নন্দিত নরকে প্রথম পর্ব – হুমায়ুন আহমেদ

0
1993

প্রথম পর্ব
#নন্দিত_নরকে
– হুমায়ুন আহমেদ

রাবেয়া ঘুরে ঘুরে সেই কথা কটিই বার বার বলছিল।
রুনুর মাথা নিচু হতে হতে থুতনি বুকের সঙ্গে লেগে গিয়েছিল। আমি দেখলাম তার ফর্সা কান লাল হয়ে উঠেছে। সে তার জ্যামিতি-খাতায় আঁকিবুকি কাটতে লাগল। শেষ পর্যন্ত হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দাদা একটু পানি খেয়ে আসি বলে ছুটতে ছুটিতে বেরিয়ে গেল। রুনু বারো পেরিয়ে তেরোতে পড়েছে। রাবেয়ার অশ্লীল কদৰ্য কথা তার না বোঝার কিছু নেই। লজ্জায় সে লাল হয়ে উঠেছিল। হয়তো সে কেঁদেই ফেলত। রুনু অল্পতেই কাঁদে। আমি রাবেয়াকে বললাম, ছিঃ রাবেয়া, এসব বলতে আছে? ছিঃ! এগুলি বড় বাজে কথা। তুই কতো বড় হয়েছিস।
রাবেয়া আমার এক বৎসরের বড়ো। আমি তাকে তুই বলি। পিঠা পিঠি ভাইবোনেরা এক জন আরেক জনকে তুই বলেই ডাকে। রাবেয়া আমাকে তুই বলে। আমার প্রতি তার ব্যবহার ছোটবোনসুলভ। সে আমার কথা মন দিয়ে শুনল। কিছুক্ষণ ধরেই বালিশের গায়ে চাদর জড়িয়ে সে একটা পুতুল তৈরি করছিল। আমার কথায় তার ভাবান্তর হল না। পুতুল তৈরি বন্ধ রেখে লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। পা নাচাতে নাচাতে সে নোংরা কথাগুলি আগের চেয়েও উঁচু গলায় বলল। আমি চুপ করে রইলাম। বাধা পেলেই রাবেয়ার রাগ বাড়বে; গলার স্বর উঁচু পর্দায় উঠতে থাকবে। পাশের বাসার জানালা দিয়ে দু-একটি কৌতূহলী চোখ কী হচ্ছে দেখতে চেষ্টা করবে।
রাবেয়া বলল, আমি আবার বলব।
বেশ।
কী হয় বললে?
আমি কাতর গলায় বললাম, সে ভারি লজ্জা রাবেয়া। এটা খুব একটা লজ্জার কথা।
তবে যে ও আমাকে বলল।
কে?
আমি বুঝতে পারছি, রাবেয়া নিশ্চয়ই কথাগুলি বাইরে কোথাও শুনে এসেছে। কিন্তু রাবেয়াকে, যার বয়স গত আগষ্ট মাসে বাইশ হয়েছে, তাকে সরাসরি এমন একটি কদৰ্য্য কথা কেউ বলতে পারে ভাবি নি।
আমি বললাম, কে বলেছে?
আজ সকালে বলেছে।
কে সে?
ঐ যে লম্বা ফর্সা।
রাবেয়া সেই ছেলেটির আর কোনো পরিচয়ই দিতে পারবে না। আবারও রাবেয়াবেড়াতে বেরুবে, আবার হয়তো কেউ এমনি একটি ইতর অশ্লীল কথা বলে বসবে তাকে।
খোকা তোর দুধ।
মা দুধের বাটি টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। কাল রাতে তাঁর জ্বর এসেছিল। বেশ বাড়াবাড়ি রকমের জ্বর। বাবা মাঝরাত্তিরে আমার দরজায় ঘা দিয়েছিলেন। আমার ঘুমের ঘোর না কাটতেই শুনলাম, তোর কাছে এ্যাসপিরিন আছে খোকা?
স্বপ্ন দেখছি এই ভেবে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ার উদ্যোগ করতেই মায়ের কান্না শুনলাম। মা অসুখ-বিসুখ একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। অল্প জ্বর, মাথা ব্যাথা–এতেই কাহিল।
বাবা আবার ডাকলেন, খোকা, তোর কাছে এ্যাসপিরিন আছে?
তোষকের নিচে আমার ডাক্তারখানা। এ্যাসপিরিন, ডেসপ্রোটেব এই জাতীয় ট্যাবলেট জমান আছে। অন্ধকারেই আমি মাঝারি সাইজের ট্যাবলেট খুঁজতে লাগলাম। এ ঘরে আলো নেই। কোথায় যেন তার জ্বলে গেছে। রাতে হ্যাঁরিকেন জ্বালান হয়। ঘুমুবার সময় রুনু হারিকেন নিবিয়ে দেয় আলোতে রুনুর ঘুম হয় না। বাবা বললেন, খোকা, পেয়েছিস?
হুঁ। কী হয়েছে?
তোর মার জ্বর।
জ্বরে এ্যাসপিরিন কী হবে?
খুব মাথাব্যথাও আছে।
অ।
তিনটি ট্যাবলেট হাতে নিয়ে দরজা খুলতেই বারান্দায় লাগান পঁচিশ পাওয়ারের বাল্ব্বের আলো এসে পড়ল। কী বাজে ব্যাপার! একটিও এ্যাসপিরিন নয়। বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, ঘরে দেশলাই রাখতে পারিস না?
মনে পড়ল ড্রয়ারে একটি নতুন দেশলাই আর তিনটি বৃস্টল সিগারেট রয়েছে। সারা দিনে পাঁচটার বেশি খাব না ভেবেও সাতটা হয়ে গেছে। আর এখন এই মধ্যরাতে একটা তো জ্বালাতেই হবে। কিছুক্ষণের ভেতরই একটু সিগারেট ধরাব, এতেই মনটা ভরে উঠল। বাবা এ্যাসপিরিন নিয়ে চলে গেলেন। দেশলাই জ্বালাতেই চোখে পড়ল, রাবেয়া বিশ্ৰীভাবে শুয়ে রয়েছে। প্রায় সমস্তটা শাড়ি পাকিয়ে পুটলি বানিয়ে বুকের কাছে জড়িয়ে রেখেছে। শীতের সময় মশা থাকে না, মশারিও সেই কারণেই অনুপস্থিত। বাবার গলা শোনা গেল, নাও শানু, খেয়ে ফেল ট্যাবলেটটা।
আশ্চর্য! বাবা এমন আদুরে গলায় ডাকতে পারেন! আমার লজ্জা করতে লাগল। বাবা আবার ডাকলেন, শানু শানু।
শাহানা নামটাকে কী সুন্দর করে ভেঙে শানু ডাকছেন বাবা। আমার আর বাবার ঘরের ব্যবধানটা বাঁশের বেড়ার ব্যবধান। উপরের দিকে প্রায় দু হাত খানিক ফাঁকা। সামান্যতম শব্দের কথাও আমার ঘকে ভেসে আসে। আমি একটা চুমুর শব্দও শুনলাম।
আমার মাঝে মাঝে ইনসমনিয়া হয়। আমার তোষকের নিচে চারটে ভেলিয়াম-টু ট্যাবলেট আছে। কিন্তু আমি কখনো ভেলিয়াম খাই না। ঘুমের ওষুধ হার্ট দুর্বল করে। আমার বন্ধু সলিল ঘুমোনর জন্য দুটি মাত্র বড়ি খেয়ে মারা গিয়েছিল। তার হার্টের অসুখ ছিল। আমারও হয়তো আছে। আমার মাঝে মাঝে বুকের বাম পাশে চিনচিনে ব্যথা হয়।
আমি হাজার ইনসমনিয়াতেও ঘুমের ওষুধ খাই না। মাঝে মাঝে এ জন্যে আমার বেশ অসুবিধা হয়। মাঝরাতে বাবা যখন শানু শানু, এই শাহানা বলে ডাকতে থাকেন, তখন আমার কান গরম হয়ে ওঠে। নাক ঘামতে থাকে। হার্টের স্পন্দন দ্রুত ও স্পষ্ট হয়। রাতের নাটকের সব কটি কথা আমার জানা। মা বলেন, আহা কর কি? ছি! বাবা ফিসফিস করে কী বলেন। তাঁর গলা খাদে নেমে আসে। মা জড়িত কণ্ঠে হাসেন। আমি দু হাতে আমার কান বন্ধ করে ফেলি। নিজের বুকের শব্দটা সে সময় বড়ো বেশি স্পষ্ট মনে হয়। কিছুক্ষণের ভিতরই আবার সব নীরব হয়।
রুনু আর রাবেয়া ঘুমের ঘোরে বিজবিজ করে। টেবিল ঘড়ির টক টিক টক টক শব্দ আবার ফিরে আসে। আমি টেবিলে রাখা জগে মুখ লাগিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে বাইরে এসে দাঁড়াই।
বারান্দার এক পাশে দুটি হাসনাহেনা গাছ আছে। মা বলেন হাছনাহেনা। দুটোই প্রকাণ্ড। রাতের বেলায় তার পাশে এসে দাঁড়ালে ফুলের গন্ধে নেশার মতো হয়। হাসনাহেনার গন্ধে নাকি সাপ আসে। মন্টু এই গাছের নিচেই এক বার একটা মস্ত সাপ মেরেছিল। চন্দ্রবোড়া সাপ। মা দেখে আঁতকে উঠে বলেছিলেন, কি করলি রে মন্টু, এর জোড়াটা যে এবার তোকে খুঁজে বেড়াবে।
আমি যদিও এ-সব বিশ্বাস করতাম না, তবু আমার ভয় লাগছিল। আমি তন্ন তন্ন করে অন্য সাপটাকে খুঁজলাম। বাড়ির চারপাশে কার্বলিক এসিড দেওয়া হল। মাস্টার চাচা বললেন, যে সাপটা রয়ে গেছে সেটা পুরুষ সাপ। সাপ দেখে তিনি স্ত্রী-পুরুষ বলতে পারতেন। কদিন সবাই খুব ভয়ে ভয়ে কাটালাম, যদিও সেই পুরুষ সাপটিকে কখনো দেখা যায় নি।
রাবেয়া বলল, মা আমি দুধ খাব।
মার কাল রাতে জ্বর এসেছিল। তাঁর মুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে। রাবেয়ার কথা শুনে মারি মুখ আরো শুকিয়ে গেল। তাঁকে বাচ্চা খুকির মতো দেখাতে লাগল। আমি জানি আমরা কেউ যখন কোনো একটা জিনিসের জন্যে আব্দার করি এবং মা যখন সেটি দিতে পারেন না। তখন তাঁর মুখ এমনি লম্বাটে হয়ে বাচ্চা খুকিদের মতো দেখাতে থাকে। তাঁর নাকের পাতলা চামড়া তিরতির করে কাঁপতে থাকে। ছোট বয়সে মার এই ভঙ্গিটাকে আঁমার খুব খারাপ লাগত। আমি একটি জিনিস চেয়েছি, মা সেটি দিতে পারছেন না। তাঁর মুখ বাচ্চা খুকিদের মতো হয়ে গিয়েছে। নাকের ফর্সা পাতলা পাতা তিরতির করে কীপছে। মায়ের এই ভঙ্গিটাকে আমার অপরাধীর ভঙ্গি বলে মনে হত। আমি মাকে কী করে কষ্ট দেওয়া যায় তা ভাবতে থাকতাম। মার গায়ে একটি টিকটিকি ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে হত। মা টিকটিকিকে বড়ো ভয় পান। মুখে বলেন ঘৃণা, কিন্তু আমি জানি এ তাঁর ভয়। এক বার মা ভাত খেতে বসেছেন, হঠাৎ ছাদ থেকে একটা টিকটিকির বাচ্চা এসে পড়ল তাঁর মাথায়। তিনি হড়হড় করে বমি করে ফেললেন। মার উপর রাগ হলেই আমি টিকটিকি খুঁজতাম কিন্তু টিকটিকি খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না। পেলেও ধরা যেত না। কাপড়ের বল বানিয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতাম দেয়ালে টিকটিকির গায়। টুপ করে তার ল্যাজ খসে পড়ত। সেই ল্যাজও মা ঘেন্না করতেন। মা কখনো আমাদের কিছু বলতেন না। মা বড়ো বেশি ভালোমানুষ। বাবা মারতেন আমাদের প্রায়ই, ভীষণ মার। মা বুলতেন, আহা কী করা! আহা ব্যথা পায় না? বাবা বলতেন, যাও, সরে যাও সামনে থেকে। আদর দিয়ে মাথায় তুলেছ তুমি। মাকে তখন বড়ো বেশি অসহায় মনে হত। আর আমার ইচ্ছে হত কাল ভোরেই বাড়ি থেকে পালাব। আর কখনো আসব না।
মা আমাকে দুধ দাও। রাবেয়া জোর করতে লাগল। আমি বাটিটি তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। মা মৃদু কণ্ঠে বললেন, আহা, খা না তুই, তোর পরীক্ষা।
দুধের বিলাসিতাটুকু আমার জন্যেই। সামনেই এম.এস.সি ফাইনাল, রাত জেগে পড়ি। নটার দিকে মা দুধ নিয়ে আসেন। আমি দুধে চুমুক দিতেই মা নীরবে রাবেয়ার শাড়ি থেকে একটি একটি করে সেফটিপিন খুলতে থাকেন। রাবেয়ার শাড়িতে গোটা দশেক সেফটিপিন সারা দিন লাগান থাকে। সমস্ত দিন সে ঘুরে বেড়ায়। তার অনাবৃত শরীর ভুলেও যেন কারুর চোখে না পড়ে, এই ভয়েই মা এ করেন। রাবেয়াকে ঘরে আটকে রাখা যাবে না।–তাকে সালোয়ার কামিজও পরান যাবে না। তার সে-বয়স নেই। অথচ সবাই রাবেয়ার দিকে অসংকোচে তাকাবে। বয়স হলেই ছেলেরা মেয়েদের দিকে তাকায়। সেই তাকানীয় লজ্জা থাকে, দৃষ্টিতে সংকোচ থাকে। কিন্তু রাবেয়ার ব্যাপারে সংকোচ বা লজ্জার কোনো কারণ নেই। রাবেয়াকে যে-কেউ অতি কুৎসিত কথা বললেও সে হাসিমুখে সে-কথা শুনবে। বাড়ি এসে অনায়াসে সবাইকে বলে বেড়াবে।
মা রাবেয়ার পাশে বসে রাবেয়ার মাথায় হাত রাখলেন। আমি একটি ছোট কিন্তু স্পষ্ট দীর্ঘনিঃশ্বাসের শব্দ শুনলাম। রাবেয়া ঢকচক করে দুধ খাচ্ছে। রাবেয়া হয়তো ঠিক রূপসী নয়। কিংবা কে জানে হয়তো রূপসী। রং হালকা কালো। বড়ো বড়ো চোখ, স্বচ্ছ দৃষ্টি, সুন্দর ঠোঁট। হাসলেই চিবুক আর গালে টোল পড়ে। যেসমস্ত মেয়ে হাসলে টোল পড়ে, তারা কারণে -অকারণে হাসে। তারা জানে হাসলে তাদের ভালো দেখায়। রাবেয়া তা জানে না, তবু সে হাসে। কারণে-অকারণে হাসে। রাবেয়ার কপালে, ঠিক মাঝখানে একটা কাটা দাগ আছে। ছোটবেলায় চৌকাঠে পড়ে গিয়েছিল। দুধ শেষ করে রাবেয়া বলল, বাজে দুধ। ছিঃ!
মা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, শুভাপুরের পীর সাহেবের কাছে যাবি এক বার? শুভাপুরে এক পীর সাহেব থাকেন। পাগল ভালো করতে পারেন বলে খ্যাতি। শুভাপুর এখান থেকে আট মাইল। সাইকেলে ঘণ্টাখানেক লাগে, কিন্তু আমি জানি পীর-ফকিরে কিছু হবে না। বড়ো ডাক্তার যদি কিছু করতে পারে। কিন্তু আমাদের পয়সা নেই। আমার ছোট হয়ে যাওয়া শার্ট মন্টু পরে। আমরা কাপড় কিনি বৎসরে এক বার, রোজার ঈদে।
রুনু এল একটু পরেই। আড়চোখে দু-তিন বার তাকাল রাবেয়ার দিকে। না, রাবেয়া সেই কুৎসিত কথাগুলি আর বলছে না। রুনু হাই তুলল। তার ঘুম পাচ্ছে। চোখ ফুলে উঠেছে। রাবেয়ার নোংরা কথা শুনে রুনুর কেমন লেগেছিল কে জানে। রুনুর বয়স এখন তেরো। আগামী নভেম্বরে চৌদ্দতে পড়বে। রুনুর বৃশ্চিক রাশি। আমার যখন এমন বয়স ছিল, তখন এ ধরনের কথা শুনে বেশ লাগত। সেই বয়সে মেয়েদের কথা ভাবতে আমার ভালো লাগত। টগর ভাইয়ের বাসায় সন্ধ্যাবেলা অঙ্ক বুঝতে যেতাম। নীলু বলে তার একটা ছোট বোন ছিল। বড়ো হয়ে এই মেয়েটিকে বিয়ে করব ভেবে বেশ আনন্দ হত আমার। নীলুর সঙ্গে কথা বলতেও লজ্জা লাগত, কথা বেধে যেত মুখে। নীলু যখন আমার হাত ধরে টেনে বলত, আসুন না। দাদু ভাই, লুড়ু খেলি। তখন অকারণেই আমার কান লাল হয়ে উঠত। গলার কাছটায় ভার-তার লাগাত।
রুনুরও কি কোনো ছেলেকে ভালো লাগে? রুনুও কি কখনো ভাবে, বড়ো হয়ে আমি এই ছেলেটিকে বিয়ে করব? কে জানে। হয়তো ভাবে, হয়তো ভাবে না। রুনু বড় লক্ষ্মী মেয়ে। এত লক্ষ্মী আর এত কোমল যে আমার মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। কেন জানি না। আমার মনে হয়, এ ধরনের মেয়েরা সুখ পায় না জীবনে। আমি রুনুকে অনেক বড়ো করব। রুনু ডাক্তার হবে বড়ো হলে। ষ্টেথোসকোপ গলায়, কালো ব্যাগ হাতে মেয়ে ডাক্তারদের বড়ো সুন্দর দেখায়। রুনু অঙ্ক ভালো পারে না। আমি তাকে নিজের পড়া বন্ধ রেখে এ্যালজেবরা বোঝাই। ডাক্তারী পড়তে অবশ্যি অঙ্ক লাগে না।
সেদিন রুনুর অঙ্কখাতা উন্টে চমকে গিয়েছিলাম। বেশ গোটা গোটা করে লেখা আমি ভালোবাসি। পরের কথাগুলি পড়ে অবশ্যি আমি লজ্জাই পেলাম। সেটি একটি ছেলেমানুষী কবিতা। আমি পৃথিবীর এই সৌন্দর্য ভালোবাসি, গাছপালা-গান ভালোবাসি–এই জাতীয়। আমি বললাম, সুন্দর কবিতা হয়েছে রুনু।
রুনু লজ্জায় গলদা চিংড়ির মতো লাল হয়ে বলল, যাও, ভারি তো। এটা মোটেই ভালো হয় নি।
আমি বললাম, তাহলে তো মনে হয়। অনেক কবিতা লিখেছিস।
উঁহু। রুনু মাথা নিচু করে হাসতে লাগল।
আমি বললাম, দেখা রুনু, লক্ষ্মী মেয়ে তুই।
রুনু আরক্ত হয়ে উঠে গিয়ে আমার ট্রাঙ্ক খুলল। তার যাবতীয় গোপন সম্পত্তি আমার টাঙ্কে থাকে। এই বয়সে কত তুচ্ছ জিনিস অন্যের চোখের আড়াল করে রাখতে হয়। কিন্তু রুনুর নিজস্ব কোনো বাক্স নেই। আমার ট্রাঙ্কের এক পাশে তার দুটি বড়ো বড়ো চারকোণা বিস্কুটের বাক্স থাকে। আর কিছু খাতাপত্রও থাকে দেখছি। বুনো হাতির ছবি আকা একটা দুনাম্বরী খাতা নিয়ে এসে লজ্জায় বেগুনি হয়ে গেল।
আমি বললাম, তুই পড়ে শোনা আমাকে।
না, তুমি পড়।
দে তাহলে আমার হাতে।
রুনু খাতাটা গুঁজে দিয়ে দৌড়ে পালাল। দেখলাম সব মিলিয়ে বারোখানা কবিতা। দুটি মায়ের ওপর, একটি পলার ওপর। (পলা আমাদের পোষা কুকুর। এক দুপুরে কোথায় যে চলে গেল!) একটি মন্টুর সাপ মারা উপলক্ষে–
মন্টু ভাই তো মারলেন মস্ত বড়ো সাপ
চার হাত লম্বা সেটি–কী তার প্রতাপ!
মনে মনে ভাবলাম, রুনুকে একটি ভালো খাতা কিনে দেব। রুনু খাতা ভর্তি করে ফেলবে কবিতায়। রবীন্দ্রনাথের একটি গল্পে বাচ্চা মেয়ের একটি চরিত্র আছে। মেয়েটি লিখতে শিখে আদি ঘরের দেয়াল, বইয়ের পাতা, মার হিসেবের খাতায় যা মনে আসত তাই লিখে বেড়াত। মেয়েটির দাদা তাকে একটি চমৎকার খাতা দিয়েছিল, যা তার জীবনে পরম সখের সামগ্ৰী হয়েছিল। কিন্তু আমার হাতে টাকা ছিল না। তবু আমি মনস্থির করে ফেললাম, রুনুকে একটা খুব ভালো খাতা কিনে দেব। আমার মনে পড়ল হাতি মার্কা যে-খাতাটায় রুনু কবিতা লিখেছে, রুনু সেটি আমার কাছ থেকেই চেয়ে নিয়েছিল। যেখানে আমার নাম ছিল, সেটি কেটে রুলু বড়ো বড়ো করে নিজের নাম লিখেছে। দিনে কঘণ্টা পড়ছি তার হিসেব রাখার জন্যে খাতাটি কিনেছিলাম। সপ্তাহ দুয়েক যাবার পরও যখন কিছু লেখা হয় নি, তখন এক দিন রুনু সংকুচিতভাবে আমার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। সাপের মতো একেবেঁকে বলল, দাদা খাতাটা আমাকে দাও না।
কোন খাতা?
এইটে।
যা, নিয়ে যা।
রুলু খাতা হাতে চলে গেল। তার মুখে সেদিন যে—খুশির আভা দেখেছি, আমি আবার তা দেখব। সাড়ে তিন টাকা দিয়ে প্লাষ্টিকের সুদৃশ্য কাভারের চমৎকার একটি খাতা কিনে দেব তাকে।
আমার হাতে যদিও টাকা ছিল না, তবু আমি রুনুকে খাতা কিনে দিয়েছিলাম। রুণুকে বড়ো ভালোবাসি। আমি বড়ো ভালোবাসি। রুনুকে দেখলেই আমার আদর করতে ইচ্ছে হয়। রুনু বড়ো লক্ষ্মী মেয়ে। রুনুর ভালো নাম সালেহা। রুনু নামটা আমারই দেওয়া। রুনুর জন্যে রুনু নামটাই মানানসই। রুনু নামে কেমন একটা বাজনার আমেজ আসে। আবার যখন দীর্ঘ স্বরে ডাকা হয় রুউউউউ নুউউউউ তখন কেমন একটা আমেজ আসে। রুনু বলল, দাদা, আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
মা মশারি খাটিয়ে দিয়ে গেছেন। বেশ মশা এখন। রাতের সঙ্গে সঙ্গে মশাও বাড়তে থাকবে। আমার কানের কাছে গুনগুন করবে তারা। পড়ায় মন দিতে পারছি না, এম. এস. সি-তে খুব ভালো রেজাল্ট করতে হবে আমার। একটা ভদ্র ভালো বেতনের চাকরির আমার বড়ো প্রয়োজন। রুনু গুটিসুটি মেরে রাবেয়ার পাশে শুয়ে পড়েছে। অবশ্যি সে এখন ঘুমুবে না। যতক্ষণ ঘরে আলো জ্বলে ততক্ষণ রুনু ঘুমুতে পারে না।
আমার পাশেই রাবেয়া আর রুনু শুয়ে আছে! এত পাশে যে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। রাবেয়াটা শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে পড়ে। এক-এক বার ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাঁদে। সে কান্না বিলম্বিত দীর্ঘ সুরের কান্না। পলাও মাঝে মাঝে এমন কাঁদত। মা বলতেন, দূর দূর। কুকুরের কান্না নাকি অমঙ্গলের চিহ্ন। গৃহস্থদের বিপদ দেখলেই কুকুর বেড়াল জাতীয় পোষা জীবগুলি কাদে। রাবেয়ার কান্নার উৎস আমরা জানি না। হয়তো সারা দিনের অবরুদ্ধ কান্না রাতে অঝোর ধারার মতোই নেমে আসে। রাবেয়ার কান্নায় রুনু ভয় পায়। বলে, দাদা, আপা কাঁদছে কেমন দেখ। আমি বলি, ভয় কি রুনু? উঁচু গলায় ডাকি, এই, এই রাবেয়া কাঁদা কেন? কী হয়েছে?
কোনো কোনো রাতে অপূর্ব জোছনা হয়। জানালা গলে নরম আলো এসে পড়ে আমাদের গায়। জোছনায় নাকি হাসনাহেনা খুব ভালো ফোটে। নেশা-ধরান ফুলের গন্ধে ঘর ভরে যায়। আমি ডাকি, রুনু ঘুমিয়েছিস?
উঁহু।
গল্প শুনবি?
বল।
কী গল্প বলব ভেবে পাই না। গল্পের মাঝখানে থেমে গিয়ে বলি, এটা নয়, আরেকটা বলি। রুনু বলে, বল। সে গল্পও শেষ হয় না। আচমকা মাঝপথে থেমে গিয়ে বলি, তুই একটা গল্প বল, রুনু।
আমি বুঝি জানি?
যা জিনিস তা-ই বল। বল না।
উঁহু, তুমি বল দাদা।
রুনুকে আমার টমাস হার্ডির এ পেয়ার অব র আইজ-এর গল্প বলতে ইচ্ছে হয়। আমার মনে হয়। রুনুই যেন এ পেয়ার অব র আইজের নায়িকা। কিন্তু রুনু আমার ছোট বোন। সামনের নভেম্বরে সে চৌদ্দ বৎসরে পড়বে। এমন প্রেমের গল্প তাকে কি করে বলি। রুনু বলে, থেমে গেলে কেন দাদা? শেষ কর না।
আমি গল্প বন্ধ করে জিজ্ঞেস করি, রুনু, তোর কাকে সবচে ভাল লাগে?
তোমাকে।
হয়তো আমাকে তার সত্যি ভালো লাগে। বাইরে তীব্র জোছনা, ফুলের অপরূপ সৌরভ, মশারি উড়িয়ে নেবার মতো বাতাস। বুকের কাছটায় গভীর বেদনা অনুভব করি।
এই আপা, এই!
কী হয়েছে রুনু?
দাদা, আপা আমার গায়ে ঠ্যাং তুলে দিয়েছে।
রাবেয়া ঘুমের ঘোরে পা তুলে দিয়েছে রুনুর গায়ে। বেশ স্বাস্থ্য রাবেয়ার। স্বাস্থ্যুবতী মেয়েদের হয়তো ভরা যৌবনের মেয়ে বলে। ভরা যৌবনকথাটায় কেমন একটা অশ্লীলতার ছোঁয়া আছে। আমার কাছে যুবতী কথাটা তরুণীর চেয়ে অনেক অশ্লীল মনে হয়। কে জানে কেন!
পাশের বাসার লোকজনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। রাত যত বাড়ে আশেপাশের শব্দ। ততই স্পষ্ট হয়। দিনে কখনো থানার ঘড়ির ঘণ্টা শুনি না। রাত নটার পর থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাশের বাসায় কে যেন কাশল। কিছুক্ষণ পর খিলখিল করে হাসির শব্দ শুনলাম। হাসির স্বরগ্রাম বেশ উঁচু। নিশ্চয়ই নাহার ভাবী। নাহার ভাবী উঁচু গলায় কথা বলেন। বিধি ডাগর আখি যদি দিয়েছিলো?–নাহার ভাবী রেকর্ড চড়িয়েছেন। প্ৰায় রাতই তিনি গান শোনেন। এই গানটি তাঁর ফেবারিটি। আমার রবীন্দ্রসংগীতের প্রাঙ্গণে মোর শিরিষশাখায় সব চেয়ে ভালো লাগে। এই রেকর্ডটি তাঁরা খুব কম বাজান। বিধি। ডঃ গর আখি বড়ো করুণ। নাহার ভাবী তো খুব হাসিখুশি। অথচ এমন একটি করুণ গান তাঁর পছন্দ কেন কে জানে। যারা খুব হাসি— খুশি, করুণ সুর তাদের খুব মুগ্ধ করে–কোথায় যেন পড়েছি।
রুনু হঠাৎ ডাকাল, দাদা ঘুমিয়েছ?
না।
নাহারা ভাবী গান বাজাচ্ছে।
হুঁ।
এর পর কোন গানটা বাজবে জান?
না, কোনটা?
আধুনিক। জোনাকি ঝিকিমিকি জ্বলো আলো।
সত্যি সত্যিই তাই বাজল। রুনু শব্দ করে হাসল।
আমি বললাম, তুই জানালি কী করে?
আমিই তো আজ দুপুরে সাজিয়ে রেখেছি। তোমার গান সবার শেষে।
রাবেয়া ঘুমের ঘোরে বলল, না না, বললাম তো যাব না। হারুন ভাই যদি সত্যি সত্যি রাবেয়াকে বিয়ে করে ফেলত, তবে আর মাঝরাতে গান শোনা হত না। রাবেয়ার গান ভালো লাগে না। কে জানে, কী তার ভালো লাগে। হারুন ভাইদের বাসার সবাই রাজি হলেও এ বিয়ে হত না।
রাবেয়া যদি কোনো দিন ভালো হয়ে ওঠে, তবে তাকে খুব এক জন হৃদয়বান ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব। হারুন ভাইয়ের মতো একটি নিখুঁত ভালো ছেলে। সেও গভীর রাতে রেকর্ড বাজাবে। চাঁদের আলো এসে পড়বে তাদের দুজনার গায়। ভদ্রলোক রাবেয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলবেন, তোমার কপালে কিসের দাগ রাবেয়া?
পড়ে গিয়েছিলাম চৌকাঠে।
তিনি সেই কাটা দাগের উপর অনেকক্ষণ হাত রাখবেন। তারপর চুমু খাবেন সেখানটায়।
রুনু আমায় ডাকল, দাদা, তোমার গান হচ্ছে।
আমি শুনলাম প্রাঙ্গণে মোর শিরিষশাখায় ফাগুন মাসে কী উচ্ছ্বাসে। আবেগে আমার চোখ ভিজে উঠল। গানটি আমার বড়ো ভালো লাগে।
গ্ৰান শুনতে শুনতে আমি নাহার ভাবীর মুখ মনে আনতে চেষ্টা করলাম। মাঝে মাঝে খুব পরিচিত লোকদের মুখও আমি কিছুতেই মনে আনতে পারি না। নাহার ভাবীর মুখটা ত্ৰিভূজ আকৃতির। হারুন ভাইদের বাসার সবার মুখ আবার লম্বাটে, ডিমের মতো। তারা সবাই ভারি সুন্দর। কয় পুরুষ ধনী থাকলে চেহারায় একটা আলগা লালিত্য আসে কে জানে। ভাবতে ভালো লাগে, এই পরিবারটিতে কোনো দুঃখ নেই। মাসের পনের তারিখের পর থেকে খরচ বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা এ পরিবারের মায়ের করতে হয় না। ইচ্ছে হলেই ইংরেজি ছবির মতো মোটরে করে এরা আউটিং-এ চলে যায়। স্বাধীনতা-দিবসে এ পরিবারের মেয়েরারাইফেল শুটিংএ ফার্স্ট সেকেণ্ড হয়।
তারা কবে এসেছিল শান্তি কটেজে আমার মনে নেই, তবে খুব বৃষ্টি সেদিন। আমি, রাবেয়া আর রুনু বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। জীপ থেকে ভিজতে ভিজতে নামল সবাই। প্রথমে রুনুর বয়সী একটি মেয়ে। নাম শীলা। বাবা আদর করে ডাকেন শীলু মা, মা শুধু বলেন শীলু। তারপর বড় ভাই, চোখে বুড়ো মানুষের চশমা হলেও একেবারে ছেলেমানুষী চেহারা। গাড়ি থেকে নেমেই চেঁচিয়ে উঠল, কী চমৎকার বাড়ি শীলু। বাবা নামলেন, মা নামলেন, চাকর-বাকর নামল। আজিজ সাহেবদের চলে যাওয়ার অনেক দিন পর বাড়িটা তরল। বর্ষা গিয়ে শীত এল। ব্যাডমিন্টন কোর্ট কেটে হৈ হৈ করে দুই ভাইবোন লাভ ইলেভেন, লাভ টুয়েলাভ করে খেলতে লাগল।
রুণু বড়ো লাজুক, নয়তো সে গিয়ে তাদের সঙ্গে ভাব করতে পারত। আমার খুব ইচ্ছে হত শীলু মেয়েটির সঙ্গে রুনুর ভাব হোক। আমি দেখতাম, সন্ধ্যা হলেই শীলু। তাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কবুতর ওড়াত। তাদের দুটি নোটন পায়রা ছিল। কারণে-অকারণে যেত রাবেয়া। তাকে আমরা বাধা দিতাম না। বাধা পেলেই রাবেয়ার মেজাজ বিগড়ে যেত। চিটাগাং-এ বড়ো খালার ভাসুর মস্ত ডাক্তার। তিনি বলেছিলেন, যা ইচ্ছে হয় তা-ই করতে দেবেন একে। দেখবেন, যা এবনর্মালিটি আছে, তা আপনি সেরে যাবে। আমাদের চিকিৎসার টাকা ছিল না। নিখরচার চিকিৎসা তাই আমরা প্ৰাণপণে করতাম। এক দিন মা কাঁদো কাঁদো হয়ে আমার টেবিলে একটি কী যেন নামিয়ে রাখলেন। দেখি চমৎকার একটি কলমদানি। ধবধবে সাদা দুটি পেঙ্গুইন পাখি কলমদানের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে। পেঙ্গুইন দুটোর মাঝামাঝি একটি বাচ্চা পেঙ্গুইন হাঁ করে শূন্যে তাকিয়ে। সেই হাঁ-করা মুখেই কলম রাখার জায়গা। আমার এ-জাতীয় জিনিসের দাম সম্বন্ধে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তবু মনে হল এ অনেক দামী। মা কাঁপা গলায় বললেন, রাবেয়া এনেছে। ওবাড়ি থেকে।
আমার প্রথমেই যা মনে হল, তা হল রাবেয়া না-বলেই এনেছে। কিন্তু রাবেয়া পোনি ঘোড়ার মতো ঘাড় বাঁকিয়ে বলতে লাগল, আমি আনি নি, ওরা আপনি দিয়েছে।
মিথ্যা রাবেয়া বলে না। কিন্তু ওরাই—বা কেন দেবে? এমন একটা সৌখিন জিনিস হঠাৎ করে দিতে হলে যে দীর্ঘ পরিচয় প্রয়োজন, তা কি আমাদের আছে? খবরের কাগজে কলমদানটি মুড়ে রুনু প্রথম বারের মতো ও-বাড়ি গেল। রাবেয়া নাকী সুরে বলতে লাগল, আমার জিনিস রুনু যে বড়ো নিয়ে চলল, ভেঙে ফেললে আমি মজা না–দেখিয়ে ছাড়ব?
জানা গেল রাবেয়া আনে নি, ওরাই দিয়েছে। না, ঠিক ওরা নয়, হারুন বলে যে-ছেলেটি। শিগগিরই বিদেশে যাবে, শুধু একটি পাসপোর্টের অপেক্ষা। সে দিয়েছে। শীলু আর তার মাও ঠিক জানতেন না ব্যাপারটা। তাঁরাও একটু অবাক হয়েছেন। শীলুর সঙ্গে এই অল্প সময়েই খুব ভাব হয়ে গেল রুনুর। একটি লম্বাটে মিমি চকলেট আর বিভূতিভূষণেব দৃষ্টিপ্রদীপ সে নিয়ে এসেছে। আমি বললাম, ওরা কেমন লোক রুনু?
খুব ভালো।
চকলেট পেয়ে গলে গেছিস, না?
যাও। শীলু কিন্তু সত্যি ভালো। জান, শীলু মোটর চালাতে পারে।
যাহা এতটুকু বাচ্চা মেয়ে!
সত্যি। ওদের মোটর সারাতে দিয়েছে। যখন আসবে, তখন সে দেখাবে চালিয়ে।
আর কি গল্প হল?
কত গল্প, ওদের অনেক রেকর্ড আছে।
অনেক?
হুঁ, হিসেব নেই। এত। আমাকে রোজ যেতে বলেছে।
শুধু তুই যাবি, ও আসবে না?
আসবে না কেন? নিশ্চয়ই আসবে।
শীলু অবশ্যি এসেছে কালে-ভাদ্রে। যখন তার রুনুর সঙ্গে দরকার পড়ত তখনি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ডাকত, রুনুরুনু। রুনু সব কাজ ফেলে ছুটে যেত। আমি মনে মনে চাইতাম, মেয়েটা ঘন ঘন আসুক আমাদের কাছে। তার সাথে গল্প করার ইচ্ছে হত আমার। আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, তার সঙ্গে যদি আলাপ হয় তবে কী বলব। দু রাতে তাকে স্বপ্নেও দেখেছি।
একটি স্বপ্নে সে শাড়ি পরে এসে খুব পরিচিত ভঙ্গিতে বসেছে আমার টেবিলে। আমি বললাম, টেবিলে কেন শীলু, চেয়ারে বস।
শীলু হাসতে হাসতে বলল, টেবিলে বসতেই যে আমার ভালো লাগে। হাতে একটা চামচ নিয়ে টুং টাং করে চায়ের কাঁপে জলতরঙ্গের মতো একটা বাজনা বাজাতে লাগল সে।
দ্বিতীয় স্বপ্নটি দেখেছি দিনে-দুপুরে। অনুরোধের আসর শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ দেখলাম শীলু এল। আগের মতোই শাড়ি-পরা। আমি বলছি, শীলু, এত দেরি কেন, কী চমৎকার গান হচ্ছিল।
আমার নাম তো শীলা, আপনি শীলু ডাকেন কেন?
শীলুর সঙ্গে আমার কথা হত এই ধরনের। হয়তো বিকেলে বারান্দায় বসে আছি। হঠাৎ শীলু, ডাকল, শুনুন, একটু রুনুকে ডেকে দেবেন?
বাবা পেঙ্গুইন পাখির কলমদান দেখে খুব রাগ করলেন। বাবার পয়সা ছিল না বলেই হয়তো অহংকার ছিল। শীলুদের পরিবারকে তাঁর একটুও পছন্দ হত না। নিজে আজীবন কষ্ট পেয়েছেন, অন্যের সুখ সে-কারণে সহজভাবে নেওয়ার মানসিকতা তাঁর ছিল না। প্রথম জীবনে ছিলেন স্কুলমাস্টার। প্রাইভেট স্কুল। মাইনের ঠিক ছিল না। আমরা সব তাঁর মাইনের উপর নির্ভর করে আছি দেখে মাস্টারি ছেড়ে ঢুকলেন ফার্মে। বারো বছরে ক্যাশিয়ার থেকে একাউন্টেন্ট হলেন। মাইনে সাড়ে তিনশ। কলমদানীটা ফিরিয়ে দেবার জন্য বাবা পীড়াপীড়ি করছিলেন কিন্তু রুনু বা মা কেউই সেটা নিয়ে এগালো না। কলমদানীর পেঙ্গুইন পাখিটি ধ্যানী মূর্তির মতো বসে রইল আমার টেবিলে। রাবেয়া শুধু মাঝে মাঝে আমায় বলে, তোমার টেবিলে বলে এটা তোমার মনে কর না, খোকা। আচ্ছা, ইচ্ছে হলে মাঝে মাঝে কলম রেখো।
ঘুমের ঘোরে রুনু বলল, না, পানি খাব না। তারপর আরো খানিকক্ষণ উঁহু উঁহু করল। থানার ঘড়িতে ঢং করে শব্দ হল একটা। সাড়ে-বারো, এক, কিংবা দেড়–যে কোনোটা হতে পারে। আমার আরেকটা সিগারেট ধরাবার ইচ্ছে হচ্ছে। কে যেন বলেছিল সিগারেটের আনন্দটা আসলে সাইকলজিকাল। তুমি একটা কিছু পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছ, তার আনন্দ। অনেকে আবার বলেন, নিঃসঙ্গের সঙ্গী। এই মধ্যরাতে আমি একলা জেগে আছি, নিঃসঙ্গ তো বটেই। সিগারেটের একটি বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম সিনেমায়। সমস্ত পর্দা অন্ধকার। আবছা আলোয় হলে দেখা গেল বড়ো রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে কে এক জন। চারপাশে কেউ নেই, ভূতুড়ে আবহাওয়া, থমথম করছে। অন্ধকার। পর্দায় লেখা হল; সে কি নিঃসঙ্গ? লোকটি থমকে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল। পর্দায় লেখা হল ৪ না, নিঃসঙ্গ নয়। এই তো তার সঙ্গী। চমৎকার বিজ্ঞাপন। আমার মনে হয়, সিগারেটের নেশার মূল্যের চেয়ে বন্ধুত্বের মূল্য অনেক বেশি।
খুট করে দরজা খোলার শব্দ হল। আমি কান পেতে রইলাম। কে হতে পারে? বাবা নিশ্চয়ই নন, তিনি ওঠেন সাড়াশব্দ করে, দরজা খোলেন ধুমধাম শব্দ করে। মন্টু অথবা মাস্টার কাকা হবেন। টিউবওয়েলে পানি তোলার শব্দ হল অনেকক্ষণ। ছড়ছড়া করে পানি পড়ার আওয়াজ। কুলি করে পানি ছিটাতে ছিটাতে এদিকেই যেন আসছে। হ্যাঁ, মাস্টার কাকাই। তাঁর মাঝে মাঝে অনেক রাতে ফুলগাছের কাছে চেয়ার পেতে গুনগুন করে গান গাওয়ার শখ আছে। পলা বেঁচে থাকলে প্রথমটায় অপরিচিত জন ভেবে ঘেউঘেউ করত। তারপর গরগর করে পরিচিত জনের অভ্যর্থনা। মাস্টার কাকা বলতেন, কিরে পলু, তোরও বুঝি ঘুম নেই?
আমি বললাম, কে?
মাস্টার কাকা বললেন, আমি, খোকা।
কি করেন?
এই বসেছি একটু। যা গরম! তুই ঘুমুস নি এখনো?
জ্বি না।
আসবি নাকি বাইরে?
দরজা খুলে বেরুতেই চোখে পড়ল কাকা বারান্দায় পা ঝালিয়ে বসে আছেন। বললাম, চেয়ারে বসেন। চেয়ার নিয়ে আসি।
না থাক।
আমি তাঁর পাশে বসলাম। গরম কোথায়? আশ্বিনের শেষাশেষি, একটু শীতই করছে। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা বাতাসও বইছে। মাস্টার কাকারও বোধকরি মাঝে মাঝে ইনসমনিয়া হয়। কাকা বললেন, ঘুমুচ্ছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভাঙল। তারপর আর হাজার চেষ্টাতেও ঘুম আসছে না।
আমি বললাম, প্রথম রাত্ৰিতে ঘুম ভাঙলে এ রকম হয়।
চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে