দখিনের জানলা পর্ব-০৭

0
499

#দখিনের_জানলা (পর্ব-৭)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

১৩.
আব্রাহাম একা একা রাস্তায় হাঁটছে। কলোনীর এই শান্তিপূর্ণ, নীরব রাস্তাটা তার ভীষণ প্রিয়। রাতে হাঁটার সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ কিংবা তারা দেখতে তার ভালো লাগে। আজ সে একবারও আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ কিংবা তারা দেখার চেষ্টা করল না। তার মাথায় এখন চমচম ঘুরছে। সে নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না কি কারণে চমচমকে সে এমন শা’স্তি দিয়ে এসেছে। তার কাজটা একদমই শোভন ছিল না। সে তখন বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারছে। কাজটা কেন করেছে, কি কারণে করেছে ভাবতেই তার রা’গে মাথার চুল গুলো টে’নে ছিঁ’ড়তে ইচ্ছে করছে। এমন বোকা কাজ সে কীভাবে করতে পারল এটাই সে ভাবতে পারছে না। নিজের কাছেই নিজেকে কেমন ছোট মনে হচ্ছে। চমচম তাকে কি খুব বা’জে ছেলে মনে করবে? আব্রাহামের কাছে চমচম তো সেই ছয় বছর বয়সী বাচ্চাটার মতোই এখনও। চুমু তো খাওয়াই যায়! আগে তো কত চুমু খেয়েছে চমচমের ফোলা ফোলা গাল দুটোতে। এখন অবশ্য গাল গুলো আগের মতো ফোলা নয়। তবে তখন চুমু খাওয়ার পর তো এমন অনুভূতি হতো না। এখন কেন হচ্ছে? হঠাৎ করেই তার মনে পড়ল, চমচম এখন আর ছয় বছরের শিশু নেই। চমচম এখন অষ্টাদশী কন্যা। আর কিছুদিন পর সে যুবতী হবে। কথাটা ভাবতেই কেন যেন আব্রাহামের গা কা’টা দিয়ে উঠল। তার ভীষণ অ’প’রা’ধ’বোধ হচ্ছে। মস্তবড় একখানা ভুল সে করে ফেলেছে। আব্রাহাম খেয়াল করল তার কপাল বেয়ে এক ফোঁটা ঘাম গড়িয়ে পড়ল। উফ! এতটা অস্থির অস্থির লাগছে কেন সে জানে না। আব্রাহাম বেশ কিছু উল্টাপাল্টা ভাবল। চমচম বড় হচ্ছে! চমচম আর ছোট্ট নেই!

রাতে বাড়ি ফেরার পর তার ভীষণ অসুস্থ বোধ হচ্ছিল। বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার আধা ঘন্টা পরেই তার গা কাঁ’পিয়ে জ্বর এলো! ভীষণ জ্বর! এই জ্বরের কারণটাও ভীষণ বিশ্রী মনে হলো তার।

—————————–

সকাল সকাল চমচম কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ছিল, তখন তার মা তাকে ডেকে হাতে একটা বাটি ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-‘তোর নিগার আন্টিদের বাসায় এটা একটু দিয়ে আয় না!’

চমচম বেশ বি’র’ক্ত হলো কথাটা শুনে। বলল,

-‘পারব না। কলেজের জন্য এমনিতেই অনেক লেইট হয়ে গেছে।’

ফাতেমা বেগম কথাটা শুনে ধ’ম’কে বললেন,

-‘লেইট হইছে মানে কী? আমারে বুঝ দেস তুই? তোর ক্লাস দশটায়। তাই নয়টা বাজার আগেই দৌড়াস কেন? ঘুরাঘুরি, ছোটাছুটি তো ভালোই করতে পারস। কাজ দিলে একটা কাজ করতে পারস না! ব’দ’মা’য়ে’শ কোথাকার!’

চমচম হার মেনে নিল। মায়ের কথা থেকে বাঁচতেই বলল,

-‘এটাতে কী আছে?’

-‘স্যুপ। আব্রাহামের জন্য। ভাবী বলল আব্রাহামটার খুব জ্বর। কিছুই মুখে তুলছে না। ভাবলাম ওর তো আমার হাতের বানানো এই স্যুপটা পছন্দ। গরম গরম খেলে ভালো লাগতে পারে। আহারে! কালকেও তো সুস্থ দেখলাম ছেলেটাকে। না জানি কোন পরীর খ’প্পড়ে পড়ছে! সুন্দর ছেলেদের পেছনে তো মেয়ে জ্বী’ন লাগে। সেগুলোরে পরী বলে। আমি একেবারে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি ছেলেটা বারবার এত অসুস্থ হয় এই কারণেই! এর আগে একদিন ছাদ থেকে শার্টের হাতা কে কে’টে নিয়ে গেছিল না! কি জানি কোন কা’লো’জা’দু যে করল!’

চমচমের মায়ের কথা শুনঃ প্রচুর রা’গ হয়। কিন্তু দাঁতে দাঁতে চেপে সেটা স’হ্যও করে যায়। পরী তো দূরের কথা! পে’ত্নীও ওই খবিশকে পছন্দ করবেনা। সে বাটিটা হাতে নিয়ে বের হওয়ার সময় তার মা আবারও বললেন,

-‘এই শোন! যাই বাটি হাতে ধরায়া চলে আসবি না। দেখা করিস ছেলেটার সাথে। অসুস্থ মানুষের খবর নেওয়া, দেখতে যাওয়া সুন্নত।’

চমচম জবাব দিল না। গটগট শব্দে পা ফেলে বাসা থেকে বের হয়।

১৪.
আব্রাহামদের বাসায় এসে চমচম সবার আগে আনিকার দেখা পায়। চমচমকে দেখেই সে মৃদু হাসে। এগিয়ে এসে বলে,

-‘কীরে! কি খবর?’

-‘কোন খবর নেই। তোমার ভাই এটার দুইদিন পরপর কীসের অসুখ হয়? ধুর! শান্তি মতো কলেজ যাচ্ছিলাম। হাতে এটা ধরিয়ে দিল। ধরো নাও। আমি গেলাম!’

-‘উহু। এসব আমাকে দিস না। মায়ের কাছে দিয়ে আয়।’

-‘আন্টি কোথায়?’

-‘ভাইয়ার রুমে।’

-‘উফ! এখন সেখানে যাব?’

-‘গেলে কী হবে?’

-‘ধ্যাত!’

চমচম সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে উঠল। আব্রাহামের রুমের দরজায় এসে দেখল নিগার খানম আব্রাহামের গা মুছিয়ে দিচ্ছিল। আব্রাহাম খালি গায়ে। চমচমের একটু অ’স্ব’স্তি লাগছিল। সে ভেবেছিল চলে আসবে। কিন্তু তাকে দেখেই নিগার খানম বলে উঠলেন,

-‘চমচম এসেছিস!’

মেকি হেসে চমচম রুমে ঢুকল। নিগার খানম কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,

-‘দ্যাখ না ছেলেটার কত জ্বর! সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। এখন এত অসুস্থ হলে হবে? কি হয়েছে হুট করে আমি সুস্থ ছেলেটা সন্ধ্যায়ও ঠিক দেখলাম। রাতে এসে দেখি জ্বর! এখন একটু কমেছে! বিশ্বাস করবি না রাতে কাঁ’প’ছিল।’

চমচম আব্রাহামের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই দেখল আব্রাহাম তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে চোখ সরিয়ে নিল। স্যুপটা নিগার খানমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-‘মা পাঠিয়েছে। আব্রাহাম ভাইয়ার জন্য।’

-‘বেশ ভালো করেছে। তোর মা টা খুবই কাজের। ওহ চামচ তো নেই! খাবে কী করে?’

-‘আমি এনে দিচ্ছি!’

-‘না না। তুই একটু বস এখানে। আমি যাই। এমনিতেও একটু রান্নাঘরে যেতে হবে। তুই থাক। দশটা মিনিট বস।’

-‘স্যুপ ঠান্ডা থাকবে এতক্ষণ!’

-‘আচ্ছা চামচ শারমিনকে দিয়ে পাঠাবো।’

-‘আমি কেন বসব? আমার কলেজ আছে তো!’

-‘থাক না একটু। অসুস্থ মানুষ। কেউ পাশে থাকলে ভালো লাগবে ওর।’

চমচমের বি’র’ক্তি এবার চরমে উঠল। কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। এমনিতেও অ’স’ভ্যটা কালকে তার সাথে যে কাজটা করেছিল সেটা সে ভুলতে পারছে না। এখন আবার এর সামনে বসে থাকবে? সে বলল,

-‘তোমার ছেলেকে কাপড় পরাও।’

নিগার খানম হেসে ফেললেন। বললেন,

-‘ও ছেলে মানুষ। সমস্যা নেই তো।’

-‘আছে। আমার বি’র’ক্ত লাগছে।’

আব্রাহাম নিজেই গায়ে টি-শার্ট জড়ালো। নিগার খানম চলে যেতেই চমচম দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। আব্রাহামের শরীরটা দুর্বল। নড়তে পারছে না। চমচমকে সে তার জায়গা থেকে দেখতে পেল না। তাই ডাক দিল,

-‘এই চমচম!’

চমচম দরজা থেকেই জবাব দিল,
-‘কী?’

-‘ওইখানে কি করছিস? এখানে এসে বস।’

-‘কেন? পারব না আমি!’

-‘তুই তো খুব বে’য়া’দ’ব।’

-‘নতুন কথা?’

-‘আয় না! একটু পানির গ্লাসটা দে। এমন করছিস কেন?’

চমচম ভাবল সত্যিই পানির তেষ্টা পেয়েছে। তাই সে কাছে এলো। পানির গ্লাস এগিয়ে দিলে আব্রাহাম একটু খায়। চমচম তা দেখে রে’গে বলে,

-‘এই অল্প একটু পানি খেতে ডেকেছ? তা এতুটুকু না খেলেই হতো!’

আব্রাহাম হাসল। চমচমকে বলল,

-‘শোন তো!’

-‘কী!’

-‘না থাক। কিছু না।’

চমচম কটমট দৃষ্টিতে তাকালো আব্রাহামের দিকে। বোধ হয় খেয়েই ফেলবে তাকে। তখন রুমে শারমিন এলো চামচ নিয়ে। চমচমকে দিয়ে বলল,

-‘আফা! আম্মা বলছে একটু ভাইজানরে খাওয়াই দিতে। আম্মা রান্না চাপাইছে। আসতে পারতেছে না!’

চমচম ভীষণ অবাক হলো। বলল,

-‘আমার কলেজে যেতে হবে! তোমরা কি বুঝছ না?’

-‘আনিকা আফাও বাইর হইব। সেও খাইতেছে। বলছে একসাথে যাইব। বেশি না দশটা মিনিট লাগব। ভাইজান খাইতে চায় না এমনেও। একটু মুখে দিব। বেশি সময় তো লাগব না।’

শারমিন চলে গেল। রা’গে চমচমের হাত পা কাঁ’প’ছে। ধুর! এমন হবে জানলে সে আসত না। কখনোই না!

সে বাটি নিয়ে আব্রাহামের পাশে গিয়ে বসল। আব্রাহামকে দেখল মিটিমিটি হাসছে। ব’জ্জা’ত ছেলে একটা! কাঁধের ব্যাগটা এক পাশে রেখে চামচে করে স্যুপ নিয়ে আব্রাহামের মুখের সামনে ধরল। বলল,

-‘নাও। গেলো।’

আব্রাহাম চমচমের দিকেই তাকিয়ে ছিল। চমচমের কথা শুনে ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
-‘গরম তো।’

চমচম আব্রাহামের দৃষ্টি লক্ষ্য করল না। সে হাতে ধরে রাখা চামচের দিকে চেয়ে বলল,

-‘আহারে আমার গরম রে! এটা কি এমন গরম? এর থেকেও কত গরম খাবার খাও আমি দেখি নাই নাকি?’

আব্রাহাম হঠাৎ করেই বেশ ভারী স্বরে বলল,

-‘প্রচণ্ড গরম। ঠু মাচ্ হট!’

-‘কচু মাচ্ হট! নাও!’

চমচম ফুঁ দিয়ে দুই তিন চামচ খাওয়ানোর পর হঠাৎ করেই খেয়াল করল আব্রাহাম চোখে অন্যরকম দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকাচ্ছে। উহু! মুখের দিকে নয়। সে আব্রাহামের দৃষ্টি অনুসরণ করতেই চমকে উঠল। হাত থেকে বাটিটা শব্দ করে বেড সাইড টেবিলে রেখে নিজের ক্রস বেল্টের উপর হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মুখ দিয়ে তার আপনাআপনি বের হয়ে এলো,

-‘ছিঃ’

আব্রাহামও আকস্মিক এমন ভাবে ধরা খেয়ে থতমত খেয়ে গেল। চমচমকে কিছু বলবে তার আগেই ব্যাগটা তুলে চমচম বের হয়ে গেল। তার ভীষণ খা’রা’প লাগছে। এমন বা’জে রকম খা’রা’প লাগার অনুভূতি তার আর কখনো হয়নি। এই প্রথম!

#চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে