নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৪৬

0
438

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৬

“আরু, এই আরু! ঠিক আছিস মা?” বলতে বলতে বেশ কয়েকবার আরুকে ঠ্যালা দিল পারুল। অয়ন ছুটে ঘর থেকে হোগলা নিয়ে উঠানে বিছাল। পারুল আরুর ডাকার এক সুযোগে বলেন, “নয়না ভাবিকে তাড়াতাড়ি ডেকে আন অয়ন।”

“আচ্ছা।” পরমুহূর্তেই অয়ন ছুটে বড়ো চাচার ঘরে চলে গেল। নয়নাদের ধান ইতোমধ্যে ঘরে তোলা হয়েছে। শাশুড়িকে নিয়ে ধান সিদ্ধ করছিল নয়না। অয়ন সেখানে উপস্থিত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে জানায়, “চাচি একটু আমাদের ঘরে যাবেন? বুবু উঠানের পাশে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে।”

“কী বলছিস, আরু কখন এসেছে?”

“জানি না, হঠাৎ দেখলাম উঠানের এক কোনে ঝোপঝাড়ের মাঝে পড়ে আছে।” অয়নের কথায় চিন্তিত দেখাল নয়নাকে। আড়চোখে শাশুড়ির দিকে তাকাতেই দেখল, তিনি নির্বিকার। নাতনি অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে, শোনার পর দাদির ছুটে যাওয়ার উচিত ছিল। তবে এটা নতুন নয়। আরুর বিয়ের পর যখন গ্ৰামে ফিরল তখন থেকে মেজো ছেলের সংসারে ঢোকে না, ইমদাদ হোসেন আসলেও না। নয়না ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। দেবরের ঘরের দিকে অগ্রসর হতে হতে শাশুড়িকে অনুরোধ করলেন, “আম্মা আমি ফেরার আগ পর্যন্ত আপনি এখানে থাকেন।”

নয়না চলার পরে তিনি এক এক করে শুকনো পাতা দিতে লাগলেন। চোখমুখে হিংস্র একটা ভাব।
নয়না ও পারুল আরুকে ধরে হোগলায় রাখলেন। পানির ঝাপটা দিতেই আরু নিভুনিভু দৃষ্টিতে তাকাল। পারুল মাথায় নারিকেল তেল দিতে দিতে বলেন, “কেমন লাগছে মা?”

“ভালো।”

“কখন এসেছিস? কিছু দেখে ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়েছিস?” নয়নার প্রশ্নে আরু অতীত মনে করতে ব্যস্ত হয়। অতঃপর সৌজন্য হাসি দিয়ে সত্য আড়াল করে বলে, “ভালো লাগছিল না, তাই এদিকে এসেছি। কীভাবে জ্ঞান হারালাম জানি না। মাথা ঘুরছে। ইদানীং মাথা ঘুরে প্রচুর।”

“অপূর্বকে বলেছিস?”

“তুমি এত অপূর্ব অপূর্ব কেন করো মা? তোমার অপূর্ব কি সুপারম্যান যে, আমার সব সমস্যা সমাধানে করে দিবে?” বিরক্তিকর গলায় বলে আরু। পারুল যে মা, ধরে ফেললেন আরুর মিথ্যা। মেয়েকে চটালেন না। মাছ বিক্রেতা এখনো দাঁড়িয়ে আছেন। পারুল অয়নের থেকে ব্যাগ নিয়ে পোনার মূল্য পরিশোধ করল। তিনি চলে যেতেই আরু বাক্য তোলে, “কীসের টাকা দিলে তাকে?”

“দিঘিতে পাঁচশো পোনা ফেলেছি। রুই, কাতলা, মৃগেল, গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প, বিগহেড কার্প। তার টাকা দিয়েছি।”

“ফেলেছ না-কি এখনো আছে।”

“তিনি আমাকে গুনে পাঁচশো দিয়েছে। আমি তিনশো বিশটা গুনে ফেলেছি। এখন বাকিগুলো বালতিতে।” আরুর মাথা টিপে দিয়ে বলে পারুল। আরু চট করে উঠে দিঘির দিকে অগ্রসর হলো। তার পেছনে পেছনে গেল সবাই। হাত ডুবিয়ে দিল বালতিতে। মাছেরা হাত ঘেঁষে সাঁতার কাটতেই সুরসুরি লাগল। খিলখিল করে হেসে উঠল আরু। বালতি থেকে কয়েকটা মাছ আলাদা করে মগে রেখে মাছগুলো ফেলে দিল দিঘিতে। পারুল সংশয় প্রকাশ করে, “মাছগুলো ছেড়ে দে, নতুবা মরে যাবে।”

“এখানে পাঁচটা আছে। ভেজে দাও, আমি ভাত দিয়ে খাবো।”

আরুর কথায় ভ্যাবাচাকা খেল সকলে। পারুলের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে নয়না বলে, “অ্যাহ! এই পোনা খাবি?”
আরু জবাব দেয় না। মাছগুলো ধরছে এক ধ্যানে। ফের পারুল বলে, “এগুলো বড় হলে খাবি, ছেড়ে দে এখন। আমি তোর জন্য বড়ো মাছের ব্যবস্থা করছি।”

“লাগবে না।” তেজ দেখিয়ে মগটা দিঘিতে ফেলে দিয়ে ঘরে ফিরে গেল আরু। মাছগুলো মারা যাওয়াতে দিঘিতে ভেসে আছে। ভেসে মাঝে যাওয়ার আগে নয়না মাছগুলো তুলে পারুলের হাতে দিয়ে বলে, “মাছগুলো ভেজে দে, খেতে পারলে খাক। ধান সিদ্ধ প্রায় শেষ। আম্মাকে বসিয়ে রেখে এসেছি। বেশিক্ষণ থাকলে বললে, আমরা তার নামে নি/ন্দা করি। পানি ঝাড়িয়ে রোদে দিয়ে কিছুক্ষণ পর আসছি। তোর সাথে আরুর ব্যাপারে আমার কথা আছে।”

পান্তা ভাতের সাথে মাছ ভাজা। শীতের দিনে কনকনে ঠান্ডায় আরু পান্তা খাচ্ছে। মাঝেমধ্যে কামড় বসাচ্ছে কাঁচা মরিচে। একটা মাছ খেয়ে চারটা মাছ তুলে রাখল থালায়। পারুল গ্লাসে পানি ঢেলে বলে, “তুলে রেখেছিস কেন?”

“স্বাদ লাগে না।”

“এগুলো‌ কি পুঁটি মাছ যে, স্বাদ লাগবে। মাছগুলো ছেড়ে দিতিস, বড়ো হলে খেতে পারতিস। অয়ন তুই খাবি?”

“না মা।” পরপর আরুকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আমি তোর ঘর গুছিয়ে দিচ্ছি।” অয়ন ছুটে গেল আরুর ঘর গোছাতে। সেখানে এসে উপস্থিত হলো কালো কুচকুচে একটা বিড়াল। মিউ মিউ করছে মাছের গন্ধে। আরু পাত থেকে তুলে রাখা তিনটা মাছ মাটিতে রাখতেই তৃপ্তিতে ভক্ষণ করল। অতঃপর ছুটে গেল। পারুল অবাক না হয়ে পারল না, আরুর বিদায়ের পর এই কালো বিড়াল কখনো এই বাড়িতে আসেনি। আজ আরুর আগমনের সাথেই চলে এলো। ইতোমধ্যে খাবার খেয়ে থালাতেই হাত ধোয় আরু। বিড়ালের কথা ভাবতে ভাবতে পারুল থালা নিয়ে ধুতে গেল। তদানীং হন্তদন্ত হয়ে মৃধা বাড়িতে এলো অপূর্ব। তিনটা ঘর খুঁজে খাবার ঘরে পৌঁছালে আরুর সন্ধান পেল। বুকের ভেতরে উদাসীন হওয়া প্রাণপাখি এবার ক্ষান্ত হলো। আরুর গাঁ ঘেঁষে আসন পেতে বলে, “মা, ক্ষুধা পেয়েছে খেতে দিন।”

অপূর্বর কণ্ঠ কানে যেতেই পারুল ও অয়ন এলো ছুটে। অপূর্বর দিকে চেয়ে পরমুহূর্তে দৃষ্টি সরাল আরু। প্রফুল্ল হয়ে পারুল বলে, “তুই এসেছিস অপু, কেমন আছিস?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি‌। আপনি ভালো আছেন?”

“তা আছি। আরুকে এই সময়ে একা ছেড়েছিস কেন? মেয়েটা ঠিকমতো বাড়িতে আসতেও পারেনি, রাস্তায় পড়ে ছিল।” চোখ পাকিয়ে অপূর্বকে বলে পারুল। আঁতকে আরুর ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকাল অপূর্ব। ডাক্তার হিসেবে এই অবস্থায় নারীর যত্নের কথা তার অজানা নয়। নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হলো। বিনয়ী হয়ে বলে, “আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি এখনো এই বাড়ির জামাই হয়ে উঠতে পারিনি। কাল শেফালীর..

“আপনি এখানে কেন এসেছেন?” অপূর্বর বাক্য ইতি টেনে আরু বলে। শেফালীর বিয়ের কথা মায়ের থেকে লুকাতে চাইছে আরু। আরুর ভাবনাকে সমর্থন করে শেফালীর বিয়ের কথা চাপা রাখল। বিষণ্ণ গলায় বলে, “আমি তোকে একবারও এখানে আসতে বলিনি। আমি তোকে আমার সামনে থেকে সরতে বলেছি।”

এতক্ষণে পারুল বুঝতে পারল দম্পতির মাঝে মান-অভিমানের খেলা চলছে। দুজনকে ফাঁকা স্থান দিতে এক গাল হেসে বলেন, “তোরা কথা বল, আমি দুপুরের রান্নার ব্যবস্থা করি।”
অয়নকে নিয়ে উঠানের শেষ প্রান্তে চলে গেল। শীতকালীন সবজি লাগিয়েছেন পারুল। পালংশাক, মুলাশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম ইত্যাদি।
আরু উঠে দাঁড়িয়ে হোগলা ধরে টান দিতেই অপূর্ব চিত হয়ে পড়ার উপক্রম হলো। রক্ষা পেয়ে হোগলা থেকে নামতেই আরু প্যারেকের সাথে ঝুলিয়ে রাখল। অতঃপর ঘরের দিকে অগ্রসর হতেই অপূর্ব তাকে অনুসরণ করল। হাঁটতে হাঁটতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আরু বলে, “সমস্যা কী? আমার পেছনে আসছেন কেন?”

“তোর থেকে কিছু প্রশ্নের উত্তর নিতে এসেছি। বিয়ের পরের দিন তোকে আমি একটা প্যাকেট দিয়েছিলাম। সেটা কোথায় রেখেছিস?”
অপূর্বর এই একটি প্রশ্নে আরুর তেজ কর্পূরের মতো উড়ে গেল‌। আমতা-আমতা করে মিথ্যা বলার চেষ্টা করতেই ধমকাল অপূর্বর, “মিথ্যা বললে দাঁত খুলে হাতে ধরিয়ে দেবো। তোকে একটা কথাও বলে বোঝাতে পারিনা। কেন আমার কথা শুনতে চাস না?”

“আপনার ওপরে তখন রাগ করে ছিলাম। তাই রাগে প্যাকেটটা কোথায় রেখেছি ভুলে গেছি। বাড়ি ফিরে খুঁজেও পাইনি। ভয়ে আপনাকে বলতে পারিনি।”

অতি আদুরে গলায় কাছে ডাকল অপূর্ব, “এদিকে আয়।” গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো আরু। পালস, চোখ ও জিভ পরীক্ষা করে বলল, “এই অপরাধের একটা শাস্তি তোকে দিলাম। আমার ভালোবাসা এতদিন তোর নামে থাকলেও আজ আমি আমার ভালোবাসার একাংশ অন্যকে দিয়ে দিলাম। এতদিন তুই আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমালেও কয়েকমাস পর অন্য একজনকে আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমানোর অধিকার দিলাম।”

অপূর্বর কথায় অশ্রু এসে ভিড় করল আরুর চোখে। অপূর্বর রাগ ভাঙাতে নরম হলো। নিজের মাথাটা অপূর্ব বুকে ঠেসে প্রেমময় কণ্ঠে বলে, “কেন? আমাকে এতবড় শাস্তি দেবেন না। আপনার বিরহে আমি বিলীন হয়ে যাব। আপনাকে অন্য নারীর সাথে ভাগ করে নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।”

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৬ [বর্ধিতাংশ]

“ধুর পা/গ/লি, অন্য নারীকে কেন আমার বুকে জায়গা দেব? আমার বুকে জায়গা হবে শিশুর। যে তোর আমার অংশ দিয়ে তৈরি।” আরুর মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বাস দিল অপূর্ব। মুখ তুলে চাইল অপূর্বর পানে। বিস্মিত আরুর নেত্রপল্লব। অপূর্ব উচ্চতা শুন্যতায় নামাতে হাঁটু গেড়ে মাটির ওপর বসল। কাপড় সরিয়ে মাথা রাখল আরুর ফরসা উদরে। দফায় দফায় কেঁপে উঠল। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে পিছিয়ে গেল। তবে রক্ষা হলো না। শক্তপোক্ত কাঠের খুঁটির সাথে বেধে গেল। বামহাতটা অপূর্বর চুলের মাঝে রেখে থেমে থেমে বলে, “কী করছেন? ছাড়ুন। কেউ চলে আসবে।”

অপূর্ব থামল না, না ছাড়ল। বিনিময়ে বন্ধন দৃঢ় করে ধরে ওষ্ঠদ্বয় ছোঁয়াল আরুর উদরে। চকিতে হাতটা নিচে নামিয়ে তুলে নিল উঁচুতে। মাটি থেকে আরুর পায়ের দূরত্ব তখন অনেকটা। ভারসাম্য বজায় রাখতে আঁকড়ে ধরল অপূর্বর কাঁধ। অপূর্ব ললাটে ললাট ঠেকাতে ভরাট গলায় আরু বলে, “কী করছেন? আজ এমন কেন করছেন? একটু আগে বললেন আরেকজনকে বুকে নিয়ে ঘুমাবেন, এখন আদর করছেন!”

অপূর্ব জবাব না দিয়ে হাসে। তার চঞ্চল বউ আজ বোকা হলো কীভাবে? ঘুরতে ঘুরতে বলে, “আমি বাবা হচ্ছি, বউ আমাকে উপহার দিচ্ছে। সেই হিসেবে এইটুকু আদর তার প্রাপ্য।”

বাক হারিয়ে ফেলল। বাঘ থেকে বিড়াল ছানার মতো চুপসে গেল। বিড়াল ছাড়া মিউ বলতে পারলেও আরু বলতে পারছে না। শত প্রচেষ্টার পর বলে, “তবে তো আমি মা হব। কিন্তু আপনাকে কে বলেছে? যাকে বুকে নিয়ে ঘুমাতে চেয়েছেন, সে কি অন্তঃসত্ত্বা?”

“আমার বউ কি পাঁচটা? একটা‌। অবশ্যই সেই বউ অন্তঃসত্ত্বা। এতদিন তোর উগ্র আচরণে হতবাক হয়েছি, ডাক্তার হয়েও অনুভব করতে পারিনি আমি বাবা হব। একটু আগে বাবার কথায় রেগে আমি তোর সাথে ওমন ব্যবহার করেছি। ঘুণাক্ষরেও যদি অনুভব করতাম তুই নতুন অতিথি আনার বাহক। তবে এমন কাজ করতাম না।”

অপূর্ব এখনো উৎফুল্লিত হয়ে আরুকে ঘুরাচ্ছে। আরুর মাথা ঘুরছে। ঝাপসা দৃষ্টিতে অপূর্বকে দৃশ্যমান হচ্ছে না। ঘনঘন পলক ফেলে বলে, “মাথা ঘুরছে, নামান আমাকে। বমি পাচ্ছে।”

অপূর্ব হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে নামাল আরুকে। পৃথিবীর গতির সাথে টক্কর দিতে না পেরে আরু হেলেদুলে বাইরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পেছন দরজার কাছে যেতেই মুখ ভরে এলো বমিতে। মাথাটা একটু বাঁকিয়ে গড়গড় করে শূন্য করল পেট। অতঃপর দরজার সাথে ঠেসে বসে পড়ল মাটিতে। অপূর্ব ধ্যান থেকে বের হয়ে আরুকে ধরল। বাইরে থেকে মেয়ের এরূপ অবস্থা থেকে পারুল সবজি ফেলে ছুটে এলেন ঘরে। সরিষার তেল মাথার তালুতে দিয়ে ম্যাসাজ করতে করতে বলেন, “এই মাত্র তোকে সুস্থ দেখে গেলাম। এরমধ্যে আবার…। একটু আমের আচার দেই? খেলে ভালো লাগবে।”

“না। চালতার আচার দাও।” অপূর্বর গায়ে মাথা ঠেকিয়ে আরু বলে। অনিতা পানি দিয়ে আরুকে কুলি করিয়ে মুখ ধোয়ালেন। চালতার আচার বাটিতে দিয়ে অপূর্বকে বলেন, “তুই তো ডাক্তার, আরু হঠাৎ এমন করা তোর ডিকশনারিতে কী বলে।”

“আপনার ঘরে নতুন অতিথি আসার লক্ষণ। অয়ন মামা হতে চলেছে। বুবু আর তোমাকে ভালোবাসবে না।”

পারুল হাসলেন। সবজি তোলার সময় নয়না এসে এই আভাস দিয়েছিলেন।অয়নের মন ভার হলো। বিষাদের সুর তুলে বলে, “তাতে কী? আমি তো মামা হব। সবাইকে বলে আসি।”

বলেই অয়ন ছুটল সবাইকে জানাতে। অপূর্ব আরুকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে শোয়াল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “আরু বাবুর আগমনের কথা শুনে বাবুর বাবাও বাবু হয়ে গিয়েছিল। তাই তোকে ঘুরিয়েছে। আমার জন্য তোর ক্লান্ত লাগছে।”

আরু চালতার আচার খেতে খেতে বলে, “এটা তো রোজকার অভ্যাস। আপনার কোনো দোষ নেই। আচার খাবেন?”

“না! তুই খা! খেয়ে ঘুমা।”
অপূর্বর আদেশ মেনে আরু চালতা খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। ক্লান্ত শরীর ব্যস্ত হলো তন্দ্রায়। তন্দ্রা ব্যাঘাত ঘটল হট্টগোলে। আহসান বাড়ির চাঁদের হাট তখন বসেছে মৃধা বাড়িতে। বিভিন্ন ধরনের কণ্ঠ আরুর কর্ণপথে যেতেই ছুটি নিল তন্দ্রা। ঘুমের কারণে দেহটা বেশ লাগছে আরুর। মাথায় ঘোমটা টেনে উপস্থিত হলো বৈঠকখানায়। ততক্ষণে আরুর গোপন তথ্য ফাঁস করেছে অপূর্ব। আরুকে দেখে চার জা গোল করে ধরল। অনিতা জড়িয়ে নিয়ে বলে, “তোর অসুস্থতার কথা আমাদের কেন বললি না মেয়ে? আমরা বুঝতে না পেরে তোর সাথে কেমন ব্যবহার করলাম।”

“আমি কিছু মনে করিনি।”

উত্তরে জাহানারা বলেন, “রাগ করে বাপের বাড়িতে চলে এসেছে। আবার বলে কিছু মনে করেনি।”

মোতাহার আহসান এগিয়ে এসে আরুর মাথায় হাত রেখে বলেন, “তোর মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছি কিন্তু। এবার বাড়িতে ফিরে তৈরি হয়ে নে।”

“কোথায় যাবো?”

“অপূর্ব আমাকে বলেছে তোর কথা‌। আমি দাদু হতে চলেছি। এই বয়সে সবাই নাতি নাতনি কাঁধে নিয়ে ঘুরে। অবশেষে আমার সময় আসছে। কী যে ভালো লাগছে।” মোতাহার আহসানের কথায় আরু লজ্জানত হলো। চোখমুখে ফুটে উঠল লাজুক ভাব। তবুও তিনি বলেন, “তোর শরীরের কথা চিন্তা করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সব ভাই-বোন মিলে বেয়ানকে নিয়ে ঘুরতে যাবি। বেয়ানের চিকিৎসার জন্য এই গ্ৰামে ভালো কোনো চিকিৎসক নেই। তাই ডাক্তার দেখানোর পাশাপাশি তোর মাইন্ড ফ্রেশ হবে। ইতোমধ্যে ব্যাগপত্র গোছাতে সুজন ও তিস্তা চলে গেছে।”

“অয়নকে নিয়ে যাই?” আরুর প্রশ্নের জবাবে পারুল বলেন, “দরকার নেই। আমাদের নায়র নিতে এসেছেন। তোরা ফেরার আগ পর্যন্ত আমরা সেখানে থাকব।”

আরু ও অপূর্ব অগ্রসর হলো আহসান বাড়ির দিকে। পেছনে আসছে তাঁরা।
__
ট্রাভেলিং ব্যাগগুলো সারিবদ্ধভাবে রাখা‌। সোয়েটার জড়িয়ে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে আরু। ব্যাগপত্র অপূর্ব গুছিয়েছে। সবাই অপেক্ষারত দুপুরের খাবারের। লঞ্চে নিয়ে যাত্রা শুরু করবে। গাড়ি এসে থেমেছে আহসান বাড়ির দোরগোড়ায়। চালক বাইরে থেকে হাঁক দিতেই তিয়াস বিরক্ত হয়ে বলে, “কতক্ষণ লাগবে মা?”

“হয়ে গেছে।” টিফিন ক্যারিয়ার এনে বিছানার ওপর রাখল জাহানারা। সুমি ক্যারিয়ানটা চালকের হাতে দিয়ে বলে, “এগুলো নেওয়ার কোনো দরকার আছে মা? ঘুরতে যাচ্ছি। নদী দেখতে দেখতে ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে গরম গরম ভাত খেতাম। ওখানেই পাওয়া যায়।”

“খবরদার কেউ বাইরের খাবার খাবি না। তোরা খেলে আরুও খেতে চাইবে। আরুর জন্য এখন বাইরের খাবার ঠিক না।” কড়া গলায় বলেন মণি। বিনিময়ে রঙ্গ করে সুমি বলে, “জা, কে তোমাকে এখন এই পকেট নিতে বলেছে। এই পকেটের জন্য বাইরের খাবার খেতে পারব না।”

পেটের ওপর হাত রেখে ভাব নিয়ে আরু বলে, “এই পকেটের জন্য যেতে পারছ ভাবী, এটা কম কিসে? চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
আরু সবাইকে তাড়া দিয়ে অনিতার কাছে গেল। পা ছোঁয়ার চেষ্টা করতেই অনিতা বাধা দিল, “এই সময়ে ঝুঁকতে নেই। সাবধানে যাক। নিজের যত্ন নিস।”

“আচ্ছা।”

সবার থেকে বিদায় নিয়ে আরু উঠল গাড়িতে। একে একে উঠল বাকিরা। তিস্তা সুজন পূর্বেই বসা ছিল। আরুকে দেখে বেশ রঙ্গ করে সুজন বলে, “ভাবী, সুখবরের সাথে মিষ্টি পেলাম না। মিষ্টি পাবো কবে?”

“বিয়েটা আগে আপনারা করেছেন, অথচ সবাইকে সুখবর আগে আমি শুনিয়েছি। মিষ্টি তাহলে কার বিলানো উচিত? সুজন মাঝি, তৈরি হন।” বলতে বলতে অপূর্বর কাঁধে মাথা রাখল আরু। গতিশীল গাড়ি থামল ব্রিজের কাছে। সেখান থেকে গাড়িতে উঠল তিনজন। আরেকদফা অপূর্ব আরুর কাছে মিষ্টি চাইল। এক ফাঁকে তুরকে ঠ্যালে আরু বলে, “মিতুর সাথে ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছিলি?”

“প্রয়াসকে চিঠি পাঠিয়েছি। সে ইতোমধ্যে ঘাটে পৌঁছে গেছে। আমরা কোন লঞ্চে যাবো তা-তো জানে না, সেটা লিখে পাঠিয়েছে।”

আরু মাথায় হাত দিল। এমনিতেই মাথা ঘুরছে তার।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে