নীলফড়িং পর্ব-১৩

0
241

#ফারহানা_হাওলাদার_প্রকৃতি
#নীলফড়িং
#পর্ব ১৩
.
.
বিকেল দিকে সবার সাথে বসে হাসি-ঠাট্টা করছিলাম। ঠিক তখনই মা এলো রুমে সাথে, স্যারের বাড়ি থেকে কিছু মেহেমান। মেহেদির থালা সাজিয়ে নিয়ে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। তারাও বেশ ভালো ভাবেই উত্তর দিল। তারা আমার পাশে এসে বসে নানান ধরণের প্রশ্ন করতে রইল। মা খালামণি তাদের জন্য স্ন্যাকস এনে দিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে তারা চলে গেলেন বিদায় নিয়ে।

সন্ধ্যায় আমাকে লালের মধ্যে সবুজ সুতোর কারুকাজ করা একটা ঘাগড়া সেলোয়ার-কামিজ পড়তে দেওয়া হলো। লাল রঙের কামিজ, লাল ঘাগড়া সেলোয়ার সাথে লাল ওড়না। ড্রেসটা পড়ার পড়ে সবাই খুব সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে দিল। আজ তাজা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে আমায়।

আমি সবার সাথে ছাদে পা রাখতেই দেখলাম অপর ছাদে সবাই গান বাজনায় মেতে আছে, বাহ খুব আনন্দ করছে সবাই।

তারা সবাই ব্লু রঙের পাঞ্জাবী, ব্লু চুরিদার পড়েছে। আর আমাদের এখানে সবাই সবুজ কামিজ, সবুজ ঘাগড়া সেলোয়ার সবুজ ওড়না। ভালো লাগছে সবাইকে এক রঙের ড্রেসে।

বেশ কিছুক্ষণ পড়ে স্যার আসলো দেখলাম ছাদে। সাদা পাঞ্জাবীর সাথে সাদা রঙের চুরিদার পড়ে। বেশ লাগছে তাকে, দেখলাম সে ইশারায় কিছু বলল। কিছুক্ষণ ভাবতে ভাবতে বুঝতে পারলাম সে ভালো লাগছে আমাকে এটাই বুঝাতে চেয়েছে। আমি মুচকি হেঁসে তাকেও সেইম ভাবে ইশারা করলাম সেও হাঁসল।

দুজন আমার দু-পাশে বসে মেহেদি পড়ানো শুরু করল। ওপাশে আমাদের নিয়ে ঠ্যাস দিয়ে গান বাজনো হচ্ছে। এপাশে সবাই ও সেভাবেই গান বাজাচ্ছে। খুব আনন্দ উল্লাস চারিদিকে। ভালো লাগছে। সব জেনো মনের মতই হচ্ছে। নাচ গানে মেতে উঠেছে চারিদিক।

এভাবেই চলছিল অনুষ্ঠান, এমন সময় আমার ফোন বেজে উঠল। পাশে থাকা ফোনের স্কিনে তাকিয়ে দেখলাম রাইয়ান নামটা ভেসে উঠল ফোনের স্কিনে।

…….আপু আমি তোমার কানের কাছে ধরছি তুমি কথা বলো।

……আরে না অতটা জরুরি না। এমনিতেও এত শব্দের মধ্যে শোনা যাবে না কথা, তাই বাদ দে ফোনটা বন্ধ করে রাখ।

…….আপু ম্যাসেজ আসছে ওই নাম্বার থেকে।

……কই দেখি।

জুঁথি ম্যাসেজ ওপেন করে আমার চোখের সামনে ধরল। আমি অবাক হলাম ম্যাসেজ দেখে। লেখা ছিলো।

….আমি তোমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। যদি না চাও আমি সবার সামনে তোমার বাবা মায়ের মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দেই তবে নিচে এসে আমার সাথে সরা সরি কথা বলো। নয়ত আমি এখনি উপরে চলে আসছি। আর যা করব সেখানে গিয়ে তা ভাবতেও পারবে না।

ইতি
তোমার রাইয়ান

আমি ম্যাসেজ দেখে বুঝতে পারছি, রাইয়ান নিশ্চয়ই কোনো প্লান নিয়ে এসেছে। কিছু তো ও করবে। আমি ভয়ার্ত চোখের চাউনিতে স্যারের দিকে তাকালাম দেখলাম সে আনন্দ করছে সবার সাথে। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। আমি মেহেদি দেওয়া বন্ধ করে, উঠে ছাদের এক পাশে এসে দেখলাম, হ্যা রাইয়ান দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার অপর পাশে। আমি আবার ঘুরে তাকালাম স্যারের দিকে সে আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করল কী হয়েছে। আমি কিছু না বলেই সোজা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম।

গেইট খুলে দিতেই রাইয়ান এগিয়ে এলো।

…….তুমি এখানে কেনো আসছ? কী চাইছ তুমি এখানে?

……তুমি এই বিয়ে করতে পারো না?

……তার পারমিশন আমার তোমার থেকে নিতে হবে?

…….হ্যা কারণ আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তুমি কোনো ভাবেই এমনটা করতে পারো না।

…….বাট আমি বাসি না। দ্যাখো কারো সাথে হাসি মুখে কথা বলার মানে এই নয় যে, আমি তাকে ভালোবাসি। বন্ধু ও ভাবা যায় তাকে। আমি তোমাকে খুব ভালো বন্ধু ভেবেছিলাম। বাট বুঝতে পারিনি ভালো বন্ধু আমার ভাগ্যে নেই।

…..প্লিজ পুস্পিতা, তুমি একবার আমাকে বিশ্বাস করো। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, অনেক সুখে রাখব। আমাকে এভাবে দূরে ঠেলে দিও না।

…….সুখে রাখার তুমি কে? সুখ দেওয়ার মালিক আল্লাহ। রাইয়ান প্লিজ তোমার মুখে ভালোবাসি শব্দটা আমার শুনতে ইচ্ছে করছে না। তুমি প্লিজ এখান থেকে চলে যাও। না হয় খুব খারাপ হবে।

……কী খারাপ হবে বলো কী করবে তুমি?

আমার দিকে এগোতে এগোতে কথা গুলো বলছিল। আমিও পেছনে এগোতে লাগলাম।

……রাইয়ান ওখানেই দাঁড়াও, এক পা এগোবে না বলে দিচ্ছি।

……আমিও তো দেখতে চাই তুমি কী করবে। ডাকবে সবাইকে ডাকো, আমিও ডাকছি তোমার হয়ে। চলো দুজনে মিলে ডাকি।

এই বলে রাইয়ান এগোতে লাগল আরও বেশি করে, তাই আমি হাত উঠিয়ে খুব জোরেই ওকে একটা থাপ্পড় দিলাম। সাথে সাথে ও আমার হাতটা ধরে ফেলল। যার জন্য মেহেদি গুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। আমি হাত ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করে চলেছি। বাট রাইয়ান কোনো ভাবেই আমার হাতটা ছাড়ছিল না।

……রাইয়ান আমার হাত ছেড়ে দাও বলছি।

……না ছাড়লে কী করবে তুমি?

……রাইয়ান খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু?

……হুম আমিও তো খারাপ করতেই আসছি।

এই বলে রাইয়ান আমার হাত ধরে টান দিয়ে গেইটের দিকে নিয়ে যেতে নিলো। কিন্তু কেউ এসে রাইয়ান যে হাতটা ধরে রেখেছিল সেই হাতটাই ধরল। যার জন্য রাইয়ান এগোতে পারল না। আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম স্যার ছিলো। যা দেখে আমার সাহস অনেকটা বেরে গেল। স্যার রাইয়ানের হাত থেকে আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। আমি স্যারের দিকে এগিয়ে গেলাম। স্যার আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে নিজের গায়ের যত শক্তি ছিলো সব দিয়ে রাইয়ান কে একটা থাপ্পড় মারলো। যার জন্য রাইয়ান ছিটকে গিয়ে গেইটের উপর পড়ল।

…….কী করবে ও জিজ্ঞেস করছিলি না? আয় দেখাচ্ছি ও কী করবে?

……স্যার প্লিজ আপনি আমাদের মধ্যে আসবেন না।

……(রাইয়ানের কাছে এগিয়ে গিয়ে) তুই যদি আমাদের মধ্যে আসতে পারিস তবে আমি কেনো পারব না? হুম বল তুই কী করতে চাইছিলি? ওকে নিয়ে যেতে এসেছিস? আয় নিয়ে যা, ধরে দ্যাখ ওর হাত আবার। তোকে সেদিন ছাড়াটাই উচিৎ হয়নি। তুই ভালো কথা বোঝার মতো মানুষই না। তোকে আজ আমি।

এই বলে স্যার ওকে আরও কয়েকটা থাপ্পড় মারলো। রাইয়ান ও মারার জন্য হাত উঠাচ্ছে বাট স্যার ওর হাত ধরে ফেলছে সাথে সাথেই। স্যার ওর হাত ধরে ওকে ঠেলা দিল। স্যার চারিদিকে তাকিয়ে কিছু একটা দেখে ছুটে গিয়ে একটা শাপল নিলো। মাটি খোদাই করার শাপল। যা ফুল গাছের পাশে রাখা ছিলো। নিয়ে ছুটে এলো ওকে মারার জন্য, যা দেখে রাইয়ান ছুটে পালাতে নিলো বাট স্যার ওর ট্রি শার্ট পেছন থেকে ধরে টান দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল ওকে। এরপর শাপল জাগিয়ে তুলল বারি দেওয়ার জন্য। যা দেখে আমি এগিয়ে গিয়ে স্যারের হাত ধরলাম।

…….স্যার প্লিজ না।

……পুস্পিতা ছাড়ো বলছি, ওকে আজ আমি মে*রে-ই ফেলব।

……না স্যার কাউকে মে”রে ফেলা আমাদের কাজ নয়। আমাদের কাজ জীবন বাঁচানো। প্লিজ স্যার ওকে ছেড়ে দিন। রাইয়ান যাও তুমি এখান থেকে। আর কখনো যদি আমাদের সামনেও পরো সেদিন কিন্তু আর আমি তোমাকে বাঁচাতে আসবো না। যাও বলছি এখান থেকে।

রাইয়ান উঠে সেখান থেকে ছুটে পালিয়ে গেল। কিন্তু স্যারের রাগ থামছিল না। তার মাথায় এক ধরনের ভূত চেপে বসে ছিলো। যা নামার নাম নিচ্ছিল না।

…….পুস্পিতা তুমি ওকে ছেড়ে দিয়ে ঠিক করলে না।

……স্যার আজ যদি আপনি ওকে মে*রে ফেলতেন তবে আপনার কী হতো? আর আমাদের ফ্যামিলির সবাইকেই বা কী উত্তর দিতাম আমরা? আপনার কী হতো ভেবে দেখেছেন? প্লিজ স্যার মাথা ঠান্ডা করুন এভাবে রাগের মাথায় কিছু করতে নেই। আপনি ভেবে দেখেছেন আপনার কিছু হলে আমার কী হবে?

স্যার আমার কথা শুনে আমার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে দেয়ালের কাছে গিয়ে খুব জোরে একটা ঘুসি মারলো দেয়ালে। যা দেখে আমি এগিয়ে গিয়ে স্যারের হাত ধরলাম। দেখলাম হাতের মুঠিটা লাল হয়ে গেছে। যা দেখে আমার চোখ থেকে দু-ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, স্যারের হাতে।

…….পুস্পিতা আমি তো ওকে কিছুই করিনি তবে এখন কাঁদছ কেনো?

…….সব তো আমার জন্যই হয়েছে। তবে আমাকে আঘাত না করে নিজেকে কেনো আঘাত করছেন?

স্যার আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে আমাকে তার বুকের মাঝে টেনে নিলো। আমিও চুপটি করে সেখানে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম অনেকটা সময়।

…….একটু অপেক্ষা করো ম্যাডাম কাল থেকে এই জায়গাটা শুধু তোমার জন্যই বরাদ্দ থাকবে। আজ কেউ দেখে নিলে মান-সম্মান বিলিন হয়ে যাবে। তাই এই ভালোবাসা কালকের জন্যেও কিছুটা রেখে দাও।

আমি স্যারের কথা শুনে লজ্জা পেয়ে তারাহুরো করে দাঁড়িয়ে গেলাম। সত্যিই তো কেউ দেখলে কী বলবে? কিন্তু তাই বলে স্যার এভাবে লজ্জা দেবে? ইশ কীভাবে বলল স্যার কথাটা? আমি নিচের দিকে তাকিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনই স্যার হাত ধরে নিলো।

…….কোথায় যাচ্ছ?

…….ছাদে।

…….একটা কথা বলব?

…….হুম।

……তোমার এই লাজুক হাঁসিটায় তোমাকে খুব মানায়।

আমি দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে হালকা হেঁসে, তার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে পালিয়ে এলাম। নিজের রুমে এসে আগে মেহেদি গুলো পরিষ্কার করলাম। ভাগ্যিস বেশির ভাগ মেহেদি শুকিয়ে গিয়েছিল। না হয় সবাই প্রশ্ন করতো এমন হলো কীভাবে? আমি হাত পরিষ্কার করে, আস্তে আস্তে উপরে চলে এলাম। দেখলাম স্যার আমাদের ছাদ টপকিয়ে তাদের ছাদে যাচ্ছে। ওহ গড স্যার এভাবে গিয়েছিল, সবাই কী ভাবছে?

আমি গিয়ে স্টেজে বসে পড়লাম। আবার সবাই নাচে গানে মেতে উঠেছে। ওরা বাকি মেহেদি গুলো আমার হাতে পায়ে দিতে শুরু করে দিল।

……আপু কোথায় গিয়েছিলি?

…….ওই এক পেশেন্ট এসেছিল।

……দুলাভাই ও তো তোর পেছন পেছন গিয়েছিল।

……ওহ আচ্ছা? কই তুই মেহেদি লাগিয়েছিস?

…….হ্যা এই দ্যাখ।

…….হুম খুব সুন্দর হয়েছে।

…….আপু তোর হাতে দুলাভাইয়ের নাম লেখা হবে কিন্তু।

……আচ্ছা তবে তুই আগে খুঁজে বের করে নিস।

……হুম তা তো বের করব। কিন্তু দুলাভাইকেও বের করতে হবে, না হয় টাকা দিতে হবে।

…….আচ্ছা তুই যদি চেয়ে নিতে পারিস তবে নিস। তাতে আমার কী?

…….দেবে তো দুলাভাই?

…….তা তুই আমাকে কেনো জিজ্ঞেস করছিস? তোর দুলাভাই কে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আয়।

……হ্যা তবে এখনি যাচ্ছি।

……এই এই জুঁথি। তুই পাগল হয়েছিস? একদম এখানে চুপ করে বস। নয়ত খালামণি কে বলে একটা থাপ্পড় খাওয়াব।

……আপু এই তো তুই বললি, দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করতে। আবার এখনি তুই থাপ্পড় খাওয়াচ্ছিস আমায়?

…….এই মেয়ে তাই বলে তুই এখনি যাবি নাকি? যখন তোর দুলাভাই তার নাম খুঁজবে, তখন গিয়ে তুই জিজ্ঞেস করে নিস।

…….আচ্ছা তবে তাই করব।

এভাবেই আজকের অনুষ্ঠান চলতে লাগল। বাসার সবাই মেহেদি লাগাচ্ছেন। ছোট বড় কেউ বাদ নেই। ভালো লাগছে সবাইকে খুশি দেখে।

রাতে মেহেদি তুলছিলাম।। অমন সময় মা এলো রুমে।

……কীরে খাবার খেতে আয়।

…….হ্যা মা তুমি যাও আমি আসছি।

মা যেতে নিয়ে আবার এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রাখল। দেখলাম মায়ের চোখে পানি। মা কাঁদছিল। মায়ের চোখ ভেজা দেখে আমার চোখ ও নিমিষেই ভিজে গেল। আমি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম। মা ও আমাকে ধরে কান্না করছিল। আমাদের কান্না শুনে খালামণি কাকি মা, ফুপি, মামি সবাই ছুটে আসলো। সবাই আমাদের শান্তনা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।



চলবে………।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে