#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫৪
অপূর্বর হাতে টিফিন ক্যারিয়ার তুলে দিল আরু। অপূর্ব হাত ঘড়ির পানে এক ঝলক চেয়ে চঞ্চল পায়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, “আরু, আমি আসি। ভারি কাজ করবি না। কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়ে ফুফুকে বলবি। কেমন?”
“সাবধানে যাবেন।” হাতের ইশারায় বিদায় দিতেই অপূর্ব এগোল। সিঁড়ি খেয়াল না করে পা রাখতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। চকিতে সামলেও নিল নিজেকে। আরু ছুটে গিয়ে অপূর্বকে ধরে বলল, “দেখে হাঁটবেন না, ব্যথা পেয়েছেন?”
“না। আমি ঠিক আছি। তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছিলাম তো তাই খেয়াল করিনি।”
“বাধা পড়েছে। একটু বসে যান।” আরুর মনে কু ডাকছে। অপূর্বর নিমিত্তে ছটফট করছে অন্তঃকরণ। অপূর্ব হাত ঘড়িতে ফের তাকাল। আরুর আবদার রাখা অসম্ভব। আলতো জড়িয়ে কপালে এঁকে দিল প্রেমের পরশ। মৃদু হেসে বলল, “আমাকে যেতেই হবে। এমনিতেই আজ দেরি হয়েছে, আর বসা সম্ভব নয়। পাখির খেয়াল রাখিস, আমার জন্য দোয়া করিস।”
অপূর্ব হাসি মুখে এগিয়ে গেল। আরু চেয়ে রইল গমনপথের দিকে। প্রাণেশ্বরের জন্য একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তিনবার আয়াতুল কুরসি পাঠ করল আরু। অতঃপর আকাশের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলতেই পেটের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল। সহনশীল ব্যথা বলে আরু উঠানে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ আবার হাঁটাহাঁটি শুরু করল। পাখি পেটের ভেতরে ফুটবল খেলছে। হাঁটতে হাঁটতে মধ্যহ্ন চলে এলো। ইমদাদুল হোসেন বাজার করতে শহরে গেছেন। অয়ন বালুমাটি লাগিয়ে বাড়ি ফিরল। পারুল দেখেই ঝাঁজালো গলায় বলল, “আবার ভিজে এসেছিস? আজ তোর বাবা আসলে আমি বিচার দিবই।”
“দিও না মা।”
“এই নিয়ে তিন দিন তুই ভিজে এসেছিস। এতদিন না বলতেও আজ বললই।”
পারুল তার সিদ্ধান্তে অটল। আরু না বোঝার স্বরে বলল, “অয়ন কি নদীতে গোসল করে মা? অয়ন সাঁতার জানেনা, নদীতে গেলে ডুবে ম/র/বে।”
“নদীতে যায় না। পাপড়িরা শহর থেকে গ্ৰামে চলে এসেছে। ওদের বাড়ি নদী থেকে বালু তুলে উঁচু করেছে। ওরা সেই ভেজা বালুতে গিয়ে খেলে। বালুতে ঘা হয়ে গেলে কে দেখবে?”
পারুলের কথায় অয়ন ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। রাগ ভাঙল পারুলের। তবুও চাপা রাগ দেখিয়ে বলে, “আরু, আমি পানি তুলে দিয়ে যাচ্ছি। কষ্ট করে ওরে একটু গোসল করিয়ে দিতে পারবি? আমি রান্না করছি মা।”
“আচ্ছা। তুমি পানি তুলে দিয়ে যাও। আমি এই অবস্থায় তুলতে পারব না।”
পারুল বালতি হাতে তুলে নামল দিঘিতে। কেউ যাতে দিঘি থেকে মাছ তুলতে না পারে, তাই দিঘিতে বাঁশ ফেলে রাখা হয়েছে। মাছগুলো তার আশেপাশে ঘুরছে। পারুল বালতি ভরতি পানি উঠানে রেখে চলে গেল। অতঃপর গাছের প্রকাণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে গায়ে ঢালতে লাগল অয়ন। আরু খানিক দূরে দাঁড়িয়ে বলল, “অয়ন, সাবান দিয়ে গা ঘষে নে। বালুতে শরীর ক্ষয় হয়।” পরপর বলল, “পানির কাছে খেলতে যাবিনা। কখন কী হয়, বলা যায়না।”
“জানিস বুবু, বালুতে খেলতে অনেক মজা লাগে। তাই বারণ করার পরেও খেলতে যাই। তুই আজকের মতো মাকে একটু বুঝিয়ে নিস, আমি আর কখনো খেলতে যাব না বালুতে।” বলতে বলতে আরুর ওড়না টেনে ধরল অয়ন। আরু আজ অন্য দৃষ্টিতে তাকাল। আগে যে ছেলেটা তাকে সহ্য করতে পারত না, আজ সে ছেলেটা তাকে এত ভালোবাসে। কৌতূহল নিয়ে আরু বলল, “হঠাৎ এত ভালো বাসছিস কেন অয়ন? আগে তো মায়ের হাতে মা/র খাওয়াতিস।”
“বুবু, তোকে ছাড়া আমার কিছুই ভালো লাগেনা। মা সারাদিন আমাকে মা/রে। আগে তোর পেছনে গিয়ে লুকাতাম, এখন কারো কাছে লুকাতে পারিনা। দাদিজান আগে আমাকে কত ভালোবাসতো, এখন গেলে গাল টিপে ব্যথা দেয়। তুই আমার কাছে ফিরে আয় বুবু। আর তোকে মার খাওয়াব না। আসবি?”
অয়ন কাঁদছে। আরুর চোখের পানি করছে টলটল। এজন্য বোধ হয় বলে, থাকতে মর্ম বুঝে হয়। অয়নের শরীরের পানিতে ভিজে গেছে আরু। চোখ মুছে বলে, “তুই তো আমাকে ভিজিয়ে দিলি। তাড়াতাড়ি গোসল শেষ কর। জামাকাপড় না পালটালে বাবুর ঠান্ডা লেগে যাবে।”
“তবে তুই যা। আমার গোসল শেষ। পা ধুয়ে জামা কাপড় পালটে নিব।”
বলেই জোতা জোড়া তুলে নিল অয়ন। আরু ঘরের দিকে যেতেই সে এগোল দিঘির দিকে। অতঃপর শব্দ হলো দিঘির পানিতে।
_
আরু জামাকাপড় পালটে রসুইঘরে গেল। পারুল রুই মাছ ভাজছে। জামাকাপড় নিয়ে দিঘির দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রয়াস করতেই পারুল থামাল, “আরু মাছ ভাজা খাবি?”
আরুর প্রতুক্তির পূর্বেই একটা মাছ থালায় তুলে আরুর দিকে বাড়িয়ে দিল। আরু জামাকাপড়গুলো নিমগাছের ডালের সাথে বাঁধিয়ে বলল, “মা জামাকাপড়গুলো ধুয়ে দড়িতে দিয়ে এসে খাই?”
“ঠান্ডা হয়ে যাবে। তুই খেয়ে নে, আমি পরে ধুয়ে দিব।”
মায়ের আদেশ পেয়ে ভাজা মাছ খেতে লাগল আরু। চোখেমুখে মলিন ভাব ফোটে উঠেছে। অপূর্বর জন্য চিন্তিত সে। মাছটা ধীরে ধীরে কাঁটা বেছে বেছে খেয়ে উঠল। অতঃপর হাই তুলে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। শরীরটা ভালো লাগছেনা। চোখের পাতা গ্রথন করে ঘুমের রাজ্যে ডুব দিল। তার ঘুম স্থায়ী হলো না বেশিক্ষণ। ঘুমের মাঝে মনে উঁকি দিল অয়নের কথা। মাছ খাওয়ার সময়ও তো দেখা পেলনা ছেলেটার। এক প্রকার যুদ্ধ করে ঘুম থেকে মুক্তি পেল। বড়ো বড়ো চোখের পাতা করে বিছানা ছাড়ল। সময় গড়িয়ে গেছে, উঠানে দাঁড়িয়ে অয়ন অয়ন বলে চিৎকার করছে পারুল। আরু নিকটে গিয়ে বলল, “অয়নকে খুঁজছ মা?”
“হ্যাঁ। ওর বাবার কাছে বিচার দিব বলেছিলাম, এজন্য ভয়ে কোথায় গেল কে জানে। তোকে কিছু বলে গেছে?”
“না, মা। আমি জামাকাপড় পালটাতে গেলাম। ও বলল, পা ধুয়ে..
আরু থেমে গেল। বাম হাতটা ভারি পেটের ওপর রেগে উদাসীন হয়ে ছুটল দিঘির দিকে। চোখে পড়ল অয়নের হলুদ দুটো জোতা ভাসছে। ভাসতে ভাসতে দু-তীরে চলে গেছে। গলাটা ধরে এলো তার। প্রবল শক্তি নিয়ে চিৎকার করে ডাকল, “অয়নননন! অয়ননননন! অয়ননননন!”
সাড়া দিল না কেউ। অথচ পাখিরা সেই চিৎকারে ভয় পেয়ে উড়ে গেছে দূরান্তে। ভারি পেট নিয়ে ঝাঁপ দিল দিঘিতে। মনে তার একটাই চাওয়া, অয়নের যাতে কিছু না হয়। কিন্তু…
দিঘিতে থাকা বাঁশের সাথে লেগে দেহ ছিন্ন ছিন্ন হলো। কিন্তু আরু থামছেনা। এক পর্যায়ে থামল, যখন দেহটা অন্য একটা দেহের সংস্পর্শে এলো তখন। চোখ মেলেই ডুব দিয়ে দেহটা দেখেই পাথর হয়ে গেল। অয়ন যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মুঠো করে ধরে আছে একটা পাতা। অন্তিম মুহুর্তে সেই পাতাটিকে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল। শ্বাস ফুড়িয়ে যেতে আরু মাথা তুলল। পারুল সেই পাড়ে এসে বলল, “কী খুঁজছিস ওখানে?”
আরু জবাব দিতে পারল না। ফের দম নিয়ে ডুব দিল। ভারি পেটকে তুচ্ছ করে অয়নকে পাঁজাকোলা করে অনেক কষ্টে ভেসে উঠল। পানি খেয়ে পেট ফুলে আছে বিধায় আরু ভালো ভাবে তুলতেও পারছে না। অয়নকে এক ঝলক দেখে পারুলের গলা শুকিয়ে গেল। ঝাঁপ দিয়ে পানিতে নেমে গাল ধরে ডাকল বেশ কয়েকবার। দীর্ঘক্ষণ পানিতে থাকার কারণে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখমণ্ডল। পারুল উন্মাদের মতো ডেকে চলেছে, “অয়ন, অয়ন, এই অয়ন। কথা বল বাবা। আমি তোর বাবার কাছে কোনো বিচার দিব না।”
অয়ন সাড়া দিল না। তড়িঘড়ি করে ওপরে তুলে পেট চেপে পানি বের করার চেষ্টা করতে থাকল পারুল। বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে। আরু মলিন চোখে চেয়ে রইল ভাইয়ের দিকে। অয়নের খোলা চোখ দুটো যেন বলছে, “আসবি বুবু?”
চলবে.. ইন শা আল্লাহ
#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫৫
বাড়ি ভরতি মানুষ। অয়নকে চাদরে মুড়িয়ে হোগলার ওপর রাখা হয়েছে। শিউরে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে তার জননী। আরু তার ভারি পেট নিয়ে বসা মাটিতে। জামা দেহেই শুকিয়েছে। পাথর হয়েছে মন। পেটের ব্যথাটা আরও বেড়েছে। কিন্তু মুখ ফুটে বলার ধ্যান নেই। ইমদাদুল হোসেন থলে রাস্তায় ফেলেই ছুটতে ছুটতে এলেন বাড়িতে। শুভাকাঙ্ক্ষীর কথা শুনে রাস্তায় ফেলে রেখে এসেছে থলে। উল্কার বেগে ভেতরে এসে মৃত ছেলের মুখটা দেখে বললেন, “পারুল, কীভাবে হলো এসব? কখন হলো?”
বাঁধ ভাঙল, জলপ্রপাত সংঘঠিত হলো। সব ছেড়েছুড়ে স্বামীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, “ওগো, আমার কী সর্বনাশ হলো! আমার কোল খালি হয়ে গেল। আমার অয়ন মা বলে ডাকছে না কেন? ওর আগে আমাকে কেন নিয়ে গেল না?”
ইমদাদুল হোসেন নিজেকে ধাতস্থ করলেন। দাঁত চেপে পুরুষ মানুষ বলে নিজেকে কঠোর করলেন। তদানীং শাড়ি উঁচু করে ছুটতে ছুটতে এলেন নয়না। আরুর কাঁধে হাত রেখে উত্তেজিত হয়ে বললেন, “কীভাবে হয়েছে আরু?”
আরু আপন কাউকে পেল। জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে পুনরাবৃত্তি করল, “চাচি, আমার জন্য সব হয়েছে। কেন অয়নকে একা রেখে আমি ঘরে গেলাম? তুই তো বলেছিলিস, পা ধুয়ে ঘরে আসবি। কেন এলি না? জানো অয়ন আমাকে বলেছিল, যাতে আমি আবার এই বাড়িতে থাকি। আসবি?
অয়ন ভাই আমার, একবার তুই ফিরে আয়। আমি আর কখনো তোকে ছেড়ে ওই বাড়িতে ফিরে যাব না।”
কাঁদছে আরু। নয়না লক্ষ করল আরুর দেহ ক্ষতবিক্ষত। ভেজা শাড়ি শুকিয়ে গেলেও ভাজ তেমনই রয়েছে। আরুকে ধরে টেনে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “এই অবস্থায় কে ভেজা থাকে মা? ঘরে আয়! জামা পালটে নে।”
পারুলের হুঁশ ফিরল নয়নার কথায়। উশকোখুশকো চুল, রুগ্ণ মুখমণ্ডল, চোখ উত্তাপ, জ্বলছে আগুন। হিংস্র পশুর মতো এগিয়ে এসে বাধা দিয়ে বলল, “ওরে নিবা না ভাবি। ওর জন্য আমার ছেলের এই অবস্থা। আমার ছেলেটাকে একটুও সহ্য করতে পারেনা। শুধু এক সন্তান কেন? ওরে দিঘির পানিতে চুবিয়ে মে/রে একসাথে আমি নিঃসন্তান হব।”
“পা/গ/ল হয়েছিস তুই? ও কী চুবিয়ে মা/র/ছে? ওর হায়াত এই পর্যন্ত ছিল। ওভাবে মেয়েটাকে দোষী করছিস কেন?” আরুকে আগলে নিয়ে কথাটা বলে নয়না। ব্যথায় ঠিকমতো দাড়াতেও পারছেনা আরু। অথচ তাকে নিয়ে চলছে টানাহেঁচড়া। আরুর দাদি অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বললেন, “তুমি চুপ করো বড়ো বউ। এই মেয়ে অপয়া, অলক্ষ্মী। আমার নাতিটাকে খেয়ে ফেলল। এজন্য এই অপয়াকে আমি সহ্য করতে পারতাম না। ওকে পুলিশে দিয়ে যদি আমি কোমরে দড়ি পরিয়ে জেলে পাঠাতে না পারি, তবে আমি শিকদার বাড়ির মেয়ে না।”
নয়না তাচ্ছিল্য করল শাশুড়িকে। আরুর বিয়ের পর থেকে অয়নকে সহ্য করতে পারত না, অথচ এখন ভালোবাসা উপচে পড়ছে। আরুকে ঘরে নিয়ে জামাকাপড় পালটে বললেন, “ওখানে যাবিনা তুই, গেলেও কারও কথা মাথায় নিবিনা। অয়নের শোকে মাথা ঠিক নেই, কী বলতে কি বলে ফেলছে।”
“মিথ্যা বলছে না।”
“মুখে মুখে কথা। চুপ করে বসে থাক।” রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে নয়না। আরু মাথা নিচু করে বলে, “চাচি, আমার পেটে ব্যথা করছে। উনি যাওয়ার সময় থেকে ব্যথা করছে। একটু একটু করে কেবল বাড়ছে।”
“টেনশনে বাড়ছে। চুপ করে একটু শুয়ে থাক।” বলেই বিছানা ঠিক করে নিজের হাতেই আরুকে শোয়ালেন নয়না। আরু শুয়ে জানালা দিকে লেবু গাছের দিকে তাকিয়ে রইল। নয়ন ভরা জল। অপূর্ব কখন আসবে? কখন? এই দম বন্ধ পরিবেশ থেকে অপূর্ব ছাড়া কেউ আরুকে বের করে আনতে পারবেনা।
.
হিংস্র বাঘের মতো গর্জন করতে করতে নয়না আরুর কাছে এলেন। হাত ধরে হেঁচকা টেনে বাইরে নিয়ে যেতে লাগলেন। আরু টু শব্দটি করল না। উঠানের একপাশে তার পরিচিত মুখগুলো দাঁড়িয়ে আছে। কেউ সাহস করে আরুকে বাঁচাতে পারছে না। অবশেষে মোতাহার আহসান পারুলকে ধরে বললেন, “শান্ত হ। ওর দোষ কী এখানে?”
“ওরই সব দোষ। পুলিশ এসেছে, ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিব।” পারুল বলে। অনিতা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই জাহানারা বলল, “ভাবি, পারুলকে সামলাতে হবে আগে।”
অনিতা বলল, “আরুর উপর দিয়ে কী যাচ্ছে, সেটা তুই দেখছিস না?”
জাহানারা বলল, “তাই বলে আরুর দোষ অস্বীকার কেন করছ ভাবী? ওর দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্যই অয়নের এই অবস্থা। আমরাও ওর সময়টা পার করে এসেছি। ওর মতো এত ন্যাকামি করিনি। ও তোমার পুত্রবধূ, পেটে বংশধর। তাই তুমি অন্ধ। কিন্তু আমি অন্ধ নই। আমার সুমি যদি এমন কাজ করত, তাহলে ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতাম।”
“হয়েছে তোর জ্ঞান দেওয়া? এতই যখন জ্ঞানী তাহলে শেফালীর সময় জ্ঞান কোথায় ছিল তোর? তখনবাড়ির মেয়ের জন্য যেমন নিজের পুত্রবধূকে বের করে দিসনি। তেমন আমিও ভাগনের জন্য পুত্রবধূকে বের করে দিতে পারব না।
বড়ো বড়ো জ্ঞান আমাকে না দিয়ে, পারুলকে জ্ঞান দে যা। উসকানি দিস না।” বিদ্রুপ করে কথাটা বলে মোতাহার আহসানের কাছে গেল অনিতা। স্বামীর হাত ধরে টেনে এনে ফিসফিস করে বলল, “পারুল কী বলছে! আরুকে পুলিশে দিবে মানে? এই অবস্থায় এত প্রেসার কীভাবে নেবে মেয়েটা?”
“এছাড়া কোনো উপায় নেই। পুলিশের সাথে আমার কথা হয়েছে। ওখানে আরুর অযত্ন হবেনা। এখানে থাকলে মেয়েটাকে শান্তি দিবেনা পারুল আর পারুলও শান্ত হবেনা। তাই এটা করতেই হবে। কালকে আরুকে বের করে অপূর্বর সাথে তোমার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিব। ওখানে আরুর অযত্ন হবেনা।” মোতাহার আহসান মনে মনে ছক করেছে। স্বামীর কথাটা সন্তুষ্ট সে। অনিতা স্বামীকে ছেড়ে পারুলের কাছে এলো। আরুর হাত ধরে পারুলের থেকে ছাড়িয়ে নিল। কড়া গলায় বলল, “কেন এমন করলি তুই? তোর জন্য অয়ন আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। পুলিশ, আরুকে নিয়ে চলে যান। ওকে আমি আর এখানে সহ্য করতে পারছি না।”
“মামি…
“চুপ। একদম আমাকে মামি বলে ডাকবি না। স্যার, আপনাকে আমি কী বললাম শুনতে পাননি?” অনিতার কথায় আরু হতাশ দৃষ্টিতে তাকাল। জীবনের প্রতি আর কোনো অভিযোগ নেই তার। যারা এই অসময়ে পাশে থাকবে, তারাই দূরে ঠেলে দিচ্ছে। মহিলা পুলিশ এসে আরুর কোমরে দড়ি পরিয়ে দিলো। অতঃপর টানতে টানতে ভ্যানগাড়ির দিকে নিয়ে গেল। আরু কাতর দৃষ্টি ও ঝাপসা চোখ নিয়ে এগিয়ে গেল। ভ্যানগাড়িতে তুলে চলল তার গন্তব্যে। ভ্যানগাড়ি যখন তার গন্তব্যের কাছাকাছি তখন আরুর পেটের ব্যথা ক্রমশ বাড়তে লাগল। শুয়ে পড়ল ভ্যানের উপর। হাত দিয়ে চুলগুলো টেনে গলা কা/টা মুরগির মতো ছটফট করতে থাকে। আরুর অবস্থা দেখে মহিলা কর্মীরা উত্তেজিত হয়ে বলল, “কী হয়েছে,এমন করছিস কেন?”
“পেটে ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে ম/রে যাচ্ছি।”
“কখন থেকে?”
“সকাল থেকে। ধীরে ধীরে বাড়ছে। এখন আর সহ্য করতে পারছি না। আপনারা কিছু করুন।” কাতরাতে কাতরাতে কথাটা বলে আরু। দুজন কর্মীরা উভয়ের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে বলে, “পেট তো বড়ো। মনে হয়, লেভার পেইন উঠেছে। ওকে দ্রুত ভেলিভারি করাতে হবে।”
“স্যার, চেয়ারম্যান সাহেবকে জানাবেন?” মহিলার কর্মীর জবাবে দারোগা বলে, “না, চেয়ারম্যান ব্যস্ত আছেন। আপনাদেরই কিছু একটা কথা হবে। আপনাদের পরিচিত কোনো ধাত্রী থাকলে খবর দিন।”
“আপা, তাহলে আপনি পোয়াতির সাথেই থাকুন। আমি ধাত্রী, প্রয়োজনীয় কাপড়, যা যা লাগবে সব নিয়ে আসি।”
বলেই কর্মী নেমে গেল ভ্যানগাড়ি থেকে। আরু যাতনা সহ্য করে চলেছে। সম্পূর্ণ সময় জুড়ে আপনজনেরা থাকলেও, গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে তারা নেই। কেউ নেই। অপূর্বও নেই।
চলবে.. ইন শা আল্লাহ