তোমায় ছেড়ে যাবো কোথায় পর্ব-২৮

0
669

#তোমায়_ছেড়ে_যাবো_কোথায়?
লেখা – মুনিরা সুলতানা।
পর্ব – ২৮।

————–*
কামরান সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে সত্যি সত্যি আমার বেশ কিছু ছবি তুলল। আমার শাড়ির সাথে মিলিয়ে কামরানের পরনে সোনালী রঙের শেরওয়ানি ডিজাইনের পাঞ্জাবি। মেরুন সুতো ও জরির কাজ করা। তবে পাগড়ী পরেনি সে। বিয়ের দিনেও পরেনি আজতো প্রশ্নই ওঠে না। তবু্ও বর বেশে ক্যামেরা হাতে ছবি তুলছে ব্যাপারটা সবার নজর কেড়েছে। কামরান ভাবিরও কিছু একক ছবি তুলে দিল। আমার ও ভাবির একসাথেও কিছু ছবি তুলল। শেষে ভাইয়া ভাবির জোড়া ছবিও তুলে তারপর ফটোগ্রাফারের কাছে ক্যামেরাটা ফিরিয়ে দিল। আর ছবি তোলার পাশাপাশি সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানের ভিডিওও করা হচ্ছে। এরপর তিয়ানা, তাসমিয়া এসে আমাদের সাথে ছবি তুললো। আমাদের কাজিনরাও একে একে এলো। আমাদের দু’জনের পরিবারের সদস্যদের সাথে একে একে আলাদা ভাবে আবার একসাথে পারিবারিক ছবি তোলা হলো। আজ আমার সব বান্ধবীরাও এসেছে। এর আগে বিয়েতে সংগত কারণেই কেউ যেতে পারেনি। কামরানের ঘনিষ্ঠ দুজন বন্ধুও এসেছে। সব মিলিয়ে আজ যেন পরিপূর্ণ সবকিছু। কোন কিছুর ঘাটতি রাখা হয়নি।
আমার শুধু বারবার মনে পরছিল আমাদের বিয়ের দিনের কথা। আজ ধুমধামে অনুষ্ঠান হলেও সেদিনের অনুভুতি, উত্তেজনা, টেনশন সবকিছু মিলে একটা অন্যরকম অনুভব ছিল। সেই সাথে এক রোমাঞ্চকর ভালোলাগার অনুভূতি বুকের ভিতর আলোড়িত করছিল। আজ কিন্তু হঠাৎ পাওয়া সারপ্রাইজ হলেও সেদিনের অনুভবের কাছে কিছুই না। কিন্তু সেই সময় বিয়েকে ঘিরে না হওয়া কিছু স্বপ্ন, আকাঙ্খা এবং মনের কোনে জমে থাকা আফসোস আজকের এই আয়োজনের মাধ্যমে সব দূর হয়ে গেছে।
অনুষ্ঠান শেষ হতে বেশ রাত হয়ে গেল। কেননা অনেক মানুষের সমাগম হওয়ায় খাওয়া দাওয়ার পাট চুকতে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেল। ভাইয়া ভাবি সহ ফিরানি উপলক্ষে শশুর বাড়িতে চলে গেলো। আমরা সবাই আমাদের বাড়িতে ফিরে এলাম। কামরান দুজন বন্ধুকে অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও তারা হোটেলে উঠেছে। কেননা বাসায় ইতিমধ্যে অতিরিক্ত মানুষ আছে। হয়তো ওদের অস্বস্তি লাগবে।
রাতের শোয়া নিয়ে বাঁধল আরেক বিপত্তি। আমার শশুর বাড়ি থেকে অনেকেই এসেছেন এখন বিশেষ অতিথি হিসেবে তাদের তো আর মেঝেতে শুতে দেয়া যায়না। তাই বিছানা গুলো তাদেরকে ছেড়ে দিয়ে আমাদের দিকের আত্মীয় স্বজনের জন্য ড্রয়িং রুম সহ অন্য বড় রুম গুলোতে ঢালাওভাবে বিছানা পাতা হলো। মেয়ে মহিলারা এক রুমে শুলো এদিকে ড্রয়িং রুমে আমার কাজিনরা এবং চাচা মামারা বিছানা শেয়ার করছে।
কামরানের জন্য দুঃখের বিষয় আমাদের আজও আলাদাই কাটাতে হচ্ছে। ওর কথা ভেবে হাসিও পাচ্ছে আবার দুঃখও হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। বিয়ের এতোগুলো দিন পরে কেউ নিশ্চয়ই ভাববে না যে আমাদের বাসর এখনো অসম্পূর্ণ থাকতে পারে। কামরান আরমান এবং ওদের এক কাজিন ভাইকে আমার রুমে থাকতে দেয়া হয়েছে। আমিও আজ ভিষণ ক্লান্ত। সারাটাদিন যেভাবে কেটে গেল শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পরব আজ। একটা লম্বা হাই তুলে ড্রয়িংরুমে ওদের ওখানে কয়েল রেখে ডাইনিং রুমে এসে দেখি চাচি আরো কয়েল জ্বালাচ্ছে। চাচির পাশে চাচার মেয়ে নিভা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে চাচি বললেন,

” হীবা যাতো মা এই কয়েল আর পানির বোতলটা সাথে একটা গ্লাস সহ তোর জামাইয়ের রুমে দিয়ে আয়।”

আমি বোতল ও কয়েল হাতে নিয়ে বললাম, ” গ্লাস আছে আমার রুমে। আমি বরং এগুলো দিয়ে আসি। ”

” আর শোন রাত জাগিসনা। তোরা তো সেই ভোর বেলায় রওনা দিবি। তাই এগুলো দিয়ে এসে তোর ননদদের সাথে গিয়ে শুয়ে পরবি। ঠিক আছে?”

” আচ্ছা। আমি ঠিক শুয়ে পরব। তুমিও যাও ঘুমিয়ে পর। আর নিভা এখনো জেগে আছিস যে? তুইওতো আমাদের সাথে যাবি। যা ঘুমিয়ে পর।

নিভা বললো, ” আম্মুকে হেল্প করছিলাম। এইতো এইবার ঘুমাতে যাবো। তাইনা আম্মু?” শেষের কথাটা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল।

চাচি আরোও কয়েল জ্বালাচ্ছিল। মেয়ের কথায় হেসে মাথা দুলিয়ে সায় জানাতে আমি এগোলাম আমার রুমের দিকে।

আরমান আধশোয়া হয়ে সেলফোনের স্ক্রিনে মনোনিবেশ করে রেখেছে। ওর কাজিন পাশেই উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। বোধহয় ঘুমিয়ে পরেছে। সেটাই স্বাভাবিক। আজই জার্নি করে এসেছে তারপর সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান। ক্লান্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি কয়েলটা ঘরের এক কোনায় রেখে দিলাম। পানির বোতল বিছানার পাশে আমার পড়ার টেবিলের উপর রাখলাম। আরমান সেলফোন থেকে চোখ দুটো সরিয়ে আমার দিকে ফিরে শুধালো,

” ভাবি এখনো শুয়ে পড়েননি? ”

” এইতো এখন গিয়ে শুয়ে পড়বো। কিন্তু তুমি এত রাত জেগে আছো কেন? সকালে রওনা দিতে হবে ভুলে গেছো? আর আরেকজন কই সে তো দেখি বিছানায় যায়নি। ”

আরমান মুচকি হেসে বলল, ” এইতো শুয়েছি তো ঘুমানোর অপেক্ষা। ভাইয়া বারান্দায় বসে আছে। ”

আমিও স্মিত হেসে বললাম, ” আচ্ছা ঘুমাও। আমি দেখি তোমার ভাইয়া কি করছে বারান্দায়।”

আরমান মাথা দুলিয়ে সায় জানিয়ে আবার তার সেলফোনের স্ক্রিনে মনোযোগ দিল। আমি বারান্দার দিকে এগোলাম। দরজার ওপাশে পা রাখতেই আচমকা হ্যাচকা টানে তাল সামলাতে না পেরে সোজা কামরানের কোলের ওপর গিয়ে পড়লাম। উঠে দাঁড়াতে যাব কিন্তু কামরানের বাধা পেয়ে পারলাম না। ও দুহাতের বেষ্টনিতে আমার পেটের উপর ধরে নিজের বুকের সাথে আমার পিঠ ঠেকিয়ে বসিয়ে রাখলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে চোখ পাকিয়ে ওর দিকে পাশ ফিরে বললাম,

” এসব কি? তুমি ইদানিং খুব বেশি অ*সভ্য হয়ে গেছ। জায়গা, সময় কোনো কিছুই বিবেচনা করছনা।”

” আমি তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছি। আর তুমি বলছ এসব ফালতু বিষয়ে মাথা ঘামাবো? নো ওয়ে…।”

কামরান আর কিছু বলার আগেই আমি হাত বাড়িয়ে ওর মুখ চেপে ধরে বললাম, ” একদম চুপ। অ*সভ্য বেহায়ার মত বিহেব করছ। ভিতরে যে তোমার ভাইরা আছে সেটাও খেয়াল নেই তাইনা?”

কামরান ওর মুখে চেপে রাখা আমার হাতটা সরিয়ে হাতের পিঠে চুমু দিল। তারপর মুখ নামিয়ে আমার ঘাড়ে গলায় আলতো করে ঠোঁট বুলালো। আমার সমস্ত শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। তারপর মুখ তুলে গাঢ় আবেগী গলায় বললো,

” কতদিন অপেক্ষা করেছি বলোতো। তোমার এক্সাম শেষে আমাদের বাসায় ফিরে যাওয়ার পরে একদিনও তোমাকে ছাড়া ঘুমাইনি। আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। লন্ডন থেকে ফিরে আমাদের বেডরুমে আমি থাকতেই পারতাম না। মাত্র কদিনেই তুমি কেমন করে যেন ঐ রুমের সবখানেই নিজের অস্তিত্ব ছড়িয়ে রেখে এসেছ। তোমার শরীরের গন্ধ পাই, তোমাকে অনুভব করি অথচ দুচোখ ভরে তোমার দেখা পাইনা। তোমার চলাফেরা, তোমার ঘুমিয়ে থাকা, ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আচরানো, লোশন মাখা এমনকি ঐ রুমে রাখা তোমার জায়নামাজে বসে নামাজ পরা সবকিছুই মিস করি আমি। আমাদের বিছানায় আমি এই কদিন ঘুমাতেই পারিনি। তাই দাদার রুমে গিয়ে শুতাম। তবুও ঘুম আসতো না। ঐযে তোমাকে জড়িয়ে ধরে তোমার শরীরের ঘ্রাণ নিতে নিতে কখন যে ঘুমিয়ে পরার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল কে জানে। এখানে এসেও তোমার থেকে আলাদা থাকতে হচ্ছে। আর কত সহ্য করা যায় বল?”

এমন ভাবে কথাটা বলল কামরান ওর গলা আবেগে কাঁপছিল রীতিমতো। আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। কি অকপট স্বীকারোক্তি। এতোদিনে মনের কথা উজার করে বলছে। কতটা ভুল বুঝেছিলাম এই মানুষটাকে। কি হতো একবার যদি আমাকে বলতো চল আমরা আগে ভালো বন্ধু হই, একে অপরকে ভালো করে চিনি জানি বুঝি তারপর সহজ স্বাভাবিক হয়ে আমাদের দাম্পত্য জীবনটাকে সামনে এগিয়ে নেই। কি হতো বললে? তাহলে তো আর এতো ভুল বোঝাবুঝি অভিমান এসব হতোনা। আমি বললাম,

” আহা! আমি কি করতাম বলোতো? কষ্টতো আমারও হচ্ছিল। তোমার থেকে দুরে আসার কষ্ট সেই সাথে তোমার সম্বন্ধে সন্দেহ নিয়ে থাকায় যে কষ্টটা হতো সেটা মুখে বলে বোঝানে যাবেনা। জানো?”

কামরান কোমল গলায় বললো, ” সরি বউ, না বুঝে আমি তোমায় অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।”

আমি কামরানোর কোলে পাশ ফিরে ওর মুখোমুখি হয়ে বসলাম। দুই হাত বাড়িয়ে পর গলা জড়িয়ে ধরলাম। কামরান আমার পিঠের ওপর দুই হাত বেঁধে আরও কাছে টেনে নিলো। স্বামীর কোলে এমন ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছি আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা। স্বপ্নের মত লাগছে সবকিছু। গত চারমাসে আমাদের জীবনে যা কিছু ঘটেছে তারপরে এমন একটা দিন আমার জীবনে আসবে তা ভাবনাতে আনতেও আমার সাহস হতোনা। কিন্তু আজ সত্যিই সেই দিন এসেছে। আল্লাহ তায়ালা কখনও তার বান্দাদের নিরাশ করেননা। আমি ভালোলাগার আবেশে কামরানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে রাখলাম। কতদিনের অপেক্ষা আজ পূর্নতা পেয়েছে। ওভাবেই বললাম,

” এতদিনে কি হয়েছে সেগুলো না হয় ভুলে যাই আমরা। তিক্ত অভিজ্ঞতা মনে না রাখাই ভালো। এখন থেকে আমাদের জীবনে সব কিছু ভালো হবে ইনশাআল্লাহ। আমরা দুজন মিলে প্রতিদিনে প্রতিক্ষণে সুন্দর সুন্দর সুখময় স্মৃতি আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা করবো নাহয়।”

কামরান আমায় আরও শক্ত বাঁধনে আঁকড়ে ধরে বললো, “হুম তুমি ঠিক বলেছ। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে যেন আর কোন ভুল না হয় সেই চেষ্টাই করবো এখন থেকে। ”

বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে রইলাম আমরা। আজ গরম পরেছে মোটামুটি। তবে বাইরে প্রচুর বাতাস বইছে। বারান্দার সামনের গাছগুলো বাতাসের তোড়ে আর আকাশের বুকে ভেসে থাকা তিন-চারদিনের নতুন বাঁকানো চাঁদের আবছা আলোয় কেমন ভুতুড়ে নাচ শুরু করেছে যেন। বাতাসে বৃষ্টি ভেজা সুবাস ভেসে আসছে। হয়তো আশেপাশের কোনখানে বৃষ্টি হচ্ছে। আমার ইচ্ছে করছে এভাবেই সারারাত পার করে দেই। কিন্তু এখানে মশা অনেক। তাছাড়া ভিতরে দেবর সম্পর্কের দুজন মানুষ শুয়ে আছে। পরে সুযোগ বুঝে মজা করতে ভুলবেনা নিশ্চয়ই। তাই আমি মাথা তুলে বললাম,

” অনেক রাত হয়েছে। ভোর বেলায় উঠে রওনা দিতে হবে তারপর সারাদিন প্রচন্ড ব্যাস্ততায় কাটবে। এখন ঘুমানো দরকার। উঠো। বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পরো। ”

কামরান বাচ্চাদের মতো জেদ ধরলো, ” প্লিজ আরেকটু থাকো না। কিযে শান্তি লাগছিল এতক্ষণ। তোমাকে নিয়ে এভাবেই সারারাত কাটিয়ে দিতে মন চাইছে। ”

আমি আদ্র চোখে ওর মুখের দিকে চাইলাম। ইচ্ছে তো আমারও করছে। কিন্তু সময়টা এখন উপযোগী নয়। তাই বললাম, ” আর মাত্র একদিন। তারপর সামনের পুরোটা জীবন এমন কত রাত এভাবে কাটাতে পারবো ইনশাআল্লাহ। একটু ধৈর্য্য ধরো। প্লিজ। এবার ছাড়ো আমায়।”

” ছাড়তে পারি তার আগে একটু আদর তো অন্তত করতে পারি। ”

কথা শেষে আমাকে একদম ছোটার সুযোগ না দিয়ে আমার ওষ্ঠে গভীর ভাবে চুমু ঠদিতে শুরু করল। কেমন পাগলের মতো এলোপাতাড়ি আগ্রাসী সেই চুমু। অধর ছেড়ে চোখের পাতায়, গালে, চিবুকে, গলায় ঠোঁটে ছোট ছোট স্পর্শে আমাকে অস্থির করে তুললো।

———–*
বিদায় বেলা সবসময় করুন ও হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতাই দিয়ে যায়। এর আগের যাওয়াটা ছিল জিদের বসে। তাই সেভাবে আজন্মকালের আপনজনদের ছেড়ে যাওয়ার কষ্টটা ঠিক সেভাবে অনুভবই করিনি। কিন্তু আজ কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে যেন। সত্যিকার অর্থে বিদায় অনুষ্ঠান আজকের হচ্ছে। বাবার বাড়ি থেকে আজীবনের সাথী স্বামীর হাত ধরে বিদায় হওয়াটা যে আজ হচ্ছে। বাবা মায়ের বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নাটা কিছুতেই থামাতে পারছিনা। আম্মাও কেঁদে চলেছেন সমানে। একে একে আমার ফুপুরা, চাচি, কাজিন বোনেরা সবাই কাঁদতে কাঁদতে বিদায় দিল আমায়। আমাকে হাপুস নয়নে কাঁদতে দেখে তাসমিয়া আপু এগিয়ে এলো আমার কাছে । দুহাতের আঙ্গুল দিয়ে আমার দুই গালে ভিজে থাকা অশ্রুবিন্দুগুলো মুছে দিয়ে বলল,

” কাঁদে না বোন। এটাই তো যুগ যুগ ধরে চলে আসা নিয়ম। মেয়েদের এভাবেই সবকিছু ছেড়ে নতুন জীবনে চলে যেতে হয়। এত কষ্ট পেয়ো না বোন। এইতো বিকেল হতে হতেই তো আঙ্কেল আন্টিরাও তো ঢাকায় যাবেন। একটা বেলায়ই শুধু। তাছাড়া তামান্না, নিভা ওরাতো আমাদের সাথেই যাচ্ছে। আর ওই বেলায়তো আবার দেখা হচ্ছে ওনাদের সাথে। এবার আমাদের রওনা দিতে হবে নইলে কিন্তু ফ্ল্যাইট মিস হয়ে যাবে। ”

আমি তখনো অনবরত ফুপিয়ে চলেছি। লম্বা কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছি। ঠিক তখন আমার ভাইয়া হন্তদন্ত হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আমাদের মাঝে এসে দাঁড়ালো। ভাইয়াকে ওভাবে আসতে দেখে আমার কান্না আপনাআপনি থেমে গেল। বড় বড় চোখ মেলে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখছি। দৌড়ে আসায় ভাইয়া সমানে হাপাচ্ছে। কামরান এগিয়ে এসে বলল,

” আরে আপনি কোত্থেকে এলেন এত সকাল বেলায়? আপনার তো এই সময় শ্বশুর বাড়িতে থাকার কথা। ”

ভাইয়া ততক্ষণে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো, “আমার বোন চলে যাচ্ছে। আর আমি বিদায় দিতে আসব না? এই শহরেই তো শ্বশুরবাড়ি কতক্ষণি বা লাগে আসতে। তাই বিদায় দিতে চলে এলাম।”

আব্বা ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,” ও বাড়িতে বলে এসেছিস তো? তোর না এলেও চলতো। বিকেলেই তো যাওয়া হচ্ছে ঢাকায় তখন দেখা তো হতোই। ”

” হ্যাঁ আব্বা বলে এসেছি। তোমার ছেলেকে কি ভাবো তুমি? আমার বোনের বিদায়ের সময় থাকব না তা কি হয় যতই পরে দেখা হোক না কেন। ”

আমি ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে আবারো কেঁদে উঠলাম। অবশেষে সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমরা রওনা দিলাম। জীবনের একটা অধ্যায়কে পিছনে ফেলে জীবনের নতুন আরেকটা অধ্যায়ের উদ্দেশ্যে পারি জমালাম।

————*
ঢাকায় পৌঁছাতেই যেন সবার ব্যাস্ততা আকাশ ছুয়ে গেলো। কেবল আমার ব্যাস্ততা নেই। সম্পূর্ণ সুস্থ না হতেই একের পর এক এইসব অনুষ্ঠান হচ্ছে। সবার চিন্তা আমি আবার অসুস্থ না হয়ে পরি। তাই যতটা পারা যায় আমাকে বিশ্রামের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। কামরান বেরিয়ে গেল অফিসের উদ্দেশ্যে। কদিন অফিসের কাজ ফোনে এবং অনলাইনে সেরেছে। যাওয়ার আগে বলে গেল আমাদের দুই তিন দিনের কাপড় একটা লাগেজে গুছিয়ে রাখতে। কনভেনশন হল থেকেই নাকি আমরা একটা রিসোর্টে যাব। তাই আজ সারাদিন অফিসের কাজগুলো গুছিয়ে নিতে অফিসেই থাকতে হবে। এদিকে দুলাভাই ও আরমান ওরা দুজনই কনভেনশন হলের কাজে দৌড়াদৌড়ি করছে। আমি অবাক হলেও কিছু বললাম না। কামরানের ইচ্ছে নিরিবিলিতে যেন আমরা দুজন দুটো দিন কাটাতে পারি তাই এই ব্যবস্থা। ওর বন্ধুর রিসোর্ট। নতুন এবং খুব বড়সড়ো নয় যদিও। তাই আমি দুজনের কাপড় চোপড় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম। বিকেলে আসরের নামাজ পড়ে পার্লারে নিয়ে গেল আমাকে আমার সাথে তাসমিয়া আপু তিয়ানা, তামান্না, চাচাতো বোন নিভা ওরাও এসেছে সাজগোজ করতে। ওয়ালিমার জন্য লেহেঙ্গা কেনা হয়েছে। মভ পিংক রঙের লেহেঙ্গাতে সোনালী রুপালী রঙের অলওভার জরির ভারি কাজ। উপরে সাথে লং শ্রাগ আছে। সাথে ম্যাচিং হিজাব। আজ লেহেঙ্গার সাথে কামরানের দেয়া ব্রেসলেটটা পরলাম। জিনিসটা লেহেঙ্গার সাথে খুব মানিয়েছে।

সন্ধ্যার আগেই আব্বা আম্মা সহ ভাই ভাবি আরোও অনেকেই এসে পৌছেছিল। তবে ওরা সবাই বনশ্রীতে আমার মামার বাসায় গিয়ে উঠেছেন। তাই আমার সাথে সবার দেখা হলো একেবারে কনভেনশন হলে। নানা ধরনের ফুলের সমাহারে সাজানো স্টেজে বসে এবং চারপাশে আমার এবং কামরানের কাছের আত্মীয় স্বজন, বন্ধুরা ও কাছের মানুষদের নিয়ে বেশ সুন্দর ভাবে আমার ওয়ালিমা অনুষ্ঠানও সম্পূর্ণ হলো। এমনকি আমার বান্ধবী সোমাও এসেছিল ও ননদ ও ছোট্ট ছেলেটাকে সাথে নিয়ে।
যেমন হঠাৎ করেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গত দুদিন ধরে ঐ বাড়ি, এই বাড়ি মিলে যেন সমস্ত অপূর্ণতাকে পরিপূর্ণ পূর্ণতায় স্বপ্নের মতো ভরিয়ে তুলতে এতটুকু কার্পণ্য করেনি। এইসব উপভোগ ও অনুভব করতেই আজ কেন যেন বারবার চোখ দুটো সিক্ত হয়ে উঠছিল আমার।

অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিরা বিদায় নিয়ে চলে গেলে কামরান তাড়া দিল আমাদেরও এখুনি বেড়িয়ে যেতে হবে। যদিও নিকট আত্মীয় স্বজনের অনেকেই এখনো চলে যায়নি। যেহেতু আমাদের শহরের সাইডের দিকে যেতে হবে। তাই আর রাত গভীর হওয়ার আগেই রওনা দেয়া উচিত। আমার ভারী গহনাদি সব খুলে শাশুড়ি মায়ের কাছে দিয়ে দিলাম। শুধু কানের ছোট দুল গলায় হালকা লকেট সহ চেইন রইল। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা কামরানের গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম। খুব ক্লান্ত লাগছে তাই কিছু সময় দুজনেই নিশ্চুপ রইলাম। কামরানও নিরবেই ড্রাইভ করছে। কিছুক্ষণ পরে নিরবতা ভেঙে কামরান আমায় শুধালো,

” কি ব্যাপার একদম চুপচাপ ঘুম পাচ্ছে বুঝি? ”

আমি আলস্য নয়নে পাশ ফিরে তাকিয়ে বললাম, ” হুম একটু। আসলে খুব টায়ার্ড লাগছে। ”

কামরান এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে আবার ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিয়ে বললো, ” চাইলে একটু ঘুমিয়ে নিতে পারো। ওখানে পৌঁছতে পৌঁছতে একটা ঘুম হয়ে যাবে তোমার।

আমি জবাবে কিছু না বলে কেবল মুচকি হাসলাম ওর দিকে তাকিয়ে। তারপর সিটে গা এলিয়ে দিলাম। হঠাৎ মনে হতে মাথা কাৎ করে কামরানের দিকে ফিরে শুধালাম,

” আমরা কোথায় যাচ্ছি বললে না তো।”

ও আবারও আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে ফের সামনে ফিরে বললো, ” পূর্বাচল। ওখানে আমার এক ফ্রেন্ডের ছোট একটা রিসোর্ট আছে। নতুন, রিসেন্টলি তৈরি হয়েছে। আসলে এখন ঈদের পরে যেকোনো রিসোর্টে যাওনা কেন প্রচুর ভির থাকবেই। তাছাড়া গাজীপুরে এত রাতে যাওয়াটা সময়েরও ব্যাপার। তাই ভাবলাম পূর্বাচল কাছে। আর দুইতিনটা ফ্যামিলির মতো রুম থাকায় গ্যাদারিং কম হবে। আমি আসলে নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ খুজছিলাম। তুমি এমনিতেই অসুস্থ। আর এই কদিনে তোমার শরীরের উপর দিয়ে খুব ধকলও গেছে। ওখানে কমপ্লিট রেস্ট নিতে পারবে। মন চাইলে আশেপাশে একটুআধটু ঘুরে বেড়াতে পারবে। অনেকটা ফার্মহাউসের মতো বলতে পারো।

” আচ্ছা। নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ যেহেতু নিশ্চয়ই খুব সুন্দরই হবে।”

কামরান মুচকি হেসে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিল। আর কথা না বাড়িয়ে সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ দুটো বুজে ফেললাম। এবং কখন যেন আমার ক্লান্ত চোখ দুটো অতল ঘুমে জড়িয়ে গেল টেরই পেলামনা।

চলবে ইনশাআল্লাহ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে