তোমাকে আমার প্রয়োজন পর্ব-৩৩

0
1810

#তোমাকে আমার প্রয়োজন??
#মেঘ পরী??

??পর্ব-৩৩??
.
?
.

যথারীতি বিকালবেলা তারা প্যাকিংয়ের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পরলো।তিথিরা আজ তাদের বাসায় থেকে গেছে,,,কারন পরেরদিন সকালেই তাদের ফ্লাইট।সকাল ৭টার সময় ওরা বাড়ির সবাই দের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে পৌঁছে গেল,, সাড়ে আটটায় তাদের ফ্লাইট।তিথি এই প্রথম প্লেনে উঠবে তাই তার একটু নার্ভাস ফিল হচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর তারা প্লেনে উঠে পড়লো। তিথি আর নিলয়ের সিট মাঝখান বরাবর।প্লেন যখন চলতে শুরু করে তিথি ভয়ে নিলয়ের হাত খিমচে ধরে,,,তা দেখে নিলয় মুচকি হেসে তিথিকে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে।

আবির আর নিশির শিট পড়েছে সামনের দিকে,,,নিলয় ইচ্ছে করে এমন ভাবে টিকিট বুকিং করেছে যাতে আগের এবং নিশি কিছুটা কোয়ালিটি টাইম স্পেন করতে পারে।নিশির প্রচুর ভয় লাগছে কারন সে ও প্রথম প্লেনে উঠছে কিন্তু তা মুখে প্রকাশ করছে না।আবির ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিশির হাত শক্ত করে চেপে ধরল,, নিশি তার হাত সরাতে চাইলেও আবির আর‌ও শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে।নিশি আর কোনো আপত্তি করল না,,এমনিতেও সে ও প্রচুর ভয় পাচ্ছে।

দীর্ঘ 6 ঘণ্টা পর তাদের প্লেন ল্যান্ড করল সিঙ্গাপুরের স্যালেটার ইয়ারপোর্টে।সেখান থেকে হোটেল যাওয়ার জন্য নিলয় আগে থেকেই দুটো ক্যাব বুক করে রেখেছিল।একটাতে আবির আর নিশি আর অন্য টাতে নিলয় এবং তিথি উঠে পড়লো।কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা তাদের গন্তব্য “”Mandarin Orchard Singapore”” হোটেলে চলে এলো।হোটেল টা খুব সুন্দর এবং অনেক বড়,, পুরো হোটেলটা কাচ আর ফাইবার দিয়ে তৈরি।তারপর নিলয় আর আবির রিসেপশন থেকে নিজেদের রুমের চাবি কালেক্ট করে যে যার রুমে চলে গেল।

তিথি প্রচণ্ড টায়ার্ড ফিল করছিল,, তাই রুমেগিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেডে শুয়ে পড়লো,,,নিলয় ও ফ্রেশ হয়ে তিথির পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল।আবির আর নিশি ও একটু রেস্ট নিয়ে নিল।

বিকাল ঘুম থেকে উঠে নিলয় তিথি কে নিয়ে রিসোর্টের ফুড সেকশনে চলে গেলো। সেখানে আবির আর নিশি তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। খাওয়া-দাওয়া র পর্ব মিটিয়ে আবার যে যার রুমে চলে গেল,,,আজ যেহেতু প্রথম দিন তাই আজ তারা বের হবে না।ওরা এখানে থাকবে সাতদিন।

পরেরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে তারা সেন্টোসা আইল্যান্ডে।সমুদ্রের মাঝে ছোট একটা দ্বীপে গড়ে উঠেছে এই পর্যটন কেন্দ্রটি।এখানে ছোট ছোট পার্ক,, ক্লাব হাউস,,বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় রাইড ইত্যাদি অনেক কিছুই রয়েছে এখানে।এখানকার মূল আকর্ষণ হলো “”ইউনিভার্সাল স্টুডিও””। এছাড়াও এই দ্বীপে আছে “”অ্যামিউজমেন্ট পার্ক””,,””ওয়াটার পার্ক””,, আর বিনোদনের জন্য রয়েছে অসংখ্য গ্যালারি।আর সবচেয়ে জনপ্রিয় “”ইনডোর স্কাইড্রাইভ””ও এখানে রয়েছে।

তিথি আজ হোয়াইট কালারের শার্টের সাথে ব্লু জিন্স পরেছে,,,আর নীলয় পড়েছে ব্ল্যাক কালারের প্যান্ট আর স্কাই ব্লু কালারের শার্ট।নিশি লাল কালারের টপের কালচে ইয়েলো কালারের প্লাজু পড়েছে আর আবির অ্যাশ কালারের জিন্সের সাথে লেমন কালারের একটা টি-শার্ট পড়েছে।

সেন্ট্রাসা দ্বীপে এসে তিথি অবাক হয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে,,,এ যেন এক কল্পনার রাজ্য ভ্রমণ করতে এসেছে। চারিদিকে খুব সুন্দর করে সাজানো,,আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এখানে বিভিন্ন সেকশন আছে যেমন “”জুরাসিক পার্ক””,, “”মাদাগাস্কার”” ইত্যাদি।একে একে এই স্থানগুলো দেখার পর,,তারা এখানকার আরও একটা বিখ্যাত জায়গায় গেল।

পানির নিচে এক অপার সৌন্দর্য গড়ে উঠেছে “”সি একুরিয়াম””এ।এখানে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ,,,সামুদ্রিক প্রাণী যেমন হাঙর,,ডলফিন,, সামুদ্রিক উদ্ভিদ ইত্যাদি। বিশাল বড় রুমে চারিদিক কাজ দ্বারা আবৃত এবং তার মাঝখান থেকে সরু একটা রাস্তা চলে যাচ্ছে আর কাচগুলোর ওপারে রয়েছে সেই সমস্ত “”সি অ্যানিম্যাল””,,””ফিস”।

তিথি অবাক হয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে,,তার মনে হচ্ছে সে যেন সাগরতলে কোন এক রহস্যঘেরা জঙ্গলের মধ্যে চলে এসেছে।নিশি ও অবাক হয়ে‌ চারপাশে দেখছিল,, হঠাৎ তার নজর গেল সামনের দিকে একটা বিশাল বড় হাঙর দ্রুত গতিতে তার দিকে ধেয়ে আসছে। এইভাবে তার দিকে হাঙরটাকে আসতে দেখে নিশি বিরাট একটা চিৎকার দিয়ে পাশে থাকা আবিরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল,,, আবিরের টিশার্ট খামচে ধরল। জোরে খামচে ধরায় আবিরের গলায় নিশির নখ লেগে কিছুটা ছিলে গেল। নিশির এমন আচরণে আবির সামনের দিকে তাকালো,,তারপর কারন অনুমান করতেই হু হা করে হেসে উঠলো।আবিরের হাসি দেখে নিশি তার দিকে তাকিতেই,,, আবির তাকে সামনের দিকে তাকাতে ইশারা করলো।

নিশি সামনের দিকে তাকাতে নিজেই নিজের কাজের জন্য লজ্জিত হয়ে পড়লো।হাঙরটা কাচের ওপর পাশে ডাগর ডাগর চোখে নিশির দিকে তাকিয়ে আছে,,হয়তো সে ও তার প্রতি নিশির এমন আচরণে হতভম্ব।নিশি লক্ষ করলো সে এখনও আবিরকে জড়িয়ে আছে,,তাই সঙ্গে সঙ্গে আবিরের কাছে থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো এখনও অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে আছে। আবার আবিরের দিকে তাকাতেই দেখলো আবির‌ও মুখটিপে টিপে হাসছে,,এটা দেখে নিশি রেগে নাক ফুলিয়ে সামনের দিকে হাঁটা দেয়।

তিথি নিলয়ের কাছে বায়না ধরেছে””ইনডোর স্কাই ড্রাইভিং”’এর।তাই নিলয় তাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছে।তিথির সাথে নিলয়‌ ও ”’ইনডোর স্কাইডাইভিং”” করবে।নিলয়প্রথমে কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কেটে নিল।তারপর ড্রেস চেঞ্জ করতে নিলয় তিথি কে ওম্যান কাউন্টারের সামনে এগিয়ে দিয়ে নিজে ও জেনারেল কাউন্টারে চলে গেল।

তিথি একটা রেড কালারের স্কাই ড্রাইভিং সুট পরেছে,,আর মাথায় হেলমেট।নিলয় ব্লু কালারের স্কাই ড্রাইভিং সুট পড়েছে সাথে হেলমেট।চোখে মোটা কাঁচের চশমা লাগানো দুজনের।ড্রেস পরা হয়ে গেলে দুজনে একটা টিউব বক্সের মধ্যে প্রবেশ করলো,,তাদেরকে হেল্প করার জন্য একজন গার্ড ও আছে সেখানে।তিথি ঝোঁকের বশে প্রথমে হ্যা বললেও এখন এবার তার ভয় লাগছে,,,নিলয়ের হাত শক্ত করে ধরে আছে সে।নিলয় তিথির দিকে তাকিয়ে তাকে শান্ত থাকতে বলল।

কিছুক্ষণ পর নিলয় এবং তিথি কে আলাদা করে রাখা হলো,, হঠাৎ তিথির মনে হচ্ছে তার ওজন ক্রমশ কমে যাচ্ছে,,, নিজেকে প্রচুর পরিমাণে হালকা মনে হচ্ছে। হঠাৎ করে দেখলো যে তার পা দুটো আস্তে আস্তে উপরে উঠছে। হঠাৎ গাইড তাকে উবুর করে শুইয়ে দিল,,এতে তিথি প্রচন্ড পরিমানে ভয় পেয়ে নিজের চোখ শক্ত করে খিচে বন্ধ করে নিল। কিছুক্ষণ পর অনুভব করল সে যেন হাওয়াইতে ভাসছে চোখ খুলে নিচে তাকাতেই হতবাক মেঝে থেকে বেশ খানিকটা উপরে উবু হয়ে সে আকাশে উড়ছে। প্রথমে ভয় পেলেও তিথি এবার খুব আনন্দের সাথে নিজের স্কাইড্রাইভ উপভোগ করছে। পাশে তাকিয়ে দেখল নিলয় ও খুব সুন্দর ব্যালেন্স করে স্কাইড্রাইভ করছে।

স্কাই ড্রাইভের পর তারা লাঞ্চ করতে একটা রিসোর্টে চলে গেল।নিলয় তার জন্য এক প্লেট ওয়ান্টন মি,, ফ্রয়েড ক্যারোট কেক,,,আর চিলি ক্রপস অর্ডার করলো।তিথি শুধু নিজের জন্য কায়া টোস্ট এন্ড সফ্ট বয়েল এগ ওডার করলো।নিশি এক প্লেট মিনসড মিট নুডলস ওডার করলো আর আবির ওয়েস্টার ওমলেট,,নেসি লিমাক আর স্যাটে ওডার করলো। এগুলো এখানকার স্পেশাল ডিস।

লাঞ্চ শেষে তারা “”জুরং বার্ডপার্ক””ঘুরতে গেল।এটি সিঙ্গাপুর এবং পুরো বিশ্বের অন্যতম বড় পার্ক। প্রায় 5 হাজারেরও বেশি প্রজাতির পাখি বাস করে এই পার্কে। একটা বিশাল বড়।এখান থেকে ঘুরে তারা হোটেল ব্যাক করলো এতটুকু ঘুরতেই তাদের সারাদিন কেটে গেল।

হোটেলে এসে তিথি ওয়ারড্রব থেকে নিজের জামা কাপড় নিয়ে সামনে ফিরতেই দেখে নিলয় তার দিকে তাকিয়ে আছে। নিলয় এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিথি তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল-;

-:কি হয়েছে??

-: কিছু না।(ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে)

-:তাহলে আমার সামনে এমন খাম্বার মতোন দাঁড়িয়ে আছেন কেন??সড়ে দাঁড়ান আমি ওয়াশরুমে যাব ফ্রেশ হতে।

-:আমি ও তো তার জন্য‌ই দাঁড়িয়ে আছি।(দাঁত বের করে)

-: মানে (অবাক হয়ে)

-: মানে হলো খুবই পরিষ্কার।আমরা দুজনে একসাথে শাওয়ার নেব আজ।

তিথি চোখ বড় বড় করে নীলয়ের দিকে তাকিয়ে একটা জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো-;

-: ইম্পসিবল।

-:সব‌ই পসিবেল মরি জান।

-:নো নো..

-: ও ইয়েস ইয়েস..

-: নো নিলয় এরকম করবেন না।এই বলে যেই নিলয় কে পাশ কাটিয়ে যাবে অমনি নিলয় খপ করে তাকে ধরে,,কোলে করে তুলে ওয়াশরুমে চলে গেল।

এদিকে নিশি‌ ফ্রেশ হয়ে এসে বেডে শুয়ে আছে একটু পর আবির ও এসে নিশির পাশে শুয়ে পড়লো।এতক্ষন সে মায়ের সাথে কথা বলছিল।নিশি একবার আবিরের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল,,এই রুমে বড়ো সোফা নেয়,,এমনি সিঙ্গেল সোফা আছে তাই তাকে বাধ্য হয়ে আবিরের সাথে বেড শেয়ার করতে হচ্ছে।এইসব চিন্তা করতে করতে একসময় নিশি ঘুমিয়ে গেল। নিশির ঘুমানোর পর আবির নিশির দিকে ঝুঁকে দেখলো যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে কি না।।এতক্ষন সে জেগেছিল নিশির ঘুমানোর অপেক্ষা করছিল।

নিশির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিশির কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে নিশি কে টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিল তারপর নিশি কে জড়িয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দিল।

যেহেতু সবাই অনেক টায়ার্ড তাই কেউ আর রাতে ডিনার করলো না। ব্যালকনিতে থাকা দোলনার উপর বসে তিথি নিলয়ের বুকে মাথা রেখে আকাশের তারা গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে করতেই তার ফর্সা মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করল।আজ প্রায় 40 মিনিট ধরে সে আর নিলয় একসাথে শাওয়ার নিয়েছে। শাওয়ারের মাঝে নিলয়ের করা দুষ্টুমি গুলোর কথা মনে পড়তে তিথি নিলয়ের বুকে নিজের মুখ লুকালো।নিলয় ও মুচকি হেসে তিথিকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আকাশের দিকে তাকালো।আজ সে সত্যিই পরিপূর্ণ তিথি নিজের জীবনসঙ্গী হিসাবে পেয়ে।

সত্যিই মন থেকে কাউকে ভালোবাসলে পৃথিবীর কোনো বাধাই পারবে না ভালোবাসার মানুষ দুটিকে আলাদা করতে। কিন্তু সত্যিই কি তাই হয়!! তাহলে পরস্পর দুটো ভালোবাসার মানুষ একসঙ্গে থেকেও কেন আজ তারা এত দূরে পরস্পরে কাছ থেকে।কেন মেনে নিতে পারছে না নিশি আবিরকে?? এই প্রশ্নটা করা খুব সহজ হলেও এর উত্তরটা দেওয়া অতটাও সহজ নয়।হয়তো কোনোদিন সবকিছু ভুলে নিশি পারবে আবিরকে ক্ষমা করে দিয়ে নতুন ভাবে পথ চলার স্বপ্ন বুনতে,,,,আবার হয়তো বা না!!!
.
.
.
.
[বাকিটা নেক্সট পর্বে]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে