তোমায় ছেড়ে যাবো কোথায় পর্ব-০৫

0
663

#তোমায়_ছেড়ে_যাবো_কোথায়?
লেখাঃ মুনিরা সুলতানা।
পর্বঃ ৫ ।

————-*
সেলফোনটা হঠাৎ বেজে উঠতে আমি আমার ভাবন ঘর থেকে বেড়িয়ে এলাম। হাত ব্যাগ থেকে সেলফোনটা বের করে দেখলাম আব্বা কল করেছে। কল রিসিভ করে কানে ধরলাম। সাথে সাথেই আব্বার উত্তেজিত কন্ঠস্বরের ধাক্কায় আমি হকচকিয়ে গেলাম। আব্বা বলছিলেন,

” সেই থেকে ফোন করে যাচ্ছি ফোন ধরনা কেন? একা জার্নি করছ। আমাদের টেনশন হয় বোঝা উচিত তোমার।”

কথা শেষ করে আব্বা থামলেন। খুব দ্রুত গতিতে বেশ উত্তেজিত হয়ে কথা বলায় তিনি হাঁপিয়ে উঠেছেন। আমি ফোনেই তা শুনতে পাচ্ছি। আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম,

” শান্ত হও আব্বা। জানোই তো ট্রেনে কেমন শব্দ হয়। আর মোবাইলটা ব্যাগে থাকায় প্রথমে বুঝতে পারিনাই। সরি আব্বা। সব ঠিক আছে। ”

আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, ” এখন কোথায়? ”

আমি একটু জানালা দিয়ে বাইরে নজর বুলিয়ে বললাম,
” যমুনা সেতু পার হচ্ছে। ”

” যাক আর বেশি দেরি নেই। শোন জয়দেবপুর পৌঁছে তোমার মামাকে ফোন দেবে। ঠিক আছে? তাহলে সময় মত সে স্টেশনে থাকতে পারবে। ”

” তুমি একদম চিন্তা করনা আব্বা। আমি সময় মত মামার সাথে যোগাযোগ করে নিব।”

” চিন্তা হবেনা? তুমি ঐ বাড়িতে পা রাখা না পর্যন্ত আমি টেনশন মুক্ত হতে পারবোনা মা। একা পাঠিয়ে আমারই ভুল হয়েছে। কেন যে জোর করে গেলাম না? এখন এখানে বসে টেনশনে ভোগা ছাড়া কিছুই করার নেই আর।”

” তুমি শুধু শুধুই টেনশনে ভুগছ। আমার কোন প্রবলেম হয়নাই তো। আর ওখানে মামা থাকবে। তাহলে কেন অযথা এমন অস্থির হচ্ছ বলোতো? ”

আব্বা নরম গলায় বললেন, ” দুনিয়ার হালচাল যে সুবিধার নয় রে মা। এখানে প্রতি পদে পদে বিপদ ওৎ পেতে থাকে। তুমি তোমার মামার জন্য অপেক্ষা করবে। ওকে তোমার সিট নাম্বার, বগি নাম্বার দেয়া আছে। ও তোমাকে ঠিক খুঁজে নিবে। নিজে নিজে এদিক সেদিক চলে যাবেনা। ঠিক আছে?”

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। বাবারা বোধহয় এমনই হয় তাদের সন্তানদের ব্যাপারে। নিশ্চয়ই আজ সারাদিন ঠিক মত কোন কিছুই করেননি। ভালো করে খাবারও খায়নি বোধহয়। আব্বার ডায়াবেটিস আছে। এভাবে অস্থির হয়ে টেনশনে ভুগলে শরীর খারাপ করবে তো। আমি আব্বার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লাম,

” আব্বা তুমি ঠিক মত খেয়েছ তো? ”

” হ্যারে মা এর মধ্যে আমার ব্রেকফাস্ট, স্ন্যাকস সব খাওয়া হয়ে গেছে। তুমি কিছু খেয়েছ মামনী? অতো সকালে তুমি তো ভালো করে নাস্তা করে যাওনি।”

” না আব্বা। খিদে পায়নি। তুমি চিন্তা করনা। আম্মু খাবার যা দিয়েছে। আমি খেয়ে নিব। আর অযথা চিন্তা করনা। নইলে তোমার শরীর খারাপ করবে। এখন রাখছি। ”

সেলফোনটা ব্যাগে রেখে দিয়ে একবার চারপাশে চোখ বুলালাম। আশেপাশের অনেকেই তাদের সাথে আনা খাবার বের করে খেতে ব্যাস্ত। বুফেকারের লোক খাবার ট্রে হাতে আসা যাওয়া করছে। আমি যখন ফোনে কথা বলছিলাম তখন আমার কাছেও এসেছিল। আমি মাথা নাড়িয়ে না করে দিয়েছিলাম। এখন এক কাপ চা অর্ডার করলাম। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম যমুনা সেতু প্রায় শেষের দিকে। শীত ও বসন্তের শুষ্ক মৌসুমের পরে যমুনা নদীর পানি প্রায় শুকিয়ে চর বেরিয়ে আছে। আবার ফাকে ফাঁকে খানাখন্দের মত ছোট ছোট জলাশয়ও দেখা যাচ্ছে। কয়েক মাসে খালি চরের উপর ছিটে ফোঁটা হয়ে বেশ কিছু ঘাস ও আগাছায় ভরে উঠেছে। আমি সামনে ঝুকে পায়ের কাছে রাখা ছোট ব্যাগটা থেকে পানির বোতল এবং খাবারের কন্টেইনার বের করে নিলাম।

দেড়টার জায়গায় কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছাতে প্রায় দুটো বেজে গেলো। আমাদের ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকতেই মামাকে দেখতে পেয়ে আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। আমি সত্যি খুব নার্ভাস ছিলাম। রাজশাহীতে একা চলাফেরা করা কোন ব্যাপারনা। সেখানে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করা অনেক সহজ। তাছাড়া সবকিছু চেনা। কিন্তু এখানে ভয়ানক ব্যস্ত এই শহরের রাস্তাঘাটের চলন্ত গাড়িগুলোকে দেখলেই কেমন ভয় ভয় করে। পথঘাট অচেনা। আমিতো ভিষণ ঘাবড়ে যাই।

সবাই একএক করে যার যার লাগেজ নিয়ে নেমে যাচ্ছে। আমিও উঠে দাঁড়িয়ে নিজের লাগেজ দুটো নামিয়ে রাখতেই মামার গলা শুনে সেদিকে ফিরে তাকালাম।

” এতো ভারী লাগেজ তুই নামিয়ে ফেললি? আরেকটু অপেক্ষা করতে পারলিনা? ”

আমি সালাম দিয়ে বললাম, ” এমন কিছু ভারি না মামা। ”

মামা সালামের জবাব দিয়ে বললেন, ” আচ্ছা ঠিক আছে।”

বলেই লাগেজ গুলো তুলে নিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমিও মামার পিছু পিছু ট্রেন থেকে নামলাম। মামা একটা সিএনজি ভাড়া নিলেন। লাগেজ পত্র উঠিয়ে আমরাও উঠে বসলাম। সিএনজি চলতে শুরু করলে মামা বললেন,

” আগে আমাদের বাসায় চল। ওখানে খাওয়া দাওয়া করে ফ্রেশ হয়ে তারপর নাহয় ও বাড়িতে গেলি। ”

আমি একমুহূর্তের জন্য দ্বিধায় ভুগলাম। অবশ্য যে কোন ব্যাপারে আমি চট করে সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা। সব ক্ষেত্রেই দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে থাকি। হতবিহ্বল হয়ে মামার দিকে চেয়ে চিন্তা করলাম। তারপর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে বললাম,

” আজ নয় মামা। আমার শাশুড়ি বারবার তাড়া দিচ্ছিলেন। সরাসরি ওখানেই যাই। এখন তো এখানেই থাকব। আপনাদের বাসায় মন চাইলেই যাওয়া যাবে। কিন্তু আজ না”

মামা হতাশ হয়ে বললেন, ” ঠিক আছে। তোর যেমন ইচ্ছে। ”

সিএনজি চলছে ব্যাস্ততম নগরীর জ্যাম ও ধুলো-ধোঁয়ায় ভরা রাস্তা ধরে। চারপাশে কেবল অবিরাম ছুটে চলেছে ব্যাস্ত সমস্ত নানান বয়সের নানান পেশার মানুষজনেরা। এই ছুটে চলার কোথায় শুরু আর কোথায় এর শেষ কেউ জানেনা। আমি একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে এই সবই দেখছি।

বাড়ির সামনে পৌঁছে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমার চোখের সামনে এই বাড়িতে প্রথম আসার দিনটি ভেসে উঠলো। সত্যিই সেই দিন গুলো কখনও ভোলার নয়। আমি এক ধ্যানে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছি। মামা সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

” কিরে এভাবে কি দেখছিস? ভিতরে চল।”

লাগেজ পত্র নামিয়ে দিয়ে সিএনজি চলে গেছে। আমি কিছু বললাম না। মামার সাথে গেটের ভিতরে প্রবেশ করলাম। দারোয়ান লাগেজ গুলো নিয়ে ভিতরে গেল। আমরাও উপরে উঠে গেলাম।

তিনটা বাজে। বাসায় শাশুড়ি মা ছাড়া কেউ নেই এখন। বুয়া দরজা খুলেছে। শাশুড়ি মা ডাইনিং রুমেই দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ আমাদের দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছেন তিনি। অবাক হওয়ারই কথা। কোন খবর না দিয়ে হুট করে এভাবে চলে এসেছি। এমন প্রতিক্রিয়াই স্বাভাবিক।

তিনি বললেন, ” একটা খবর দিতে পারতে। স্টেশনে গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম। আর কার সাথে এসেছে ও? আপনি গিয়েছিলেন রাজশাহীতে? ” শেষ প্রশ্নটা মামার উদ্দেশ্যে।

মামা জবাব দিলেন, ” না সেই সুযোগ দিয়েছে নাকি? গতকাল রাতে আমাকে জানিয়েছে, হীবা সকালে রওনা দিচ্ছে। আমি যেন স্টেশনে থাকি। ”

” এভাবে একা একা কেন এলে বলতো? একদম ঠিক করনি কাজটা। ঠিক আছে জার্নি করে এসেছ যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। দুপুরে খাওয়া হয়নি তো? খাওয়া দাওয়া করে নাও। ” মামার দিকে ঘুরে বললেন, ” আপনিও বসুন খাওয়া দাওয়া করে তারপর যাবেন। ”

মামা বাঁধা দিয়ে বললেন, ” আমি বাসা থেকে খেয়ে বেরিয়ছিলাম। এখন একবার অফিসে যেতে হবে। আমি এখনি বেরোবো। ”

” সে কি তাই হয় নাকি? এভাবে খালি মুখে চলে যবেন? ”

মামা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তখনই বুয়া শরবতের গ্লাস সহ ট্রে হাতে নিয়ে এল। ট্রেটা ডাইনিং টেবিলে নামিয়ে রাখতেই শাশুড়ি মা একটা গ্লাস তুলে মামার দিকে এগিয়ে দিলেন,

” অন্তত শরবতটা খেয়ে যান। নাও মা তুমিও খাও। ”

” জি। ” একটা গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে কামরার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে শুধালাম, ” বাসায় কেউ নেই বোধহয়? ”

শাশুড়ী মা বললেন, ” না। একজন অফিসে আর বাকি দুজন ভার্সিটিতে। তিয়ানা একটু পরেই চলে আসবে। ”

আমি মৃদু হেসে গ্লাসে চুমুক দিলাম। মামা চলে গেলেন। আমিও গোসল করে কাপড় পাল্টে ব্রাউন ও মেরুনের মিশেলে একটা সুতির সালোয়ার কামিজ পরে নিলাম। শাশুড়ি মা বোধহয় বিশ্রাম নিচ্ছেন। আমি চুপচাপ খাওয়া দাওয়া সেরে কামরায় এসে নামাজ আদায় করলাম। তারপর বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। আমি বাসায় ফোন করে কথা বললাম। তারপর একসময় ক্লান্ত শ্রান্ত চোখ দুটোয় কখন যেন ঘুমে জড়িয়ে ধরল টেরই পায়নি।

সন্ধায় তিয়ানা আরমান ও শাশুরি মায়ের সাথে চা নাস্তা খেতে খেতে কিছুক্ষণ গল্প গুজব করে বেশ কেটে গেল। এরপরে ভাই বোন দুজন যার যার কামরায় চলে গেল পড়াশোনা আছে বলে। আমি ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখলাম কতক্ষণ। কামরান এখনও আসেনি। আমি এবারে একটু বিচলিত বোধ করছি। মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে কি করব, কি বলব? ভিষন অস্বস্তি ও সংকোচ লাগছে। সেই সাথে একটু লজ্জাও। বিয়ের পরে তিন মাস হয়ে গেছে। কিন্তু এই মানুষটার সাথে আমার মনের সম্পর্কের মধ্যে যোজন যোজন দুরত্ব। স্বাভাবিক ভাবে এতদিনে আর দশটা দম্পত্তির সম্পর্কের মধ্যে সুন্দর একটা বোঝাপড়া হয়ে যায়। সম্পর্কের মধ্যে একটা রসায়ন তৈরি হয়ে যায়। শারীরিক ভাবে দুরে থাকলেও ডিজিটাল যুগের কল্যানে যোগাযোগ থেকে মানসিক ভাবে পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসা কোন ব্যাপারই না। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে সবকিছুই ব্যাতিক্রম। কামরান এই তিন মাসে একবারও ফোন করেনি। তবে ওর সাথে মাত্র তিনবার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। প্রথমে আমি যাওয়ার পরে পৌছানোর খবর দিতে কামরানের কাছে কল দিয়েছিলাম। তখন বোধহয় দুই মিনিট কথা হয়েছিল। ব্যাস। এরপর আমার শাশুড়ি মায়ের সাথে দাদি এবং আম্মার প্রায় কথা হতো। কখনো শাশুড়ি মা কল করতেন, কখনও আমার আম্মারা কল করতেন। এমনই দুদিন উনাদের কথার ফাকে কেউ হয়তো ফোনটা কামরানের হাতে ধরিয়ে দেয়ায় বাধ্য হয়েই আমার সাথে ঐটুকু কথা বলেছিল। তাও কি বলেছিল? আমার কিছু লাগবে? টাকা পয়শা দরকার হলে বলতে বলেছিল। ব্যাস এই। আমার মেজাজটা নিয়ন্ত্রণে রাখা দায় হয়ে যেত। কেনরে বাবা আমি কি পানিতে পরে ছিলাম? স্বামীর সাথে কি স্ত্রীর কেবল টাকা পয়শা ও প্রয়োজনের সম্পর্ক? আমার খুব কষ্ট হত। আমার এক বান্ধবীর বছর খানেক আগে বিয়ে হয়েছিল। তাদের দুজনের সম্পর্ক দেখে সত্যিই বিয়ে নিয়ে একটা ফ্যান্টাসি মনের মাঝে দানা বেঁধেছিলা। কত স্বপ্ন ছিল বিয়ে সংসার এসব নিয়ে। অথচ আমার জীবনে কেমন হঠাৎই ঝড়ের বেগে সেই দিনগুলো চলে এল। বুঝতেই পারলামনা কি হয়ে গেল। যখন চোখ মেলে তাকালাম সবকিছুকে কেমন দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছিল। শুধুমাত্র এইসব তীক্ত অভিজ্ঞতার কারনে এখানে আসার এতটুকু আগ্রহ ছিলনা আমার। এখনো এই সম্পর্কে গভীর ভাবে জড়িয়ে যাইনি। তাই নিজেকে সামলে নেয়া যাবে। কিন্তু একবার মনেপ্রাণে জড়িয়ে গেলে তখনকি আর নিজেকে সামলে নিতে পারবো? কিন্তু আমার দাদি বারবার করে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। বিয়ে কোন ছেলে খেলা নয়। একবার যখন বিয়েটা হয়েই গেছে তখন সেটাকে সফল করার দায়িত্ব আমাদের। চেষ্টা না করেই হাল ছেড়ে দিব কেন? আমি অজানা সময়গুলো নিয়ে অযথাই ভয় পাচ্ছি বলে এমন বোকামি করছি। আসলেই কি তাই? তাই যদি হতো তাহলে কামরানের দিক থেকে কোন আগ্রহ দেখিনা কেন? চোখের সামনেই অনেকেরই তো বিয়ে হতে দেখেছি। কই তাদের বিয়ের পরের সময়গুলো তো আমাদের মতো ছিলনা। কত মধুর ছিল তাদের ঐ সময়গুলো। তাই তো আমারও কতো স্বপ্ন ছিল বিয়ে সংসার নিয়ে। কিন্তু এখন..? কিন্তু দাদি আমাকেই দোষ দিচ্ছেন। আমার মধ্যেই নিশ্চয়ই কোন ঘাটতি আছে। তাই আমার স্ত্রী হিসেবে করনীয় নিয়ে নানাভাবে পরামর্শ দিয়েছেন। কামরান ও টিউলিপকে নিয়ে আমার যে সন্দেহ সেটাও বলা সম্ভব নয় কারন যা সম্পর্কে নিশ্চিত নই শুধু সন্দেহের বসে কিছু বলাও ঠিক নয়। আমার এখন অনেকটা জেদ চেপে গেছে। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। হয়তো আমারও ভাবনায় ভুল থাকতে পারে। পালিয়ে কোন সমস্যার সমাধান হয়না। এখানে থেকেই যাচাই করে সমাধান করতে হবে। জানিনা ভাগ্যে কি আছে? তবে এটাও বিশ্বাস করি আমি, আল্লাহ তায়ালা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। হয়তো আমার জন্য সামনে ভালো কিছুই অপেক্ষা করছে। আমাকে শুধু ধৈর্য্য ধরতে হবে।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালাম। নিজের কামরায় গিয়ে অজু করে এশার নামাজ আদায় করে নিলাম। রাতের খাবার খেতে ডাকতে এলো তিয়ানা। আমরা চারজন একসাথে খেয়ে নিলাম। কিন্তু কামরান এখনও আসেনি। আমি শেষে না পারতে লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করেই বসলাম,

” তিয়ানা, তোমার ভাই কি রোজই এমন রাত করে বাড়িতে আসে? ”

তিয়ানা মুখ তুলে আমার দিয়ে চেয়ে বললো, ” না ভাবি। মাঝে মধ্যে কোন মিটিং থাকলে দেরি হয়। বাট ডেইলি হয়না। আজ বোধহয় মিটিং আছে। ”

” ওহ। ” আমি কেবল এইটুকুই বলতে পারলাম। আমার ভিতরটা কেমন ছটফট করছে। খেতেও ভালো লাগছে না। মাত্র কদিনের দেখা ঐ মানুষটার অভাব বোধ করছি আমি। ভাবা যায়? কিন্তু কেন বুঝতে পারছিনা।

আরমান হঠাৎ বলে উঠলো, ” কেন ভাবি ভাইয়াকে মিস করছ বুঝি? ডোন্ট ওরি অপেক্ষার ফল মধুর হয়।”

আরমানের মুখে দুষ্টুমি হাসি ঝুলে আছে। আমার কান দুটো গরম হয়ে উঠলো। আমি সরু চোখে একপলক ওর দিকে চেয়ে লাজুক হেঁসে আবার খাওয়াতে মনযোগ দিলাম। খাওয়া দাওয়া সেরে সবকিছু গুছিয়ে রাখলাম সবাই মিলে। কেবল কামরানের খাবার টুকু টেবিলে রাখা আছে। ও এলে সেগুলো ওভেনে গরম করে দেয়া হবে। শাশুড়ি মা ওর জন্য অপেক্ষায় বসে আছেন দেখে আমি বললাম,

” আপনি রেস্ট নিন আম্মা। আমি খাবার গরম করে দিব।”

” তুমি পারবে তো? ”

” কেন পারবনা? শুধু গরম করে দেয়াই তো। ”

” আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তাহলে ঘরে গেলাম। ”

কথা শেষে উনি উনার কামরার দিকে চলে গেলেন। আমি লিভিং রুমের বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। এই বাড়িতে প্রতিটি বেলকনিতে পেট বরাবর রেলিঙ দেয়া। উপরে সম্পূর্ণ খোলা। রেলিঙের উপর দুই হাতের কনুই ভর দিয়ে আনমনা হয়ে নিচের দিকে চেয়ে আছি। কিছুক্ষণ পরেই গাড়ির হর্ণের শব্দে আমি চমকে উঠলাম। দারোয়ান গেট খুলে দিলে গাড়িটা ভিতরে প্রবেশ করল। কামরান এসেছে ভাবতেই আমার বুকের ভিতরটা কেমন ঢিপঢিপ করতে শুরু করল। হঠাৎ একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছে। একদিকে ওকে এতদিন পরে দেখার আকাঙ্খা অন্য দিকে লজ্জা সংকোচে নার্ভাস হয়ে পরছি। দুরুদুরু বুকে বেলকনি থেকে দরজায় এসে দাড়ালাম। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলাম ও চাবি দিয়ে নিজেই দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করল। এবং কত শত যুগ পরে যেন ওকে দেখলাম। আমার ভিতরে তৎক্ষনাৎ যেন একটা শীতল হাওয়ার পরশে আপাদমস্তক শিরশির করে উঠলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে