকটেবল। আসলেই সে আনপ্রেডিকটেবল। এই ব্যাপারে ফাহমানের ধারণা আরও পাকাপোক্ত হলো ঝুমুরের মুখের কথা শুনে।
~চলবে ইনশাআল্লাহ্…
#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-১৭
#মিফতা_তিমু
‘ আমাদের সাক্ষাতের সেই বৃষ্টি ভেজা প্রহর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কোনোদিনই আপনি আমার কাছে আমার বান্ধবীর ভাই ছিলেন না। আগেও ছিলেন না এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন না। ‘
ফাহমান থমকেছে। তার চলতি নিশ্বাসে ভাটা পড়তে চলেছে যতক্ষণ না ঝুমুরের মুখ থেকে সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত শব্দটি না শুনতে পারছে। এদিকে কথাগুলো বলে ঝুমুর থামলো কিছুক্ষণ। নির্নিমেষ চেয়ে রইলো ফাহমানের দিকে। ফাহমান তার দিকে চেয়ে আছে অধীর আগ্রহে। ঝুমুর আবারও বলতে শুরু করলো।
‘ আমি আপনার প্রেমে পড়েছি ডাক্তার সাহেব। আপনার মতো এক অসহ্যকর ডাক্তার সাহেবের প্রেমেই আমি খুব বাজে ভাবে পড়েছি। কিন্তু আপনি আমাকে চিনলেন না। আমি ভিনদেশী বলে আমায় তুচ্ছ করলেন। বুঝলেন না প্রেমে যখন পড়েছি তখন সেটা স্বীকার করার ক্ষমতাও আছে আমার। ‘
ফাহমান এখনও নির্নিমেষ চেয়ে আছে ঝুমুরের দিকে। ঝুমুর তার মনের কথাটা বলেছে ঠিকই কিন্তু বলেনি সে ফাহমানকে ভালোবাসে। কে জানে আদৌ বলবে কিনা ? ভিনদেশীরা আবার সহজে ভালোবাসার কথা স্বীকার যায় না কিনা। এই দেখো আবারও ঝুমুরকে ভিনদেশী ভেবে তাকে তুচ্ছ করছে সে। ঝুমুর ঠিকই বলেছে। আসলেই সে অসহ্যকর ডাক্তার।
ঝুমুর ফাহমানের দিকে চেয়ে আছে জবাবের আশায়। কখন ফাহমান তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু একটা বলবে আর সে প্রাণ ভরে শুনবে। কিন্তু ফাহমান ওই ব্যাপারে কিছুই বললো না। উল্টো আলোচিত বিষয়ের সম্পূর্ণ বাহিরে গিয়ে বললো ‘ আমরা সৃষ্টির সেরা জীব। কারণ সৃষ্টিকর্তা আমাদের অভিমান করার মতো করে একটা মন দিয়েছেন। সেই মন তখনই অভিমান করে বসে যখন আমাদের কাছের মানুষগুলো আমাদের রাগের কারণ বুঝতে না পেরে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থাকে। কিন্তু এর শাস্তি বাকিরা পেতে পারে না। এর শাস্তি হিসেবে আমরা পারিনা তাদের আমাদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে। ‘
ঝুমুর দীর্ঘ এক নিশ্বাস ফেললো। ফাহমান দিলো না তার কথার উত্তর। ব্যাপারটা যেন সম্পূর্ণই এড়িয়ে গেলো সে। শুনেও না শুনার ভান করলো। তবে কি সে ঝুমুরকে ভালোবাসে না ? ঝুমুর জানে না, সে কিছুই জানে না। শুধু এটা জানে তার মাথার ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
ফাহমান আবারও বললো ‘ আমরা বাহিরে দাড়াচ্ছি। পনেরো মিনিট অপেক্ষা করবো। এর মধ্যে তৈরি হয়ে নিচে আসো। যদি না আসো তাহলে ধরে নিবো তুমি আর আসবে না। ‘
ঝুমুর শুনলো কিন্তু কিছু বললো না। কি বলবে সে ? মানুষটা তার প্রেম প্রস্তাবের কোনো যুতসই জবাবই দিলো না। উল্টো এখন অন্য কথা বলছে। এই পরিস্থিতিতে আর কিইবা বলার থাকে তার। ঝুমুর মাথা নামিয়ে ফেললো। কিছু ভালো লাগছে না তার।
ফাহমান কথাগুলো বলে এগিয়ে গেলো প্রস্থানের উদ্দেশ্যে। তবে বেরিয়ে যেতে যেতে পিছন ফিরে আলতো হেসে বললো ‘ ওগো বিদেশিনী, সোনার বরণ কন্যা তুমি এসো আমার দ্বারে বাগান কন্যা রুপে। তোমার ঐ প্রেম নিবেদন আমি আজলা ভরে গ্রহণ করলাম। ‘
ঝুমুর চকিতে চোখ তুলে তাকালো। ফাহমান ততক্ষনে দৃষ্টির বাহিরে। এতক্ষণে যেন অমাবশ্যার চাঁদ ওঠা মনের আকাশে পূর্ণিমা তিথির দেখা মিলল। ঝুমুরের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো এক টুকরো হাসি। তার বিষাদ মায়ায় জড়ানো চোখ দুটো আনমনে হাসছে।
বাগান বাড়ির গলির মাথায় দাড়িয়ে আছে ফাহমান, ফারুক আর হৈমন্তী। ফাহমানের চোখ ফোনের স্ক্রিনে। বাকি দুজন অধীর আগ্রহে বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। তারা জানতে ইচ্ছুক যে ফাহমান এমন কি বললো যে ঝুমুরের রাজি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এত প্রখর। অন্তত ফাহমানের হাবভাব দেখে তো তাই মনে হয়। অথচ ঝুমুরকে হাজার বলে কয়েও তার গৃহীত সিদ্ধান্ত হতে এক চুল নাড়ানো যায় না।
অপেক্ষার পালা একসময় ফুরিয়ে এলো। ঝুমুর বেরিয়ে এলো সকলের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে। তাকে দেখে হৈমন্তী আর ফারুকের চোখ জ্বলজ্বল করছে। তারা বোধহয় আশাই করেনি যে ঝুমুর আসলেই ফাহমানের কথায় রাজি হবে। ফারুক ফোনে ব্যস্তরত ফাহমানের গায়ে কয়েকবার টোকা দিল। ফাহমান সেই টোকা খেয়ে মুখে তুলে চাইলো সামনের দিকে।
স্ট্রিট লাইটের আলোয় ঝুমুরের লম্বাটে বুদ্ধিদীপ্ত মুখে জ্বলজ্বল করছে ঐশ্বরিক দ্যুতি। তীক্ষ্ণ সৌন্দর্য্যের সেই ভিনদেশী তখন বাঙালি সাজে পুরো দস্তর তৈরি হয়েছে বাহিরে বের হবার জন্য। ঝুমুরের পরনে ওয়েলনাট ব্রাউন কালারের সিল্ক শাড়ি। হাতে তার শখের কাঠের চুড়িগুলো আর কানে ছোট ফুলের কানের দুল। প্রসাধনী বলতে চোখের কোলে কাজল পড়ানো আর কপাল বরাবর কালো রঙের ছোট একটা টিপ। তাতেই যেন ফাহমানের বিদেশিনীকে বেহেস্তি হুর মনে হচ্ছে। ফাহমান প্রেয়সীর এই মারকাটারি লুক দেখে না হেসে পারলো, সযত্নে লুকিয়ে নিলো তৃপ্তির হাসিখানা।
‘ তুই এত ভালো মানুষ!! ফাহমান বললো আর রাজি হয়ে গেলি কি করে ? ‘
ফারুকের প্রশ্নে ঝুমুর জবাব দিলো ‘ তোমার বন্ধু মানুষ কাজেই তাকে না করলে তোমার মান সম্মান চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ‘
হৈমন্তী বললো ‘ বুঝেছি, এবার চল বইন। এমনিতেই অনেক সময় খেয়ে ফেলেছিস। ‘
হৈমন্তীর কথায় সকলেই এবার রেস্টুরেন্টের পথে রওয়ানা দিলো। এখান থেকে রেস্টুরেন্ট বেশি দূরে না। পনেরো মিনিটের রাস্তা। কাজেই দুইটা রিকশা নিলো তারা। একটাতে ঝুমুর আর হৈমন্তী আবার আরেকটাতে ফাহমান ফারুক।
যে যার যার জায়গায় বসে আছে শান্ত রুপে। ফারুক অর্ডার করেছে বাফে ডিনার। এখন যার যেটা ইচ্ছা সেটা খাবে। রাত আটটায় ডিনার শুরু হবে। এখন বাজে সাতটা পঞ্চাশ। কাজেই এই দশ মিনিট তাদের অপেক্ষা করে কাটাতে হবে। ফাহমান নিজের ফোন দেখতে ব্যস্ত কিন্তু ঝুমুরের ফোনে মন লাগছে না। মনটা তার উচাটন। এমনিতেই এসব ইলেকট্রিকাল ডিভাইসের উপর সে খুব কমই নির্ভর করে।
ফারুক আর হৈমন্তী বসে বসে রেস্টুরেন্টের মেনু কার্ড দেখছে। ফারুকের হঠাৎ করে চিকেন ফাহিতা খাওয়ার মন ধরেছে। তাই সে আলাদা করে সেটাও অর্ডার করেছে। এছাড়াও ফারুক হৈমন্তী মিলে রেস্টুরেন্টের মেনু কার্ড নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে কারণ এই জায়গায় তাদের সবারই প্রথম আসা। ঝুমুর ওদের দুজনের মেনু কার্ড নিয়ে এত গবেষণা দেখে বিরক্ত। ওদের কাজে বিরক্ত হয়ে না পেরে বললো ‘ তোমরা বসো, আমি হাত ধুয়ে আসছি। ‘
ঝুমুর উঠে গেছে ওয়াশরুমের দিকে। হাত ধোয়ার কথা বলে ফাহমানও সেদিকে গেছে। ফারুক আর হৈমন্তী ওরা ফিরলে যাবে। ঝুমুর ফোনটা বেসিনের থেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুচ্ছে। ফাহমান ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ঝুমুর দেখলো কিন্তু কিছু বললো না। ফাহমান তার দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে হাত ধুচ্ছে।
ঝুমুর এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ন্যাপকিনে হাত গড়িয়ে বললো ‘ এভাবে তাকিয়ে থাকার কারণ ? ‘
ফাহমান বললো ‘ কাউকে বলেছিলাম বাগান কন্যা রুপে সেজে এসো। কিন্তু মনে হচ্ছে আমার চাওয়াটা ভুল ছিল। একটু চাইতে গিয়ে বেশিই চেয়ে ফেলেছি। সে আবার আগুন রূপবতী কিনা তাই সামান্য শাড়ি পড়াতেও জান্নাতী হুর মনে হচ্ছে। ‘
ঝুমুর জবাব দিলো না তবে ফাহমানের দিকে তাকিয়ে হাসলো। বেসিনের কাছ থেকে ফোন হাতে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। বাফে সাইড থেকে নিজের প্লেট তুলে নিলো। এক পাশে অল্প পরিমাণে রাইস, আরেক দিকে তিন ধরনের সবজি আর এগ কারি। ফাহমানও পাশে দাড়িয়ে তার খাবারটা নিচ্ছিল। কিন্তু ঝুমুরকে মিট বল কারি মিস করে যেতে দেখে নিজ দায়িত্বে সেটা ঝুমুরের প্লেটে তুলে দিলো।
ফাহমানের কাজে বিস্মিত ঝুমুর বললো ‘ এটা কি করছেন ডাক্তার সাহেব ? ‘
‘ রূপবতীর যত্ন করছি। আমার মনে হয় তার একটু খাওয়া উচিত। শরীরে মাংস বলতে কিছু আছে বলে মনে হয় না। ‘ ফাহমান নিজের প্লেটে খাবার তুলতে তুলতে বললো।
‘ কিন্তু আমি রাতে অল্প খাবারই খাই। ভাত কম সবজি বেশি খাই। ‘ ঝুমুর কাতর কন্ঠে বলল।
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ বাগান কন্যা আমি জানি আপনি ভাত কম সবজি বেশি খান। কিন্তু আমার সঙ্গে চলতে হলে এত কম খেলে হবে না। বেশি খেয়ে অভ্যাস করুন কারণ আমি থাকলে আপনি না পারলেও আপনাকে বেশি খেতে হবে। আপনি মানুষ এতটুকু, আপনার ডায়েট না করলেও চলবে। ‘ শেষের কথাগুলো নিজের দুই আঙ্গুলের ইশারায় বললো ফাহমান।
বাফে সাইডে কয়েকজন ওয়েটার দাড়িয়েছিলেন ক্রেতাদের সুবিধার জন্য। একজন ঝুমুর আর ফাহমানের বার্তালাপ শুনে যে মিটিমিটি হাসছেন ঝুমুর সেটা লক্ষ্য করলো। সে ভীষন রকমের অসস্তিতে গুটিয়ে গেল। দ্রুত নিজের ডিশগুলো নিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে গেলো। নেওয়া শেষে ঝুমুরের পিছন পিছন ফাহমানও এগোলো। ওদের ফিরে যেতে দেখে হৈমন্তী আর ফারুক এগোলো।
ঝুমুর একমনে খাচ্ছে। ফাহমান খেতে খেতে তার দিকে নজর বুলাচ্ছে। রীতিমত একটু পরপর কাশিও দিচ্ছে। সবই আসলে ঝুমুরের মনযোগ আকর্ষণের পাঁয়তারা। তবে ঝুমুর বুঝলো না। ফাহমানকে এতবার কাশতে দেখে সে মুখ তুলে বললো ‘ কি ব্যাপার ? ঠান্ডা লেগেছে নাকি আপনার ? ‘
ফাহমান ভ্রু কুটি করলো। এই অবুঝ মেয়ে বুঝলই না ফাহমান সব তার মনযোগ প্রকাশের জন্য করছে। ফাহমান ভ্রু কুটি করেই বললো ‘ না কিছু না, লাগেনি আমার ঠান্ডা। ‘
ঝুমুর এবার গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললো ‘ এত কেশে কেশে আমার মনযোগ আকর্ষণের করার প্রয়োজন নেই। আপনি ডাকলে আমি সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিতাম। ‘
ফাহমান বুঝলো ঝুমুর অতও বোকা নয়। হয়তো বোকা মানুষটা সে নিজেই। বারবার না জেনেই ঝুমুর সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করছে। কি হয়েছে তার কে জানে। ফাহমান জানে না। সে শুধু এটা জানে সে এখন পুরোপুরি নিশ্চিত যে তার স্বপ্ন কন্যা ঝুমুর, হাসপাতালের সেই নূপুর কন্যা নয়। সে ছিল তার ক্ষণিকের মোহ যে ঝুমুরের অনুপস্থিতিতে মনে আসন পেতে বসেছিল। তবে মোহ যে বেশিদিন স্থায়ী হয়না সেটা ফাহমান ঝুমুর যখন তাকে আয়োজনবিহীন এই নীরব সন্ধ্যায় হিমেল হাওয়ায় দাড়িয়ে নিজের মনের কথা বলেছিল তখনই টের পেয়েছিল। সেই মুহূর্তে সে আবিষ্কার করেছিল তার হৃদয়খানা সারাদিন অজস্রবার শুধুই বাগান কন্যার নাম নেয়।
ঝুমুর দেখলো ফাহমান হারিয়ে গেছে তার ভাবনায়। ঝুমুর কিছু একটা মনে করে হাসলো। ফাহমান সেটা লক্ষ্য করলো। অবাক হয়ে বলল ‘ কি ব্যাপার হাসলে কেন ? ‘
ঝুমুর খেতে বলল ‘ কী ? ওহ… সে আপনি বুঝবেন না। ‘
ঝুমুরের কথায় ফাহমান চোখ দুটো বড় বড় করে ফেললো। তাচ্ছিল্য হেসে বললো ‘ কিহ!! আমি বুঝবো না ? ওই দেখো এই পিচ্ছি বলে কি আমাকে। তোমার কেন মনে হচ্ছে আমি বুঝব না ? তুমি যদি পিচ্ছি মানুষ হয়ে বুঝতে পারো তবে আমিও পারবো। বলো বলো কেন হাসছিলে ? ‘
ঝুমুর ঘাড় নাড়লো। বললো ‘ আমি মোটেই পিচ্ছি নই। যথেষ্ট বড় আমি। ‘
‘ হ্যাঁ এতটুকুই বড় তাইনা ? ‘ ঝুমুরের দিকে আঙ্গুলের ইশারায় দেখিয়ে বললো।
ঝুমুর ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। বললো ‘ হ্যাঁ, এতটুকুই বড়। ‘
ফাহমান রাগলো। বললো ‘ তুমি বলবে না ? ‘
‘ না ‘
ঝুমুরের স্পষ্ট উত্তরে ফাহমান আর কথা বাড়ালো না। ঝুমুরের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ঝুমুর বুঝলো ফাহমানের ঠিক পছন্দ হয়নি তার এড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু কিছু করার নেই। তাদের ভালো লাগা সবে পূর্ণতা পেয়েছে। এখনই সেই কথাটা বলে নিজেদের এই লুকোচুরি সম্পর্কের মাধুর্য্য আর গাম্ভীর্য নষ্ট করতে চায় না সে।
তবে ঝুমুরের এটা ভেবে ভালো লাগে যে তার আর ফাহমানের মধ্যে একটা হলেও তো মিল আছেই। দুজনেই ভাবনার গভীরে গিয়ে চিন্তা করে। যেকোনো ব্যাপারে চিন্তা করতে করতে তারা হারিয়ে যায় আপন খেয়ালে। তখন তাদের চিন্তাটা কোথাও না কোথাও গিয়ে ঠিকই একই সুরে গান বাঁধে।
ফারুক আর হৈমন্তী নিজেদের প্লেট নিয়ে এসে হাজির হয়েছে। ওদের আসার পর সবাই খেতে খেতে একসঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিলো। খাওয়া দাওয়া শেষে একসময় সকলে বিল মিটিয়ে বেরিয়েও এলো। ঝুমুর জানিয়েছে এত খেয়ে আপাতত সে ভারগ্রস্ত তাই সে বাড়ি অব্দি পায়ে হেঁটেই যাবে। তার এই কথায় অবশ্য কেউই আপত্তি করলো না কারণ খেয়ে তাদেরও শরীর ভার।
ঝুমুর চুপচাপ মানুষ। তাকে তেমন একটা কথা বলতে কখনোই দেখা যায় না। তার ধারণা বেশি কথা বলে নিজের বুদ্ধি ভ্রষ্ট করার চেয়ে অন্যের কথা মন দিয়ে শুনে তাদের পজিটিভ ভাইবগুলো নিজের মধ্যে ধারণ করা অনেক বেশি কাজের। তাই সে বলে কম শুনে বেশি। তার এই স্বভাবের জন্য কম বেশি অনেকেই তার উপর বিরক্ত। তাদের মধ্যে সবার আগে তালিকার প্রথমে ফারুকের নাম স্বর্ণাক্ষরে জ্বলজ্বল করছে।
ফারুক ভীষন কথা বলতে পছন্দ করে। বিভিন্ন ব্যাপারে আলোচনা করতে তার ভালো লাগে। তারমানে এই না সুযোগ পেলেই সে আবোলতাবোল বকে। বরং তার মুখ হতে নিঃসৃত প্রত্যেকটি কথাই মাথায় নেওয়ার মতো। ফারুক সুযোগ পেলেই ভালো ভালো শিক্ষণীয় মুভি,সিরিজ ঘেঁটে দেখে। ওগুলো থেকে ওর মনে যেসব কথা আসে সেগুলোই সে গুছিয়ে উপস্থাপন করে।
কিন্তু এই ক্ষেত্রে ফারুক মনযোগী শ্রোতার সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কথা বলবে এমন বক্তাও পছন্দ করে। ঠিক এই কারণেই ঝুমুরের নিশ্চুপ থাকা তার পছন্দ নয়। তাই সে ঝুমুরের সঙ্গে পারতপক্ষে এই ব্যাপারে কথা বলে না। যা বলার তাফিমকে বলে কারণ তাফিমের আবার পড়াশোনা বাদে বাকি সব ব্যাপারে একটু বেশিই আগ্রহ কিনা।
অন্যদিকে হৈমন্তী আবার চটপটে কথা বলা পাগলী। বক্তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কথা বলতে সে ওস্তাদ। যদিও ঝুমুরকে কিছু বলতে শুরু করলে ঝুমুর শুধুই হা হু করে কিন্তু তাতে হৈমন্তীর আপত্তি নেই। তার কথা বলতে পারলেই হলো। তাই অসাধারণ এই বক্তা ফারুককে পেয়ে সে তো মহা খুশি। মনের আনন্দে ফারুকের মুখে মুভি এক্সপ্লেনেশন শুনছে আর নিজেও কথা বলছে।
ফারুক আর হৈমন্তী যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেছে তখন ফাহমান ঝুমুর একে অপরের মাঝে দূরত্ব রেখে হেঁটে চলেছে। ফাহমানের মাঝে তখন আড়ষ্টতা। ঠিক কথা এগিয়ে নিতে সাহস পাচ্ছে না। ঝুমুর তার এই অসস্তি বহুক্ষণ যাবতই লক্ষ্য করছে। তাই কথাটা সেই এগিয়ে নিলো।
‘ তা আপনার নূপুর কন্যার মন খারাপ হবে না ? ‘
ফাহমান খানিকটা অবাক হলো। ঝুমুর এটা আবার কি বলছে ? নূপুর কন্যার মন খারাপ কেন হবে ? কি কারণে হবে ? ফাহমান বললো ‘ কি!! নূপুর কন্যার মন খারাপ কেন হবে ? ‘
‘ না মানে তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা পুরুষ অন্য এক মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে তাতে তার তো মন খারাপ হওয়ারই কথা। ‘
ঝুমুরের কথায় ফাহমান সুধালো ‘ তা উনার কেন মন খারাপ হবে ? তাছাড়া সে তো আমাকে চিনেই না। জানেও না। ‘
‘ চিনে চিনে, হয়তো আপনি জানেন না যে তার চোখে আপনিও এক সুদর্শন পুরুষ যে অন্যদের কাছে অচেনা,অজানা। ‘
ফাহমান চকিতে ঝুমুরের দিকে দৃষ্টি ফেললো। ঝুমুর তখন নিকষ কালো অন্ধকারে স্ট্রিট লাইটের আলোয় মিটমিটিয়ে হাসছে। ফাহমান দেখলো, চোখ ভরে দেখলো সেই হাসি। এই মিটমিটে হাসির মাঝেই লুকিয়ে আছে প্রতি নিয়ত তার হৃদয় ক্ষরণ করা অজস্র আর্তনাদ যা সময় অসময়ে হঠাৎই জেগে উঠে।
~চলবে ইনশাআল্লাহ্….