#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০১
“অপূর্ব ভাই দেশে ফিরেছে, তাতে আমার কী মা? তোমার ভাই-পো, তুমি শীতের পিঠা নিয়ে যাও। গতবার রাজহাঁসের লড়ানি খেয়ে হাঁটু ছিলে এসেছি। আমি আর হাঁটু ছিলতে ঐ বাড়িতে যাবো না, ব্যাস।”
ছাগল ছানা মিঠুকে আঁকড়ে ধরে নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থেকে বলে আরু। মেয়ের কথাতে অপ্রসন্ন হলেন পারুল। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে পারুল ধমকে বললেন, “অ/ভ/দ্র মেয়ে, মায়ের কথা শুনছে না।”
“আমি অ/ভদ্র, তাই না? তাহলে আরও অ/ভদ্র হবো, যাবো না।” ক্রোধের গোঙানির শব্দ তুলে আরু অগ্ৰসর হলো দিঘির দিকে। ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে এসে আরুর কাঁধ দখল করে নিল ময়না পাখি। অতঃপর পারুলের সাথে তাল মিলিয়ে দুবার বলে, “অ/ভদ্র মেয়ে, অ/ভদ্র মেয়ে।”
তৃতীয় বার বলার পূর্বেই ধমকে আরু বলে, “চুপ, একদম চুপ। আর একবার যদি বলিস, দুইদিন খেতে দিবো না।” আরুর ধমকানিতে ‘অভ/দ্র মেয়ে’ দুই শব্দের বাক্যটি ভুলে গেল ময়না। আরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পারুল বলে,
“অপূর্ব আমার হাতের পাটিসাপটা পিঠা খেতে পছন্দ করে, আরুসোনা। গতকাল ছেলেটা দেশে ফিরেছে। ধান সিদ্ধ দিয়েছি, এখন যেতেও পারব না। তাই পিঠা করে দিয়েছি। তুই একটু কষ্ট করে যা-না, মা।”
মায়ের মিষ্টি কথাতে নিজ সিদ্ধান্তে দীর্ঘক্ষণ অনড় থাকতে পারে না আরু। তৎক্ষণাৎ পিঠার বাটিটা কেড়ে নিয়ে ইতস্তত করে আরু বলে, “গোসল করে খেয়ে যাই।”
“ওখানে গেলে তোকে না-খাইয়ে রাখবে না আমার ভাবী। যাওয়ার পথে নদীতে গোসল করে যাস। ভাবীর শাড়ি পরবি। আবার ফেরার সময় নিজের জামাকাপড় পরে আসবি।”
“ময়নাকে নিয়ে যাই?”
“অপূর্ব ঘোড়া নিয়ে এসেছে। বিদেশি ঘোড়া। ঘোড়া দেখে তোর ময়না ভয় পাবে। ওকে রেখে যা।” বলেই হাত মেলে ময়নাকে কাছে আসার জন্য ইঙ্গিত করল পারুল। অবিলম্বে পারুলের হাত গিয়ে দখল করল ময়না। ঘোড়া! বিদেশি ঘোড়া। গ্ৰামের এই অজপাড়া গাঁয়ে কখনো ঘোড়া আসেনি, যার দরুন দেখাও হয়নি আরুর। আনমনে ভেবে আরু শুধাল, “মা, প্লেনে করে ঘোড়া আনা যায়?”
“জানি না, অপুকে জিজ্ঞেস করিস। আমার অপুকে তো জীবনেও দেখিস নি। দেখবি একদম রাজপুত্র। তাড়াতাড়ি যা।” বলেই পারুল ঘরে চলে গেলেন। মামা বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও ঘোড়া দেখার ইচ্ছে আরুর। সেই আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করতে অগ্রসর হলো ‘সাত ভাই চম্পা’ নিবাসের উদ্দেশ্য।
আরশি মৃধা আরু। পড়াশোনায় বড্ড পাকা আমাদের প্রিয় আরু। আরুদের বাড়ি থেকে মামার বাড়ির দূরত্ব একটা খাল। সচরাচর মামা বাড়িতে দেখা যায় না তাকে। অপূর্ব ভাই! অবশ্য তাকে কখনো আরু দেখেনি। বড়ো মামা মোতাহার আহসান বিদেশে পড়াশোনার জন্য গিয়েছিল, তখন তার সাথে পরিচয় হয়েছিল অনিতার। সেখানে বিয়ের এক যুগ সমাপ্ত করে দেশে ফিরেছেন। এলেন না, তার একমাত্র ছেলে অপূর্ব। তিনি নানাদের কাছেই বড়ো হলেন। আরুর বাবা ইমদাদুল হোসেন মৃধা ব্যবসার কাজে প্রায়ই বিদেশে যান, তখন মনের মতো পিঠা তৈরি করে দেন পারুল।
আহসান বাড়িতে রাজহাঁস পোষণ। আহসান বাড়ির পূর্ব প্রজন্ম এই রাজহাঁস পুষতেন। বংশের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এখন রাজহাঁস পোষেণ তাঁরাও। এখন তাদের দশটা বাচ্চা। গতবার রাজহাঁসের দৌড়ানি খেয়ে ‘গাউছিয়া মার্কেট’ থেকে বাবার কিনে দেওয়া থ্রী পিসের সালোয়ারটা ছিঁ/ড়ে গেছে। এজন্য ডাল গুটুনি-টা ভেঙেছেন আরুর পিঠে।
খালের ভাটার টান পড়েছে। খাল সাঁতরে পিঠা নিয়ে উপস্থিত হলো আহসান বাড়ির দোরগোড়ায়। ভেজা থাকায় দিঘির দক্ষিণের প্রবেশদ্বার দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল আরু। ঢাকনা খুলে একবার পরখ করে নিল পিঠাগুলো। ঢাকনা যুক্ত বিধায় বাটি ভিজলেও পিঠাগুলো ভিজল না। পুনরায় ঢাকনা বন্ধ করতে ভুলে গেল।
‘এক দুই তিন চার এমনি করে, বছরগুলো পেরিয়ে’ গান ধরতে ধরতে ভেজা আরু পৌঁছে গেল মামার বাড়িতে। দিঘির পাড়ে ঘাসের উপর চেয়ারে লুঙ্গি পরিহিতা এক পুরুষ রোদ পোহাচ্ছে। তাঁকে দেখামাত্র আরুর হৃৎপিণ্ডের গতি বৃদ্ধি পেল। সিল্ক চুলগুলো রোদ্দুরে লালচে দেখাচ্ছে। বিদেশি বলে? চাপ দাড়ির মাঝে টোল পড়া গালের হাসিটা তীরের মতো বিঁধল বুকে। প্রথমবার দেখা সেই পুরুষটি আরুর হৃদয়ে জায়গা করে নিল। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে গিয়েও যথাসম্ভব সামলে নিল নিজেকে। আচমকা শ্রবণ হলো রাজহাঁসের ‘কড়কড়’ কণ্ঠস্বর। রাজহাঁসের বাচ্চার উপর পা দিয়েছে সে। অতিদ্রুত সরে এলো। বাচ্চারা মায়ের কাছে ছুটে গেল। ‘কড়-কড়’ করে আরুর নামে বিচার দিল। অতঃপর মা রাজহাঁসটা ছুটে এলো দ্রুত গতিতে। দু-হাতে বাটিটা আঁকড়ে ধরে দিল দৌড়।
‘ঝুনঝুন! ঝুনঝুন! ঝুনঝুন!’ নূপুরের ঝুনঝুন করা শব্দে অপূর্ব ফিরে তাকায় পেছনে। আকাশী রঙের ভেজা ফ্রক পরা একটি মেয়ে রাজহাঁসের থেকে বাঁচতে ছুটে চলেছে। ফর্সা পায়ে বেশ লাগছে নূপুরটি। ইউকে বসবাসরত অবস্থা নূপুর পরিহিত কোনো নারীকে দেখেনি অপূর্ব! তবে গ্ৰামে সব মেয়েরা এই নূপুর পরে। হালকা রঙের ভেজা পোশাক আঁটসাঁট হয়ে দেহের ভাঁজ প্রকট করছে। মেয়েটির ফিগার দেখে অপূর্ব-র তাকে কিশোরী মনে হলেও তার পোশাক আশাক নিতান্তই বাচ্চা। হাতেও রুপার বালা, তাতেও ঝুনঝুন করছে, গলাতে রুপার চেন, নাক-কান এমনকি মধ্য-নাকেও রয়েছে রুপার নথ। হাতে বাটি। ভিখারিরা রুপা ব্যবহার করে? অপূর্ব-র অশান্ত মন, আরুকে ভিখারি ভেবে নিল। অপূর্ব-র ভাবনার মাঝে ঈষৎ দূরে জমানো গোবরের স্তূপে গিয়ে পড়ল আরু। হাতে পিঠা পুলি গুলো পড়ল গোবরে। হাত, পা, মুখ ও ভেজা পোশাকে গোবরে যেন পদ্মফুল আরু। আরুর গোবর রূপ দেখে সয়ং রাজহাঁস ভয়ে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ছুটে গেল। পরক্ষণে ছিঁচকাদুনে আরু কেঁদে উঠল। শরীরে গোবরে গন্ধে গাঁ গুলিয়ে উঠছে তার।
বাটি নিয়ে এগিয়ে গেল। চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলে দেশে ফিরেছে বলে, মোতাহার আহসান চাল ডাল বিলিয়েছে। অপূর্ব উচ্চস্বরে বলে, “মা, ভিখারি এসেছে। সকালের মতো এনাকেও দু মুঠো চাল দাও।”
হাত থেকে গোবরে ভর্তি বাটিটা নিচে পড়ল আরুর। ভুবন কাঁপানো চিৎকার দিয়ে বলে, “বড়ো মামি!”
অনিতা চালের বাটি সমেত হাজির হলেন বটে। তবে, বাকিরা সবাই আরুর চিৎকারে উপস্থিত হলো। লাঠিতে ‘ঠুক-ঠুক’ শব্দ করে নানি জান এলো। অনিতা বলেন, “আরু, তুই। (আশেপাশে তাকিয়ে) অপু ভিখারি কোথায়?”
আরু বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো। ‘নানা বাড়ির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও সুদর্শন পুরুষটি আমার এই অপূর্ব ভাই।’ অপূর্ব হাই তুলে বলে, “সামনে গোবর ভর্তি বাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভিখারিকে দেখতে পারছ না, মা। খাবার আর টাকার অভাবে গোবর বাটিতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।”
নানি জান হেসে ফেললেন। বললেন, “পাগলী মেয়ে। তা তোকে তো স্বপ্নেও আমাদের বাড়িতে পাওয়া যায় না। হঠাৎ এলি যে।”
“আমি নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছি, এই বাড়িতে যতদিন রাজহাঁস থাকবে ততদিন আমি এই বাড়িতে পা রাখব না। কিন্তু তোমার মেয়ে জোর করে এই বাড়িতে পাঠিয়েছে, আমি মন থেকে মোটেও আসিনি।
আর এই ছেলেটা বলছে, আমি না-কি ভিখারি।” ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে না-ঝরা চোখের পানি মুছে নিল আরু।
অপূর্ব নাকে হাত দিয়ে দুর্গন্ধ দূর করার প্রচেষ্টা করছে। অনিতা বলে, “ও আরু। তোর ফুফুর একমাত্র মেয়ে।”
“ফুফির সেই ফা/জিল/ মেয়েটি?” নির্বিকার ভঙ্গিতে কথাটা বলে সম্মুখে আসা চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিল অপূর্ব। আরু পরপর দুই একবার ডানে-বামে মাথা নামিয়ে নাকোচ করতে চাইলেও নাকোচ করতে সে পারল না। সতিটা সত্যি রয়ে গেল। স্তম্ভিত হয়ে ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু আরু করে উঠতে পারল না। বিব্রত পরিস্থিতি তুর, শেফালী ও তিস্তা হাজির হলো। তুর আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে, “এই আরু, তবে তুই এলি? অপূর্ব ভাই ঘোড়া এনেছে। দেখলে আয়।”
কয়েক মুহুর্তের জন্য ‘ঘোড়া’ নামক প্রাণীটার নাম আরুর মস্তিষ্ক থেকে কাট হয়ে গিয়েছিল। পুনরায় মস্তিষ্কে যুক্ত হতেই লাফিয়ে উঠল আরু, “চল, দেখে আসি। মা-তো আমাকে ঘোড়ার লোভ দেখিয়ে পিঠা পাঠিয়েছেন।”
আরু দুকদম এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে বাহু টেনে ধরল অপূর্ব। ৪৫° ঘুরিয়ে ঈষৎ নিকটে এনে রুদ্র গলায় বলে, “এই নোংরা অবস্থায় আমার ঘোড়ার কাছে যাবি না।”
প্রথমবার অজানা পুরুষের স্পর্শ পেতে হৃৎপিণ্ডের রক্ত চলাচল থেমে গেল আরুর। অপূর্ব-র বলার সময় নির্গত হওয়া প্রতিটি শ্বাস আরুর কপালে সংঘর্ষ করছে। গ্ৰামের সেই বোকা অথচ চঞ্চল মেয়েটি আজ বাক্যহীন কোনো পুরুষের সংস্পর্শে এসে।
হুট করে কাছে টেনে নেওয়ার সময় আরুর শরীরের সেই গোবরের কিছু অংশ ছিটকে গেল অপূর্ব-র শরীরে। ডানহাত দিয়ে শক্ত করে চেপে রাখা আরুর হাতটা সে ছাড়ল না বরং, বিশ্রী গন্ধ থেকে পুনরায় নাক-কে বাঁচাতে চেপে ধরল নাক। ক্রুব্ধ কণ্ঠে বলে, “দিলি তো আমাকে নোংরা করে। ইচ্ছে করছে গোবরের ভেতরে নিয়ে ঢুবিয়ে রাখি।”
“আপনি টান দিলেন বলেই তো..। তাছাড়া সব দোষ আপনাদের হাঁসের। হাঁস-কে নিয়ে ঢুবিয়ে রাখুন গোবরে।”
“বললেই হলো। নাম তো আরু। আরু আর গরু সমানই। তোকে গরু মনে করে হাঁসে দৌড়ানি দিয়েছে। তোর জন্য আমাকে আবার গোসল করতে হবে। আমার গোসলের সব পানি তুই কল চেপে তুলে দিবি।”
“বললেই হলো? যাবো না।” দৃঢ় গলায় আরু।
“দেখা যাবে।” বলতে বলতে অগ্ৰসর হলো কলতলার দিকে। হাতে টান পড়ার দরুন আরুও এগিয়ে চলেছে সঙ্গে।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]