নূপুর বাঁধা যেখানে পর্ব-০৩

0
1788

#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-৩
#মিফতা_তিমু

গাউসিয়াকে ঢাকার সবথেকে বড় মার্কেটই বলা চলে। কি নেই এখানে ? জামা কাপড় থেকে শুরু করে মেয়েদের সাজসজ্জা, গয়নাপাতি সবকিছুরই বিপুল সমারোহ আছে। এত মানুষের উপস্থিতিতে সবসময় গিজগিজ করে জায়গাটা। এই কারণেই ঝুমুরের এই জায়গা মোটেই পছন্দ নয়। তবুও আকাশ চুম্বি দামে অন্য জায়গা থেকে কেনার চেয়ে ন্যায্য মূল্যে কেনার দায়ে সে এখানে আসে।

ঝুমুর বরাবরই একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের। সবার সঙ্গে অত সহজে মিশে যেতে পারে না যতটা সহজে সে যেকোনো বইকে আপন করে নিতে পারে। বই হলো তার একমাত্র সঙ্গী যে তাকে কখনো নিরাশ করেনা। তার বিশ্বাস বইয়ের মতো করে তার মন কেউ বুঝতে পারে না। বই পারে তাকে হাসাতে, কাদাতে, তার খারাপ হয়ে যাওয়া মনকে ভালো করতে। তাই ঝুমুরের সবথেকে কাছের এবং প্রিয় বন্ধুর তালিকায় বই সর্বাগ্রে।

তবে হৈমন্তীও ঝুমুরের কাছের বন্ধু। প্রিয় সখীই বলা চলে। দুজনে একসঙ্গে সেই ক্লাস সেভেন থেকে যখন ওরা সবে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কলেজের সকলে তাদের এক নামে চিনে শুধুমাত্র তাদের বন্ধুত্বের জন্য। ঝুমুরের তেমন বন্ধু নেই। বলেই হয়তো তার বন্ধুত্বের তালিকায় স্থান পেয়েছে তার লাকি নাম্বার টু। প্রথম তার প্রাণপ্রিয় বই আর দ্বিতীয় নাম্বারে একসঙ্গে অবস্থান করছে হৈমন্তী, শাওমি। দুজন ড্র করে একই নাম্বারে থাকলেও ঝুমুর দুজনকেই ভালোবাসে তাই কেউ কারোর থেকে কোনো অংশে কম নয়। শুধু পার্থক্য একটাই, একজন কাছে আর আরেকজন দূরে।

শাওমি বয়সে ঝুমুরের তিন বছরের ছোট হলেও ওরা দুই জন পিঠাপিঠি বোন এবং একে অপরের সবথেকে ভালো বন্ধু। সাধারণত দেখা যায় পিঠাপিঠি বোনদের মধ্যে অনেক ঝগড়া,মারামারি হয়। কিন্তু ঝুমুর আর শাওমি সেই সুযোগটাই পায়নি। তারা একে অপরের সঙ্গে ছিলই বা কতদিন। শাওমি ঝুমুরের বয়সে ছোট ঠিকই কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঝুমুরের থেকেও সে বেশি বুঝদার।

শাওমির ভালো নাম নিঝুম তবে লোকে তাকে বেশিরভাগই শাওমি বলে সম্বোধন করে। শাওমিকে নিঝুম নামে তাসনুবা ডাকতেন কিন্তু সেই নামে এখন আর ডাকার মানুষটা নেই কাজেই কেউ আর ডাকে না। শাওমি নামে ডাকতেই তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

গাউসিয়াতে ঘুরে ঘুরে নিজের মনমতো কেনাকাটা করা অনেকটা কঠিন বলা যায়। এখানে এত এত দোকান যে কি রেখে কি কিনবে সেটাই ঠিক করা কঠিন। তাই এখানে কেনাকাটা করতে হলে মনোবল দৃঢ় নাহলে টাকা ফস্কে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
ঝুমুর কেনাকাটার ব্যাপারে বেশ খুঁতখুঁতে। যেটা তার মনমতো নাহয় সেটা সে দ্বিতীয়বার দেখার কথা চিন্তা করেনা। তার প্রিয় রং হলো মেরুন। তবে প্রিয় রঙকে সে অবসেশনে তৈরি করেনি। প্রিয়কে প্রিয়ই রেখেছে। কোনোকিছুই অতিরঞ্জিত ভালো লাগে না তার।

সমস্যা হলো ঝুমুরের পা সাইজে ছোট তাই তার মাপের স্লিপার খুঁজে পাওয়া কঠিন। ঝুমুর চেয়েছিল রাফ ইউজের জন্য দু তিনটে স্লিপার কিনে রাখবে তাহলে অন্তত তার সুবিধা হবে। এমনিতেই যেই সেই স্লিপার সে পড়তে পারেনা। পায়ে তার ফোস্কা উঠে। তাই একটু বাছবিচার করতে হয়।

অনেক দোকান খুঁজেও যখন ঝুমুর তার কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেলো না তখন তানিয়া শাহজাহান ওকে নিয়ে গেলেন আরেক শু শপে। আর সেখানেই খানিক বাছাবাছি শেষে ঝুমুর তার মনমতো জিনিসটা পেয়ে গেলো। কেনাকাটা নিয়ে সে সেরকম চুজি নয় তবে বাংলাদেশে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে বাছবিচার করে চলতে হয়। যেই দেশে আছে সেই দেশের রীতিনীতি মেনে চলবে এটাই স্বাভাবিক। বরং না মেনে চললে তখন পিছে হাজার লোক কথা বলবে। জুতো কেনাকাটা শেষে তানিয়া শাহজাহান আর ঝুমুর ড্রেস সেকশনের দিকে হাটা দিলেন।

—-

গাউসিয়া মার্কেটের সামনে এসেই এতকিছুর মেলা দেখে প্রচন্ড মেয়েলি স্বভাবের হৈমন্তী খুশিতে যেন ঝুমঝুমিয়ে উঠলো। ও ফাহমানকে তাড়া দিয়ে এগিয়ে গেলো মার্কেটের দিকে। ফাহমানও দ্রুত পা চালিয়ে মার্কেটে ঢুকলো। মার্কেটে আসার আগেই একটা ফিক্সড বাজেট নিয়ে এসেছিল হৈমন্তী। সেই বাজেটের মধ্যেই কেনাকাটা শেষ করতে হবে তাকে। তাই অতিরিক্ত কিছু কিনবে না এটাই মাথায় রেখেছে সে।

হৈমন্তীর জন্য ড্রেস কেনার ব্যাপারে সবটা পছন্দ ফাহমানই করলো। হৈমন্তীর ধারণা তার থেকেও ফাহমানের পছন্দ অধিকতর সুন্দর। তাইতো সে ফাহমানকে ধরে বেধে নিয়ে এসেছে নাহলে তার কেনাকাটা করতে গাউসিয়া সে একলাই আসতে পারে। ঠিক যেমনটা কথা হয়েছিল তেমনটাই করলো সে। নিজের সাধ্যের ভিতরেই পছন্দ মতো ফাহমানকে দিয়ে বেশ কিছু ভালো ড্রেস কিনিয়ে এক জোড়া স্লিপার কিনে নিলো।

তবে সবকিছু কেনাকাটা শেষেও হৈমন্তীর হাতে রয়ে গেছে বেশ কিছু টাকা। বেচে যাওয়া টাকা দেখে তার আর আনন্দ দেখে কে। সে ছুটেছে কানের ঝুমকো কেনার জন্য। আর তার কেনাকাটার সব ব্যাগ দুই হাতে নিয়ে বিরক্তিকর শব্দ করে পিছু নিচ্ছে ফাহমানও। এই এক বোন তাকে জ্বালিয়ে মারলো। তার জীবনটাই তেজপাতা হয়ে গেলো।

ছোটবেলায় অনেক শখ করে বোন চেয়েছিল ফাহমান। এখন সেই বোন চাইবার শাস্তি সে হারে হারে টের পাচ্ছে। একটা মাত্র বোন তবুও যেন হাড় মাস জ্বালিয়ে ছেড়েছে। ভাগ্যিস একটাই বোন, আরও হলে যে কি করতো কে জানে।
হৈমন্তী কয়েক জোড়া ঝুমকো, হাতের চুড়ি কিনে অবশেষে ক্ষ্যান্ত হলো। সবগুলো ফাহমানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে এবার মার্কেট থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে ছুটলো।

ঝুমুর যতই সিম্পলি থাকার চেষ্টা করুক না কেন দিনশেষে সেও মেয়ে মানুষ। হেভি মেকাপ কিংবা জুয়েলারি তার হয়তো পছন্দ নয় তবে সিলভারের লাইট অর্নামেন্টসের প্রতি তার মারাত্মক রকমের দূর্বলতা আছে। গাউসিয়া এলে যতবারই চোখে পড়ে ততবারই কেনার জন্য মনটা আকুপাকু করে। তখন বিবেকের দংশনে না কিনে আর পারা যায়না।

যার ভয় ছিলো তাই হলো। কেনাকাটা করে ফেরার সময় ঝুমুরের চোখে পড়লো সারি সারি দোকানের বাহিরে সাজানো ঝুমকোগুলোর উপর। ব্যাস আর লাগে কি। মনটা তো এমনিতেই তার দূর্বল। তার উপর প্যাকেট প্যাকেট ভালোবাসাগুলো দেখে তাকে আর আটকে রাখা গেলো না। তানিয়া শাহজাহানকে ফেলেই দ্রুত সে এগিয়ে গেলো দোকানের দিকে।

কিন্তু শুভ কাজে একটা না একটা বাধা তো থাকবেই। এবারও কালকের মতোই অচেনা এক লোকের সঙ্গে ধাক্কা খেল সে। ধাক্কা খেয়েই সর্বপ্রথম তার মাথায় যেই প্রশ্নটা এলো সেটা হলো তার হয়েছে কি ? রোজই কারোর না কারোর সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে। তাকে কি ধাক্কা খাওয়ার রোগে পেয়েছে ? স্ট্রেঞ্জ!!

ধাক্কা খেয়ে ফাহমান রমণীর মুখ খেয়াল করলো না। প্রচন্ড তাড়ায় আছে সে। হৈমন্তী ইতিমধ্যে মার্কেটের বাইরে চলে গেছে। এই বোনকে নিয়ে আর পারা গেলো না। এত চঞ্চল যে কি বলবে। তাই সে ‘ দুঃখিত ‘ বলে দ্রুত বেরিয়ে গেলো। ফাহমানের কথায় ঝুমুরও আর কথা বাড়ালো না। এমনিতেই গয়নাগুলোর জন্য তার মন উচাটন। এখন আর দেরি করা ঠিক হবে না।

অথচ দুজনের কারোরই জানা হলো না যাদের দেখাই হলো একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে তাদের ভবিতব্যটাও হয়তো বিধাতা এভাবেই জুড়ে দিয়েছেন। নিজেদের অজান্তেই তারা যেন বারবার একে অপরের মুখোমুখি হচ্ছে। একজন প্রথম দেখায়ই প্রেমে পড়ে যাচ্ছে তো আরেকজন এই দেখা দেওয়াকে নেহাতই কাকতালীয় ভেবে উড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আদৌ কি এ তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কাকতালীয় কিছু নাকি অযাচিত ভাবে দেখা পাওয়ার মাধ্যমেই প্রণয়ের শুরু ?

—-

সন্ধ্যার নাস্তা শেষে বই নিয়ে বসলো ঝুমুর। কাল কুরিয়ার থেকে বইয়ের পার্সেল দিয়ে গেছে। এবারে সে বিখ্যাত এক লেখিকার পাঠকপ্রিয় এক বই নিয়ে বসেছে। এর আগে তার অন্য একটা বই পড়েছিল। ওটা পড়েই এই লেখিকার লেখার প্রেমে পড়ে গেছে সে।

ঝুমুরের বই পড়ার জার্নি শুরু তিন বছর আগে থেকে। আগে বইয়ের প্রতি আগ্রহ থাকলেও সেটাকে ভালোবাসায় রুপ দিতে করেনি তেমন। কোরিয়া থাকতে মায়ের সঙ্গে লাইব্রেরী যেত সে। তবে কোরিয়া থেকে ফেরার পর বাংলা ভাষা রপ্ত করতে কষ্ট হয়েছে তার। বাংলায় কথা বলতে সে আগেই জানতো তবে লিখতে জানতো না।আলহামদুলিল্লাহ এই কবছরে সেটা আরও উন্নত হয়েছে। এখন সে ভালো গল্প লিখতে পারে। কখনও কখনও শখ করে ছোট ছোট অনুগল্পও লিখে রাখে। সেসব নিতান্তই সকলের অজানা ব্যাপার কারণ ওগুলো ঠাই পায় তার লুকিয়ে যত্নে রাখা দিনপঞ্জির পাতায়।

ঝুমুর একাধারে পড়াশোনায় আর বই পড়ায় মনযোগী। আসলে পরিবারের বড় সন্তান, বড় নাতনী হিসেবে তার কাছ থেকে সবার এক্সপেক্টেশন বেশি। তাই হয়তো সে তার নিজস্ব দুনিয়া গড়ে নিয়েছে বইয়ের রাজ্যেই। তার ধ্যান, জ্ঞান সবকিছুই বইকে ঘিরে।

কিন্তু একটা জিনিস ব্যতিক্রম। মাঝে মাঝে চিরচেনা নিয়মের বাহিরে বেরিয়ে ঝুমুর ঘুরে বেড়ায় তার কল্পনার আলিশান রাজ্যে। যেই রাজ্যে সে নিজেই নিজের দুনিয়ার রানী। সেখানে আছে তার জন্য এক রাজকুমার যার দেখা পাওয়া এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা। যখন সে দীপ্তিমান সূর্যের মতো উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে একসময় অভিমানী মেঘের মতোই বেহিসাবি অভিমানের পশলা সাজিয়ে কাদতে বসবে তখন বীর বেশে ঘোড়ার পিঠে চড়ে হাজির হবে সেই রাজপুত্তুর।

ঝুমুর নিয়মের শিকলে বেঁধে জীবন এগিয়ে নিতে পছন্দ করে। কিন্তু কোনো এক বৃষ্টি মুখর দিনে তারও ইচ্ছে করে বেহিসাবি হতে। হঠাৎ তারও নিয়মের শিকল ভাঙতে ভালো লাগে। ইচ্ছে করে নিয়মের বেড়াজাল ছিঁড়ে হারিয়ে যেতে অচেনা মানুষের ভিড়ে। যেখানে তার কাছ থেকে থাকবে না কারো অযাচিত কোনো আশা, থাকবে না কারোর প্রতিনিয়ত ভালো রেজাল্ট করার তাগিদ।

বই পড়তে ব্যস্ত থাকা ঝুমুর লক্ষ্য করলো তানিয়া শাহজাহান তার সামনে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ ধরেছেন। ও মিষ্টি হেসে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে কোমল কণ্ঠে ধন্যবাদ জানালো তার ইমোকে। সে নম্র স্বভাবের, কড়াকড়ি করা তার পছন্দ নয়। তার আচরণ যেমন নম্র তেমনই খাদ্যভাসও নম্র। কড়া চা ঝুমুরের পছন্দ নয়। ও হালকা জাল করে দেড় চামচ চিনি দিয়ে তানিয়া শাহজাহানের হাতে বানানো দুধ চা খেতে পছন্দ করে। এছাড়া সে নিয়মিত আদা চা খায়।

চা খেতে খেতে ঝুমুরের কানে কনকনে এই শীতে বাহিরে অবিরাম বর্ষণের আওয়াজ কানে এলো। ঝুমুর বই রেখে ধীর পায়ে উঠে গেলো জানালার কাছে। আস্তে করে থাই গ্লাসটা সরিয়ে দিলো। এখন বৃষ্টির ছোট ছোট ফোঁটা তার গায়ে এসে লাগছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে স্বল্প পরিসরে। বর্ষণের মনোমুগ্ধকর এই শব্দ আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো এক চেনা ঘ্রাণে ঝুমুরের অন্তঃকরণ শীতল হচ্ছে। বৃষ্টির গন্ধ নিয়ে শরীর জুড়ানো বুঝি একেই বলে। কিন্তু মন কাড়া এই বৃষ্টির শব্দে তার মনটা ক্রমশ বিরহের সুরে হারিয়ে যাচ্ছে। টের পাচ্ছে অদৃশ্য এক বিরহী বাতাস।

জানালার কাছে টেবিলে বসে থিসিস লিখছিল ফাহমান। মেডিক্যালে ভর্তি হবার পর প্রথম প্রথম তার খুব কষ্ট হতো। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটানা বাহিরে কাটাতে হতো। সারাদিন সিনিয়র ডক্টদের পিছনে ঘুরে তাদের ঝারিঝুরি খেয়েও হাসিমুখে সবটা মেনে নিয়ে মনের মধ্যে পুষে রাগ গুলো জমিয়ে ফেলতে হতো। দিনশেষে বাড়ি ফিরে ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসতো। তবুও ঘুমানো নিষেধ ছিল। কারণ তখন বসে বসে কলেজের পড়া যে করতে হবে।

এমন অনেক রাত গেছে যখন ফাহমান পড়ার চাপে ঘুমোতে পারেনি। আসলে লোকে ভাবে একবার ডাক্তার হতে পারলেই জীবনটা বিন্দাস চলে যাবে, কাড়ি কাড়ি টাকা শুধু পকেটে ভরবেই। কিন্তু কেউ আর এটা দেখে না ডাক্তার হতে গিয়ে মানুষটাকে যে ঠিক কত রাত না ঘুমিয়ে পড়তে হয়, কত দিন ক্লান্ত হয়েও থিসিস লিখতে হয়। তারা শুধু এমবিবিএসের ট্যাগ পাওয়ার পর উপরের দেখানো শান্তিটাই দেখে। ভিতর দিয়ে যে মানুষটাকে আরও কত কষ্টের জন্য এগিয়ে যেতে হবে সেটা আর কেউ দেখে না।

তবে এখন সেসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে ফাহমান। এখন আর তার কান্না পায় না, ঘুম আসলেও ঘুমকে কি করে তাড়াতে হয় সেটা সে জানে। তার ঘুম তাড়ানোর একমাত্র ওষুধ হলো এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা। ওটা পেলেই ফাহমানের আর কিছু লাগে না। এই বর্ষণ মুখর দিনে সে ওটারই অভাব বোধ করছিলো। কিন্তু তার অভিযোগ আফসোসে রূপ নেওয়ার আগেই মারিয়াম চা দিয়ে গেলেন।

চা পেয়ে আর আফসোস করে সময় কাটালো না ফাহমান। থিসিস পেপার তুলে রেখে জানালার থাই গ্লাস আরও বেশি করে খুলে দিল সে। এক হাত টেবিলের উপর রেখে আরেক হাত দিয়ে চায়ের কাপ মুখের সামনে ধরলো। বৃষ্টির ফোঁটা তার গায়ে এসে পড়ছে। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে চরম প্রকৃতি প্রেমী হওয়া সত্বেও তার নাকে চিরকালের বৃষ্টির সেই চিরচেনা ঘ্রাণ লাগছে না। বরং কোথা থেকে এক তিতকুটে মিষ্টি লেবু ফলের গন্ধ ভেসে আসছে।

লেবু ফলের গন্ধ!! অদ্ভুত, যখনই ফাহমান জানালার কাছে এসে দাঁড়ায় তখনই এই গন্ধটা নাকে আসে তার। অথচ সামনে থাকা বাগানে যেই লেবু ফলের গাছ আছে সেটা দেখে মনে হয়না এত ঘ্রাণ ছড়াতে পারে। ফাহমান হাসলো। ভাগ্যিস এটা শুধুই ফলের ঘ্রাণ। কেউ যদি এই ঘ্রাণ শরীরে মাখে তাহলে কি বিদঘুটে পরিস্থিতিটাই না হতো।

—-

পরেরদিন সকালেও ঝুমুরের ঘুমটা রোজকার মতোই ভোরবেলা ভেঙে গেলো। সে উঠে বসল, কম্বল গুছালো তারপর রুম পরিপাটি করলো। সবশেষে এলো চুলগুলো আঁচড়াতে বসলো। চুলের জট ছাড়িয়ে লম্বা চুলগুলো বেণী করে নিলো। তারপর রাতের জামা বদলে ফেললো। জামা বদলে সে লং সোয়েট শার্ট আর ট্রাউজার পড়ে গলায় স্কার্ফ ঝুলিয়ে হাতে এক কাপ চা নিয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।

ঝুমুর সাধারণত বাগানে কিংবা ছাদে গেলে নগ্ন পায়ে যায়। খালি পায়ে ইট কংক্রিটের মেঝে আর ভেজা মাটিতে হাঁটতে তার খুব ভালো লাগে। কিন্তু তার মানে এই না সে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা মানে না। সে সবসময় নিট অ্যান্ড ক্লিন থাকে। তবে ওদের বাড়ির ছাদে যেতে সিড়িগুলো পরিষ্কার থাকলেও তানিয়া শাহজাহানের বাড়ির সিড়ি পরিষ্কার নয়। সবাই তো আর এক নয়।

পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারটা ব্যক্তি ক্ষেত্রে ভিন্ন রকম হয়। ঝুমুর এই জিনিসটা খুব ভালো মতোই বুঝে। যেটা তার পছন্দ হতে পারে সেটা অন্য কারোর পছন্দ নাও হতে পারে। তাই নিজের মতামত সে কোনওদিন অন্য কারোর উপর চাপিয়ে দেয় না।

প্রকৃতি দেখতে দেখতে হাতের ঘড়িতে নজর দিলো ঝুমুর। এখন তার নিচে নামার সময় হয়ে গেছে। দ্রুত খেয়েদেয়ে তাকে বেরিয়ে পড়তে হবে। কুরিয়ার অফিসে যাওয়া প্রয়োজন। এবার সে বইয়ের পার্সেল ক্যাশ অনে নেয়নি যাতে কুরিয়ার অফিস অব্দি নিজে হেঁটে গিয়ে নিয়ে আসতে পারে। আসলে একটু হাঁটাহাঁটি করলে শরীর, স্বাস্থ্য দুইই ভালো লাগবে।

~চলবে ইনশাআল্লাহ্….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে