নূপুর বাঁধা যেখানে পর্ব-১২+১৩

0
1248

#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-১২
#মিফতা_তিমু

ভোরবেলা রোজকার অভ্যাস বশত ছাদে এসেছিল ফাহমান। ভেবেছিল শীতল সমীরণে বুক ভরে শ্বাস নিবে। কিন্তু সেগুরে বালি। মনে হচ্ছে এই মেয়ে তাকে বেচেঁ থাকতেই মেরে ফেলবে। কি সুন্দর নিজের সাজানো রাজ্যে কাদামাটি নিয়ে খেলতে নেমেছে। তার কপালে, গালে, নাকে, চিবুকে আর সমস্ত হাতে পায়ে কাদা মাটির বাস। অথচ সকালের স্নিগ্ধ রোদ্দুরে সে কি সুন্দর মাটি আর ফুল নিয়ে ফুলখেলি করতে নেমেছে।

ভাবছেন ফুলখেলি আবার কি তাইতো ? জল নিয়ে খেললে যদি সেটা জলখেলি হয় তবে ফুল নিয়ে খেললে তো সেটা ফুলখেলিই হবে। সে যাকগে এই কথা। ফাহমানের এখন বেশ রাগ লাগছে। এই মেয়েটা কি কিছুই বুঝে না ? কেন বারবার নিজের এই মায়াবী রূপ নিয়ে ফাহমানের সামনে এসে দাঁড়ায় ? সে কি চাইছে ফাহমানকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করতে ?

ফাহমান নিজেও নিজের কাজে, আচরণে অবাক। কি এমন আছে ওই মেয়েতে যে সে এভাবে বারবার তার প্রতিটা আচরণে মুগ্ধ হচ্ছে ? কেন বারবার তার কাজল পড়ানো চোখের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে ? কেন লম্বা চুলগুলোতে ঝুটি বেধে গালে, কপালে কাদা মেখে মিঠে রোদ্দুরে হাসতে থাকা ওই বাগান কন্যার ঠোট বাঁকানো হাসিতে মুগ্ধ হচ্ছে ?

ফাহমান চরমভাবে আতঙ্কিত। কোথায় হাসপাতালের সেই নূপুর কন্যাও তো সুন্দরী তবুও এই সাদামাটা ভিনদেশী মেয়ের প্রেমেই কেন পড়ছে সে ? নূপুর কন্যাকে পুরোপুরি দেখেনি ফাহমান। তাতে কি তার টানা টানা কাজলবিহীন চোখ তো দেখেছিল। যেই কন্যার চোখ এতটা নজরকাড়া হতে পারে তার সৌন্দর্য নিশ্চই প্রলয়ংকরী। তবে কেন সে আগুনকে ছেড়ে বারবার পানির প্রেমে পড়ছে ?

ফাহমান শুনেছিল প্রথমে দর্শনধারী তারপর গুণবিচারী। এই প্রবাদটা কম বেশি সকলেই মানে। তবে কেন তার বেলায়ই উল্টোটা হলো ? সে কেন সেই নূপুর কন্যাকে ছেড়ে তার কল্পনায় আঁকা নূপুর রুপী ঝুমুরের প্রেমে পড়ল ? কেন পারলো না নিজেকে আটকাতে এই ধ্বংসাত্মক প্রলয় হতে ? কেন স্বার্থপর বিবেকের প্ররোচনায় বারবার একই ভুল করছে ?

ঝুমুর তো সম্পর্কে ফাহমানের বন্ধুর ভাগ্নি। তার সঙ্গে ওর সম্পর্ক হওয়া উচিত মামা ভাগ্নির মতো। অথচ সে কিছুতেই পারছে না ঝুমুরকে সেই চোখে দেখতে। উল্টো বারবার তার মায়াবী চেহারার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। কাজল পড়ানো গভীর চোখ দুটোয় হারিয়ে যাচ্ছে। ফাহমান বুঝতে পারছে সে মাঝ দরিয়ায় ডুবন্ত অবস্থায় আছে। অথচ মন সেই কথা মানে না। মন তো বলে প্রেম ঘটা করে কখনও হয় না, সে তো ব্যাস হয়ে যায়।

কিন্তু ফাহমান বিবেকের দেওয়া যুক্তিই বা কি করে মেনে নেয় ? ঝুমুরের সঙ্গে ফাহমানের কোনদিক দিয়ে যায় ? ঝুমুর হয়তো বাংলাদেশে আছে, বাংলাদেশের সংস্কৃতি মেনে বড়ও হচ্ছে কিন্তু মনে প্রাণে তো সে আজও ভিনদেশী। কোরিয়ার মুক্তমনা স্বভাব তার মধ্যে কিছুটা হলেও আছে নাহলে তার জায়গায় অন্য কেউ হলে কাল কাধে হাত রেখে ডাকার জন্য ঠিক সবার সামনে চপটাঘাত করতো। তবে কেন তার প্রেমে এমন ডুবন্ত ধ্বংস প্রায় নৌকার মতো বারবার ডুবছে ফাহমান ?

ফাহমান জানে না তার সঙ্গে কি হচ্ছে তবে এটা বুঝতে পারছে খুব দ্রুত লাগাম না টানলে এই প্রেম শীঘ্রই তাকে ডুবাবে। ঠিক যেন তীরে এসে তরী ডোবা। অন্তত ফাহমান এই ভুলটা করতে পারবে না। এই যে এমন ধারার ভুল আর করা যাবে না ফাহমান এটা টের পাচ্ছে, এই ভাবনা ঠিকই উবে যাবে যখন ঝুমুর এসে দাড়াবে তার সামনে। ঠিক তখনই সে সব ভুলে ব্যস্ত হয়ে পড়বে ঝুমুরকে বিরক্ত করায়, ঝুমুরকে রাগিয়ে দেওয়ায়। কারণ সে স্বীকার না এলেও এটাই সত্যি যে রাগে লাল হয়ে যাওয়া ঝুমুরের মুখটা দেখার লোভ সে কিছুতেই সামলাতে পারে না।

লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। এই কথাটা যেন ফাহমান নিজ চোখে ফলে যেতে দেখছে। এইযে সে জানে ঝুমুরকে খোঁচাখুঁচি করা, তাকে রাগিয়ে দেওয়া তার নিজের জন্য ঠিক নয়। এতে সে ঝুমুরের মায়ায় আরও জড়িয়ে যাবে। অথচ সে পারছে না ঝুমুরকে রাগিয়ে দিয়ে তার ক্ষিপ্ত, উত্তপ্ত মুখ দেখার লোভ সামলাতে। এই লোভই তার জন্য মৃত্যুসম হয়ে দাড়াবে। এর ফলস্বরূপ তাকে ফাঁসির আসামীর মতোই প্রেম নামক দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে আজীবনের জন্য। তবুও ফাহমান জেনে বুঝেই সাবধান হবে না। নিজ পায়ে হেঁটে যাবে কণ্টক বিছানো প্রেমের ফাঁদের দিকে।

ঝুমুর কিছুক্ষণ শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ল। কিন্তু একসময় মনে হলো হাত দিয়ে করলে আরও দ্রুত হবে। ইতিমধ্যে তার পুরো মুখে মাটি লেগে গেছে। সে সূর্যের পানে চেয়ে মিষ্টি হেসে আবারও কাজে হাত দিল। এবার হাত দিয়েই মাটি খুঁড়তে শুরু করলো সে। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তেই সে ঘাড় ঘুরালো অন্যদিকে। তখনই তার চোখে চোখ পড়লো হৈমন্তীদের বাড়ির ছাদে দাড়ানো ফাহমানের। তাকে দেখে অজানা এক কারণে ঝুমুর কিঞ্চিৎ হাসলো।

ঝুমুরের নজরে ধরা পড়ে ফাহমান হঠকারিতায় করে বসলো এক অবিশ্যম্ভাবী কাজ। ঝুমুরের চোখে চোখ পড়তেই সে উল্টোদিকে ঘুরে হাঁটা দিল। ফাহমানের এহেন অদ্ভুত কাজে ঝুমুর যার পরণাই অবাক। এই লোকটার আবার হলো কি ? হঠাৎ ওকে দেখে এভাবে পালালো কেন ? কিছুদিন আগেও তো এমনই একজন তাকে দেখে পালিয়েছিল। সেদিনও কি সেই মানুষটা ফাহমান ছিল ? কিন্তু তাকে দেখে পালাবে কেন ? লোকটা তো উল্টো তাকে দেখলে খোঁচানোর চেষ্টা করে।

এত কেনর উত্তর জানেনা ঝুমুর কাজেই ওসবের উত্তর মাথা খাটিয়ে বের করার চেষ্টা করলো না। এত জটিল চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা অন্তত তার নেই। তার বিবেক বুদ্ধি এসব অপেক্ষা পড়ালেখায় ভালো চলে। কাজেই ঝুমুর তার এত এত কেনর উত্তর বের না করে কাজে মন দিলো। এমনিতেই তো আজ বাসে দেখা হবেই তাদের। দুজনে তো একই বাসে উঠে। কাজেই তখন নাহয় বোঝা যাবে লোকটার অমন ব্যবহারের কারণ কি।

দ্রুত পায়ে ঘরে এসে ঢুকলো ফাহমান। তার উঠতি নামতি নিশ্বাস এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। সে জানেনা ঝুমুরকে দেখা মাত্রই সে কেন এমন ভো দৌড় দিল। হয়তো সে চাচ্ছিল না তখন ঝুমুরের মুখোমুখি হতে। তাছাড়া ঝুমুরের ঠোঁটের কোণে ওই হাসি দেখা মাত্র ফাহমানের মনে হলো এই বুঝি দেখার ছিলো। শেষমেষ মেয়েটা ওকে নিজের প্রেমে ফেলেই ছাড়লো। এর থেকে বড় অন্যায় আর কিছু হতে পারে না। ফাহমানের এটা হলো নিজের সঙ্গে নিজের করা অন্যায়।

ফাহমান জানে ঝুমুরের সঙ্গে তার যায়না। ঝুমুর ধনী পরিবারের মেয়ে তার উপরে ভিনদেশী সেখানে ও তো সামান্য মধ্যবিত্ত এক এমবিবিএস ইন্টার্ন। ঝুমুরের সঙ্গে তার কিছুতেই যায় না। এ হলো বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর আহ্বান। না, ফাহমান পারে না জেনে বুঝে এই ভুল করতে। সে কিছুতেই পারে না ঝুমুরের সর্বনাশা প্রেমে সাড়া দিতে। কখনোই না…. মরে গেলেও না।

ফাহমান রোজকার মতোই খেয়ে দেয়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। সে সচরাচর কলেজ গেট থেকেই হাসপাতালে যাওয়ার বাস ধরে। অথচ আজ নিজের অজান্তেই কলেজ গেটের পরিবর্তে ধরলো হোসেন মার্কেটের রাস্তা। ফাহমান কখন এমনটা করলো সে নিজেই বলতে পারবে না। সে শুধু জানে যখন সে নিজেকে আবিষ্কার করলো হোসেন মার্কেটের রাস্তার ওপারে তখন সে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ঝুমুর তখন দাড়িয়ে ফাহমান হতে কিছুটা দূরে। তার পরনে স্কাই ব্লু রঙের ঢিলেঢালা লোনের থ্রী পিস। পায়ে কালো স্লিপার। কালো কুচকুচে কোমর অব্দি নেমে আসা চুলগুলো সাদা মুক্তোর মতো দেখতে পাথরের ক্লিপ দিয়ে মাঝে সিথি করে দুই দিকে কানের কাছে আটকে রাখা। কাধে ব্যাগ। ফাহমান হতভম্ব হয়ে সেই দিকে তাকিয়ে। সে আবিষ্কার করেছে আজ ঝুমুরের পরিধিত জামার সঙ্গে আকাশের রং পুরোপুরি মিলে গেছে। নীলচে আকাশের নিচে দাড়িয়ে নীলচে রংয়ের জামা পরনে ঝুমুর যেন স্বর্গ হতে নেমে আসা অনিন্দ্যপুরীর এক পরী।

ফাহমান ঝুমুরকে আপাদমস্তক লক্ষ্য করতে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে কখন ঝুমুর এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে সে টেরই পায়নি। তার হুস ফিরলো ঝুমুরের ডাকে। ঝুমুর তার চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো ‘ এই যে ডাক্তার সাহেব!! কোথায় হারিয়ে গেলেন ? ‘

—-

ফাহমান আর ঝুমুর দাড়িয়ে আছে বাসের সামনে কিন্তু ভিড়ের ঠেলাঠেলিতে এগোতে পারছে না। ফাহমান এগোচ্ছে না বলেই ওকে ফেলে ঝুমুর এগোতে পারছে না। এতে ঝুমুরের রেগে যাওয়ার কথা কিন্তু সে রেগে না গিয়ে বরং ফাহমানের দিকে তাকিয়ে তার নির্বুদ্ধিতায় এবং হঠকারিতায় হাসছে। হাসতে হাসতেই সে ফাহমানের বাম হাতের কব্জিতে হাত রেখে এগোলো। ব্যস্ত গলায় বললো ‘ এইযে দেখি সাইড দেন। ‘

মেয়েলি গলা পেয়ে উত্তপ্ত জনতা তখন চোখ মেলে, দূরে সরে দাঁড়িয়েছে। ঝুমুর বাসে উঠে গেছে কিন্তু ফাহমান তখনও তার দিকে তাকিয়ে। লোকজন তাকে ঠেলছে কিন্তু সে এগোনোর সাহস পাচ্ছে না। তার বিশ্বাস হচ্ছে না ঝুমুর এখনও তার হাত ধরে দাড়িয়ে আছে। তাকে এভাবে নিশ্চল হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বাসের কন্ডাকটর রাগলেন বোধকরি। তিনি বেশ ঝাঁঝালো গলায় বললেন ‘ এই যে মিয়া উঠলে উঠেন নাহলে আপনার জন্য তো কেউ উঠতে পারছে না। ‘

ফাহমানকে ঠেলাঠেলি করে উত্তপ্ত জনতা এগিয়ে গেছে। ঝুমুর তখনও সাইডে দাড়িয়ে। হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে তাকে ইশারায় উঠতে বলছে। ফাহমান দেখলো ঝুমুরের হাতে গুটিকতক ব্রেসলেট। যদিও এরকম একসঙ্গে এতগুলো ব্রেসলেট একমাত্র ঝুমুর বিনা আর কাউকে পড়তে দেখেনি তবে অতগুলো ব্রেসলেট পড়ুয়া ঝুমুরের নিটোল হাত যেন অন্যরকম সুন্দর। ফাহমান ঝুমুরের দিকে মুখ তুলে তাকালো। ঝুমুর এখনও আশা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

কন্ডাকটর এবার বললেন ‘ ভাই আপনি উঠলে উঠেন নাহলে আমরা বাস ছাইড়া দিতাছি। এইসব প্রেম পিরিত আপনারা বাড়ি যাইয়া কইরেন। ‘
ঝুমুর এবার ফাহমানের হাত টেনে ধরে বললো ‘ কাম অন ডক্টর, এটাই শেষ সুযোগ। এরপর কিন্তু আবারও এরকম সুযোগ নাও পেতে পারেন। ‘

হঠাৎ বাসের তীব্র ঝাঁকুনিতে ফাহমানের অগভীর ঘুম ভেংগে গেল। সে ঝুমুরের কাধে মাথা রেখে হেলে পড়েছিল। অপ্রস্তুত সে ধীরে সুস্থে উঠে বসলো। তারমানে এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্নও বুঝি এত সুন্দর হয়। এত সুন্দর স্বপ্ন হলে এমন স্বপ্ন সে রোজ দেখতে চায়।

ঝুমুর ফাহমানকে জেগে উঠতে দেখে বললো ‘ এভাবে বাসে উঠেই ঘুমিয়ে পড়লে সফল ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে। সত্যি আর হবে না। ‘
ঝুমুরের কথার ধরনে না হেসে পারলো না ফাহমান। রুক্ষ ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে উঠলো। এই মেয়ে কিনা তাকেই তার বলা কথা শুনিয়ে দিচ্ছে। সাহস কত। ফাহমান বললো ‘ আমার কথা আমাকেই শুনিয়ে দিলে ? তোমাকে যতটা বোকা ভেবেছিলাম অত বোকা নও। ‘

বিপরীতে ঝুমুর চমৎকার ভাবে হাসলো। বললো ‘ টিট ফর ট্যাট মিস্টার। নারী জাতিকে যদি আপনি বোকা ভেবে থাকেন তাহলে আপনি সবথেকে বড় ভুল করবেন। এবার করেছেন করেছেন। এই ভুল আর দ্বিতীয়বার করতে যাবেন না। তাহলেই ধরা খাবেন। মেয়েদের মাথা মাথা নাকি গোলক ধাঁধা সে আপনি সারাজীবন তপস্যা করলেও বুঝবেন না। ‘

ফাহমান কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইলো সেই নজরকাড়া হাসির দিকে। ঝুমুর লক্ষ্য করলো। কালকের মতোই আবারও জিজ্ঞেস করলো ‘ আপনি যখনই আমাকে দেখেন তখনই আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। এত কি দেখেন আপনি ? ‘
ফাহমান কালকের মতোই আজও বললো ‘ তোমাকে ‘।
তবে আজ ঝুমুর থমকালো না। সে ভেবেই ছিল কালকের মতোই আজও ফাহমান একই কথা বলবে। তাই সে বললো ‘ আমাকে এত দেখবার কারণ ? রোজই তো দেখেন। তাও মন ভরে না ? ‘

‘ সে তো জানি না ‘

‘ তাহলে কি জানেন ? ‘

‘ সেটাও জানি না ‘

ঝুমুর হাসবে না কি করবে বুঝলো না। সে বাসের জানালায় হাত রেখে আঙ্গুল ঠেকালো কপালে। ভাবলো কি বলবে এই লোককে। সে ভালই বুঝতে পারছে ফাহমান উত্তর না দেওয়ার জন্যই এড়িয়ে যাচ্ছে। ফাহমান আড়চোখে দেখছিল ঝুমুরকে। ঝুমুরকে জানালার উপর হাত রাখতে দেখে সে ঝুমুরের হাত টেনে ধরলো। ঝুমুর ওর হাত টেনে ধরাতে ফাহমানের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।

ফাহমান ঝুমুরের সন্দিহান দৃষ্টি দেখে বললো ‘ বাসে উঠে কখনও এভাবে জানালায় হাত রাখবে না। যারা চোর আছে তারা হাত কেটে হাতের গয়না চুড়ি ব্রেসলেট ছিনতাই করে নিবে। ‘
ঝুমুর কিঞ্চিৎ চমকালো। বিস্মিত গলায় বললো ‘ কিন্তু আমি তো হীরে জহরত বা সোনার চুড়ি পড়িনি। ‘
উত্তরে ফাহমান বললো ‘ যে চুরি করার সে দুই টাকার অর্নামেন্টসও চুড়ি করবে। ‘

ফাহমানের কথায় যুক্তি খুঁজে পেলো ঝুমুর। কথাটা মেনে নিয়ে এবার তার আকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নটা করলো। এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য সেই থেকে অপেক্ষা করছে সে। বললো ‘ আচ্ছা আপনি আমাকে দেখলেই পালিয়ে যান কেন ? ‘
প্রথম দফায় ঝুমুরের কথার মানে ধরতে পড়লো না ফাহমান। সে আবার কখন পালালো। তাই সে বললো ‘ আমি আবার কখন পালালাম ? ‘

ঝুমুর বললো ‘ ঐযে আজ সকালে যখন আমি বাগান থেকে আপনার দিকে তাকিয়েছিলাম তখন আপনি আমাকে দেখা মাত্রই দ্রুত হেঁটে বেরিয়ে গেছিলেন। এরকম আগেও একদিন এমন করেছেন, আমি দেখেছি। ‘
ফাহমান এবার বুঝল ঝুমুর সকালের কথা বলছে। সে আমতা আমতা করে বলল ‘ ওই…. ওই জরুরি এক কাজ মনে পড়ে গেছিলো। ‘

‘ দুদিনই আপনার জরুরি কাজ মনে পড়েছিল ? স্ট্রেঞ্জ!! ‘
ফাহমান বুঝলো ঝুমুর তার কথায় আপাতত বিশ্বাস করেনি। তবে তার আর কোনো উত্তর দেওয়ার ইচ্ছা নেই। কাজেই সে কানে ইয়ারফোন গুঁজে চোখ বুজলো। ঝুমুর দেখলো ফাহমানের চোখ বন্ধ তাই সেও উপায় না পেয়ে সিটে গা এলিয়ে দিল।

~চলবে ইনশাআল্লাহ্….

#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-১৩
#মিফতা_তিমু

ঝুমুর ভেবেছিল ফাহমানের কাছ থেকে কোনো না কোনো ভাবে তার পেটের কথা উগড়াবে। কিন্তু সেগুরে বালি। ফাহমান কিছু তো বললোই না উল্টো মুখে কুলুপ এঁটে কানে ইয়ারফোন গুঁজে বসে রইলো। প্রশ্নের উত্তর না দিক অন্তত কথা তো বলবে। কিন্তু সেটাও বলছে না। এমন ধারার লোক ঝুমুর আগে তো দেখেনি। বাংলাদেশের সব মানুষ কি একই ? কে জানে। ঝুমুর বিড়বিড় করে বললো ‘ মিচিননোম(পাগল লোক) ‘

ফাহমান কানে ইয়ারফোন তো গুজেছে কিন্তু তার মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু তো ঝুমুরই। ঝুমুরের গা দিয়ে ভেসে আসছে এক তিতকুটে মিষ্টি সুগন্ধি। খুবই মন মাতানো সেই ঘ্রাণ। ফাহমানের বড্ড চেনা এই সুগন্ধী। এই সুগন্ধিতে ফাহমানের খুবই খারাপ অনুভূতি হচ্ছে। দমবন্ধকর ভালোলাগাময় সেই অনুভূতি। ফাহমানের মনে হচ্ছে সে বুঝি দমবন্ধ হয়ে মারাই যাবে এই ভালো লাগায়।

আবার ভালোলাগার সঙ্গে মিশে আছে চেনা অচেনা এক অন্যরকম অনুভূতি। এই সুগন্ধি ফাহমানের চেনা চেনা লাগছে। আগেও এই সৌরভ পেয়েছে সে। কার কাছ থেকে ? মানুষটা হাসপাতালের সেই নূপুর কন্যা। কিন্তু সে তো তাকে মাত্র ওই একবারই দেখেছিল তাহলে এখনও কেন সেই সুবাস তার নাকে লেগে আছে ? সে কি অনেক কাছ থেকে দেখেছিল বলেই কি। কি আশ্চর্য!! দুজনের ব্যবহারিত সুগন্ধির ঘ্রাণ একই কেন ? তবে কি দুজনের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে ?

প্রথমে ফাহমানের মনে হয়েছিল ঝুমুর আর ওই নূপুর কন্যার সুগন্ধির ঘ্রাণ যখন এক তারমানে দুজনের মধ্যে কোনো না কোনো যোগাযোগ আছে। পরমুহূর্তেই মনে হলো জগতে তো একই ঘ্রাণের সুগন্ধি ব্যবহার করা কত মানুষই আছেন। তারমানে কি তাদের সবার মধ্যে যোগাযোগ আছে ? এই দুই নারীর কথা ভাবতে ভাবতে ফাহমান নির্ঘাত পাগল হয়ে যাচ্ছে। নাহলে এমন একটা অভাবনীয় কাল্পনিক চিন্তা সে কি করে করলো ? নাহ্ কিছুতেই ওদের নিয়ে আর ভাবা যাবে না। না না…. না, না। মরে গেলেও না। এটা ফাহমানের নিজের কাছে নিজের প্রতিজ্ঞা।

কিন্তু এই প্রথম ফাহমানের মনে হলো সে নিজেকে নিজে দেওয়া প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারবে না। পারবে না সে ঝুমুর কিংবা নূপুর কন্যা কাউকে ভুলতে। সে প্রতি মুহূর্ত ঝুমুরকে নিয়ে ভাবছে। আর যখনই সে ভাবছে তখনই আচানক ঝুমুরকে ঘিরে নূপুর কন্যাও তার মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ শুরু করছে।

এ যেন এক গোলক ধাঁধা। ফাহমান যাকেই ভুলতে চাইছে সেই অপর জনকে পুঁজি করে আবারও মস্তিষ্কে খুঁটি গেড়ে বসছে। আবার দুজনকেই ভুলতে চাইলেও বিপদ। কেউ না কেউ তার মস্তিষ্কে ঠিকই খাপটি মেরে লুকিয়ে থাকছে। অপেক্ষা করছে সুযোগ বুঝে কোপ কেড়ে ফাহমানকে নাজেহাল করার। এখন এই পরিস্থিতিতে ফাহমান করবে তো করবে কি ?

ফাহমানের এই প্রথম মনে হলো ওসব টিভি সিরিয়ালের ডেইলি সোপের কাহিনীর মতো যদি কেউ তারও অ্যাকসিডেন্ট করিয়ে মেমোরি লস করিয়ে দিত তাহলে কতই না ভালো হতো। অন্তত এক মস্তিষ্কে দুই নারীকে ঘিরে চিন্তা করার জন্য নিজেকে চরিত্রহীনের তকমা তো দিতে হতো না।

অবশ্য দোষটা তো তার নিজেরই। কি প্রয়োজন ছিল অতগুলো মেয়ে ছেড়ে শেষমেষ নূপুর কন্যা কিংবা ঝুমুরের মাঝেই মুগ্ধ হতে? চাইলে অন্তত একজনকে সেই চোখে দেখতে পারতো। কিন্তু কি আশ্চর্য!! একটা মানুষ কি করে একসঙ্গে দুটো মানুষের প্রতি মুগ্ধ হতে পারে ? কি করে পারে দুজনের প্রতিই দূর্বল হয়ে যেতে ?

ফাহমানের মনে হলো সে নির্ঘাত ভবিষ্যৎ প্লে বয় হতে চলেছে। ইতিহাসের পাতায় তার নাম লেখা হবে স্বর্ণাক্ষরে। পরিচিত হবে সে চরিত্রহীন এক প্রেমিক হিসেবে। যে একসঙ্গে দুটো প্রেমিকাকে নিজের উদার মন দান করেছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ কি বিতিকিচ্ছিরি কান্ড। এমন দিন দেখবার আগে মৃত্যু কেন হলো না ? নিজ চরিত্রে এ কি কলঙ্ক লেগে গেলো ? এমনটা কেন শুধু তার সঙ্গেই হলো ? কেন তাকেই আক্রমণ করে বসলো ?

চারিত্রিক এই দূর্বলতার কারণ নিশ্চই ফাহমানের পুরুষালি মন। ফাহমান জানে পুরুষরা স্বভাবত উদার। ফাহমানের মন নিশ্চই একসঙ্গে দুই তিন জনকে মন দেবার মতো বড়। কি নিম্ন মানসিকতার চিন্তা ভাবনা। ও গড প্লিজ সেভ মি বলতে বলতে ফাহমান ঝুমুরের পাশ হতে সরে গেলো। নাহ্ এই দম্বন্ধকর ভালোলাগাময় অনুভূতি নিয়ে কিছুতেই ঝুমুরের পাশে আর বসা যাবে না। আর দুটো মিনিট যদি সে ঝুমুরের পাশে অবস্থান করে তবেই সব শেষ। এই বিচ্ছিরি ভালোলাগাময় অনুভূতির তরে সে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করবে।

ফাহমানকে আচমকা উঠে যেতে দেখে হতবাক ঝুমুর যখন বিস্মিত নয়ন মেলে ফাহমানের দিকে চেয়েছিল অসস্তিতে গাট হয়ে থাকা ফাহমান তখন পাশে দাড়িয়ে থাকা গর্ভবতী নারীকে বসার জায়গা করে দিলো। সে যে শুধু নিজের অসস্তির জন্য সরে দাড়িয়েছে তা তো নয়। পাশে এক গর্ভবতী নারী দাড়িয়েছিলেন। সে সুস্থ সবল এক পুরুষ মানুষ হয়ে যদি বসে থেকে এক অসুস্থ মহিলাকে দাড় করিয়ে রাখে তবে জগতে সে বিনা শ্রেষ্ঠ কাপুরুষ আর কেউ নয়।

মহিলা ফাহমানের এই উদারতায় খুশি হলেন। ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে ধন্যবাদ জানালেন। ফাহমান বিপরীতে কিছু বললো না তবে কৃতজ্ঞতায় নুয়ে আসা সেই রমণীর হাসি দেখে প্রশান্তি অনুভব করলো।

এতক্ষণ স্তম্ভিত নয়ন মেলে ফাহমানকে দেখছিল ঝুমুর। তবে ফাহমানের এই উদার মানসিকতার পরিচয় পেয়ে সে তৃপ্ত। সে ধারণা করেছিল ফাহমান উদার মনের ভালো একটা মানুষ। কিন্তু মানুষটা যে এত ভালো তার জানা ছিল না। আজকালকার সময়ে যেখানে মানুষ নিজের স্থান শক্তপোক্ত হাতে ধরে রাখতে ব্যস্ত সেখানে ও নিজ থেকে সরে গিয়ে এই অসুস্থ মহিলাকে জায়গা দিলো। এরকম মানুষ হয়তো খুঁজতে গেলে চিরুনি তল্লাশি চালাতে হবে।

ফাহমান বাসের হাত রাখার জায়গায় ধরে দাড়িয়েছিল। মনযোগ দিয়ে দেখছিল ঝুমুরকে। ঝুমুরের চোখ মুখে শ্রাবণ দিনের রোদ মেঘ খেলা চলছে। কখনও মন খারাপ করছে তো কখনও হাসছে। আর ফাহমান এক দৃষ্টে সেই মেঘ মেদুর রৌদ্রোজ্জ্বল খেলা দেখছে। ফাহমান জানে এটা তার জন্য অনুচিত। তবুও তার ভালো লাগে ঝুমুরকে দেখতে। আবার একই সময় চোখে ভাসে হাসপাতালের সেই নূপুর কন্যার টানা টানা চোখ। এই দুর্মূল্যের বাজারে দাড়িয়ে ফাহমান এক হৃদয়ে দুই নারীকে স্থান দেয় কি করে ?

—-

কোচিং শেষে বাড়ি ফিরে বই খাতা নিয়ে বসেছিল ঝুমুর। আজ কোচিংয়ে দেওয়া লেসনগুলো দেখে নেওয়াই উদ্দেশ্য। সেই কাজে একসময় ইস্তফা পড়লো যখন কাজের মাসী সরলতা দেবী এসে হাজির হলেন। সরলতা অনেক বছর ধরেই ছুটা কাজের লোক হিসেবে কাজ করছেন এই বাড়িতে। ঝুমুরকে সেই ছোট থেকে দেখছেন তিনি। সেই হিসেবে উনার ঝুমুরের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হওয়ার কথা। কিন্তু তাদের সম্পর্ক সেরকম তো নয়ই বরং একজন আরেকজনকে সহ্য করতে না পারার মতো সম্পর্ক। এখন এর পিছনে আসল কারণ কি সেতো সময় এলেই বুঝা যাবে।

সরলতা দেবী ফারুকের ঘর মুচ্ছিলেন। ঝুমুর ফারুকের ঘরের পালঙ্কের উপর বসে বসে সরলতার কাজ দেখছিল। এটা ঝুমুরের বাজে অভ্যাস বলা যায়। মনোয়ারা বেগম যখনই তাকে সরলতা দেবীর কাজ দেখার দায়িত্বে রেখে যান তখনই সে আঠার মতো সরলতা দেবীর পিছনে লেগে থাকে। ঘরের প্রত্যেকটা কোণায় পাই টু পাই পরিষ্কার করায় সে। নিজের দায়িত্বে গাফিলতি তার মোটেই পছন্দ নয়। মনোয়ারা বেগম যেন ভাবতে না পারেন ঝুমুর নিজের কাজে গাফিলতি করেছে।

এইদিকে ঝুমুরের এই পিছনে লেগে থাকায় সরলতা দেবীর কোনো সমস্যা না থাকলেও তার আশেপাশে কেউ থাকলে অযাচিত আলাপ জুড়ে দেয়ার এক বাতিক তার ভয়াবহ রকমের আছে। আর ঝুমুরের এই জিনিসটাই একেবারে পছন্দ নয়। হ্যাঁ এটা ঠিক যে সে বলে কম শুনে বেশি। কিন্তু আজগুবি, অযাচিত, অসংলগ্ন কথাবার্তা তার মোটেই পছন্দ নয়। আর ঠিক এই কারণেই সে সরলতা দেবীকে মুখের উপর বলে দেয় যেন এসব তার কানে না তুলে। কিন্তু সরলতা দেবী কি আর সেটা শোনার মানুষ। সেও কটা শক্ত কথা শুনিয়ে দিয়ে আবারও যেই কি সেই। পুরনো বিষয় ছেড়ে নতুন বিষয় নিয়ে আলাপ শুরু করেন।

ঝুমুর পালঙ্কের উপর বসে সরলতা দেবীকে ফারুকের পিসি টেবিলের নিচে ভালোমত মোছার কথা বলছিলো। সরলতা দেবী বেশি কথা বলেন ঠিকই কিন্তু ঝুমুরের এত নখরা সহ্য করে ঘর ভালোমত মুছে সাফ সুতরাও করে রাখেন তিনি। নাহলে ঝুমুরের এই অতিরিক্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য তো কেউ এই বাড়িতে কাজও নিতে চায় না। তাদের পছন্দ নয় ঝুমুরের কাজের মাঝে বারবার এই জায়গা, ওই জায়গা মুছতে বলার ব্যাপারটা। কিন্তু সরলতা দেবী অন্যরকম। তাই উনাকে চাইলেও বাদ দেওয়া যায় না।

ঝুমুরের দেখানো জায়গায় মুছতে মুছতে সরলতা দেবী বললেন ‘ আর বইলো না দিদিমণি। তোমার মামী মা আছে না ? মহিলা এক্কেরে পরিষ্কার না। কাল দেখলাম সামি বাবার ট্রাউজারখান ফালাই রাখছে। পরে তোমার আপি তুলিল সেই ট্রাউজার আর তোমার মামী মারে বকতে বকতে কাপড় ভিজাইলো। মাঝে মাঝে তোমার আপির লেইগা পরাণডা বড্ড পুড়ে আমার। মানুষটা একটা মনমতো বউও পাইলো না। তোমার মামা তো বিদেশে আছে আরেক বউ বাচ্চা লইয়া। এইদিক দিয়া প্রথম আকাইম্মা বউরে ফালায় গেছে মায়ের ঘাড়ে। ‘

ঝুমুর প্রথমে ভেবেছিল সরলতা দেবীকে কিছু বলবে না। কিন্তু মহিলা দেখি তার একা থাকার সুযোগ নিয়ে তাদের পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাচ্ছেন। পারিবারিক ব্যাপারে বাইরের মানুষের নাক গলানো মোটেই বরদাস্ত করতে পারে না ঝুমুর। তাই কিছুটা রুক্ষ গলায় বললো ‘ এইসব বলে লাভ নেই দিদিমা। আপনি ভালো করে জানেন আমি আমার ফ্যামিলি মেম্বার নিয়ে বাহিরের কারোর কথা বলা পছন্দ করিনা। তাছাড়া আমার পরিবারের নামে আমার কাছে সমালোচনা করে যদি ভেবে থাকেন আমায় উসকে দিবেন তবে ভুল ভাবছেন। কে পরিষ্কার আর কে অকর্মা এসব জানতে আমি আগ্রহী নই। আমার নিজের চোখ আছে দেখার জন্য। ‘

ঝুমুরের কড়া বাক্যবাণ শুনলেন মহিলা তবে থামলেন না। ঠেস মেরে বললেন ‘ তুমি তো হেইডা বলবাই। তোমার মামা মামীর কাহিনী তো তুমিও জানো। হেই বাচ্চাকাল থেইকা তুমগো বাসায় কাম করি আমি। তুমগো লেইগা বিয়াথা করিনি। আর তুমি আইসো আমারে এইডা বলতে যে আমি বাইরের মানুষ। এই কথাখান আমি তোমার আপিরে কমু। ‘

‘ কথা আমি কি জানি না জানি সেটার না। কথা হলো আপনি যে কেন এতকাল বিয়ে করেননি সেটা আমিও জানি। আমার মুখ খুলাবেন না দিদিমা। তাছাড়া আপনি চাইলেই বলতে পারেন আপিকে। আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার মনে হয়না আমি ভুল কিছু বলেছি। ‘

সরলতা দেবী আর এই ব্যাপারে কোনো কথা আগালেন না। তবে গাইগুই করে তাফিমের অভিযোগ তুলে ধরলেন। ঝুমুর সেই বেলায়ও বললো সে জানে তার ভাই বোনেরা কে কি করে কাজেই তাকে অন্য কারোর জানানোর প্রয়োজন নেই। এভাবেই একেক সময় সরলতা দেবী একেকজনের ভুল ধরলেন আর একসময় ঝুমুর আবিষ্কার করলো আসলে সরলতা দেবীকে থামিয়ে লাভ নেই।

ব্যধিটা আসলে সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। সমাজ শিক্ষা দিচ্ছে আমরা নিজেদের রেখে বাকি সবার ভুল ধরবো। আর এই শিক্ষাই যুগে যুগে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। এর থেকে কি কারোরই নিস্তার নেই ? ঝুমুর একা কখনোই পারবে না এর বিরুদ্ধে লড়তে। তাই আপাতত মুখ বন্ধ করে রাখাটাই শ্রেয় কারণ কথায় কথা বাড়ে।

সরলতা দেবী কাজকর্ম সেরে ঝুমুরকে জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তখন প্রায় বিকেল। ঝুমুর এর মাঝে খাওয়া দাওয়া করে নিয়েছে ঘন্টা খানেক আগে। তাই এখন স্কিপ করা এক্সারসাইজ করে নেওয়া যায়। ঝুমুর ঘরের দরজা লক করে চাবি সমেত চিলেকোঠার ঘরে উঠে এলো। তার পড়নে গ্রে টিশার্ট আর ব্ল্যাক ট্রাউজার। ঝুমুর লো স্পিডে ট্রেডমিল অন করে পা চালাতে শুরু করলো। একসময় গতির সঙ্গে তাল মিলাতে মিলাতে ঝুমুর ট্রেডমিলের স্পিড বাড়িয়ে দিল।

শীতের বিকেল শীতলতায় ছেয়ে থাকলেও এক্সারসাইজ করে ঝুমুর তার মাখনের মতো নরম শরীর দিয়ে অনেক ঘাম ঝরিয়েছে। ব্যায়াম করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। ব্যায়াম করে শরীরের ঘাম ঝরালে শরীরে জমে থাকা অতিরিক্ত মেদ কমে যায়। এতে শরীর হালকাও থাকে সঙ্গে মেজাজও ফুরফুরে থাকে।

ডিভানের উপর বসে গলায় জড়িয়ে রাখা টাওয়েল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিচ্ছে ঝুমুর। তার কালো কুচকুচে চুলের কিনার ঘেসে কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল। ঝুমুর উঠে দাড়ালো। এখন সবার আগে হট শাওয়ার নেওয়া দরকার। শাওয়ার নিলে শরীরটা হালকা লাগবে। আশা করি হেয়ার ড্রয়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিলে তার আর ঠান্ডা লাগার সম্ভাবনা থাকবে না। তাই ঝুমুর গলায় টাওয়েল জড়িয়ে এক হাতে ফোন আর আরেক হাতের আঙুলে উডেন ম্যাপেল লিফ কি রিং ঘোরাতে ঘোরাতে নিচে নামলো সিড়ি দিয়ে।

ঝুমুরের হাতে থাকা উডেন ম্যাপেল লিফ কি রিংটা ওকে ওর জন্মদিনে দিয়েছিলো হৈমন্তী। জিনিসটা তার নিজের হাতে বানানো। ঝুমুরের যেমন কিছু আশ্চর্যান্বিত গুণ আছে তেমনই হৈমন্তীরও আছে। হৈমন্তী আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট রিলেটেড জিনিসগুলোতে বেশ পারদর্শী। তাইতো ঝুমুরের ষোলো তম জন্মদিনে নিজ হাতে কি রিংটা বানিয়ে দিয়েছিলো। সেই থেকে এই রিং ঝুমুরের বড্ড প্রিয়। এই রিংটা দেখলে তার সুদূর জন্মভূমি কোরিয়ার কথা মনে পড়ে। যেখানে তার জন্ম হয়েছিল, যেখানে সে বাবা মায়ের সঙ্গ নিয়ে বেড়ে উঠেছিল।

~চলবে ইনশাআল্লাহ্…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে