#দেয়াল
পর্ব – ৬,+৭
লেখকঃ #Ramim_Istiaq
৬.
ছোট মামার সাথে আজ শহড়ে যেতে হবে রামিমের।
ছোট মামিকে দেখার আর তর সইছে না তার।
রন্টি মামা যে সত্যি সত্যি বিয়ে করেছে সেটা মোটামুটি নিশ্চিত হলেও কিছুটা দ্বিধা কাজ করছে রামিমের।
যেই মামা মেয়ে দেখলে পালাতো সে বিয়ে করেছে তাও আবার প্রেমের বিয়ে বিশ্বাস করা কিছুটা হলেও কষ্টকর।
জিরু বাবার কথা অনুযায়ী আজ ছোট মামিকে বাসায় নিয়ে আসবে।
সকাল থেকেই ফোন দিয়ে যাচ্ছে রন্টু মিয়া।
রামিমের ফোনটা বেজেই চলেছে রিসিভ করার নামগন্ধও নেই।
রন্টু মিয়া কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেছে।
রামিম গেছে তিথীর সাথে কথা বলতে কারন ও বাড়িতে সবাই একজনকেই খুব ভালোবাসে সেটা হলো তিথী।
বড় মামা ভিষন রাগী। তার রাগের বহিঃপ্রকাশ একবার দেখেছিলো রামিম।
বড় মামি ছোট মামা দুজনকেই মেরেছিলো।
রামিম তিথী তখন খুব ছোট বয়স ৭ হবে।
সামনে যে যাচ্ছে তাকেই ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিচ্ছে নয়তো মারছে এমন অবস্থায় তিথী সামনে গিয়ে দাড়ায়।
রামিম সেদিন প্রচুর অবাক হয়েছিলো –
তিথীকে দেখে বড় মামা চলে গেলো।
রামিম ভাবে তিথী মেয়েটার চোখে অনেক মায়া, যতই রাগ থাকুক না কেনো ওর চোখের দিকে তাকালে সব রাগ পানি হয়ে যায়।
সেদিনের পর থেকে রামিম তার বড় মামার আশেপাশে খুব একটা ভীড়ে না।
শেষমেষ সিদ্ধান্ত হলো তিথীও সাথে যাবে।
অগত্যা তিনজনে রওনা দিলো শহড়ের উদ্দেশ্য।
রামিম যে গ্রামে থাকে তা না তবে শহড় থেকে একটু ভেতরে সব ধরনের সুবিধাই আছে শুধু কোলাহল নেই শহড়ের ব্যস্ততা নেই ট্রাফিক পুলিশ নেই না আছে গাড়ির হর্নের শব্দ।
ঠান্ডা বাতাস বয়, কোকিলের ডাক শোনা যায় সকালে পাখির কিঁচিরমিঁচির শব্দে ঘুম ভাঙে শহড়ের মত গাড়ির হর্নের শব্দে না।
রন্টু মিয়াকে বেশ খুশি খুশি লাগতেছে।
ট্যাক্সিতে পিছে একটা সিট সামনে দুইটা।
ড্রাইভারের পাশে দুজন বসেছে রামিম তিথী আর রন্টু মিয়া পিছনে।
তিথী জানালার পাশে রামিম মাঝখানে ওপাশে রন্টি মামা।
রামিম খেয়াল করলো তিথীও বেশ হাসিখুশি আজ।
একটু পরপর রামিমের দিকে চেপে বসছে আর মুচকি হাসছে।
প্রেমের লক্ষন বেশ ভালোই বুঝে রামিম তাই এখন দুরে দুরে থাকে তিথীর থেকে।
ছোট মামির নাম ঝর্ণা ইসলাম।
বেশ পানি পানি ভাব আছে নামটাতে মজা করে বলে রামিম।
মেয়েটা দেখতো ভালো, উচ্চতাও ভালো তবে চুলগুলা ছোটছোট।
রামিম হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করতেছে কিন্তু পারতেছেনা।
সে ভাবতাছে তিন্নির যেদিন বিয়ে হবে ও তো চলে যাবে আমাকে ছেড়ে আমি কি আঁটকাতে পারবোনা ওকে?
মনটা ভারি হয়ে যায় রামিমের।
এবার সামনে বসেছে ড্রাইভার মশাই বেজায় খারাপ। ভুড়ি নিয়ে নড়তে পারেনা কিন্তু গাড়িতে বসিয়েছে ৫ জন মানুষ।
তার ভুড়ির প্রশস্ততা একটা সিট দখল করেছে তারপরও পাশে দুজন বসিয়েছে।
সেদিকে খেয়াল নেই রামিমের।
একবার তিন্নির কথা ভাবতে শুরু করলে আর বাইরের পৃথিবীর কথা মনে থাকেনা তার।
কথা অনুযায়ী জিরু বাবা এসেছে রামিমের মামাবাড়ি। বেশ হাক ডেকে বলে চলেছে তোদের সংসারে উন্নতি আসতে চলেছে। ভালো কিছু হবে আজ।
বড় মামা বড় মামি বাইরে এসে দেখবে এসব তার কিছুক্ষণ পরেই রন্টি মামা রামিম তিথী বাড়িতে প্রবেশ করবে এমনটাই প্লান করা।
প্লানমতো সবকিছু হলেও বড় মামাকে কিছুতেই মানানো গেলোনা রন্টু মামার বিয়ের ব্যাপারটা।
ঝর্ণা ইসলাম ওরফে ছোট মামি আর রন্টি মামাকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরলো রামিম।
মা আর বোন এই দুজন মানুষ সবসময় দূর্বল।
রামিম দেখলো তার মা বেশ খুশি হয়েছেন রন্টু মামার বউকে দেখে।
রুমে এসে ঘুমালো রামিম।
আপাতত কদিন এখানেই থাকবে রন্টু মামা।
নিচতলায় একটা রুম সবসময় ফাকা থাকে সেখানেই তাদের ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন নাজনীন বেগম।
রামিম স্বপ্নে দেখে তিন্নিকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করেছে সে।
ছোটখাটো একটা সংসার। প্রচুর ভালোবাসাবাসি।
ছোট একটা ঘর, জানালার পাশে কয়েকটা রজনীগন্ধা ফুলের গাছ, টিনের চালে কয়েকটা ফুটো সেখানে দিয়ে সূর্যের আলো গোলাকার হয়ে রুমে ঢুকে ছড়িয়ে যায়।
বর্ষাকালে টুপটাপ পানি পড়ে ছিদ্র দিয়ে।
ছোট ছোট সীসার কলস দেওয়া ফুটোর নিচে।
টুপটাপ শব্দ হচ্ছে….
রামিম তিন্নি ঘুমিয়ে আছে একে অপরকে জড়িয়ে হঠাৎ কয়েকফোটা পানি রামিমের মুখের ওপর পড়লো ঘুম ভেঙে গেলো রামিমের।
বাস্তবেও ঘুম ভেঙে গেছে,
রামিম ভাবে- পালিয়ে গেলে কেমন হয়?
চলে গেলাম এই শহড় থেকে দুরে বহুদুরে।
শহড় পেড়িয়ে আরেকটা শহড় তারপর আরেকটা এভাবে যেতে যেতে একটা নদীর ধারে ছোট একটা গ্রাম পড়বে সেখানে দুজনে থাকবো।
৭.
কয়েকদিন কেটে যায়।
রন্টু মিয়াকে মেনে নিয়েছে বাড়ির লোকজন।
মেনে না নিয়ে কি করবে বয়স তো কম হয়নি এখন বিয়ে না করলে কখন করবে।
জিরু বাবাকে ৫০০ টাকার দুইটা নোট দিয়ে এসেছে রন্টু।
ইদানীং কামরুল সাহেব একটু বেশিই টেনশনে আছেন বলে মনে হচ্ছে নাজনীন বেগমের।
কথা বলেনা চুপচাপ থাকে।
এসব দেখে নাজনীন বেগম আর চুপ থাকতে পারেনা।
– কি হয়েছে তোমার?
– কিছুনা।
– তাহলে এমন চুপচাপ?
– তুমিও তো কথা বলোনা আমি কি দেয়ালের সাথে কথা বলবো? নাকি চেয়ার টেবিলের সাথে?
– আগে বলবে তো আমিতো রাগ করে বলিনি তাই বলে তুমিও বলবেনা?
– বুঝলে নাজু ছেলেমেয়েকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে। উল্টাপাল্টা কিছু করে না বসে।
– আমি বলছিলাম কি, তিন্নিকে বউ করে রেখেদি? আমাদের কাছেই থাকলো মেয়েটা।
– তুমি ভেবে বলছো? এটা হয়না বুঝলে। সমাজ বলে একটা জিনিস আছে।
– ছেলেটাকে দেখেছো? সবার আগে ছেলেমেয়ের সুখ তারপর বাকি সব।
– তুমি বুঝবেনা নাজু। বুঝলে এ কথা বলতেনা।
নাজনীন বেগম শুয়ে পড়ে।
যে বুঝার চেষ্টাও করবেনা তাকে বুঝিয়ে কি লাভ?
মাঝরাতে তিন্নি রামিমের রুমে আসে।
রামিম চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলে দেয়।
তিন্নি চোখ তুলে তাকাতে পারেনা রামিমের দিকে।
রামিম প্রশ্ন করে ইদানীং এত রাতে আমার রুমে কেনো আসিস?
তিন্নি কিছু বলেনা চুপচাপ তাকিয়ে থাকে রামিমের দিকে।
– হা করে কি দেখছিস?
– কিছুনা তোর নাকি শরীর খারাপ তাই দেখতে এলাম।
– আমার শরীর তো কবেই ভালো হয়ে গেছে।
– ওহ তাহলে হয়তো ভুল দেখেছি তুই ঘুমা।
তিন্নি রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রামিম হাত ধরে ফেলে তিন্নির।
– তিন্নি একবার বলনা ভালোবাসি আমি এই সমাজ এই দেয়াল সব নিয়ম ভেঙে ফেলবো।
তিন্নি আজও জবাব দেয়না।
হাত ছাড়িয়ে নেয়।
রামিম আবার টান মেরে বুকে জড়িয়ে নেয় তিন্নিকে।
দোতলায় এত রাতে কেউ আসেনা তাই ভয় পায়না রামিম।
ঠোঁটের নিচে আঙুল রাখে তিন্নির।
একটা হাত কানের নিচ দিয়ে গলা ছুঁয়ে যায়।
তিন্নির গরম নিঃশ্বাস টা অনেকদিন পর অনুভব করে রামিম।
তিন্নি ছাড়িয়ে নিতে পারেনা নিজেকে।
ঠোঁটের খুব কাছাকাছি এসে রামিম থেমে যায়।
কানের কাছে মুখটা নিয়ে বলে,
– তুই আমাকে বিয়ে না করলে রামিম মরে যাবে তিন্নি। তুই দেখে নিস।
তিন্নি ছলছল চোখে তাকায় রামিমের দিকে।
অন্ধকারে কেউ কাওকে দেখতে পায়না আর।
চোখের পানিও না।
এজন্যই রাত ভালোলাগে।
কাঁদলেও কেউ দেখতো পায়না।
বিষন্নতাগুলা অন্ধকারেই চাপা পড়ে থাকে।
পাত্রপক্ষ আবার দেখতে এসেছে তিন্নিকে।
কয়েকটা ছেলে ভালো ছিলো তবে তিন্নিকে বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাবে সেজন্য মানা করে দিয়েছেন কামরুল সাহেব।
মেয়েকে একনজন দেখতে না পারলে কি লাভ হলো এতদিন আগলে বড় করে?
এবারের ছেলেটা বেশ ভালো।
তিথী এসে তিন্নিকে সাজিয়ে দিয়েছে।
ছেলেটা দেখতে শুনতে বেশ ভালো, নাম কবির। বিএসসি ইন্জিনিয়ার। ভালো চাকরি করে, বেতনও ভালো। বয়সও কম। এবার আর কোনো সমস্যা নেই।
ছেলেপক্ষ দেখে চলে যায়।
কামরুল সাহেব কিছুটা খুশি।
মিষ্টি হাতে রামিমের রুমে ঢুকে।
রামিম শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলো, কামরুল সাহেব বললো,
– রামিম নে মিষ্টি খা।
রামিম সরাসরি উত্তর দেয়,
– তোমাদের খুশির খবর তোমরা মিষ্টি খাও আমার মিষ্টি খাওয়ার কোনো কারন নেই।
– রামিম তিন্নির বিয়ে ঠিক হয়েছে আশা করি কোনো ঝামেলা করবিনা তুই। যদি করিস তবে আমার মরা মুখ দেখতে হবে তোকে। পারবিতো বাবার লাশ কাধে তুলতে?
রামিম থমকে যায়। কামরুল সাহেব চলে যেতেই দরজা আটকে কাঁদতে থাকে রামিম।
এছাড়া আর কি করার আছে?
কামরুল সাহেব খুব কঠিন একটা চাল চেলেছেন।
পাকা খেলোয়াড়রা কখনো কাঁচা চাল চালেনা।
কামরুল সাহেব জানেন এবার আর রামিম কোনো সমস্যা করবেনা।
রামিমের এবার আর কিছু করার নেই।
ইট সিমেন্টের দেয়ালে এবার পাথর দিয়ে আরেকটা বাঁধন দেয়া হয়েছে। হাতুরি দিয়ে সেটা ভাঙা সম্ভবনা।
তিন্নি রুমে এসে রামিমকে হুট করেই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।
রামিম আজ শক্ত করে জড়িয়ে ধরেনা ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে।
তিন্নি অবাক চোখে দেখে রামিমকে।
– ছেলে ভালো তোকে অনেক ভালো রাখবে বিয়েটা করে নি।
তিন্নি ফুঁপিয়ে কাঁদে কথা বলতে পারেনা।
রাত হয় রুমের আলো নিভে যায়।
পাশাপাশি রুম, রুম দুটোর মাঝখানে একটি দেয়াল, লম্বা খাড়া একটি দেয়াল। দুপাশে কাঁদছে দুজন তবু কেউ বলবেনা ভালোবাসি। কান্নার পানি বরফ ঠান্ডা হলে হয়তো ওপাশের জন বুঝতে পারতো সে কাঁদছে।
চলবে?