দুপাতার পদ্ম পর্ব-০৯

0
644

#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_০৯
#Writer_Fatema_Khan

অন্ধকার দূর আকাশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ মেহেরের। চোখ দুটো ছলছল করছে। এক অজানা ভয় আকড়ে ধরছে তাকে। আবার বুঝি তার আর মাহির জীবনে আসতে চলছে কোনো নতুন ঝড়।
“তুমি না চাইলে কেউ তোমাকে জোর করবে না মেহের।”
কারো গলার শব্দে চমকে পেছনে তাকালো মেহের। সামনে থাকা ব্যক্তির কাছে তার নেত্রদ্বয়ের পানি চোখ এড়ালো না। খুব দ্রুতই কাছে চলে আসলো মেহেরের। তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলো মেহের।
“আড়ালে চোখ মুছে ফেললেই বুঝি সবকিছু সবার থেকে লুকানো যায়?”
“কেন এসেছেন এখানে আয়াত চৌধুরী? এবার আপনি খুশি তো, শেষ পর্যন্ত আপনার সাথে আমার বিয়েটা তাহলে হচ্ছে।”
“আমি কিন্তু তোমাকে জোর করছি না, আর না এখনো জোর করছি। তুমি চাইলেই বিয়েটা ভেঙে দিতে পার, এতে আমার একটুও আপত্তি থাকবে না। কারণ আমি তোমাকে ভালোবেসে পেতে চেয়েছি তোমার অমতে নয়।”
“আপনি খুব ভালো করেই জানেন আমি এখন হাজার চাইলেও মানা করতে পারব না। তাই মজা নিচ্ছেন বুঝি?”
আয়াত আয়েকটু কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় মেহেরের। মেহের দূরে যেতে চেয়েও নড়লো না। আয়াত মেহেরের দুই গালে হাত রেখে বললো,
“একবার বিশ্বাস করেই দেখো না আমাকে, তোমার ওই দুই চোখের পাতায় কখনো পানি আসতে দেব না। ওই দুপাতার পদ্ম হয়েই থাকব আমি এটা আমার বিশ্বাস।”
আর কিছু না বলে আর মেহেরের জবাবের অপেক্ষা না করে বারান্দা থেকে প্রস্থান করলো আয়াত। কারণ সে জানে মেহেরের কাছে আশানুরূপ কোনো উত্তরই পাবে না সে। মেহের আয়াতের যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকে আর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
“কখনোই আপনি আমার চোখের দুপাতার পদ্ম হয়ে উঠতে পারবেন না। কারণ আপনার প্রতি আগে যেই মায়াটা ছিল আজ থেকে সেটার সমাপ্তি ঘটেছে। আর ভালোবাসা সে তো অনেক দূর।”
সকালের কথা মনে পরতেই আবার কান্নায় ভিজে গেলো চোখ দুটি। সকালে সবাইকে টেবিলে আসতে দেখে খুশিতে সবাইকে নিজ হাতে সার্ভ করে দিল মেহের। সবাই এই বৃষ্টি মুখর দিনে খিচুড়ি, ইলিশ ভাজা, বেগুন ভাজা আর গরুর মাংস পেয়ে তো খুব খুশি। আয়াতের বাবা মেহেরকে বললো,
“মেহের মা তুই আমার কাছে এসে বস আর সার্ভ করতে হবে না। যার যা লাগবে নিজে নিয়ে নিবে। তুই আমার কাছে বসে খা।”
মেহের হাসি মুখে চাচার পাশের চেয়ারটাতে বসে পরলো। আয়াতের নজর মেহেরের পানেই৷ কাসফি তো একমনে খাচ্ছে আর সবার কথা শুনে হাসছে। সে আয়াতের দিকে তাকিয়ে দেখে আয়াত না খেয়ে প্লেটে হাত ঘুরাচ্ছে আর মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। কাসফি বোকার মতো বলে বসলো,
“আয়াত ভাইয়া এ সব কিছুই তো তোমার পছন্দের, তাহলে না খেয়ে মেহের আপুর দিকে তাকিয়ে আছো কেন? তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও না হলে ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
আয়াত তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে খাওয়াই মনোযোগী হলো। সবার সামনে লজ্জায় ফেলো দিলো। মেহেরের মা পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বলে উঠলো,
“আয়াত ভালো হয় নি খেতে নাকি শরীর খারাপ লাগছে?”
“না না চাচী আমি ঠিক আছি। আর খাবার খুব ভালো হয়েছে।”
বলেই আরেকবার মেহেরের দিকে তাকালো। মেহেরের বাবা সবাইকে বললেন,
“রাতের খাবার শেষ করে সবাই যেন বসার ঘরে উপস্থিত থাকে। সবার সাথে আমাদের কিছু জরুরি কথা আছে৷”
“কি বলবে চাচা, আমি আবার বের হব একটু রাতে আসতে দেরি হতে পারে।”
“খাবার শেষ করো সবাইকে এক সাথেই বলবো।”
আয়াত আর কথা বাড়ালো না নিজের খাবার চট জলদি শেষ করে উঠে উপরে চলে গেলো। বাকি সবার খাবারও প্রায় শেষ। সবাই খাবার টেবিল ছেড়ে যার যার ঘরে চলে যায়। মেহের, মেহেরের মা আর চাচী মিলে টেবিল গুছিয়ে নেয়। মেহেরের মা আর চাচী রান্নার কাজ শুরু করেন৷ বৃষ্টি থেমে গেছে সেই অনেক আগেই। আয়াতের মা মেহেরকে বললো,
“মেহের যা তো ছাদে ভেজা কাপড় গুলো একটু ছড়িয়ে দিয়ে আয়। কাল রাতে ধুয়ে দিয়েছিলাম, রাতে তো শুকায় নি। এখন বৃষ্টি কমে রোদ উঠেছে এখন একটু দিয়ে আয়।”
“আচ্ছা চাচী।”
“আর শোন। কাসফিকে নিয়ে যাইস অনেকগুলো কাপড় তো।”
“ঠিক আছে।”
মেহের চাচীর ঘর থেকে সব কাপড় একটা বালতিতে করে ছাদের উদ্দেশ্যে যেতে নিলে কাসফিকে ডাকার জন্য কাসফির ঘরে উঁকি দেয়। দেখে কাসফি ঘুমাচ্ছে। তাই আর কাসফিকে না ডেকে নিজেই ছাদে চলে গেলো। ছাদের দরজা খোলা দেখে আবার অবাক হলো মেহের। কারণ ছাদের দরজা কখনো খোলা থাকে না, সবসময় তালা লাগানো থাকে। মেহের ছাদে ঢুকে এক এক করে কাপড় দড়িতে ছড়িয়ে দিতে লাগলো। হঠাৎ মেহেরের নজরে এলো ছাদের ঘরটায় আলো জ্বলছে। মেহের উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো৷ দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই মেহের বুঝতে পারলো দরজা ভেতর থেকে খোলা আছে। মেহের ছাদের ঘরটাতে ঢুকে উঁকি দিতে লাগলো। কিন্তু ভেতরে ঢুকে কাউকেই খুঁজে পায় না মেহের।
“এই ঘরে আবার কে এলো? এখানে তো আয়াত থাকত আগে। আর ঘরটাও পরিষ্কার করে গুছিয়ে দেওয়া হয়েছে! কিন্তু আয়াতের ঘরে থাকে কে?”
“আয়াতের ঘরে এখনো আয়াতই থাকে৷”
পেছনে ফিরে দেখে আয়াত সবে মাত্র গোসল সেড়ে বের হয়েছে৷ চুল থেকে টপটপ পানি পরছে৷ পরনে খালি একটা শর্ট প্যান্ট আর হাতে টাওয়েল চুল মুছছে। মেহের কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরে আয়াতকে এভাবে দেখে৷ আয়াত মেহেরের দিকে এগিয়ে আসে অনেকটাই৷ মেহের পিছিয়ে যায় কিছুটা।
“তা তুমি হঠাৎ এখানে? কোনো কাজ ছিল নাকি?”
“না মানে আমি তো ছাদে কাপড় দিতে এসেছিলাম, দেখলাম এই ঘরে আলো জ্বলছে তাই দেখতে এলাম এখানে কে আছে?”
“ওহ, এটাই স্বাভাবিক। আমি যে দুই দিন ধরে ছাদে থাকি তার খবর তুমি মাত্র পেলে তাহলে।”
“তা তুই তো এবার নিজের ঘরেই থাকবি বললি, তাহলে এখানে আসার কারণ কি?”
আয়াত আরও কিছুটা এগিয়ে বলে,
“যদি বলি যাকে দেখার জন্য নিচে সেই আমাকে দেখতে চায় না তাই ছাদের ঘরে চলে আসা।”
মেহের এদিক ওদিক তাকাতে থাকে, কি বলবে বুঝতে পারে না। আয়াত তার অবস্থা বুঝে বলে,
“আচ্ছা মেহের এসেই যখন গেছো একটা কাজ করে দিবা আমার।”
“কি কাজ?”
“আমি আসলে একটু বের হবো, লেইট হচ্ছে। তাই তুমি যদি আমার শার্টটা আয়রন করে দিতে তাহলে তাড়াতাড়ি হত।”
“এই সকাল সকাল কই যাবি তুই তাও শুক্রবারে?”
“আজ শুক্রবার বলেই তাড়াতাড়ি বাইরে যাচ্ছি।”
“মানে!”
“মানে অনেক সহজ। আজ বাসায় সবাই থাকবে তাই আমি চাই না আমার জন্য কেউ বিব্রতবোধ করুক। তাই ভাবলাম বাইরে ঘুরে বেড়ানোই ঠিক হবে তাই না।”
মেহের আর কথা বাড়ালো না। খাটের উপর থাকা শার্ট নিয়ে আয়রন করতে লাগলো৷ আয়াত আয়নার সামনে গিয়ে নিজের চুল ভালো করে মুছে নিলো। শার্ট আয়রন করা হয়ে গেলে মেহের বলে,
“আয়াত।”
“হুম বলো।”
“শার্ট আয়রন হয়ে গেছে, আমি নিচে যাই।”
“সকালের খাবার খুব মজার ছিলো, থ্যাঙ্কিউ।”
“সকালে বৃষ্টি ছিলো তাই ভাবলাম এসব রান্না করি এই আর কি। তোর ভালো লেগেছে শুনে ভালো লাগলো।”
“সকালে তোমাকেও অনেক ভালো লাগছিলো একদম মায়াবতী। ভেজা চুল, স্নিগ্ধ তোমার চাউনি, নিষ্পাপ তোমার মুখ। সব মিলিয়ে মায়াবতী।”
“আমি আসছি আয়াত।”
বলেই আর এক মিনিটও দাড়ালো না মেহের। মেহেরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে হালকা হাসলো আয়াত।
“সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে তুমি কখনো আমার হবে না। আমার ভালোবাসা কখনোই তোমার বোধগম্য হবে না। যদি তুমি বুঝতে তোমার প্রতিটা চাউনি আমার বুকে কি ঝড় তোলে তাহলে হয়ত কিছুটা আন্দাজ করতে পারতে৷ আমার ভালোবাসায় কোনো খাত নেই, আছে শুধু তোমার জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা। যা কখনো ফুরাবার নয়।”
আয়াত আয়রন করা শার্টটা গায়ে জড়িয়ে তৈরি হয়ে বের হয়ে গেলো। নিচে এসে দেখে মেহের মাহিকে খাওয়ানোতে ব্যস্ত৷ আয়াত এগিয়ে মাহিকে কোলে তুলে নিলো আর বললো,
“আমার সোনা টা বলো তো কি নিয়ে আসবে মামা তোমার জন্য?”
মাহি কিছুই না বলে খিলখিল হাসি দিয়ে উঠলো। মাহির হাসি দেখে আয়াতও হাসলো। তারপর বললো,
“মামা আসার পথে এত্তগুলা চকলেট নিয়ে আসব ঠিক আছে।”
মাহি মাথা নেড়ে হাত তালি দিতে থাকে। যার মানে সে খুব খুশি।
“কিন্তু এই পেত্নীটাকে একটাও দেওয়া চলবে না।”
কাসফির মাথায় একটা চাটি মেরে।
“আহ্! ভাইয়া লাগছে।”
“পিচ্চির আবার লাগে নাকি? আচ্ছা মাহি মামা তাহলে যাই ঠিক আছে।”
“ঠিক আছে।”
মাহিকে আবার সোফায় রেখে আয়াত যেতে নিলে আয়াতের বাবা ডেকে বলেন,
“এত সকাল কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
“কিছু কাজ আছে আমার তাই যাচ্ছি।”
“রাতে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসো, সবার সাথে কিছু কথা আছে আমাদের।”
“ঠিক আছে। যাচ্ছি তাহলে।”
মেহেরের দিকে একপলক তাকালো আয়াত। তারপর বের হয়ে গেলো বাড়ি থেকে।

চলবে,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে