তুমি নামক সপ্তর্ষি মন্ডলের প্রেমে পর্ব – ১১

0
1283

#তুমি নামক সপ্তর্ষি মন্ডলের প্রেমে💖
#মিফতা তিমু
#পর্ব -১১

সিটের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে চোখটা লেগে এসেছিল কিন্তু গাড়ির হর্ণে ঘুম ভেংগে গেল।চোখ খুলে দেখলাম আমরা জ্যামে আটকে আছি। পুরান ঢাকা যাওয়ার রাস্তায় জ্যাম পড়েছে।প্রায় সারা বছরই রোজ রোজ হাজার হাজার মানুষ রাতের বেলা এখানে আসে আমাদেরই মত খাবার খেতে আর সেই সুবাদে সারা বছরই এই দিকটায় এরকম জ্যাম লেগে থাকে।

এত জ্যাম দেখে ডাক্তার সাহেবের কপালে ভাঁজ পরেছে।আমার গাড়ির এসি তে প্রবলেম হয় বলে উনি এসি বন্ধ করে জানালা খুলে দিয়েছিলেন।এসি না চালানোর কারণে উনি এই জ্যামের মধ্যে এত শীতেও ঘামছেন রীতিমত। মানুষটা প্রচন্ড আদর যত্নে আর আরাম আয়েশে বড় হয়েছে বলেই হয়তো গরম সহ্য করতে পারেনা।অবশ্য আমিও কম আরাম আয়েসে বড় হইনি।

সৎ মায়ের সংসারে থেকে বাবার চোখের বিষ হওয়ার পরও কোনো এক অজানা কারণে বাবা আমি কোনো কিছু চাওয়ার আগেই দিয়ে দিত তাই অভাব কি সেটা আমিও তেমন একটা বুঝি না।তবে বাবার অজান্তে ফিরোজা বেগমের অনেক চোখ রাঙানি আর মার খেয়েছি ছোটো বেলায়।আম্মু আমায় আজ থেকে দশ বছর আগে মানে যখন আমার ১৫ বছর তখন ছেরে গিয়েছিল।আম্মু চলে যাওয়ার পর সেদিন শেষ দেখেছিলাম বাবাকে কাদতে।কতদিন একলা ঘরেই বন্দী থাকতো।এরপর হঠাৎ একদিন বের হলো আর ফিরে এলো ফিরোজা বেগম কে নিয়ে।তারপর কিছুদিন ফিরোজা বেগম আমায় খুব খাতির যত্ন করলেও আস্তে আস্তে তার আচরণ বদলে গেলো।আমায় উঠতে বসতে শুধু খোটা দিত অবশ্য তা বাবার আড়ালে।আর বাবা, সে তো আমায় দেখতেই পেত না।দুরদুর করে তাড়িয়ে দিত কিন্তু ফিরোজা বেগম কিছু বললেই রেগে যেত যার কারণে ফিরোজা বেগম আমায় আড়ালে শাসাত।

এরপর যখন আমার ১৯ বছর হলো তখন মামু আমায় নিয়ে গেলো তার সঙ্গে লন্ডনে।এতদিনে ওখানেই আমি মামী,মামু, ছোটো মামা, অলিভ আপু আর আলভী ভাইয়ার সঙ্গে ছিলাম।সেখান থেকে ফিরোজা বেগমই এক প্রকার মিথ্যা কথা বলে আমায় এখানে আনালেন।মামু আর মামী কে মিথ্যে বলে চলে এলাম এখানে আর এখানে আসার পরই হুট করে বিয়ে হয়ে গেলো।

অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে জ্যাম ছেরে দিয়েছে বুঝতেই পারলাম না।জ্যাম ছেরে দেওয়ার কারণে গাড়ি অনেকটা এগিয়ে গেছে আর সেই ফাঁকে ডাক্তার সাহেবও তার গাড়ি সা সা করে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছেন।আমি ডাক্তার সাহেবের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।মানুষটা বড্ড কনফিউজিং।কখনো কখনো উনার ব্যবহারে মনে হয় উনি আমার বড্ড কাছের কেউ আর তখন ইচ্ছে করে নিজের সবটা দিয়ে উনাকে ভালোবাসতে কিন্তু কখনো কখনো আবার উনার খারাপ ব্যবহার গুলোই কষ্ট দেয় আমায়।

‘ মানলাম আমি সুন্দর কিন্তু তাই বলে আপনি যদি এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকেন তাহলে তো আমার লজ্জা লাগবে মিসেস আফরিন। ‘ ড্রাইভ করতে করতে সামনের দিকে চোখ দিয়েই বললেন ডাক্তার সাহেব কথাগুলো।

আমি বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে আছি উনার দিকে।দিনদিন উনার অসভ্যতামি কথাবার্তা বেড়েই চলেছে।আমি রেগে গিয়ে উনি ড্রাইভ করা অবস্থাতেই দুই চারটা কিল বসিয়ে দিলাম উনার হাতে।উনি তাড়াহুড়ো করে কোনমতে গাড়ি থামালেন তারপর বললেন,
তাহরীম: আমার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও মারার ইচ্ছা আছে নাকি?

উনার কথা শুনে আমি চোখ দুটো ছোট ছোট করে উনার দিকে তাকালাম।উনি আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রুখানি সোজা করে বললেন,
তাহরীম: আমায় যে এভাবে মারছিল মাঝ রাস্তায় ড্রাইভিং করা অবস্থায় তাতে অ্যাক্সিডেন্ট এ আমি তো যেতামই সঙ্গে তুমিও যেতে।
আফরিন:আমি মরলে মরতাম আপনার কি তাতে?আপনি তো আমার থেকে ছূটকারা পেলে বাঁচেন।তাইতো আমায় নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে আপনার বিবেককে বাঁধে।আমি কে আপনার?কেউ নই আমি আপনার।আমাকে নিয়ে আপনার ঘুরতে যেতে হবে না।আপনি আমায় এখানে নামিয়ে দিন।আমি নিজে নিজে চলে যেতে পারব আর চিন্তা করবেন না আমি খুব তাড়াতাড়ি নিজের একটা ব্যবস্থা করে আপনাকে আমার থেকে মুক্তি দিবো বলেই আমি গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে উঠে পড়ে লাগি।কিন্তু গাড়ীর দরজা খুললে তো। মরাটা খুলছেই না।

‘ ওটা নিয়ে এত গুতাগুতি করে লাভ নেই।ওটা খুলবে না।আমি লক করে রেখেছি। ‘

কথাটা কানে ভেসে আসতেই পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেল।আমি থমথমে গলায় আক্রোশ ভরা কণ্ঠে বললাম,
আফরিন: এসবের মানে কি ডাক্তার সাহেব? আপনি আমার সঙ্গে মাইন্ড গেমস কেন খেলছেন? কেন বারবার আমায় আপনার প্রতি দূর্বল করে দিচ্ছেন? আমি আপনার প্রতি দূর্বল হয়ে যাবো তারপর আপনি আমায় ছুড়ে ফেলবেন এটাই চাইছেন তো আপনি? আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি যে আপনি তার প্রতিশোধ নিচ্ছেন?আমায় মুক্তি কেন দিচ্ছেন না?

‘ যখন সঠিক সময় আসবে তখন তুমি আমার থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে আর আমি তোমার সঙ্গে কোনো মাইন্ড গেমস খেলছিনা।আমি যা করছি সব তোমার প্রতি থাকা কর্তব্যের দায় বদ্ধতা থেকে করছি। ‘ নিরলস কণ্ঠে বললেন ডাক্তার সাহেব।

উনার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম।কিছু বলার মত খুঁজে পাচ্ছিনা তবুও নিজেকে সামলে রেখে থমথমে গলায় বললাম,
আফরিন: আমি কি শুধুই আপনার কর্তব্য ডাক্তার সাহেব?এই কদিনে কি এর থেকে বেশী কিছু হয়ে উঠতে পারিনি?
তাহরীম: বিয়ের রাতেই তো কথা হয়েছিল যে তোমার এমবিবিএস শেষ হতেই আমরা দুজন আলাদা হয়ে যাবো।তাহলে এরপরও এসব কথা কেন উঠছে?
আফরিন: তাহলে এতদিন আপনার করা নরম ব্যবহার দিয়ে কেন দুর্বল করে দিলেন আমায়? আমায় আপনার প্রতি দূর্বল করে কি পেলেন আপনি?কেন আমায় বন্ধুদের সামনে আমায় বউ বলে ডাকলেন?কেন এত প্ল্যানিং করে আমায় উইশ করলেন? কেন কেন কেন?…. কথাগুলো আমি কাদতে কাদতে বললাম।

‘ সবকিছুর উত্তর হয়না আফরিন।আমরা এখন এখানে ঘুরতে এসেছি তাই সেই কাজে মন দিলেই হয়। হাতে তো শুধু এই দেড় টা বছরই আছে।তারপর তুমি যখন এমবিবিএস এর রেজাল্ট দিবে তখন তো চলেই যাবে।ততদিন নাহয় সবার সামনে আমরা স্বামী স্ত্রীর মতো ব্যবহার করি।আমি চাইনা কেউ আমাদের সম্পর্কের সত্যতা জানুক। ‘ কথাগুলো বলে ডাক্তার সাহেব আবারও গাড়ি স্টার্ট দিলেন।

শা শা করে গাড়ি ছুটে চলেছে পুরান ঢাকার উদ্দেশ্যে।আমি জানালাটা খুলে দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছি ।আমার গভীর দৃষ্টি বাইরে থাকা প্রকৃতির দিকে।ডাক্তার সাহেবের তখনকার বলা সেই কথাগুলো আমায় ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে।এখন বুঝতে পারছি পৃথিবীটা বড্ড কঠিন। এখানে যে যেটা চায় সে সেটা কখনোই পায় না।ছোটোবেলায় যখন আম্মু ছিল তখন আম্মু আর বাবার ঝামেলা দেখেই বড় হয়েছি।সবসময় ওদের মধ্যে ঝামেলা হতো।ওদের ঝামেলা আর তারপর আম্মুর চলে যাওয়ায় ভালোবাসার উপর থেকেই বিশ্বাস উঠে গেছিল কিন্তু ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে বিয়ের পর সেই অবিশ্বাসে অনেকটা ভাঙন ধরেছিল।তবে আবারও আজ ডাক্তার সাহেব তার ব্যবহার দ্বারা আমায় ক্রুশ বিদ্ধ করলেন।

তবুও আমি ভাঙব না।আমাদের বিয়ের সবে এক সপ্তাহ পেরিয়েছে।বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যেই যে উনার আমাকে ভালবাসতে হবে তার তো কোনো বাধ্য বাধকতা নেই। দেড়টা বছর তো আছে।একসময় না একসময় উনি ঠিকই ভালোবাসবেন আমায় আর এটা আমার বিশ্বাস।

আমার ভাবনার মাঝেই আমরা পুরান ঢাকায় পৌঁছে গেলাম।চারপাশ থেকে অনেক হইহুল্লোড় আর আওয়াজের শব্দ আসছে।এই সময়টায় এখানে অনেক মানুষ থাকে।এখানে দিনে যেমন ব্যস্ততা রাতেও তেমনি ব্যস্ততা।প্রত্যেকটা হোটেল শত শত গ্রাহকের ভিড়ে ব্যস্ত।সবাই ব্যস্ত কে কাকে ডিঙিয়ে আগে খেতে পারে। গাড়ি থেকে নেমে আমি এত মানুষ দেখেই খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম।এত মানুষ আমি আগে কখনো দেখিনি।

এমনিতে মানুষ হিসেবে আমি ঘরকুনো।সবসময় বাড়িতে নিজের রুমের মধ্যে থাকতাম আর বইয়ের মাঝে মুখ গুজে থাকতাম।এর জন্য অবশ্য ফিরোজা বেগমের কাছ থেকে আমায় ফকিন্নির মেয়ের উপাধিও পেতে হয়েছে।সে যাকগে পুরনো কথা।আমি বরং এখন ঘুরতে আসার সময়টা উপভোগ করি।

ডাক্তার সাহেব তার গাড়ি হেফাজতে রাখার ব্যবস্থা করে আমার কাছে এসে দাড়ালেন।তারপর কিছুক্ষণ আমার পাশে দাড়িয়ে আশেপাশে চোখ ফিরিয়ে কিছু একটা দেখলেন।তারপর ফোন বের করে কাউকে ফোন করে একটু দূরে সরে গেলেন।কিছুক্ষণ পর কথা বলে ফিরে আসলেন।আমি বললাম,
আফরিন: কোথায় গিয়েছিলেন?

‘ আজকাল কি মিসেস আফরিন একটু বেশিই বউগীরি করছে না ‘ ভ্রু নাচিয়ে নাচিয়ে বললেন কথাগুলো ডাক্তার সাহেব।

আফরিন: একটা দুই শব্দের সামান্য প্রশ্ন করলাম আর তার উত্তর না দিয়ে আপনি নয় শব্দের ত্যাড়া প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন আমার দিকে।একটা প্রশ্নের উত্তর কি সোজাসুজি দেওয়া যায় না?

তাহরীম: ওয়েল তবে উত্তরই দেই। উত্তরটা হলো সেটা সারপ্রাইজ….
আমি অবাক হয়ে বললাম,
আফরিন: সারপ্রাইজ!
তাহরীম: হুম সারপ্রাইজ।আপনার যাতে প্রবলেম নাহয় তারই ব্যবস্থা করেছি।
আফরিন: আমার আবার কিসের প্রবলেম?
তাহরীম: সেটা আমি কি করে জানবো?আপনার প্রবলেম তো আপনি জানবেন।
আফরিন: আরে আজব তো।মাত্রই তো বললেন আমার যাতে প্রবলেম নাহয় সেই ব্যবস্থা করেছেন।এখন ব্যবস্থা যখন করেছেন তখন নিশ্চই জানবেন আমার কি প্রবলেম হবে।
তাহরীম: হুস আর একটা কথাও না বাকিটা গিয়ে দেখবেন….আমার ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে কথাগুলো বললেন।

উনার উষ্ণ ছোঁয়া পেতেই আমি চুপসে গেলাম।এই লোকটার পাগলামির কারণে কোনদিন না আমিই পাগল হয়ে যাই।আমি কোনরকম হাত পা গুটিয়ে দাড়িয়ে আছি।উনি উনার হাত সরিয়ে নিতেই আমি বললাম,
আফরীন: ডাক্তার সাহেব তাড়াতাড়ি চলুন।সেই বিকেলে খেয়েছি এরপর আর খাওয়াই হয়নি।খুব খিদে পেয়েছে।
তাহরীম: হুম চলো…

তারপর আমি আর ডাক্তার সাহেব একটা হোটেলে ঢুকলাম।হোটেলটাতে অন্য সব হোটেলের থেকে কম ভিড়।আমি অবাক চোখে তাকিয়ে সব দেখছি। হোটেলের নাম হাজী নান্না বিরিয়ানি।আমি ডাক্তার সাহেব কে আঙ্গুল দিয়ে গুতো দিলাম।উনি আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন বিদ্ধ চাহনি দিয়ে বললেন,
তাহরীম: কি হয়েছে?
আফরিন: সব হোটেল থেকে এই হোটেলে মানুষ এত কম কেন? আমি এই হোটেলের রিভিউ দেখেছি।এটার রিভিউ অনুযায়ী তো এখানে অনেক মানুষ থাকার কথা এই সময়।

আমার কথা শুনে ডাক্তার সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হাসলেন তারপর বললেন,
তাহরীম: এই হোটেল টা আমার বন্ধুর।বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ওকে বলেই হোটেল খালি করিয়েছি।কোনো খেয়াল আছে কয়টা বাজে?এখানে পৌঁছতে পৌঁছতেই রাত এগারোটা বেজে গেছে।

ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে আমার মাথায় যেন বাজ পড়লো।আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
আফরিন: এত রাত হয়ে গেছে?বাড়ি ফিরব কখন? মা তো চিন্তা করবে।
আমার কথা শুনে ডাক্তার সাহেব মুচকি হেসে উনার বাম হাতটা আমার ডান হাতে রেখে হাত মুষ্টি বদ্ধ করলেন।আমি অবাক চোখে উনার দিকে তাকালাম।উনি মুচকি হেসে বললেন,
তাহরীম: আজ সারারাত ঘুরবো বলেই রাতে এসেছি।এখন তাড়াতাড়ি চলো নাহলে আবার হোটেল ফুল হয়ে যাবে।
আমি কথা না বাড়িয়ে আলতো ভেবে মাথা নাড়লাম।উনি আমার হাত ছেড়ে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে।আমি উনি আমার যেই হাতে ধরেছিলেন সেই হাতে আলতো ভাবে হাত ছুঁইয়ে মুচকি হেসে এগিয়ে গেলাম।

~ চলবে ইনশাল্লাহ্

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে