#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪১
ভিজে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরু। পাশে অপূর্ব দাঁড়িয়ে আছে। এখানকার রিচ্যুয়াল শেষ হতেই অপূর্ব অগ্রসর করল কলতলার দিকে। মল্লিকা বাধা দেয়, “এই অপু, একা যাচ্ছিস তোর বউকে কে নিয়ে যাবে। কোলে করে কলতলায় নিয়ে যা।”
অপূর্ব ফিরে আরুর দিকে তাকাল। প্রতিবেশীদের উপস্থিতির কারণে আরুকে তুলতে লজ্জা অনুভূত হলো তার। মণি রঙ্গ করে বলে, “অপু তুই লজ্জা পাচ্ছিস কেন? শুধু আমাদের সাথে ঠোঁট কাটা হলে চলবে, গ্ৰামবাসীর সামনেও তো হতে হবে না-কি?”
“গ্ৰামবাসী আর তুমি কি এক চাচি? তুমি আমার বয়সী। তোমার সাথে আমি যা করতে পারি, অন্যের সাথে তা করা সম্ভব নয়।” মৃদু কণ্ঠে বলে আরুকে পাঁজাকোলা করে নিল অপূর্ব। আরু তার কাঁধে হাত রাখতেই কলতলায় চলে গেল অপূর্ব। ভেতরে ঢুকে আরুকে নামিয়ে দরজার ছিটকিনি তুলে দিল। ভেজা সেন্ট গেঞ্জি খুলে টিউবওয়েলের হাতলে রেখে বলে, “ফটাফট কল চেপে পানি তোল, গোসল করে বের হতে হবে।”
“পারব না।” কঠোর ভাবে বলে টিউবওয়েলের হাতল উপরে তুলে। প্রথমবার আরুর এমন ভঙ্গিমা দেখে অপূর্ব হতভাগ না হয়ে পারল না। অথচ কখনো অপূর্বর মুখে মুখে তর্ক করে না আরু। অপূর্ব চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “কী বললি তুই? আমার মুখের উপর কথা বলার সাহস কোথায় পেলি? এদিকে আয়।”
“আসব না। পারব না। আজ আপনি পানি তুলে আমাকে দিবেন, গোসল করতে। না-হলে এখন আমি মাথার কাপড় ফেলে এই ভেজা অবস্থায় চলে যাবো। এবার আপনার মত?” বুকে হাত গুজে বলে আরু। অপূর্ব বুঝতে পারে, তাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বাধ্য হয়ে প্রথমবার নিজে টিউবওয়েল চেপে পানি তুলে আরুর গোসলের জন্য। অপূর্বর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বলছে, ‘তোর খবর আছে আরু।’
__
সূর্য আজকাল সময়ের আগে মেঘের আড়ালে তলিয়ে যায়। বর্ষাকালে সূর্য সর্বোচ্চ তাপমাত্রা দিলেও বর্ষার কারণে গরম অনুভূত হয় না। আরু একা বারান্দায় গিয়ে বসে বৃষ্টি উপভোগ করছে। তাদের উঠান জুড়ে একাধারে নৃত্য পরিবেশন করছে বৃষ্টি। হঠাৎ কল এলো অপূর্বর ফোনে। অপূর্ব ফোন রেখে হাঁটতে গেছে। ফোনটা রিসিভ করে সালাম বিনিময় করতেই ওপাশ থেকে ইমদাদ হোসেন বলে, “আরু, অপূর্ব কোথায়? তোরা কখন আসবি? আমি কি গাড়ি নিয়ে আসব?”
“না বাবা, আসতে হবে না। উনি বাড়িতে নেই, ফিরলে আমি তাকে নিয়ে চলে আসব।”
“আচ্ছা। তুই আর অপূর্ব একা আসিস না। সবাইকে নিয়ে আসিস।”
“আচ্ছা। রাখি।” তারপরে কল রেখে আরু নিচে গেল। বৃষ্টির মাঝে সবাই ক্যাসেট দিয়ে ভূতের সিনেমা দেখছে। অপূর্ব ফিরে নিজেও যোগ দিয়েছে সবার সাথে। তুর ও শেফালী ওড়না মাথায় দিয়ে রেখেছে ভয়ে, কখনোবা আংশিক মাথা বের করছে। সুমি তৎক্ষণাৎ চা নিয়ে হাজির হলো। আরু এগিয়ে সুমির হাত থেকে ট্রে নিয়ে সবাইকে চা পরিবেশন করতে থাকে। সবাইকে দিয়ে এক পর্যায়ে অপূর্বর হাতে চা দিয়ে বলে, “বাবা ফোন দিয়েছিল, আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে। কখন যাবেন?”
“আমি গেলেও থাকতে পারব না। কাল থেকে আমার চেম্বার খোলা। তুমি যেতে চাইলে দিয়ে আসব।” চা নিয়ে চুমুক বসায় অপূর্ব। অনিতা লক্ষ্য করে এগিয়ে এসে বলে, “কী হয়েছে আরু, মুখ কালো করে আছিস কেন?”
“মামি, ও বাড়িতে যাওয়ার জন্য বাবা ফোন করেছিল। কিন্তু উনি বলছে, তার সময় নেই। আমাকে একা থাকতে।”
“ও কী কথা! এখন সময় না-থাকলে কবে সময় হবে? নতুন বিয়ে করেছিস শ্বশুর বাড়িতে যাবি, হানিমুনে যাবি। ছুটি নেই মানে কী?” তীক্ষ্ণ গলায় অনিতা বলে। অপূর্ব বৈঠকখানা ত্যাগ করে দোতলায় চলে গেল। তার মাথায় এখন প্রচণ্ড উত্তেজনা। দু-দিন পরপর ছুটি নেওয়ার কারণে কথা শুনতে হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। আরু মন খারাপ নিয়ে সোফায় বসতেই ইমদাদ ছাতা মাথায় নিয়ে হাজির হয় আহসান বাড়িতে। তক্তার সাথে ঝুলিয়ে আরুকে রাগ দেখিয়ে বলে, “তোদের জন্য কত অপেক্ষা করব, কখন যাবি? তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে চল, তোর মা অপেক্ষা করছে।”
অনিতা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলে, “আরু বেয়াইকে চা দাও।”
বেয়াই সম্বোধন শুনে প্রসন্ন হলেন ইমদাদ। খোশগল্পে মেতে উঠলেন বেয়াইয়ের সাথে। আরু বাবাকে চা দিয়ে উপরে গেল। অপূর্ব মনযোগী হয়ে কাগজে কিছু লিখছে। আরু আঁচলটা কোমরে গুঁজে বারান্দায় থাকা ময়না পাখিদের খাবার দিল। অতঃপর শব্দ করে ট্রাভেলিং ব্যাগ বিছানায় রাখে। গোছানো জামাকাপড়গুলো ছুড়ে ফেললে এলোমেলো হয়ে গেল তা। শব্দে বিরক্ত হয়ে অপূর্ব এক নজর তাকাল আরুর দিকে। চণ্ডাবতী রূপ দেখে অপূর্ব খাতা কলম পাশে রেখে পেছন থেকে আরুকে জড়িয়ে ধরে। অপূর্বকে ছাড়াতে ছাড়াতে আরু উড়ণচণ্ডী হয়ে বলে, “আদিখ্যেতা করছেন কেন? আমাকে একদম ধরবেন না।”
“চণ্ডী রূপে পুড়ে ছাই হওয়ার আগে তাকে থামানো উত্তম। (পরপর বলে) এত রেগে আছে কেন ময়না পাখিটা?” জড়িয়ে ধরেই বলে।
“একদম ময়না পাখি বলবেন না, বাবা নিতে এসেছে। আপনার খোঁজ করছে, তাকে গিয়ে বোঝান আপনি যাবেন না। বিয়ের আগে বউকে চোখে হারায়, বিয়ের পর কর্পূরের মতো উড়ে গেছে প্রেম।” অভিমানী শোনাল আরুর গলা। অপূর্ব তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ললাটে এঁকে দিল ভালোবাসার পরশ। চরম আদুরে গলায় বলে, “তুমি কি চাও তোমার স্বামীকে হাসপাতাল থেকে বের করে দিক। প্রতিদিন মানুষ ফি দিয়ে অ্যাপয়েন্টম্যান্ট করে রাখে। কিন্তু আমার সাথে দেখা করতে পারে না। চিকিৎসক হিসেবে আমার উচিত ওদের রোগ সম্পর্কে জেনে বিস্তারিত পরামর্শ দেওয়া। আজকে তুমি যাও, আগামী বৃহস্পতিবার আমি যাবো। শুক্রবার থেকে শনিবার তোমাকে নিয়ে চলে আসব। আমার জন্য তুমি বাবা মাকে দেখতে পাবে না, এটা আমার ভালো লাগবে না। তাই প্রথম ও শেষবারের মতো আমি তোমাকে একা ঐ বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দিলাম।”
আরুর রাগ নেমে এলো শূণ্যতায়। পরক্ষণে অপূর্বর কাছে তা হুরহুর করে বেড়ে গেল। একটা প্যাকেট আরুর হাতে দিয়ে বলে, “এটা রাখো!”
“কী এটা?”
“সামনে তোমার পরীক্ষা। আমি চাই না এখন নতুন কেউ আসুক।” অপূর্বর ইঙ্গিত বুঝতে সমস্যা হলো না আরুর। মুখ ফুটে বলার আগে নিচ থেকে অপূর্বর ডাক পড়ল। ইমদাদ হোসেনের ডাকে সাড়া দিতে অপূর্ব নিচে চলে গেল। রাগে হাতের প্যাকেটটা মুঠো করে ফেলে দিল খাটের নিচে। অতঃপর আবার জামা কাপড় গোছাতে ব্যস্ত হলো। গোছানো শেষে আরু ব্যাগ সমেত নিচে নামল। অপূর্ব ইতোমধ্যে বুঝিয়েছে ইমদাদ হোসেনকে। তাই জামাতা ছাড়াই মেয়েকে নিয়ে যাত্রা শুরু করল মৃধা বাড়ির দিকে।
বাড়িতে একা আরুকে দেখে অপূর্বর খোঁজ করল পারুল। প্রথমবার জোড়া নায়র শ্বশুর বাড়িতে না এসে একা মেয়েকে দেখে প্রশ্ন করল কেউ। আরু রাগ দেখিয়ে বলে, “আমাকে কেন এত কথা জিজ্ঞেস করছ, তোমার ভাইপো কোথায়? ওকে জিজ্ঞেস করো। আমার থেকেও তোমার ভাইপোকে বেশি বিশ্বাস করো।”
তারপরে নিজের ঘরে চলে গেল আরু। পাঁচ বান্ধুবীকে এভাবে ফুল দিয়ে ঘর সাজাতে দেখে বুঝতে বাকি রইল না, তারাও অপূর্বর জন অপেক্ষারত। আরুকে দেখে উত্তেজিত হয়ে মিতু বলে, “দুলাভাই কোথায়, তোদের জন্য কেমন ঘর সাজিয়েছি বল।”
প্রসন্ন না হয়ে অপ্রসন্ন হলো আরু। রেগে ফুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলল। আঙুল তুলে বলে, “আমি তোদের ঘর সাজাতে বলেছি? সাজিয়েছিস কেন? আর কখনো আমাকে জিজ্ঞেস না করে আমার ঘরে আসবি না। বের হ।”
ওরা আরুর রাগ দেখে বিলম্বে জিনিসপত্র নিয়ে ত্যাগ করল ঘর। আনমনে অপূর্বকে নিন্দা করে খাবার না-খেয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল আরু।
চলবে.. ইন শা আল্লাহ
#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪২
চালের উপর বৃষ্টির ধারা নৃত্য পরিবেশন করছে। রাস্তার দুই ধারে থাকা কদম গাছে কদম ফুল ফুটেছে। সেই গাছে আশ্রয় নিয়েছে নাম না-জানা বহু প্রজাতির পাখি। ঠান্ডা আবহাওয়ায় কোল বালিশ জড়িয়ে আরু নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আর পাঁচটা দিনের মতো আজকে রাতটা কাঁটছে তার। মৃধার বাড়ির লোকেরা শত ডেকেও আরুকে বিছানা থেকে উঠাতে পারেনি। বিনিময়ে শুনতে হয়েছে আরুর বাজখাঁই গলা।
মধ্যরাতে পেছনের ঘরে প্রবেশ করে কেউ। কদম ফুলের গুচ্ছ টেবিলের উপর রেখে কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় উঠে। কোল বালিশ থেকে আরুকে ছাড়িয়ে টেনে নেয় হৃদমাঝারে। রাতের অন্ধকার পেরিয়ে আলোর সূচনা হলেও বৃষ্টির বিরতি দেওয়ার নাম নেই। তারা নিজের কাজে ব্যস্ত। মোরগ ডেকে সবাইকে সকালের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। বৃষ্টির দিনে মোরগ নিজে ঠাওর করতে পারেনি ভোরকে। লম্বা চুলগুলো হাত খোঁপা করে উঠে বসল আরু। অনুভব করল পাশ থেকে জড়িয়ে রাখা একটা হাত তার শাড়ি ভেদ করে নগ্ন পেট স্পর্শ করছে। চকিতে পাশে ফিরতেই মিলল অপূর্বর মুখশ্রী। গতকাল রাতে এই বিছানায় একা ঘুমিয়েছিল, অপূর্ব এলো কীভাবে? রাতে প্রখর বাদল ছিল। সেই সময়ে অপূর্বর আসা অসম্ভব। চাপা অভিমান নিয়ে অপূর্বকে ছাড়িয়ে বিছানা থেকে নামল আরু। নজরে এলো একগুচ্ছ কদম। দৃষ্টিতে সরিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। পেছনের দরজা খুলে মাটির সিঁড়িতে দাঁড়াতেই দেখল, রসুইঘর থেকে ধোঁয়া উড়ছে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রসুইঘরে ঢুকে। নয়না পারুলকে দেখে হেসে বলে, “তুই উঠেছিস, ভালো করেছিস। জামাইকে তুলে মুখ ধুতে বল। নিজেও মুখ ধুয়ে পিঠাগুলো দিয়ে আয়।”
“জামাইকে যদি এত খাওয়ানোর শখ তাহলে নিজে গিয়ে দিয়ে আসুন। আমি পিঠা দিয়ে আসতে পারব না। কালকে তো বড় মুখ করে বলেছিল, ‘কাজ আছে, বৃহস্পতিবার ছাড়া যেতে পারব না।’ রাতে চোরের মতো কেন এসেছে? বের করে দিতে পারলে না?” বলতে বলতে নিমগাছের ডাল ফেলে দাঁত মাজতে থাকে আরু। পারুল চোখ রাঙিয়ে বলে, “বিয়ে হয়ে গেছে, এবার গলার স্বর ছোটো কর। জামাই ঘরে, তোর কথা শুনলে কী ভাববে!”
“আরু তুই মুখ ধুয়ে অপূর্বকে জাগা।” নয়না বলে। তখনই বাড়ির ভেতরে ঢুকে আসে পাঁচ যুবতি। বৃষ্টি খরা দিয়েছে। সাথী বলে, “ভাইয়া কখন এসেছে চাচি?”
“মাঝরাতে বৃষ্টিতে ভিজে মিষ্টি, পান, বিস্কুট নিয়ে এসেছে। রাতের বৃষ্টি, জ্বর না আসলেই হয়। এতরাতে আসার কী দরকার ছিল, সকালে আসতে পারত।” হাত নাড়িয়ে বলে অনিতা। অতঃপর তন্বী বলে, “আরুকে কষ্ট করে যেতে হবে না, আমরা যাচ্ছি। গতকাল রাতে ভাই আসেনি বলে, কী রেগে ছিল! কত কষ্ট করে বিছানা সাজালাম, সবকিছু নষ্ট করে ফেলল।”
তৎক্ষণাৎ অপূর্ব চলে এলো বাইরে। পরনে তার ঢিলেঢালা একটা পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি। এই পোশাকটা আরু চেনে, ইমদাদ হোসেন মৃধার। আরু প্রায়ই ধুয়েছে। মুখ ফিরিয়ে নিল অপূর্বকে দেখে। অপূর্ব কাশতে কাশতে আরুর কাছে গেল। গাছ থেকে ডাল ভেঙে বলে, “আমাকে আর কষ্ট করে ডাকতে যেতে হবে না, আমি চলে এসেছি। তবে তোমাদের একটু কষ্ট করতে হবে। টিউবওয়েল চেপে পানি তুলে দিতে হবে মুখ ধোয়ার জন্য।”
“অবশ্যই দুলাভাই। প্রয়োজনে আপনার গোসলের পানিও তুলে দিবো।” মিতুর কথায় আরু ফিক করে হেসে ফেলল। নিমের ডাল ফেলে দিয়ে দিঘির দিকে যেতে যেতে অকপটে বলে, “নিমগাছের ডালে হবে না, বাকল লাগবে। শুধু মুখ না ধুইয়ে পাঁচজনে মিলে গা ধুইয়ে দে। পারলে মুখের ভেতরে হাত দিয়ে অন্তরটাও ঘষে দিস। তোদের দুলাভাইয়ের মুখে এক, অন্তরে আরেক। অন্তরটা পরিষ্কার থাকলে এক কথা বিরাজ করবে।”
“আরু, জামাইকে কী বলছিস এগুলো! নিজের কাজে যা।” পারুল থমথমে গলায় বলে। আরু চলে গেল দিঘির পাড়ে। দিঘির দিকে ইঙ্গিত করে অপূর্ব বলে, “সুন্দরী মেয়ে কিংবা আত্মীয়র ভেতরে বিয়ে করো না, বউয়ের থেকে সম্মান পাবে না।”
__
মাটিতে হোগলা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। অপূর্ব জোতা খুলে বস। বিভিন্ন ধরনের পিঠা ইতোমধ্যে অপূর্বর সামনে সাজিয়ে রেখেছে পারুল। আরু হাতপাখা নিয়ে বসে আছে। ঠান্ডা বলে হাওয়া করতে হচ্ছে না অপূর্বকে। অপূর্ব জামাই পিঠা ভেঙে মুখে দিয়ে বলে, “মা, এত আমি খেতে পারব না। আপনারা সবাই বসুন। একসাথে খাবার খাই।”
“না, তুই আমাদের জামাই। প্রথমবার শ্বশুর বাড়িতে এসেছিস। তোর খাওয়া শেষ হলে আমরা খাবো।” পারুল গ্লাসে পানি ঢেলে বলে। বিপরীতে অপূর্ব বলে, “আমি তো অহরহ এসেছি। আজ প্রথম নয়।”
“এতদিন এসেছিস ফুফুর বাড়ি হিসেবে, আজ এসেছিস জামাই হিসেবে। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর।” পারুল থামতেই অপূর্ব খাওয়া শুরু করে। আরু মনে মনে ছক করে বলে, “প্রথমবার শাশুড়ির হাতের তৈরি পিঠা খাচ্ছে জামাই। স্মরণীয় করে রাখতে হবে। উনি আবার লজ্জা পায়, তোরা একটু খাওয়া।”
আরু উঠে যেতেই পাঁচ যুবতি বসল হোগলায়। অপূর্বকে কোণঠাসা করে সমস্ত খাওয়া মুখে তুলে দিল। অপূর্ব ফেলতেও পারছে না। ঠেসে ঠেসে সব খাবার শেষ করে ঢেকুর তুলে ঘরে চলে গেল। ঠিকভাবে হাঁটাচলাও করতে পারছে না। পেটে হাত দিয়ে রেখেছে। পারুল জামাইয়ের পক্ষ নিয়ে বলে, “তোর সবকিছুতে বাড়াবাড়ি, জামাইকে জোর করে খাওয়ালি। যদি বদহজম হয়। আমি জিরা দিয়ে স্পেশাল একটা টোটকা বানিয়ে দিচ্ছে। অপুকে খাওয়া।”
তারপরে রসুইঘরে গিয়ে পারুল অপূর্বর জন্য এক গ্লাস ঔষধ তৈরি করে নিয়ে এলো। পারুল দিতেই আরু ছুটে গেল ঘরে। অপূর্ব উবুড় হয়ে শুয়ে আছে। অপূর্বকে দেখে মায়া লাগল আরুর। এভাবে শাস্তি না দিলেও পারত। প্রথমবার জামাই শ্বশুর বাড়িতে এসে ঘরে-বাইরে যাচ্ছে। ব্যাপারটা যদি ঘটে এবং জানাজানি হয়। খুব খারাপ হবে। অপূর্বর মাথার কাছে বসে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “মা, এটা পাঠিয়েছে। ধীরে ধীরে খেয়ে চোখ বন্ধ করে রাখুন।”
“তোর তো খুব ভালো লাগছে আমাকে এই অবস্থায় দেখে। নাচতে ইচ্ছে করছে। খাবো না আমি।” অপূর্ব শুয়ে থেকেই বলে। আরুর কষ্ট হয়। একটু চাপা অভিমান নিয়ে বলে, “আমি কখনো আপনার ক্ষতি চাইনা। একটু রেগে ছিলাম জাস্ট। এটা খান।”
অপূর্ব উঠে বসে ঠিকই, তবে গ্লাসটা কেড়ে টেবিলের উপর রেখে দিল। আরুর আঙুলের ভাঁজে আঙুল ঢুকিয়ে বলে, “মা বোধহয় আমাকে মিষ্টি দিতে ভুলে গেছে। কালরাতে এত মিষ্টি নিয়ে এলাম, একটিও পেলাম না।”
“আপনি এই ভরা পেট নিয়ে আবার মিষ্টি খেতে চাইছেন? এবার পেট ফেটে যাবে নির্ঘাত।”
“তবুও মায়ের মিষ্টি দেওয়া উচিত ছিল।”
“আপনি মিষ্টি খাবেন? আমি নিয়ে আসছি।”
“না, এখন আর খাবো না। মা ভুল করে মিষ্টি দেয়নি, তার মেয়ে হিসেবে তোর উচিত তার ভুল শুধরানোর। কাছে আয় আরু, আমাকে মিষ্টি মুখ করা।” বলে অপূর্ব মাথা এগোলে আরুর দিকে। আরুর অধরে অপূর্বর স্পর্শ পৌঁছাতেই ছটফট করে উঠে আরু। অপূর্বকে ফেলে ত্যাগ করে কক্ষ। অপূর্বর মনে পড়ে গতরাতের কথা। দোতলায় বসে কাজ করছিল অপূর্ব। রাত করে বাড়িতে ফেরে মোতাহার আহসান। দোতলায় আলো জ্বলতে দেখে সংশয় নিয়ে স্ত্রীকে প্রশ্ন করে, “দোতলায় আলো জ্বালিয়ে রেখেছ কেন? এই গ্ৰামে বিদ্যুৎ কেবল আমার একার ঘরেই আছে। এত অপচয় কেন করছ?”
“অপূর্ব আছে দোতলায়।” অনিতা বাক্য তোলে।
“কেন? আরুর সাথে জোড়া নায়র যায়নি?”
“ওর কীসব কাজ আছে, তাই আরু একা গেছে।”
“অপূর্ব নিজেকে কী মনে করেছে? ওর যদি এতই ব্যস্ততা তাহলে এখন কেন বিয়ে করল? কালকে বিয়ে করেছে আর আজকেই ও এত ব্যস্ত হয়েছে যে, জোড়া নায়র যেতে পারেনি। ফুফু বাড়ির আবদার? অপূর্বর জন্য ঐ বাড়ির লোকদের কথা শোনাতে ছাড়বে পাড়া প্রতিবেশীরা? ফুফু বাড়ি তো শ্বশুর বাড়ি, তাই গুরুত্ব দিচ্ছে না। ওকে ঘুমাতে বারণ করে দাও, আমি খেয়ে ওর সাথে কথা বলল।” কথাটা বলে মোতাহার আহসান খাবার ঘরে গেলেন। অনিতা দ্রুত কাঠের সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে উঠে গেলেন। অপূর্বকে স্বামীর কথাটা জানাতেই তড়িগড়ি করে তৈরি হয়ে নিল। অনিতা ঘরে থাকা মিষ্টি, পান, বিস্কুট অপূর্বর হাতে ধরিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বের করে দিলেন। বৃষ্টি তখন ঝুম দিয়ে পড়ছে। অনিতা ঘরে গিয়ে অপূর্বর জন্য ছাতা নিয়ে এলেন। কিন্তু অপূর্ব দম না দিয়ে ভিজে চলে গেল। সেখানে গিয়ে নিজের পোশাক ছেড়ে ইমদাদ হোসেনের পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরিধান করে নিয়েছে।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৩
অতিবাহিত হয়েছে কয়েকমাস। চোখের পলকে পেরিয়ে এসেছে সময়। সামনে আরু, শেফালী ও তুরের টেস্ট পরীক্ষা। আজ স্কুল থেকে রুটিন দিয়েছে। তন্বীসহ চার বান্ধুবী পরীক্ষা নিয়ে কথা বলতে বলতে ফিরছিল বাড়ির পথে। হঠাৎ তাদের সামনে একটা সাইকেল থামে। প্রয়াস মুচকি হেসে তুরের দিকে তাকায়। কাশি দিয়ে বলে, “আমার তুরের সাথে কথা ছিল। আপনারা একটু ওকে আমার সাথে ছাড়বেন?”
তিন বান্ধবী একত্রে সালাম দিল, “আসসালামু আলাইকুম ভাই।”
সালাম না দিয়ে প্রেমিকাকে চাওয়াতে খানিক লজ্জা পেল প্রয়াস। মাথানত করে বলে, “ওয়া আলাইকুম সালাম।” পরপর আরুকে বলে, “আরু, অপূর্ব ভাইয়ের সাথে কেমন চলছে তোমার দিনকাল?”
“নাম ধরে নয়, ভাবী বলুন। সম্পর্কে অপূর্ব ভাই আপনার বউ, তার স্ত্রী আপনার বড়ো হবে।”
“জি।”
“শেফালীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। তুরকে কবে বিয়ে করবেন? তৃতীয় ব্যক্তি যাতে আপনাদের সম্পর্কে না ঢুকে। চল আমরা আগে আগে যাই।” শেফালী ও তন্বীর হাত ধরে সামনে সামনে পথ ধরে আরু। মাঝপথে তন্বীকে বিদায় দিয়ে কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই দেখা মিলল কালাচাঁনের। আড়চোখে শেফালীর দিকে তাকিয়ে বইখাতা গুলো শক্ত করে ধরে আগে আগে পেরিয়ে যায় পথ। বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে দেখতে পেল অন্য দরজা দিয়ে অপূর্ব ভেতরে প্রবেশ করছে। হাতে বাজারের থলে থাকার সত্ত্বেও, সেই থলে থেকে চুইসে চুইসে রক্ত ঝরে পড়ছে। অপূর্ব থলেটা অনিতার দিকে দিয়ে বলে, “আমার এক কলিগের পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছে। দুটো খাসি দিয়ে আকিকা দিয়েছে। পরিচিত সবার জন্য খাসির মাংস এনেছে। ভালোবেসে নিয়ে এসেছে, তাই নিয়ে এলাম। রান্না করে আরুর জন্য দুই টুকরো রেখে সবাইকে দিও।”
“আরুর জন্য আমি কেন আলাদা করে রাখব? ও খাসি মাংস খেতে ভালোভাবে। যতটা খেতে পারে খাবে, প্রয়োজনে আমি রাখাল ভাইকে আবার বাজারে পাঠিয়ে দিবো কাল সকালে।” বলে অপূর্বর থেকে মাংস নিয়ে হাঁটা দিল। আরু বইখাতার সোফার উপরে রেখে ফিরে এলো। অনিতার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে বলে, “আমি এক্ষুনি ধুয়ে বসিয়ে দেই। টাটকা খেতে বেশি ভালো লাগে।”
“তোর সামনে পরীক্ষা, তোকে রান্না করতে হবে না।”
“আমি তো এই বাড়ির বউ। ভাবীও এই বাড়ির বউ। আমার উচিত তার থেকে বেশি কাজ করা। কারণ আমি বড়ো বউ।” তারপরে মাংসগুলো নিজের মনের মতো টুকরো করে নিল। ভালোভাবে ধুয়ে বসিয়ে দিল উনুনে। মশলা দিয়ে মাংসগুলো উনুনে রেখে বই নিয়ে বসল ইশরা। উনুনে লাকড়ি দিতে দিতে বই পড়ছে। অন্যদিকে অপূর্ব গোসল সেরে আরুর কাছে এলো। আরুকে এভাবে রান্নার পাশাপাশি পড়তে দেখে প্রসন্ন হলো। আরুর কাজ সহজ করতে অপূর্ব নিজেও বসল উনুনের কাছে। আগুনে কাঠ পুড়ে ছাই হলে দুই একটা কাঠ ভেতরে দিচ্ছে। অপূর্ব বলে, “আজ এত আগ্রহ নিয়ে পড়ছিস। কবে পরীক্ষা, কিছু জানিয়েছে?”
“রুটিন দিয়েছে।” বলে আরু তার বইয়ের ভেতরে থেকে অপূর্বকে রুটিন বের করে দিল। রুটিন পর্যবেক্ষণ করে অপূর্ব বলে, “এখনো এক সপ্তাহ।”
সময়টা অগ্রহায়ণের প্রথম দিকে। মৃদু শীতের আবহাওয়া। সবাই এসে উনুনের কাছে বসে। আরু লক্ষ্য করে শেফালী নেই। উঁকিঝুঁকি দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করে, “মা, শেফালী ঘরে এক একা কী করছে?”
মণি আঁতকে বলে, “ওকে তো দেখলাম না। আসলে আমার সাথে আগে দেখা করে।”
“তাই তো! আমিও দেখিনি।” অনিতা তাল মেলায়। অনিতার হতে সবাই সহমত হয় কেউ দেখেনি। সবাই তো সন্দেহজনক দৃষ্টিতে আরু ও তুরের দিকে তাকায়। আরু নতজানু হয়ে আমতা-আমতা করে বলে, “কালাচাঁন এসেছিস সেখানে। শেফালীর সাথে কথা বলবে, তাই আমি ওকে রেখে এগিয়ে এসেছি। পেছনে তুর ছিল।”
“আমি ফেরার পথে শেফুকে দেখিনি। আমি জানি, তোরা দুজনে একসাথে।”
অপূর্ব বিরক্ত হয়ে বলে, “আজব ব্যাপার! তোরা তিনজনে সামনে পেছনে হেঁটেছিস কেন? তোরা না সবসময় হাত ধরে হাঁটিস?”
কেউ কোনো জবাব দিতে পারল না। অপূর্ব বিরক্ত নিয়ে মোতাহার আহসানকে কল দিল। কালাচাঁনের ফোন নাম্বার অপূর্বর কাছে নেই। রিসিভ হতেই অপূর্ব বিরাগী হয়ে বলে, “বাবা, শেফালী বাড়ি ফেরেনি। কালাচাঁন ওদের স্কুলের সামনে গিয়েছিল।”
“শেফালী কালাচাঁনদের বাড়িতে গেছে। বাসন ধুতে গিয়ে ঘাটলা ভেঙে বেয়ান দিঘিতে পড়ে গেছে। হাত ভেঙে গেছে বোধহয়। তুমি ডাক্তার, তোমাকে আর বোঝাতে হবেনা আশা করি।” ওপাশ থেকে মোতাহার আহসান।
“কিন্তু বাবা, ওদের এখনো বিয়ে হয়নি।”
“বেয়ানের সাথে আমার কথা হয়েছে। তিনি বলেছে, কাজি নিয়ে যেতে। তোমরা সবাই তৈরি হয়ে নাও। তারপরে কালাচাঁনদের বাড়ির দিকে এগোও। আমি তিয়াসকে ফোন করে কাজি নিয়ে আসতে বলেছি।” তারপরে ফোন রেখে দিল মোতাহার আহসান। পরক্ষণে মহিলাদের আদেশ দিল অপূর্ব, “কালাচাঁনের মায়ের হাত ভেঙেছে, তাই কালাচাঁন শেফালীকে নিয়ে গেছে ওদের বাড়িতে। বাবা সবাইকে তৈরি হয়ে ওদিকে যেতে বলেছে। কাজি ডেকে আজ শেফালীকে কালাচাঁনের হাতে তুলে দিবে। এই অবস্থায় সংসার সামলাতে শেফালীকে সেখানে প্রয়োজন।”
অপূর্বর কথা শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে গেল সবাই। তৈরি হতে চলে গেল। অপূর্ব ফ্রেশ হয়ে বসে ছিল বিদায় আর তৈরি হতে গেল না। আরুর পরনে এখনো স্কুলের পোশাক। একদিকে উনুন জ্বালানো অন্যদিকে শেফালীর কাছে যাওয়া প্রয়োজন। কী করবে ভাবছে আরু! অপূর্ব বাটি থেকে পানি ফেলে উনুনের কাছে বসে কষানো মাংস নেওয়া চেষ্টা করছে। আরু বাটিটা নিয়ে কয়েক টুকরো মাংস দিয়ে বলে, “আমি কি যাবো না-কি থাকব?”
“বাবা সবাইকে যেতে বলেছে। বাড়ি পাহারা দেওয়ার মানুষ আছে। তোর যদি যেতে ইচ্ছে না করে তাহলে থাকতে পারিস।” বলে অপূর্ব মাংস টেনে ছেঁড়া চেষ্টা করে। ভালোভাবে সিদ্ধ না হওয়াতে কোষ আলাদা হচ্ছে না। অপূর্ব থমথমে গলায় বলে, “এটা খাসির মাংস না-কি গন্ডারের? ওরা ভুলে খাসির বদলে গন্ডার দিয়ে ফেলে না-তো? চিবুতেই পারছি না।”
“সিদ্ধ হতে দিয়েছেন? জিভ থেকে জল পড়ছে।” ভেংচি দিয়ে আরু বলে। তারপরে ছুটে গেল ভেতরে। টাঙ্গাইলের শাড়ি পরে মাথায় কাপড় টেনে ঘর থেকে নামে আরু। তুর ব্যতীত সবার পরনে শাড়ি। সবার শেষে ঘরে থেকে নামে অনিতা। দরজায় বড়ো তালা ঝুলিয়ে একটা খিল্লি পান এনে চম্পার হাতে দেয়। চম্পা আঁচলে গিট দিয়ে নেয়। আরু অতি সাবধানে চম্পার পাশে হাঁটতে হাঁটতে আঁচল থেকে পান খুলে মুখে দেয়।
হেঁটে হেঁটে তাঁরা পৌঁছে যায় কালাচাঁনদের বাড়িতে। বাবা ও পাঁচ ছেলে চেয়ারে বসে খোঁজ নিচ্ছে সুন্দরীর। সুন্দরীর হাত প্রাকৃতিক জরিবুটি দিয়ে বাঁধা। অনেকটা ফুলে উঠেছে। নিঃসন্দেহে ভেঙে গেছে। মণি বেয়ানের পাশে বসে বলে, “বেয়ান হাত ভাঙল কীভাবে?”
“ঘাটলা থেকে পড়ে। এইদিকে তেমন বাড়ি ঘর নেই। সন্ধ্যা হলে আমি ঘরে ঢুকি আর বের হই না। শরীর খারাপ থাকায় দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়েছি। ঘুম থেকে উঠে দেখি মাগরিবের আজান দিচ্ছে। আছরের নামাজ শেষ। অন্যদিকে দূরের বাড়ি থেকে পানি আনতে হবে, পুকুর খেতে পানি এনে বালতি ভরতে হবে, মাগরিবের নামাজ পড়তে হবে। তাড়াতাড়ি ওজু করে কলস নিয়ে ঘরে যাওয়ার সময় পা পিছলে ঘাটলা নিয়ে পড়ে যাই। রাতে মনে করেছি, সামান্য ব্যথা। ঘুম থেকে উঠে দেখি ফুলে উঠেছে। কালাচাঁন আমাকে নিয়ে হাসপাতালে গেল বিকালে। কিছু টেস্ট করেছে। আগামীকাল বলবে, হাত ভেঙেছে কি-না। রিপোর্ট ভাঙা আসলে গ্ৰামের বাইরে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে।”
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পান চিবাচ্ছে আর কথা শুনছে আরু। মুখ ফিরিয়ে পানের পিক ফেলতে গিয়ে অপূর্বর শার্টে ফেলল। অন্ধকারে অপূর্ব ঠাওর করতে না পেরে মুখ খোলে, “কী ফেলেছিস? যেখানে-সেখানে এগুলো কী ফেলছিস?”
আরুর পরবর্তী দৃশ্য দেখার আগেই ভয়ে পেছনের দিকে গেল। সেখানে শেফালী রান্না করছে আর সুমি তাকে সাহায্য করছে।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৩ [বর্ধিতাংশ]
মাটির উনুনে রান্নার কারণে হাতে ও মুখে কালি লেগেছে শেফালীর। একদিকে লাকড়ি দেওয়া অন্যদিকে তরকারি দেখার জন্য শেফালী পেয়ে উঠছে না। আরু হাসতে হাসতে পিঁড়ি টেনে বসল। রঙ্গ করে বলে, “সারাবছর মা চাচিদের রান্না খেয়ে এসেছিস। এবার একটু তোর শাশুড়িকে রান্না করে খাওয়া।”
“আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য তোরা আর ছেলে পেলি না? একটা জঙ্গল এটা। আশেপাশে কেউ থাকেনা। আমি এখানে কীভাবে থাকব? একবার বাড়িতে যাই, আর আসব না।”
“হাস্যকর শেফু। কিছুক্ষণ পর তোকে পাকাপোক্ত এখানে রাখতে কাজি সাহেব নিয়ে আসছে তিয়াস ভাই। মার্কেট বন্ধ তাই ছোট চাচির বিয়ের শাড়ি এনেছে তোকে সাজাতে।” হাসতে হাসতে বলে আরু। মা ও চাচিরা ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে রসুইঘরে এসে পৌঁছেছে। সুমিকে রান্নার দায়িত্ব দিয়ে শেফালী মণিকে জড়িয়ে ধরে বলে, “মা, আমি এখানে থাকব না। তুমি আমাকে নিয়ে যাও। এখানে আমার ভয় করে।”
“স্বামী থাকলে সেখানে তোর কীসের ভয়? কোনো ভয় নেই। বিয়ের পর কালাচাঁনকে আঁচলে বেঁধে রাখবি। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে যাতে ও ঘরে থাকে।” শেফালীর মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দেয় মণি। তখনই শুনতে পেল অপরিচিত একটা কণ্ঠস্বর। অতঃপর শোনা গেল তিয়াসের গলা। অর্থাৎ কাজি সাহেব এসেছে। শেফালীর মন ভার হলো। মা ও চাচিরা শেফালীকে বোঝাতে শুরু করল। দীর্ঘক্ষণ পর তাঁরা শেফালীকে নিয়ে বারান্দায় গেল। রান্না ইতোমধ্যে শেষ।
শেফালীকে বধূবেশে তৈরি করে নিয়ে গেল ঘরে। মোতাহার আহসানের নেতৃত্বে নিকাহনামা লিখেছে কাজি। কালাচাঁনের নিকাহ পড়ানো শেষ। কোনে উপস্থিত হতেই কাজি সাহেব শুরু করলেন, “একশো এক টাকা ধার্য করিয়া ও নগদ টাকা বুঝিয়ে পাইয়া মরহুম আব্দুল লতিফ সিদ্দিকের একমাত্র পুত্র কালাচাঁন সিদ্দিক আপনার নিকাহ করিতে চায়। আপনি কি বিয়ে রাজি আছেন মা? তাহলে বলুন কবুল।”
শেফালীর চোখ থেকে পানি ঝরল মাটিতে। তাকিয়ে দেখল তার প্রিয়জনের মুখ। কবুল উচ্চারণ করার পর এই একা বাড়িতে ফেলে রেখে যাবে আহসান পরিবার। কাছের মানুষদের ছেড়ে শেফালী কীভাবে এখানে থাকবে? মুখে হাত দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল শেফালী। কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমি বিয়ে করব না, আমি বাবা মাকে ছেড়ে কোথাও থাকতে চাই না। আমি বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান। তাদের ছেড়ে কীভাবে এখানে থাকব।”
পেছনের বারান্দা থেকে মেয়ের কান্না শুনে কেঁদে ফেললেন মণি। আবেগপ্রবণ হলো শাহিনুজ্জামান। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলে, “এটাই নিয়তি। বিয়ের পর প্রতিটি মেয়েকে বাবার বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়িকে আপন করে নিতে হয়।”
“এতই আপন করে নিতে হয় যে, বোনের বিয়েতেও খবর দেয় না।” বলতে বলতে ভেতরে প্রবেশ করে তিস্তা। তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সুজন। উপস্থিত সবাই বিস্মিত তিস্তাদের দেখে। এতকিছুর মাঝে তিস্তার কথা মাথা থেকে বের হয়ে গেছে। জাহানারা উৎফুল্লিত হয়ে তিস্তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “এতরাতে কীভাবে এলি, খবর পেয়েছিস কীভাবে?”
“তোমাদের কাছে পর হয়ে গেলেও তিয়াসের কাছে এখনো বোন। ও আমাকে জানিয়েছে।” কথাটা বলে শেফালীর পাশে বসে তিস্তা। মোতাহার আহসান খোশমেজাজে বলেন, “তোকে দেখে আমার ভালো লাগল। আমাদের চলে যাওয়ার পর ভাইবোনের সম্পর্ক এভাবে থাকুক।”
পরিবারের বড়ো মেয়ে হওয়ার কারণে তিস্তা সবার আদরের। মোতাহার আহসান চোখের ইশারায় শেফালীকে ঈঙ্গিত করল। দুঃখী মুখ করে তিস্তা বলে, “মন খারাপ করিস না শেফু বেবি। তুরের বিয়েটা হতে দে, তারপরে আমরা তিনজনে ঘর জামাই থাকব। বাড়ির মেয়ে তিনজনের সাথে দুইজন বউ পারবে না।”
কবুল বলার লক্ষণ পাওয়া গেল শেফালীর মাঝে। আড়চোখে তিস্তার পানে চেয়ে বলে, “তুমি ঠিক বলছ তো?”
“হ্যাঁ।”
“আলহামদুলিল্লাহ কবুল। আলহামদুলিল্লাহ কবুল। আলহামদুলিল্লাহ কবুল।” এক নাগাড়ে বলে ফেলে শেফালী। এতক্ষণ হেঁয়ালি করা মেয়েটাকে হঠাৎ এভাবে কবুল উচ্চারণ করাতে সবাই হাসল। শাহিনুজ্জামান ও মণি তাদের একমাত্র মেয়ে শেফালীকে কালাচাঁনের হাতে তুলে দিয়ে বলে, “আমার একমাত্র মেয়ে শেফালী। তোমার সম্পর্কে আমার ধারণা মন্দ। কেবল আমার ভাইয়ের কথাতে শেফালীর সাথে তোমার বিয়েতে রাজি হয়েছি। আমাদের কাছে মেয়ের সুখই আমার সুখ। মেয়ে অসুখী হলে এই বিয়ে ভাঙতেও আমাদের সময় লাগবে না।
আমাদের বাড়ির ভাগনিকে তোমার হাতে তুলে দিতে না-পারলেও, মেয়েকে তুলে দিয়েছি। আশা করি, আমাদের মান রাখবে।”
সুন্দরী শেফালীর হাত ধরে বলে, “কালাচাঁন নয়, শেফালীর দায়িত্ব আমি নিলাম। ওকে সুখে রাখার দায়িত্ব আমার। কালাচাঁনকে যখন জুতার মালা গলায় পরিয়ে গ্ৰাম থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তখন কেবল এই শেফালী আমার কোল খালি হতে দেয়নি। তাই শেফালীকে কালাচাঁনের বউ করে এনেছি। আমি বিশ্বাস করি এই শেফালী আমার কালাচাঁনকে বুঝতে পারবে।”
অতঃপর সুন্দরী চোখের ইশারা করলেন শেফালী ও কালাচাঁনকে। ঈঙ্গিত বুঝতে পেরে পা ছুঁয়ে সালাম করে আশির্বাদ চায় ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য। মোতাহার আহসান বলেন, “দুজন দুজনকে বুঝে সবার দায়িত্ব নেওয়াই সংসার। দোয়া করি কালাচাঁন ও শেফালী সুখী হোক। কালাচাঁন তোমাকে আমি ভরসা করে ভাই ও ভাবীকে বুঝিয়ে শেফালীকে দিয়েছি। ওদের কাছে আমার মাথা হেঁট করবে না।”
“জি চাচা।”
“আমরা এগোই। মা আপনি শেফালীর সাথে থাকবেন?” মোতাহার আহসান চম্পাকে উদ্দেশ্য করে বলে। চম্পা সায় দিল, “কাছের কেউ থাকলে শেফালী ভরসা পাবে। আমি আজ থাকি।”
মধ্যবয়স্ক পুরুষেরা চলে গেলেন। থেকে গেল জাহানারা, মল্লিকা ও ছোটোরা। হাসতে হাসতে বারান্দায় গেল তিস্তা। সুমি, তুর ও আরু পেছনের বারান্দা গোছাচ্ছে। তিস্তা ব্যাগ থেকে কিছু গাঁদা ফুল বের করে বিছানার উপরে রাখল। সুমি ভ্রু কুঁচকে বলে, “তিস্তা আপু ফুল পেলেন কোথায়? চাচা তাড়াতাড়ি আসতে বলাতে আমরা ফুল সংগ্রহ করতে পারিনি।”
“দিঘির পাড়ে কয়েকটা গাঁদা ফুল গাছ লাগিয়েছি। আসার সময় হঠাৎ চোখ পড়ল ফুলের দিকে। তাই পরিস্থিতি আন্দাজ করে নিয়ে এলাম।”
অতঃপর চারজনে মিলে হাতে হাতে ফুল দিয়ে ঘর গুছিয়ে ফেলল। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে কালাচাঁন ও শেফালীকে বাসর ঘরে নিয়ে এলো। তিয়াস একজোড়া স্বর্ণের আংটি বের করে শেফালীর হাতে দিয়ে বলে, “আজ থেকে তোর জীবন শুরু হয়েছে। অতীত ভুলে গিয়ে কালাচাঁনকে নিয়ে সুখী হ। আমাদের ভাগ্যে যা লেখা আছে, তাকে নিয়েই জীবন সাজাতে হবে।”
শেফালী তাকাল তিয়াসের দিকে। কালাচাঁনের বিচারের দিন তিয়াস শেফালীকে স্বার্থপর বলেছে। এরপর আর কখনো কথা হয়নি। আজ আবার কথা বলেছে। অথচ এই মানুষটাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছে। অন্যদিকে কালাচাঁন আরুর দিকে তাকিয়ে আছে। মুক্তার মতো দাঁত পানে লাল হয়েছে। ঠোঁটের মাঝ থেকে চুইষে পড়ছে লাল রঙের তরল পদার্থ। এতে আরুকে মোহনীয় লাগছে কালাচাঁনের। এই বাসর সাজানোর কথা ছিল আরুর নামে, অথচ সেখানে শেফালী। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে কালাচাঁন বলে, “আপনারা যেতে পারবেন না-কি আমি দিয়ে আসব?”
“আজ তোমাদের বাসর। নিজেদের সময় দাও। আমরা যেতে পারব।” বিরতি দিয়ে অপূর্ব বলে, “যদি হাত ভেঙে থাকে, তাহলে আমি নিজ দায়িত্বে আমার পরিচিত এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। আর আমরা ভাইবোনেরা তাকে সঙ্গ দেওয়ার পাশাপাশি সেখানে ঘুরেও আসব কয়েকদিন।”
“আচ্ছা ভাইয়া।” কালাচাঁন বলে। অতঃপর সবাই দলবেঁধে বেরিয়ে গেল আহসান বাড়ির উদ্দেশ্যে। দরজার খিল তুলে দিল কালাচাঁন। পরক্ষণে লক্ষ্য করল, তিয়াসের দিয়ে যাওয়া জুয়েলারি বক্সটা মাটিতে পড়ে আংটি দুটো পায়ের কাছে এসেছে গড়িয়ে। মাটিতে বসে অঝোর ধারায় কাঁদছে শেফালী। কালাচাঁন কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার অন্তঃকরণ ক্ষয় হচ্ছে আরুর নামে। পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে কামনা করেছে।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]