নিভৃত পূর্ণিমা – ৫
নাদিম ড্রাইভিং শেখাতে রাজি হওয়াতে খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল সায়রা বানু। গতকালের দিনটা খারাপ ভাবে শুরু হলেও আজ শেষটা সুন্দর হয়েছে। ভাগ্য ড্রাইভিং শেখার সুযোগ করে দিয়েছে। আমেরিকাতে ড্রাইভিং না জানা আর আরেকজনের কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটাচলা করা একই কথা।
— ফিরতে ফিরতে কতক্ষণ লাগবে? হাসি মুখে প্রশ্ন করল সায়রা বানু।
— ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া থেকে এলিকট সিটি ফিরতে তিন ঘণ্টার মতো লাগতে পারে। বিকেল হয়ে যাবে।
— পথে দেশি কোনো দোকানে থামতে পারবে?
— অবশ্যই পারবো। কী জন্য?
— কয়েকটা জিনিস কিনব। তুমি আমার জন্য এতকিছু করছ, আজ তোমাকে খুব মজার একটা জিনিস খাওয়াব।
— আর কষ্ট করার দরকার নেই। যা রান্না আছে, ওতেই হয়ে যাবে।
— এটা একটা বিশেষ আইটেম। আজ মন ভালো, আমারও খুব খেতে ইচ্ছে করছে।
— আমি হেল্প করতে পারি?
— পথে থেমে দোকানে নিয়ে গেলেই হেল্প করা হবে।
— আচ্ছা।
এপার্টমেন্টে ফেরার পথে কয়েকটা দেশি দোকান ঘুরে গমের আটা, ডাল, কয়েক রকমের মশলা, কয়েক রকমের ক্রাশড বাদাম আর দুটা প্যান কিনল।
ঘরে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে ওজু করে বেডরুমে নামাজ শেষ করে রান্না ঘরে এলো সায়রা বানু।
নাদিম বলল, একা একা রান্না করবে? দেখতে পারি?
একটু চিন্তা করল সায়রা বানু। রাজি হল। বলল, আচ্ছা, দেখ।
নাদিম ভেবেছিল কাচ্চি বিরিয়ানি, রাইতা টাইপের কিছু রান্না করা হবে, কিন্তু চাল, মাংস না নিয়ে কিচেন কাউন্টারে নানা রকমের ডাল, মশলা রাখতে শুরু করল সায়রা বানু। মোটামুটি সবকিছু হাতের কাছে এনে রান্নার আয়োজন শুরু করল।
ডাইনিং টেবিল থেকে রান্না ঘর দেখা যায়, কিন্তু আরো একটু এগিয়ে এল নাদিম। একা একা একজন রান্না করবে, সে বসে বসে খাবে, এটা ভাল দেখায় না।
— কিছু করতে হলে বলবে। বলল নাদিম।
— আচ্ছা। কিন্তু ভাব দেখে মনে হলো সায়রা বানুর সাহায্য লাগবে না।
কিচেন ক্যাবিনেট খুলে মাঝারি আকারের একটা এলুমিনিয়ামের বাটি বের করল। ক্যাবিনেটগুলো পরিষ্কার করে সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে। বাটিতে একটা কাপের চার ভাগের এক ভাগ পরিমাণ চানা ডাল নিল, তারপর পর্যায় ক্রমে সমপরিমাণ মসুর ডাল, উরের ডাল, আধা ভাঙ্গা সবুজ মুগ ডাল, তুর ডাল নিল। পানি নিয়ে ভালো করে কয়েকবার ধুয়ে যখন স্বচ্ছ, পরিষ্কার পানি বের হল, তখন সব পানি ফেলে দিয়ে আবার নূতন করে পানি দিয়ে ডালগুলো ভিজিয়ে এক পাশে রাখল।
এবার ভালো করে হাত ধুয়ে নিল। তারপর একটা অ্যালুমিনিয়ামের বোলে চার কাপ গমের আটা, অর্ধেক কাপ সেমোলিনা, অর্ধেক টেবিল চামচ বেকিং সোডা, এক চা চামচ আজওয়াইন পাউডার, আন্দাজ মতো লবণ, চার চা চামচ ঘি, দেড় কাপের মতো পানি ঢেলে ডান হাতে মেশাতে থাকল। অপর হাতে মাঝে মাঝে একটু একটু পানি দিয়ে, খুব শক্ত না, আবার খুব নরমও না, এরকম কাই এর দলা বানিয়ে ফেলল। বিভিন্নভাবে চেপে চেপে অনেকক্ষণ ছানল। তারপর ভেজা রুমালে ঢেকে এক পাশে সরিয়ে রাখল।
নাদিমকে বলল, পনেরো মিনিট এভাবে থাকবে।
এবার ডালের বাটির সব পানি ফেলে দিয়ে ডালগুলো প্রেশার কুকারে ঢেলে নিল। তারপর আন্দাজ মতো পানি, লবণ, সামান্য হলুদের গুঁড়া, এক চা চামচ ঘি দিয়ে ভালো করে নাড়ল। প্রেশার কুকার ওভেন টপ স্টোভে বসিয়ে আগুনে জ্বেলে দিল। প্রেশার কুকার চার বার শিস দিতেই, আগুন নিভিয়ে ফেলল। ঢাকনা খোলার আগে সব বাষ্প বের করে ফেলল।
এবার পাশের চুলায় এলুমিনিয়ামের পাতিলে একটু তেল, একটু ঘি দিয়ে তার মধ্যে আন্দাজ করে লবঙ্গ, শুকনো লাল মরিচ, সবুজ এলাচ, কালো এলাচ, তেজপাতা, দারুচিনির কাঠি, জিরা এবং সামান্য একটু হিং দিল। কয়েক সেকেন্ড ভালো করে নাড়ল। তারপর কুঁচি পেঁয়াজ, কাটা কাঁচা মরিচ দিয়ে তিন মিনিটের মত নাড়াচাড়া করল। এরপর আন্দাজ করে টমেটো পেস্ট, আদা-রসুন পেস্ট দিয়ে আরো দুই মিনিট ভাজল। তারপর ধনে গুঁড়া, হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া এবং গরম মসলা দিয়ে সাথে অল্প একটু পানি ঢেলে ভালো করে নাড়তে থাকল। যখন দেখল মশলা হয়ে এসেছে তখন প্রেশার কুকারের সব ডাল ঢেলে দিল। এবার ভালো করে নেড়ে নেড়ে মাঝারি আঁচে চার মিনিটের মত রান্না করল। তারপর চুলা থেকে সরিয়ে রাখল। এবার সামান্য একটু লেবুর রস দিয়ে আবার ভালো করে নাড়ল। চায়ের চামচ দিয়ে একটু ঘি ছড়িয়ে দিয়ে তারপর আগে থেকে কুঁচি করে কাঁটা ধনেপাতা ছিটিয়ে দিল। তারপর মুখ ঢেকে ওভেনে রেখে দিল যেন গরম থাকে। দেখে মনে হল ডাল রান্না শেষ হয়েছে।
ডাল রান্না শেষ করে একবার নাদিমের দিকে তাকাল। কিছু না বলে চুপচাপ দেখতে থাকল নাদিম।
ডাল রান্না শেষ করে আবার আটার কাইয়ের বাটি কাছে আনল। আটার কাই থেকে একটু খানি তালুতে নিয়ে গোল করে গলফ বলের সমান একটা গোল্লা বানাল। তারপর চাপ দিয়ে কিছুটা চ্যাপ্টা করে ফেলল। এভাবে সবগুলো আটার কাই দিয়ে গলফ বলের সমান ছোট ছোট চ্যাপ্টা আকারের অনেকগুলো গোল্লা বানিয়ে থালায় সাজিয়ে রাখল।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে সায়রা বানুর কাজ করা দেখছিল নাদিম। কি যে দ্রুত হাত চলে মেয়েটার! কত রকমের কাজ করছে। কখনো হাত উপরে তুলে ক্যাবিনেট থেকে এটা সেটা নিচ্ছে, কখনো ডানে-বামে জিনিস রাখছে, তারপরও দোপাট্টা একটুও এদিক সেদিক হয় না। ঘাগরা-চোলির সাথে ইচ্ছে মতো সেফটি পিন দিয়ে আঁটকে নিয়ে তারপর রান্নাঘরে এসেছে।
গোল্লা বানানো শেষ হতে চুলার উপর একটা বিশেষ রকমের এলুমিনিয়ামের প্যান বসাল। প্যানের নিচের দিকে চালনির মতো অনেকগুলো ফুটো করা। প্যানের মধ্যে আটার গোল্লাগুলো সাজিয়ে রাখল। তারপর মাঝারি আঁচে আগুন দিয়ে প্যানের মুখ ঢেকে দিল। প্যানের নিচে ছিদ্র থাকায় সরাসরি আগুনে আটার গোল্লাগুলো সেঁকা হতে থাকল। দাঁড়িয়ে থেকে একটু পর পর আটার গোল্লাগুলো উলটে দিতে থাকল যেন রঙটা বাদামি হয় কিন্তু বেশি পুড়ে না যায়।
সবগুলো আটার গোল্লা যখন সেঁকা হয়ে গেল তখন চুলা বন্ধ করে ফেলল। আটার গোল্লাগুলো দেখতে অনেকটা মিনি ব্রেড রোল বা ছোট বনরুটির মত হয়েছে, কিন্তু উপর দিকে ফেটে গেছে। নাদিমের মনে হলো গমের আটার ছোট ছোট বন রুটি বানাল সায়রা বানু।
উপর ফেটে যাওয়াতে নাদিম যেন ভুল না বোঝে সে জন্যই বোধ হয় সায়ার বানু বলল, উপরের দিকে ফেটে গেলে বুঝতে হবে রুটি ঠিক মতো হয়েছে।
চারটা রোল বাইরে রেখে বাকিগুলো একটা পাত্রে রাখল সায়রা বানু। সেঁকা গোল্লা রুটির উপর চামচ দিয়ে ঘি ছিটিয়ে একটু ভেজা ভেজা করল। পাত্রের মুখ কাপড়ের রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখল।
নাদিম ওর কিচেনে কী ছিল জানত। রান্না করতে যত প্যান, হাঁড়িপাতিল, সরঞ্জাম লাগছে সব কিছু শনিবার এবং আজ কেনা হয়েছে।
এবার আলাদা করে রাখা রুটিগুলো হাতে নিয়ে ভেঙ্গে কয়েকটা টুকরা করল। তারপর ব্লেন্ডারে দিয়ে ঝুরাঝুরা করে একটা বাটিতে ঢালল। দেখলে মনে রুটির ঝুরা হয়েছে। কিন্তু খুব মিহি করেনি। এবার ঝুরার উপর চামচ দিয়ে একটু ঘি ছড়িয়ে দিল। তারপর কয়েক রকমের বাদাম কুঁচি ছিটিয়ে তার উপর গুড়ের পাউডার ছিটিয়ে দিল। এবার হাত দিয়ে ভালো করে মেশাল।
নাদিমের দিকে তাকিয়ে বলল, সব তৈরি। তুমি ডাইনিং টেবিলে বসো।
চারটা ছোট সাদা বাটি বের করল সায়রা বানু। ওভেন থেকে ডাল বের করে দুটা বাটিতে বাড়ল। অন্য দুইটা বাটিতে রুটির ঝুরা দিল।
এবার একটা বড় প্লেটে একটা ডালের বাটি, একটা ঝুরা রুটির বাটি এবং দুইটা গোল রুটি এবং একটা চায়ের চামচ রেখে নাদিমের দিকে এগিয়ে দিল। বলল, এই খাবারটার নাম “ডাল বাটি চুরমা”। রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় একটা খাবার। সাধারণত লাঞ্চে, বিয়ে বাড়িতে খাওয়ানো হয়।
এবার কোন আইটেমের কী নাম সেটাও বুঝিয়ে দিল। ডাল দেখিয়ে বলল, পাঁচমিশালি ডালের নাম “ডাল”। গমের রুটি দেখিয়ে বলল, এই গোল্লা রুটি বা রোলকে বলে “বাটি” এবং সিরিয়ালের মতো দেখতে মিষ্ট রুটি চূর্ণকে বলে “চুরমা”। সব মিলিয়ে নাম হলো “ডাল বাটি চুরমা।“ কখনো রাজস্থান গেলে দেখবে এখানে সেখানে লোকজন কয়লার উপর এই গোল্লা রুটি সেঁকছে।
মনে মনে অবাক হলো নাদিম। “ডাল বাটি চুরমা” রান্না করতে লাগল দেড় ঘণ্টার মতো। কী পরিমাণ উচ্ছ্বসিত হলে গাড়িতে বসে ভেবেছে, আসার পথে কেনাকাটা করেছে, তারপর এত কষ্ট করেছে রান্না করেছে, যেন গরম গরম নাদিমকে খাওয়াতে পারে। যৌথ পরিবার বোধ হয় ওর জীবনটা নরক বানিয়ে ফেলেছিল।
প্লেট হাতে নিয়ে নাদিম বলল, অনেক ধন্যবাদ। কীভাবে খেতে হয়?
সায়রা বানু বলল, রাজস্থানে এই খাবার বড় প্লেটে পরিবেশন করা হয়। হাত দিয়ে রুটি ভেঙে ছোট ছোট টুকরো করে ডালে ডুবিয়ে খেতে পার। অথবা প্লেটে রুটির টুকরা রেখে তার উপর ডাল দিয়ে চামচ দিয়ে খেতে পারো। চুরমা সাধারণত খাবারের শেষে মিষ্টি হিসাবে খেতে হয়। অনেকে ডাল-বাটির সাথে মাঝে মাঝে চুরমা খায়। তোমার যেভাবে ভালোলাগবে সেভাবেই খাও।
— তুমি খাবে না? জিজ্ঞেস করল নাদিম। এক সাথে শুরু করি?
— আমিও খাব। আমি টিভি দেখব আর খাব। এই জন্যই তো রান্না করলাম। হাসি মুখে বলল সায়রা বানু। রান্না করার তৃপ্তি চোখে মুখে। ক্লান্তির ছায়াও নেই।
— ঠিক আছে টিভি দেখ আর খাও, কিন্তু থালা বাসন আমি ধুয়ে ফেলব। ওগুলো পরিষ্কার করতে যেয়ো না।
অনেক ক্লান্ত ছিল সায়রা বানু, বলল, আচ্ছা। শুকরিয়া।
আরাম করে সোফায় বসে আবার “বিন্ধ বানুঙ্গা –” দেখতে শুরু করল। প্রথম তিনটা পর্ব ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া যাওয়ার আগে দেখে ফেলেছিল। আজ চতুর্থ পর্ব দেখতে শুরু করল। কিছুক্ষণ সিরিয়াল দেখে, একটু খানি খাবার মুখে দেয়, আবার সিরিয়ালে ডুবে যায়। দেখে মনে হয় ভীষণ সুখী একটা মেয়ে।
সায়রা বানুর সাথে কিছুক্ষণ সিরিয়াল দেখল নাদিম। তারপর খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আবার কাজ করতে থাকল। রঘুনাথ রেড্ডির দেয়া রেজুমে এবং ফরওয়ার্ডিং লেটারকে কাটছাঁট করে পাঠিয়ে লিখল, এবার এপ্লিকেশন জমা দিত পারো। রাজি হলো রঘু। কিন্তু লিখল, ইন্টার্ভিউ পাওয়ার সম্ভাবনা কমে গেল।
নাদিম যখন “ডাল বাটি চুরমা” খাচ্ছিল, তখন নিউ ইয়র্কের খালাম্মা তার বান্ধবীকে ফোন করল। ভদ্রমহিলার চার-পাঁচটা সফল ঘটকালি করার রেকর্ড আছে। অনেকে তার সাথে যোগাযোগ রাখে।
— কেমন আছিস নাজমা? ফোন তুলতেই জিজ্ঞেস করল খালাম্মা।
— ভালো। সবই ভালো। মেয়ের একটা কিছু হলে দুশ্চিন্তা কমত। দুঃখ ভরা গলায় জবাব দিল নাজমা।
নাজমা নাদিমের খালাম্মার স্কুল জীবনের বান্ধবী। সব সময় ঘরের বিষয় আলাপ করে। প্রায়ই মেয়ের জন্য ছেলে দেখতে বলে।
— আমার দূর সম্পর্কের বোনের ছেলে মেরিল্যান্ড থাকে। ওর ফেসবুক প্রোফাইল তোকে দিয়েছি। সোফিয়াকে দিস। ইন্টারেস্টেড হলে দেখা করতে বলতে পারি।
— ছেলেটার সম্পর্কে একটু বল।
— নাম নাদিম আখতার। বাংলাদেশে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়েছে। এদেশে আইটি তে ব্যাচেলর্স করেছে। এতদিন চাকরি করত, এক সপ্তাহ হয় প্রজেক্ট শেষ হওয়াতে চাকরি চলে গেছে।
— ওহ, চাকরি নেই? বেকার?
— ওর লাইনে এগুলো সাময়িক। যখন চাকরি হবে, অনেক বেতন পাবে।
— দেখতে কেমন?
— দেখতে ভালো। লম্বা, উজ্জ্বল শ্যামলা।
— আচ্ছা। সোফিয়াকে বলব। এদের তো কিছু বলাই যায় না। নিজেও কাউকে যোগার করতে পাড়ল না, আবার বাবা-মা চেষ্টা করলে রাগ করে। মনে করে এতে ওর অসম্মান হয়। এদের নিয়ে কী যে যন্ত্রণা!
— কখন দেখা করতে পারবে সোফিয়া? জিজ্ঞেস করল খালাম্মা।
— সোফিয়া চাকরি করে। উইকেন্ডে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বুধবার কিংবা বৃহস্পতিবার লাঞ্চের সময় হলে ভালো হয়। কয়েক ঘণ্টা ছুটি নেবে। ছেলেটা নিউ ইয়র্ক আসতে পারবে?
— নাদিমের হাতে এখন অনেক সময়। তুই কনফার্ম করলে নিউ ইয়র্ক আসতে বলব।
— এভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়াকে মনে হয় এরা বলে “ব্লাইন্ড ডেট”। সোফিয়ার সাথে কথা বলে জানাব।
কথা শেষ করে ফোন রেখে দিল খালাম্মা। এবার নাদিমকে নিউ ইয়র্ক আসতে রাজি করাতে হবে।
এদিকে খুব আয়েস করে সিরিয়াল দেখতে দেখতে ডিনার শেষ করল সায়রা বানু। খাবারগুলো রেফ্রিজারেটরে তুলে রাখতেই নাদিম থালা বাসন ধুয়ে ফেলল। কিচেন পরিষ্কার পরিছন্ন করে ঘুমাতে গেল সায়রা বানু। আজ আর বেশি রাত করল না নাদিম। আগামীকাল সোমবার, রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে ফোন আসতে পারে।
পরদিন একই ভাবে সকাল হলো।
আজানের শব্দে ভোরে ঘুম ভাঙ্গল। সায়রা বানু নামাজ পরল, একই সুরা পড়ল। তারপর আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
নামাজ পড়ে একটু ঘুমিয়ে উঠে পড়ল নাদিম। ইউটিউবে কিছু বিষয় পড়াশোনা করল। সকাল দশটা বাজতেই বেশ কয়েকটা রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে ইমেইল এলো। বেশিরভাগ ইন্ডিয়ান নাম, একটা-দুটা আমেরিকান। এর মধ্যে মিশেল নামে একজন ইমেইল করে কথা বলতে চেয়েছে। নাদিম লিখল, যে কোন সময় ফোন করতে পার।
মিশেল লিখল, হাতের কাজ শেষ করে ঘণ্টা খানেক পর কল করব।
নিজের রেজুমে আরো কয়েকবার পড়ল নাদিম। কোন প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে সুবিধা হবে।
কথা মতো ঘণ্টা খানেক পর ফোন করল মিশেল।
— হ্যালো, আমি নাদিম।
— হাই, নাদিম। আমার নাম মিশেল ময়নিহান। আমি এই ফার্মের রিক্রুটিং এজেন্ট। তোমার স্টোরি কী বল তো?
— আমাকে ফোন করার জন্য অনেক ধন্যবাদ, মিশেল। আমি ওপিটি তে আছি। একটা কোম্পানিতে সাইবার সিকিউরিটি সেকশনে কাজ করতাম। ওদের প্রোজেক্ট কন্ট্রাক্ট শেষ হওয়াতে এখন আবার চাকরি খুঁজছি।
— ইউ আর ওয়েলকাম। ধন্যবাদের জবাব দিল মিশেল। তারপর বলল, সরাসরি কাজের কথায় আসি, কেমন? তোমার ভাল দিক হচ্ছে আমেরিকার ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি আছে। কিন্তু চ্যালেঞ্জিং দিকটা হচ্ছে তোমার অভিজ্ঞতা কম। রেজুমেতে হাড্ডি বেশি, মাংস কম। হাড় জিরজিরে শরীরে মাংস লাগাতে হবে।
— কীভাবে আরো ভাল করে লিখব?
— তোমার সম্পর্কে বলো। কী কী কাজ করতে, কাজের পরিবেশ, কয়জনের টিম ছিল, তোমার রোল কী ছিল, এসব বলো। আমি নোট নিচ্ছি, তারপর আমার মতো করে রেজুমে সাজিয়ে দেব। অল্প অভিজ্ঞতা হলেও নিজেকে সুন্দর করে পরিবেশন করা যায়।
এমন করে কথা বলল যেন মিশেল ওর বড় বোন। নাদিমের রেজুমে পড়ে বয়স আন্দাজ করেছে। নিজের অজান্তেই বড় বোনের মত সাহায্য করছে। নিজের সম্পর্কে অনেক কিছু বলল নাদিম। একবারও বাধা না দিয়ে শুনে গেল মিশেল। বলল, আমি নোট করে নিলাম। বিকেলে আপডেটেড রেজুমে পাঠিয়ে দেব।
— অনেক ধন্যবাদ। আমাকে এত সাহায্য করে তোমার লাভ কী?
হেসে ফেলল মিশেল। বলল, তুমি চাকরি পেলে আমার কোম্পানির লাভ আছে। আমি হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্টে কাজ করি। তোমাকে যতটুকু সম্ভব গুছিয়ে পরিবেশন করাও আমার কাজ। তবে সবার জন্য এরকম করি না। তোমার চাকরি চলে গেছে শুনে খুব মায়া লাগল। বুঝতে পারছ?
— বুঝতে পারছি। থ্যাংক ইউ সো মাচ।
— ওয়েল কাম। যোগাযোগ রাখব। এখন রাখি।
ফোন রেখে দিল মিশেল। কিছু আমেরিকান আছে যাদের ব্যবহার এতো ভাল, না পেলে বিশ্বাস হয় না। অচেনা মহিলা কিন্তু হৃদয় ছোঁয়া কথা বলল।
নাস্তা শেষ করে নিজে নিজে কি সব কাজ করছিল সায়রা বানু। বলল, আগামী সোমবার সকালে ড্রাইভিং পরীক্ষার এপয়েন্টমেন্ট পেয়েছি, নেব?
— নাও। কিন্তু কিছু কাজ এগিয়ে রাখতে হবে। তোমার রেসিডেন্সির প্রমাণ দেখাতে হবে। ব্যাংকের ঠিকানা এই এপার্টমেন্টের দিয়ে একটা স্টেটমেন্ট প্রিন্ট করতে হবে।
— আচ্ছা। বলল সায়রা বানু।
— লাইসেন্সের পড়াশোনায় সাহায্য লাগলে বলবে।
— আচ্ছা। বলব।
ফোনে লার্নারস পারমিটের বিষয়গুলো পড়া যায়। সে সব দেখতে থাকল সায়রা বানু। নাদিম নিশ্চিত যে ইংরেজি বুঝতে ওর কাছে আসবে সায়রা বানু।
নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল নাদিম।
বিকেলে নূতন করে রেজুমে লিখে নাদিমকে পাঠাল মিশেল ময়নিহান। এক ফোটা মিথ্যে লিখেনি মিশেল, কিন্তু আরো অনেক অভিজ্ঞতা গুছিয়ে লিখেছে, এভাবে লেখার কথা চিন্তা করেনি নাদিম। আগের চেয়ে আরো সুন্দর হয়েছে। রেজুমেতে দেশি ভাব কম, পড়লে বোঝা যায় আমেরিকান কেউ লিখেছে। আবার প্রোফাইল আপডেট করল নাদিম। অকসয় কুমারকে রেজুমে পাঠিয়ে আবার তাগাদা দিল।
সোমবার রাতে নাদিমকে ফোন করল নিউ ইয়র্কের খালাম্মা। বলল, নাদিম, তুমি বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্ক আসতে পারলে খুব ভালো হয়। সোফিয়া লাঞ্চের সময় দেখা করতে পারবে।
— আসছে বৃহস্পতি বার? একটু তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?
— তোমার চাকরি পেতে বেশি সময় লাগবে না। তার আগে দেখাদেখির কাজ পিছনে ফেলে দাও। আমি বলি কী, ব্যস্ত না হলে আসো।
— না, ব্যস্ত না খালাম্মা।
— ফেসবুকে মেয়েটার ছবি দেখেছ না? ভীষণ মিষ্টি চেহারা। আচার-ব্যবহার ভালো। একবার দেখা করতে তো অসুবিধা নেই। কয়েক দিন তুমি না হয় আমাদের বাসায় থাকবে?
— না, খালাম্মা। থাকব না। সকালে যাব, দেখা করে দিনে দিনে ফিরে আসব।
মনে মনে দিন গুনল নাদিম। সোমবার সায়রা বানুর লাইসেন্স পরীক্ষা। বৃহস্পতিবার বাইরে থাকলে ক্ষতি হবে না।
বলল, আচ্ছা, খালাম্মা। ওদের বলেন আমি বৃহস্পতি বার আসতে পারব।
— আচ্ছা। বলব। আমি কনফার্ম করলে তোমরা ফেসবুকে জায়গা, সময় ঠিক করে নিও?
— আচ্ছা।
সায়রা বানু তার প্রিয় সিরিয়াল দেখছিল, নাদিম বলল, আমি বৃহস্পতিবার সকাল নিউ ইয়র্ক যেতে পারি। রাতে ফিরে আসব।
কথাটা শুনল সায়রা বানু কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। নাদিমের কথা শেষ হতে আবার সিরিয়াল দেখতে থাকল।
একদিন একদিন করে দিন আগাতে থাকল। একটা দিন যেন আগের দিনের প্রতিচ্ছবি। সকালে আজানের শব্দে ঘুম ভাঙে। সায়রা বানু একই সুরা পড়ে। নাদিম চাকরির জন্য পড়ালেখা করে। সন্ধ্যায় সায়রা বানু সিরিয়াল দেখে। ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়ে।
চাকরি বিহীন এক একটা দিন নাদিমের কাছে অনেক লম্বা মনে হয়। অস্থির হয়ে বুধবার সকালে রঘুকে জিজ্ঞেস করল ইন্টার্ভিউ পাবে কিনা? রঘু জানাল, শর্ট লিস্ট হয়েছে, কিন্তু নাদিম বাদ পড়েছে।
মন খারাপ করল নাদিম বলল, ওহ-হো।
সাথে সাথে রঘু বলল, মন খারাপ করার কিছু নেই। আরো জায়গার পাঠাব। তোমার আপডেটেড রেজুমে দেখলাম। মন্দের ভালো। সম্ভাবনা বাড়ল। কোথাও না কোথাও হয়ে যাবে।
কিন্তু মন ভালো হলো না নাদিমের। ছেলেদের বেকার জীবন এমন একটা দুঃসময়, যার অভিজ্ঞতা নেই সে বুঝবে না।
বুধবার দুপুরে খালাম্মা কনফার্ম করল।
সোফিয়া বাবা-মায়ের সাথে লং আইল্যান্ড থাকে কিন্তু ওর অফিস কুইন্স এলাকায়। লাঞ্চের সময় কুইন্স শপিং মলের কাছে একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করতে পারবে।
এমনিতেই মন খারাপ ছিল, হাতে একটা কাজ পেয়ে ভালো লাগল। রাজি হলো নাদিম। পরদিন সকাল সকাল নাস্তা করে কাপড় পড়তেই দরজার কাছে এসে দাঁড়াল সায়রা বানু। কাপড় পরে হাত ব্যাগ নিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি। বলল, একা একা ঘরে থাকতে পারব না। আমিও যাবো।
— না গেলেই কী না? বলল নাদিম।
— আমিও যাবো। একই ভাবে অবুঝের মতো বলল সায়রা বানু। আমাকে কোথাও রেখে তুমি তোমার কাজ করবে। কারো কোনো অসুবিধা হবে না।
সায়রা বানুকে বোঝানো যাবে না বুঝতে পেরে বলল, ঠিক আছে, চলো।
(চলবে)