তুমি নামক সপ্তর্ষি মন্ডলের প্রেমে পর্ব – ২ ও ৩

0
2047

#তুমি নামক সপ্তর্ষি মন্ডলের প্রেমে💖
#মিফতা তিমু
#পর্ব-২+৩.

খট করে আওয়াজ হতেই আমার ঘুম উড়ে গেলো।আসলে স্যারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ নাকে তীব্র নিকোটিনের গন্ধ এলো।মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আসছে।আমি নাক বন্ধ করে ফেললাম হাত দিয়ে।সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাহরীম স্যার আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।আমি বিছানা থেকে নেমে উনার দিকে এগিয়ে গেলাম কিন্তু উনি কিছু বলছেন না বলে আমিও নিঃশব্দে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ উনি আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন।আমি ঘাবড়ে গেলাম। শুকনো ঢোক গিলে পিছতে লাগলাম। পিছতে পিছতে একসময় আলমারির দরজায় আমার পিঠ ঠেকে গেল।উনি আমার দুই দিকে হাত বেরিকেট করে দাড়ালেন।আমি বেরও হতে পারছি না।তারপর আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এলেন।আমি ভয়ে চোখ দুটো খিচে বন্ধ করে ফেললাম। হঠাৎ নিজের আশেপাশে উনার উপস্থিতি অনুভবে ব্যর্থ হলাম।চোখ খুলে দেখলাম উনি নেই।উনি হাতে টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকছেন।আমি ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম আলমারির পাশেই আলনা আছে। ওহ শিট উনি টাওয়েল নিচ্ছিলেন আর আমি কি না কি ভাবলাম।ইস আফরিন তোর মনটাও এতক্ষণ ফিরোজা বেগম,অর্ণব আর পাড়ার আন্টিদের খারাপ কথা শুনে শুনে খারাপ হয়ে গেছে।

মিনিট দশেক পর ডাক্তার সাহেব গোসল সেরে বের হলেন।উনি বের হতে হতে ততক্ষণে আমি শাড়ী বদলে নিলাম। শাড়ী বদলে একটা ঢিলেঢালা কুর্তি আর ডিভাইডার পড়েছি।এখন মনে হচ্ছে সস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছি নাহলে এভাবে লং টাইম শাড়িতে থাকা ইজ ইম্পসিবল।

বারান্দায় টাওয়েল মেলে দিয়ে ডাক্তার সাহেব এসে বেডের ডান দিকে শুয়ে পড়লেন।আমি হাতে বালিশ নিয়ে কাচুমাচু মুখে দাড়িয়ে আছি।বুঝতে পারছিনা শুবো নাকি না।আমি শুচ্ছি না দেখে ডাক্তার সাহেব বললেন,
তাহরীম: এখন কি তোমায় ঘুমানোর জন্যও ইনভাইট করতে হবে?

আমি আমতা আমতা করে বললাম,
আফরিন: না মানে আপনি আমার সাথে বেড শেয়ার করবেন?
তাহরীম: তোমায় তো কেউ আর আমার সঙ্গে শুতে বলেনি। তোমায় শুধু বলা হয়েছে ঘুমোতে আমার সঙ্গে। তাছাড়া আমাদের দুজনেরই জানা আছে আমাদের সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে। তাহরীম মেহমাদ তার লিমিট সম্পর্কে ওয়াকিফ তাই সে লিমিট ক্রস করবে না।তুমি নিশ্চিন্তে শুতে পারো। এমনিতেও আমাদের বিয়েটা শুধু দেড় বছরের একটা আগ্রিমেন্ট।

ডাক্তার সাহেবের কথায় আমি চমকে উঠলাম।আমাদের বিয়ে দের বছরের এগ্রিমেন্ট মানে।আমি বললাম,
আফরিন: দেড় বছরের এগ্রিমেন্ট মানে?বিয়ে তো বিয়ে হয়।তার মধ্যে আবার সময় সীমাবদ্ধ করা থাকেনি।

এবার আমার কথা শুনে তাহরীম স্যার উঠে বসলেন আর আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,
তাহরীম: কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ এ থাকে।তোমায় আমি এমনই এমনই বিয়ে করিনি।তুমি সমাজের চাপে পড়ে বিয়ে করেছো আর আমি তোমার এবং আমার সম্মান বাঁচাতে বিয়ে করেছি।তাই শুধু শুধু এই সম্পর্কটা কে সারাজীবন বয়ে বেড়ানোর মানেই হয়না।আমরা তোমার এমবিবিএস শেষ হওয়ার আগ অব্দি এজ এ হাসব্যান্ড ওয়াইফ একসাথে থাকবো তারপর তুমি মুক্ত। এরপর তুমি কি করছো,কি খাচ্ছ, কোথায় যাচ্ছ সেটা তোমার ব্যাপার কিন্তু স্টিল দেট তুমি আমার রেসপনসিবিলিটি আর তোমায় আমার কথা শুনতে হবে।তোমার কোনো আপত্তি আছে?

ডাক্তার সাহেব এর কথা শুনে মনে হচ্ছে কেউ আমার মাথায় পঞ্চাশ কেজির বস্তা চাপিয়ে দিয়েছে।এই অল্প কয়টা কথার খুব গভীর অর্থ।উনার কথাগুলো স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে উনি আমার থেকে মুক্তি চাইছেন,উনি আমার সঙ্গে থাকতে চাননা। অগত্যা আমিও দ্বিমত না করে বললাম,
আফরিন: আমার কোনো আপত্তি নেই…

উনি আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বললেন,
তাহরীম: কিসের ব্যাপারে? না মানে আমার কথা শোনার ব্যাপারে নাকি সেপারেশন এর ব্যাপারে।
আমি কিছুক্ষন উনার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম,
আফরিন: দুটোই…

এবার হঠাৎ উনার চেহারা বদলে গেলো।উনার চেহারায় রাগ ফুটে উঠলো।আমি উনার হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ ধরতে পারলাম না।উনি আমার দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় ‘ শুয়ে পড়ো রাত হয়েছে ‘ বলেই শুয়ে পড়লেন পাশ ফিরে।অগত্যা উপায়ন্তর না পেয়ে আমি স্যারের পাশে বালিশ রেখে খানিকটা চেপে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়লাম।

একসময় শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়েও পড়লাম।ঘুম ভাঙলো সকালের মিষ্টি রোদে।ঘুম ভেংগে নিজেকে ঘুমন্ত ডাক্তার সাহেব এর পাশে আবিষ্কার করলাম।নিজের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি করে কুর্তির জামা নামিয়ে দিলাম কারণ কুর্তি পেট থেকে সরে গিয়েছিল।

আমার নড়াচড়ায় ডাক্তার সাহেব পাশ ফিরে আমার মুখোমুখি আমায় গলায় মুখ রেখে শুলেন।আমার বেশ খানিকটা কাছাকাছি থাকায় পাশ ফিরতেই উনি আমার উপর চলে এলেন।উনার ঠোট আমার গলা ছুঁয়ে যাচ্ছে।উনার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার ঘাড়ে আছড়ে পারছে।আমি উনার হুট করে কাছে আসাটা মেনে নিতে পারছি না তাই আস্তে আস্তে সরে এলাম যার কারণে উনার হাত আমার জামায় থাকায় সেই ছিটকে গিয়ে উনার উপরই পড়লাম।

ঘুম ভেংগে আমায় উনার উপর দেখে ভ্রু কুচকে ডাক্তার সাহেব বললেন,
তাহরীম: আমার ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ নিয়ে কি আমার সুযোগ নিচ্ছিলেন মিসেস মেহমাদ?

উনার কথা শুনে উনার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালাম আমি।এমন একটা পরিস্থিতি তে উনার মুখ থেকে এরকম একটা কথা আসা করিনি।আমি উনার উপর থেকে তড়িৎ গতিতে সরে গিয়ে বললাম,
আফরিন: আসলে আপনি গড়াগড়ি খেতে খেতে আমার কাছে চলে এসেছিলেন তাই আপনার কাছ থেকে সরতে গিয়েই টাল সামলাতে না পেরে আপনার উপর পরে গেছিলাম।

আমার কথায় ডাক্তার সাহেব আর কিছু বললেন না। নির্লিপ্ত ভাবে উঠে বিছানা ছাড়লেন।অতঃপর আলমারি থেকে জামা কাপড় নিয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন।যেতে যেতে কি মনে করে আবার আমার দিকে ফিরে এলেন আর বিছানা থেকে আমার ওড়না উঠিয়ে আমার গায়ে পেঁচিয়ে দিয়ে বললেন,
তাহরীম: হয়তো আমরা নামে স্বামী স্ত্রী তবে প্রকৃত অর্থে নই তাই ওড়না ছাড়া আপনাকে দেখার অধিকার আমার নেই মিসেস মেহমাদ। এন্ড ওয়ান থিং আমাদের বিয়ের কথা যেন কলেজে জানাজানি না হয়।আমি চাই না কিছুতেই কেউ আমাদের বিয়ের কথা জানুক বলেই উনি আর এক মিনিটও সেখানে না দাড়িয়ে বাথরুমে চলে গেলেন।

উনার প্রথমের কথাগুলো শুনে যতটা না ভালো লাগছিলো পরের কথা শুনে ঠিক ততটাই খারাপ লাগছে।উনি তবে চাননা আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কাউকে জানাতে।হয়তো আমাদের বিয়ের মেয়াদ সবে দেড় বছর বলে। দেড় বছর তো দেখতে দেখতে কেটে যাবে তাই হয়তো কলেজে হাসির খোরাক হতে চাননা।

সব আজেবাজে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বিছানার সঙ্গে সঙ্গে ঘর গুছিয়ে নিলাম অতঃপর নিজের জামা কাপড় বের করে ফেললাম।একটা কলাপাতা রঙের শাড়ী বের করলাম।

স্যার এখনো বাথরুমে গোসল করতে ব্যস্ত আর আমারও এখন আর কোনো কাজ নেই দেখে বারান্দায় এসে দাড়ালাম। শীতের সকালে হালকা রোদ পোহাতেও খুব ভালো লাগে।আমি চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে বেতের সোফায় বসলাম।আমার চুল বলতে গেলে মোটামুটি লম্বা তাই সোফায় বসাতে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।কিছুক্ষণ পর শুনলাম ঘর থেকে দাড়িয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাক্তার সাহেব বলছেন,
তাহরীম: এই যে রানী ভিক্টোরিয়া এভাবে যে চুল ছেড়ে দিয়ে রোদ পোহাচ্ছেন খেয়াল আছে যে চুলে পিপঁড়া উঠছে? এরপর তো মাথায় উকুনের পরিবর্তে পিপঁড়া দেখতে পাবো যেটা রাতের বেলা বেরিয়ে এসে আমায় কামড়াবে কারণ আমি আপনার সঙ্গেই ঘুমোই।

ডাক্তার সাহেবের কথায় আমি কিছু বলার অবকাশই পেলাম না। সিরিয়াসলী! মাথায় উকুনের পরিবর্তে পিপঁড়া! ইয়াক ছিঃ….

বিয়ের পরেরদিনই নিজের স্বামী কে পরনারীর সঙ্গে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় দেখবো ভাবতেই পারিনি। গোসলে গিয়েছিলাম বাথরুমে কিন্তু বেরোতে বেরোতে দেখি আমারই ঘরে দাড়িয়ে এক অজ্ঞাত নারী আমার তাহরীম স্যার কে জড়িয়ে ধরে আছে।এরকম একটা দৃশ্য দেখার পর নিজেকে সামলানোর অনেকটা কষ্ট সাধ্য ব্যাপার। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

আমি খানিকক্ষণ দাড়িয়ে থেকে বললাম,
আফরিন: এক্সকিউজ মি….
আমার আওয়াজ পেতেই দুজনে ছিটকে সরে গেলো। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে মিষ্টি হেসে বললো,
মেয়েটা: ওহ ভাবি….আমি হলাম তোমার আদরের ননদিনী নিহারিকা নিহা।তুমি আমায় ভালোবেসে নিহাও বলতে পারো।তাহসান ভাই আর তাহরীম ভাইয়ের একমাত্র ছোটবোন।

নিহার কথা শুনে এবার মাথাটা দেওয়ালে বারি দিয়ে ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। সিরিয়াসলী!ভাই বোনের সম্পর্ককে কিনা আমি প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক বানিয়ে দিলাম। আফরিন তুই বড্ড কলুষিত হয়ে গেছিস।তোর চিন্তাধারা পাল্টানো উচিত।

আমি কথা বলছি না দেখে নিহা আমার সামনে তুরি বাজিয়ে বললো,
নিহা: কোথায় হারিয়ে গেলে ভাবী? আমি আর ভাই তো এখানে আছি তাহলে তুমি কার কথা ভাবছো এত?

‘ উনার আবার ভাবার জন্য কারোর উপস্থিতি লাগে নাকি।উনি তো কেউ পৃথিবীতে না থাকলেও তাকে নিয়ে ভাবতে পারবে। ‘ কথাগুলো খানিকটা বিরবিরিয়ে বললেন ডাক্তার সাহেব।

উনি বিড়বিড় করে বললেও কথাগুলো আমার কানে ঠিকই এলো।আমি উনার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালাম কিন্তু আমার বিরক্তি সূচক ভাব কে উনি বিশেষ পাত্তা দিলেন না। আমায় এড়িয়ে বললেন,
তাহরীম: নিহা তোর ভাবী কে বলে দে আজ বিয়ের প্রথম দিন বলে বাবা বা মা কেউই ওকে কলেজ যেতে দিবেনা ।তারমানে এই না যে ও ঘরে বসে বসে ঘোড়ার ঘাস কাটবে।আমি সব সাবজেক্টের কিছু রিসেন্ট টপিক মার্ক করে দিয়েছি তাই ওগুলো যেন পরে নেয়।আমি সন্ধ্যায় ফিরেই পড়া ধরবো।

এবার তাহরীমের কথা শুনে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো নিহা।ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে বললো,
নিহা: উফফ সবেমাত্র কাল বিয়ে হয়েছে তোমাদের আর তুমি আজই হসপিটাল চলে যাচ্ছ। তাও যদি তুমি একা কাজ করতে তাহলে তো ভালই হতো।তুমি তো ভাবী কেও পড়তে বসিয়ে দিচ্ছিলে।এখন মনে হচ্ছে দুই পড়ুয়া কে একসঙ্গে বিয়ে দিয়ে ভুল করেছি।

তাহরীম: বেশি কথা না বলে যা বলেছি তাই কর আর নিচে খেতে আয় বলেই উনি বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।উনার পিছন পিছন আমি আর নিহাও এলাম।ডাইনিং রুমে যেতেই দেখলাম খাওয়ার টেবিল ভরে উঠেছে বাহারি খাবারে।টেবিলের এক পাশ রিমা ভাবী আর তাহসান ভাইয়া।আরেক পাশে মা আর বাবা এবং বাবার পাশের চেয়ার খালি।আর আরেক পাশে আরও দুটো চেয়ার। নিহা গিয়ে বাবার পাশের চেয়ারে বসলো আর ডাক্তার সাহেব গিয়ে বাকি খালি দুটো চেয়ারের একটা তে বসলেন।অগত্যা উনার পাশে খালি থাকা চেয়ারে আমিও বসলাম।

সবাই খাওয়া শুরু করতেই আমিও রুটি আর ভাজি নিলাম।তারপর খেতে শুরু করলাম।বাবা খেতে খেতে তাহরীম স্যার কে বললেন,
বাবা: তা তাহরীম বিয়ে তো করলে এখন রিসেপশন করবে না? রিসেপশন তো করা দরকার।
বাবার কথা শুনে স্যার নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে খেতে খেতে বললেন,
তাহরীম: বিয়ে করেছি এটাই তো বেশি আবার অনুষ্ঠান করার কি আছে?বাবা আমি এখন কাউকে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে জানাতে চাচ্ছি না।

ডাক্তার সাহেব এর কথা শুনে এবার সকলে অবাক চোখে উনার দিকে তাকাল।তাহসান ভাইয়া বললেন,
তাহসান: জানাতে চাচ্ছিস না মানে?
তাহরীম: চাচ্ছি না মানে চাচ্ছি না। আফরিন এর এখন এমবিবিএস বাকি আছে আর ওর ফুল লাইফ পরে আছে।এখনই সবাই কে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে জানিয়ে আসান এর এবিলিটির উপর প্রশ্ন তুলতে চাচ্ছি না।এতে করে ও যদি ভালো রেজাল্ট করে এমবিবিএস শেষও করে তবুও ওর দক্ষতার উপর প্রশ্ন উঠবে।লাইফে তো পড়েই আছে।বিয়ের অনুষ্ঠান আর দেড় বছর পরে করলে কিইবা হবে…বলেই উনি খাওয়ায় মন দিলেন।

সকলে উনার কথায় গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন।উনি আমার পড়াশুনার কথা বললেও আমি জানি সেটা শুধুমাত্র একটা অজুহাত বৈকি আর কিছু নয়।তারপর সকলে আবার খাওয়ায় মন দিল।খাওয়া শেষে তাহরীম স্যার উঠে গিয়ে হাত ধুতে ধুতে বলেন,
তাহরীম: মা আমার আজ আসতে দেরি হবে।এক দিনের ছুটি নিয়েছিলাম যেটার প্রেসার পড়বে আজ।তাই আর ওয়েট করো না।
স্যারের কথার জবাবে মা কিছু বললেন না। স্যারও আর কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন।

আমি খাওয়া শেষ করে রান্নাঘরে গিয়ে সব এটো থালাবাসন ধুচ্ছিলাম কারণ মা আর ভাবি ডাইনিং টেবিল গুছাচ্ছেন।মা রান্নাঘরে এসে আমায় থালাবাসন ধুতে দেখে বলেন,
মা: রিমা তাহরীমের বউ কে বলে দাও তার বর যা বলেছে তাই যেন করে, সে যেন তার পড়াশুনায় মন দেয়। সংসার করার জন্য পুরো জীবন পড়ে আছে।
আমি আরেকটা লাস্ট প্লেট ধুতে ধুতে বললাম,
আফরিন: মা শুধু পড়াশুনা,খাওয়া দাওয়া আর ঘুম দিলে তো মোটা হয়ে যাবো।তখন সবাই দেড় বছর পর এটাই বলবে যে তাহরীম মেহমাদের বউ মোটা।তাই একটু আধটু কাজ করলে ক্ষতি নেই।

আমার কথার প্রতি উত্তরে মা কিছু বললেন না।আমি থালাবাসন ধুয়ে হাত টা কিচেন টিসু দিয়ে মুছে বেরিয়ে এলাম। হাঁটা দিলাম আমার ঘরের দিকে।ঘরে ঢুকতে ঢুকতে খেয়াল করলাম ডাক্তার সাহেবের ঘরের পাশে আরেকটা ঘর আছে।আমি সেই ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম।

ঘরের দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই চোখ আমার কপালে উঠে গেলো।পুরো ঘর জুড়ে শুধু বই আর বই।বাবা এত বই….ডাক্তার সাহেব মনে হয় বই পড়তে অনেক পছন্দ করেন। তারমানে এটা উনার স্টাডি রুম।আমি ঘুরে ঘুরে পুরো স্টাডি রুম দেখতে লাগলাম। স্টাডি রুমটা অনেকটা একটা লাইব্রেরির মত করে সাজানো। হঠাৎ দেখতে দেখতে একটা বইয়ের তাকে আমার চোখ আটকে গেলো।বইটার নাম ‘ দা জার্নি অফ অ্যাডভেঞ্চার ‘।

এতগুলো বড় বড় বইয়ের ভিড়ে একটা ছোটো বই দেখে আমি অবাক হলাম।এগিয়ে গিয়ে বইটা হাতে নিলাম। বইটা হাতে নিতেই বইয়ের তাকগুলো আওয়াজ করে মাঝ থেকে দুই ভাগ হয়ে পাশে সরে গেলো।

বইয়ের তাক সরে যেতেই এই স্টাডি রুমেই আমি আরেকটা ঘর আবিষ্কার করলাম।একটা ঘরের ভিতর আরেকটা ঘর।কিন্তু একটা রুম কে এভাবে লুকিয়ে রাখার মানে কি? ডাক্তার সাহেবের কী এমন অমূল্য সম্পদ আছে যা উনি এই ঘরে বইয়ের তাকের পিছনের ঘরটা তে লুকিয়ে রেখেছেন।উম্ম ব্যপারটা দেখতে হবে ভেবেই আমি আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে ঘর টাতে ঢুকলাম। ঘরে ঢুকতেই কেউ যেন আমার হাত চেপে ধরলো।

আমার যেন আত্মারাম খাঁচছাড়া হওয়ার জোগাড়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম তাহরীম স্যার থুক্কু ডাক্তার সাহেব আমার দিকে অগ্নি বর্ষিত চোখে তাকিয়ে আছেন।মনে হচ্ছে এখনই উনার এই চোখ দিয়ে জ্বালিয়ে দেবেন।আমার দিকে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বললেন,
তাহরীম: তোমার এই ঘরে আসার সাহস কি করে হলো? কারোর ঘরে ঢুকতে হলে যে তার পারমিশন লাগে জানোনা?

উনার কথায় আমি ধীর গলায় খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,
আফরিন: না আসলে স্টাডি রুমে এসেছিলাম। হঠাৎ একটা বই চোখে পড়লো আর ওটা হাতে নিতেই এই ঘরটা খুলে গেলো বলেই আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম তবে ডাক্তার সাহেব আমার হাত ছেড়ে উনার দুই হাত দিয়ে আমার মুখটা ধরে উনার মুখোমুখি দাড় করালেন যাতে আশেপাশে কিছু না দেখতে পারি আর ধীর গলায় বললেন,
তাহরীম: আজ যেটা করেছ সেটা যেন দ্বিতীয়বার না হয়। আইন্দা আমার ব্যাপারে নাক গলানোর চেষ্টা করবে না।আমার ওয়াইফ তুমি শুধু নামে কাজে নও।এখন এই ঘর থেকে যাও।

ডাক্তার সাহেবের কথাগুলো যেন মনে গভীর দাগ কেটে গেলো।একদিকে এই ঘরে কি আছে সেই চিন্তা আরেক দিকে উনার অপমান মূলক কথাবার্তা।দুটোই যেন একসঙ্গে মিলে জ্বালিয়ে খাচ্ছে।চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগ মুহূর্তে হনহন করে বেরিয়ে গেলাম নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে।

~ চলবে ইনশাল্লাহ

#তুমি_নামক_সপ্তর্ষি_মন্ডলের_প্রেমে💖
#মিফতা_তিমু
৩.

মেন রোডের ধার ঘেঁষে খুব সতর্ক ভাবে স্কুটি নিয়ে আগাচ্ছি।একটু চোখ এদিক ওদিক হলেই অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে আর বাপি যদি জানতে পারে অ্যাকসিডেন্ট করেছি তাহলে হাত পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে দিবে তাই গাধার স্পিডে স্কুটি নিয়ে এগোচ্ছি। এমনিতেই একটু আগে অ্যাকসিডেন্ট করতে নিয়েছিলাম কিন্তু আল্লাহর রহমতে বেচেঁ গেছি।হঠাৎ স্কুটির সামনে একটা লোক এসে দাড়ালো।আমি সাথে সাথে ব্রেক কষলাম।

সামনে হুট করে দাড়ানো তে রেগে গেলাম।আরেকটু হলেই অ্যাকসিডেন্ট হতো।তাই রেগে গিয়ে সামনে দাড়িয়ে থাকা লোকটা কে দেখলাম। লোকটা কে দেখে আমি নিজেই আতকে উঠলাম। একি এতো একেবারে Mud Man দাড়িয়ে আছে আমার সামনে।চোখে মুখে কাদা মাখানো আর গায়ের সুন্দর সাদা শার্টটাও কাদায় ভরে গেছে।আমি লোকটার দিকে তাকাতেই দেখলাম লোকটা আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে যেন কোনো মানুষ নয় ভুত দেখেছে,এক প্রকার চমকে উঠেছে লোকটা।

আমি বুঝতে পারলাম আমার কপালে শনি আছে কারণ এই লোকটাই সেই লোকটা যার গায়ে একটু আগে অ্যাকসিডেন্ট করতে গিয়ে কাদা ছিটিয়েছি আর কথা শুনার ভয় তাড়াতাড়ি করে পগার পার হয়েছি।লোকটা কে কিছু বলার উদ্দেশ্যে গলা ঝেড়ে কাশলাম তারপর বললাম,
আফরিন: কিছু বলবেন ভাইয়া?

আমার ডাকে লোকটা একটু অপ্রস্তুত হলো।আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে কোমরে হাত দিয়ে মেয়েদের স্টাইলে দাড়ালো।আমি লোকটার হাবভাব দেখছি।লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করে নিজেকে ইসারা করে বললো,
লোকটা: এসব কি করেছেন মিস?

লোকটার গম্ভীর গলা শুনে ভয় পেয়ে গেলাম। হায়রে কি রাক্ষসের মত গলা।আমি আমতা আমতা করে বললাম,
আফরিন: না মানে ভাইয়া সরি…আমায় ক্ষমা করে দিন।
লোকটা:আপনার ক্ষমা দিয়ে আমি এখন কি করবো?আপনি ক্ষমা চাইলেই কি আমার মুখের উপর থাকা কাদা চলে যাবে?আর যেটা পারেন না সেটা চালান কেন?

আফরিন: আসলে আমার মামু বলেছে স্কুটি একদম কেয়ারফুলি চালাতে যেন অ্যাকসিডেন্ট নাহয়। অ্যাকসিডেন্ট হলে আমার হাত পা ভেঙে লেংড়া বানিয়ে ঘরে বসিয়ে দিবে আর আপনি তো বুঝতেই পারছেন আমায় লেংড়া বানিয়ে দিলে কেউ আর আমায় বিয়ে করবে না।

আমার কথা শুনে লোকটা আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালো।আমি উনার এমন চাহনি দেখে বললাম,
আফরিন:কিন্তু চিন্তা করবেন না আপনার যা ক্ষতি করেছি তা আমি কম্পেনসেট করবো।আমি আপনাকে আপনার নষ্ট হয়ে যাওয়া জামা কাপড়ের টাকা দিচ্ছি,আপনি শার্ট প্যান্ট কিনে নিবেন।
এবার লোকটা আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ কপালে আঙ্গুল ঘষলো তারপর বললো,
লোকটা: আপনার কি আমাকে গরীব মনে হয় যে সামান্য জামা কাপড়ের জন্য টাকা নিবো আপনার থেকে?আপনি আমাকে,তাহরীম মেহমাদ কে টাকা দেখাচ্ছেন?আপনি যে আমার সময় নষ্ট করলেন এখন এই সময় কি করে ফেরত পাবো? গাড়ী নষ্ট হয়েছে বলে হেলপের জন্য বেড়িয়েছিলাম কিন্তু এখন মনে হচ্ছে গাড়ি থেকে বের হওয়াই আমার ভুল হয়েছে।

উনার কথা শুনে আমি কিছুক্ষন মনে মনে ছক কষলাম তারপর বললাম,
আফরিন: দেন আমি আপনাকে ড্রপ করে দেই?আপনি শুধু আমায় অ্যাড্রেস বলুন..
উনি আমার দিকে তাকিয়ে সন্দিহান গলায় বললেন,
তাহরীম:আপনি একজন পরপুরুষ এর সঙ্গে স্কুটি শেয়ার করবেন?আপনার ভয় করছে না?
আমি ভ্রু উল্টিয়ে না বোঝার ভান করে বললাম,
আফরিন: ভয় পাওয়ার কি আছে?এই মানুষ ভর্তি জায়গায় আপনি আমার কি ক্ষতি করবেন আর করার হলে তো আগেই করতেন। তাছাড়া আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে না আপনি অভদ্র মানুষ।

আমার কথা শুনে তাহরীম আমার পিছনে স্কুটি তে উঠতে উঠতে বললেন,
তাহরীম:বিশ্বাস…বিশ্বাস জিনিসটা এত সহজে কাউকে দিতে নেই।কে জানে কেউ আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারে কিনা।

উনার কথা শুনে মাথাটা ঝিম ধরে উঠলো।চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা ছেলে আর মেয়ের দৃশ্য।সেখানে ছেলেটাও মেয়েটা কে এভাবেই বলছে।ছেলে আর মেয়ে দুজনের একজনকেও চিনতে পারলাম না।শুধু দেখলাম মেয়েটার পরণে স্কুল ড্রেস আর চুলে দুই লম্বা বিনুনি করা।

উনার ডাকে সম্বিত ফিরল।কথা না বাড়িয়ে স্কুটি স্টার্ট দিলাম।উনি আমায় হাত দেখিয়ে দেখিয়ে রাস্তা দেখাতে লাগলেন।একসময় আমরা ওনার গন্তব্যে এসে পৌছালাম কিন্তু উনার গন্তব্য স্থল দেখে অবাক হলাম।আরে এটা তো আমারই মেডিক্যাল কলেজ যেখানে আমি থার্ড ইয়ারে ট্রান্সফার অ্যাডমিশন নিয়েছি কানাডা থেকে।

এটা তো আমারই কলেজ বলতে বলতে পিছনে ঘুরলাম কিন্তু একি উনি তো আমার পিছনে নেই। আশেপাশে তাকালাম তবুও উনাকে পেলাম না।সব স্টুডেন্টই আমার দিকে অদ্ভুত ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে আছে।হয়তো আমার সঙ্গে Mud Man কে দেখে অবাক হয়েছে। যাহ লোকটা চলে গেলো।মানুষ এত অকৃতজ্ঞ কেন?একটা thank you ও বললো না। ও বলবে কেন?উনার এই অবস্থা তো আমার কারণেই হয়েছে।আমি উনার ক্ষতি করেছি আবার আমিই উনাকে লিফট দিয়েছি তাই হয়তো শোধবোধ শেষে চলে গেছেন। যাই হোক ক্লাসে যাওয়া দরকার।

স্কুটি পার্ক করে ক্লাসের দিকে হাঁটা দিলাম।লোকটার নাম তাহরীম বলেছিলো।যাক আনকমন নাম, সুন্দরও বটে।ক্লাসের দিকে হাঁটা দিলাম তখনি শুনলাম কেউ একজন আমায় ডাকছে ‘ আর্তুগুল গাজী ‘ বলে ।আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। ঐ যে বিচ্ছুর দল আমায় আবার এই নামে ডাকছে।এই আর্যালের বাচ্চাকে মন চাচ্ছে লাত্থি দিয়ে উগান্ডায় পাঠাতে।

আমি অ্যাডমিশন নিয়েছি এই কলেজে সবে সাতদিন হয়েছে।আর এই সাতদিনেই আমার বন্ধু হয়ে গেছে আর্যাল, আফ্রা, ফারাহ, ইরহান, ফারহাজ।আমি কোমরে হাত দিয়ে তাহরীম স্টাইলে ওদের সামনে দাঁড়ালাম তারপর বললাম,
আফরিন: তোদের সাহস তো কম না আমার নাম ভেঙ্গাস।আমার নাম জান্নাতুল আফরিন কাজী কতবার বলবো। আফরিন ডাকতে না পারলে ‘AK’ ডাক তাহলেই তো হয়।

আর্যাল: তোকে আর্তুগুল গাজীই ডাকবো। কই শাখ?
আফরিন:আমায় ডাকবি আবার আমায় জিজ্ঞেস করছিস সন্দেহ আছে কিনা?অবশ্যই আছে।আমি এই নাম মানিনা আর মানব না।তোদের কষ্ট হলে ‘AK’ ডাকবি। আর এভাবে ডাকিস না।গুনাহ হতে পারে।
আফরা: ওকে ফাইন গায়েজ ওর কথা শোন।আমাদের তো জানা নেই,যদি মজার ছলে সত্যি সত্যি গুনাহ করে ফেলি তাহলে কি হবে বুঝতে পারছিস?

আফরার কথা শুনে আর্যাল মুচকি হেসে আফরার থুতনি তে হাত রেখে বলল,
আর্যাল:আমার সেনোরিটার কোনো কাজে আপত্তি থাকলে সেই কাজ আমি কিছুতেই করবো না।ভাই আমি তো আর থাকছি না এতে।
ফারহাজ: ফারাহ যদি না থাকে তাহলে আমিও থাকবনা কারণ আমি আবার মনে করি শত্রু কে ফলো করতে হয় নিজে বাঁচতে হলে।
ইরহান: ভাই তোরা সবাই পেরা করে নিয়েছিস। আর্যাল আর আফরা দুটো লাভ বার্ড এবং ফারহাজ, ফারাহ দুই ঘোর শত্রু।কিন্তু মাঝ দিয়ে আমি আর আফরিন দুই পিওর সিঙ্গেল একলা পরে গেছি।আয় আফরিন বেবী আমরা দুটো গলা জড়িয়ে কাদি।

আফরিন: এখন আর গলা জড়িয়ে কাদা যাবেনা।ক্লাসে চল লেট হচ্ছে।
আমার কথায় সকলে সায় দিল আর আমরা ক্লাসে চলে এলাম।ক্লাসে এসেই বুঝতে পারলাম দেট উই আর টু মিনিটস লেট।আমার পিছনে বিচ্ছু গুলো দাড়িয়ে আছে।আমি সামনে দাড়িয়ে খানিক উকি দিয়ে বললাম,
আফরিন: মে আই কাম ইন স্যার?

হুট করে লাফিয়ে উঠে আর্যালের কাছে চলে গেলাম কারণ আমার সামনে এসে হাজির হয়েছে ম্যাজেন্ডা কালারের শার্ট এন্ড ব্ল্যাক জিন্স এ সেই তাহরীম মেহমাদ।লোকটা যে হুট করে সামনে হাজির হবে সেটা ভাবতেই পারিনি।আমি ভয়ে আবোলতাবোল বলতে শুরু করলাম,
আফরিন: কন হো আপ? কাহাসে আয়ে?আপনি কি উড়ে এসেছেন?আপনি কি তাহরীম মেহমাদ হো?

আমার কথায় যেন তাহরীম নামক লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।এরকম বাংলা হিন্দি মিলায় বললে যে কেউ থতমত খাবে আর সেটাই হলো।উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
তাহরীম: একটু পানি দিন তো কেউ।

উনার কথা শুনে ইরহান পানির বোতল এগিয়ে দিলে উনি সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
তাহরীম: আলতু জালালতু আই বালাতু টালতু বলে খেয়ে ফেলুন এক ঢোকে।

উনার কথা শুনে আমি উনার দিকে বড় বড় চোখে তাকালাম আর সেটা দেখে উনি বললেন,
তাহরীম: আমায় দেখে আপনি যেভাবে ভয় পেয়েছেন মনে হচ্ছে কোনো আরশোলা দেখেছেন।আপনি হিন্দি ফারসি উর্দু সব বলতে শুরু করবেন একটু পরে।অলরেডি হিন্দি বাংলা মিক্স করে ফেলেছেন। এরপর আর কিছু বুঝতেই পারব না।

আমি তড়িঘড়ি করে উনার হাত থেকে পানি নিলাম তারপর এক ঢোকে সবটা খেয়ে ইরহানকে খালি বোতল ফেরত দিলাম। ইরহান আমার দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকালো।এরপর তাহরীম আমাদের ইসারা করলেন ভিতরে ঢুকতে।আমরা গিয়ে যে যার যার সিটে মানে আমাদের সিক্রেট সিক্সের নির্দিষ্ট করা পিছনের সিটে বসে পড়লাম।

তাহরীম: সো স্টুডেন্টস তোমাদের আমার আগে যেই প্রফেসর ছিলেন উনি ফর সাম পার্সোনাল ইস্যু ক্লাস নেওয়া বাদ দিয়েছেন অথরিটির সঙ্গে কথা বলে।তাই আজ থেকে আপনাদের ক্লাস আমি নিবো।আমি হলাম নিউরোলজি ডিপার্টমেন্টের হেড ডক্টর তাহরীম মেহমাদ।এখন থেকে মিস লিলির ক্লাস আমিই নিবো। সো নো ফার্দার টক সবাই ক্লাসে মন দিন বলেই উনি বোর্ড এ লিখায় মন দিলেন।

এইদিকে উনি আমাদের সাবজেক্ট টিচার শুনে তো আমার অবস্থা খারাপ। মানে একদিনেই এই অবস্থা উনাকে দেখে তারপর তো ঘুমের মধ্যেও ওনার ভাষাতে আরশোলা দেখার মত করে ভয় পাবো।আমার নসিবই খারাপ নাহলে একটা মানুষের সঙ্গে দিনে তিনবার দেখা হয় নাকি কারোর?

এসব জল্পনা কল্পনা করতে করতেই তাহরীম স্যার যে আমায় ডাকছেন সেটা শুনতেই পেলাম না। ফলশ্রুতিতে যা হবার তাই হলো। তাহরীম স্যার রাগ করে আমার দিকে মার্কার পেন ছুড়ে মারলেন আর উনার মার্কারের বারি খেয়ে আমার কপালের সাইডে ফুলে গেলো।আমি উঃ করে কপাল ডলতে ডলতে সামনের দিকে তাকালাম আর আমার চোখ পড়ল স্যারের দিকে।উনি গরম চোখে তাকিয়ে আছেন।আমায় উনার দিকে তাকাতে দেখে বললেন,
তাহরীম:ইউ স্ট্যান্ড আপ…. হোয়াটস ইউর নেম?

আমি উঠে দাড়িয়ে আশেপাশে তাকালাম অতঃপর উনাকে বললাম,
আফরিন: স্যার আপনি কি আমায় বললেন?
উনি আমার দিকে তাকিয়ে এবার ভ্রু নাচিয়ে নাচিয়ে বললেন,
তাহরীম: এখানে কি আপনি ছাড়া আর কেউ কল্পনা করতে ব্যস্ত?আমার তো মনে হয়না।আপনি এতটাই ব্যস্ত আপনার কল্পনার জগতে যে আমি যে দুই তিনবার ডাক দিলাম সেটা শুনলেনই না।কি এত ভাবছিলেন?

উনার কথা শুনে আমি মিইয়ে গেলাম।কি বলবো উনাকে যে আমি উনার কথাই ভাবছিলাম।কিছু বলার মত না পেয়ে বললাম,
আফরিন: সরি স্যার আর হবে না।
তাহরীম: নো নো নো… তাহরীমের কাছে সরির কোনো মূল্য নেই।এর জন্য তো আপনাকে শাস্তি পেতে হবে মিস…

আফরিন: জান্নাতুল আফরিন কাজী….
তাহরীম: ওহ ইয়েস আফনান। সো আফরিন আপনার শাস্তি হলো আপনি আর এখন থেকে সিক্রেট সিক্সের সঙ্গে বসতে পারবেন না যেটা আপনার ফ্রেন্ড সার্কেল।
স্যারের কথায় আমি অবাক হয়ে বললাম,
আফরিন: তাহলে আমি কোথায় বসবো স্যার?
তাহরীম: কেন জায়গার কি অভাব পড়েছে?আপনি এখন থেকে এখানে সামনের সিটে বসবেন….একদম আমার চোখের সামনে যাতে আমি চাইলেই আপনাকে দেখতে পারি।

স্যারের কথায় আমার মাথায় যেন বাজ পড়লো।আমি এখন আমার বন্ধুদের ছেরে ওই অপরিচিত স্টুডেন্টদের মধ্যে গিয়ে বসবো? ও গড স্যার তো আমার জন্য বিপদ ডেকে এনেছেন।একেবারেই প্রফেসরদের মত খারুস।এই খারুস লোকটা নাকি আবার ডাক্তার। সাহেবদের মত চলাফেরা করে নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিচ্ছে।আমার জানা আছে কেমন ডাক্তার। ডাক্তার সাহেব তো তাই এত ভাব দেখায়… হুহ….

অতীতের স্মৃতিচারণ ছেড়ে বেরিয়ে এলাম আমি।ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম দেখাটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত।ভাবিনি যেই মানুষটার সঙ্গে একরকম সাপে নেউলে সম্পর্ক আজ তাকেই স্বামী হিসেবে মেনে নিতে হবে।

ডাক্তার সাহেব প্রথম দিন থেকেই কেমন চোখে চোখে রাখেন।ক্লাসে এসে সবার আগে আমায় পড়া ধরেন আর পড়া না পারলে ক্লাস থেকে বের করে দেন কিংবা এসাইনমেন্ট দিয়ে দেন।আবার বন্ধুদের সঙ্গেও তেমনভাবে আড্ডা দিতে দেন না।পুরোই অদ্ভুত কিসামের একটা মানুষ।এমন ভাব করেন যেন আমার গার্ডিয়ান উনি।

যাই হোক এখন উনার চিন্তা করলে লাভ নেই।উনার চিন্তা করে তো আর পড়া হবে না।আর পড়া নাহলে আবার শাস্তি শুরু।আগে তো কলেজেই আমার জীবন দুর্বিষহ করে তুলতেন এখন ঘরে পেয়েছেন।আল্লাহ জানে আমার মত অসহায় অবলা বউ পেয়ে কিই না করেন।

রাজ্যের যত চিন্তা ভাবনা আছে সব বাদ দিয়ে পড়াশুনায় মন দিলাম।কিন্তু এবার হলো আরেক ঝামেলা।যেই পড়ায় একটু মনটা বসেছিল ওমনি আবার ফোনের কারণে ডিস্ট্রাক্ট হয়ে গেলাম।ফোন টা হুট করে বেজে উঠলো।

ফোন তুলে দেখলাম অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এসেছে।আমি চেয়ার টেবিল ছেড়ে উঠে জানালার কাছে গেলাম তারপর জানালা খুলে দিয়ে ফোনটা রিসিভ করলাম।ওই পাশ থেকে কেউ একজন বলল,
অপরিচিত: হ্যালো মিস জান্নাতুল আফরিন কাজী কে কি পাওয়া যাবে?
আফরিন: জি আমিই জান্নাতুল আফরিন কাজী।কিছু বলবেন?
অপরিচিত: জী আমি আপনার কলেজ অথরিটির ম্যানেজিং ডিপার্টমেন্ট থেকে বলছি।কিছুদিন আগে আপনি ফোর্থ ইয়ারের ফাইনাল সেমেস্ট্রি দিয়েছিলেন সেটাতে আপনি ভালো ভাবেই পাস করেছেন সেই সঙ্গে ভালো রেজাল্টও করেছেন।আমাদের কলেজের নিয়ম মতো ফোর্থ ইয়ার ফাইনাল সেমিস্টার এর পর টপ স্টুডেন্ট কে একজন ডক্টরের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে সিলেক্ট করা হয় আর আপনাকেও সিলেক্ট করা হয়েছে।যেহেতু আপনি ফোর্থ ইয়ারে সব স্টুডেন্টদের মধ্যে রেকর্ড মার্কস পেয়ে টপ করেছেন তাই আপনাকে ডক্টর ফারহান ইমতিয়াজ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে সিলেক্ট করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।

লোকটার কথা শুনে আমার মনে হলো আমার দুনিয়া এক মিনিটের জন্য থমকে গেছে।এত বড় একজন ডক্টরের অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়া আমার ক্যারিয়ারে অনেক বড় অ্যাচিভমেন্ট। নিউরোলজি ডিপার্টমেন্ট এর হেড তাহরীম স্যারের পর ফারহান স্যারের জায়গা সবার উপরে।উনার অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে পারা মানে আমার জন্য হাতে চাঁদ পাওয়া।আমি উৎফুল্ল চিত্তে বললাম,
আফরিন: আপনি কি সিওর মানে আমাকেই সিলেক্ট করেছেন উনারা?
অপরিচিত: জি জয়নিং লেটারে তো আপনার নামই লেখা আছে। অথরিটি থেকে বলেছে কালই আপনাকে জয়েন করতে। অলরেডি জয়নিং লেটার আপনাকে পাঠিয়ে দিয়েছি।আর এর জন্য আপনাকে পেও করা হবে।আপনার কাজ শুধু ডক্টর ফারহান কে ওটি তে অ্যাসিস্ট করা আর প্রাক্টিক্যালি সবটা উনার সঙ্গে থেকে এক্সপেরিয়েন্স করা।আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?

আমি কি বলবো ভাষাই খুঁজে পাচ্ছিনা।এরকম একটা সুযোগ তো পাগলেও হাতছাড়া করবে না। প্রাক্টিক্যালি সবটা এক্সপেরিয়েন্স করা একটা হিউজ অপরচুনিটি।তাই আমি কোনরকমের দ্বিমত পোষণ না করেই বললাম,
আফরিন: না আমার কোনো আপত্তি নেই।ডক্টর ফারহান কি জানেন?
অপরিচিত: জি ইনফ্যাক্ট উনি নিজেও বলেছেন এজ এ অ্যাসিস্ট্যান্ট আপনি খুব ভালো পারফর্ম করবেন কারণ উনি পার্সোনালি আপনার ডেডিকেশন এক্সপেরিয়েন্স করেছেন।তাহলে কাল আপনি জয়েন করছেন তাইতো?

আমি হ্যাঁ বলতেই ঐপাশ থেকে লোকটা ফোন কেটে দিলো।আমি আনন্দে কেঁদে দিলাম।এত বড় একটা অ্যাচিভমেন্ট যেন আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।আসলে মানুষ অধিক সুখ হজম করতে পারেনা আর আমারও হয়েছে সেই অবস্থা।আমার হুট করে আবার মনে পড়লো ডাক্তার সাহেবের দিয়ে যাওয়া পড়ার ব্যাপারে।এখন প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে।ডাক্তার সাহেব রাত দশটায় ফিরবেন।এখন যদি না পড়ি তাহলে পড়া শেষ করতে পারবো না আর শেষ করতে না পারলে উনি যে কি করবেন সেটা একমাত্র উনিই জানেন।

আমি তাড়াহুড়ো করে সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পড়তে বসলাম।সব পড়া শেষ করে এতই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে কখন বইয়ের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারলাম।ঘুম ভাঙলো মুখের উপর কারোর উষ্ণ নিশ্বাস আছড়ে পড়তে।আমি চোখ দুটো পিটপিট করে খুললাম কারণ চোখে এখনও ঘুম জড়িয়ে আছে।আর চোখ খুলে যা দেখলাম তাতে সেই আগের মতই ঘাবড়ে গেলাম তবে প্রকাশ করলাম না।

ডাক্তার সাহেব আমার উপর একেবারে ঝুঁকে পড়েছেন।উনি খুব মনযোগ সহকারে আমায় পর্যবেক্ষণ করছেন আর উনি আমার এতটাই কাছে যে আমি উনার নিশ্বাসের শব্দ অব্দি শুনতে পারছি।আমি উনার দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে আছি।আমায় তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি বললেন,
তাহরীম: আমার দিকে তাকিয়ে থাকার কারণ?
আফরিন: ঠিক যেই কারণে আপনি তাকিয়ে আছেন।
তাহরীম: মানে?
আফরিন: আপনি আমায় খুব মনযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছেন তাই আমিও একই কাজটা করলাম।আপনাকে দেখছিলাম আর কি।

এবার আর উনি কথা বাড়ালেন না।আমার দিক থেকে সরে গিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালেন আর বললেন,
তাহরীম: খবর পেয়েছ?
আমি অবাক হয়ে বললাম,
আফরিন: কিসের?
তাহরীম: এটাই যে তুমি টপ করেছ আর কলেজের নিয়ম অনুযায়ী তুমি ফাইনাল ইয়ারে টপ করে উঠেছ বলে তোমায় একজন সিনিয়র ডক্টরের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে সিলেক্ট করা হয়েছে আর সে হলো…

আফরিন: ওহ ফারহান স্যার… দি গ্রেট ডক্টর ফারহান ইমতিয়াজ… মাই ক্রাশ বয়…
আমার কথা শুনে ডাক্তার সাহেবের কি প্রতিক্রিয়া হলো দেখতে পেলাম না।তার আগেই উনি তড়িৎ গতিতে আমার দিকে এগিয়ে এলেন আর আমার দিকে ঝুঁকে বললেন,
তাহরীম: তোমার ক্রাশের কাথায় আগুন… খবরদার ফারহানের সাথে বেশি ঘেঁষাঘেঁষি করবে না আর নেকা মেয়েদের মত বারবার স্যার স্যার করবে না।

এবার আমার ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে এলো।আমি ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে বললাম,
আফরিন: আর ইউ জেলাস ডাক্তার সাহেব?
আমার কথা শুনে এবার ডাক্তার সাহেব খানিকটা দূরে সরে গেলেন আর বললেন,
তাহরীম: ফর ইউর কাইন্ড অফ ইনফরমেশন ইউ আর রং মিসেস মেহমাদ।মিষ্টার মেহমাদ মোটেই জেলাস নয়।আমি শুধু তোমাকে প্রোটেক্ট করতে চাইছি কারণ আমরা যতদিন একসাথে আছি ততদিন আমার দায়িত্ব তোমাকে প্রোটেক্ট করা বলেই উনি আর এক মিনিটও সেখানে দাড়ালেন না।সোজা হনহন করে বেরিয়ে গেলেন

~ চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে