#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ১২
#দিশা_মনি
দীপ্র ও স্নেহাকে মুখোমুখি বসানো হয়েছে। কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শেষে বলে উঠলেন,
‘এবার তুমি কবুল বলো মা।’
স্নেহা একটু সময় নিলো। তারপর তাকালো দীপ্রর দিকে। দীপ্র উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। স্নেহা বলে উঠল,
‘কবুল।’
দীপ্রর এই সময় মনে পড়লো নিপুণের কথা। নিপুণকে দেওয়া তার কথা। সে তো নিপুণকে বলেছিল মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই তাদের আলাদা করতে পারবে না। তাহলে আজ এমন কেন হলো? দীপ্র কিছুতেই পারল না কবুল বলতে। কিছু সময় অপেক্ষা করল। ভাবল নিপুণের কথা। নিপুণের মুখটা ভেসে আসছে তার মনের মাঝে। দীপ্র খুব কষ্ট পাচ্ছে এই মুহুর্তে। সে বুঝতে পারছে না কিভাবে নিজের মনের কথা প্রকাশ করবে। দীপ্রর এখন কিছুতেই এই বিয়েটা করতে ইচ্ছা করছে না। সে উঠে দাঁড়ায়। বলে,
‘আমার পক্ষে এই বিয়ে করা সম্ভব নয়। আমার ক্ষমা করে দেবেন আপনারা।’
দীপ্র চলে যেতে উদ্যত হলেই গ্রামের লোকেরা তাকে ঘিরে ধরে। বলে,
‘এই বিয়েটা না করে তুমি কোথাও যেতে পারবে না। যদি না করো তাহলে তোমাদের দুজনকে পাথর নিক্ষেপ করে মা*রা হবে।’
দীপ্র স্নেহার দিকে তাকায়৷ তার মনে হতে থাকে শুধুমাত্র তার জন্য কেন এই মেয়েটি বিপদে পড়বে। এখন পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, সে আর পিছু হটতে পারবে না। তাই দীপ্র পরিস্থিতির মানে বুঝল। ভাগ্যের কাছে নতি স্বীকার করল। ধীর পায়ে হেটে এসে বসলো স্নেহার পাশে৷ ব্যাথাতুর কণ্ঠে বলল,
‘কবুল।’
তারপর চোখ বন্ধ করে নিপুণের কথা মনে করে ভাবল,
‘কখনো ভাবিনি নিপুণ, তোকে ছাড়া অন্য কারো নামে কবুল বলতে হবে আমায়। তবে আমি তোকে ভালোবাসি। জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তুই আমার মনেই থাকবি। আর এই বিয়েটা শুধুই আমার দায়িত্ব হিসেবে থাকবে। এই মেয়েটা আমি অস্বীকার করতে পারব না। কিন্তু ও শুধুমাত্র আমার কাছে একটা দায়িত্ব ব্যতীত আর কিছুই নয়।’
এদিকে স্নেহা দীপ্রর পানে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
‘আপনার জন্য আমার সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। আপনার বাবা, নিপুণের বাবা-মা সবাই আমার মায়ের সাথে অন্যায় করেছিল। তাদের সেই অন্যায়ের শাস্তি কিছুটা আপনাদের উপরেও তো বর্তায়। মা-বাবার কৃতকর্মের শাস্তি তো তার সন্তানকে পেতে হবে। আপনাদের হয়তো কোন অপরাধ নেই কিন্তু আপনাদের সবথেকে বড় অপরাধ যে আপনারা চৌধুরী পরিবারে জন্ম নিয়েছেন। তবে চিন্তা করবেন না। আমার প্রতিশোধ নেওয়া শেষ হলে আমি সবকিছু ঠিক করে দেবার চেষ্টা করব।’
✨
নিপুণকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিচ্ছে পার্লারের লোকেরা। তাকে ঘিরে ধরেছে তার বন্ধু-বান্ধব এবং কাজিনেরা৷ সবার মুখে হাসি আর ধরে না। নিপুণ নিজেও অনেক খু্শি। নিপুণের এক বান্ধবী বলে,
‘বাহ, নিপুণ। তোকে তো অনেক সুন্দরী লাগছে। দীপ্র ভাইয়া তো আজ তোকে দেখে পাগল হয়ে যাবে।’
নিপুণ বলে,
‘তোরাও না, এমন কথা বলিস যে আমি লজ্জা পেয়ে যাই।’
এমন সময় খোদেজা চৌধুরী, রাহেলা চৌধুরী এবং দিলারা চৌধুরী এসে উপস্থিত হলেন সেখানে। রাহেলা চৌধুরী এগিয়ে এসে বললেন,
‘বাহ, আমাদের মেয়েকে কি সুন্দর লাগছে। কারো নজর না লাগুক।’
দিলারা চৌধুরীর মন মেজাজ এমনিই ভালো নেই। তার মেয়ের সাথে তার কোন যোগাযোগ নেই। তিনি জানেনও না তার মেয়েটা এখন কোথায় আছে, কেমন আছে। এরই মাঝে আবার তার ছেলের বিয়ের দামামা বেজে গেছে। সব মিলিয়ে তিনি বিরক্ত ভীষণ। কিন্তু নিজের স্বামীর সিদ্ধান্তর বিরোধিতা তিনি করেননি। এমনিতেও নিপুণকে নিয়ে তার কোন সমস্যা নেই। নিপুণ যথেষ্ট ভালো মেয়ে। তার সামনেই বেড়ে উঠেছে মেয়েটা, যথেষ্ট সংস্কারী এবং ভালো মনের। নিপুণ যে দীপ্রর যোগ্য এব্যাপারেও কোন সন্দেহ নেই। সবথেকে বড় ব্যাপার দীপ্র নিপুণকে পছন্দ করে। এরপর দিলারা চৌধুরীর আপত্তির কোন কারণ নেই। কিন্তু তার সমস্যা একটাই। তার মেয়েকে নিয়ে চিন্তার কারণেই তিনি মন থেকে এসব মানতে পারছেন না। এরমধ্যে খোদেজা চৌধুরী বলেন,
‘যা হচ্ছে ভালোই তো হচ্ছে। বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই থাকছে। তাই না বলো বড় ভাবি?’
দিলারা চৌধুরী মলিন হাসেন। নিপুণের কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
‘অনেক সুখী হ। আর আমার ছেলেটাকেও সুখে রাখিস।’
✨
স্নেহা ও দীপ্র চুপচাপ বসে আছে। গ্রামবাসীরা তাদেরকে ঘিরে আছে। দীপ্র সকলের উদ্দ্যেশ্য বলে,
‘শান্তি পেয়েছেন তো আপনারা? আপনারা যা চেয়েছেন তাই হয়েছে। এখন আপনারা প্লিজ আমাদের যেতে দিন।’
একজন গ্রামবাসী বলে,
‘ঠিক আছে। তোমরা এখন যেতে পারো। তোমাদের বিবাহিত জীবন সুখের হোক এই দোয়া করি।’
দীপ্র মলিন হেসে বলে,
‘আমার জীবনের সব সুখ কেড়ে নিয়ে এখন আপনারা আমার সুখের জন্য দোয়া করছেন। হাহ, হাস্যকর!’
দীপ্র আর স্নেহা সেখান থেকে রওনা দেয়। স্নেহা বুঝতে পারে দীপ্র এখন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। তাই সে কিছু বলে না৷ কিন্তু হোস্টেলে পৌঁছে স্নেহা দীপ্রর উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘আপনি চাইলে আমি সবটা ভুলে যাব। আপনি আপনার পথে আর আমি আমার..’
স্নেহাকে থামিয়ে দিয়ে দীপ্র বলে,
‘আমি যখন এই বিয়েটা করেছি তখন নিজের দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে আসতে পারি না। তুমি আমার স্ত্রী, আমি কবুল বলে তোমায় বিয়ে করেছি। তাই এখন চাইলেও আমি পিছিয়ে আসতে পারব না।’
‘কিন্তু আপনি তো এই বিয়েটা মন থেকে মেনে নিতে পারেন নি স্যার।’
‘এটা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। তুমি এখন থেকে আমার স্ত্রী। আর আমি একজন স্বামী হিসেবে তোমার প্রতি সব দায়িত্ব পালন করব।’
স্নেহা কিছুটা থেমে বলে,
‘আপনি চিন্তা করবেন না। এই সম্পর্ক আপনাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে না। আমি খুব শীঘ্রই আপনাকে এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি দেব।’
‘এসব নিয়ে পড়ে কথা বলা যাবে। তুমি এখন তৈরি হয়ে নাও। তোমাকে আমার সাথে আমার বাড়িতে যেতে হবে। না জানি ওখানে গিয়ে আমাকে আর কি কি সহ্য করতে হবে।’
স্নেহা মনে মনে বলে,
‘আজ তাহলে আবার আমি চৌধুরী বাড়িতে পা রাখব। মেয়ের অধিকার আমি পাই নি। কিন্তু বউয়ের অধিকার অবশ্যই পাবো।’
স্নেহাকে নিয়ে চৌধুরী বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছে দীপ্র। স্নেহা চৌধুরী বাড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এই সেই চৌধুরী বাড়ি। যেখানে আমার মায়ের সাথে এক বার না। বারংবার অন্যায় হয়েছে। এবার সেই অন্যায়ের উপযুক্ত প্রতিশোধ আমি নেব। আমার মায়ের খু*নিকেও আমি খুঁজে বের করব।’
এদিকে নিপুণ বসেছিল সবার মধ্যমনি হয়ে। অপেক্ষা করছিল দীপ্রর জন্য। এনগেজমেন্টের সময় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দীপ্রর আসার কোন কথা নেই। তাই রাহেলা চৌধুরী আলতাফ চৌধুরীর কাছে গিয়ে বলে,
‘ভাইয়া একটু দীপ্রকে ফোন করে বলুন তো ও কখন আসবে।’
আলতাফ চৌধুরী দীপ্রকে ফোন করতে যাবে এমন সময় দীপ্র চলে এলো। দীপ্রকে আসতে দেখে নিপুণ উঠে দাঁড়ালো। হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। কিন্তু এই হাসি ছিল শৈবালের নীড়ের মতো। দীপ্রর পাশে দাঁড়ানো স্নেহাকে দেখে নিপুণের সব হাসি উবে গেল। তার মনে পড়ল এই মেয়েটাকেই সে সেদিন দীপ্রর অফিসে দেখেছিল। হঠাৎ করেই অজানা আশংকা দানা বাধল মনে। আলতাফ চৌধুরী দীপ্রকে দেখে এগিয়ে গিয়ে বললেন,
‘তোমার আসতে এত দেরি হলো কেন দীপ্র? এসো এনগেজমেন্টের সময় তো হয়ে গেছে।’
দীপ্র একবার করুণ চোখে নিপুণের দিকে তাকায়। অতঃপর স্নেহার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘এই এনগেজমেন্ট হবে না। কারণ আমার বিয়ে হয়েছে। আর ও হলো আমার স্ত্রী।’
দীপ্রর কথায় যেন এখানে উপস্থিত সবার সামনে বাজ পড়ল। নিপুণের পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সে তাকালো দীপ্রর দিকে। পরক্ষণেই দেখল স্নেহাকে। একটা বিকট চিৎকার দিয়ে বলল,
‘এটা হতে পারে না দীপ্র ভাইয়া। তুমি এভাবে আমায় ঠকাতে পারো না।’
বলেই সে হঠাৎ করে মাটিতে বসে পড়লো। পুরো পৃথিবী যেন তার থমকে গেছে। নিপুণের বেঁচে থাকার ইচ্ছা শেষ হয়ে গেল। সে আল্লাহর কাছে নিজের মৃত্যু প্রার্থনা করতেও দ্বিধা করল না৷ কিছুক্ষণের মাঝেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨