#ধূসর শ্রাবণ
#লেখিকা:#তানজিল_মীম💚
#পর্ব-০৪+০৫
বাসর ঘরে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে বর্ষা। মাথায় তাঁর হাজার প্রশ্ন, শুভ্র কেন ফিরে এলো। কি এমন ঘটলো তাঁর সাথে যার কারনে শুভ্র ফিরে আসলো। আর ফোনটাও বা কি করে ভাঙলো শুভ্রের। বর্ষা নিশ্চিত শুভ্রের কোনো বন্ধুরই এক্সিডেন্ট হয় নি, এটা নিছকই বানানো কথা। তাহলে কি ঘটলো শুভ্রের সাথে যার জন্য শুভ্র লন্ডন না গিয়ে ফিরে এসে তাঁকে বিয়ে করলো। মাথায় যেন এক একটা প্রশ্নের পাহাড় তৈরি হচ্ছে বর্ষার। এমন সময় দরজায় খট করে আওয়াজ আসতেই চমকে উঠলো বর্ষা। বর্ষা বুঝতে পেরেছে শুভ্র এসেছে। তবে আপাতত মাথা উচু করে শুভ্রকে দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তাঁর তাই চুপচাপ মাথা নিচু করেই বসে রইলো বর্ষা।’
অন্যদিকে,
দরজা আঁটকে চুপচাপ এগিয়ে আসতে লাগলো শুভ্র বর্ষার দিকে। প্রথমে বর্ষার দিকে যাওয়ার কথা ভাবলেও পরক্ষণেই মত পাল্টে আলমারির দিকে গেল শুভ্র। তারপর আলমারি খুলে টিশার্ট আর প্যান্ট বের করে চলে যায় সে ওয়াশরুমের দিকে। ড্রেস চেইঞ্জ করতে হবে তাঁকে এখনো বিয়ের সাজে সজ্জিত সে। শুভ্রের তাল বাহানা সবই আড়চোখে দেখেছে বর্ষা। তবে সে বুঝতে পারছে না শুভ্রের কান্ডকারখানা। তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো বর্ষা, সে বুঝলো না তাঁদের এই ধোঁয়াশা ঘেরা সম্পর্কের ইতি কেমন হবে?’
কিছুক্ষনের মধ্যেই শুভ্র ফ্রেশ হয়ে বাহিরে বেরিয়ে আসলো। তারপর নিশ্চুপে এগিয়ে যেতে লাগলো সে বর্ষার কাছে। বর্ষা তখনও একহাত ঘোমটা টেনে চুপচাপ বসে আছে। শুভ্র বর্ষার পাশে বসে সংক্ষিপ্ত ওয়াডে অপরাধী স্বরে বললো,
‘ সরি।’
সঙ্গে সঙ্গে বর্ষা চোখ তুলে ঘোমটা খুলে তাকালো বর্ষা শুভ্রের দিকে। তবে কিছু বললো না হয়তো শুভ্র যা বললো সব তাঁর মাথার উপর দিয়ে গেছে। বিস্ময় ভরা চোখে বর্ষাকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবারো বললো শুভ্র,
‘ আমি জানি বর্ষা আমি যা করেছি তাতে হয়তো এই সরি শব্দটা খুবই ঠুংকো। আমার জন্য তোমাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। অনেক মানুষ বাজে মন্তব্যের স্বীকার হয়েছো। সবকিছুর জন্য আমি খুব দুঃখিত বর্ষা।’
উওরে এবারও নিশ্চুপ হয়ে রইলো বর্ষা কিন্তু কিছু বললো না। বর্ষাকে চুপ থাকতে দেখে তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো শুভ্র তারপর বললো,
‘ অনেক রাত হয়ে গেছে এখনো এত ভাড়ি সাজে বসে আছো কেন যাও ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।’
বলে পাশ ফিরে চুপচাপ বসে রইলো শুভ্র। এভাবে ২ মিনিটের নীরবতা কাটিয়ে হঠাৎই বলে উঠল বর্ষা,
‘ আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে, শুভ্র?’
এতক্ষণ পর বর্ষার মুখের ভয়েস শুনে বিস্মিত ভরা চোখে শুভ্র তাকালো শুধু বর্ষার দিকে। বর্ষা তখন চুপচাপ বসে ছিল মাথা নিচু করে শুভ্রের দিকে না তাকিয়েই কথাটা বললো সে শুভ্রকে। বর্ষার কাজে শুভ্র কিছুটা হতাশা নিয়েই বললো,
‘ তুমি কি আমার দিকে না তাকিয়েই কথা বলবে বর্ষা?’
এবার বর্ষা তাকালো শুভ্রের মুখের দিকে। তারপর নিশ্চুপেই বললো,
‘ আপনি তো চলে গিয়েছিলেন তাহলে ফিরে কেন এলেন শুভ্র?’
বর্ষার কথা শুনে শুভ্র নীরবেই বলে উঠল,
‘ অনেকসময় আমরা যা চাই তাই হবে এমনটা নয়। চাওয়া না পাওয়ার মধ্যে কিছু জিনিস আছে বর্তমানে তুমি আমার জন্য সেটাই। আর আমি জানি আমরা দুজনেই পরিস্থিতির স্বীকার দাদুর মন রাখতেই আমরা এই বিয়েটা করেছি।’
‘ তাঁর মানে আপনি দাদুর জন্যই ফিরে এসেছেন শুভ্র?’
উওরে দীর্ঘ শ্বাস শ্বাস ফেলে বললো শুভ্র,
‘ তেমনটাই তবে,
‘ তবে কি শুভ্র?’
শুভ্র আরো কিছু বলবে এমন সময় শুভ্রের ফোনটা বেজে উঠল। শুভ্র একবার ফোন তো একবার বর্ষার দিকে তাকিয়ে বসা উঠে দাঁড়ালো তারপর বললো,
‘ বাকি কথা পরে হবে বর্ষা তুমি ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।’
এতটুকু বলে ফোনটা তুলে চলে যায় শুভ্র বেলকনিতে। আর বর্ষা নিরালায় তাকিয়ে থাকে শুভ্রের যাওয়ার পানে। এমন এক মুহূর্তেও কেউ শুভ্রকে ফোন করবে এটা সত্যি খুব বিস্মিত বিষয় হয়ে দাঁড়ালো বর্ষার জন্য।’
প্রায় আধ ঘন্টা পর, শুভ্র কথা বলা শেষ করে বেলকনি থেকে আসলো ভিতরে। ততক্ষণে বর্ষা ড্রেস পাল্টে সুন্দর একটা শাড়ি পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে নীরবে। শুভ্র একপলক তাকালো বর্ষার মুখের দিকে তারপর বললো,
‘ জানো তো আমরা অনেক সময় যা চাই তা যেমন পাই না তেমনি অনেক সময় চাওয়ার জিনিসের চেয়েও অতি মূল্যবান কিছু পাই।’
এতটুকু বলে তপ্ত নিশ্বাস ফেলে রুমের লাইট অফ করে সোফায় শুয়ে পড়লো শুভ্র। সে জানে না তাঁর আগামী দিনগুলো কেমন হবে? আধও কি সে মানিয়ে নিতে পারবে বর্ষাকে! সত্যি তো প্রত্যেকবার মেয়েদেরই কেন মানিয়ে নিবে হবে? ছেলেদের কেন নয়!’ মাঝে মাঝে ছেলেদেরও মানিয়ে নেওয়া উচিত।’
_____
গভীর রাত! ঘড়ির কাঁটায় প্রায় দুটো ছাড়িয়ে গেছে। এমন সময় আচমকা চোখ খুলে ফেললো বর্ষা। মাথার ভিতর অগোছালো কথারা ঘুরপাক খাচ্ছে খুব। শুভ্রের কান্ডকারখানা যেন বুঝা বড় দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর জন্য। কি বলছে না বলছে সবই যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে বর্ষার। দূর আকাশ বেয়ে মৃদু বাতাস আসছে রুমে। তবে আপাতত প্রকৃতির দিকে খুব বেশি নজর দিলো না বর্ষা নিমিষেই চোখ দুটো বুঝিয়ে নিল সে।’
পরেরদিন সকালে সূর্যের ফুড়ফুড়ে আলোতে ঘুম ভাঙলো বর্ষার। রুমে তখন শুভ্র ছিল না। সোফায় শুভ্রকে না দেখে কিছুটা চিন্তিত মুখ নিয়েই শোয়া থেকে উঠে বসলো বর্ষা। পরক্ষনেই ওয়াশরুম থেকে শব্দ আসায় বর্ষা বুঝলো শুভ্র হয়তো ওয়াশরুমে গেছে। কিছুক্ষন এদিক সেদিক তাকিয়ে তক্ষৎনাত বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো বর্ষা। এমন সময় দরজায় নক করলো কেউ। বর্ষাও নিজেকে হাল্কা গুছিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেল দরজার কাছে। দরজা খুলতেই শুভ্রের ছোট বোন শ্রভ্রাকে দেখে বললো সে,
‘ গুড মর্নিং!’
শুভ্রা মুচকি হেঁসে বললো,
‘ গুড কি বেড পরে বলবো ভাবি। আগে বলো তুমি এখনো তৈরি হও নি কেন? নিচে সবাই তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’
‘ এই তো এক্ষুনি আসছি শুভ্রা।’
‘ ঠিক আছে ভাবি তাড়াতাড়ি এসো ভাইয়া কই?’
‘ তোমার ভাইয়া ওয়াশরুমে গেছে।’
‘ ঠিক আছে ভাইয়াকে নিয়ে তাড়াতাড়ি এসো ভাবি।’
উওরে কিছু বলার আগেই শুভ্রা চলে যায়। বর্ষাও বেশি কিছু না বলে দরজা আঁটকে দেয় আবার।’
এমন সময় পিছন থেকে শুভ্র বলে উঠল,
‘ কে এসেছিল?’
আচমকাই শুভ্রের কন্ঠ কানে আসতেই হকচকিয়ে উঠল বর্ষা পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো সে,
‘ শুভ্রা! আপনায় আর আমায় তাড়াতাড়ি নিচে যেতে বলেছে?’
প্রতি উওরে শুভ্র শুধু একটা ক্ষুদ্র শব্দই ব্যবহার করে বলে,
‘ ওহ।’
শুভ্রের কথার প্রতি উওর হিসেবে বর্ষাও নিরিবিলি শব্দ বলে,
‘ হুম।’
_____
ভার্সিটির লাইব্রেরির একদম শেষ বেঞ্চের কর্নার সিটে চুপচাপ বসে আছে হিয়া। চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ তাঁর। যদিও বইয়ের পাতায় মুখ লুকিয়ে আছে সে। তারপরও বিরক্ত লাগছে কেমন যেন সবকিছুই ধূসর মিশ্রিত ধোঁয়াশা লাগছে আশপাশ। হিয়া বই ছেড়ে ডাইরিতে হাত দিলো। তারপর নিজের অজান্তেই কিছু অগোছালো শব্দকে গুছিয়ে লিখতে শুরু করলো সে। এমন সময় হাতে গোণা পাঁচ ছয়টা ছেলের সাথে কালো শার্ট, কালো জিন্স, চোখে কালো চশমা, হাতে কালো ওয়াচ পড়ে পুরো ফিল্মি স্টাইলে হিয়ার দিকে হেঁটে আসছিল নির্মল। চোখে মুখে স্পষ্ট রাগের ছাপ তাঁর। নির্মল ঢুকতেই লাইব্রেরি জুড়ে থাকা ছেলে মেয়েগুলো পুরো হা হয়ে তাকিয়ে রইলো তাঁর দিকে। কিন্তু তাদের দৃষ্টি বেশিক্ষণ আর রাখলো না নির্মলের দিকে। কারন নির্মল একবার বলেছিল তাঁকে দেখলে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যাবে না কারোই। নির্মলের কথা মাথায় রেখেই পরক্ষণেই সবাই চোখ নামিয়ে যে যার কাজে মনোযোগ দিলো।’
এদিকে নির্মল হাঁটতে হাঁটতে একদম এসে বললো হিয়ার মুখোমুখি চেয়ারে। হিয়ার তখনও দৃষ্টি ছিল ডাইরির পাতায়। নির্মল হিয়ার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠ নিয়ে বললো,
‘ কাল এয়ারপোর্টে তুমি কার সাথে কথা বলেছিলে, হিয়া?’
নির্মলের কথাটা কান পর্যন্ত আসলেও সেটার উওর দেওয়ার যেন কোনো প্রয়োজন মনে করলো না হিয়া। সে তার মতো চুপচাপ ডাইরির পাতায় কিছু লিখতে ব্যস্ত ছিল। হিয়ার এমন চুপচাপ জিনিসপত্র একদমই সহ্য হয় না নির্মলের। তারপরও বরাবরই এই মেয়েটা অসহ্যকর যন্ত্রণা দেয় তাঁকে। নির্মল নিজের রাগটাকে যথাসম্ভব কন্ট্রোল করে আবারো বলে উঠল,
‘ কি হলো তুমি কথা বলছো না কেন? কার সাথে কথা বলেছিলে তুমি।’
এবারও নিশ্চুপ হিয়া। এবার যেন নিজের সহ্যের সীমা অতিক্রম করছে হিয়া। নির্মল প্রচন্ড রাগ নিয়ে বললো,
‘ তুমি কি ভেবেছো তুমি কিছু না বললে আমি জানতে পারবো না হিয়া,আই প্রমিজ জাস্ট দু’দিনের মধ্যে ছেলেটাকে খুঁজে বের করে ওর রক্তাক্ত দেহটাকে তোমার সামনে হাজির করবো আমি।’
এবার না চাইলেও যেন চুপ থাকতে পারলো না হিয়া৷ ডাইরির পাতা থেকে কলম আর চোখ দুটো টাকেই সরিয়ে বললো সে,
‘ আপনি নিজেকে কি ভাবুন বলুন তো? প্রথমত এমনটা নয় আমি যে ছেলের সাথেই কথা বলবো সে ছেলেই আমার প্রেমিক হবে। আর দ্বিতীয়ত আপনি কি মনে করেন কোনো ছেলেকে মেরে তার নিথর দেহ আমার সামনে আসলেই আমি আপনাকে ভালোবাসি বলে ফেলবো। দেখুন এইসব চিন্তাধারা মাথা থেকে বের করুন।’
এতটুকু বলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো হিয়া। তারপর নিজের ব্যাগ ডাইরি আর কলমটাকে হাতে নিয়ে বললো,
‘ কাল যে ছেলের সাথে আমি কথা বলেছি সে আমার কেউ ছিল না। আর তার থেকেও বড় কথা সে বিবাহিত। আশা করি আপনার জন্য ওই ছেলের বায়োডাটার ইনফরমেশন হিসেবে এর চেয়ে বেশি কিছু জানার প্রয়োজন পড়বে না।’
এতটুকু বলে তক্ষৎনাত জায়গা ত্যাগ করলো হিয়া৷ আর নির্মলও নিশ্চুপে শুধু তাকিয়ে রইলো হিয়ার যাওয়ার পানে!’
#চলবে……
#ধূসর_শ্রাবণ💚
#লেখিকা:#তানজিল_মীম💚
#পর্ব-০৫
ব্রেকফাস্ট টেবিলে বর্ষা বাদে গোল হয়ে বসে আছে সবাই। একমাত্র কাঁটা চামচের শব্দ ব্যতিত তেমন কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না তেমন। শুভ্র, শুভ্রের বাবা মা, দাদু,শুভ্রা সবাই চুপচাপ খাওয়ায় ব্যস্ত। যদিও তাঁরা বর্ষার অপেক্ষা করছিল অনেকক্ষন কিন্তু শুভ্র বারন করায় নিজেদের খাওয়ার কাজে মগ্ন হন সকলেই। তাদের পাশেই রাহেলা নামক এক মহিলা খাবার সার্ভ করছেন। উনি এ বাড়ির পুরনো একজন কাজের লোক। যদিও উনি কাজের লোকের চেয়ে পরিবারের একজন সদস্যের মর্যাদাই বেশি পান। এমন সময় সিঁড়ি বেয়ে একটা লাল টুকটকে শাড়ি পড়ে নিচে নামলো বর্ষা। এই শাড়িটার জন্য যা দেরি হলো তাঁর। এতটা দেরি হওয়ার জন্য বেশ সংকোচতা ফিল হচ্ছিল ভিতরে ভিতরে। বর্ষাকে আসতে দেখে শুভ্রা বলে উঠল,
‘ ওই তো বর্ষা ভাবি চলে এসেছে।’
সাথে সাথে সবাই তাকালো বর্ষার দিকে। শুভ্র একপলক তাকিয়ে তক্ষৎনাত চোখ সরিয়ে খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো যেন খাওয়া ব্যতীত আপাতত তাঁর জন্য আর বড়সড় কোনো কাজ নেই। বর্ষা টেবিলের কাছ পর্যন্ত আসতেই শুভ্রের বাবা বলে উঠল,
‘ আমার পাশ দিয়ে বসো, বউমা?’
এই প্রথমবার বর্ষা শুভ্রের বাবার মুখে বউমা ডাকটা শুনলো বেশ লেগেছে তাঁর। বর্ষা মুচকি হেঁসে বললো শুভ্রের বাবার পাশে থাকা চেয়ার পেতে। বর্ষা বসতেই রাহেলা খাবার দিতে শুরু করলো বর্ষাকে। কিছুক্ষনের নীরবতার ভর করলো সকলের মাঝে। হঠাৎই সেই নীরবতা কাটিয়ে শুভ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো শুভ্রের বাবা,
‘ তোমার লন্ডনে যাওয়ার ফ্লাইট কবে শুভ্র?’
খাবারের প্রতি বিশেষ মনোযোগ ছিল শুভ্রের। হুট করেই বাবা মুখের কন্ঠ শুনে খাওয়া বন্ধ করে বাবার মুখের দিকে তাকালো শুভ্র তারপর বললো,
‘ এক সপ্তাহ পর।’
শুভ্রের কথা শুনে শুভ্রের বাবা বেশ ভাবনাহীন ভাবেই বলে উঠল,
‘ তুমি নিশ্চয়ই জানো এবার তুমি একা নও তোমার সাথে বর্ষাও যাবে। ‘
প্রতি উওরে কিছু বললো না শুভ্র কারন সে এটা জানতো। শুভ্রকে চুপ থাকতে আবারো প্রশ্ন ছুড়লো শুভ্রের বাবা,
‘ এখন তুমি কি বলো?’
বাবার ফের প্রশ্ন শুনে শুভ্র তাঁর বাকি খাবারগুলো শেষ করে আধ গ্লাস পানি খেয়ে উঠে দাঁড়ালো তারপর টিসু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
‘ তোমরা তো সবকিছু আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছো তাই নতুন করে আমি আর কি বলবো, তোমাদের যা ভালো মনে হয় তাই করো। যাইহোক আমি একটু বের হবো আমার কিছু কাজ আছে।’
এতটুকু বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় শুভ্র। শুভ্রের যাওয়ার পানে কিছুুক্ষন তাকিয়ে থাকে বর্ষা। বাকি সবাই না বুঝলেও সে বুঝতে পেরেছে অনেকটা অভিমান নিয়েই কথাগুলো বললো শুভ্র।’
সকাল থেকেই বাড়ির মানুষজন বেশ ব্যস্ত কারন কাল শুভ্র আর বর্ষার বৌ-ভাতের অনুষ্ঠান। বউভাতের অনুষ্ঠানটা বাড়িতে হওয়ায় ব্যস্ততা যেন আরো বেশি সবার। শুভ্রদের আত্মীয়স্বজন আসতে শুরু করেছে অনেকেই। পুরো বাড়ি জুড়েই একটা হট্টগোল ব্যাপার। যদিও এগুলো কাল থেকেই ছিল। শুভ্রদের বাসা থেকে বর্ষাদের বাড়ির দুরত্ব কয়েক মিনিটের জাস্ট।’
নিজের রুমে চুপচাপ বসে আছে বর্ষা। তাঁর পাশেই শুভ্রা বক বক করে যাচ্ছে। শুভ্রার কথার প্রতি উওর হিসেবে জাস্ট হা না এই দুটো শব্দই বেশি ইউজ করছে সে। হঠাৎই বর্ষা বলে উঠল,
‘ আচ্ছা শুভ্রা তোমার ভাইয়ার বিদেশি ফ্রেন্ডরা কেন আসলো না বিয়েতে?’
এতক্ষণ বর্ষার হা না শব্দ ছেড়ে বড় কথা শুনে শুভ্রা বেশ ভাবনাহীন ভাবেই বলে উঠল,
‘ আজ আসবে বোধহয় আসলে তোমাদের বিয়েটা তো কয়েকদিন আগে হয়ে গেছে তাই হয়তো তাঁরা আসতে পারে নি।’
‘ ওহ!’
‘ হুম। ভাইয়া বোধহয় তাদের আনতেই গেছে।’
প্রতি উওরে তেমন কিছু বললো না বর্ষা। এমন সময় তাঁর ফোনটা বেজে উঠল উপরে তাঁর বেস্টফ্রেন্ড আরোহীর নাম দেখে চোখে মুখে হাসি ফুটলো কিন্তু পরক্ষণেই হাসিটাকে দমিয়ে রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
‘ ফোন কেন করেছিস তুই?’
বর্ষার কথা শুনে অপর পাশে আরোহী বলে উঠল,
‘ লে খুকি যেখানে রাগ আমার করার কথা সেখানে তুই করছিস কেন?’
‘ মানে?’
‘ মানে আবার কি বিয়ের ডেটের দুসপ্তাহের আগেই বিয়ে সেরে ফেলেছিস আবার রাগ দেখাচ্ছিস?’
‘ তোকে তো আগেই বলেছি?’
‘ কচু বলেছিস যাই হোক পিছন ফের।’
‘ কি?’
‘ বলছি পিছন ঘুর।’
সাথে সাথে পিছনে ফিরে তাকালো বর্ষা। সত্যি সত্যি পিছনে তাঁর প্রবাসী বেস্টফ্রেন্ডকে দেখে চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো তাঁর। তক্ষৎনাত খুশি হয়ে একবার শুভ্রা তো একবার আরোহীর দিকে তাকিয়ে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো সে আরোহীকে। তারপর কান্না ভেঁজা কন্ঠ নিয়ে বললো সে,
‘ কেমন আছিস দোস্ত কতদিন পর তোকে দেখলাম?’
‘ আমি ভালো আর তুই?’
‘ হুম ভালো!’
________
পরন্ত বিকেল বেলা! ঢাকার উওরার আনাচে কানাচে বিভিন্ন বইয়ের দোকানে ঘুরে ঘুরে দেখছে হিয়া। মাথা মন সবকিছুই নিস্তেজ প্রায় তাঁর। কোনো এক সাহিত্যের খোঁজেই নাজেহাল অবস্থা তাঁর। বিকেল হওয়া সত্বেও প্রচন্ড গরমে মাথা মন প্রায় ক্লান্ত তাঁর। কিছুটা হতাশ হয়েই বইয়ের দোকান থেকে নামলো হিয়া। ব্যস্ত শহর জুড়ে চলছে শাঁই শাঁই সব গাড়ি। হিয়া তাঁর ক্লান্ত মাখা মুখটা নিয়েই হাঁটা ধরলো হাতের ডান দিকের রাস্তা দিয়ে। হয়তো বইয়ের খোঁজের জন্য তাঁকে কুরিয়ার সার্ভিস অর্থাৎ অনলাইনই ব্যবহার করতে হবে। শুধু শুধু সারা বিকেল জুড়ে হাটলো এদিক সেদিক। মুখ জুড়ে থাকা ঘামগুলো নিমিষেই ওড়না দিয়ে মুছে ফিললো সে। এই মুহূর্তে বৃষ্টি নামলে হয়তো মন্দ হতো না খুব। কিন্তু আকাশটা আজ বড্ড পরিষ্কার মনে হয় না আজ আর বৃষ্টি নামবে। আনমনেই আকাশ পথে তাকিয়ে এগিয়ে চললো হিয়া ব্যস্তশীল রাস্তা পেরিয়ে। তৃষ্ণা পেয়েছে খুব কিন্তু আশেপাশে তেমন কোনো চায়ের দোকান দেখছে না সে। যাও আছে তাও তাঁর অপজিট রাস্তায় সেখানে যেতে হলে তাঁকে মাঝরাস্তার এই গাড়িগুলো টপকাতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে রাস্তাপারাপাত হতে মটেও মন চাইছে না তাঁর। একবার পা হলে দ্বিতীয় ঘুরে আবারো আসতে হবে তাঁকে।’
শেষমেশ নিরুপায় হয়েই ক্লান্ত শরীর আর মন নিয়েই হাঁটা শুরু করলো সে। কয়েককদম যেতেই হঠাৎই পিছন থেকে একটা পিচ্চি ছেলে এসে ওড়না ধরে টান দিলো হিয়ার। গলায় টান অনুভব হতেই তক্ষৎনাত দাঁড়িয়ে পড়লো সে ওখানেই পিছন ফিরে পিচ্চি একটা ছেলেকে দেখে নিচে বসে বললো হিয়া,
‘ কিছু বলবে আমায়?’
উওরে ছেলেটিও মাথা নাড়িয়ে হা সমর্থন দিলো যার অর্থ হা সে কিছু বলবে। ছেলেটির মাথা নাড়ালো দেখে হিয়া তাঁর চোখের চশমাটা হাত দিয়ে ঠিক করে বললো,
‘ হুম বলো।’
সাথে সাথে পিছন থেকে একসাথে একবোতল ঠান্ডা পানি, আর অন্য হাতে একটা গোলাপ আর চিরকুট এগিয়ে দিল হিয়ার পানে। ছেলেটির কাজে হিয়া অবাক হয়েই ওগুলো হাতে নিলো। পরক্ষণেই পাল্টা কিছু বলতে তাঁর আগেই পিচ্চি ছেলেটি দৌড়ে হাওয়া হয়ে গেল মুহূর্তেই। হিয়া বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো তারপর চিরকুটটা খুললো সে যেখানে লেখা,
‘ এত আলসে কে তুমি? জানো না তৃষ্ণা পেলে পানি খেতে হয়, সবসময় সাহিত্যের পিছনে ছুটলেই হবে নাকি মিস ঔপন্যাসিকা। মাঝে মধ্যে কাল্পনিকতা থেকে বেরিয়ে বাস্তবেও মুখ লুকাতে হয় প্রিয়দর্শিনী।’
হিয়া বেশ অবাক হলো চিরকুটটা পড়ে। সে যে সাহিত্যের পিছনে ছুটছিল এটা কি করে বুঝলো এই চিরকুটের মালিক। অবাক হয়েই বললো সে,
স্ট্রেঞ্জ!’
বলেই পেছন ফিরে তাকালো কয়েকবার বাট আশেপাশে তেমন কাউকেই চোখে পড়লো না তাঁর।’
পরক্ষণেই বেশি কিছু ভাবলো না আর এগিয়ে গেল নিজের গন্তব্যের দিকে। চেয়েছিল ফুলটা ফেলে দিতে কিন্তু ফুলটা এতটাই সুন্দর যে না চাইলেও সেটাকে নিয়েইন এগিয়ে গেল সে। আপনা আপনি ঠোঁটে হাসি ফুটলো তাঁর।’
অন্যদিকে থেকে বেশখানিকটা দূরে হিয়া হাসিমাখা মুখ দেখে নিশ্চুপেই হাসলো কেউ। হয়তো এতক্ষণ হিয়ার এই হাসিমাখা মুখটা দেখার জন্যই ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করছিল সে।’
_____
পরেরদিন খুব ধুমাধাম করেই বৌভাতের অনুষ্ঠান পালন করা হলো শুভ্র আর বর্ষার। শুভ্রের কয়েকজন বিদেশি ফ্রেন্ডরাও সামিল ছিল তাতে। যদিও তাতে বর্ষার কোনো খোপ ছিল না। বর্ষার সাথে হাই হ্যালো ব্যতীত তেমন কোনো কথা হয় নি আর তাদের সাথে।’
রাত প্রায় ১০টার কাছাকাছি! সারাদিনের অনুষ্ঠান ছেড়ে সবেমাত্র বিছানায় গা এলিয়েছে বর্ষা। আজ তাঁর মা বাবাও এসেছিল। সাথে এসেছিল হাতেগোনা কয়েকজন বন্ধু। বর্ষা খুব নিশ্চুপ স্বভাবের হওয়ার খুব একটা বন্ধু জোটে নি তাঁর। হাতে গোনা দু’চার হবে হয়তো। তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো বর্ষা, আজ আবারও বেলকনিতে দাঁড়িয়ে শুভ্র কারো সাথে কথা বলছে। কার সাথে রাত করে কথা বলে বুঝতে পারে না বর্ষা। কোনো বিশেষ কেউ। উওর মেলে না বর্ষার। অতঃপর বেশি কিছু না ভেবেই চোখ বুঝে ফেললো সে। তাদের সম্পর্কটা ঠিক কোনদিকে যাচ্ছে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। শুভ্রও তেমনভাবে কোনো কথাই বলে না বর্ষার সাথে। যেটা খুবই খারাপ লাগছে বর্ষার কাছে, শুভ্র চায় কি? কি চলছে শুভ্রের মনে! বুঝে উঠতে পারে না বর্ষা। চোখ বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো তাঁর। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে বর্ষার এই বিয়ে না হলেই বোধহয় ভালো হতো?’
____
রাত প্রায় দেড়টার কাছাকাছি! টেবিল জুড়ে থাকা কিছু ডাইরির পৃষ্ঠা উল্টে চলছে বারংবার। যদিও সেখানে কিছু অস্পষ্ট শব্দ ব্যতীত তেমন কিছুই লেখা নেই। জানালার কার্নিশ বেয়ে আসা রাতের জোৎসা ভরা আলো এসে পড়ছে সেই ডাইরির পাতাতে। এদের পাশেই খাট জুড়ে ঘুমিয়ে আছে হিয়া। কয়েক মুহূর্ত আগেই চোখ বুঝেছে সে। যদিও ঘুমটা খুব বেশি গভীর হয় নি তাঁর। এমন সময় হঠাৎই বেলকনির পাশ দিয়ে কিছু ভয়ানক শব্দ কানে আসতেই হিয়ার কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেল সাথে আঁতকে উঠলো মন। চটজলদি শোয়া থেকে উঠে বসলো হিয়া রুমের লাইট জ্বালালো থাকায় খুব বেশি ভয় পেলো না সে। হিয়া কিছুটা ঘাবড়ানো মুখ নিয়েই এগিয়ে গেল বেলকনির দিকে। তক্ষৎনাত একটা প্যাকেট আর প্যাকেটার ওপর দড়ির সাথে আটকানো একটা চিরকুট দেখে আরো যেন অবাক হয় খুব। হিয়া তক্ষৎনাত এগিয়ে যায় সেদিকে হয়তো সে যেটার খোঁজে সারা বিকাল জুড়ে হাঁটলো সেটাই এটা। হিয়া আশপাশ তাকিয়ে চটজলদি চিরকুটটা হাতে নিলো। তবে এবার চিরকুটটা খোলা আগে সাথে থাকা প্যাকেটটা খুললো সে। প্যাকেটটা খুলতেই মুখে হাসি ফুটলো তাঁর। কারন সে যে বইটা খুঁজছিল সেটাই এটা। হিয়া খুশি মনে চিরকুটটা খুললো যেখানে লেখা,
‘ তোমার একটুখানি নিশ্চিতে ঘুমানোর উপহার হিসেবে এই ছোট্ট উপন্যাস প্রিয়দর্শনী।’
হিয়া খুশি মনে তাকালো আবারো তাঁর হাতে থাকা বইটার দিকে। যেখানে তাঁর প্রিয় একজন লেখক রবীন্দ্রনাথের লেখা উপন্যাস ‘ঘরে-বাইরে’ নামটি জ্বল জ্বল করছে। ঠোঁটে হাসি রেখেই বইটি বুকে জড়িয়ে ধরলো হিয়া। অনাকাঙ্ক্ষিত খুশিরা যখন হুট করে হানা দিলে যেমন খুশি খুশি লাগে এই মুহূর্তে হিয়ার অবস্থাটাও তাই যেটা হয়তো লিখে প্রকাশ করা যাবে না।’
#চলবে….